6 of 8

সুনীলের সঙ্গে

সুনীলের সঙ্গে

দিনে দিনে কত কী যে হল। বাংলা শতাব্দী পেরিয়ে গেল, ইংরেজি শতাব্দী পেরিয়ে গেল, ‘কৃত্তিবাস’-এর জন্মের পর পঞ্চাশ বছর চলে গেল, অবশেষে সুনীলের বয়সও সত্তর হল। ঠিক ৭০ অবশ্য নয় ছোট্ট ছেলেদের যেমন বলে, তিন পেরিয়ে চারে পড়ল—কিংবা নয় পেরিয়ে দশ। তেমনি সুনীল এই সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে ঊনসত্তর পেরিয়ে সত্তরে পড়ল। আগে অবশ্য একটা ভুল ছিল সুনীলের জন্মসাল কোথাও কোথাও ভুল করে ১৯৩৩ ছাপা হয়েছিল আসল ছিল ১৯৩৪। ১৯৩৩ হলে অবশ্য এ-বছরই সুনীল সত্যি ৭০ পূর্ণ করল।

আমার সঙ্গে সুনীলের বন্ধুত্বের সম্পর্কের আলোচনায় উপরোক্ত তথ্য প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু ভবিষ্যতে কোনওদিন হয়তো বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরা ওই ’৩৩-’৩৪ নিয়ে মাথা ঘামাবেন তাই একটু লিখে রাখলাম।

সুনীলের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫৮ সালের এক মেঘমেদুর সকালে। আমি তখন অজ্ঞাত পরিচয় কবি-যশোপ্রার্থী এক এলেবেলে যুবক। মফস্বলে শিক্ষকতা করি, সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি, পাজামার ওপরে ফুলপ্যান্ট, কাঁধের ঝোলায় জামাকাপড়, টর্চ, সপ্তাহে পাঁচদিন কর্মস্থল হাবড়ার কল্যাণগড়ে থাকি, দু’দিন কলকাতায় কালীঘাটে পুরনো বাসাবাড়িতে পাগল দাদার সঙ্গে। আমি সুনীলের বৃন্দাবন পাল লেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম একটি কবিতা জমা দিতে ‘কৃত্তিবাস’-এ ছাপার জন্যে—সেই সময় যেমন যেতাম নতুন সাহিত্য পরিচয় অগ্রণী কিংবা পূর্বাশার দরবারে।

সেসব জায়গায় অবশ্য খুব বেশি প্রশ্রয় পাইনি, কদাচিৎ দু’একটি কবিতা ছাপানোর সুযোগ পেয়েছি; আমার কোনও পাত্তা পাওয়া হয়নি।

‘কৃত্তিবাস’-এ এসে কিন্তু একেবারে ভিড়ে গেলাম, সুনীলদের বৃন্দাবন পাল লেনের একতলার বাইরের ঘরের তক্তোপোশের ওপর বিছানায় বসে চুটিয়ে তাস খেলছে কয়েকজন যুবক আবার ব্রিজ খেলা হচ্ছে। আমাকে দেখে তারা ভ্রূ-কুঁচকে তাকাল—এই সময়ে একজনের সামায়িক অনুপস্থিতির সুযোগে আমি তার তাসের হাতটা ধরলাম। আমি তাস খেলা জানি বলে এরা বোধহয় একটু খুশি হল। এরা মানে—সুনীল ছাড়া ভাস্কর দত্ত এবং আশুতোষ চতুর্থজনের নাম মনে করতে পারছি না।

আমার অনেক কিছু মনে নেই, থাকার কথাও নয় প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ঘটনা। সুনীলের লেখায় পড়েছি আমি নাকি প্রথম দানেই ‘সেভেন নো ট্রাম্পস’ থেকে তারপর ডবল রিডবল করে এক হাজার ডাউন খেলেছিলাম। বৃন্দাবন পাল লেনের তাস খেলার ইতিহাসে সে নাকি একটা রেকর্ড। সে যাই হোক, সুনীলের সঙ্গে মিশে গেলাম। আড্ডা দিতে দিতে গভীর রাত্রি হয়ে গেলে সুনীল অনেকদিন বাড়িতে না ফিরে আমাদের কালীঘাটের বাড়িতে রাত্রিবাস করেছে। এরও কিছু পরে সুনীলের বাবা তখন মারা গেছেন বৃন্দাবন পাল লেনের পরে শ্যামপুকুর বাড়ি হয়ে সুনীলরা উঠে গেল দমদমে। সে বাড়িতে রাত্রিবাস আমার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সুনীলের মা’র হাতের রান্না আমি যে কত খেয়েছি, কোনওদিনই সে বাড়িতে আমার অন্নের অভাব হয়নি।

সুনীলের থেকে বয়েসে আমি সামান্য ছোট। সেই সুযোগ নিয়ে আমি কখনও কখনও সুনীলকে কটুকথা বলেছি হয়তো দুর্ব্যবহার করেছি, (লিখিতভাবে নয়) কিন্তু সুনীল সেটা গায়ে মাখেনি। অন্যদিকে সুনীল তার পদ্যে, গদ্যে, আত্মজীবনীতে এমনকী একাধিক উপন্যাসে তারাপদ রায় নামে এক প্রায় অসফল, অর্ধখ্যাত ব্যক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু এত কথা এসব আমি কী লিখছি! সুনীল সপক্ষে আমার যা কিছু বলার আমি একদিন যদি সুযোগ পাই এসব কথা সবিস্তারে আমার আত্মজীবনীতে লিখব।

কিন্তু তার কি কোনও প্রয়োজন আছে? ইতিমধ্যেই সুনীল প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। এই তো আজ শুক্রবার ২৯ আগস্ট ২০০৩ আনন্দবাজার পত্রিকা শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠায় সম্পত্তি বিজ্ঞাপনে দেখছি (তৃতীয় কলাম ওপরের দিকে) ‘বোলপুর…ফুলডাঙ্গা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে এক বিঘা দশ কাটা জমি বিক্রয় আছে।’ হয়তো সেই জমি কেনা নিয়ে এতক্ষণ মারামারি-কাটাকাটি শুরু হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *