সুনীতিমালার উপাখ্যান

সুনীতিমালার উপাখ্যান

আমার নাম সুনীতি। বাবা নাম দিয়েছিলেন, সুনীতিমালা। বাবা বলত, শুধু ফুলে তত শোভা নেই, ফুলের সঙ্গে দুটো পাতা থাকলে চোখ জুড়োয়। সুনীতি নামের সঙ্গে মালা যোগ করে বাবা আমাকে ফুলে পাতায় চোখজুড়নো কানজুড়নো করতে চেয়েছিল। বাবা বুঝতে পারেনি, বড়কে ছোট করা আমাদের স্বভাব। সুনীতিমালা থেকে সুনীতি, সুনীতি থেকে সুনু হয়ে যেতে আমার দেরি হল না। কেউ কেউ আবার ‘নিতু’-ও বলত।

আমার বাবার চোখ ছিল আকাশের দিকে, মন ছিল মাটিতে। আকাশ নক্ষত্র নীহারিকাপুঞ্জ ছায়াপথ—এইসব নিয়ে বাবার দেড় বেলা কেটে যেত, বাকি সময়টা ছিল আমাদের জন্যে। আমি আর মায়ের জন্যে, বাবার কিছু বন্ধু-বান্ধবের জন্যে।

বাবা পড়াত আকাশ-রহস্য। ইউনিভার্সিটিতে। বেনারসে। আর বাড়িতে বসে বসে পুরনো সংস্কৃত বইপত্র পড়ত। আমি ও-সবের একবর্ণও বুঝতাম না। মাঝে মাঝে বাবা কালিদাস থেকে শ্লোক আবৃত্তি করত নিজের মনেই।

আমরা ছিলাম ‘ছুট সমাজী’। মানে সমাজ ছাড়া। আমাদের নাকি সমাজের বাইরে রাখা হয়েছিল। আমার মাকে লোকে পাশ কাটিয়ে যেত। বলত, নিচু ঘরের মেয়ে। অথচ আমার মাকে কি সুন্দর দেখতে ছিল। কালো রঙে আভা জ্বলত। যেমন লম্বা তেমন গড়ন। মায়ের মাথার চুল হাঁটু ছুঁয়ে থাকত।

বাবা কম বয়েসেই মারা গেল। আমার তখন পনেরো ষোল বয়েস। মা আমাকে নিয়ে বছরখানেক এলাহাবাদে গিয়ে থাকল, তারপর চলে এল কলকাতায়।

কলকাতায় মা একটা চাকরি পেয়েছিল! মোটামুটি ভাল চাকরি। আমরা লেক গার্ডেন্সের দিকে থাকতাম।

আমার বাইশ বছর বয়েসে মা আমার বিয়ে দিল। কাগজে বিজ্ঞাপন ঘেঁটে ঘেঁটে মা ছেলে বাছত। আমায় দেখাত। বলত, দেখ তো এই ছেলেটা তোর পছন্দ।

সব ছেলেকেই আমার পছন্দ হত। শুধু বেঁটে ছেলে ছাড়া।

মা রাগ করে বলত, তুই কিরে সুনু? যা দেখাই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে দিস। আমার সঙ্গে ঠাট্টা করিস!

মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল ওই রকমই। রগড় আর ঠাট্টায় আমাদের কমতি ছিল না। মা আমায় রগড় করে কিছু বললে অমিও সমান রগড় করে তার জবাব দিতাম।

একদিন মায়ের মাথায় একটা কি দুটো লম্বা লম্বা সাদা চুল দেখে আমি গালে হাত দিয়ে বললাম, ”বাঈ, এবার তুমি বুডডি হয়ে গেলে! আমি কি করব?”

মাকে আমি মাঝে মাঝে তামাশা করে মাই, বাঈ, শকুন্তলাজী—কত কি বলতাম। আমার মায়ের নাম ছিল শকুন্তলা।

মা বলল, ”বুডডি হলাম তো কী হল! আমাকে তোর বিয়ে দিতে হবে নাকি?”

আমি বললাম, ”যদি হয়।” বলে হেসে ফেললাম।

মা আমার পিঠে গুম করে কিল বসিয়ে বলল, ”বড্ড পেকেছিস।”

আমার বিয়ের ছেলে পছন্দর বেলায় আমি সব সময় মাথা হেলাই দেখে মায়ের সন্দেহ হত, বিয়েতে আমি রাজি নই। মাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।

রাত্রে একই ঘরে দু বিছানায় দুজন শুয়ে গল্প করতে করতে মা বলত, ”তোর মতলবটা কী বল তো সুনু? বিয়ে করবি? না করবি না?”

”করব।”

”তাহলে অমন বলিস কেন?”

”আমি বিয়ে করব। আমার ছেলে হবে। তোমার কোলে তুলে দিয়ে আমি আবার আমার বরের কাছে চলে যাব।”

”কী স্বার্থপর! আমি তোর ছেলে মানুষ করব কেন?”

”বারে, তুমি একলা থাকতে পারবে নাকি?”

”বেশ পারব।”

”তাহলে একটা কথা বলি শকুন্তলাজী! ছেলে হলে আমি নেব। মেয়ে হলে তোমায় দেব।”

”পরের জিনিস আমি নেব না।”

”না নিয়ে যাবে কোথায়! তুমি নেবে, নেবে, নেবে।”

মা আর মেয়ের এইরকম তামাশা রগড় থেকে সত্যিই একদিন বিয়ের ফুল ফুটে গেল। কথা পাকা হয়ে গেল। অবশ্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে না, মায়ের অফিসের যে ছোট কর্তা তাঁর দেওয়া সম্বন্ধ ধরে।

মায়ের অফিসের ছোট কর্তা মাকে খুব স্নেহ করতেন। পছন্দ করতেন। তিনি অবাঙালি হয়েও বাঙালির বাড়া। দু পুরুষ কলকাতাতে। নিজের ছোট ছেলের বউ বাঙালি বাড়ির।

 যে আমায় বিয়ে করতে এল তার নাম গগন। আমার চেয়ে বয়েসে পাঁচ বছরের বড়। ছিপছিপে লম্বা চেহারা, শ্যামলা রঙ গায়ের, গালের হাড় সামান্য উঁচু, ঝকঝকে চোখ। গগনের চোখে ঠোঁটে হাসি ছড়ানো!

আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। মায়েরও।

গগনের বিদ্যেবুদ্ধিতে অঙ্ক আর হিসেব। সেখানে আমার বাবার মতন আকাশ-রহস্য নেই। হিসেবে কড়ি গলতে দেয় না। বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী। নামেই শুধু গগন।

আসানসোলের দিকে এক নতুন ফ্যাক্টরির সে অ্যাকাউন্টস অফিসার। কম্পানি তাকে ছোট বাংলো দিয়েছে থাকার, মালি দিয়েছে বাগান দেখাশুনার, দু-চার রকম অ্যালাউন্স।

মায়ের অফিসের ছোট কর্তার ভাইপো, দাদার ছেলে, ফ্যাক্টরির সে ম্যানেজার। ওদের পারিবারিক কিছু টাকা পয়সা ওই কারখানায় খাটছে। উদ্যমটাও তাই বেশি।

গগনকে বিয়ে করে চলে যাবার সময় মা আমাকে আড়ালে এনে বলল, তুই মন খারাপ করিস না, কাঁদিস না। তোর সুখ, তোর হাসিমুখই আমার আজ সব। যতদিন তোর বাবা ছিল ততদিন তোদের জোড়া মুখে হাসি দেখতে দেখতে জীবন কেটেছে। তারপর সে গেল, তুই থাকলি। তোকে সামনে রেখে কাটালাম এতকাল। এখন তুই আমার কাছে থাকছিস না—তবু তোর সুখ আর হাসিটুকু থাকবে, সুনু। আমি একটুও মন খারাপ করব না। কাছেই তো থাকলি। গগনকে নিয়ে আসবি যাবি। আমিও মাঝে মাঝে গিয়ে তোকে দেখে আসব। তোর সুখই আমার সুখ।

মানুষ যেন কেমন! যে মায়ের গায়ের গন্ধ আমার নাকে লেগে থাকত সর্বক্ষণ, নিঃসাড়ে মা ঘরে ঢুকলেও যার শাড়ি আর চুলের গন্ধে আমি বুঝতে পারতাম মা ঘরে এসেছে—গগনের সঙ্গে বিয়ের পর—সেই মায়ের গন্ধ ফিকে হয়ে আসতে লাগল একটু একটু করে। আমার কী দোষ। বিয়ের আগে আমার জীবন ছিল মায়ের সঙ্গে জড়ানো। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো বিশ ঘণ্টা তো মা আর আমি। শোওয়া বসা খাওয়া গল্পগুজব করা সেলাই-ফোঁড়াই সব সময়ে আমার চোখের সামনে মা। আমাদের গায়ে মাখা সাবান, টুথপেস্ট—সেটাও তো একই। সারাক্ষণ মাকে এমন করেই না গায়ের পাশে পেয়েছি। বিয়ের পর কোথায় মা, আর কোথায় আমি। মা কলকাতায় লেক গার্ডেন্স-এর ছোট্ট বাড়িতে একা। আর আমি গোবিন্দনগর বলে একটা জায়গায়, গগনের কাছে, গগনের বাংলোয়। আমার চোখের সামনে গগন। ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরার সময় দেখি গগনের হাত আমার গায়ে। সকালে ঘুম ভাঙলে চোখ মেলতেই দেখি গগন পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। বাইরে তখন ভোরের পাখি ডাকাডাকি শুরু করেছে।

আর কী আমার শুয়ে থাকার হাই তোলার সময় আছে! মায়ের কাছে থাকার সময়—ভোর হল, না সকাল গড়ালো—আমার কিছুই আসত যেত না। কিন্তু এখন যায়। এখন আমি গগনের বউ। এই বাড়ি আমার, সংসার আমার। ঘড়িতে আটটা বাজল কি কারখানার জিপগাড়ি এসে যাবে গগন সাহেবকে নিয়ে যেতে। তার আগে সাহেবকে তৈরি করে দিতে হবে আমায়। সকালের চা থেকে ডিম রুটি, কোনোদিন খানিকটা সুজি, দুধ, পরিজ। গগন দাড়িটাড়ি কামিয়ে তৈরি হতে হতে সাড়ে সাত। তারপর যা করে রুটি ডিম সুজি খেতে শুরু করত তাকে আর খাওয়া বলে না, মুখে গোঁজা বলা যায়। আটটা নাগাদ গগন সাহেব বা সেনগুপ্তসাহেব একতাড়া অফিসের কাগজ ব্রিফকেসে ভরে তার নতুন বউয়ের গালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল।

গগনের ফিরতে ফিরতে বেলা বারোটা। এসে স্নান, খাওয়া, একটু বিশ্রাম, গা গড়াগড়ি, বউয়ের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে বেলা আড়াইটে। আবার জিপ এল। গগনসাহেব চলে গেল অফিসে। ফিরতে প্রায় ছটা। কোনো কোনো দিন সাতটাও বেজে যেত। তারপর গগন আর সুনু। আর এই ছিমছাম ছোট্ট বাংলো-বাড়ি। নদী থেকে বাতাস আসছে দমকে দমকে, বাগানের বড় শিশুগাছের পাতা খসে পড়ছে, মহুয়াগাছের তলায় চাঁদের আলো জাফরি কেটে খেলা করছে আপনমনে, দু-দশটা ফুলের গাছ জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে আছে। নয়ত অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষ চলছে। বাংলোর বাইরের দুটো বাতি যতটুকু আলো ছড়ায় ততটুকু চোখে পড়ে। বাকি অন্ধকার।

গগন আর আমি তখন বসার ঘরে হাত-পা মেলে গল্প করছি। হাসাহাসি। খুনসুটিপনা। গগন ইংরিজি গান চালিয়ে দেয়। আমি বন্ধ করে দিই। আমি বাংলা গান চালালে গগন বন্ধ করে দেয়, বলে—তোমাদের এই নাকি কান্না আর শোনা যায় না। জ্যান্ত গান শোনো। সাবু বার্লি আর চলে না।

এসবই আমাদের দুজনের মধ্যে মজার ঝগড়া। খুনসুটিপনা। ছেলেমানুষের মতন একজন অন্যজনকে চিমটি কাটা। এই গগনই যখন স্নান করতে যায় তখন গলা ছেড়ে গান ধরে যে ছিল আমার স্বপনচারিণী….” কিংবা ‘স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি রেখেছি হৃদয়ে যতনে।’

গগনের গান শুনে আমি হেসে মরি। কারখানার ভোঁ। কোনো গানই দু-চার লাইনের বেশি জানে না।

চোখ মেলার মুহূর্ত থেকে রাত এগারো সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত আমার যে গগনকে নিয়েই কেটে যায়। সে বাড়িতে থাকুক আর অফিসেই থাকুক। দুজন কাজের লোক আমার। একজন ছেলেমানুষ, নাম বিষ্টু। অন্যজন বউ গোছের। ছেলেটা বাড়িতেই থাকে—তার কুঠরিতে, মালির সঙ্গে। বউয়ের নাম নন্দা। সে বিকেল পড়লেই চলে যায়। তবু আমার কত কাজ। শোবার ঘর নিজের হাতে পরিষ্কার করি। গগন যা দস্যিপনা করে, বিছানা বালিশের দিকে তাকানো যায় না সকালে। নিজের হাতেই ঘরটা গুছিয়ে নিই। তারপর অন্য ঘরদোর বউ পরিষ্কার করে, মোছামুছি করে। ছেলেটাকে দিয়ে ঘর গোছাই, বারান্দা সাফসুফ করিয়ে রাখি। রান্না নিজের হাতে করি। বউ কেটেকুটে দেয় সবজি, মাছ। তিনদিন অন্তর ধোপা আসে। রোজই কিছু না কিছু থাকে তার জন্যে। এর ওপর একটা মিঠাইঅলা আসে সাইকেলে চেপে। আজ পানতুয়া, কাল রসগোল্লা, কোনোদিন জোর করে মিহিদানা গছিয়ে দিয়ে যায়। গগন দই খেতে ভালবাসে। তার জন্যে দই পাতার ব্যবস্থা করতে হয়। বউ আমাকে দই পাতা শিখিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কেউ বেড়াতে আসে। কেউ বা আসে খোঁজখবর নিতে। মিসেস প্যাটেল, ঘোষ বউদি, পুষ্পা—এইরকম সব প্রতিবেশী।

সারাদিন গগনকে নিয়ে থাকলে আমার মায়ের কথা কতক্ষণ আর ভাবা যায়। ওরই মধ্যে মায়ের কথা ভাবি। চিঠি লিখি মাকে। মায়ের চিঠি এলে কী খুশিই লাগে। এরই মধ্যে মা একবার এসে দিন চারেক থেকে গিয়েছিল। বড় স্বস্তি আর সুখ নিয়ে ফিরে গিয়েছিল মা।

সত্যি করে একটা কথা বলতে আমার আপত্তি কী! যতদিন মায়ের কাছে ছিলাম, মা ছাড়া আমার কেউ ছিল না, কিছু ছিল না। গগনকে পাবার পর আমার কাছে গগনই হয়ে গেল বড়। সে আমার নিজের হল। আমি হলাম তার নিজের। যে-সংসার ছেড়ে চলে এসেছি সেই সংসার যেন তার ধূপের গন্ধ এখন আর এতটা দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারছিল না। গন্ধটা তাই ফিকে হয়ে আসছিল। তার মানে এই নয় যে, মাকে আমি ভুলে যাচ্ছিলাম। সব মেয়ের বেলায় যেমন হয়, বিয়ের পর আমি আমার স্বামীতে মগ্ন হয়ে থাকলাম। গগন আমাকে সকাল দুপুর রাত ভরে রাখল তার ভালবাসা দিয়ে।

আমি বুঝতে পারতাম, এই ভালবাসার শেষ নেই। আগেও ছিল না। মায়ের ভালবাসার সঙ্গে এর অনেক তফাত।

তখন আর কে বুঝেছে, ভালবাসার কোথায় পোকা?

দুই

একটা বছর সবেই কাটল, আমাদের বিয়ের তিথির পর পরই গগন একদিন একটা ঝকঝকে মোটর বাইক আর দৈত্যের মতন এক ভদ্রলোককে এনে হাজির করল। বলল, ”সুনু, রাজেন ভাওয়াল। কোলিয়ারি কন্ট্রাকটার। আমাদের বন্ধু। উনি বিগ বস। মেলাই টাকা। শখ করে মোটর বাইকটা কিনেছিলেন, এখন বেচে দিতে চাইছে। বলছেন, ওঁর জিপটাই কাজে আসে।”

গগন বেশ কিছুদিন ধরেই গাড়ি গাড়ি করছিল। কখনও বলছিল, পুরনো একটা গাড়ি কিনবে দেখেশুনে; কখনও বলছিল মোটর বাইক। ও প্রায়ই বলত, ”সন্ধের দিকটা মাঝে মাঝে বড় ‘বোর’ করে। তোমায় নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাব, একটু আসানসোলে বাজারে গেলাম; কিছু কেনাকাটা হল, সিনেমা দেখলাম দু-একটা; কিছুই হয় না। শুধু অফিস আর কোয়ার্টার। কোথাও যেতে হলে অফিসের কাছে জিপটা ভিক্ষে চাও, না হয় প্যাটেলের পোঁ ধরে বসে থাকো। প্রেস্টিজ থাকে না।”

একটা গাড়িটাড়ি থাকলে যে বেশ হয়—এটা আমিও মেনে নিতাম। আমরা বড় ফাঁকায় ফাঁকায় থাকি, একই লোকজন চোখ মুখ ছাড়া কিছু দেখতে পাই না। শহর এখান থেকে মাইল নয় দশ।

তবু আমি টাকার কথা তুলতাম। হোক না পুরনো—তবু একটা গাড়ি কেনার টাকা তো চাই।

গগন বলত, ”তুমি কিছু বার কর সিন্দুক থেকে, বাকিটা অফিস থেকে লোন নেব। চাইলেই দিয়ে দেবে।

আমি যদি একটু খুঁতখুঁত করতাম, গগন বলত, ”আমার মান যাচ্ছে সুনু। নিজেদের একটা দু-চাকা চার-চাকা থাকা দরকার।”

ভাওয়ালকে দেখে বুঝলাম, গগন ওই ঝকমকে লাল মোটর বাইকের লোভে পড়েছে; হয়ত কথাবার্তাও সেরে রেখেছে খানিক; আমার না বলা উচিত হবে না।

দৈত্যের মতন বিশাল দেখতে হলেও ভাওয়াল মানুষটি ভাল। আমাকে ঠাট্টা করে বলল, ”মেমসাহেব, রেখে দিন জিনিসটা। ভাল গাড়ি। নিজে চড়ে বলছি। আপনি যখন সাহেবের সঙ্গে পেছনে বসে হাওয়া খেয়ে ফিরবেন—তখন বুঝতে পারবেন কোন পক্ষিরাজে চড়েছেন!”

গগন মোটর বাইকটা কিনে নেবে কথা দিল। দামও একসঙ্গে দিতে হবে না, বার কয়েকে দিলেই হবে।

পাকা কথাবার্তা হয়ে গেল।

সেদিন রাত্রে গগনের কী ফুর্তি। মোটর বাইক ছাড়া কথা নেই মুখে। নতুন খেলনা পেলে ছেলেমানুষরা যেমন করে তেমন করতে লাগল। ওর স্বভাবে বরাবরই এক ছেলেমানুষি, চঞ্চলতা আছে। আমি বুঝতে পারতাম না, যে-মানুষ এত চঞ্চল অস্থির—সে কেমন করে একটা কারখানার গোটা হিসেবপত্র, লাভ লোকসান, টাকা পয়সার ঝামেলা সামলায়! আমি না বুঝলেও জানতাম, অফিসে গগনের সুনাম আছে।

গগন যখন বিছানায় শুয়ে আমায় জ্বালাচ্ছে আর মোটর বাইকের গল্প করছে তখন আমি বললাম, ঠাট্টা করেই, ”দেনা শোধের জন্যে এবার আমার হাত টান করে সংসার চালাতে হবে। মাংস একদিন, ডিম দুদিন, মাছ দুদিন। দুধ, চিনি, তেল, ডাল সব কমিয়ে দেব। বিষ্টুকেও বলব, তুই অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নে; তোর সাহেব ভটভটি কিনেছে।

গগন আমার গাল টিপে দিয়ে বলল, ”আমাকে হিসেব শিখিয়ো না। তোমার চেয়ে হিসেবের মাথা আমার ভাল। ….তুমি ভুলে যেও না, এখনও তোমার কোলে ট্যাঁফোঁ তুলে দিইনি। দিলে খরচের ঠেলা বুঝতে। একটা বাচ্চা সামলাবার এক বছরের খরচ তোমার মোটর বাইকের দামের চেয়ে বেশি বই কম নয়। আরে শালা, যে-রেটে তোমার বাচ্চা দুধ খেত—অত দুধ তুমি তোমার মাইনর সাইজ ব্রেস্টে সাপ্লাই করতে পারতে না মেমসাহেব। একটা গোরু পুষতে হত বাড়িতে।”

”অসভ্য!” বলে গগনের গায়ে আমি ঠেলা মারতেই সে হো হো করে হেসে আমার বুকের ওপরেই আবার লুটিয়ে পড়ল।

তখন ফাল্গুন মাস। মাত্র দু মাসের মধ্যেই মোটর বাইক কেনা, চালাতে শেখা, লাইসেন্স সব হয়ে গেল। বৈশাখ মাসের শেষ দিকে আমি গগনের মোটর বাইকের পেছনে বসে শহরের হাওয়া খেয়ে এলাম। সেদিনটা বৈশাখী পূর্ণিমা না হলেও জ্যোৎস্নায় ভরা ছিল পথঘাট, মাঠ; গাছপালা ডুবে ছিল চাঁদের আলোয়। আর আমি গগনের পেছনে বসে তার কোমর জাপটে ধরে আঁচল উড়িয়ে, এলোমেলো চুল গালে গলায় জড়িয়ে বাড়ি ফিরলাম।

গগন বলল, ”দারুণ থ্রিল।”

আমারও গায়ে কাঁটা দিল। সত্যি, বেশ লাগল।

মাকে আগেই বাইক কেনার কথা লিখেছিলাম। এবারে লিখলাম, মা আমি সেদিন ওর সঙ্গে বাইকে করে ঘুরে এলাম। ফিরতে রাত হয়ে গেল। কী ভাল চালাতে শিখেছে, নতুন বলে মনেই হয় না।

এমন করেই জ্যৈষ্ঠ গেল, আষাঢ় গেল। বর্ষার চেহারা বুঝে আমরা দুজনে আজ যাই শহরে কিছু কেনাকাটা করতে, কোনোদিন বা সিনেমা দেখতে। আবার এক একদিন শুধুই বেড়াতে বেরোই।

সেদিন না মেঘলা, না বৃষ্টি। শ্রাবণ মাস হলেও খটখটে ছিল। বিকেলের দিকে গগন ছটফট করতে লাগল। রবিবার বলে কথা। গগন হঠাৎ বলল, ”সুনু, আজ বৃষ্টি হবে না। চলো, একটা সিনেমা দেখে আসি। শুনছিলাম, পুরনো একটা ভাল ছবি এসেছে।”

আমি না করলাম না।

আমারও যেন আজকাল খানিকটা নেশা ধরে গিয়েছিল। সিনেমার নেশা নয়, শহুরে বাজারেরও নেশা নয়, পথঘাট গাছপালা মাঠ আর রাস্তার নেশা। এ তো কলকাতা শহর নয়। এদিককার রাস্তাঘাটও অন্যরকম। পিচ বাঁধানো রাস্তার সবটাই ভাল নয়, এবড়োখেবড়ো যথেষ্ট, গর্তও কম নয়, তবু বেশ ফাঁকা। সরু রাস্তার দুধারে শুধু গাছ, আম জাম কাঁঠাল শিশু কত কী! মাঝে মাঝে পলাশ ঝোপ। আর মাঠ। যেতে যেতে ক্ষেত খামার। ছোট ছোট গাঁ-গ্রাম। কোলিয়ারির সরু সরু রাস্তা এসে মিশেছে বড় রাস্তায়। রাত্রে ফেরার সময় দেখি রাশ রাশ জোনাকি উড়ছে গাছের পাতায়। অন্ধকার গভীর হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে মাঠে, যেন সবই ঘুমোচ্ছে। আকাশজুড়ে কত তারা। বাবার কথা মনে পড়ত।

ওই রাস্তা দিয়েই মাঝেসাঝে গাড়ি আসছে আলো ছিটিয়ে, আসছে ট্রাক। সেই আলোয় রাস্তার কাছাকাছি কোনো গাঁয়ের দোকানপাট ছবির মতন ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।

আর ওই যে গগনের কোমর জড়িয়ে বসে থাকা, বাতাসে বাঁধা-আঁচল খুলে যাওয়া, মাথার উড়ন্ত চুল মুখে এসে পড়া…। বেশ লাগত। আজকাল আমি পুরো মাথা জুড়ে একটা নেটও পরে নিতাম চুল ওড়া বন্ধ করতে।

গগন মোটর বাইক বার করল। আমিও সেজেগুজে বেরিয়ে এলাম। একবার আকাশের দিকে চেয়ে বললাম, চলো।

যাবার সময় সবই শুকনো। বৃষ্টির গন্ধ নেই কোথাও।

ফেরার সময় দেখি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। সিনেমা হলের মধ্যে বসে বুঝতে পারিনি কখন বৃষ্টি এসেছে, কখন থেমেছে।

বাদলা বাতাস, ভিজে ভিজে গন্ধ, অন্ধকার, জোনাকির দল নেমেছে গাছ গাছালিতে, আকাশে দু-এক টুকরো মেঘ। ভালই লাগছিল।

গগন সাবধানেই গাড়ি চালাচ্ছিল। রাস্তা কোথাও কোথাও ভিজে আছে। হয়ত এদিকে বৃষ্টির পশলা ছিল খানিকক্ষণ।

প্রায় বারো আনা পথ শেষ। বাকি চার আনা। সামনেই এক বড় কালভার্ট। প্রায় সাঁকোর মতন। নিচে দিয়ে এক নালা বয়ে গিয়েছে। দু পাশের মাঠ অনেকটা নিচুতে।

সাঁকো শেষ হয়েছে কি অন্ধকারের আড়াল থেকে একটা মোষ এসে পড়ল রাস্তায়। গগনের চোখ ছিল সামনে। বাইকের আলোয় মোষটা আচমকা দেখতে পেয়েই সে পাশ কাটাল। কতটা কাটাল, কত আচমকা, রাস্তার মধ্যে অন্য কিছু পড়েছিল কিনা—সেসব জানা বা বোঝার আগেই আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম। তারপর গড়াতে গড়াতে গড়াতে…।

আমার কখন জ্ঞান হয়েছিল আমি জানি না। যখন হয়েছিল তখন আমি হাসপাতালে।

হাসপাতালে আমার দিন গেল, সপ্তাহ গেল। বড় হাসপাতালের বড় সার্জন আমার ডান পায়ের হাঁটুর ওপর থেকে কেটে কুটে ফেলে দিলেন। গ্যাংগ্রিন ধরে যাচ্ছিল। কিছুই নাকি করার ছিল না আর। আমার ডান পায়ের বারো আনা চলে গেল, থাকল চার আনা।

নিজের বাড়িতে একদিন ফিরলাম। মা সঙ্গে ছিল। মায়ের বড় ছোটাছুটি যাচ্ছিল। একবার কলকাতা, একবার আমাদের কাছে।

বাড়ি ফিরে আমার সঙ্গী হল আয়া, ক্রাচ, মাঝে মাঝে ডাক্তার।

মা বলল, ”আমার সঙ্গে কলকাতায় চল। ক’মাস থাকবি।”

আমি বললমা, ”না। তুমি যাও। আমি এখানেই থাকব। এত লোকজন এখানে রয়েছে, তোমার কাছে গিয়ে আলাদা কী লাভ হবে।”

মা কলকাতায় ফিরে গেল। ফাঁক পেলেই আসবে আবার।

আমার জীবন শুরু হল অন্যভাবে।

তিন

আমার বাড়িতে আমি—সুনীতিমালা, সুনু আবার জায়গা করে বসলাম। কিন্তু তার ধরন গেল পালটে। আগে ছিলাম অবাধ, স্বাধীন, তরতরে, মুক্ত। এখন আমার ডানা-কাটা পাখির মতন অবস্থা হল। উড়তে চাই—পারি না। ঝাপটা দিয়ে উঠি হয়ত, আবার পড়ে যাই।

তবু এ আমার বাড়ি। এই বাড়ির সব কিছু আমার নখদর্পণে। গগন বিরক্ত হত। বলত, তোমার অত দরকার কিসের?

আমার দরকার গগন কেমন করে বুঝবে? কে চায় চিরকালের মতন অক্ষম থাকতে! যা গিয়েছে আমার বরাবরের জন্যে তা তো গিয়েইছে, কিন্তু বাকিটা? সে যে অনেক। তেইশ চব্বিশের পরও জীবন থাকে। আয়ু। সেটা আমি যেতে দেব কেন? আমি প্রাণপণ বাকিটা আঁকড়ে থাকতে চাইতাম।

ক্রাচ আমার পছন্দ হত না। হাতের কাছে থাকত বটে, তবে চাকা লাগানো একটা বসার গাড়ি আনালাম। গাড়িতে বসে আমি এ-ঘর ও-ঘর, বারান্দা, রান্নার জায়গায় নিজে নিজেই যেতে পারতাম। আমার জন্যে প্রথমে ছিল আয়া, তারপর এল যমুনা বলে মাঝ বয়সী এক মেয়ে। আমি বলতাম, যমুনাদি। যমুনাদি আমায় স্নানঘরে নিয়ে যেত, দরকার মতন শাড়ি সায়া পরিয়ে দিত। আমার কথা মতন ঘর সংসারের কাজ গুছিয়ে দিত।

সবই যখন ধীরে ধীরে মানিয়ে আনছি তখন বুঝতে পারলাম, আমার সংসারে আমি ফিরে এসেছি ঠিক, কিন্তু গগনের কাছে আর ফিরে আসিনি। তার সেই চঞ্চলতা, তাপ, ঘনিষ্ঠতম মিলনের আবেগ থেকে সে আমায় ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রথম বলত, ছেলেমানুষি করো না, চুপ করে শুয়ে থাকো, ঘুমোও। ঘুম না আসে ঘুমের ওষুধ খাও।

এক একদিন যেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে একটু আলগা আলগা আদর সেরে রূঢ়ভাবে আমাকে বলত, নাও, ঘুমোও। আমাকে ঘুমোতে দাও।

এই উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অপমান আমাকে কাঁদাত; জাগিয়ে রাখত সারারাত। ও আমায় নিত্যদিন এভাবে প্রত্যাখ্যান করবে কেন? আগে যে-মানুষ আমায় না-ছুঁয়ে থাকতে পারত না—এখন সে আমায় দূরে সরাতে পারলে বাঁচে! কেন?

শেষে একদিন আমি লাজলজ্জা যা কিছু গগনের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ”আমার কি কিছুই নেই? একটা পা কাটা গিয়েছে বলে তোমার কি আর….”

আমাকে কথা শেষ করতে দিল না গগন, বিশ্রী মুখ করে বলল, ”তোমার নিজের চোখ থাকতে না পারে, আমার আছে। আমি চোখ চাইতে পারি না। ইট মেক্স মি সিক। লেজ কাটা টিকটিকির মতন ওই দৃশ্য…এত আগলি, কুচ্ছিত…আমার সমস্ত কিছু অসাড় হয়ে যায়। প্লিজ—আমায়—আমায় ডিস্টার্ব করো না। কাল থেকে আমি অন্য ঘরে শোবো।”

তা হলে এই! গগন আমাকে তার বিছানায় সহ্য করতে পারে না। তার পৌরুষ অসাড় হয়ে যায় আমার নগ্ন পা পেট দেখলে! যদি আমার একটা হাত যেত, যদি চোখ যেত একটা, যদি আমার কথা বলার শক্তি চলে যেত—আমি বোবা হয়ে যেতাম—গগনের বোধহয় তেমন কিছু আটকাত না। তার কোথায় আটকাচ্ছে, কেন কুৎসিত মনে হচ্ছে এই অঙ্গহীনার দেহাংশ—আমি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম।

মানুষ কি মাত্র একটি অঙ্গ দিয়েই গড়া। তাতেই সে পূর্ণ? তাহলে ভগবান এতগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিলেন কেন? আমার পরিচয় একটি দুটি অঙ্গ ঘিরে? বাকি সব মিথ্যে!

গগনকে আর আমি বিরক্ত করলাম না।

পরের দিন, যমুনাদিকে বললাম, ছোট ঘরেই আমার শোবার ব্যবস্থা সাজাতে। পাশে বাথরুম আছে। এতে চমকে যাবার মতন কিছু ছিল না। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর ওই ঘরটাতেই আমার বিছানা পড়েছিল। সঙ্গে মা থাকত। মা না থাকলে আয়া। দিন আমার ওই ভাবেই কেটেছে তখন।

তবু যমুনাদি কিছু মনে করে ভেবে পরে বললাম, ”সাহেবের অনেক কাজ এখন অফিসের। রাত জেগে আলো জ্বালিয়ে কাজ করে; আমার ঘুম আসতে চায় না।….ওর কাজ মিটুক, তারপর….”।

যমুনাদি কী মনে করল কে জানে। যা করে করুক। আমার আর কী আসে যায়! তাছাড়া সন্ধের পর তো ও আর থাকে না। আমি কোন ঘরে শুই বসি—তা নিয়ে যমুনাদির মাথা ঘামাবার দরকার কী?

আমার শোবার ঘর আলাদা হল।

গগন আমায় যে কী ভীষণ ঘৃণা করতে শুরু করেছে এটা বুঝতে আমার বড় দেরি হয়ে গেল। আমি বড় বোকা। ওর চোখ মুখ ব্যবহার দেখেই আমার বোঝা উচিত ছিল, আমি আর ওর ভালবাসার স্ত্রী নই, সামাজিক স্ত্রীলোক মাত্র, যাকে ও নিতান্ত লোকলজ্জার খাতিরে ঘরে রেখে দিয়েছে। হয়ত স্বার্থবশে। এখানকার ম্যানেজার মায়ের কলকাতা অফিসের ছোট কর্তার ভাইপো। ছোট কর্তাদের পারিবারিক টাকা খাটছে এই কারখানায়। ওদের মুঠোয় অনেক জোর। গগন যদি আমাকে তাড়ায়—তার অসুবিধে হবে, হতে পারে।

গগনের রাগ বিতৃষ্ণা ঘৃণা দিন দিন এতই বাড়তে লাগল যে সে আমার সঙ্গে প্রায় কথাই বলত না। নিজের মনে বিড়বিড় করে হয়ত আমায় গালাগাল দিত। মাঝে মাঝে অকারণে অসভ্যের মতন চেঁচাত। বিষ্টুকে যা-তা বলত। শেষে গগন রাত্রে ঘরে বসে মদ খেতেও শুরু করল।

একদিন শুনি বসার ঘরে বসে মদ খেতে খেতে বেজায় জোরে একটা ইংরিজি গান বাজাচ্ছে। গানের একটা দুটো কথা আমার কানে এল : ‘হোয়ার হার লাভ লাইক…’।

কেন কে জানে আমার সারা শরীর মন যেন বিষিয়ে উঠে রাগে ঘৃণায় জ্বলে উঠল। কাঁপতে লাগল সারা গা। মাথা আগুন হয়ে উঠল। আর তখনই বুঝতে পারলাম, গগনকে আমিও ঘৃণা করতে শুরু করেছি। হয়ত আগে থেকেই শুরু করেছিলাম। তার তীব্রতা বুঝতে পারিনি। এবার পারলাম। হোয়ার হার লাভ লাইক…! …তাই নাকি?

চার

সম্পর্কে যমুনাদির ভাই। নাম, নিবারণ। আমারই বয়েস। দেখতে রোগা, রঙ কালো, নাক ভোঁতা, চোখ ছোট ছোট, গালে ব্রণর বড় বড় গর্ত, হাত পা লম্বা লম্বা। ছেলেটা প্রথমে আসত যমুনাদির খোঁজে। শেষে বুঝলাম, সে আমাকে ধরতে আসে। আমি যদি গগনকে বলে তার একটা চাকরি করিয়ে দি কারখানায়।

নিবারণকে আমি পাত্তা দিতাম না। কার চাকরি কে জোটায়? তা ছাড়া এ-গগন আর সে-গগন নেই যে আমি জোর করে ধরলে কিছু হবে।

যমুনাদি আগে না বুঝুক পরে হয়ত বুঝেছিল। গগনের ওপর আমার আর কোনো হাত নেই। কী বলেছিল নিবারণকে আমি জানি না। আমায় একদিন বলল, ”আমি কত করে ওকে বারণ করে দিয়েছি, বউদি। বলেছি, তোমায় যেন এ-ভাবে বিরক্ত না করে। সাহেবের এখন মাথা তোলার ফুরসত নেই, এত কাজ! চাকরি কি হাতের মোয়া যে চাইলেই পাওয়া যায়! কিন্তু কী করব বউদি, ও তো শুনতেই চায় না। নিবারণ ছেলে খারাপ তা নয়; বি এ পর্যন্ত পড়েছে। বাড়িতে বড় অভাব। ও একেবারে নাছোড়বান্দা। তুমি ওকে স্পষ্ট করে বলে দিও, কিছু হবে না।”

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছি বইকি আগে! তবে বেশি কথাবার্তা তো বলতাম না নিবারণের সঙ্গে। ভাবলাম এরপর স্পষ্ট করেই বলে দেব।

সেদিন আমি বাংলোর ভেতর বারান্দায় বসে। শীতের হাওয়া দিতে শুরু করেছে সবে। বেলা দশ-টশ হবে। আমার গায়ে হালকা গরম চাদর। চাকা-লাগানো চেয়ারে শাড়িজামা চাদর গায়ে বসে থাকলে চট করে বোঝা যায় না, আমার একটা পা নেই। শাড়ি থাকে লুটনো, গায়ের চাদর থাকে ঝোলানো পা পর্যন্ত। তাছাড়া আমি আমার গোটা পা সামনের দিকে এগিয়ে এমন করে বসি যে সহজে আমার ডান পায়ের ফাঁকিটা চোখে পড়ে না।

শেষ অগ্রহায়ণের রোদভরা মাঠে বাগানে মালি কাজ করছিল। মরসুমি ফুলের চারা জেগেছে সদ্য। চড়ুই আর ময়নার ঝাঁক বাগানে ওড়াউড়ি করছিল। প্রজাপতিও এসেছে কতক।

এমন সময় সাইকেল নিয়ে নিবারণ এসে হাজির।

তফাতে সাইকেল রেখে আমার কাছে এসে বারান্দার রোদে বসল। বসেই বলল, ”বউদি, আপনার শরীর ভাল?”

কথাবার্তায় নিবারণ শুধু ভদ্র নয়, হাসিতামাশাও করতে পারে। বললাম, ”ভাল।”

নিবারণ বলল, ”পাঁচ সাত দিন আসতে পারিনি। ভাবলাম, আজ আপনার খবর না নিয়ে জলস্পর্শ করব না। বিশ্বাস করুন, মুখ ধুয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে বেরিয়ে পড়েছি সাইকেল নিয়ে। চার মাইল এসেছি, মাত্র চল্লিশ মিনিটে।”

নিবারণের হাতে ঘড়ি নেই। হেসে বললাম, ”বুঝলে কেমন করে চল্লিশ মিনিটে এসেছ?”

”আন্দাজে। আমরা বুঝি।”

”এখন তো বেলা দশটা। ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়লে এত বেলা হয়?”

নিবারণ মাথা নেড়ে বলল, ”উঠতে যে বেলা হয়ে গিয়েছে। কাল দুর্গাপুর গিয়েছিলাম। ট্রেনে ফিরতে রাত হল। কাল চেকিং চলছিল। ডবলু টি মারতে পারছিলুম না। শেষে রাত আটটার গাড়ি ধরলাম। অণ্ডালে নেমে কিছুই পাই না। আবার রানীগঞ্জ। সেখান থেকে….”

”বুঝেছি। আগে তাহলে জলস্পর্শ করো…।” বলে আমি বিষ্টুকে ডাকলাম।

নিবারণ বলল, ”দিদি আসেনি?”

”না, এখনও আসেনি। মাঝে মাঝেই দেরি করে। কামাইও রয়েছে। আমার আজকাল অত দরকারও করে না যমুনাকে। ভাবছি ছাড়িয়ে দেব এবার।….এই তো বলছিল কার বিয়েতে যেতে হবে। তার অবশ্য দেরি আছে। মাঘ মাসে।”

বিষ্টু এল।

আমাকে বলতে হল না, নিবারণ নিজেই বলল, ”এক গ্লাস চা আর গোটা চারেক হাতেগড়া রুটি আনবি। গুড় পেলে আনবি, না পেলে আনবি না। যা, ভীষণ খিদে পেয়েছে।”

আমি হেসে ফেললাম। নিবারণ আজকাল অনেকটা এইরকম।

পরে বললাম, ”দুর্গাপুরে গিয়েছিলে কোথায়?”

”আর কোথায়? খোঁজখবর লাগাতে।…বউদি কপাল খুললে কী না হয়। হারু চট্টরাজ, এইট ক্লাসের বিদ্যে। দেখলাম বেনাচিটিতে একটা দোকান লাগিয়েছিল। চার বছর পুরো হয়নি। ফেঁপে লাল! বলুল, দিন সাত-আটশো টাকা বিক্রি।”

আমি বললাম, ”তুমিও লাগাও না। চাকরি চাকরি করে না ঘুরে একটা দোকান-টোকান দাও না! ফেঁপে যাবে!”

নিবারণ বলল, ”আমার টাকা কোথায়?”

হঠাৎ আমার যে কী হল, বললাম, ”তুমি চেষ্টা করো। টাকা আমি তোমায় দেব কিছু।”

নিবারণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর দেখি তার চোখ আমার হাতের দিকে। সোনার চুড়ি দেখছিল। নিবারণের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি সেই মুহূর্তে যেন ওর অনেক কিছু দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম, ছেলেটা লোভী। প্রয়োজন তাকে লোভী করে তুলেছে হয়ত।

এরপর আমার কী মতিচ্ছন্ন হল আমি জানি না, নিবারণের লোভ আর প্রয়োজনকে আমি পরখ করতে লাগলাম।

মা আমায় বিয়ের সময় মোটামুটি গয়না দিয়েছিল। এ-বাড়িতে আলমারির লকারে রাখা ছিল সব। চুরি চামারির ভয় ছিল না। আড়াল করে করেই রেখেছিলাম গয়নাগাটি।

আমার মাথার দোষ হয়েছিল কিনা বলতে পারব না, এতকাল যা নিয়ে মাথা ঘামাইনি, এখন ঘামাতে লাগলাম।

এক একদিন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আয়নার সামনে বসে আমি গয়নাগুলো দুটো একটা করে পরতাম, আর নিজেকে দেখতাম।….কে বলেছে আমি ডানাকাটা পরী! আমি আমার মায়ের মতন অনেকটা, বাকিটা বাবার মতন। মায়ের গায়ের রঙ আমার মতন নয়। আমি ফরসা না হই শ্যামলা। আমার চোখ নাক মুখ মায়ের ধাঁচের। শুধু আমার কপাল আরও একটু ঢেউ তোলা, চোখ আরও একটু বড়, টানা টানা। আমার গলা ঘাড় হাত কোনোটাই ফেলনা নয়। যৌবনের সরসীতে কাদা ওঠেনি।

গলা কান হাতের গয়নাগুলো পরে নিজেকে দেখতাম আর ভাবতাম—গগন কি আমার কাটা পায়ের বাইরে আর কিছুই দেখতে পেল না। টিকটিকির লেজ কেটেছে যেখানে সেখানেই কি তার চোখ আর মন! তার বাইরে আমি—সুনীতি—সুনু কেউ নই। আমার কোনো অস্ত্বিত্ব নেই অন্য কোথাও।

মাঘ গেল, ফাল্গুন গেল।

চৈত্র এল খাঁ খাঁ করে, আকাশ বাতাস জ্বালিয়ে, তপ্ত দীর্ঘ নিশ্বাসের মতন কত বাতাস বয়ে যেতে লাগল।

শেষে একদিন একটা বটুয়া ভরে বাকি যা ছিল আমার নিবারণের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ”আর তুমি কোনোদিন এসো না। কোনোদিন না। আমার যা ছিল সবই দেওয়া শেষ হল। তোমার কাছ থেকে যা নেবার নেওয়া হল। এখানেই শেষ।”

নিবারণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বটুয়া নিল। তাকাল। তার চোখজুড়ে অপরাধ না লোভ ফুরোবার কান্না আমি বুঝলাম না। আমার চোখেই বা কী ছিল কে জানে!

নিবারণ চলে গেল মুখ মাথা নিচু করে।

পাঁচ

জ্যৈষ্ঠের শেষে একদিন আমি গগনকে বললাম, ”ডাক্তারবাবুকে একবার খবর দিও।”

”কেন?”

”আমার শরীর খারাপ লাগছে।”

পরের দিন বিকেলের দিকে ডাক্তার এলেন।

কারখানার ডাক্তার নয়। মাইল তিন চার তফাতে থাকেন। খবর দিলে আসেন ভদ্রলোক। মাঝবয়সী মানুষ। তাঁর গাড়িটার বয়েস বোধহয় আরও বেশি।

উনি যখন এলেন গগন তখন অফিসে। এসে বললেন, সকালের দিকে আসতে পারেননি। একে রোগীর ভিড়, তায় গুমোট আর গরম।

”কী হয়েছে মিসেস সেনগুপ্ত?”

বললাম, কী হয়েছে!

”চলুন দেখি।”

ঘরে এসে বিছানায় শুলাম।

ডাক্তার মানুষটি ভাল। দেখলেন যত্ন করে।

হাত পা চোখ, বুক পেট। ব্লাড প্রেসার। তারপর বললেন, ”এই শরীর খারাপ কতদিন ধরে চলছে?”

”মাস দুই।”

ডাক্তারবাবু যেন একটু হাসি মুখ করলেন। ”ঠিক আছে।…..এখনকার মতন দু-একটা ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। পরে এসে আবার দেখে যাব, কী বলেন।”

নিজের প্যাডের পাতায় লিখলেন পাঁচ রকম। তারপর কাগজটা আমার হাতে দিয়ে হেসে বললেন, ”চলি, মিসেস সেনগুপ্ত! ভাবনার কিছু নেই।”

সন্ধের আগে আগে গগন ফিরল অফিস থেকে। ফিরেই বাথরুমে ঢুকল স্নান সারতে। আজ যেন অসহ্য গুমোট। বাতাস নেই। গাছপালা ঠায় দাঁড়িয়ে, একটা ডাল কয়েকটা পাতা তাও কাঁপছে না।

আমার ঘরে আমি চুপ করে বসে ছিলাম। আলো জ্বলছিল। পাখা চলছিল ঝড়ের মতন।

গগন আমার ঘরে এল হঠাৎ। বলল, ”ডাক্তার এসেছিল?”

আমি মাথা হেলালাম।

”কী বলল?”

আমি অপেক্ষা করছিলাম। ইশারা করে টেবিলটা দেখালাম। বললাম, ”কাগজটা চাপা রয়েছে।”

গগনের ডান হাতে সিগারেট ছিল। এগিয়ে গিয়ে বাঁ হাতে কাগজটা তুলে নিল। দেখল। তারপর এমনভাবে চমকে উঠল, যেন, কোনো সাপে তাকে ছোবল মেরেছে।

কাগজটা বার কয়েক দেখল। তার মুখ কালো, কঠিন, বিশ্রী হয়ে উঠল। সারা মুখে অবিশ্বাস। মাথা নাড়ল জোরে জোরে। ”ইমপসিবল! হতেই পারে না। অসম্ভব। অ্যাবসার্ড! ডাক্তার বেটা কি গাঁজা খেয়ে এসেছিল?”

আমি কোনো কথা বললাম না। গগনকেও দেখতে ইচ্ছে করছিল না আর। ওকে আমার এত বেশি ঘেন্না করছিল কেন—কে জানে!

কাগজটা হাতে নিয়ে গগন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সিগারেটের টুকরোটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে চটি দিয়ে মাড়াতে মাড়াতে বলল, ”পড়েছ কাগজটা?”

আমি চুপ।

”কী? কথা বলছ না যে?”

নিজেকে আমি প্রাণপণ শক্ত করছিলাম।

”বেটা ডাক্তারকে আমি দেখে নেব। উজবুক কোথাকার!….ও যা খুশি লিখল, তুমি চুপ করে থাকলে!….বেটা লিখছে, প্রেগনেনসি…। আ—শালা গাছের ফল! অ্যাবসার্ড! হয় কেমন করে? আকাশ থেকে পড়ল!…কী তুমি চুপ করে আছ। কথা বলছ না? স্বপ্ন দেখছ? শখ? মুনিঋষিরা করে দিয়ে গেল বুঝি যেমন আগে করত।”

আর আমি পারলাম না। গগনের চোখে চোখে তাকালাম। আমার সমস্ত ঘৃণা, বিদ্বেষ, তিক্ততা দিয়ে। বললাম, ”হ্যাঁ।”

গগনের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। পুড়ে ছাই হয়ে যাবার মতন দেখাচ্ছিল তাকে। কথা বলতে পারছিল না। তার চোখ স্থির। হাত পা অসাড়। নিশ্বাস যেন বন্ধ।

কতক্ষণ যে গগন ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল জানি না। শেষে তার চেতনা এল। পালটে গেল চেহারা। বলল, ”কী বললে? আবার একবার বলো?”

বললাম, ”হ্যাঁ।”

গগন যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠাস করে এক চড় মারল গালে। আবার মারল। আবার। আমার শাড়ির আঁচল খুলে ছিঁড়ে দিল। ওকে জানোয়ারের মতন দেখাচ্ছিল। চিৎকার করছিল গগন। ”আমি তোমায় গলা টিপে মেরে ফেলব। নচ্ছার নোংরা মেয়েছেলে? চিট? খোঁড়া মাগি কাঁহাকা!….কে সে? কোন শালা ব্যাস্টার্ড! তাকে আমি খুন করব।”

গগন আমায় জন্তুর মত মারছিল। চড়, চাপড়, ঘুষি।

”তুমি লোকের কাছে আমার মান ইজ্জত সম্ভ্রম ডুবিয়ে দিলে! লোক হাসালে?

আমি বললাম, ”লোকের কাছে তোমার মান বাড়ালাম। খোঁড়া পা-কাটা বউকেও তুমি কত ভালবাস তার প্রমাণ তো রেখে দিলাম। লেজখসা টিকটিকির মতন একটা পা-কাটা বউয়ের সঙ্গে তুমি থাকতে কত আদর করতে তাকে বিছানায়—সেই প্রমাণটা থেকে গেল।”

গগন কী একটা তুলে খেপার মতন ছুঁড়ে মারল। সাজ-আয়নার কাচ ভেঙে পড়ল ঝনঝন করে। ”মান বাঁচালে!…..আবার কথা! নোংরা মাগি! নাম আবার সুনীতি!”

বিষ্টু আর মালি তাদের ঘর থেকে ততক্ষণে ছুটে এসেছে। এই ভীষণ চেঁচামেচি তাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।

গগন মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে বেরিয়ে গেল।

আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম আমি। তারপর শুধু কাঁদলাম। সারা রাতভর।

পরের দিন গগন কারখানা যাবার আগে বলে গেল, ”তোমার মাকে চিঠি লিখে দাও, তোমায় এসে নিয়ে যাক। টেলিগ্রাম করো। আর্জেন্ট। এ-বাড়িতে আর তোমার জায়গা হবে না।”

আমি জানতাম, মায়ের কাছেই আমাকে চলে যেতে হবে। আমার আশ্রয় মা।

তিন দিনের মাথায় মা এল ছুটতে ছুটতে।

আমি কিছু বলার আগে গগনই সব বলেছিল।

মা আমার কাছে এসে দাঁড়াল যখন তখন মায়ের চেহারা দেখে মনে হল, বাবা মারা যাবার সময় বুঝি মাকে এই রকম উদভ্রান্ত, অসহায় ব্যাকুল দেখেছিলাম।

খানিক সময় মা আমাকে দেখল। শুধু দেখল।

আমিও মাকে দেখছিলাম। মায়ের মাথার আরও কত চুল সাদা হয়ে গিয়েছে।

শেষে মা আমার পাশে এসে বিছানায় বসল। কাঁপছিল মা। তারপর আমায় জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। আমিও কাঁদছিলাম।

শেষে ভাঙা কান্না জড়ানো গলায় মা বলল, ”তোকে আমি নিয়ে যাব।”

মায়ের সঙ্গে আমার কথা ছিল, মেয়ে হলে মায়ের কাছে তুলে দেব, ছেলে হলে—আমার কাছে রাখব। এই ঠাট্টা তামাসার কথাটা এখন কেন মনে পড়ল কে জানে!

কী হবে! শেষ পর্যন্ত পেটেই মরবে, না, এই জগতের আলো বাতাস দেখতে পাবে মাংসের ডেলাটা, আমি কেমন করে বলব?

আর যদি দেখতেও পায় এই জগতের আলো বাতাস—তা হলেও কি ধন্য হবে! কে বলেছে এই মানুষ জন্ম পরম। জীবন জন্ম চরিতার্থ হয়!

কই আমি তো হলাম না।

আমার কাছে আজ গগন আর নিবারণের মধ্যে কোনো তফাত নেই। একজন ভালবাসার নামে বুঝত দেহভোগ। বুঝত অঙ্গ, অন্তর নয়। আর অন্যজন ছিল লোভী। প্রয়োজনকেই সার বুঝেছিল।

মাকে আমি বলতে যাচ্ছিলাম, মা—ভালবাসা কোথায় থাকে বলতে পার?

বলতে গিয়েও বলা হল না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন কী দেখলাম। তারপর মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ছেলেমানুষের মতন কাঁদলাম।

পরের দিন আমাদের জন্যে গাড়ি এল। সোজা কলকাতায় আসব।

আসার সময় দেখি গগন বাড়িতে নেই। তার লাল মোটর বাইকটা বারান্দায় দাঁড় করানো আছে। হয়ত সে তুলে রেখেছে।

মা বলল, ”আয়।”

”চলো।”

বিষ্টু আর মালি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

গাড়ি চলতে শুরু করলে আমি আবার একবার বারান্দার দিকে তাকালাম। মোটর বাইকটায় চোখ পড়ল। এখনও তকতকে রয়েছে। গগনের শখের জিনিস। মানুষ যদি শুধু শখের হত—আহারে!

মা বলল, ”গায়ে শাল জড়িয়ে নে। ঠাণ্ডা রয়েছে।”

(১৯৮৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *