সুনিশ্চিত শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ
সুনিশ্চিত শান্তি অর্জনের পথে প্রথম পদক্ষেপটি কোনো শিশুর প্রথম টলমলে পা ফেলার মতোই ছোট ও অনিশ্চিত হতে বাধ্য। এই পরিচ্ছেদে আমি যা-কিছু কাম্য তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না, আলোচনা করতে চাই অদূর ভবিষ্যতে আলাপ-আলোচনার সাহায্যে যা-কিছু অর্জন করা যেতে পারে তাই নিয়ে।
প্রথমেই যা দরকার তা হলো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার বিভিন্ন বিতর্কের ব্যাপারে এক ভিন্ন পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা। বর্তমানে এই বিতর্কগুলো চালানো হয় কোনো অ্যাথলেটিক প্রায়োগিতার মেজাজে। কোনো পক্ষই ঐকমত্যে পৌঁছানো নিয়ে মাথা ঘামায় না, মাথা ঘামায় শুধু পৃথিবীর বাকি অংশের সামনে প্রচারের প্রতিযোগিতার জেতা নিয়ে, নয়তো অপর পক্ষের কাছ থেকে এমন কিছু ছাড় আদায় করা নিয়ে যা ক্ষমতার ভারসাম্যকে তাদের অনুকূলে কিছুটা ঝুঁকিয়ে দিতে পারে। কোনো পক্ষই মনে রাখে না যে মানুষের ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন এবং ঐকমত্যে না পৌঁছানোর চেয়ে যে কোনো ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছতে পারলেও কিছুটা কাজ হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে অস্ত্রপরীক্ষা বন্ধ করার জন্য দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা আলোচনার কথা ভাবুন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় পক্ষই একমত যে নতুন নতুন দেশ পারমাণবিক অস্ত্র পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনাকে যে অনেকটাই ঠেকানো যাবে, সে ব্যাপারেও উভয় পক্ষ একমত। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে উভয় পক্ষই উপলব্ধি করেছে যে শুধু অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধ করলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না, সব পক্ষকে সেই পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য ইচ্ছুকও হতে হবে। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা একটি যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করেছিলেন, কোনো পক্ষ কোথাও অস্ত্র পরীক্ষা করেছে কি না তা যাচাই করে দেখার অধিকার অপর পক্ষের থাকবে এবং এই বিবৃতি দিয়েই সূচনা হয়েছিল আলাপ আলোচনার। অতঃপর আমেরিকান সরকার ঘোষণা করে যে মাটির নিচে কোনো অস্ত্রপরীক্ষা করা হলে সহজেই অন্যের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়। কয়েক বছর আলাপ-আলোচনার পর এই বাধাটি অতিক্রম করা সম্ভব হয়। অতঃপর সোভিয়েত সরকার ঘোষণা করে যে পরিদর্শনের কাজ রাষ্ট্রসংঘের একজন প্রতিনিধির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলে চলবে না, পরিচালিত হবে তিনজনের নেতৃত্বে-একজন প্রাচ্যের, একজন পাশ্চাত্যের, একজন নিরপেক্ষ, এবং তাদেরকে কাজ করতে হবে সর্বসম্মতিক্রমে। আমেরিকা ও রাশিয়া এইসব কৌশলের আশ্রয় নেওয়ায় কয়েক বছরের আলাপ-আলোচনা নিষ্ফল হয়ে গেল এবং রাশিয়া আবার অস্ত্রপরীক্ষা বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো পক্ষেরই ঐকান্তিক আগ্রহ নেই।
যে-সব সমস্যার ফলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, সেগুলো মেটাতে হলে পরস্পরকে বুদ্ধিতে ছাপিয়ে যাওয়া অথবা এই বিপজ্জনক স্থিতাবস্থাকে দীর্ঘায়িত করার মানসিকতা নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসলে চলবে না, আলোচনা করতে হবে ঐকমত্যে পৌঁছনোর দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে। কোনো ঐকমত্যই যে উভয়পক্ষের কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে না, সেটাও মেনে নিতে হবে। আলোচনার লক্ষ্য হবে এমন এক ঐক্যমতে পৌঁছানো যা শক্তিসাম্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাবে না, বরং যুদ্ধের বিপদকে কমিয়ে আনবে।
আলোচনার মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটানোর উপযুক্ত একটিমাত্র চালিকাশক্তির কথাই জানা আছে আমার। এই চালিকাশক্তিটি হলো পারমাণবিক যুদ্ধের আতঙ্ক সম্বন্ধে উভয় পক্ষের সচেতনতা। বর্তমানে উভয় পক্ষই মনে করে, স্নায়ুযুদ্ধে সাফল্য পেতে হলে এমন একটা ভাব দেখাতে হবে যাতে মনে হয় যুদ্ধ বাধলে তাদের জয় অবধারিত। শুধু স্নায়ুযুদ্ধে জেতার জন্যই যে তারা এমন ভাব দেখায় তা নয়, নানারকম মিথ্যা প্রতিশ্রুতির লোভ দেখিয়ে নিজেদের নাগরিকদের মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যও বিভিন্ন দেশের সরকার এই ভাবটা বজায় রাখে। একপক্ষ ঘোষণা করে, উষ্ণযুদ্ধে আমরা জিততে পারি, অপর পক্ষ উত্তর দেয়, আমরা তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেব। এই ধরনের বিবৃতির উতোর চাপান উভয় তরফেরই যুদ্ধোন্মাদনা বাড়িয়ে তোলে। শান্তির দিকে এক কদমও এগোতে হলে উভয় পক্ষকেই বুঝতে হবে যে উভয়ের সামনে একই বিপদ অপেক্ষা করছে এবং তাদের প্রকৃত শত্রু অপর পক্ষ নয়, প্রকৃত শত্রু হলো উভয় পক্ষের ভাণ্ডারে মজুত করে রাখা গণহত্যার অস্ত্রসমূহ।
উভয় তরফই এই সত্যটা উপলব্ধি করলে সমস্যাটা একেবারেই বদলে যাবে। তখন আর অপর পক্ষকে ছাপিয়ে যাওয়া বা নিজেদের জয়লাভের সম্ভাবনায় দেশবাসীকে আস্থাশীল করে তোলার সমস্যার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তখন সমস্যাটা দাঁড়াবে সবার পক্ষে গ্রহণযোগ্য এমন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা যার সাহায্যে প্রমাণ করা যাবে যে আলোচনাকে ফলপ্রসূ করে তোলা অবশেষে সম্ভবপর হয়েছে।
যুদ্ধবাদী ও শান্তিবাদী উভয় তরফেই বেশ কিছু অসার বাগাড়ম্বর চালু আছে। সেগুলোর উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনের ব্যাপারেও সেগুলো কোনো সাহায্য করবে না। মুক্তি অথবা মৃত্যু স্লোগানটির মধ্যে বিধৃত বাগাড়ম্বরপূর্ণ যুদ্ধবাদী প্রচারের বিষয়টি নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। পশ্চিম জার্মানির শান্তিবাদী বন্ধুরা এর পাল্টা এক স্লোগান উদ্ভাবন করেছেন, মৃত্যুর থেকে কমিউনিজমও ভালো। রাশিয়ার কিছু মানুষ পাল্টা স্লোগান দিয়েছেন, মৃতদেহের থেকে পুঁজিপতিরাও ভালো। এই দুটি স্লোগান তত্ত্বগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক, কারণ এর মধ্যে একটি স্লোগান গ্রহণ করবে পশ্চিমী দুনিয়ার সরকারগুলো, অন্যটি গৃহীত হবে পূর্বাঞ্চলের সরকারগুলো দ্বারা। দুটি স্লোগানের কোনোটিই পূর্ব ও পশ্চিম উভয়ের সামনেই সমানভাবে বিদ্যমান সমস্যাকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। যেহেতু কোনো পক্ষেরই সামরিক বিজয় অসম্ভব, সেহেতু এটাও একান্তই স্পষ্ট যে কোনো পক্ষের কাছে অপর পক্ষের সম্পূর্ণ নতিস্বীকারের ভিত্তিতে উত্তেজনার অবসান ঘটানো যাবে না, বরং বর্তমান শক্তিসাম্যকেই টিকিয়ে রাখতে হবে, শুধু আশঙ্কার শক্তিসাম্যকে পরিণত করতে হবে আশার শক্তিসাম্যে। অর্থাৎ পারস্পরিক সহাবস্থানকে মানবজাতির টিকে থাকার অপরিহার্য শর্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং সেই মেনে নেওয়ায় আন্তরিকতা থাকতে হবে, কথার-কথা হিসেবে গ্রহণ করলে চলবে না।
এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং সেই সঙ্গে আরও যতগুলো দেশকে একত্রিত করা যায় তাদের সকলকার একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবেই বলতে হবে যে পারমাণবিক যুদ্ধ পূর্ব, পশ্চিম ও নিরপেক্ষ, সবার পক্ষেই চরম বিপর্যয়কর হয়ে উঠবে এবং পূর্ব, পশ্চিম বা নিরপেক্ষ দেশগুলোর কোনো উদ্দেশ্যই তাতে সিদ্ধ হবে না। আমি আশা করি যথেষ্ট আন্তরিকার সঙ্গেই এ রকম একটি ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে। উভয় পক্ষই জানে এই ঘোষণাপত্রে যা বলা হবে তা অত্যন্ত সত্য, কিন্তু আত্মগরিমা, প্রচার আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির জালে উভয় পক্ষই আটকা পড়ে গেছে এবং এ থেকে নিজেদের মুক্ত করার কোনো উপায় আজ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি তারা। এই অবস্থায় ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করার ব্যাপারে নিরপেক্ষ দেশগুলোকেই উদ্যোগী হতে হবে। তারা উদ্যোগী হলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো পক্ষই সেই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর না করার মতো নিন্দনীয় ব্যাপারের দায়ভার বহন করতে রাজি হবে না।
পরবর্তী পদক্ষেপ হবে একটি সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করা, ধরা যাক দুবছরের জন্য, যে সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষই যাবতীয় প্ররোচনামূলক কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবে। প্ররোচনামূলক কাজকর্ম বলতে ধরা হবে পশ্চিম বার্লিনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কিংবা কিউবায় আমেরিকার হস্তক্ষেপ জাতীয় কাজকর্মকে। কোনো কাজ প্ররোচনামূলক কি না, তা বিচার করার ভার থাকবে রাষ্ট্রসংঘের যথাসম্ভব নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের ওপর।
স্থগিতাদেশ জারি থাকার এই দুবছরের মধ্যে পরবর্তী আলাপ-আলোচনার পথ প্রশস্ত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কোনো পক্ষই অপর পক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র বৈরিতামূলক প্রচার চালাবে না, সেই সঙ্গে উভয় পক্ষের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অনেক বাড়িয়ে তুলে পূর্ব সম্বন্ধে পশ্চিমের এবং পশ্চিম সম্বন্ধে পূর্বের মানুষদের মধ্যে চালু ধারণা দূর করতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে এই সব ধারণা নিছকই বিদ্বেষপ্রসূত। বিনা প্ররোচনায় অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার বিপদ হ্রাস করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে উভয় পক্ষই মনে করে অপর পক্ষ যে কোন মুহূর্তে বিনা প্ররোচনায় তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। এই ধরনের আক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে তার আভাস পাওয়ার উপযোগী প্রভূত বন্দোবস্ত উভয় পক্ষই করে রেখেছে। কিন্তু উভয় পক্ষেরই বন্দোবস্তে যথেষ্ট ভ্রমপ্রবণতা আছে, ফলে অনেক সময় আক্রমণের কোনো ঘটনা না ঘটলেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় আশঙ্কিত হতে পারে তারা। সেই ভুল সঙ্কেতে বিশ্বাস করলে তারা প্রতি-আক্রমণ চালাবেই, কিন্তু অপর পক্ষের কাছে সেটা বিনা প্ররোচনায় অযৌক্তিক হামলা। হিসেবেই প্রতিভাত হবে। এ এক পারস্পরিক দুঃস্বপ্ন, উৎস যার উত্তেজনা, এবং সেই উত্তেজনাই এ-দুঃস্বপ্নকে ভয়ংকরতর করে তুলেছে। উভয় পক্ষের সামনে যতদিন তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ-এর আশঙ্কা ঝুলে থাকবে–যা প্রতিশোধ না হয়ে নিছকই কোনো ভুল সঙ্কেতের প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক আক্রমণও হতে পারে– ততদিন এই উত্তেজনা হ্রাস করা আদৌ সহজ নয়। পরিস্থিতি যথেষ্টই জটিল হয়ে উঠেছে, এ অবস্থায় এ ব্যাপারে কি করা উচিত তা স্থির করা খুবই কঠিন। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ অবশ্য এ সমস্যা সমাধান করতে পারে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই বিপদ অনেকটা কমিয়ে আনা যেত উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলোকে নিশ্চিহ্ন করাটা বেশি বাড়াবাড়ি মনে হলে, উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলোর ব্যবহার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজ আবিষ্কারের পর থেকে উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলোর গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। অনিচ্ছাকৃতভাবে বা আকস্মিকভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার বিপদ হ্রাস করার ব্যাপারটা এক জটিল প্রায়োগিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ব্যবস্থা না করা গেলে এই বিপদ প্রশমনের জন্য কিছু আংশিক ব্যবস্থাই শুধু করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে উভয় পক্ষেরই যদি আন্তরিক আগ্রহ থাকে, তাহলে পূর্ব ও পশ্চিমের দেশগুলো থেকে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত একটি প্রয়োগিক আয়োগকে এই বিপদ হ্রাস করার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে সেই প্রয়োগ ঠিক কোন কোন পদক্ষেপের সুপারিশ করবে তা বলা মুশকিল, আর সেই সঙ্গেই মনে রাখা দরকার, আংশিক ব্যবস্থাগুলো কখনোই নির্ভরযোগ্য নয়। এই বিপদকে যথাযথভাবে প্রতিহত করার একমাত্র উপায় হলো পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ।
এর পাশাপাশি, একদিকে, উভয় পক্ষকেই পরস্পরের অবস্থা সম্বন্ধে আরও ভালোভাবে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠতে হবে, অন্যদিকে, পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে উভয় পক্ষকেই ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।
স্থগিতাদেশ জারি থাকার পর্যায়ে প্রধান কাজ হবে পূর্ব, পশ্চিম ও নিরপেক্ষ দেশগুলো থেকে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গড়ে তোলার ব্যাপারে ঐকমত্য অর্জন করা। যথাযথভাবে কাজ করতে হলে এই ধরনের কমিটির সদস্যসংখ্যা অল্প হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যেমন, পশ্চিমের চারজন, পূর্বের চারজন আর নিরপেক্ষ দেশগুলোর চারজন প্রতিনিধিকে নিয়ে কমিটি গঠিত হতে পারে। এই কমিটির এক্তিয়ারে শুধু পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতাই থাকবে, অন্তত প্রথমদিকে তো বটেই। কোনো বিষয়ে কমিটি সর্বসম্মত ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে কমিটির সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু উভয় পক্ষেরই মতামত তাদের যুক্তসহ সর্বসমক্ষে ঘোষণা করা হবে। কমিটির সিদ্ধান্তগুলো পরিচালিত হবে কয়েকটি বিশেষ নীতির ভিত্তিতে। এর মধ্যে প্রথম ও প্রধান হলো কমিটির প্রস্তাবগুলো যেন কোনো মতেই কোনো পক্ষকে বাড়তি কোনো সুবিধা না দেয়, কেননা সেক্ষেত্রে অন্য পক্ষ তা গ্রহণ করবে না। যেমন, পশ্চিমী বেতার কেন্দ্রগুলো তাদের তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার বন্ধ করলে তবেই রাশিয়া পশ্চিমী বেতারকেন্দ্রগুলোর সম্প্রচারে বাধা দেওয়া থেকে বিরত হতে পারে। দ্বিতীয় নীতিটির কাজ হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক সংঘাতে লিপ্ত অঞ্চলগুলোতে উত্তেজনা প্রশমনের পথ খুঁজে বার করা, যেমন ইজরায়েল ও আরব দুনিয়া অথবা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যেকার সংঘাত। তৃতীয় নীতিটি কাজ করবে প্রথম দুটি নীতি সহায়ক হিসেবে। এই নীতিটি হলো–সম্ভবপর প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি দেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া। এ ব্যাপারে কতদূর সফল হওয়া যাবে তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে, কারণ রাশিয়া তার অনুগামী দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ নীতির প্রয়োগে রাজি হবে না, আবার লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ নীতির প্রয়োগে আমেরিকাও নিঃশর্তে রাজি হবে বলে মনে হয় না। ফরমোজার বাসিন্দাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকে কেউ মনোযোগ দিয়েছেন কি না আমার জানা নেই, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো পক্ষেরই কোনো বিবৃতি চোখে পড়েনি আমার। সারা পৃথিবী জুড়ে বিদ্যমান উত্তেজনা যতদিন না কমছে ততদিন পর্যন্ত সর্বত্রই ক্ষমতার রাজনীতির কাছে হার মানতে হবে আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতিকে, নীতিটি হাজার কাম্য হলেও তার কোনো অন্যথা হবে না। এটা সত্যিই দুঃখজনক, তবে বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে ঐকমত্য অর্জন করতে হলে এটুকু অপরিহার্য বলেই মেনে নিতে হবে।
স্থগিতাদেশ জারি থাকার পর্যায়ে আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজেও হাত দেওয়া দরকার-রাষ্ট্রসংঘের সংস্কার এবং তাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার কাজ। রাষ্ট্রসংঘে যোগদানে ইচ্ছুক প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্যই তার দরজা খোলা রাখতে হবে। এই মুহূর্তে এ ব্যাপারে চীনের বিষয়টাই সব থেকে জরুরি, কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির কথাও বাদ দেওয়া যাবে না। তবে জার্মানির সমস্যাটা খুবই জটিল। এ বিষয়ে পরবর্তী একটি পরিচ্ছেদে আলোচনা করব আমি।
রাষ্ট্রসংঘের বেশ কিছু ত্রুটি আছে। কিছু কিছু দেশকে নিজের অন্তর্ভুক্ত না করার ব্যাপারটা তো আছেই, সেই সঙ্গেই কয়েকটি দেশের হাতে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা থাকলে রাষ্ট্রসংঘের পক্ষে কিছুতেই বিশ্বসরকার গঠনের লক্ষ্যে এগোনো সম্ভব হবে না, আবার বিভিন্ন দেশের হাতে এখনকার মতোই অস্ত্রশস্ত্র থেকে গেলে ভেটো প্রয়োগের অধিকার বাতিল করাও কঠিন। জার্মানি সমস্যার মতোই এই বিষয়টিতেও কোনো সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছতে হলে প্রথমে নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।
রাষ্ট্রসংঘের কিছু ত্রুটি আছে বলে সমন্বয় সংক্রান্ত যে কোনো কাজের সূত্রপাত ঘটানোর জন্য সেই উদ্দেশ্যে গঠিত কোনো সমন্বয় কমিটি রাষ্ট্রসংঘের থেকে ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। শুধুমাত্র পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী এই ধরনের একটি সংস্থা যদি দক্ষতার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যায় তাহলে এক সময় পর্যাপ্ত নৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারবে, ফলে তার কোনো প্রস্তাব বাতিল করা কারুর পক্ষেই সহজ হবে না এবং সে এমন এক প্রভাবের অধিকারী হয়ে উঠবে যা বিশ্বসরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করতে পারবে। এই ধরনের সংস্থার একটা বড় সুবিধা হলো–এতে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব নিতে পারবে নিরপেক্ষ দেশগুলো, কোনো বিষয়ে কোনো পক্ষের প্রস্তাব অপর পক্ষের থেকে বেশি যুক্তিসম্মত মনে হলে সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়ে প্রস্তাবটি অনুমোদন করিয়ে নিতে পারবে তারা। আশা করা যায়, নিরপেক্ষ দেশগুলো কখনও এ পক্ষের প্রস্তাব সায় দেবে, কখনও ও-পক্ষের। তাছাড়া কখনও যদি দুটি পক্ষের মধ্যে কোনো এক পক্ষ নিরপেক্ষ দেশগুলোর বিরোধিতার সম্মুখীন হয় যে বিরোধিতার সামনে উভয় পক্ষকেই কখনও না কখনও পড়তে হবেই তাহলে দুই তরফের মধ্যে সালিশি করার ব্যাপারেও ওই সংস্থার নিরপেক্ষ প্রতিনিধিরা সহায়ক ভূমিকা নিতে পারবেন। কোনো বিষয়ে আলোচনায় পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যেকার তিক্ততা কমানোর জন্যও আবেদন জানানো যাবে নিরপেক্ষ দেশগুলোর কাছে এবং কোনো বিশেষ দৃষ্টিকোণে আবদ্ধ থাকার বদলে ধীরে ধীরে এক বিশ্বজনীন দৃষ্টিকোণে গড়ে তোলা সম্ভবপর হবে। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যেকার কোনো সমস্যা অচলাবস্থায় পৌঁছে গেলে উভয় পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র নির্ণয়ের ব্যাপারেও বেশ বড় ভূমিকাই নিতে পারবে নিরপেক্ষ দেশগুলো। বিশ্বব্যাপী সুস্থিরতা গড়ে তোলার ব্যাপারে এইসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিরপেক্ষ দেশগুলোর দ্বারা সাধিত হতে পারে। আমার মতে, শান্তি সুরক্ষিত করার কাজে নিরপেক্ষ দেশগুলোকেই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে, আর সেই ধারণা থেকেই আমি মনে করি ব্রিটেন ন্যাটো জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি নিরপেক্ষ শিবিরের সাহায্যে সুস্থিতি আনার কাজে ব্যাপৃত হলেই সবচেয়ে ভালো হয়। জাতীয় অহমিকা থেকে ব্রিটেনের অধিকাংশ বাসিন্দাই মনে করে এ ধরনের কাজ পশ্চিমী দুনিয়াকে দুর্বল করে দেবে, তবে কর্তৃত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কট্টরপন্থী আমেরিকান বিশেষজ্ঞরা কিন্তু তা মনে করেন, না। তাছাড়া ব্রিটেন নিরপেক্ষ থাকলে যুদ্ধের পর ব্রিটেনের কিছু মানুষ বেঁচে গেলেও যেতে পারে। তবে ব্রিটেনের নিরপেক্ষতার পক্ষে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হলো–নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বিশ্বশান্তির ব্যাপারে ব্রিটেন যে ভূমিকা। পালন করতে পারবে, কোনো একটি শিবিরের অংশীদার হয়ে গেলে সে ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না তার পক্ষে।
এই অধ্যায়ে নিরস্ত্রীকরণ বা আঞ্চলিক সমস্যার বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আলোচনা করিনি আমি, আলোচনা করেছি পূর্ব ও পশ্চিমের বৈরিতা হ্রাস করার কয়েকটি প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়ে। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে নিরস্ত্রীকরণ ও আঞ্চলিক সমস্যা নিয়েই আলোচনা করার চেষ্টা করব আমি।