সুনন্দর জার্নাল
প্রথমে একটা ভুতের গল্প উদ্ধৃত করছি। সুনন্দর জার্নালের পরলোকগত যশস্বী লেখক এই গল্পের সূচনায় কবুল করেছেন, ‘গল্পটি আপনারা সকলেই জানেন।…ভালো গল্প দু-বার শুনলেও ক্লান্তি আসে না। সুতরাং পুনরাবৃত্তি অমার্জনীয় হবে না ভরসা করছি।’
আমি নিজেও পুনরাবৃত্তি-এক্সপার্ট, কিন্তু আমার ভণিতা কখনও এত উচ্চমানের হয় না। তবে ভূতের গল্পের ক্ষেত্রে আমি হয়তো বলতাম, সব ভূতের গল্পই পুরনো, সুতরাং আমার কোনও দোষ নেই।
সে যা হোক, আগে গল্পটা হোক।
অতি সংক্ষিপ্ত এক ভৌতিক কাহিনী—
অন্ধকার রাত্রি। কোনও দ্রুতগামী এক্সপ্রেস ট্রেন। তারই একটি কামরায় মুখোমুখি দু’জন যাত্রী। একজন নিবিষ্ট চিত্তে একটি পত্রিকা পড়ছেন, অপর জন নীরবে বসে আছেন।
যিনি পত্রিকা পাঠ করছিলেন, তিনি বিরক্ত হয়ে চোখ তুললেন। সহযাত্রীদের উদ্দেশ করে বললেন, এতে একটা হানাবাড়ির বিবরণ আছে। স্রেফ গাঁজা। ভূত-টুত আমি বিশ্বাস করি না।
দ্বিতীয় যাত্রী বললেন, ওঃ, করেন না নাকি? আর বলেই তিনি তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
শুধু এইটুকুই গল্প অতঃপর প্রথম যাত্রীটির কী হয়েছিল গল্পে তা বলা নেই। সুনন্দর জার্নালের মতে, ‘বলবার প্রয়োজন নেই।’
অনাবশ্যক মেদ বর্জিত, ছিপছিপে চাবুকের মতো ঝকমকে ছুরির মতো নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনবদ্য রচনা সুনন্দর জার্নাল।
১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ দীর্ঘ আট বছর ধরে এই জার্নাল ‘দেশ’ পত্রিকায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
লিখন কুশলতা এবং বিষয়বস্তুর সর্বজননীতায় অসামান্য জনপ্রিয় হয়েছিল সুনন্দর জার্নাল। ঠিক হালকা হাসির ব্যাপার ছিল না। কিন্তু সরসতার কোনও অভাব ছিল না এই চলমান রচনায়।
মাত্র কয়েকটি নিবন্ধের নাম উল্লেখ করছি এই জার্নালের বিষয়-বৈচিত্র্য বোঝানোর জন্যে। পরপর পাঁচটি রচনার নাম হল, ‘হরে মুরারে’, ‘আমার রাশিফল’, ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘পাণ্ডুর বই’ এবং ‘জয় ঘটোৎকচ নাইট’। এগুলি প্রকাশিত হয়েছে পরপর পাঁচ সপ্তাহে ১৯৬৯ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে। পরপর এই রকম সব রকমারি বিষয়। ভাবা যায়।
মনে আছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাঙালি পাঠক উন্মুখ হয়ে থাকতেন সুনন্দর জার্নালের জন্যে। এমন অনেক পাঠককে জানতাম যিনি সপ্তাহান্তে ‘দেশ’ পত্রিকা হাতে পেয়ে প্রথমেই সুনন্দর জার্নালের পৃষ্ঠাটি খুলতেন।
পড়তে সবসুদ্ধ দশ-পনেরো মিনিটের বেশি লাগত না। আটশো-নয়শো শব্দের মধ্যে সীমিত ঝরঝরে ভাষায় বুদ্ধিদীপ্ত রচনা ও বিষয়বস্তু সংগৃহীত হয়েছে দৈনন্দিন জীবন থেকে, খবরের কাগজের সংবাদ থেকে।
কিন্তু শুধু সংবাদভাষ্য নয়। সরস আলোচনা, তীক্ষ্ণ মন্তব্যে সুনন্দর জার্নাল ছিল একটি প্রাঞ্জল ধারাবাহিক, পৌনঃপুনিকতার একঘেয়েমি এই জার্নালকে স্পর্শ করেনি।
এই জার্নাল লিখতে লিখতেই উনিশশো সত্তর সালে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর আগে ও পরে একাধিকবার সুনন্দর জার্নাল বই হয়ে বেরিয়েছে। যে কারণেই হোক সেসব বই পাঠকের কাছে পৌঁছয়নি, সেই বইগুলির প্রকাশ ছিল একটু দায়সারা গোছের।
অনেকদিন পরে এ বছর বইমেলায় ‘সুনন্দর জার্নাল’ মিত্র ও ঘোষ থেকে প্রকাশিত হয়ে রাতারাতি বেস্টসেলার হয়ে গেছে। আমি দেখেছি লোকে লাইন দিয়ে ‘সুনন্দর জার্নাল’ কিনছে। আসলে এখন পর্যন্ত পাঠক এই ধরনের রচনা পছন্দ করে, ব্যাপারটা আমি হাড়ে হাড়ে জানি।
অবশেষে ছোটমুখে একটা বড় কথা।
গঙ্গারাম আমার টেবিলে ‘সুনন্দর জার্নাল’ দেখে বললেন, ‘সুনন্দের জার্নাল নয় কেন?’ আমি বললাম, ‘নারায়ণবাবু শুধু জনপ্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন না, কৃতবিদ্য অধ্যাপক ছিলেন, তাও বাংলা সাহিত্যের। তিনি কি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ভুল লিখে গেছেন, কেউ কিছু বলেনি।’ গঙ্গারাম বললেন, ‘তা বলতে পারি না, কিন্তু ভেবে দেখুন রামের বনবাস, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা। সর্বত্র একাকার, এমনকী রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।’
আমি চুপ করে রইলাম। বাংলা বানান-ব্যাকরণের নিয়মকানুন সত্যিই ভাল জানি না।