সুধীরকুমার মিত্রের স্থাপত্য ভাবনা – মণিদীপ চট্টোপাধ্যায়
যুগে যুগে মানুষের সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে তার স্থাপত্য চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে সেই সময়ের বিভিন্ন প্রকার গৃহের নির্মাণশৈলীর মধ্যে দিয়ে। সামাজিক মূল্যায়ণে দেবতাদের প্রার্থনা গৃহই প্রাধান্য পেয়েছে সর্বকালের স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসাবে। সেইজন্যই, গ্রিক স্থাপত্য যাকে আবার Classical Architecture বলা হয়, যা পশ্চিমে স্থাপত্যরীতির গোড়াপত্তন ঘটায়, তারও সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে এথেন্স শহরে পাহাড় চূড়ায় ‘পার্থেনন’-এর মন্দির সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে যার অধিষ্ঠাত্রীদেবী ছিলেন এথেনা আর যা তৈরি হয়েছিল ৪৪৭ খ্রিস্টপূর্বে। আবার ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই পার্থেননই রূপান্তরিত হয়েছিল ভার্জিন মেরির গির্জায় এবং পরবর্তীকালে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রভাবে মসজিদ পর্যন্ত পর্যবসিত হয়েছিল। তাহলেই দেখা যাচ্ছে সর্বকালে মন্দির-গির্জা-মসজিদ অর্থাৎ দেবতাদের আলয় স্থাপত্যের মহিমা প্রচারে অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছে।
আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার অন্যতম পথিকৃত সুধীরকুমার মিত্র তার সাবলীল লেখন শৈলীর মাধ্যমে, হুগলি জেলার প্রেক্ষাপটে, সেই দেবতাদের আলয় সৃষ্টিতে যে স্থাপত্যকলার নান্দনিক রূপটি, যা কিনা কালের অবহেলায় অনেকাংশে অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। তাকে গভীর অধ্যবসায়ে আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন এক অপূর্ব সুন্দর নামে, হুগলী জেলার দেবদেউল, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে, এবং আনন্দের কথা, লেখকের জীবদ্দশাতেই পরবর্তী পরিবর্ধিত সংস্করণ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তবে পরিতাপের বিষয় যে, প্রথম প্রকাশের পরেই ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে বইটি রবীন্দ্র পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রচর্চার অন্যতম পুরোধা মান্যবর প্রমথনাথ বিশী মহাশয়ের সুপারিশের পরেও পুরস্কার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে লেখক বাংলা ভাষায় কারিগরি কুশলতায় স্থাপত্য চিন্তনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন যার অন্যতম পথিকৃৎ হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে তার দেবায়তন ও ভারত সভ্যতা গ্রন্থের জন্য যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। সেই ধারাবাহিকতার কথা স্বীকার করে সুধীরকুমার মিত্র লিখেছেন :
হুগলী তথা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বঙ্গ-সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং ভারত সংস্কৃতির সঙ্গে তার সংযোজন অনস্বীকার্য। মহৎ স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে ভারতীয় সংস্কৃতি ভান্ডার এক সময় পূর্ণ ছিল… (প্রথম সংস্করণের লেখকের ‘নিবেদন’ দ্রষ্টব্য)।
বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতির স্মরণে ও সংরক্ষণে লেখকের গভীর মমতা বার বার তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে। তার কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি যে, সরকারি অবহেলা থেকে বাংলার প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনকে সংরক্ষণ প্রয়াসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের (কার্যকাল ১৯৩৪-১৯৩৮) প্রচেষ্টায় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে আশুতোষ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর উদ্যোগে বাংলায় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের সূত্রপাত হয়। তারই পরিণামে, ‘‘তমলুক, পান্না, বেড়াচাঁপা, রাজার ঢিপি ও হরিনারায়ণপুর থেকে যেসব প্রাচীন কীর্তিসম্ভার আবিষ্কার করেছেন তা থেকে গঙ্গার অববাহিকা পথে সুদূর অতীতকাল থেকে যে নগর সভ্যতা ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে।’’ প্রকৃতপক্ষে, বাংলার সেই প্রাচীন নগর সভ্যতার নামকরণ হয়েছে ‘গঙ্গারিডি’ নামে, যার বিষয়ে এখনও অনেক কিছু অনুসন্ধানের অপেক্ষায় রয়েছে।
দেশে দেশে স্থাপত্যের প্রকাশ ঘটেছে সেই দেশের সামাজিক মূল্যবোধ, গৃহ নির্মাণের প্রচলিত পদ্ধতি, নির্মাণ উপকরণ ও শৈলীর সার্থক সমন্বয়ের মাধ্যমে। তাই পাহাড়ময় গ্রিসের ‘পার্থেনন’ মন্দির তৈরি হয়েছিল বিরাট-বিরাট পাথরের স্তম্ভ ও খিলান সহযোগে আর স্থাপত্যে ‘ডোরিক’ রীতির এক অপূর্ব সুন্দর বলিষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। তখনকার কালে গৃহ নির্মাণের প্রচলিত পদ্ধতিতে ছাদের কাঠের কড়িবরগা ব্যবহারে অনুপ্রাণিত হয়ে, পাথরের বুকে সেই প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে পার্থেননের শিখর দেশে। সেই একই কারণে, অজন্তা ইলোরা, যার বুকে খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ বৌদ্ধ ধর্মের কাহিনি রচিত হয়েছে। গুহা মন্দির স্থাপত্যের প্রবেশ তোরণে কাঠের গঠনশৈলীর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
বাংলার দেবদেউল রচনায়ও প্রচলিত নির্মাণ পদ্ধতির সেই একই প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, লেখকের ভাষায় :
কুঁড়ে ঘরের বাঁশ ও খড়ের চালের প্রতিকৃতির অনুকরণে ইটের দ্বারা নির্মিত মন্দিরকে চালা মন্দির বা বাঙলা মন্দির বলে। ঢালু ক্রমহ্রস্বমান সামনে পিছনের দুটি ঢালের উপর সুন্দর চূড়াবিশিষ্ট এই মন্দির-প্রতিকৃতি বাঙলাদেশের প্রাচীনতম দেবগৃহে ‘চন্ডীমন্ডপ’ থেকে উদ্ভূত। এই ধরনের দোচালা মন্দিরকে বলা হয় একবাঙলা। দুটি দো-চালাকে পাশাপাশি জুড়ে দিয়ে নির্মাণ করা হতো জোড়বাঙলা মন্দির।
জোড়বাঙলা মন্দির ভারতীয় স্থাপত্যের ইতিহাসে বাঙলার একটি বিশিষ্ট দান। বাঙলাদেশে চালা স্থাপত্য শৈলী মন্দিরের এটি একটি পরিবর্ধিত রূপ। দুটি বাঙলা দো-চালা ঘরের সমন্বয়ে গঠিত জোড়বাঙলার নিদর্শন হচ্ছে হারিটে বিশালাক্ষী মন্দির, গুপ্তিপাড়ায় শ্রীচৈতন্যদেবের মন্দির এবং দশঘরায় শিবের মন্দির। বিষ্ণুপুর ছাড়া এই জোড়বাঙলার প্রাচীনতম নিদর্শন বাঙলাদেশে আর বোধ হয় নেই। দো-চালা মন্দিরের উন্নততর রূপ হচ্ছে জোড়বাঙলা। (পৃ. ৫)
মন্দির নির্মাণ উপকরণেও স্থানীয় প্রভাব অনস্বীকার্য এবং বাংলার মন্দির-স্থাপত্য প্রসঙ্গে লেখকের মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ :
নদনদীবহুল বাঙলাদেশের নরম পলিমাটি বাঙলার শিল্পকলার অন্যতম উপকরণ হিসাবে সুদূর অতীতকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাঙলাদেশে পাথর দুর্লভ বলে এখানকার স্থাপত্যকীর্তি সমস্ত ইটের দ্বারাই নির্মিত হতো; কিন্তু প্রচুর বৃষ্টিপাত, বন্যা ও নদনদীর তটক্ষয়ে ইটের স্থাপত্যকীর্তি খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। তারপর মুসলমান আমলে হিন্দুমন্দির ধ্বংস ও দেবদেবীর মূর্তি নষ্ট করা তাদের অভিযানের অন্যতম অঙ্গ ছিল বলে হিন্দুযুগের সমস্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন বাঙলাদেশ থেকে লুপ্ত হয়ে যায়।
সামাজিক মূল্যবোধের নিরিখে, ‘‘ভারতের মন্দির-স্থাপত্যে ও ভাস্কর্যে ভারতের ধর্ম, ভারতের দর্শন, ভারতের আধ্যাত্মিকতা মুখ্য স্থান অধিকার করে আছে। মন্দিরের প্রতি অঙ্গে প্রতিটি যুগের আধ্যাত্মিকতার সুষ্ঠ বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়।’’ (পৃ. ৪) বাংলার মন্দিরেও সেই প্রতিফলন দেখা যায় আর সেই সাথে পোড়ামাটির অলংকরণ বৈচিত্র্য, যা কিনা মন্দির স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে ভাস্কর্যের অপূর্ব সুন্দর প্রকাশ ঘটায়। হুগলি জেলার মন্দির গাত্রেও সেই রকম মৃৎফলক বা টেরাকোটা শিল্প বহুমাত্রায় ছড়িয়ে আছে।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলার মন্দির-স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট হল টেরাকোটা শিল্পসম্ভার, যার বিশ্বজুড়ে খ্যাতি। টেরাকোটার ওপর বিদেশের অনেক বিখ্যাত বই আছে। আর-এক বাংলার মন্দিরের নিষ্ঠাবান সাধক ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড ম্যাককাচ্চন সাহেব যার ১৯৬১ সালে আদম সুমারির রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি সুধীরকুমার মিত্র মহাশয়। (পৃ. ৬) পরিতাপের বিষয় হল যে ডেভিড সাহেব বাংলার মন্দিরের ওপর বিস্তৃত ও বিপুল গবেষণার কাজ অসমাপ্ত রেখে অপরিণত বয়সে প্রয়াত হন। বস্তুত সেই গবেষণালব্ধ কাজের অনেকাংশ পরবর্তীকালে মিচেল সাহেব তার বিখ্যাত বাংলার মন্দির-স্থাপত্য বইতে প্রকাশ করেন।
সুধীরকুমার মিত্রের স্থাপত্য গবেষণা ও ভাবনা, যার প্রথম প্রকাশ হুগলী জেলার দেবদেউল (প্রথম প্রকাশ, ১৯৭১)। আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত হয় দক্ষিণের দেবস্থান (প্রথম প্রকাশ, ১৯৮৫) যার মূল প্রেরণা ছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ষোড়শ শতকে দাক্ষিণাত্যের দেবধাম পরিক্রমার পথ অনুসরণ করা। এই প্রকাশনায় তাঁর স্থাপত্য ভাবনা আরও পরিণত হয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে ভারতের ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির গভীরতায়।
দক্ষিণের দেবস্থান-এর উপক্রমণিকায় লেখক যথার্থই বর্ণনা করেছেন :
দক্ষিণ ভারতের গগনচুম্বী মন্দিরগুলি কেবল হিন্দুদের ধর্মপ্রাণতা নয়, এইসব সুপ্রাচীন সুন্দরতম মহিমাময় দেবস্থান সে কালের হিন্দুদের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের স্মৃতিচিহ্নরূপে আজও বিশ্বজিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তারপর, দাক্ষিণাত্যের বিস্তৃত তীর্থধাম, কন্যাকুমারী, কাঞ্চীপুর, গুরুবায়ু, চিদম্বরম, ত্রিবান্দ্রাম থেকে তিরুপতি এবং অবশেষে পুরীর স্থান মাহাত্ম্যর সঙ্গে বিশেষ মন্দির-স্থাপত্যের বিশদ আলোচনা করেছেন কারিগরী কুশলতায়।
পরিশেষে সুধীরকুমার মিত্রকে তার স্থাপত্য চিন্তন ও বিশ্লেষণের জন্য অসংখ্য সাধুবাদ জানাতে হয় আর স্বীকার করতে হয় যে, বাংলায় স্থাপত্য ভাবনাতেও তিনি এক অগ্রপথিক এবং তার সেই অবদান তার জন্মশতবর্ষের আলোতে আরও বেশি উজ্জ্বল ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর স্থাপত্য ভাবনার বিস্তার ও বিশ্লেষণ আমাদের মুগ্ধ করে এবং তাঁকে সার্থক গবেষকের নিষ্ঠা ও মহিমায় সমুজ্জ্বল করে রাখে আগামী প্রজন্মের কাছে।
আলোচিত গ্রন্থ
হুগলী জেলার দেবদেউল।
দক্ষিণের দেবস্থান।