সুধীরকুমার মিত্রের গিরিশচন্দ্র মুগ্ধতা – অরুণ মুখোপাধ্যায়
বলা যেতে পারে, বইটির জন্ম আকস্মিকভাবেই। সুধীরকুমার মিত্র প্রয়াত হয়েছেন ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি। তারপর কেটে গেছে ষোলোটি বছর। এসেছে সুধীরকুমার মিত্রের জন্মশতবর্ষ (জন্ম ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি) ২০০৮-২০০৯। বাড়িতে ড্রয়ার খুলে দেখা গেল এক অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি। বিষয় উনিশ শতকের বিশিষ্ট নাট্যকার অভিনেতা গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
অবাক হবারই কথা। যিনি হুগলি জেলার ইতিহাসের মতো আকরগ্রন্থ লিখেছেন, হুগলি জেলার দেবদেউলের মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন, তাঁর কলমে রচিত হয়েছে গিরিশ পরিচয়! জেজুরের ইতিহাস, তারকেশ্বরের ইতিহাস তাঁকে আঞ্চলিক ইতিহাস রচয়িতা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিল। মৃত্যুঞ্জয়ী কানাইলাল দত্ত, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু, প্রফুল্ল চাকী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে শ্রদ্ধামাখানো দৃষ্টিতে গ্রন্থ নির্মাণ করেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলন তাঁকে খুবই প্রভাবিত করেছিল, বিশেষত, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবন। তাই জীবনীমূলক রচনায় হাত দিয়েছিলেন। বাপুজি মহাত্মা গান্ধী ও যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্রে রেখেও বই লিখেছেন। বরণীয় বাঙালি বইটি পড়লে তাঁর বিপ্লবী প্রীতির কথা জানা যায়।
তীর্থ সপ্তক বা দক্ষিণের দেবস্থান একদিকে তীর্থ, ভ্রমণ ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর আগ্রহকেই তুলে ধরে। শ্রীচৈতন্য কড়চা তাঁর অনুসন্ধিৎসু মননের ফল। পত্রপত্রিকার আলোকে নজরুল-নজরুল গবেষণায় নতুন দিগন্ত এনে দেবে।
কিন্তু আকস্মিকভাবে আবিষ্কৃত ১০০ পাতার পান্ডুলিপিটি। যা তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পরে ড্রয়ার থেকে বেরিয়ে এল তাঁরই জন্মশতবর্ষে। বিস্মিত হবারই কথা। এই বই গিরিশচন্দ্রচর্চার জন্য অপরিহার্য। শুধু তাই নয়। অবাক কান্ড যে, সুধীরকুমার মিত্র গিরিশচন্দ্রের অনুরাগী ছিলেন তা নতুন করে জানা গেল। অথবা বলা যেতে পারে গিরিশচন্দ্র পুনরাবিষ্কৃত হলেন।
সুধীরকুমার মিত্র রচিত গিরিশ পরিচয় পাঠকের দরবারে হাজির হয়েছে জানুয়ারি ২০০৯-এ। বইটি সম্পাদনা করেছেন ড. সুনীল দাশ।
সুধীরকুমার মিত্র তাঁর জীবদ্দশায় এই বই দেখে যাননি। কিন্তু পান্ডুলিপি লিখে গেছেন। তাঁর লেখায় পাই, ‘‘গিরিশচন্দ্র নাট্যসাহিত্যের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালাদেশে ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতিতে যে অপূর্ব চিন্তাধারা দিয়া গিয়াছেন—তাঁহার প্রতিভা উৎসের ভাব-প্রবাহিণী হইতে বাঙ্গালি যে নূতন জীবনরস প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাই ভারতের শাশ্বত মর্মবাণী।’’
লেখকের মনে হয়েছে, গিরিশচন্দ্র যোগ্য সমাদর পাননি। দেশের লোক তাঁকে চিনতে পারেনি। গিরিশচন্দ্রের কবিতায় নাটকে গানে উপন্যাসে জাতীয়তার প্রাণ, দেশের স্বরূপ মূর্তির ছবি পেয়েছেন সুধীরবাবু। তিনি লিখছেন, ‘‘তাঁহার কবিতা নাটক যাচাই করিতে ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড, জার্মানীতে যাইতে হইবে না। তাঁহার রচনায় বিজাতীয়তা নাই—বিলাতি ভাব নাই; ভাব ধার করিতে তাঁহাকে বিদেশে যাইতে হয় নাই।’’
চমৎকার ব্যাখ্যা। চমৎকার বিশ্লেষণ। অথচ অত্যন্ত সহজ সরল ভাষা। বুঝতে অসুবিধা হয় না। তিনি লিখছেন, ‘‘গিরিশচন্দ্র খাঁটি দেশীয় কবি। তিনি দেশীভাবে খাঁটি বাঙালির মত দেশমাতৃকার সেবা করিয়াছেন। দেশের প্রাণের কথা ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। এই জন্যই তিনি মহাকবি। সমগ্র দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।’’
গিরিশচন্দ্র ঘোষ সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, ‘‘জ্ঞান, ভক্তি ও ধর্ম—সনাতন ধর্মের এই ত্রি-ধারা তাঁহার রচনায় অনাবিল রসস্রোত ও পবিত্র প্রেমের সঞ্চার করে। রঙ্গমঞ্চকে তিনি শিক্ষালয় ও ধর্মমন্দিরে রূপান্তরিত করিয়াছিলেন।’’ এই স্বীকৃতি গিরিশের অবশ্য প্রাপ্য ছিল।
পাপীতাপী, লাঞ্ছিত, পতিত যদি হরিনাম কীর্তন করে তাহলে তারা সার্থক জীবনলাভ করবে—এই ছিল ভক্তভৈরব গিরিশের নাট্যবৈশিষ্ট্য। আর এই কথাই তিনি তাঁর নাটকে ও অভিনয়ে প্রচার করে গেছেন। গিরিশচন্দ্রের ধর্মসাধনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁকে সিদ্ধযোগীমহাপুরুষ বলে মনে হয়েছে সুধীরকুমার মিত্রের।
জয় রামকৃষ্ণ ছোটো লেখা। গিরিশচন্দ্রের জন্মে লেখার সূচনা, গিরিশচন্দ্রের পিতা নীলকমল ঘোষের প্রয়াণে গদ্যের সমাপ্তি। বন্ধুদের সঙ্গে যাত্রা দেখতে গিয়ে গিরিশচন্দ্র সারারাত না ফিরে ভোরে বাড়ি ফিরলেন। বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। গিরিশচন্দ্র সত্য কথা বললেন, বেদম মার খেলেন। বন্ধুরা তাঁকে বলল, মিথ্যে কথা বললে মার খেতে হত না। গিরিশচন্দ্র বন্ধুদের কথা শুনে বললেন, পিতাকে মিথ্যা কথা বলে রক্ষা পাওয়া গেলেও পিতার উপরে থেকে যিনি সমস্ত প্রত্যক্ষ করছেন তার কাছ থেকে কীরূপে রক্ষা পাওয়া যাবে। ‘‘বরং সত্য কথা বলিয়া পাপের সাজা লইলে ভবিষ্যতের বোঝা অনেক কমিয়া যায়।’’
পিতার সঙ্গে গঙ্গায় নৌকাভ্রমণ করতে গিয়ে গিরিশ বুঝেছিলেন, যে, ‘‘বিপদে ডুবিবার সময় হাত ধরিবার কেহই নাই।’’ এই শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে।
আমার মনে হয়েছে জয় রামকৃষ্ণ প্রকৃতপক্ষে এক পূর্ণাঙ্গ গিরিশজীবনী লেখার প্রয়াস। যা অসম্পূর্ণ হয়েই রইল।
গিরিশচন্দ্রের রচনার টুকরো অংশ উদ্ধৃত করে সুধীরকুমার মিত্রমশাই গিরিশের ভাবনার চুম্বকটুকু তুলে ধরতে চেয়েছেন। যেমন ‘‘বিজাতীয় আদর্শে সকলেই প্রায় বিজাতীয় ভাবাপন্ন; হিন্দুর হিন্দু পরিচ্ছদ নাই—হিন্দুর হিন্দুভাবে সদালাপ নাই।’’ (ছত্রপতি) কিংবা ‘‘একমাত্র রিলিজিয়াস ইউনিটি (সর্বধর্ম সমন্বয়) ব্যতীত অন্য কোনো প্রকারে আমাদের একতা বা মিলন সম্ভবপর নহে।’’ (মায়াবসান) অথবা ‘‘বাংলায় পক্ষাপক্ষ নাই—একটা গোলযোগ চাই। নিজের স্বার্থসিদ্ধি করা চাই, বাঙ্গলায় কেউ কারো মুখ চায় না।’’ (মিরকাশিম) এমন স্পষ্ট জড়তাহীন বক্তব্য গিরিশচন্দ্র রেখে গেছেন তাঁর নাট্য সাহিত্যের পাতায়। আর সুধীরকুমার সেই প্রস্ফুটিত পুষ্পসম্ভার থেকে চয়ন করেছেন সমাজ, সংসার, জীবন, দর্শন সংক্রান্ত বক্তব্যগুলি। ‘ঠিক’ খুঁজে বের করাও একটা কঠিন কাজ।
আরও কিছু বাণী উদ্ধৃত করা যাক।
১. ‘‘ধন, মান, জীবন, যৌবন—সমস্ত অর্পণ করলে তবে প্রেম লাভ হয়।’’ (বিষাদ)
২. ‘‘বোঝ কামে প্রেমে কী তফাৎ—কাম স্বার্থপর মনকে কুঁকড়ে দেয়; প্রেম জগদবাণী—প্রাণ মন জগদ্ব্যাপী হয়।’’ (নসীরাম)
৩. ‘‘সংসারে সুখ বিশ্বাস-দুঃখ সন্দেহ। যার বিশ্বাসী হৃদয়, সে ফকির হোক—আর সংসারী হোক—দুঃখের তরঙ্গ একরকম কাটিয়ে যায়। … সংসারে সুখ-দুঃখ উভয়ই আছে; হেথা দুঃখের ভয় পাওয়া হীনতার পরিচয়।’’ (মনের মতন)
৪. ‘‘বাংলার কৃতঘ্নতা দূর করো। বাঙ্গলার সেবায় নিযুক্ত হও। প্রেমে সকলকে বশীভূত করো।’’ (সৎনাম)
৫. ‘‘ভারতকে উৎসাহ প্রদান আমাদের কাজ।’’ (সৎনাম)
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের হাতে পড়ে মাতাল নাট্যকার গিরিশ হীরক খন্ডের মতো দ্যুতিময় হয়ে উঠেছিলেন। উপরোক্ত গদ্যাংশ সে-কথাই প্রমাণ করে। বঙ্গদেশ ও ভারতবর্ষ প্রীতি যে উনিশ শতকের মহামানবের ভাবনায় ছিল তাও জানা যায় এইসব লেখায়। সুধীরকুমার প্রয়োজনীয় অংশটুকু চয়ন করেও এক মহাকর্তব্য সম্পাদন করেছেন।
বর্ণনা অধ্যায়ে গিরিশের রচনার অংশ সংকলিত হয়েছে। যা কবিতার চিত্রকল্পের মতো। গিরিশ রচনাশৈলীর দৃষ্টান্ত বোঝাতেই সুধীরবাবুর এহেন বর্ণনাত্মক বর্ণনার আশ্রয় নেওয়া।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের জীবন, কর্ম ও সমকালীন ঘটনাবলি এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ সময়কালকে সুধীরকুমার এই বই-এ ধরে রেখেছেন। এই কালপঞ্জিতে নজর রাখলে আমরা ‘সেই সময়’ স্বচ্ছভাবে দেখতে পাব।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গিরিশ রচনাবলির তালিকা অসাধারণ কাজ। ভাবতে অবাক লাগছে সুধীরবাবু পঞ্চাশের দশকে ‘লাইব্রেরি ওয়ার্ক’ করে কী অসাধ্য সাধনই না করেছেন! গল্প, ধর্ম প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাট্য প্রবন্ধ, সামাজিক প্রবন্ধ, শোক প্রবন্ধ, বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিবিধ প্রবন্ধ শিরোনামে গিরিশচন্দ্রের লেখার তালিকা মুদ্রিত হয়েছে।
যিনি হুগলি জেলার পথে প্রান্তরে ঘুরে জেলার ইতিহাস, জেলার দেবদেউলের ক্ষেত্র সমীক্ষা করেন, তিনিই আবার কী অনায়াসে পাঠাগারমনস্ক হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গিরিশ সাহিত্যের সম্পদ খুঁজে বেড়ান। তাঁর অধ্যবসায়ের এক দিক উন্মোচিত হল এই তালিকায়। সুধীরকুমার মিত্র তাই আমাদের কাছে এক আদর্শ শিক্ষক।
মহাকবি গিরিশচন্দ্র নামে ছোটো এক লেখায় সুধীরকুমার বলেছেন, ‘‘বাংলার রঙ্গালয়ের উন্নতি এবং উত্তরকালে অভিনেতা ও নাট্যকারদিগকে পথ-প্রদর্শনের জন্যই গিরিশের জন্ম।’’ পাঠক দেখুন, কত কম কথায় কত সহজভাবে গিরিশের মূল শক্তিটুকুর নির্যাস প্রকাশ করেছিলেন সুধীরকুমার।
কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে দুর্গাপূজার দৃশ্য প্রথম দেখানো হয় ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ১৬ শ্রাবণ ন্যাশনাল থিয়েটারে। গিরিশচন্দ্র ঘোষের রাবণবধ নাটকে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গোৎসব দৃশ্যটি অভিনীত হবার পর গিরিশচন্দ্র নাট্যকার হিসেবে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন। দুর্গাপূজার দৃশ্যের নেপথ্যে থাকা অনেক কথা সুধীরকুমারের কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
বিবেকানন্দ গিরিশচন্দ্রকে বলতেন ‘জি. সি.’। গিরিশচন্দ্র বিবেকানন্দকে বলতেন সূর্যোদয়ের আগে তোলা মাখন। আর রামকৃষ্ণদেব গিরিশচন্দ্রকে সম্বোধন করতেন ‘আঁস্তাকুড়ের আমগাছ’।
সুধীরকুমার মিত্র আমাদের বিস্মিত করলেন। হুগলির ইতিহাস, বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনকথা তাঁর ঋদ্ধ কলমে প্রকাশ পেয়েছে জানতাম। কিন্তু তাঁর এত নাট্যজগৎপ্রীতি, বিশেষত যা গিরিশচন্দ্রকে কেন্দ্র করে আলোড়িত, তা অজানা থেকে যেত গিরিশ পরিচয় না পড়লে। গিরিশে মুগ্ধ সুধীরকুমার মিত্র এই বইটিতে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত। জন্মশতবর্ষে সেই আলোক বিচ্ছুরিত হোক।
আলোচিত গ্রন্থ
গিরিশ পরিচয়।