প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

সুধীরকুমারের জীবন ও ইতিহাসচর্চা – সৌমিত্রশংকর সেনগুপ্ত

সুধীরকুমারের জীবন ও ইতিহাসচর্চা – সৌমিত্রশংকর সেনগুপ্ত

সংক্ষিপ্ত জীবনী ও রচনাবলি

সুধীরকুমার মিত্রের সাধারণ্যে পরিচিতি হুগলি জেলার ইতিহাস বইটির জন্য। প্রথম প্রকাশ বাংলা ১৩৫৫ সনে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সমসাময়িক সংবাদ ও সাময়িকপত্রে যে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রন্থসমীক্ষায় বইটির আলোচনা করে, তা থেকে সাধারণ পাঠক ও আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাকারীদের মধ্যে বইটি কেমন সাড়া ফেলেছিল তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তখনও স্বাধীনতা-প্রাপ্তির বর্ষপূর্তি হয়নি। বঙ্গভঙ্গের অব্যবহিত পূর্বকাল থেকে বাংলাভাষীর নিজস্ব ঘরানার অঞ্চলচর্চার সূত্রপাত হয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের কালপর্বে বাঙালির অস্তিত্বের স্বরূপ-সন্ধানের অন্যতম উপায় হয়ে ওঠে, জেলা ও অঞ্চলচর্চার মাধ্যমে নিজের দেশ ও জনসমাজকে জানার প্রয়াস। জেলাভিত্তিক আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার যে ঢেউ ওঠে, তার শেষতম তরঙ্গটি ছিল সুধীরকুমার মিত্রের হুগলী জেলার ইতিহাস।

বইটির পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় দুই দশকের মধ্যে। ১৩৬৮ থেকে ১৩৭৫ বঙ্গাব্দের মধ্যে তিন খন্ডে প্রকাশিত হয় হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ। পরিপূরক গ্রন্থ হুগলী জেলার দেবদেউল-এর প্রকাশকাল ১৩৭৮। রসায়নের ছাত্র, সওদাগরি অফিসে অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে কর্মরত, ইতিহাসের শাস্ত্রীয় শৃঙ্খলায় প্রশিক্ষণহীন এক স্বদেশকর্মীর সারা জীবনের সাধনা হয়ে উঠেছিল একটি জেলার ইতিহাস, সমাজ ও জনজীবনচর্চা।

সুধীরকুমার মিত্রের জন্ম ১৯০৯ সালের ৫ জানুয়ারি, হুগলি জেলার জনাই-বাকসা গ্রামে, মামার বাড়িতে। পিতৃ-পিতামহের বাস ছিল, হুগলি জেলারই হরিপাল থানার জেজুর গ্রামে। মা ছিলেন রাধারানি দেবী, বাবা ছিলেন আশুতোষ মিত্র। পিতৃকুল ও মাতৃকুল দুটিই ছিল ঐতিহ্যবাহী। পিতা আশুতোষ মিত্র ছিলেন জেজুর গ্রামের প্রাচীন মিত্র বংশের সন্তান। সুধাকর সম্পাদক কবি রাধামাধব মিত্রও এই পরিবারের মানুষ। লেখকের পিতাও ছিলেন একাধিক গ্রন্থের লেখক। লেখকের দাদামশাই গুরুদাস সিংহ ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহের ভ্রাতুষ্পুত্র।

সুধীরকুমারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু গ্রামের পাঠশালাতে। কর্মসূত্রে আশুতোষ সপরিবারে কলকাতায় দর্জিপাড়ার কাছে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে বসবাস শুরু করেন। সুধীরকুমার ভরতি হন স্কটিশচার্চ স্কুলে। সেটা সম্ভবত ১৯১৮ সাল। ১৯২৬ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে সুধীরকুমার স্কটিশচার্চ কলেজে ভরতি হন এবং এখান থেকেই রসায়ন বিজ্ঞানে স্নাতক হন।

ইতিমধ্যে দক্ষিণ কলকাতায় কালিঘাট মন্দিরের কাছে নিজের বাড়ি তৈরি করেছেন পিতা আশুতোষ। কলকাতায় স্থায়ী বসবাস শুরু হয়েছে মিত্র পরিবারের। কিন্তু জেজুরের গ্রামের বাড়ির সঙ্গে তাঁদের যোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত ছিল সকলের। সুধীরকুমার গ্রামের যাত্রাতেও অভিনয় করেছেন কয়েকবার। নিজের দেশ গ্রাম ছিল তাঁর স্বপ্ন ও সাধনা। এছাড়া যুবক বয়স থেকে কংগ্রেসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ সুধীরকুমার জেজুর অঞ্চলে কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় সংগঠক ছিলেন; দীর্ঘকাল তিনি জেজুর কংগ্রেস কমিটির সভাপতিও ছিলেন। গ্রাম ও তার মানুষজনের সঙ্গে নিবিড় যোগ উত্তরকালে হুগলী জেলার ইতিহাস রচনার পটভূমি ও প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল।

সাহিত্যচর্চায় সুধীরকুমার আগ্রহী ছিলেন বাল্যকাল থেকে। যৌবনে তিনি অখিল ভারত কায়স্থ মহাসম্মেলনের মুখপত্র কায়স্থ পত্রিকার সহ-সম্পাদক। এসময়েই সাতাশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় নিজের গ্রাম ও বংশের পরিচয়সূচক জেজুরের মিত্র বংশ। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশ যখন আপন অস্তিত্বের স্বরূপ সন্ধানী হয়ে ওঠে, তার স্বদেশি রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্যতম ছিল দেশ জানা, নিজেকে জানা। গ্রাম, জেলা ধরে ধরে অঞ্চলচর্চা, বিশেষত, আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি সূত্রপাত হয় পারিবারিক ইতিহাস রচনার। শিবেন্দ্র শাস্ত্রীর বাঙ্গালার পারিবারিক ইতিহাস-এ যেমন খন্ডে খন্ডে সংগৃহীত ও সংকলিত হতে থাকে, তেমনি বাংলা প্রদেশের বিভিন্ন জেলার খ্যাতনামা পরিবার ও ব্যক্তি পরিচয়, ব্যক্তি উদ্যোগে, কখনো-বা গোষ্ঠীর প্রযোজনায় পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে পুস্তিকা প্রকাশ হতেও দেখা যায়। বিশ বা ত্রিশ দশকের পত্রিকার পাতা ওলটালে এ ধরনের প্রকাশনার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। সুধীরকুমার মিত্রর জেজুরের মিত্র বংশ রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা অর্জন করেছিল। অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করেন, নিজের পারিবারিক ইতিহাস রচনার মধ্য দিয়ে যে অন্বেষণের আরম্ভ হয়েছিল, তারই পরিণতি হুগলি জেলার ইতিহাস রচনা।

সুধীরকুমার মিত্রের গ্রন্থের সংখ্যা একত্রিশ। গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি পাওয়া যায় তিনটি। মুদ্রিত পুস্তিকার সংখ্যা দশ। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ, যা সন্ধান পাওয়া যায়, তিন শতাধিক। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায়, তিন শতাধিক। এই বিপুল সাহিত্য কীর্তির কথা মাথায় রেখেই হুগলী জেলার ইতিহাস বইটি প্রসঙ্গে নিশীথরঞ্জন রায় লিখেছিলেন, ‘সুধীরকুমার যদি অন্য কোনো বই রচনা নাও করতেন, তাহলেও এই একটিমাত্র রচনা তাঁকে এ-দেশীয় সাহিত্য-সমাজে, বঙ্গীয় সাহিত্য-সমাজে অবিস্মরণীয় করে রাখত।’ এই অবিস্মরণীয় বইটি লেখার একটি বোধনপর্বও আছে। জেলার ইতিহাস রচনায় সুধীরকুমারকে উৎসাহিত করেছিলেন স্যার যদুনাথ সরকার। কিন্তু এ কাজে হাত দেওয়ার সাহস সুধীরকুমার অর্জন করেছিলেন বিক্রমপুরের ইতিহাস-প্রণেতা যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত-র কাছ থেকে। বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতি সম্মেলনের দৌলতপুর অধিবেশনে যোগেন্দ্রনাথ সুধীরকুমারকে জেলার ইতিহাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন। যোগেন্দ্রনাথের পরামর্শ ও সাহচর্যে তাঁর ভাবনা ও মননের যে উত্তরণ ঘটে যায়, তার সাক্ষ্য তিনি হুগলী জেলার ইতিহাস-এর প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘বহুদিন পূর্বে স্বর্গীয় কুমার মুনীন্দ্র দেবরায়ের আমন্ত্রণে একবার বাঁশবেড়িয়াতে গিয়াছিলাম, তখন বংশবাটীর প্রাচীন মন্দিরগুলি দেখিলেও সত্য কথা বলিতে কি আমার মনে তখন কোনো রেখাপাত করে নাই। এইবার দৌলতপুর হইতে ফিরিয়া সপ্তগ্রাম, বংশবাটী, ত্রিবেণী প্রভৃতি কয়েকটি স্থানে যাইয়া হৃদয়ে গভীর আনন্দ অনুভব করিলাম। সঙ্গে ক্যামেরা থাকায় কয়েকখানি ছবি তুলিলাম, কিন্তু আশা যেন আর মিটিতে চায় না, দুই দিন পর পুনরায় কলকাতায় ফিরিয়া আসিলাম।’

পরবর্তী কয়েক বছর নিয়ম করে সপ্তাহান্তে একটি একটি মহকুমা ধরে হুগলি জেলার প্রায় আঠারো-শো গ্রাম পরিক্রমা করেন সুধীরকুমার। শহর গ্রাম পল্লির ছোটো ছোটো তথ্যের হাত ধরে ভবিষ্যৎ পাঠকদের দেশ চেনানোর এই প্রয়াস আমাদের মাথা নত করে দেয়। জেলার প্রতিটি অঞ্চলের তথ্য যেমন জড়ো করেছেন, সংগ্রহ ও ব্যবহার করেছেন চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, পান্ডুলিপি, প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ। জেলার ইতিহাসের বহু স্বল্পজ্ঞাত তথ্যে নতুন আলোকপাত করেছেন। একখন্ডে, বহু চিত্রসমৃদ্ধ হুগলী জেলার ইতিহাস শিশির পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৫৫ সালে, তখনও স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি হয়নি।

একখন্ডে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধপঞ্জি পাশাপাশি রাখলে বোঝা যায় কীভাবে তিনি ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের দিকে এগিয়ে গেছেন। ক্ষেত্রসমীক্ষার তথ্য যাচাই করার জন্য প্রকাশ করেছেন প্রবন্ধাকারে। মন্তব্য ও মতামতগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে, নিজের ভাবনা পুনর্বিবেচনা করে, চূড়ান্ত রূপ দিয়েছেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত প্রকল্পের।

বইটির পরিবর্তিত সংস্করণ হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ তিন খন্ডে প্রকাশিত হয় মিত্রাণী প্রকাশনী থেকে। নিজের তৈরি করা কাঠামো ভেঙে আবার নির্মাণ করলেন সুধীরকুমার। বাংলা দেশের বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তিনি স্থাপন করলেন হুগলি জেলার ইতিহাস।

এই অবিস্মরণীয় বইটির বাইরেও সুধীরকুমারের রচনাপঞ্জি দীর্ঘ। লিখেছেন বহুবিধ বিষয়ে। আনন্দবাজার পত্রিকা, উদয়ন, কায়স্থ পত্রিকা, দেশ, প্রবর্তক, প্রবাসী, বঙ্গদর্শন, বঙ্গশ্রী, দৈনিক ও মাসিক বসুমতী, বেতার জগৎ, যুগান্তর, রবিবাসর প্রভৃতি নামী পত্রপত্রিকায়। বাংলা ভাষার অজস্র ছোটো পত্রিকাতেও ছড়িয়ে আছে তাঁর অগণিত প্রবন্ধ। রাজনীতিচর্চা করেছেন, পরাধীন ভারতের শিক্ষিত, সমাজ সচেতন প্রতিটি ভারতীয়দের কাছে যা একান্ত প্রত্যাশিত। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশ স্বাধীন করার জন্য একজন নাগরিকের যতটা কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তা তিনি করেননি। এই আত্মবিশ্লেষণ তাঁকে প্রণোদিত করেছিল বিপ্লবীদের জীবনী রচনায়। হয়তো এভাবেই দেশ গঠনের দায়িত্বে নিজেকে সাধ্যমতো যুক্ত রেখেছিলেন তিনি। যেন এটাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক কাজ। বাংলা ভাষায় অঞ্চলচর্চা তিনি সোচ্চারে না হলেও, মৌন চরিত্রে ছিল স্বদেশি রাজনৈতিক কর্মসূচি, স্বদেশিয়ানার চর্চা।

মননশীল সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে নিষ্ঠাবান এই মানুষটি দীর্ঘজীবনে বেশ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদন করেছেন। ১৯৩১ সালে প্রকাশ করেন বুভুক্ষা নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা। ১৯৩৯-৫৫ যুক্ত ছিলেন কায়স্থ পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। ১৩৬১ সালে হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেন বঙ্গদর্শন। স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের মুখপত্র রাখাল বেণু পত্রিকার তিনি ছিলেন প্রথম সম্পাদক। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সুধীরকুমার সম্পাদনা করেছেন সব্যসাচী, পার্থসারথী, অতি আধুনিক এবং চন্দননগর।

জীবনভর যুক্ত ছিলেন নানা সংগঠনের সঙ্গে। চল্লিশের দশকের সূচনায় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সংগঠিত করেছিলেন ‘বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতি সম্মেলন’। এমন একটি সমিতির প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম অনুভব করেন প্রফুল্লকুমার সরকার। সম্মেলনের সম্পাদক হন সুধীরকুমার। সেটা ১৯৩৯-এর জুন মাস। অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন স্থানে পর পর তিন বছর এই বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতি সম্মেলনের অধিবেশন হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের দৌলতপুর, কলকাতা ও চন্দননগরের এই অধিবেশনগুলিতে সে যুগের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। নলিনীরঞ্জন সরকার, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিমল সিংহ, সুনির্মল বসু প্রমুখেরা ওই অধিবেশনগুলিতে যোগ দেন ও কোনো-না-কোনো বিভাগের সভাপতিত্ব করেন। এ প্রয়াসের উল্লেখ পাওয়া যায় আনন্দবাজার-এর পাতায় : ‘বঙ্গভাষা যে ভারতের শ্রেষ্ঠ ভাষা এবং ইহার প্রাচীনত্ব, ঐশ্বর্য, ব্যাপকতা থাকা সত্ত্বেও ইহার দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় স্বর্গীয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, স্বর্গীয় প্রফুল্লকুমার সরকার, কুমার বিমলচন্দ্র সিংহের সহযোগিতায় শ্রীসুধীরকুমার মিত্র বঙ্গভাষা সংস্কৃতি সম্মেলন প্রতিষ্ঠা করেন।’ (১২ চৈত্র, ১৩৫১)। সুধীরকুমার মিত্র রচিত পুস্তিকা ভারতের রাষ্ট্র ভাষা (১৯৪২) এবং India’s National Language (1944) প্রকাশ করে সম্মেলন। এ ছাড়া ১৯৪৭ সালে দেশভাগের অব্যবহিত পূর্বে প্রকাশিত নয়া বাংলা বইটিতেও বাঙালি ও বাংলাভাষা বিষয়ে সুধীরকুমারের ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠির পরিচয় নিরূপণ, হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার তুলনামূলক আলোচনা, সীমা নির্ধারণ কমিশনে প্রদত্ত ব্যবচ্ছেদ-প্রস্তাব এবং ব্যবচ্ছেদের পরে যে নয়া বাংলা গঠিত হবে তার আর্থ-সামাজিক অবস্থারও পর্যালোচনা করা হয় বইটিতে।

১৯৩৭ সালে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অখিল ভারত কায়স্থ মহাসম্মেলন। উদ্বোধন করেছিলেন স্যার যদুনাথ সরকার। সুধীরকুমার ছিলেন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্রচার-সম্পাদক। এ সমাজের মুখপত্র কায়স্থ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন নরেন্দ্রনাথ বসু। দীর্ঘকাল সুধীরকুমার ছিলেন পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক।

স্ত্রী-শিক্ষা ও জনশিক্ষা প্রসারে সুধীরকুমার মিত্র ছিলেন এক অগ্রণী কর্মী। ১৯৫৫ সালে হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও জিতেশচন্দ্র গুহ-র সঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দেশবন্ধু কলেজ ফর গার্লস’। দীর্ঘকাল এই কলেজের তিনি সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়ের তিনি সম্পাদক ছিলেন বহু বছর। সভাপতি ছিলেন ‘হেমেন্দ্র বিদ্যামন্দির’ এবং ‘দেশবন্ধু শিশু শিক্ষালয়’-এর। কালিঘাটে নিজের পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘সত্যচরণ ইনস্টিটিউট’ ও অবৈতনিক পাঠাগার। যুক্ত ছিলেন ঐতিহ্যসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান রবিবাসরের সঙ্গেও।

১৯৮০-৮১ সাল থেকে তিনি ‘চৈতন্য রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর সঙ্গে যুক্ত হন। বৈষ্ণব সাহিত্য ও বৈষ্ণব ধর্মান্দোলেনের বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, চৈতন্য চরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত ছিল তাঁর নিয়মিত পাঠ্য। জীবনের শেষ দু-দশক ভক্তিসাধনা এবং চৈতন্যদেবের ধর্মান্দোলন নিয়ে বহু প্রবন্ধ রচনা করেন সুধীরকুমার। চৈতন্য চকড়া নামে ওড়িয়া ভাষায় রচিত একটি দুষ্প্রাপ্য চৈতন্য বিষয়ক গ্রন্থের মূল্যায়ন পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়।

১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি সুধীরকুমার মিত্রের জীবনাবসান হয়। এ বছরের ৫ জানুয়ারি সূচিত হয়েছে তাঁর জন্মশতবর্ষ। প্রথম জীবনের সক্রিয় রাজনীতিচর্চা, সারা জীবন নানা সামাজিক সংগঠনে সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসাবে ক্রিয়াশীলতা, বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা, পত্রিকা সম্পাদনা, অজস্র প্রবন্ধ ও বেশ কিছু গ্রন্থের লেখক—এইসব পরিচয় ছাপিয়ে সুধীরকুমারের পরিচয় তিনি হুগলি জেলার ইতিহাস প্রণেতা। বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় তাঁর অবদানটির জন্যই চিরস্মরণীয়। ফলে, তাঁর জেলা-ইতিহাসচর্চা ও সাধনা পৃথকভাবে আলোচনার যোগ্য। এই প্রসঙ্গে অবশ্য আলোচ্য তাঁর পূর্ববর্তী আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ধারা।

বাংলাভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ধারা

১৮৬৪ সালে বহরমপুর থেকে একটি ছোটো বই প্রকাশিত হয়। শ্যামধন মুখোপাধ্যায় ‘সংগৃহীত’ মুরশিদাবাদের ইতিহাস। আট আনা দামের বইটি ছাপা হয়েছিল ধন-সিন্ধু প্রেসে। শ্যামধন হুগলি জেলার মানুষ ছিলেন। মুন্সেফ পদে চাকরি করতে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার গোয়াসে। ‘রাজকীয় কর্ম্ম উপলক্ষে দীর্ঘকাল’ মুর্শিদাবাদে বাস করার সূত্রে সংগৃহীত ‘স্থানীয় বৃত্তান্ত’ এবং পারসি তারিখ বা ঐতিহাসিক বিবরণ, স্টুয়ার্ট ও মার্সম্যান সাহেবের ইতিহাস বই এবং রেভিনিউ সার্ভেয়র জে. ই. গ্যাসট্রেলের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে মুর্শিদাবাদের ক্ষুদ্র ইতিহাসটি লেখেন তিনি। শ্যামধন কর্মসূত্রে মুর্শিদাবাদে যাওয়ার কয়েক দশক আগেও মুর্শিদাবাদ শহর ছিল বাংলা সুবা-র রাজধানী; কাশিমবাজার, কালিকাপুর, ফরাসডাঙা, চুনাখালি ছিল ইউরোপীয় বণিকদের কুঠি ও আবাসস্থল। একদা বাংলার প্রধান নগরাঞ্চলের ভাঙনের ছবি চোখের সামনে দেখে শ্যামধনের মনে হতেই পারে ‘কোন মাহাত্মার সময়ে তাঁহার মহতী কীর্তিস্বরূপ এই স্থান রাজধানী নাম ধারণপূর্বক জনসমাজে বিখাত হইয়াছিল অগ্রে তদ্বিরণ করা আবশ্যক।’

বইটির শেষাংশে গ্যাসট্রেলের প্রতিবেদন নির্ভর স্থানিক বিবরণ ছাড়া শ্যামধনের মুরশিদাবাদের ইতিহাস মূলত নগর মুর্শিদাবাদ ও নবাব পরিবারের ইতিহাস। প্রেরণা ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে অঞ্চলচর্চার অভিমান ও অভিজ্ঞান এ বইটির ছিল না। বরং, এর পূর্বসূরি, কালিকমল সার্বভৌমের বগুড়ার সেতিহাস বৃত্তান্ত (১৮৬১) গ্রন্থটি এবং ১৮৬৪ সালে অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হিজলীর বৃত্তান্ত নিবন্ধটিকে নির্দ্বিধায় অঞ্চল-কথার পর্যায়ে ফেলা যায়।

কালিকমল সার্বভৌম বগুড়ার সেতিহাস বৃত্তান্ত রচনার ছ-বছর আগে বগুড়া আসেন। অর্থাৎ, তিনিও বগুড়ার মানুষ ছিলেন না। সম্ভবত শিক্ষকতার বৃত্তি নিয়ে বগুড়াতে আসেন তিনি। একটি সদ্যপরিচিত জেল বা অঞ্চলের কথা জানার এবং অন্যদের জানানোর স্বতোৎসারিত আগ্রহই যে শ্যামধন ও কালিকমলকে গ্রন্থরচনায় প্রবৃত্ত করেছিল এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।

তুলনায় হিজলীর বৃত্তান্ত ‘বঙ্গদেশের প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও পুরাবৃত্ত সম্বন্ধীয় সুপ্রণালীবদ্ধ বৃত্তান্ত’ সংগ্রহে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সংগঠিত উদ্যোগের ফসল। তত্ত্ববোধিনী-র আক্ষেপ বাংলার শিক্ষিত ব্যক্তিরা ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার ইতিহাস ও ভূগোল পরিশ্রমের সঙ্গে অধ্যয়ন ও শিক্ষা করেন ‘কিন্তু তাহাদের বীরভূম ও বাঁকুড়া জেলা কোনো বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা কিছুই বলিতে পারিবেন না।’ এই ভাবনার থেকে তত্ত্ববোধিনী ‘ইতিহাস সংগ্রহ’ শিরোনামে আঞ্চলিক তথ্য ও বৃত্তান্ত সংগ্রহের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার রূপায়ণের রসদ জোগাবেন তাঁরা ‘যাঁহারা এতদ্দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে কর্মোদ্দেশে অথবা অন্য কোনো কারণে বহু দিন বাস করিয়াছেন এবং তথাকার প্রাকৃতিক, সামাজিক ও পুরাবৃত্ত বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করিয়াছেন।’

তত্ত্ববোধিনী-র ‘ইতিহাস সংগ্রহে’-র প্রথম নিবন্ধটিই ‘হিজলীর বৃত্তান্ত’। লেখক অজ্ঞাত ‘কোন বন্ধু’। কেন হিজলি, এ প্রশ্ন আমাদের মনে আসা স্বাভাবিক। বৃত্তান্তলেখকও সচেতন ছিলেন। এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েই তিনি শুরু করেন, ‘লোনা হিজলী’ বিপুল শস্য ও লবণ উৎপাদক। হিজলির বিবরণ এ নিবন্ধে কোনো পাঠ্য বা পরিচিত ইতিহাস বইকে ঘিরে গড়ে ওঠে না। স্থান-বিবরণ, জনশ্রুতি, লবণ তৈরির প্রক্রিয়ার দীর্ঘ আলোচনা—সব মিলিয়ে ‘হিজলীর বৃত্তান্ত’, চোখ মেলে অঞ্চলটিকে দেখেছেন, এমন এক মানুষের লেখা বর্ণনা।

এই বই বা নিবন্ধগুলি যখন লেখা হচ্ছে তখন ‘হেনরি বেভারিজের ডিস্ট্রিক্ট অব বাখরগঞ্জ : ইটস হিস্ট্রি অ্যাণ্ড স্ট্যাটিসস্টিকস’ লেখা হয়নি। হান্টার ভারতে এসেছেন, জেলার প্রশাসনিক চাকরি শুরু করেছেন, কিন্তু ‘অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ লেখা হবে আরও কয়েক বছর পরে। লর্ড মেয়োর ইচ্ছায় নিয়োগপত্র পেয়ে হান্টার তিন পর্বে স্ট্যাটিসস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট এবং গেজেটিয়ার প্রকাশের পরিকল্পনায় হাত দেবেন আরও এক দশক পরে। আরও অনেক পরে চিন্তাশীল ও বাঙালি সমাজে আলোড়ন ফেলবে বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধগুলি।

বেভারিজ, হান্টার এবং বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ আনা হল কারণ, বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ধারা নিয়ে যে কোনো আলোচনায় অনুপ্রেরণার উৎস ও চর্চার ধরন-গড়নের নির্মাতা হিসাবে তাঁদের লেখাগুলিকেই চিহ্নিত করা হয়। ফলে এ প্রশ্নটা থেকেই যায়, তারও আগে, বাংলা দেশের ছোটো ছোটো অঞ্চল, নগর বা জেলা নিয়ে এই যে লেখালেখি, এর কারণ কী? এর উত্তর খোঁজার পর্ব শুরু হয়েছে, ইদানীংকালে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা বিষয়ক বহু প্রকাশনা, আলোচনার সংবাদ নজরে আসে; উত্তর-সন্ধানে ব্যাপৃত রয়েছেন ইতিহাসের শাস্ত্রীয় শৃঙ্খলায় প্রশিক্ষিত গবেষকেরাও। এই মুহূর্তে কয়েকটি প্রাথমিক লক্ষণকে চিহ্নিত করা যাক, পূর্ণাঙ্গ উত্তর তোলা যাক গবেষকদের জন্য।

বিজয়ীর পরাক্রম বিজিত দেশ শাসনের যথেষ্ট শর্ত হতে পারে, বিজিত দেশের মানুষকে শাসনের যথেষ্ট শর্ত নয়। বিজয়ী দেশকেও নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, বিজিত দেশের মানুষের কাছে নিজেকে গ্রহণীয় করতে হয়। ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে আমাদের পড়ানো হয় গ্রিক ও রোমান সভ্যতার ইতিহাস, ইউরোপীয় সভ্যতার ইতিহাস। ইতিহাসের একটা নির্দিষ্ট ধাঁচ ও ধরনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। স্টুয়ার্ট ও মার্সম্যানের ইতিহাস দীর্ঘকাল আমাদের মননে রাজত্ব করে। একটা বড়ো ইতিহাসের কাঠামোর মধ্যে আমরা ঢুকে পড়ি, যে কাঠামোতে আঞ্চলিক ইতিহাসের জন্য এতটুকু পরিসর নেই।

ভারতে সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশ শাসন হঠাৎই ছেদ আনে। নতুন ভূমিব্যবস্থা ও ভূমিসম্পর্ক চাপিয়ে দেওয়া হয়। সমাজবিকাশের প্রক্রিয়া অবাধ হলে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির সদর্থক উপাদানগুলোকে আত্তীকরণ করে যেভাবে প্রগতিশীল পুঁজিবাদী সংস্কৃতি বিকশিত হয়, ভারতে তা হতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে উনিশ শতকের শেষ অবধি শিক্ষিত বাঙালি মানসের তিনটি পর্বকে শনাক্ত করা যায়। প্রথম পর্বে, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যকে অবাধে গ্রহণ করা হয়; দ্বিতীয় পর্বে, এরই প্রতিক্রিয়ায়, ভারতের অতীত ঐতিহ্য, মূলত হিন্দু ভারতের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়; তৃতীয় পর্বে, এই দুয়ের সম্মেলনে আধুনিক ভারতের স্বরূপসন্ধান চলে। আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার আধুনিক ধারার যে উদাহরণগুলিকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি, তা মূলত এই তৃতীয় পর্বের সূচনাকালের। ইংরাজ পন্ডিত সমাজের তৈরি করে দেওয়া ভারত ইতিহাসের কাঠামোতে আশৈশবের পরিচিত গ্রাম, জনপদ, সমাজকে চিনতে না পারার প্রতিক্রিয়াই হয়তো আঞ্চলিক ইতিহাস নির্মাণের জমি তৈরি করে।

হান্টার-বেভারিজের পূর্বসূরি ছিলেন, ফ্রান্সিস বুকানন বা হ্যামিলটনেরা। বিহারের পূর্ণিয়া, পাটনা, শাহাবাদ, ভাগলপুর, উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর ইত্যাদি জেলার ‘অ্যাকাউন্ট’ বুকানন সংগ্রহ করেছিলেন প্রশাসনিক প্রয়োজনে। হ্যামিলটনের ডেসক্রিপশন অব হিন্দুস্তান লেখা হয়ে যায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই। বাংলার ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, জনসমাজ নিয়ে বঙ্গবিদ্যাচর্চায় নিমগ্ন ইংরাজ গবেষকদের অজস্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি-র জার্নালের পাতায়। উল্লেখ্য, বিশেষত ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় লেখা, জেমস লঙের ক্যালকাটা অ্যাণ্ড ইটস নেবারহুড এবং অন দি ব্যাঙ্কস অব রিভার ভাগীরথী। এসব লেখার লক্ষ্য পাঠকদল ইংরাজ ও ইউরোপীয় পাঠকেরা হলেও শিক্ষিত বাঙালিদের কাছে এগুলি নিশ্চয়ই অপরিচিত ছিল না। এ ছাড়া বাংলার সবকটি জেলায় রাজস্ব নির্ধারণের প্রয়োজনে জমিখন্ড ধরে ধরে সমীক্ষার সূচনা ১৮৫০-এর শুরুতেই হয়েছিল। এর অভিঘাতে নিজেদের মতো করে অঞ্চলকে চিনে নেবার ভাবনা জাগ্রত হওয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা।

১৮০৭ সনে লণ্ডন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেকটরস কোম্পানির কলকাতার কর্তাব্যক্তিদের লিখেছিলেন :

we are of the opinion that a statistical survey of the country would be attended with much utility.

নেপোলিয়নিক ওয়ারের সময় ব্রিটেনে উপযোগবাদী (utilitarian) দর্শন রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। উপযোগবাদ বলে, একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্ত তখনই বৈধতা পায়, যখন তা ‘socially useful effects’-এর জন্ম দেয়। কিন্তু, কোর্ট অব ডিরেক্টরস যখন utility-র কথা বলেন, তখন একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে তারা ‘the greatest good for the greatest number’ এই নীতি পূর্বভারতে প্রয়োগের কথা মাথায় রাখেন। এখানে utility মানে সাম্রাজ্যের পূর্ব-ভারতীয় খন্ড থেকে মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুচারু শোষণ। ফলে ১৮০৭ সালে ওয়েলেসলির নির্দেশে ফ্রান্সিস বুকানন যখন পরিসংখ্যান সংগ্রহের কাজে নামেন, কোম্পানি চায় রাজস্ব বৃদ্ধির প্রতিটি ক্ষেত্র, বাজার সম্প্রসারণের প্রতিটি সম্ভাবনাকে তিনি নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করবেন। এভাবে পরিসংখ্যান সংগ্রহের অভিযান হোক, কিংবা প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা, কাজের অভিমুখ নির্ধারিত হয় পাশ্চাত্যের প্রভুমন্যতায়।

১৮০৭ থেকে ১৮১৪—এই দীর্ঘ সময়ে কোম্পানি রাজত্বের ভগ্নাংশমাত্র অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন বুকানন। ছয় দশক পরে এই কাজ শেষ করেন উইলিয়াম উইলসন হান্টার। সাম্রাজ্যের সদ্য অধিকৃত ভূখন্ডের মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতকে। রাজস্ব সমীক্ষা শুরু হয়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই। কিন্তু ১৮৫৭-র পরে মহারানির ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সাম্রাজ্য শাসনে যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়, তার অনুষঙ্গেই আসে জনগণনা, ভাষাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক সমীক্ষা। লর্ড মেয়োর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে ১৮৬৯ সালে ডিরেক্টর জেনারেল অব সেন্সাস পদে নিযুক্ত হন হান্টার। ১৮৭১ সালে সামাজ্যের তথ্যভিত্তির পদ্ধতি ও ব্যাপ্তি বিষয়ক তার পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। প্রথম পর্বে জেলাভিত্তিক স্ট্যাটিসস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৮৭৫ সাল থেকে। ১৮৮১ সাল থেকে প্রকাশিত হয় দি ইমপিরিয়াল গেজেটিয়ার। তৃতীয় পর্ব, জেলাভিত্তিক গেজেটিয়ার প্রকাশনা শুরু হয় বিশ শতকের প্রথম দশকে। প্রায় এক শতাব্দীকাল ধরে নির্মিত বিপুল রাজকীয় তথ্যভিত্তি আজ অবধি অঞ্চলচর্চার অপরিহার্য উপাদান হিসাবে গণ্য। একই সঙ্গে, এই বিপুল প্রশাসনিক উদ্যোগ, তার সমান্তরাল উদ্যোগ হিসাবে শিক্ষিত বাঙালি মানসে নিজস্ব আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার প্রবণতাকে উসকে দিয়েছিল, এমন ভাবনাও অমূলক নয়।

কিন্তু একটি জেলার বা একটি অঞ্চলের এবং সংলগ্ন জনসমাজের ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ সম্ভবত হান্টারের অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল এবং হেনরি বেভারিজের হিস্ট্রি অব বাখরগঞ্জ। প্রথমটির প্রকাশকাল ১৮৬৮, বিষয় বিষ্ণুপুর, বীরভূম এবং তৎকালীন ভাগলপুর জেলার কিয়দংশ। দ্বিতীয়টির প্রকাশকাল ১৮৭৬।

হিস্ট্রি অব বাখরগঞ্জের ভূমিকায় বেভারিজ লিখলেন :

My idea always have been that the proper person to write the history of a district is one who is native of it, who has lived all his life in it and who has abundance of leisure to collect information. It is only a Bengali who can treat satisfactiorily of the productions of his country, or of its social condition—its castes, leading, families, peculiarities of language, customs etc.

এ স্বীকারোক্তি থেকে ভরসা পান সতীশচন্দ্র মিত্র। ‘আমাদের দেশে প্রায় সকলেই দূরে বসিয়া ইতিহাস লেখেন। যিনি প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধীয় যাবতীয় বিবরণ সম্বলিত প্রকান্ড পুস্তক প্রকাশ করিয়াছেন, তিনিও প্রতাপাদিত্যের লীলাক্ষেত্রে পদার্পণ করেন নাই। প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে নাটক নভেলের তো কথাই নাই, উহার সবগুলিই কলিকাতার দ্বারবন্ধ ত্রিতল গৃহে বসিয়া লেখা হইয়াছে। চাক্ষুষ প্রমাণের মতো প্রমাণ নাই। কোনো দেশের ইতিহাস রচনার প্রথম স্তরে এই প্রমাণ সংগৃহীত হইলে, পরে তাহার উপর ভিত্তি রাখিয়া ঐতিহাসিক সমালোচনা চলিতে পারে।’

বেভারিজের রচনা এবং সতীশচন্দ্র যখন একথা লিখছেন, তার মধ্যবর্তী কালপর্বে অঞ্চলচর্চার এক বিপুল ঢেউ বাংলাকে ছুঁয়ে গেছে। অ্যানালস রচনা, বিপুল তথ্যভিত্তির সংকলন, গেজেটিয়ার প্রকাশ ইত্যাদি যে সময়কাল জুড়ে হয়েছে, সেই কালপর্বেই ছোটো-বড়ো নানা আকারে রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে আঞ্চলিক ইতিহাসের অনেক গ্রন্থ ও নিবন্ধ। প্রবন্ধ-নিবন্ধের তালিকা সুদীর্ঘ; গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়, বোঝা যায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চা গ্রন্থপঞ্জী (১৮০১-১৯৯০), তারাপদ সাঁতরার বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : একটি সমীক্ষা এই দু-টি সূত্র থেকে।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আঞ্চলিক সত্তার মধ্যে বাঙালির আত্ম-অনুসন্ধানের যে ঝোঁক দেখা দিয়েছিল, গত শতাব্দীর প্রথম দশকে, বঙ্গভঙ্গ-উত্তর পর্বে তা বিপুল ঢেউ হয়ে আসে। বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকটি প্রবন্ধ—বাঙ্গালার ইতিহাস (বঙ্গদর্শন, ১২৮১), বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা (বঙ্গদর্শন, ১২৮৭)—কীভাবে বাঙালির ইতিহাসচর্চাকে উৎসাহিত করেছে তা বহু আলোচিত। রাজপুত-মারাঠার দেশপ্রেম, বীরত্ব ততদিনে ইতিহাসাশ্রিত সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। বাংলার আইকন কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য, সিরাজ-উদ-দৌল্লা। উপনিবেশবাদীর নির্দেশিত ইতিহাসের প্রতিস্পর্ধায় এভাবেই উপনিবেশের কন্ঠস্বর গড়ে ওঠে। উপনিবেশ ভারত ও বাংলার ইতিহাস রচনার সূত্র ধরেই আসে বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাস ও অনুসন্ধান। অনুসন্ধান যখন ছোটো এককে নেমে আসে, ঐতিহাসিক যখন হন স্থানীয় মানুষ, তখন স্থান, ব্যক্তি ও পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

দেশের কাব্যে, গানে, ছড়ায়, প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ, কীটদষ্ট পুঁথির জীর্ণপত্র, গ্রাম্য পার্বণে, ব্রতকথায়, পল্লির কৃষি কুটিরে পরিষৎ যেখানে স্বদেশকে সন্ধান করিবার জন্য উদ্যত হইয়াছেন সেখানে বিদেশি লোকে কোনোদিন বিস্ময় দৃষ্টিপাত করে না। (রবীন্দ্রনাথ :স্বদেশী সমাজ)

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় ব্যক্তি-উদ্যোগের পাশাপাশি সাংগঠনিক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তাও গুরুত্ব পায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর একাদশ বর্ষের (১৩১২ সন) কার্যবিবরণী থেকে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবক্রমে পরিষদের কর্মক্ষেত্রের পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনার সীমা ত্যাগ করে পরিষৎ পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ভৌগোলিক তত্ত্ব ইত্যাদিও তার অনুসন্ধানের আওতায় আনছে। এর জন্য পরিষৎ-এর আঞ্চলিক শাখা তৈরি করা ও মফসসলের কলেজের ছাত্রদের দ্বারা তথ্য সংগ্রহ করা যায় কি-না, তার চেষ্টা করা হল।

১৩১৩ বঙ্গাব্দে রংপুর সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরেই রঙ্গপুর-সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৩১৩-৪৫ সময়কালে এই পত্রিকার ইতিহাস ও অঞ্চলচর্চা বিষয়ক যে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার সংখ্যা নেহাত কম নয়। সাহিত্য পরিষৎ-এর এই প্রাচীনতম শাখাটির পর ১৯২০ সালের মধ্যে আরও চৌদ্দটি স্থানীয় শাখা স্থাপিত হয়। এর প্রতিটি শাখাই অঞ্চলচর্চা, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাসচর্চায় নিবেদিত ছিল। ১৯১০ সালে দীঘাপাতিয়ার রাজা শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রায়বাহাদুর রমাপ্রসাদ চন্দের মিলিত উদ্যোগে গঠিত হয় বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি। এরপর ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বীরভূম অনুসন্ধান সমিতি। উদ্যোক্তা এবং সম্পাদক ছিলেন হেতমপুরের জমিদার-তনয় ‘মহারাজকুমার’ মহিমা নিরঞ্জন চক্রবর্তী, সহকারী সম্পাদক হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, উপদেষ্টা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সভাপতি নগেন্দ্রনাথ বসু।

বীরভূম অনুসন্ধান সমিতির প্রকল্পে বীরভূম জেলার গ্রাম-গ্রামান্তরে পায়ে হেঁটে ঘুরে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করলেন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, সংকলিত হল তিন খন্ডে বীরভূম বিবরণ। দরিদ্র ব্রাহ্মণ তিনি, বেতনভোগী সহকারী সম্পাদক, আজ অবধি বইটি প্রচারিত হয় ‘জমিদার-তনয় মহিমানিরঞ্জন চক্রবর্তী’-এর নামে।

এখানে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের প্রসঙ্গ টেনে আনা সম্ভবত অন্যায় হবে না। তাঁকে নিয়ে অসামান্য আলোচনা করেছেন গৌতম ভদ্র। পুঁথি সংগ্রহের আদিপর্বে ‘বিদ্যাভূষণী মনসা’ নামে পুঁথির পরিচিতি দিতে গিয়ে আবদুল করিম স্বচ্ছন্দে লিখেছেন :

বাঙ্গালা সাহিত্যের সেবা একরূপ সখের কাজ; অথচ দেখা যায় এ কার্য উদর-চিন্তাশূন্য লোকদিগের যোগ্য ও গ্রহণীয় হইলেও, যত অন্ন চিন্তা-বিষধর-দংশন কাতর শ্রীহীন ব্যক্তিরাও ইহাতে উন্মত্ত। এই প্রবন্ধের অধম লেখকও শেষোক্ত শ্রেণির একজন…।

চট্টলবাসী, বাঙাল, বাংলা ভাষার মুসলমান সাহিত্য সেবক ও দরিদ্র—এই পরিচয়গুলি আবদুল করিম নিজের গায়ে দেগে দিয়েছিলেন। নানা অর্থে তিনি যেন প্রান্তবাসী, বঙ্গভাষা দরবারে একটু কুন্ঠিত, সংকুচিত। অথচ পুঁথিসংগ্রহ তাঁর কাছে একাধারে সখের কাজ ও স্বাদেশিক কাজ। তিনিও বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি, বীরভূম অনুসন্ধান সমিতির আদলে, ধনী উকিলপুত্র নলিনীকান্ত সেনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকল্প নেন ‘চট্টগ্রাম প্রাচীন সাহিত্য সংগ্রহ সমিতি’ গঠনের। নলিনীকান্তের অকালমৃত্যুতে এ চেষ্টা সফল হয় না। কিন্তু লোভনীয় আইন ব্যবসায়ের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকের বৃত্তি নিয়ে নলিনীকান্তের ফিরে আসাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন আবদুল করিম। ‘মাতৃভূমির সেবাব্রতাবলম্বনের জন্য তাঁহার অন্তরে যে প্রবল অনুরাগ ছিল, সেই অনুরাগের নিকট তাঁহার স্বার্থ বলিদান করিয়া গত বৎসর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।’ এখানে স্বদেশ ও মাতৃভূমি চট্টগ্রাম। ভিটেমাটিই শেষ পর্যন্ত জন্মভূমি।

এই স্বদেশব্রতের প্রেরণার উৎস কী? আরও একবার আবদুল করিমের নিজের কথায় শোনা যাক। ‘নিজ বাড়িতে ও পাড়া প্রতিবেশীর বাড়িতে তখন হামেশাই পুঁথি পড়ার মজলিস বসিত। কিছু না বুঝিলেও সেই মজলিশে গিয়া আলাওলের পুঁথি পড়া শুনিতাম। শুনিয়া শুনিয়া আমার ভাবপ্রবণ কিশোর হৃদয়ে যে আনন্দ জন্মিত, তাহার স্মৃতি আজও মুছিয়া যায় নাই।…প্রাচীন পুঁথির সন্ধান ও আবিষ্কার আমার যেন ধ্যানের বস্তু হইয়া ওঠে। সারা জীবন আমি ধ্যাননিমগ্ন যোগীর ন্যায় সেই এক ধ্যানেই কাটাইয়াছি।’

পূর্ব বাংলার আর এক প্রান্তে একটি জেলার ইতিহাস রচনার সাধনায় নিমগ্ন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের কন্ঠেও একই সুর ধ্বনিত হয়। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিক্রমগুপ্তের ইতিহাস প্রকাশিত হয় ১৩১৬ বঙ্গাব্দে। প্রথম সংস্করণে গ্রন্থকারের নিবেদনে লেখা হয়েছিল :

সোনার শৈশবে মা দিদিমার মুখে যখন রামপালের কাহিনি শুনতাম…শুনিতে শুনিতে আত্মহারা হইয়া যাইতাম আরও শুনিতে সাধ যাইত, কিন্তু তাহারা আমার সেই সাধ পূর্ণ করিতে পারিতেন না; সেই শৈশবেই বিক্রমপুরের অতীত গৌরবের পুণ্য ইতিহাস আমার হৃদয়ে গাঢ়রূপে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তারপর বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে সুপ্ত বাসনা জাগরিত হইয়া আমাকে দেশের ইতিহাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করে…

‘আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে বিক্রমপুরের ন্যায় প্রাচীন ও ইতিহাস-বিখ্যাত প্রসিদ্ধ স্থানের ইতিহাস রচনা করিতে যাওয়া যে ধৃষ্টতা, তাহা বুঝিয়াও যে কেন আমি এমন গুরুতর কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, তাহার উত্তর দিতে আমি অক্ষম। ছেলে মাকে ভালোবাসে, মায়ের কথা শুনিতে ও বলিতে তাহার ভালো লাগে, তার শৈশবসুলভ সরলতাপূর্ণ বাক্যবিন্যাসে সে মায়ের কতই না রূপবর্ণনা করে এবং তাহাতেই তাহার তৃপ্তি হয়; তেমনি আমার মাতৃভূমির প্রতি তরু, প্রতি লতা, প্রতি মসজিদ, প্রতি মঠ, প্রতি দেবালয় ও প্রতি মৃত্তিকা কণার মধ্য হইতে বিশ্বজননীর যে চেতনাময় আহ্বান আমাকে তাঁহারি গুণ-গানে হৃদয়ে প্রেরণা জাগাইয়া দিয়াছিল—ইহা কেবল তাহারি বিকাশ।’

প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষজ্ঞদের পাশে নানা সামাজিক ও পৌর প্রতিষ্ঠান, গবেষণা-অনুসন্ধান কেন্দ্রের উদ্যোগে স্বশিক্ষিত গবেষকেরা যখন উঠে আসছেন, লোক-ইতিহাস, অঞ্চলের ইতিবৃত্ত রচিত হচ্ছে তাঁদের হাতে, আত্মপ্রকাশের প্রাথমিক মাধ্যম হিসাবে বেশ কিছু পত্রপত্রিকার আশ্রয় পাচ্ছেন তাঁরা। গ্রন্থ প্রকাশের ভাবনা ছিল সকলেরই, কিন্তু সেই ব্যয়সাধ্য প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগে পত্রিকায় প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ যেমন তথ্য যাচাই করতে সহায়তা করে, তেমনই সাধারণভাবে অঞ্চলচর্চাকারীর পরিচয়ও তৈরি করে। কারো কারো ক্ষেত্রে তো সাময়িকপত্রই রচনার প্রধান বাহন। রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। তত্ত্ববোধিনী, সাধনা, ভারতী এবং বঙ্গদর্শন-এ সাদরে ঠাঁই পেত ইতিহাসচর্চা বিষয়ক প্রবন্ধ। ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবে ও উৎসাহে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রকাশ করেন ত্রৈমাসিক ঐতিহাসিক চিত্র। পত্রিকার প্রস্তাবনায় লেখা হয়েছিল :

আমাদের ইতিহাসের অনেক উপকরণ বিদেশীয় পরিব্রাজকগণের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ; তাহা বহু ভাষায় লিখিত বলিয়া আমাদের নিকট অপরিজ্ঞাত ও অনাদৃত। মুসলমান বা ইউরোপীয় সমসাময়িক ইতিহাস লেখকগণ যে সকল বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন তাহারও অদ্যাপি বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয় নাই। পুরাতন রাজবংশের কাগজপত্রের মধ্যে যে সকল ঐতিহাসিক তত্ত্ব লুক্কায়িত আছে তাহার অনুসন্ধান লইবারও ব্যবস্থা দেখা যায় না।…লিখিত ভ্রমণ কাহিনি ও ইতিহাসাদি প্রামাণ্য গ্রন্থের অনুবাদ, অনুসন্ধানলব্ধ নবাবিষ্কৃত ঐতিহাসিক তথ্য, আধুনিক ইতিহাসাদির সমালোচনা এবং বাঙালি রাজবংশ ও জমিদার বংশের পুরাতত্ত্ব প্রকাশিত করাই (এই প্রস্তাবিত পত্রের) মুখ্য উদ্দেশ্য।

পত্রিকার প্রকাশকালে শুভেচ্ছা জানান রবীন্দ্রনাথ, ‘সমস্ত ভারতবর্ষের সম্বন্ধে আশা করিতে পারি না, কিন্তু বাংলার প্রত্যেক জেলা যদি আপন স্থানীয় পুরাবৃত্ত সংগ্রহ করিতে আরম্ভ করে, প্রত্যেক জমিদার যদি তাহার সহায়তা করেন এবং বাংলার রাজবংশের পুরাতন দপ্তরে যে-সকল ঐতিহাসিক তথ্য প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে—ঐতিহাসিক চিত্র তাহার মধ্যে প্রবেশাধিকার লাভ করিতে পারে, তবেই এই ত্রৈমাসিক পত্র সার্থকতা প্রাপ্ত হইবে।…যাহা তথ্য হিসাবে মিথ্যা অথবা অতিরঞ্জিত, যাহা কেবল স্থানীয় বিশ্বাস-রূপে প্রচলিত, তাহার মধ্যেও অনেক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। কারণ ইতিহাস কেবলমাত্র তথ্যের ইতিহাস নয়, তাহা মানবমনের ইতিহাস, বিশ্বাসের ইতিহাস।’

সতীশচন্দ্র মিত্র যখন যশোহর-খুলনার ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ করছেন, তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হচ্ছে ভারতী, শিল্প ও সাহিত্য, ঐতিহাসিক চিত্র প্রভৃতি সাময়িকপত্রে। পরে সেইসব লেখা যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। যোগীন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন :

প্রথমে ময়মনসিংহ হইতে প্রকাশিত ‘আরতি’ নামক মাসিক পত্রিকাতে ‘বিক্রমপুরের ইতিবৃত্ত’ নামে বিক্রমপুরের কতকাংশ প্রকাশিত হয়, তৎপরে ‘প্রবাসী’, ‘জাহ্নবী’, ‘নব্য ভরত’, ‘সুপ্রভাত’, ‘মানসী’, ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ ও ‘সাহিত্য’ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাদিতেও এতদ্সম্পর্কিত বহু প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হইয়াছিল। এখন সে সকল প্রবন্ধাদি সংশোধিত, পরিবর্তিত ও বহু নূতন নূতন বিষয় সন্নিবিষ্ট করিয়া বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রকাশ করিলাম।

এ প্রবন্ধে পরে আমরা দেখব, কীভাবে সুধীরকুমার মিত্রও তাঁর ক্ষেত্র সমীক্ষার তথ্যগুলি প্রাথমিক খসড়া হিসাবে নিবন্ধাকারে প্রকাশ করেন সাময়িকপত্রে, প্রাপ্ত মতামত যাচাই করে, সংশোধন ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে পৌঁছোচ্ছেন ‘হুগলি জেলার ইতিহাস’-এ।

কেবলমাত্র বাংলার ভাষার প্রধান সাময়িক পত্রগুলি নয়, উনিশ শতকের শেষদিক থেকেই আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার দেখা মেলে বাংলা দেশের বিভিন্ন জেলার স্থানীয় পত্রপত্রিকাতেও। তমোলুক পত্রিকা, হালিশহর পত্রিকা, মুর্শিদাবাদ সম্বাদপত্রী, চুঁচুড়া বার্তাবহ, শ্রীহট্ট দর্পণ, বরিশাল হিতৈষী, বাঁকুড়া দর্পণ, বীরভূম বার্তা, রাজশাহী সমাচার প্রভৃতি পত্রিকা সে অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা তুলে ধরতে থাকে। আঞ্চলিক ইতিহাসের অপেশাদার গবেষকদের রচনা-নিবন্ধ প্রকাশের প্রধান মাধ্যম ছিল এসব স্থানীয় পত্রপত্রিকা। বাংলা সাময়িকপত্রে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা বিষয়ক যে রচনাপঞ্জি অশোক উপাধ্যায় সংকলন করে চলেছেন তা থেকে এই সম্ভারের বিপুলতা উপলব্ধি করা যায়।

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর একটি তথ্য-নির্মাণের ধারা উল্লেখযোগ্য। বাংলা দেশের বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের কুলগ্রন্থ, কুলগৌরবের অতিরঞ্জিত বর্ণনা সত্ত্বেও এক ধরনের সামাজিক ইতিহাস বহন করে। ওই কুলগ্রন্থাবলি থেকে সামাজিক ইতিহাস সংকলন শুরু করেন নগেন্দ্রনাথ বসু। ১৯০০-১৯৩৩ সময়কালে প্রকাশিত হয় নগেন্দ্রনাথ বসুর বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস-এর তেরোটি খন্ড। খ্যাতিমান পরিবারগুলির, বিশেষত, জমিদার ও ধনাঢ্য পরিবারগুলির পরিচয় সংকলন ও প্রকাশের একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা শিবেন্দু শাস্ত্রীর বাঙ্গালার পারিবারিক ইতিহাস, সুরেন্দ্রনাথ বসুর ভারত গৌরব (১৯১৬), জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমারের বংশপরিচয় (২৬ খন্ড, ১৯২১-৪০)। পারিবারিক উদ্যোগে নিজেদের বংশ পরিচয় বাচক পুস্তিকার সংখ্যা অগণন। সুধীরকুমার মিত্র-র ইতিহাসচর্চার সূত্রপাতও হয় এমনই একটি পুস্তিকার প্রকাশের মধ্য দিয়ে—জেজুরের মিত্র বংশ।

‘হুগলি জেলার ইতিহাস’ রচনার প্রয়াস

উইলিয়ম উইলসন হান্টার সম্পাদিত এ স্ট্যাটিসস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল গ্রন্থমালার তৃতীয় খন্ডের দ্বিতীয় অংশে ছিল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব দি ডিস্ট্রিক্ট অব হুগলি ইনক্লুডিং দি ম্যাজিস্টেরিয়াল ডিস্ট্রিক্ট অব হাওড়া। হুগলি জেলার প্রাকৃতিক অবস্থা, জনবিন্যাস, অর্থনীতি, শহর-নগর, ঐতিহাসিক স্থান ও জনজীবনের এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি। প্রকাশকাল ১৮৭৬ সাল। এর কয়েক বছর পরে ১৮৮৮ সালে হুগলির জেলাশাসক জর্জ টয়েনবি জেলা রেকর্ডরুমে রক্ষিত ১৭৯৫ থেকে ১৮৪৫ সালের দলিলপত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে লিখলেন, এ স্কেচ অব দি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব দি হুগলি ডিস্ট্রিক্ট ফ্রম ১৭৯৫ টু ১৮৪৫ উইথ সাম অ্যাকাউন্ট অব দি আর্লি ইংলিশ, পোতুর্গিজ, ডাচ, ফ্রেঞ্চ অ্যাণ্ড ড্যানিশ সেটলমেন্টস। প্রশাসনিক সুবিধার্থে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলাকে উত্তর-দক্ষিণে দু-ভাগ করা হয় এবং দক্ষিণাংশের নাম হয় হুগলি জেলা। ১৮৪৫ সালেই হুগলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাওড়া জেলা হিসাবে গঠিত হয়। ওই বছরেই দু-টি পৃথক চুক্তির বলে ডাচশাসিত হুগলি শহর এবং দিনেমার বাণিজ্যনগরী শ্রীরামপুর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে হুগলি জেলার অংশ পরিণত হয়। সুতরাং, টয়েনবির বিবরণী থেকে হুগলি জেলার প্রথম পঞ্চাশ বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। সরকারি প্রকাশনার মধ্যে এরপর যে বইটির নাম আসে তা ও’ম্যালি এবং মনমোহন চক্রবর্তী সম্পাদিত বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার—হুগলি (১৯১২)।

অন্যদিকে উনিশ শতকের শেষার্ধে অন্তত তিনটি পারিবারিক ইতিহাসের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে—প্রমথনাথ বর্মণের সিঙ্গুরের স্বর্গীয় জমিদার দ্বারকানাথ বাবু ও তাঁহার বংশাবলীর জীবনচরিত (১৮৮৭), চুঁচুড়ার প্যারীলাল সোম রচিত আমার ও আমার পূর্বপুরুষের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত (১৮৯৪) এবং বাঁশবেড়িয়ার রাজবংশের ইতিহাস সংক্রান্ত বই এ. জি. বোয়ারের দি ফ্যামিলি হিস্ট্রি অব বাঁশবেড়িয়া রাজ (১৮৯৬)। ১৯০৬ সালে শম্ভুনাথ দে লিখলেন হুগলি—পাস্ট অ্যাণ্ড প্রেজেন্ট। ৫১০ পৃষ্ঠার এই বিপুল গ্রন্থে হুগলি শহরের ইতিহাস বিস্তৃতভাবে বর্ণিত। হুগলি জেলার কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়ে ইতিপূর্বে অন্য কোনো ইতিহাস-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। ১৩২০ সাল থেকে ১৩৩৫ সালের মধ্যে জেলার বিভিন্ন অঞ্চল, মূলত গুরুত্বপূর্ণ শহর ও মহকুমাভিত্তিক গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হতে থাকে। অবনীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (উত্তরপাড়া), বসন্তকুমার বসু (শ্রীরামপুর মহকুমা), মতিলাল রায় (চন্দননগর), হরিহর শেঠ (চন্দননগর), মুণীন্দ্র দেবরায় (বাঁশবেড়িয়া)—এদের প্রত্যেকের এক বা একাধিক গ্রন্থ আজও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র হিসাবে ব্যবহৃত তো হয়ই, সুপাঠ্য গ্রন্থ হিসাবেও তাঁদের গুরুত্ব অম্লান।

এর মাঝখানে ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে ডি. জি. ক্রুফোর্ডের এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব দি হুগলি ডিস্ট্রিক্ট। ৮০ পৃষ্ঠার এই বইটির প্রকাশক ছিল, বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেস। লেখক হুগলি জেলার প্রাচীন ইতিহাস বিবৃত করা ছাড়াও ওই জেলায় পোর্তুগিজ, ইংরেজ, ডাচ, ড্যানিশদের আগমন এবং অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির ব্যবসা বাণিজ্যের কথাও বর্ণনা করেছেন। এর সঙ্গে তিনি হুগলি জেলার বেশ কিছু স্থানের আলোচনাও করেছিলেন, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যাধিক্য ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষায় সমগ্র জেলা ধরে পরিকল্পিত জেলা ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করেন অম্বিকাচরণ গুপ্ত। এককালে বটতলার প্রকাশকদের মারফত এঁর গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, ধর্মকথা ইত্যাদি বহু বই প্রকাশিত হয়। প্রদীপ এবং সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা-য় তাঁর গবেষণা নিবন্ধও স্থান পেত। অম্বিকাচরণের হুগলী বা দক্ষিণ রাঢ় (প্রথমার্ধ) কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ১৩২১ বঙ্গাব্দে। এরপর ১৩৩২ সালে বিধুভূষণ ভট্টাচার্য লেখেন ও প্রকাশ করেন হুগলী ও হাওড়ার ইতিহাস।

সুতরাং, ১৯৩৯ সালে বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতি সম্মেলনের দৌলতপুর অধিবেশনে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত যখন যুবক সুধীরকুমারকে উৎসাহিত করছেন জেলার ইতিহাস রচনায়, তখন যশোহর-খুলনা, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, ঢাকা, বাখরগঞ্জ বা বিক্রমপুরের যে মানের জেলা ইতিহাস রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে, তাদের তুল্য কোনো জেলা বিবরণী হুগলি জেলায় অনুপস্থিত। অতএব ইতিমধ্যে জেজুরের মিত্র বংশ লিখে রবীন্দ্র-প্রশংসাধন্য, লেখক যশপ্রার্থী, উদ্যমী সংগঠক সুধীরকুমার তাঁর নিজের জেলার ইতিহাস প্রণয়নে ব্রতী হবেন এ আর আশ্চর্য কী!

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে সম্মান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘অনেক পন্ডিত আছেন, তাঁরা কেবল সংগ্রহ করতেই জানেন। হরপ্রসাদ জ্ঞানের উপাদানগুলিকে শোধন করে নিতে পেরেছিলেন।’ হুগলি জেলার ইতিহাস নির্মাণে এই উপাদান শোধনের সমস্যার বিষয়ে সর্বদা সচেতন থেকেছেন সুধীরকুমার। সচেতন থেকেছেন তথ্যের প্রামাণ্যতা নিয়ে। সামর্থ্যকে উজাড় করে দিয়েছেন সত্য আবিষ্কারের চেষ্টায়। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচলিত মতের বিরোধিতা করেছেন। গ্রামে-গঞ্জে দীর্ঘকাল পরিশ্রম করে যেমন কাজে লাগিয়েছেন নতুন নির্ভরযোগ্য উপাদান; চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, পান্ডুলিপি, প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনই বিদেশি সূত্র, যতটুকু পেয়েছেন, সদব্যবহার করেছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন লেখার পিছনে দেখাকে। কেবল অতীতচর্চার বশে নিজের জেলার ইতিহাস লেখা নয়; দেশ, জাতি, স্বজন, সময়কে জানা ও চেনানোর দায়বোধ থেকে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার যে ধারার সূচনা হয়েছিল সতীশচন্দ্র মিত্র, নিখিলনাথ রায়, গৌরীহর মিত্র, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত-র প্রয়াসে, তাকে পুষ্ট ও সম্প্রসারিত করলেন সুধীরকুমার।

অথচ জেলার বহু শিক্ষিত মানুষের ঔদাসীন্য তাঁকে ব্যথিত করেছে। চিঠি লিখেছেন, উত্তর পাননি। অর্ধশিক্ষিত, দরিদ্র গ্রামবাসী আপ্যায়নে, সঙ্গদানে তাঁকে আপ্লুত করেছেন। বিপরীতে বহু শিক্ষিত, সম্পন্ন মানুষ তাঁকে জর্জরিত করেছেন বিদ্রূপবাক্যে। প্রথাগত গবেষক নন বলে জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রাইভেট রিডিং রুমে আসন পাননি।

হুগলী জেলার ইতিহাস প্রকাশের পর পাঠক সমাজ থেকে বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। তখনও স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি হয়নি। সদ্য অতীত মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণা ছিল যে স্বাদেশিকতা, এই বইটির মধ্যে সেই স্বদেশচেতনার অন্তর্বস্তু শনাক্ত করতে পাঠকসমাজের ভুল হয়নি। স্বাধীন দেশ ও জাতি গঠনের স্বপ্নের শরিক যাঁরা, তাঁরা এ ধরনের বইয়ের সঙ্গে আত্মিকতা বোধ করবেন, তাও স্বাভাবিক। গ্রন্থ প্রকাশের অব্যবহিত পরে দেশ পত্রিকার পুস্তকসমীক্ষায় লেখা হয়েছিল :

একটি জেলার মধ্যে ইতিহাস রচনার এমন বিচিত্র ও বিপুল পরিমাণ উপাদান থাকিতে পারে, এই গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বে ইহা ধারণা করা সাধারণের পক্ষে অসম্ভব হইত। গ্রন্থকার দীর্ঘকালব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং বহু ক্লেশ স্বীকারপূর্বক এ সকল বিস্মৃতপ্রায় অমূল্য উপাদান সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছেন। গ্রন্থখানি হুগলি জেলার কেবল ইতিহাসমাত্রই হয় নাই, ইহা হুগলির শিক্ষা, সংস্কৃতি, লোকজন, প্রাকৃতিক সম্পদ, সাহিত্য, ভূগোল, পুরাতত্ত্ব সব কিছু লইয়া একখানি সুখপাঠ্য সাহিত্য-গ্রন্থে পরিণত হইয়াছে।…বাংলার ইতিহাসের উপাদান গবেষকের গবেষণাশালায় কতটা আছে জানি না, কিন্তু তাহা যে বাংলার নগরে পল্লিতে, বনে জঙ্গলে এবং সাধারণ লোকজনের মধ্যে ছড়াইয়া রহিয়াছে একথা ঠিক। এই সকল উপাদান সংগ্রহ করিতে আজ গবেষকের যতটা প্রয়োজন, তার চাইতে বেশি প্রয়োজন শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রীসুধীরকুমার মিত্রের ন্যায় অক্লান্ত পরিশ্রমীর।’ (দেশ, ১৯ চৈত্র, ১৩৫৫)

এর চোদ্দো বছর পর প্রকাশিত হয় বইটির পরিবর্ধিত সংস্করণ হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ-এর প্রথম খন্ড। মোট তিন খন্ডের এই পরিবর্ধিত সংস্করণটি সম্পর্কে নিশীথরঞ্জন রায় লিখেছিলেন :

বস্তুত, এতে রয়েছে মধ্য যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্রসারিত একটি যুগের ইতিহাস যা অবলীলাক্রমে উত্তীর্ণ হয়েছে বৃহত্তর বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের স্তরে।

এবারেও দেশ, আনন্দবাজার, দৈনিক বসুমতী, যুগান্তর, অমৃতবাজার ইত্যাদি বাংলা ভাষার প্রথম সারির সংবাদ ও সাময়িকপত্রে সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। দেশ পত্রিকা পরিবর্ধিত সংস্করণকে সময়োপযোগী বলে স্বাগত জানায়। একই সঙ্গে বিষয় বিন্যাসের ত্রুটি চিহ্নিত করে গঠনমূলক সমালোচনার পরে বইটির তথ্য সংকলন রীতি কতদূর ইতিহাস পদবাচ্য সে বিষয়ে মতভেদ ব্যক্ত করে। বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার শতাব্দী প্রাচীন ধারাটিকে বারবার এমত মৌলিক প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। বেভারিজের হিস্ট্রি অব বাখরগঞ্জ, হান্টারের এ স্ট্যাটিসস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল গ্রন্থমালা এবং জেলাভিত্তিক গেজেটিয়ারগুলি জেলার তথ্য সংকলনে যে বিন্যাসরীতি প্রচলন করে, সেই সুসংবদ্ধ পরিকল্পিত বিন্যাসরীতি থেকে বাংলা ভাষার অঞ্চলচর্চাকারীরা সরে আসতে পারেননি। সাধারণ চোখে দেখলে সতীশচন্দ্র মিত্র, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বা সুধীরকুমার মিত্র সকলেই ওই বিন্যাস রীতিকে সামনে রেখেই নিজের নিজের জেলার ইতিহাসের কাঠামো তৈরি করেছেন। কিন্তু, তাঁদের মৌলিকত্ব কাঠামো নির্মাণে নয়। পূর্বোক্ত প্রশাসকবৃন্দ প্রণীত গ্রন্থগুলি সরকারি তথ্যভিত্তি নির্মাণের প্রয়াস হওয়ায় মূলত বিভিন্ন সরকারি রিপোর্ট ও মহাফেজখানার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ওই গ্রন্থমালা রচিত। হান্টার স্থানীয় ইতিহাস, জনশ্রুতি (তাঁর নিজের ভাষায় wayside history) ইত্যাদি সংগ্রহ করলেও শেষাবধি সরকারি বাধায় তা স্ট্যাটিসস্টিক্যাল অ্যাকাউন্টে যুক্ত করতে পারেননি। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রথম প্রজন্মের আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাকারীরা জনশ্রুতি, লোক ইতিহাস, প্রবাদ প্রবচন, জমিদার পরিবার ও অন্যান্য খ্যাতকীর্তি পরিবারগুলির পরিচয় ও ইতিহাস, ব্যক্তি পরিচয়, জাতি পরিচয় বিষয়ক অনুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ করে পরিবেশন করেছেন। মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণে নয়, তাঁদের মৌলিকত্ব তথ্য সংগ্রহের দেশজ রীতিতে। তাঁদের অভিনবত্ব তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিতে—সকলেই তাঁদের জেলার গ্রাম-নগর-পল্লি পায়ে হেঁটে না দেখে তৃপ্ত হননি, এভাবে যেন জেলার সঙ্গে আত্মিক যোগ আরও নিবিড় হয়েছে। ফলে প্রশাসনিক প্রকাশনাগুলির কাছাকাছি বিন্যাস কাঠামোতে যে তথ্য তাঁরা পরিবেশন করেছেন, তা মৌলিক চরিত্রে পৃথক, অভিনব ও সপ্রাণ হয়ে উঠেছে। মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের গুণে তা ইতিহাস পদবাচ্য হয়ে উঠেছিল কি-না, সে প্রশ্ন এখানে গৌণ। ইতিহাসের বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে যে আঞ্চলিক-বিবরণ তাঁরা পেশ করেছেন, তা যে ভবিষ্যতে পেশাদার ঐতিহাসিক ও অপেশাদার অঞ্চলচর্চাকারীর কাছে তথ্যের আকর, তা অনস্বীকার্য।

সুধীরকুমার মিত্রের হুগলী জেলার দেবদেউল বইটি এ প্রসঙ্গে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। এটিকে হুগলী জেলার ইতিহাসের পরিপূরক গ্রন্থ বলা চলে। পরিপূরক কারণ, এ বইটিও লেখকের মনে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে হুগলি জেলার ইতিহাস রচনার তথ্য সংগ্রহের সময়েই। ১৯৭১ সালে কলকাতার আনন্দধারা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বইটির নিবেদনে লেখক লিখেছিলেন, ‘আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে হুগলি জেলার ইতিহাস রচনার তাগিদে পাঁচ বছর ধরে হুগলির আঠারো-শো গ্রাম সরেজমিনে পর্যটন করার সময় হুগলি জেলার আড়াই হাজার ছোটো বড়ো মাঝারি ধরনের বিভিন্ন মন্দির দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়। আরামবাগের দুর্গম অঞ্চলের গ্রাম থেকে শুরু করে শ্রীরামপুর, চুঁচুড়া প্রভৃতি শহর ও সিঙ্গুর, ধনিয়াখালি প্রভৃতি আধা শহরে কত রকমের ভগ্ন, অর্ধভগ্ন, বিগতশ্রী দেবদেউল যে দেখেছি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিক থেকে তা অমূল্য বলা যায়।’ এই বইটি প্রকাশের আগেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পূর্ত দপ্তরের উদ্যোগে বিভিন্ন জেলার মন্দির ও পুরাকীর্তির বিবরণ প্রকাশনা সূচিত হয়েছিল। কিন্তু পরিবেশনার ধরনে পুরাকীর্তি গ্রন্থমালার সঙ্গে সুধীরকুমার মিত্রের হুগলী জেলার দেবদেউলের অনেক পার্থক্য। বিন্যাসরীতিও সম্পূর্ণ নিজস্ব। ‘পূর্বাভাস’ অংশে লেখক মন্দির স্থাপত্য রীতি, পোড়ামাটির অলংকরণ ও মূর্তিকলা বিষয়ে এবং ‘দেবদেবী’ অংশে বাংলার বিভিন্ন দেব-দেবীর পৌরাণিক ও শাস্ত্রীয় পরিচয় বিষয়ে সাধারণ আলোচনা করেছিলেন। তৃতীয় অংশে হুগলি জেলার বিভিন্ন মন্দিরের অবস্থান, পরিচিতি, স্থাপত্য, অলংকরণ, লিপি পরিচয় আলোচিত। চতুর্থ ও পঞ্চম অংশে আলোচিত হয়েছিল জেলার মসজিদ ও গির্জাগুলি। বইটির সপ্রশংস ভূমিকা লিখেছিলেন আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। হুগলী জেলার ইতিহাস বইটিতে থানাভিত্তিক বিভিন্ন গ্রাম-নগর এবং সেখানকার মন্দির মসজিদের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়েছিল, তার পরিপূরক বিশদ তথ্যের ভান্ডার হিসাবে হুগলী জেলার দেবদেউল পাঠক সমাজের নজর কাড়ে।

সুধীরকুমার তাঁর আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাকে, বিশেষত হুগলি জেলাকে কেন্দ্র করে বঙ্গসমাজের ইতিহাস নির্মাণকে তাঁর সারাজীবনের সাধনায় পরিণত করেছিলেন। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ যেমন তাঁর গোটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মহাভারত প্রকল্পে, কিংবা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান সংকলনে। এক খন্ডের হুগলী জেলার ইতিহাস থেকে তিন খন্ডে হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ-এ উত্তরণের পরেও তাঁর জিজ্ঞাসা ক্ষান্ত হয় না। সদ্য অতীত প্রকাশনায় বাদ পড়ে যাওয়া তথ্য ও সত্যের সন্ধানে তিনি নিজেকে চিরজিজ্ঞাসু করে রাখেন। বঙ্গসমাজ বইটির যে নিজস্ব খন্ডগুলি তিনি ব্যবহার করতেন, তার প্রতিটি পাতার মার্জিনে এবং মূলপাঠে রয়ে গেছে নিজের হাতে করা অজস্র সংশোধন ও সংযোজন। মার্জিন স্থান সংকুলান না হলে টুকরো কাগজে লিখে তারকাচিহ্নিত করে আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছেন। সংবাদপত্র সাময়িকপত্রে প্রকাশিত সংবাদ ও নিবন্ধ এমনকী হ্যাণ্ডবিলও সংগ্রহ করে পাতার মধ্যে ভাঁজ করে রেখেছেন, নানা অংশ ভবিষ্যৎ সংকলনে গ্রহণের ভাবনায় চিহ্নিত করে রেখেছেন। গ্রহণ-বর্জনের এই প্রয়াস এতটাই ব্যাপক যেন বহু পরিচিত, বহু আলোচিত, মুদ্রিত বইটির পরবর্তী সংস্করণের পান্ডুলিপি তৈরির নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সুধীরকুমারের জীবনব্যাপী সাধনার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠছে ভবিষ্যতের পাঠক-প্রজন্মের।

সূত্রনির্দেশ

 ১. ইতিহাসের রূপরেখা : গ্রাম জনপদ, তারাপদ সাঁতরা, আশাবরী পাবলিকেশন, ১৪০৮।

 ২. বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চা গ্রন্থপঞ্জী ১৮০১-১৯৯০, সম্পাদনা : সুনীলবিহারী ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, মার্চ ১৯৯৮।

 ৩. সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চা : সম্পাদনা : শেখর ভৌমিক, ইন্দিরা প্রকাশনী, কলকাতা, অগস্ট ২০০৫।

 ৪. আঞ্চলিক ইতিহাস : সম্পাদনা : সমীরকুমার পাত্র, শেখর ভৌমিক, ইন্দিরা প্রকাশনী, কলকাতা, মার্চ ২০০৭।

 ৫. বাংলা পুঁথি তালিকা নির্মাণ ও আত্মসত্তার রাজনীতি : মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, গৌতম ভদ্র, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৪১১।

 ৬. চিন্তার চালচিত্র : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ১৩০০-১৩৩০: গৌতম ভদ্র ও দীপা দে, পরিষৎ-এর শতবর্ষ পূর্তি স্মারক সংখ্যা (সম্পাদনা সত্যজিৎ চৌধুরি), পৌষ, ১৪০৩।

 ৭. ক. বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ধারা—রমাকান্ত চক্রবর্তী।

 খ. যোগেশচন্দ্র, রামানন্দ, সত্যকিঙ্কর ও এক আঞ্চলিক সত্তার নির্মাণ—শেখর ভৌমিক, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১১২ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, কার্তিক-পৌষ, ১৪১২।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *