সুধা

সুধা

জিনিস যখন ভাঙে সবাইকে জানিয়ে, জোরে শব্দ করে ভাঙে। সুধার হাত থেকে ফুলদানিটা পড়ে নিঃশব্দে ভেঙে গেল। পিসি গুনগুন করতে করতে ঘরে ঢুকছে। নার্ভাস থাকলেই পিসি এটা করে। বেসুরো গলায় গুনগুন করে গান গায়। পিসি এসেছে কাল বিকেলে। আসার পর থেকেই গুনগুন শুরু হয়েছে। কাল সন্ধে পর্যন্ত গানের কথা কিছু কিছু বোঝা যাচ্ছিল। রাতের দিকে অবশ্য কথা জড়িয়ে গেল। আজ সকাল থেকে অবস্থা আরও খারাপ। গলা থেকে শুধু বিনবিন ধরনের আওয়াজ বের হচ্ছে। সেই বিনবিন আওয়াজ থামিয়ে পিসি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘কী হল রে সুধা? হাতে ঝাঁটা কেন? আজ কি তোর ঝাঁটা নিয়ে ঘোরার দিন?’

সুধার খুব বিচ্ছিরি লাগছে। এই চমৎকার ফুলদানিটা পিসি এনেছে। আজ বিকেলে এতে ফুল সাজানোর কথা ছিল। সে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “ইস, ফুলদানিটা ভেঙে ফেললাম।’

পিসি একমুখ হেসে বলল, ‘ফুলদানি ভেঙেছিস! খুব ভাল করেছিস, বেশ করেছিস। কীভাবে ভাঙলি?’ পিসির আনন্দে সুধা ভীষণ অবাক হল। সে বলল, ‘কীভাবে ভাঙলাম মানে? হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। পিসি আরও বড় করে হেসে বলল, ‘সোনা মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে আমার। ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসার দিন মেয়ের হাত থেকে ফুলদানি পড়ে ভাঙা খুব ভাল লক্ষণ। আমার দিদিমা বলত, এর মানে হল, মেয়ে পছন্দ হবে। এই বিয়ে তোর কেউ ঠেকাতে পারবে না। আচ্ছা সুধা, ফুলদানিটা কোন হাত থেকে পড়েছে মনে আছে? যদি বাঁ হাত থেকে পড়ে থাকে তা হলে বুঝবি বেশি ভাল। দেখতিস আজই ওরা বরযাত্রীর সংখ্যা, কতজন আমিষ খাবে, কতজন নিরামিষ খাবে— সব বলে দিয়ে যেত। কিন্তু ফুলদানি না হয়ে যদি কাচের কাপ ভাঙত, তা হলে সমস্যা ছিল। বুঝতে হত, সব ঠিকঠাক হলেও ছেলেপক্ষের একটা ‘কিন্তু কিন্তু’ রয়ে গেছে। আর পাথরের যদি কিছু ভাঙত তা হলে ধরে নিতে হত, কোনও চান্স নেই। তোর পিসেমশাই যেদিন আমায় দেখতে যাবে, সেদিন বাড়ির সব পাথরের জিনিস সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। যাক, বড় ফাঁড়া কাটল। নে সর দেখি, কাচগুলো পরিষ্কার করি। তোর পিসেমশাইকে একটা ফোন করব। সে বেচারাও চিন্তায় আছে। বলব, আর চিন্তা কোরো না। সুধার বিয়ে ফাইনাল। তুমি কেটারারের সঙ্গে কথা বলো।’

সুধা মুগ্ধ হয়ে পিসির দিকে তাকিয়ে আছে। তার খুব খারাপ লাগছে। চোখ ফেটে জল আসছে। ইচ্ছে করছে, ছুটে গিয়ে এই বোকাসোকা ভালমানুষটাকে জড়িয়ে ধরে।

শোবার ঘরে ফোন বাজছে। সুধা গিয়ে ফোন ধরল।

‘বি কেয়ারফুল সুধা, বাড়িতে যেন কেউ সন্দেহ না করে। লাস্ট মোমেন্টে সন্দেহ করলে বিরাট কেলেঙ্কারি। সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। বিকেল পর্যন্ত হাসিখুশি থাকবে। কাউকে কিছু বুঝতে দেবে না। লোকগুলো আসবে কখন?’

সুধা চাপা গলায় বলল, ‘কতবার বলব? বলছি তো পাচটা বাজবে। কলকাতা থেকে এতটা পথ আসবে, দেরি তো হবেই।’

‘ভেরি গুড। যত দেরি হয় তত ভাল। তা হলে যেরকম ঠিক করা আছে সেভাবেই হবে।’

‘তুমি ফোন করেছ কেন? বাড়িতে ফোন করতে তোমায় মানা করেছি না? আমার ভয় করছে।’

‘ভয় করারই কথা। এতবড় একটা ভয়ের কাজ করছ, ভয় হবে না তো কী হবে?’

‘কাল থেকে পিসি এসে আছে। বাবা ছুটি নিয়েছে। এত কিছু হবে আমি জানতাম না। বাড়িতে খুব হইচই হচ্ছে।’

‘তুমিও হইচই করো।’

‘ওভাবে বলছ কেন? একটু আগে পিসির আনা একটা ফুলদানি ভেঙে ফেলেছি। রেয়ার জিনিস। বিদেশ থেকে কেনা। হংকং না সিঙ্গাপুর। পিসি কী বলল জানো?’

‘কী আর বলবে? বড়লোক আত্মীয়স্বজনরা গরিব কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবারকে যা বলতে পারে তাই বলবে। বেশ করেছিস ভাল করেছিস তো আর বলবে না। এসব মানুষদের আমার খুব ভাল করেই জানা আছে।’

‘না, তোমার জানা নেই। পিসি বলল, বেশ করেছিস, ভাল করেছিল। আমার খুব খারাপ লাগছে।’

‘বারবার খারাপ লাগছে খারাপ লাগছে কোরো না তো। সম্বন্ধটা তোমার পিসি এনেছে তাই এত আদিখ্যেতা। সামান্য একটা স্কুলমাস্টার পাত্রের জন্য একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি? সিঙ্গাপুরের ফুলদানি, জাপানের চায়ের কাপ, হল্যান্ডের পাপোশ। মিষ্টি কোথা থেকে আসছে? নাইজেরিয়া থেকে নিশ্চয়ই। ওখানে শুনেছি শিঙাড়া নিমকি খুব ভাল পাওয়া যায়।

‘তুমি এমন করে বলছ কেন? আমার বাড়ির লোকেরা তো কোনও দোষ করেনি। তারা তো কিছুই জানে না। যাই শোনো, আমি এখন বাড়িতে সব বলে দেব?’

‘এখন বলে দেবে! খেপেছ নাকি? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল সুধা? তুমি এখন বলবে আর তোমার বাবা-মা কী করবে? মেনে নেবে? বলবে, বেকার ছেলেটাকে খবর দে, ধুতি পাঞ্জাবি পরে রেডি হতে বল, আমরা পালকি পাঠিয়ে দিচ্ছি? অল রাবিশ। শেষ মুহূর্তে সবটা গোলমাল করে দিতে চাও নাকি? একদম মুখ বন্ধ করে থাকে। স্টেশনে কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবে মনে আছে তো? ভেরি গুড, তাও আর একবার বলছি, মন দিয়ে শোনো। স্টেশনে ঢুকেই ওভারব্রিজের তলায় আসবে। আমি থাকল বুক স্টলের কাছে। তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। তাতে কিছু এসে যায় না। আমি তোমাকে ঠিক দেখে নেব। খামোকা ছটফট করবে না। ছটফট করলে লোকের সন্দেহ হবে। সেরকম হলে স্টল থেকে একটা পত্রিকা তলে ওলটাবে। ট্রেন আসার আগেই আমি দ্যাখা দেব। চিন্তা কোরো না, কলকাতায় সব ব্যবস্থা করা আছে।’

পিসি কলকাতা থেকেই সব ব্যবস্থা করে এনেছে। শুধু ফুলদানি নয়, আরও অনেক কিছু এনেছে। বোন চায়নার কাপ ডিশ, রং মিলিয়ে ট্রে, এমনকী টেবিল ক্লথ পর্যন্ত। জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে পিসি বলল, ‘হ্যাঁরে রমলা, সুধার আঁকা ছবিটবি কিছু আছে নাকি?’

রমলা অবাক হয়ে বলল, ‘ছবি! ছবি দিয়ে কী হবে দিদি? দেয়ালে টাঙাবে নাকি?’

বোকার মতো কথা বলিস না। বোকার মতো কথা বলিস বলেই আজ তোর এই হাল। এত সুন্দর মেয়েটার এখনও বিয়ে দিতে পারলি না। ছেলের বাড়ির লোকদের শুধু মেয়ে দেখালেই চলবে?মেয়ের হাতের কাজ দেখাতে হবে না? আজকাল ছবি আঁকিয়ে মেয়েদের কীরকম ডিমান্ড জানিস? জানবি কী করে? থাকিস তো এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে। কলকাতায় আর্টিস্ট পাত্রীদের নিয়ে টানাহেঁচড়া ব্যাপার। ইস, অ্যাকাডেমিতে যদি সুধার একটা এগজিবিশনের ব্যাকগ্রাউন্ড থাকত তা হলে একেবারে মার কাটারি করে দিতাম। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এসে লাইন লাগাত। তবে এ-ছেলেও ভাল। স্কুলমাস্টার তো এখনকার দিনে ফেলনা কিছু নয়।’

রমলা বলল, ‘দিদি, সুধা ছবি আঁকতে পারে না, কিন্তু গাইতে পারে।’

আবার বোকার মতো কথা। ওসব ছিল আমাদের সময়কার ব্যাপার। এক দঙ্গল মিলে দেখতে এল। পাত্রের দাদু বলল, রামপ্রসাদি জানো মা? মেয়ে গাইল, মায়ের পায়ের জন্য হয়ে। ছেলের বাবা বলল, ডি এল রায়। মেয়ে গাইল, বসিয়া বিজনে। ছেলের আবদার হল রবীন্দ্রসংগীত শুনবে। তখন শোনাতে হল, কী রাগিনী বাজালে হৃদয়ে। মেয়ে দেখা তো নয় যেন গানের জলসা বসেছে। ভাবটা এমন যেন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কোনও কাজই থাকবে না, শুধু উঠতে গান আর বসতে গান। সেসব ভণ্ডামির দিন গেছে। এখন গানে মাইনাস পয়েন্ট। খবরদার সুধা, গান জানো কিনা জিজ্ঞেস করলে সোজা বলে দিবি, জানি না।’

যত সময় যাচ্ছে সুধার খারাপ লাগাটা বাড়ছে। কেন এমন হচ্ছে? সে তো জেনে বুঝেই ‘হ্যাঁ’ বলেছিল। তা হলে কেন খারাপ লাগবে?

‘কী রে সুধা, মুখটা ব্যাজার কেন? মন খারাপ? তা তো হবেই। ছেলে দেখতে আসা মানেই শ্বশুরবাড়ির দিকে এক পা। পাকা দেখার দিন তো আমি কেঁদেকেটে একসা করেছিলাম। তোর যদি ইচ্ছে হয়, তুইও একটু কেঁদে নে।’

সুধা চমকে উঠল। ধরা পড়ে যাচ্ছে নাকি? হাসিমুখে বলল, ওমা, কাঁদব কেন? কী যে বলো। পিসি, আমি একটা দারুণ হাতের কাজ জানি।’

পিসি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী কাজ?’

‘কাপড় কাচা। তুমি যদি বলো, ছেলের বাড়ির লোকদের আজ একটা ডেমনস্ট্রেশন দিয়ে দিতে পারি। ধরো, এক বালতি সাবান জল নিয়ে গিয়ে ওদের একটা বেকভার কেচে দেখালাম।’

‘ফাজলামি করছিস? আর শোন, এখন আর একদম হাসাহাসি করবি না। বেশি হাসলে মাসলে ব্যথা হয়ে যাবে, বিকেলে ঠিক সময় আর হাসতে পারবি না। গালে লাগবে।’

সুধা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘আমি কি বিকেলে সারাক্ষণ হাসিহাসি মুখে বসে থাকব?’

‘সারাক্ষণ হাসবি কেন? সবাই যখন হাসবে তখন একদম হাসবি না। ফাজিল ভাববে। মনে রাখবি সুধা, ছেলে হল গিয়ে অঙ্কের মাস্টার। অঙ্কের মাসটাররা সব বরদাস্ত করে, ফাজলামি বরদাস্ত করে না। ভাল পাত্র এনে দেব বলেছিলাম, এনে দিলাম। এবার তোমরা মা-মেয়ে মিলে ঠিক করো, হাসবে না কাঁদবে। রমলা, ব্রজ গেল কোথায়? সামান্য মিষ্টি কিনতে এত সময় লাগে? উফ, তোদের হাতে যেটা ছাড়ব সেটাই গোলমাল করে ফেলবি।’

কথাটা ভুল নয়। গোলমাল হয়েছে। ব্রজেশ্বর কোথাও জল-ভরা তালশাঁস সন্দেশ পায়নি। স্টেশনের কাছে একটা দোকানে এই ধরনের সন্দেশ ছিল ঠিকই, কিন্তু ভেঙে দ্যাখা গেল, তাতে জল নেই। শুকনো খটখট করছে। ব্রজেশ্বর কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘বিকেলের মধ্যে কিছু ব্যবস্থা হয় না?’ দোকানদার বিরক্ত মুখে বলল, ‘না, হয় না। সন্দেশে জল ভরে দেওয়ার কোনও সিস্টেম আমাদের নেই। এইটা লাগলে নেন, নইলে ছেড়ে দেন।’ ব্রজেশ্বর খুবই চিন্তিত। দিদি তাকে যে লিস্ট দিয়েছে, তাতে জলভরা রয়েছে এক নম্বরে। সেই লিস্ট গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক হচ্ছে না। দিদির উদ্যোগেই সুপার গতি হতে চলেছে। সামান্য সন্দেশে সেই গতিপথ রুদ্ধ হলে খুব খারাপ হবে। প্রথম দিন বিয়ের প্রস্তাব শুনে বলেছিল, ‘সেকী, এখন বিয়ে কীসের? সুধার বয়সই বা কত? সবে লে কলেজে ঢুকল। তা ছাড়া হাতে টাকাপয়সা নেই।’ রমলা কড়া গলায় বলল, ‘না, এখনই হবে। টাকাপয়সা কোনও দিনই তোমার হবে না। দিদি ঠিকই বলেছে, অভালের ঘরে সুন্দরী মেয়েকে বেশিদিন রাতে নেই। ছেলের বাবার সঙ্গে দিদিকে এই কথা বলতে বলো।’

মিষ্টির বাক্স, দইয়ের হাঁড়ি হাতে ব্রজেশ্বর যখন বাড়ি ফিরল, সবার চোখে জল। সুধা, সুধার পিসি, সুধার মা তিনজন যেন কান্নাকাটির কম্পিটিশন লাগিয়েছে। এমনকী রতনের মা-ও বারবার চোখে আঁচল চাপা দিচ্ছে। ঘর-ভরতি ধোঁয়া। মাটির হাঁড়িতে নারকেলের ছোবড়া জ্বালানো হয়েছে। তার মধ্যে আবার একগাদা ধুনো।

ব্রজেশ্বর চোখে রুমাল দিয়ে বলল, ‘ব্যাপার কী রে সুধা?’ সুধা নাক টেনে বলল, ‘মশা তাড়ানো হচ্ছে না। পিসি বলেছে, সন্ধেবেলা যেন একটা মশাও ওদের ধারেকাছে আসতে না পারে।’

‘সেকী রে! সন্ধা পর্যন্ত এই ধোঁয়াকান্ড চলবে নাকি?’

বলা যাচ্ছে না, চলতেও পারে। চললে ভালই হয়। মেয়ে পছন্দ করে শ্বশুরবাড়ির সবাই কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাবে। শুধু কি মশা বাবা? এতক্ষণ পিসি ধুলো তাড়িয়েছে। রতনের মাকে দিয়ে ঘর ঝাড়িয়েছে। রতনকে দিয়ে বালতি বালতি জল ঢেলে বারান্দা ধুইয়েছে। এরপর বলছে বাড়িওলার পারমিশন নিয়ে ছাদ সাফাই অভিযানে নামবে?’

‘ছাদ! ছাদ কেন?’

‘তোমার হবু বেয়ান যদি ছাদে পায়চারি করতে চান। পিসি কোনও রিস্কের মধ্যে যেতে রাজি নয়।’

‘বলিস কী রে! দিদি তো বিয়ের আগেই বিয়েবাড়ির খাটনি খাটছে! হা হা।’

‘দাঁড়াও এখনই হেসো না। খাটনি আরও আছে। তুমি মিষ্টি কিনেছ নাকি? কিনলে সব নর্দমায় ফেলে দিয়ে এসো। পরিকল্পনা বদল হয়েছে। মায়ের পরিকল্পনায় পিসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নো দোকান বিজনেস। জলখাবার সব বাড়িতেই বানানো হবে। সেই কর্মকাণ্ড শুরু হবে দুপুরে। মা বানাবে, পিসি হেল্‌প করবে, আর আমি বিশ্রাম নেব। পরিবেশনের সময় অবশ্য আমার নামেই সবটা চালানো হবে। আমি ঘরে গিয়ে দরজা দিলাম বাবা। আর ধোঁয়ায় থাকলে দমবন্ধ হয়ে মারা যাব।’

ব্রজেশ্বর এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, ‘যা, তুই ঘরে যা।’ তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার এত ভাল লাগছে যে নড়াচড়া করতেও ইচ্ছে করছে না। মেয়ের বিয়েতে এত ভাল লাগে! এত ভাল!

সুধার ঘরে দরজা বন্ধ থাকায় ধোঁয়া নেই। তবু তার চোখ দিয়ে হু হু করে জল পড়ছে। তার সামনে খাতা। কাঁদতে কাঁদতেই সে কোনওরকমে লিখল, ‘মা বাবা পিসি আমায় তোমরা ক্ষমা কোরো।’ লেখার ওপর টপ টুপ করে চোখের জল পড়ছে। সুধা কেটে দিয়ে লিখল, ‘আমায় তোমরা মা ক্ষমা কোরো না।’ তারপর পাতাটা ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে ফেলল। এইসময় আবার ফোন বাজল।

‘সব ঠিক আছে সুধা? নাক টানছু কেন? সর্দি হয়েছে?’

“হ্যাঁ হয়েছে। এতবার যেন করছ কেন?’

‘এতবার কোথায়? মাত্র তো দু’বার করলাম। দেখছি, কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছ। কাউকে কিছু বলছ নাকি?’

‘না, এখনও বলিনি, তবে বলতে পারলে ভাল হত। ইস, পিসি নিজের হাতে ছাদে জল ঢালছে।’

‘ছাদে জল ঢালছে! কেন, ছাদে জল ঢালছে কেন? ওই মাস্টারটা ছাদে সাঁতার দেবে নাকি?’

‘ওনার নামে বলছ কেন? উনি কী করেছেন?’

‘সরি, টেনশনে মাথা ঠিক নেই। ও শোনো, শাড়িটাড়ি কিছু নিতে হবে না। ওরা সব কিনে রাখবে। এতক্ষণে নিশ্চয় কেনা হয়ে গেছে। তুমি শুধু ঠিক সময় চলে আসবে। ছাড়লাম। যাও এখন আনন্দ করো।’

‘মানে?’

‘মানে কিছু নয়। নিজের বিয়েতে আনন্দ করবে না তো কার বিয়েতে করবে? বিয়ে তো তোমার হচ্ছেই, কোথায় হচ্ছে সেটা অন্য কথা।’

‘আমি রাখছি। কেউ মনে হয় দরজা ধাক্কাছে। আর ফোন কোরো না।’

দুপুরে খাওয়ার পর ঠিক পর পর তুলকালাম কাণ্ড হল। পিসেমশাই গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছে। একা আসেনি, পাইকপাড়া থেকে জেঠুমণি জেঠিমাকে নিয়ে এসেছে। সোদপুর থেকে তুলেছে মেজমাসি, মেজমাসির মেয়ে আর তাদের রাঁধুনি মহিলাকে। এই মহিলা নাকি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সবথেকে ভাল মাছের কচুরি বানাতে পারে। এখানেই শেষ নয়, গাড়ির পেছনে পেছনে একটা ট্যাক্সিও এসেছে। তাতে গম্ভীরমুখে বসে আছে অনন্তকাকা রত্নাকাকিমা। তারা কিছুতেই ট্যাক্সি থেকে নামতে চাইছে না। খুব রেগে আছে। কেন তাদের আগে বলা হয়নি।

পিসেমশাইকে একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে পিসি চোখ বড় করে বলল, ‘কী সর্বনেশে কাণ্ড! এ কী করেছ? সবাইকে নিয়ে এসেছ কেন? আমি তো বলেছিলাম ফাইনাল হলে সবাইকে খবর দেওয়া হবে।’ পিসেমশাই তার মোটা বউকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলল, ‘এতক্ষণে একটা বিয়েবাড়ি বিয়েবাড়ি চেহারা হয়েছে। ন্যাড়া বাড়িতে আনন্দের কাজ হয় নাকি? চিৎকার চেঁচামেচি হবে, হইচই হবে, তবেই না। এই যে সুধা, তোর পাগলা পিসিকে বুঝিয়ে বল দেখি। অত ঢাক ঢাক গুড় গুড়ের কী হয়েছে? এমন তো নয়, যে তুই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করছিস। ঠিক কিনা? হ্যাঁরে, তোর বন্ধু টন্ধু কাউকে দেখছি না কেন সুধা? কাউকে ডাকিসনি? এটা একটা বড় ভুল করেছিস রে। পাত্রের সব খবর মেয়েরা পেয়ে যায়। কিন্তু ব্যাঁকা গোঁফ, বোকা জুলফি আর লুকোনো টাকের খবর কিছুতেই পায় না। সেটা একমাত্র মেয়ের বন্ধুরাই দিতে পারে। যা যা বন্ধুদের ডেকে আন। পরদার আড়াল থেকে তারা নোট করবে। তারপর তাকে গোপন রিপোর্ট দেবে।’ মা হেসে বলল, ‘যা, চট করে বাবলিকে একটা খবর দিয়ে আয়।’

সুধা মাথা নিচু করে শাড়ি পরছে। হালকা নীল ডুরের একটা সাধারণ শাড়ি। এরপর সে মুখে একটু পাউডার দেবে। ছোট্ট একটা টিপ পরবে কি? না থাক। বেশি সাজগোজ করলে অন্যের চোখে পড়ে যেতে পারে। ভালবাসার মানুষকে বিয়ে করবার দিনটা সব মেয়ের জীবনেই সবথেকে ভাল দিন। সেদিক থেকে আজকের দিনটাও সুধার জীবনে সবথেকে ভাল দিন। কিন্তু সুধার ভাল লাগছে না। বারবার মনে হচ্ছে, কেন সে এমন একটা দিনে রাজি হল? শাড়ি পরা শেষ হতেই আবার টেলিফোনের আওয়াজ।

‘কী হল আবার ফোন করছ কেন?’

‘সব ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ। আমি এখনই বেরোচ্ছি।’

‘তোমাকে কেউ ফলোটলো করবে না তো?’

‘ফলো! কী বলছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না! ফলো করবে কে?’

‘তোমাদের বাড়িতে অতি লোকজন চলে এসেছে বলেই কথাটা বলছি। আত্মীয়স্বজনগুলো মহা হারামি হয়। সরি, আসলে ভোম্বলের কেসে এরকম হয়েছিল কিনা। মেয়ের মামা পুলিশ নিয়ে গিয়ে ভোম্বলকে ক্যাচ করেছিল। যাই হোক, অ্যালার্ট থাকবে। সেরকম বুঝলে রিকশা দু’-চার পাক ফালতু ঘুরিয়ে স্টেশনে ঢুকবে।’

‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ?’

‘ভয় পাব কেন? না, না, ভয় পাইনি।’

এই দুপুরেই বাড়ি গন্ধে ম ম করছে। মালপোয়া ভাজার গন্ধ। এটা পিসির লিস্টে ছিল না। রত্নাকাকিমা এসে স্পেশাল আইটেম হিসেবে ঢুকিয়েছে। মেজমাসি সুধাকে দেখে মুখ টিপে হাসল। বলল, ‘দরজা এঁটে এতক্ষণ কার তপস্যা করছিলি? তোর মা ডাকতে বলল। আমি বললাম, থাক দিদিভাই, মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বোধহয় টেলিপ্যাথিতে ক্লাস চলছে। অঙ্ক ক্লাস। ছাত্রীকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।’ সুধা শুকনো হাসি হেসে বারান্দায় এল। পিসি আবার রতনের মাকে দিয়ে বারান্দা মোছাচ্ছে। মেজমাসির মেয়ে বাগান থেকে কাদা পায়ে উঠেছিল। সেই পায়ের ছাপ তোলা হচ্ছে। সুধাকে দেখে পিসি অবাক হয়ে বলল, ‘ওমা, তুই ভরদুপুরে কোথায় বেরোচ্ছিস?’ সুধা বলল, ‘কোথায় বেরোব আবার, তোমরাই তো বললে বাবলিকে ডেকে আনতে।’ পিসি হেসে বলল, ‘যা চট করে ঘুরে আয়। তোর পিসেমশাইয়ের কাণ্ডটা দেখা হইচই লাগিয়ে দিয়ে এখন তোর বাবার সঙ্গে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার হয়েছে যত ঝামেলা।’

বাড়ি ছেড়ে কয়েক পা যেতে রিকশ পাওয়া গেল। রিকশর হুড তুলে দিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল সুধা। রিকশওলা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘কী হল দিদি? গাড়ি থামাব?’ সুধা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘না, থামাবে না। তুমি স্টেশন চলে।’

দুটো যোগ, দুটো বিয়োগ। মোট চারটে অঙ্ক। চারটে অঙ্কই ভুল করেছে প্রথমা। ভুল করে সে নাচতে নাচতে পাশের ঘরে উঠে গেছে এবং মহা উৎসাহে ড্রইং খাতায় ছবি আঁকতে শুরু করেছে। ছবির বিষয় হল, মাঠে গোরু চরছে। আকাশে মেঘ।

বসার ঘরে সুধা তার চার বছরের মেয়ের অঙ্ক খাতা হাতে নিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছে। বিশ্বনাথ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘অত চিন্তা কোরো না সুধা। অঙ্ক মাস্টারের ছেলেমেয়েরা সবসময়ই অঙ্কে গাধা হয়। তবে তোমার মেয়ে আঁকায় মনে হয় দারুণ করবে। তোমার পিসিমাকে বলে রাখো, উনি খুশি হবেন। ভাল পাত্র পাওয়া যাবে। সামান্য স্কুলমাস্টারের গলায় ঝুলতে হবে না।’

সুধা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে বলল, ‘এরকম ঠাট্টা করতে তোমাকে কতবার বারণ করেছি। বলছি তো, এসব শুনলে আমার মাথায় আগুন জ্বলে।’ বিশ্বনাথ স্ত্রীর কাছে সরে এল। গলা নামিয়ে বলল, ‘তাই ভাবি, রেগে গেলে তোমাকে এত সুন্দর লাগে কেন। আসলে মাথার আগুনের কিছুটা তখন তোমার মুখেও চলে আসে।’ সুধা মনে হয় একটু লজ্জা পেল। নইলে তার গাল লালচে হবে কেন। মুখ নামিয়ে বলল, ‘আহা, ঢঙ! বুড়ো বয়সে আদিখ্যেতা।’ বিশ্বনাথ আরও সরে এসে সুধার একটা হাত ধৰল। বলল, ‘সুধা, একটা জিনিস কিন্তু আমি ধরে ফেলেছি।’

‘কী ধরে ফেলেছ?’

‘ধরে ফেলেছি, তুমি এতদিন যেটা বলে, সেটা সত্যি নয়। সত্যিটা হল, মোটেই সেদিন তুমি নিজে থেকে চলে আসোনি। স্টেশনে ছেলেটির জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলে। কিন্তু ছেলেটি আসেনি। হয় সে ভয় পেয়েছিল, অথবা অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে। আমি ঠিক জানি না। জানতে চাইও না। তবে এটা আমি বুঝতে পেরেছি, তোমার মতো ভাল মেয়ে কোনও ভালবাসাকেই দুঃখ দিতে পারে না। আমি কি ভুল বলছি সুধা?’

সুধা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘আমি জানি না। হাতটা ছাড়ো, আমার কাজ আছে।’ বিশ্বনাথ হাত ছাড়ল না। দু’জনে অনেকক্ষণ এভাবে বসে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *