অনুবাদ
2 of 2

সুজন হরবোলা

সুজন হরবোলা

সুজনের বাড়ির পিছনেই ছিল একটা সজনে গাছ। তাতে থাকত একটা দোয়েল। সুজনের যখন আট। বছর বয়স তখন একদিন দোয়েলের ডাক শুনে সে ভাবল–আহা, এ পাখির ডাক কেমন মিষ্টি। মানুষে কি কখনও এমন ডাক ডাকতে পারে? সুজন সেইদিন থেকে মুখ দিয়ে দোয়েলের ডাক ডাকার চেষ্টা। করতে লাগল। একদিন হঠাৎ সে দেখল যে, সে ডাক দেবার পরেই দোয়েলটা যেন তার ডাকের উত্তরে ডেকে উঠল। তখন সে বুঝল যে, এই একটা পাখির ডাক তার শেখা হয়ে গেছে। তার মা দয়াময়ীও শুনে বললেন, বাঃ রে খোকা, মানুষের গলায় এমন পাখির ডাক তো শুনিনি কখনও! সুজন তাতে যারপরনাই খুশি হল।

সুজন দিবাকর মুদির ছেলে। তার একটা বড় বোন ছিল, তার বিয়ে হয়ে গেছে, আর একটা বড় ভাই মারা গেছে তিন বছর বয়সে। সুজন তাকে দেখেইনি। সুজনের মা খুব সুন্দরী, সুজন তার মতো নাক-চোখ পেয়েছে, তার রঙটাও বেশ পরিষ্কার।

দিবাকরের ইচ্ছা ছেলে লেখাপড়া শেখে, তাই সে সুজনকে হারাণ পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দিল। কিন্তু পড়াশুনায় সুজনের একেবারেই মন নেই। পাততাড়ি নিয়ে পাঠশালায় বসে থাকে আর এ-গাছ সে-গাছ থেকে পাখির ডাক শুনে মনে মনে ভাবে এসব ডাক সে গলায় তুলবে। গুরুমশাই পাঁচের নামতা বলতে বললে সুজন বলে, পাঁচেকে পাঁচ, পাঁচ দুগুণে বারো, তিন পাঁচে আঠারো…। গুরুমশাই তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেন, সেই অবস্থায় সুজন শালিক বুলবুলি চোখ-গেল পানকৌড়ির ডাক শোনে আর ভাবে কখন সে পাঠশালা থেকে ছুটি পেয়ে এইসব পাখির ডাক নকল করতে পারবে।

তিন বছর পাঠশালায় পড়েও যখন কিছু হল না তখন একদিন হারাণ পণ্ডিত দিবাকরের দোকানে গিয়ে তাকে বলল, তোমার ছেলের ঘটে বিদ্যা প্রবেশ করানো শিবের অসাধ্য। আমি বলি কি, তুমি ছেলেকে ছাড়িয়ে নাও। তোমার কপাল মন্দ, নইলে তোমার এমন ছেলে হবে কেন? অনেক ছেলেই তো দিব্যি লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে যাচ্ছে।

দিবাকর আর কী করে, ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, অ্যাদ্দিন পাঠশালায় গিয়ে কী শিখলি?

আমি বাইশ রকম পাখির ডাক শিখেছি, বাবা, বলল সুজন। আমাদের পাঠশালার পিছনে একটা বটগাছ আছে, তাতে অনেক রকম পাখি এসে বসে৷

তা তুই কি হরবোলা হবি নাকি? জিজ্ঞেস করল দিবাকর।

হরবোলা? সে আবার কী?

হরবোলারা নানারকম পাখি আর জন্তু-জানোয়ারের ডাক মুখ দিয়ে করতে পারে। তারা এইসব ডাক ডেকে লোককে শুনিয়েই রোজগার করে। তোর যখন পড়াশুনা হল না, তখন দোকানে বসেও তুই কিছু করতে পারবি না। হিসেব যে করবি, সে বিদ্যেও তো তোর নেই। তাই তোকে আমার কোনও কাজে লাগবে না।

সুজন সেই থেকে হরবোলা হবার চেষ্টায় লেগে গেল। তার কাজ মাঠে ঘাটে বনবাদাড়ে ঘোরা, আর পাখির ডাক শুনে, জানোয়ারের ডাক শুনে, সেই ডাক মুখ দিয়ে নকল করা। এই কাজে তার ক্লান্তি নেই, কারণ তার স্বাস্থ্য বেশ ভাল, অনেক হাঁটতে পারে, গাছে চড়তে পারে, সাঁতার কাটতে পারে। তার ডাকে যখন পাখি উত্তর দেয়, তখন তার মনটা নেচে ওঠে। মনে হয় সব পাখিই তার বন্ধু। ভোলা মাঠে গিয়ে বসে গোরু বাছুর ছাগল ভেড়ার ডাক সে তুলেছে, তারা তার ডাকে জবাব দেয়। তার হাম্বা ডাক শুনে নিস্তারিণী বুড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ধবলীর বাছুরটা হঠাৎ ফিরে এল ভেবে; তার গাধার ডাক শুনে। মোতি ধোপার গাধা ঘাড় তুলে কানখাড়া করে ডাকতে শুরু করে, মোতি ভাবে আরেকটা গাধা এল কোত্থেকে! ঘোড়ার চিহিতেও সুজন ওস্তাদ, সেটা সে ডাকে জমিদার হালদারের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে। সে ডাক শুনে সহিস করিম মিঞা ভাবে, কই, আমার ঘোড়া তো ডাকছে না–এটা আবার কার ঘোড়া?

পাখির কথাই যদি বলল, তা হলে সুজন অন্তত একশো পাখির ডাক তুলেছে। কাক চিল চড়ই, শালিক, কোয়েল, দোয়েল, পায়রা, ঘুঘু, তোতা, ময়না, বুলবুলি, টুনটুনি, চোখ-গেল, কাদাখোঁচা, কাঠঠোকরা, হুতোম প্যাঁচা–আর কত নাম করব? সুজন এইসব পাখির ডাক তুলে নিয়েছে এই গত কয়েক বছরে। সে ডাক শুনে পাখিরাই যদি ভুল করে তা হলে মানুষের আর কী দোষ?

বয়স কত হল সুজনের? তা হয়েছে মন্দ কী! তাকে আর খোক বলা যায় না, সে এখন জোয়ান। সে গতরে বেড়েছে, সবল সুস্থ শরীর হয়েছে তার। বাবা বলে, তুই এবার কাজে লেগে পড়। রোজগারের বয়স হয়েছে তোর। কার্তিক হরবোলা থাকে এই পাশের গাঁয়ে। তাকে গিয়ে বল তোর। একটা হিল্লে করে দিতে। না হয় তার সঙ্গে রইলি কটা দিন; তারপর আরেকটু বয়স হলে নিজের পথ দেখবি।

বাপের কথা শুনে সুজন কার্তিক হরবোলার সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। কার্তিকের বয়স হয়েছে দুকুড়ির উপরে–সে বিশ বছর হরবোলার কাজ করছে। কিন্তু সুজন দেখল সে নিজে যতরকম ডাক জানে, কার্তিক তার অর্ধেকও জানে না। সুজন এই কিছুদিন হল নাকিসুরে মুখ দিয়ে সানাই বাজাতে শিখেছে, তার সঙ্গে ডুগি তবলা সে নিজেই বাজায়; শিঙে ফোঁকার আওয়াজও শিখেছে, নাচের সঙ্গে যে ঘুঙুর বাজে সেই ঘুঙুরের আওয়াজ করতে শিখেছে মুখ দিয়ে। কার্তিক এসব কিছুই জানে না। সে সুজনের কাণ্ড দেখে হাঁ! তবে মুখে কিছু বলল না, কারণ কার্তিকের হিংসে হচ্ছিল। সে শুধু বলল, আমি শাগরেদ নিই না। তোমার যা করার তা নিজেই করতে হবে।

সুজন বলল, আজ্ঞে আপনি কী করে শুরু করলেন তা যদি বলেন তা হলে আমার একটু সুবিধে হয়।

তাতে কার্তিকের আপত্তি নেই। সে বলল, আমি তেরো বছর বয়সে যন্তিপুরের রাজবাড়িতে গিয়ে হরবোলার খেলা দেখাই। রাজা খুশি হয়ে আমাকে ইনাম দেন। সেই থেকে আমার নাম হয়ে যায়। তুই কোনও রাজাকে খুশি করতে পারিস তত তোরও একটা গতি হয়ে যাবে। আমার দ্বারা কিছু করা সম্ভব নয়।

সুজন আর কী করে? সে কাউকে চেনে না, কোথাকার কোন রাজবাড়িতে গিয়ে খেলা দেখাবে সে? মনের দুঃখে সে বাড়ি ফিরে এল।

সুজনের গ্রামের নাম হল ক্ষীরা। ক্ষীরার উত্তরে তিন ক্রোশ দূরে একটা বড় মাঠ পেরিয়ে ছিল একটা গভীর বন। এই বনের নাম চাঁড়ালি। চাঁড়ালির বনে যত পাখি আর জানোয়ারের বাস তেমন আর কোনও বনে ছিল না। সুজন একদিন দিন থাকতে থাকতে সেই বনে গিয়ে হাজির হল। জানোয়ারে তার কোনও ভয় নেই, আর পাখিতে তো নেই-ই। এই বনে গিয়ে তিনটে নতুন নাম-না-জানা পাখির ডাক সে তুলল। সূর্যি যখন মাথার উপর থেকে পশ্চিমে নামতে শুরু করেছে, এমন সময় সুজন শুনতে পেল ঘোড়ার খুরের শব্দ, আর দেখল একপাল হরিণ ছুটে পালিয়ে গেল।

কিছু পরেই সুজন দেখল যে, বনের মধ্যে দিয়ে আসছেন ঘোড়ার পিঠে এক রাজা, আর আরও পাঁচ-সাতটা ঘোড়ায় তাঁর অনুচরের দল। দেখে সে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, কারণ বনে অন্য মানুষ দেখবে সেটা সে ভাবেনি। এটা সে ভালই বুঝল যে, রাজা মৃগয়ায় বেরিয়েছেন।

এদিকে রাজাও সুজনকে দেখে অবাক!

তুই কে রে? রাজা হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ঘোড়া থামিয়ে।

সুজন হাতজোড় করে নিজের নাম বলল।

তুই একা ঘুরে বেড়াচ্ছিস, তোর বাঘের ভয় নেই?

সুজন মাথা নেড়ে না বলল।

তার মানে কি এ বনে বাঘ নেই? রাজা জিজ্ঞেস করলেন। শুনেছিলাম যে, চাঁড়ালির বনে অনেক বাঘের বাস?

বাঘ আপনার চাই?

চাই বইকী! শিকারে এসেছি দেখতে পাচ্ছিস না? বাঘ ছাড়া কি শিকার হয়?

বাঘ খুঁজে পাননি আপনারা?

না, পাইনি। হরিণ ছাড়া আর কিছুই পাইনি।

সুজন একটুক্ষণ ভাবল; তারপর বলল, বাঘ আছে, আর সে বাঘের ডাক আমি শুনিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আপনি কি সে বাঘ মারবেন, রাজামশাই?

মারব না? শিকার মানেই তো জানোয়ার মারা।

কিন্তু বাঘ আপনার কী ক্ষতি করল যে, তাকে মারবেন?

রাজা আসলে খুব ভাল লোক ছিলেন। তিনি একটুক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, বেশ, আমি তোর কথা মানলাম। বাঘ আমি মারব না, কারণ সত্যিই সে আমার কোনও অনিষ্ট করেনি। কিন্তু সে যে আছে তার প্রমাণ কই?

সুজন তখন দুহাত চোঙার মতন করে মুখের ওপর দিয়ে সামনের দিকে শরীরটাকে নুইয়ে একটা বড় দম নিয়ে ছাড়ল একটা হুঙ্কার। অবিকল বাঘের ডাক। আর তার এক পলক পরেই বনের ভিতর থেকে উত্তর এল, ঘ্যাঁয়াঁওঁ!

রাজা তো তাজ্জব!

তোর তো আশ্চর্য ক্ষমতা, বললেন রাজা। তুই থাকিস কোথায়?

আজ্ঞে, আমার গাঁয়ের নাম ক্ষীরা। এখান থেকে তিন ক্রোশ পথ।

তুই আমার সঙ্গে আমার রাজ্যে যাবি? তার নাম জবরনগর। এখান থেকে ত্রিশ ক্রোশ। আমার মেয়ের বিয়ে আছে সামনের মাসে আজবপুরের রাজকুমারের সঙ্গে। সেই বিয়েতে তুই হরবোলার ডাক শোনাবি। যাবি?

আজ্ঞে বাড়িতে যে বলতে হবে আগে।

তা সে তুই আজ বাড়ি চলে যা। আমরা বনে তাঁবু ফেলেছি। সেখানে রাত কাটিয়ে কাল সকালে ফিরব। তুই কাল সক্কাল সক্কাল চলে আসিস বাড়িতে বলে।

বেশ, তাই হবে।

.

০২.

সুজন বাড়ি ফিরে এসে মা-বাবাকে সব কথা বলল। দিবাকর তো মহাখুশি। বলল, এইবার ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন। তোর বোধ হয় একটা হিল্লে হল।

মা বলল, তুই যে যাবি, আর ফিরবি না নাকি?

পাগল! বলল সুজন। কাজ হয়ে গেলেই ফিরব। আর নাম-ডাক হলে মাঝে মাঝে বেরিয়ে যাব, মাঝে মাঝে ফিরব।

পরদিন ভোর থাকতে সুজন বেরিয়ে পড়ল। যখন চাঁড়ালির বনে পৌঁছল তখন সূর্য তালগাছের মাথা ছাড়িয়ে খানিকদূর উঠেছে। বনের ধারে একটু খুঁজতেই একটা খোলা জায়গায় জবরনগরের রাজার তাঁবু দেখতে পেল সুজন। রাজা দেশে ফিরে যাবার জন্য তৈরি হয়েই বসে আছেন। বললেন, তোকে একটা ঘোড়ায় তুলে নেবে আমার লোক, তুই তার সঙ্গেই যাবি!

সুজনকে আগে ভাল ভাল মিঠাই আর ফলমূল খেতে দিয়ে রাজা পাত্রমিত্র সঙ্গে করে রওনা দিলেন জবরনগর। ঘোড়ার পিঠে কোনওদিন চড়েনি সুজন, যদিও ঘোড়ার ডাক তার শেখা আছে। মহা আনন্দে রোদ থাকতে থাকতেই সুজন পৌঁছে গেল জবরনগর।

গাছপালা দালান-কোঠা পুকুর বাগান হাট বাজারে ভরা এমন বাহারের শহর সুজন কখনও দেখেনি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করে তার ভারী আশ্চর্য লাগল। সে রাজাকে জিজ্ঞেস করল, এত গাছপালা, এত বাগান, তবু একটাও পাখির ডাক নেই কেন?

রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে যে কতবড় দুঃখের কথা সে কী বলব তোকে! ওই যে দূরে পাহাড় দেখছিস, ওই পাহাড়ের নাম আকাশি। ওই পাহাড়ের গুহায় একটা রাক্ষস না থোক না জানোয়ার কী জানি এসে রয়েছে আজ পাঁচ বছর হল। তার খাদ্যই হল পাখি। সে যে কী জাদু করে তা জানি না, পাখিরা সব আপনা থেকে দলে দলে উড়ে গিয়ে তার গুহায় ঢোকে, আর রাক্ষসটা তাদের ধরে ধরে খায়। এখন এই শহরে আর কোনও পাখি বাকি নেই। কেবল একটা হীরামন আছে আমার মেয়ের খাঁচায়, রাজবাড়ির অন্দরমহলে।

কিন্তু তার খাবার ফুরিয়ে গেলে সে রাক্ষস বাঁচবে কী করে?

খাবার কি আর সে শুধু আমার শহর থেকে নেয়? পাহাড়ের উত্তরে আছে আজবপুর, পশ্চিমে আছে গোপালগড়–পাখির কি আর অভাব আছে?

এই জানোনায়ারকে কেউ দেখেনি কখনও?

না। সে গুহা থেকে বেরোয় না। আমি নিজে তীর-ধনুক নিয়ে গুহার মুখে অপেক্ষা করেছি, আর সঙ্গে সশস্ত্র সৈন্য ছিল পঞ্চাশজন। কিন্তু সে দেখা দেয়নি। গুহাটা অনেক গভীর; মশাল নিয়ে তার ভিতরে কিছুদূর গিয়েও তার দেখা পাইনি।

সুজন এমন অদ্ভুত ঘটনা কখনও শোনেনি। শুধু পাখি খায় এমন রাক্ষসও থাকতে পারে? আর তাকে কোনওমতেই শায়েস্তা করা যায় না, এ তো বড় আজব কথা!

ততক্ষণে রাজার দল প্রাসাদে পৌঁছে গেছে। রাজা বলল, প্রাসাদের একতলায় একটা ঘরে তুই থাকবি। কাল সকালে আমার মেয়েকে একবার শোনাবি তোর পাখি আর জানোয়ারের ডাক। আমার মেয়ের নাম শ্রীমতী। তার মতো বিদুষী মেয়ে আর ভূভারতে নেই। সে শাস্ত্র পড়েছে, ব্যাকরণ পড়েছে, ইতিহাস পড়েছে, গণিত পড়েছে, দেশবিদেশের রূপকথা সে জানে, রামায়ণ মহাভারত জানে। সে ঘরেই থেকেছে চিরটা কাল। সূর্যের আলো তার গায়ে লাগতে দিইনি, তার মতো দুধে-আলতায় রঙ আর কোনও মেয়ের নেই।

সুজন তো শুনে অবাক! মেয়েমানুষের এত বিদ্যেবুদ্ধি? আর সে নিজে যে অবিদ্যের জাহাজ! এই রাজকন্যার সঙ্গে তো কথাই বলা যাবে না।

এই রাজকন্যারই কি বিয়ে হবে? সে জিজ্ঞেস করল রাজাকে।

হ্যাঁ, এরই বিয়ে। আজবপুরের যুবরাজের সঙ্গে। সেও পণ্ডিত ছেলে, অনেক পড়াশুনো করেছে। রূপেগুণে সবদিক দিয়েই ভাল।

রাজপ্রাসাদে পৌঁছে সুজনকে তার ঘর দেখিয়ে দিল রাজার একজন পরিচারক। রাজামশাই বললেন, আজ বিশ্রাম কর, কাল সকালে তোকে এরা নিয়ে আসবে আমার কাছে। তারপর তোর গুণের পরীক্ষা হবে।

একটা কথা রাজামশাই। সুজন ওই পাখিখোর রাক্ষসের কথা তুলতেই পারছিল না।

কী কথা?

আকাশি পাহাড়টা এখান থেকে কতদূরে?

চার ক্রোশ পথ। কেন?

না, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।

রাজা যে তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন সেটা সুজন তার ঘর দেখেই বুঝতে পারল। দিব্যি বড় ঘর, তাতে চমৎকার নকশা করা একটা পালঙ্ক, আর তা ছাড়াও আসবাব রয়েছে কাঠের আর শ্বেতপাথরের। পালঙ্কের বালিশের মতো বাহারের নরম বালিশ সুজন কখনও চোখেই দেখেনি, ব্যবহার করা তো দূরের কথা!

রাত্তিরে খাবারও এল এমন যা সুজন কোনওদিন খায়নি। কত পদ, আর তাদের কী স্বাদ, কী গন্ধ! সবশেষে মিষ্টান্নই এল পাঁচ রকম। এত খাবে সে কী করে?

যতটা পারে তৃপ্তি করে খেয়ে সুজন ভাবতে বসল। সেই রাক্ষসের কথাটাই বারবার মনে পড়ছে তার। পাখির মতো এত সুন্দর জিনিস, আর সেই পাখিই এই রাক্ষস টপ টপ করে গিলে খায়? এমনই তার খিদে যে, শহরের সব পাখি সে শেষ করে ফেলেছে। একবার তার আস্তানাটা দেখে এলে হয় না? সুজনের এখনও ঘুম পায়নি। বাইরে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড় কোনদিকে সে তো দেখাই আছে, শুধু গুহাটা কোথায় সেটা খুঁজে বার করা।

সুজন খাট থেকে উঠে পড়ল। তারপর দুগ্ন বলে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। তাকে সকলেই চিনে গেছে, কাজেই ফটকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না।

চারিদিকে ফুটফুটে চাঁদের আলো, সুজন তারই মধ্যে সটান চলল আকাশি পাহাড় লক্ষ্য করে। অল্প কুয়াশায় পাহাড়টাকে মনে হয় ঝাঁপসা।

নিঝুম শহর দিয়ে দেড় ঘণ্টা হেঁটে সুজন গিয়ে পৌঁছল পাহাড়ের তলায়। চারিদিকে জনমানব নেই, রাতের প্যাঁচাও বোধহয় গেছে রাক্ষসের পেটে।

পাহাড়ের পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিকটা পৌঁছতেই সুজন দেখতে পেল মাটি থেকে ত্রিশ-চল্লিশ হাত উপরে একটা অন্ধকার গুহা।

এটাই নিশ্চয় সেই রাক্ষসের গুহা। মানুষও কি এই রাক্ষসের খাদ্য নাকি? আশা করি নয়।

সুজন সাহস করে পাহাড় বেয়ে উঠে গেল।

এই যে গুহার মুখ। পাহাড়ের উলটো দিকে চাঁদ, তাই গুহার ভিতরে মিশকালো অন্ধকার।

সুজনের মনে রাগ থেকে কেমন যেন একটা সাহস এসেছে। পাখিরা তার বন্ধু; আর সেই বন্ধুরা যাচ্ছে এই রাক্ষসের পেটে, তাই এ রাগ।

সুজন অন্ধকার গুহার ভিতরটায় গিয়ে ঢুকল।

দশ পা ভিতরে যেতেই তাকে সেই দশ পা-ই ছিটকে বেরিয়ে আসতে হল।

গুহার ভিতর থেকে একটা ভয়ংকর হুঙ্কার শোনা গেছে। এমন বীভৎস ডাক কোনও জানোয়ারের মুখ দিয়ে বেরোয় না।

এটা রাক্ষস, আর রাক্ষস সুজনকে দেখেছে, আর দেখে মোটেই পছন্দ করেনি।

.

০৩.

সুজন এই ঘটনার পর আর সময় নষ্ট না করে প্রাসাদে তার ঘরে ফিরে এসেছিল। পরদিন সকালে একজন কর্মচারী এসে তাকে রাজার সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেল। রাজা এখনও সভায় যাননি। আগে তাঁর মেয়েকে শোনাবেন সুজনের পাখি আর জানোয়ারের ডাক, তারপর রাজকার্য। সুজন বুঝল, মেয়ের। উপর রাজার কত টান।

এদিকে রাজকন্যা শ্রীমতী কাল রাত্রেই শুনেছে সুজনের কথা কীভাবে বাঘের ডাক ডেকে সে জঙ্গলে বাঘ আছে প্রমাণ করে দিয়েছিল। শ্রীমতী বেড়াল ছাড়া কোনওদিন কোনও জানোয়ারের ডাক শোনেনি। পাখি যখন ছিল শহরে–আজ থেকে পাঁচ বছর আগে–তখনও সে তার হীরামন ছাড়া কোনও পাখির ডাক শোনেনি। ঘর থেকে সে বাইরেই বেরোত না, শুনবে কী করে? সে যে অসূর্যম্পশ্যা। যে সূর্যকে দেখেনি, তার তো প্রকৃতির সঙ্গে চোখের দেখাই হয়নি। অবিশ্যি বই পড়ে সে অনেক কিছুই জেনেছে, কিন্তু বইয়ে আর কত জানা যায়? চোখে দেখা আর কানে শোনায় যা হয়, শুধু বই পড়ে কি তা হয়? বাংলার পাখির নাম শ্রীমতীর মুখস্থ, কিন্তু সেসব পাখি কেমন ডাক ডাকে, কেমন গান গায়, তা সে কানে শোনেনি কখনও।

সুজন যখন গিয়ে অন্দরমহলের আঙিনায় পৌঁছাল, তখন শ্রীমতী তার ঘর থেকে আরেকটা ঘরে এসে বসেছে। এ-ঘরে একটা খোলা জানলা আছে, তাই দিয়ে আঙিনায় কোনও গান বাজনা হলে তার আওয়াজ শোনা যায়। সেই আঙিনাতেই এই হরবোলা তার কারসাজি দেখাবে।

দেউড়িতে আটটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই রাজামশাই সুজনকে বললেন, কই, শুরু কর এবার তোর খেলা। আমার মেয়ে উপরে বসে আছে, সে শুনতে পাবে।

কালটা বসন্ত, তাই সুজন পাপিয়া আর দোয়েলের ডাক দিয়ে শুরু করল। মানুষের গলায় এমন আশ্চর্য পাখির ডাক কেউ শোনেনি কখনও। পাঁচ বছর পরে এই প্রথম জবরনগরে পাখির ডাক শোনা গেল।

শুরুতেই রাজকন্যার চোখে জল এসে গেছে। চাপা স্বরে বলল শ্রীমতী, আহা কী সুন্দর! পাখি এমন করে ডাকে? আর এই পাখিরা সব গেছে সেই রাক্ষসের পেটে? কী অন্যায়! কী অন্যায়!

সুজন একটার পর একটা ডাক শুনিয়ে চলল। রাজার বুক গর্বে ভরে উঠল, আর রাজকন্যার প্রাণ ছটফট করতে লাগল। এমন যার ক্ষমতা, তাকে একবার চোখে দেখা যায় না?

ঘরের বাইরে বারান্দা, সে বারান্দা বাহারের কাপড় দিয়ে ঢাকা। সেই কাপড়ের এক পাশ ফাঁক করলে তবে নীচে দেখা যেতে পারে। রাজকন্যার পাশে তার সখী বসা, তাকে একবার ঘর থেকে সরানো দরকার। সুরধুনী, আমার জলতেষ্টা পেয়েছে, একটু খাবার জল এনে দে, বলল রাজকন্যা।

জল আনতে সেই শোয়ার ঘরে যেতে হবে, তাতে কিছুটা সময় যাবে।

সুরধুনী চলে গেল।

শ্ৰীমতী এক ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এসে কাপড় ফাঁক করে দেখে নিল সেই ছেলেটিকে। সে এখন ফটিক-জলের ডাক ডাকছে। শ্ৰীমতীর দেখে বেশ ভাল লাগল ছেলেটিকে; তবে এটা সে বুঝল ছেলেটির পোশাকে যে, সে গরিব।

সুরধুনী জল নিয়ে আসার আগেই শ্রীমতী তার জায়গায় ফিরে এসেছে।

এক ঘণ্টা চলল সুজনের হরবোলার খেলা। এমন খেলা জবরনগরের রাজবাড়িতে কেউ কোনওদিন দেখেনি। আর রাজকন্যা তো এমন সব ডাক শোনেইনি; তার চোখের সামনে একটা নতুন জগৎ খুলে গেছে প্রকৃতির জগৎ, যার সঙ্গে এই যোনো বছরে তার কোনওদিন পরিচয়ই হয়নি। এই গরিব ঘরের ছেলেটি তার জীবনে একটা নতুন প্রাণ এনে দিয়েছে।

এইসব ভাবতে ভাবতেই শ্রীমতীর মনে পড়ল যে, আসছে মাসে তার বিয়ে। যাকে সে বিয়ে করবে, সেই যুবরাজ রণবীর কথা দিয়েছে যে, শ্রীমতীর পড়াশুনার ব্যবস্থা তার বাড়িতেও হবে। আর তার জন্য অন্দরমহলের ভিতরে একটা ঘর রাখবে যাতে সূর্যের আলো কখনও প্রবেশ না করে। আলো লেগে রাজকন্যার রঙ যদি কালো হয়ে যায়!

সুজন কিন্তু রাজকন্যাকে দেখতে পায়নি। রাজা তাকে একটা হাতে আঁকা ছবি দেখিয়ে বলেছেন, এই দেখ আমার মেয়ের চেহারা। ছবি দেখেই সুজনের মনে হয়েছে এ যেন স্বর্গের অপ্সরী। তারপর সুজন যখন শুনল যে, রাজকন্যা তার হরবোলার ডাক শুনে মোহিত হয়ে গেছে, তখন গর্বে তার বুকটা ভরে উঠল। আর তা ছাড়া রাজামশাই ইনামও দিয়েছেন ভাল; একটা হিরের আংটি আর একশত স্বর্ণমুদ্রা। সুজন জানে, এই টাকায় তাদের বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে চলে যাবে।

কেবল একটা কথা ভেবে তার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ওই রাক্ষসটাকে যদি শায়েস্তা করা যেত!

.

০৪.

দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। এর মধ্যে সুজন বেশ কয়েকবার কাছাকাছির মধ্যে অন্য শহরে গিয়ে হরবোলার খেলা দেখিয়ে আরও কিছু রোজগার করে নিয়েছে, আর সে রোজগারের প্রায় সবটুকুই সে দেশে গিয়ে তার বাপের হাতে তুলে দিয়েছে। সে বেশ বুঝতে পারছে যে তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। যেটুকু সময় সে রাজবাড়িতে থাকে, তার অনেকটাই সে নতুন নতুন ডাক অভ্যাস করে কাটিয়ে দেয়। একথা সে কখনওই ভুলতে পারে না যে, সামনে বিয়ের সভায় তাকে খেলা দেখাতে হবে, জবরনগরের রাজার সুনাম তাকে রাখতে হবে।

যদিও বিয়ের ধুমধাম শুরু হয়ে গেছে, রাজকন্যা শ্ৰীমতীর মনের অবস্থা কী তা কেউ জানে না। তার জীবনটা যেমন চাপা, তার মনটাও তেমনই চাপা। তবে এটা ঠিক যে, গত এক মাসে তাকে হাসতে দেখেনি কেউ। সুজন প্রাসাদের নীচের ঘরে পাখির ডাক অভ্যাস করে, তার সামান্য কিছুটা শব্দ ভেসে আসে দোতলায় অন্দরমহলের এই অংশে। সেই ক্ষীণ শব্দ শুনে শ্রীমতীর মনটা দুলে ওঠে। আশ্চর্য গুণ এই যুবকের! না জানি কথাবার্তায় সে কেমন!

এই কৌতূহল এক মাসে চরমে পৌঁছে গেছে। যে এমন সব ডাক ডাকতে পারে, যে এমন সুপুরুষ অথচ সরল, সে তোক কেমন সেটা শ্ৰীমতীকে জানতে হবেই। সে একদিন সুরধুনীকে কথাটা বলেই ফেলল।

.

সুরধুনী আজ পাঁচ বছর ধরে শ্রীমতীর সখী। শ্রীমতীকে যে ঘরে বন্ধ করে রাখা হয় সেটা সুরধুনী পছন্দ করে না। সে শ্ৰীমতীর কাছে বর্ণনা দেয় সকালের ফুটফুটে রোদে গাছপালা নদনদী মাঠঘাটের। পাখি কেমন জিনিস সে এককালে দেখেছে, সে কথাও সে বলল।

তোকে ভাই একটা কাজ করতেই হবে, শ্ৰীমতী বলল।

কী কাজ?

সেই হরবোলার ঘরে যাবার রাস্তাটা জেনে নিতে হবে।

সুরধুনী কথা দিল সে জেনে দেবে। আর তারপর সত্যিই একদিন অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে প্রহরীকে শ্ৰীমতীর কাছ থেকে নেওয়া একটা মোহর ঘুষ দিয়ে সে নীচে এসে দেখে গেল সুজনের ঘর। সুজন তখন বসন্তবৌরীর ডাক অভ্যাস করছে।

সেই রাত্রে সুজন যখন খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় উঠতে যাবে তখন সুরধুনী এল তার ঘরে।

এ কী! বলে উঠল সুজন।

সুরধুনী ঠোঁটে আঙুল দিল। তারপর ইশারা করে ঘরে ডেকে নিল শ্রীমতীকে।

তুমি! অবাক হয়ে বলল সুজন। তোমার ছবি আমি দেখেছি!

তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম, ধীর কণ্ঠে বলল শ্রীমতী। তুমি আমার সামনে নতুন জগৎ খুলে দিয়েছ।

কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কী কথা বলব? আমার তো বিদ্যে বুদ্ধি নেই। আমি পাঁচের নামতাও বলতে পারি না, আর তুমি শুনেছি অনেক লেখাপড়া করেছ। তাই–

তুমি সূর্য দেখেছ?

হ্যাঁ। রোজ দেখি। সূর্য যখন ওঠে, তখন আকাশে সিদুর লেপে দেয়। আবার যখন ডোবে, তখনও। সূর্য ওঠার আগেই পাখিরা গান শুরু করে। সূর্য ডুবলেই তারা তাদের বাসায় চলে যায়।

বসন্তের ফুল দেখেছ তুমি?

হ্যাঁ। এখনও দেখি। রোজই দেখি। লাল নীল হলদে সাদা বেগুনি কত রঙ! মৌমাছি এসে মধু খায়, প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় ফুলের ধারে ধারে। কুঁড়ি থেকে ফুল হয়। সে ফুটে আবার ঝরে পড়ে। গাছের পাতায় বসন্তে কচি রঙ ধরে, শীতে সে পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে।

একটা কথা ভেবে বড় কষ্ট হয়। কী কথা? পাখিরা এত সুন্দর গান গায়, কিন্তু এখন সেসব পাখি চলে গেছে ওই রাক্ষসের পেটে। তাকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমার কিছুই ভাল লাগছে না।

কিন্তু তোমার যে সামনে বিয়ে। এখন ভাল না লাগলে চলবে কী করে? বিয়েতে কত আনন্দ! আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু তোমার মুখে পাখির গান শোনার পর থেকে আর আনন্দ নেই। আমি বাবাকে বলেছি।

কী বলেছ?

যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে যদি ওই রাক্ষসকে মারতে পারে, তবেই আমি তাকে বিয়ে করব। আমাকে বিয়ে করার শর্তই হবে ওই।

সে না মেরে যদি আর কেউ মারে?

যে মারবে তাকেই আমি বিয়ে করব। যার শক্তি নেই সে মানুষই নয়।

তুমি খুব কঠিন শর্ত করেছ।

একথা কেন বলছ?

আমি সেই রাক্ষসের গুহায় গিয়েছিলাম। তার এক ডাকে আমি পালিয়ে এসেছি। সে বড় ভয়ানক ডাক।

শুনে আমি খুব দুঃখ পেলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি এত বাঘ ভাল্লুকের ডাক ডাকলে, তোমার বুঝি সাহস আছে। যাই হোক, যে এই বিহঙ্গভুকে মারতে পারবে আমি তাকেই বিয়ে করব।

এর নাম বিহঙ্গভু বুঝি?

হ্যাঁ।

তুমি কী করে জানলে?

আমি বইয়ে পড়েছি। বিহঙ্গ মানে পাখি।

এইখানেই কথার শেষ হল। সুরধুনীর সঙ্গে শ্রীমতী আবার নিজের ঘরে চলে গেল।

.

০৫.

পরদিন সুজনকে যেতে হল মরকতপুর। সেখানের রাজা হরবোলার ডাকে খুশি হয়ে সুজনকে ভাল বকশিশ দিলেন। সুজন জবরনগরে ফিরে এল। শ্রীমতীর ফরমাশ মতো একবার রোজ তাকে পাখির ডাক শোনাতে হয়, আর রাজা রোজ তাকে বকশিশ দেন।

এদিকে রাজার মনে গভীর চিন্তা। তাঁর মেয়ে বেঁকে বসেছে, যে রাক্ষসকে মারতে পারবে তাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। আজবপুরের যুবরাজ রণবীর তাই কালই সকালে আসছে। জবরনগর। তাকে একা যেতে হবে আকাশির গুহায়। সে সফল হলে তবেই শ্ৰীমতীকে বিয়ে করতে পারবে। সাহসী যোদ্ধা হিসেবে রণবীরের নামডাক আছে, তাই জবরনগরের রাজার ভরসা আছে সে হয়তো এই পরীক্ষায় সফল হবে।

এদিকে সুজন মনে মনে ভাবছে–যা ডাক শুনেছি রাক্ষসের, সে তো কোনওদিন ভুলতে পারব না। এমন যার ডাক, তার চেহারা না জানি কেমন, আর শরীরের শক্তিই বা না জানি কেমন! আজবপুরের রাজকুমার কি পারবে মারতে এই রাক্ষসকে?

পরদিন সকালে সূর্য ওঠার কিছু পরেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে আজবপুরের যুবরাজ জবরনগর এসে হাজির হল। তার গায়ে বর্ম, কোমরে তলোয়ার, পিঠে তৃণ, হাতে ধনুক। তাছাড়া ঘোড়ার পাশে খাপের মধ্যে ঢোকানো রয়েছে একটা বল্লম।

এ ছাড়া রাজকুমারের সঙ্গে ছিল দুই জন অশ্বারোহী, যারা জালে করে শ্মশান থেকে ধরে এনেছিল তিনটে শকুনি। জাল সমেত এই শকুনিগুলোকে ফেলা হবে গুহার মুখে, তা হলেই রাক্ষস বেরোবে–এই ছিল তাদের মতলব।

জবরনগরের বেশ কিছু লোকও গুহার উলটোদিকে সমতল ভূমিতে জড়ো হয়েছিল এই যুদ্ধ দেখার জন্য। জবরনগরের রাজা নিজে না এলেও, দূত পাঠিয়েছিলেন সংগ্রামের ফলাফল জানার জন্য।

যুবরাজ রণবীর এখন তৈরি। এইবার তার দুজন সহচর জালসমেত শকুনিগুলিকে গুহার সামনে ফেলে শিঙায় ফুঁ দিয়ে জানিয়ে দিল যে, তারা উপস্থিত। তারপর তারা দুজন সরে গেল, শুধু ঘোড়ার পিঠে রইল রণবীর।

দর্শকের ভিড়ের মধ্যে যারা ছিল তাদের একজনের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। সে হল সুজন হরবোলা। খবর পেয়ে সে সবার আগেই গিয়ে হাজির হয়েছে গুহার সামনে। কিন্তু কেন সে জানে না, তার মন বলছে যুবরাজ সফল না হলেই ভাল।

কিন্তু কই? রাক্ষস বার হয় না কেন? তার জন্য এমন টোপ ফেলা হয়েছে, তবুও কেন সে গুহার মধ্যে বসে?

এদিকে যুবরাজের ঘোড়া অস্থির হয়ে ছটফটানি শুরু করেছে। এবার যুবরাজ সাহস করে গুহার দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শিঙাও বেজে উঠল তিনবার, আর তার পরেই সকলের রক্ত হিম করে দিয়ে শোনা গেল এক বিকট হুঙ্কার, যার ফলে যুবরাজের ঘোড়া সামনের পা দুটো আকাশে তুলে যুবরাজকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে উলটোমুখে দিল ছুট। তখন যুবরাজকেও ছুটতে হল ঘোড়ার পিছনে। বোঝাই গেল সে রাক্ষসের কাছে হার স্বীকার করেছে; যার এমন গর্জন তার সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস যুবরাজের নেই।

ভিড় করে যারা এসেছিল তারাও যে যেদিকে পারে চম্পট দিল। কেবল একজন–সুজন হরবোলা–মুখ গম্ভীর করে কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরপদে ফিরতি পথ ধরল।

রণবীরের পর আরও সাতটি দেশের সাতটি যুবরাজ বিহঙ্গভুকে মারতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তার ডাক শুনে পালিয়ে বাঁচল, আর সেইসঙ্গে রাজকন্যার বিয়েও পিছিয়ে যেতে লাগল, রাজার কপালেও দুশ্চিন্তার রেখা দিনে দিনে বাড়তে লাগল।

এই আটজন যুবরাজের শোচনীয় অবস্থা সুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে; দানবের হুঙ্কারে শুধু ঘোড়ার নয়, ঘোড়সওয়ারের মনেও যে ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে সেটা সুজন নিজের চোখে দেখেছে।

এই আটজন হার মানার ফলে আর কোনও দেশের কোনও রাজপুত্র সাহস করে জবরনগরের এই দানব সংহারে এগোতে পারল না।

ন দিনের দিন সকালবেলা রাজা মন্দির থেকে পুজো সেরে যেই বেরিয়েছেন অমনই দেখলেন সুজন হরবোলা তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রাজার মন খুব খারাপ, তাই গম্ভীর ভাবেই বললেন, কী সুজন, তোর আবার কী প্রয়োজন?

সুজন বলল, মহারাজ, আমাকে একটা বল্লম দিতে পারেন?

রাজা অবাক হয়ে বললেন, কেন, কী হবে বল্লম দিয়ে?

আমি বিহঙ্গভুককে মারার একটা চেষ্টা দেখব।

তোর কি মতিভ্রম হল নাকি?

একবার দেখিই না চেষ্টা করে, মহারাজ! সে যখন প্রাণী, তখন তার প্রাণ আছে, আর প্রাণ যদি থাকে তা হলে তার কলিজা আছে। সেই কলিজায় যদি বল্লমটা গেঁথে দিতে পারি তো সে নির্ঘাত মরবে।

কিন্তু সে তো গুহা থেকে বারই হয় না!

ধরুন, যদি আজ বেরোয়! তার মতিগতি তো কেউ জানে না।

রাজা একটু ভাবলেন সুজনের দিকে চেয়ে। তার স্বাস্থ্যটা যে ভাল, শরীরে যে শক্তি থাকার সম্ভাবনা, সেটা তাকে দেখলে বোঝা যায়।

অবশেষে রাজা বললেন, ঠিক আছে, বল্লমের অভাব নেই। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তোর হাবভাবে মনে হয় তুই এ কাজটা না করে ছাড়বি না।

বল্লম জোগাড় হল অল্পক্ষণের মধ্যেই। এবার সুজন ঘোড়াশাল থেকে একটা ঘোড়া নিয়ে বল্লম হাতে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে আকাশির দিকে রওনা দিল।

এদিকে রাজার সুজনের উপর একটা মমতা পড়ে গেছে; ছেলেটার কী হয় দেখবার জন্য তিনিও ব্যস্ত হয়ে একটা ঘোড়ায় চড়ে চললেন পাহাড়ের দিকে।

সুজন গুহার সামনে পৌঁছনোর আগেই ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিল। সে জানে সে যদি ঘোড়ার পিঠে থাকে তা হলে ঘোড়া ভয় পেয়ে ছুট দিলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে পালাতে হবে।

গুহার ভিতরে দিনের বেলা রাতের মতো অন্ধকার, কারণ গুহাটা উত্তরমুখী।

ইতিমধ্যে রাজাও পৌঁছে গেছেন; তিনি একটু দূর থেকে ঘোড়ার পিঠে চেপেই ঘটনাটা দেখবেন। আজ লোকের ভিড় নেই, কারণ শহরে ঢ্যাঁড়া পড়ে গেছে যে আর কোনও রাজপুত্র রাক্ষসকে মারতে আসবে না।

সুজন হাতে বল্লম নিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল গুহার দিকে। চারিদিক নিস্তব্ধ। পাখি নেই, তাই এই অবস্থা, না হলে সকালে পাখি না ডেকে পারে না।

এবার সুজন ঠাকুরের নাম জপ করে একবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে বিরাট একটা দম নিয়ে সেই দম ছাড়ার সময় তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই নদিনে শেখা একটা ভয়ঙ্কর ডাক ছাড়ল। এই ডাকে রাজার ঘোড়া ভড়কে গিয়ে লাফ দিয়ে উঠেছিল, কিন্তু রাজা কোনও মতে তাকে সামলালেন।

এইবার এল সেই হুঙ্কারের জবাব–আর সেইসঙ্গে গুহা থেকে এক লাফে বাইরে রোদে এসে পড়ল যে প্রাণীটা, সেটা মানুষ না রাক্ষস না জানোয়ার, তা কেউই সঠিক বলতে পারবে না। বরং বলা চলে তিনে মিশে এক কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী, যাকে দেখলে মানুষের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়।

সুজন হরবোলা কিন্তু আর কিচ্ছু দেখল না, দেখল শুধু প্রাণীটার যেখানে কলিজাটা থাকার কথা সেই জায়গাটা। সেটার দিকে তাগ করে সে প্রাণপণে চালিয়ে দিল তার হাতের বল্লমটা। তারপর আর তার কিছু মনে নেই।

.

জ্ঞান হয়ে চোখ খুলে সুজন প্রথমেই দেখতে পেল সেই মুখটা, যেটা আঁকা ছবিতে দেখে তার মনটা নেচে উঠেছিল।

শ্রীমতীর পাশেই রাজা দাঁড়িয়ে; বললেন: রাক্ষস মরেছে, তাই তোমার হাতেই দিলাম আমার মেয়েকে। আজ থেকে সাতদিন পরে বিয়ের লগ্ন। তোমার বাপ-মাকে খবর দিতে লোক যাবে ক্ষীরা গ্রামে। তারাও এখানেই থাকবে বিয়ের পর, আর তুমিও থাকবে।

আর আমার লেখাপড়া?

শ্ৰীমতী হেসে বলল, আমি বলেছি সে ভার আমার। পাঁচের নামতা দিয়ে শুরু–বিয়ের পরদিন থেকেই। আর যদ্দিন না দেশে পাখি আসছে তদ্দিন তুমি আমাকে পাখির ডাক শোনাবে।

তা হলে একটা কথা বলি?

বলো।

তুমি আর ঘরের মধ্যে বন্দি থেকো না।

না, আর কোনওদিন না।

আর তোমার হীরামনটাকে ছেড়ে দাও। খাঁচায় পাখি রাখতে নেই। ওরা আকাশে উড়তে পারে না; ওদের বড় কষ্ট হয়।

শ্ৰীমতী মাথা নেড়ে বলল, বেশ, তাই হবে।

সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৯৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *