1 of 8

সুচিকিৎসা

সুচিকিৎসা

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ডমরু চরিতে এক আশ্চর্য চিকিৎসার কথা লিখেছিলেন। সে কাহিনী যথেষ্ট বিস্তৃত, আমরা কিঞ্চিৎ সংক্ষেপে এখানে একটু বলে নিচ্ছি।

ডমরুর জ্বর হয়েছে, কম্প জ্বর। বেচু কবিরাজকে খবর দেওয়া হল। বেচু জাতে কৈবর্ত, আগে চাষ করত। এখন কবিরাজ হয়ে বিলক্ষণ পসার হয়েছে। বেচু এসে ডমরুর নাড়ি ধরে শ্লোক পড়তে লাগল,

“কম্প দিয়া জ্বর আসে

কম্প দেয় নাড়ি।

ধড়ফড় করে রোগী

যায় যমবাড়ি॥”

নাড়ি পরীক্ষা করার পর বেচু ডমরুকে বিষবড়ি দিল। সামান্য বিষবড়ি নয়, একেবারে নতুন ওষুধ, সম্প্রতি সে নিজে মনগড়া করে প্রস্তুত করেছে।

ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে ডমরুর স্ত্রীর মনে যাতে কোনও সন্দেহ না থাকে সেই জন্যে বেচু নিজেও দুটো বড়ি খেয়ে নিল।

বড়ি খাওয়ার তিন ঘণ্টা পরে ওষুধের গুণ প্রকাশিত হল। ডমরুর চোখ লাল হয়ে উঠল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল। প্রাণ যায় আর কী !

ডমরুর অবস্থা দেখে তাঁর বন্ধু আধকড়ি বেচুর খোঁজ করতে গেলেন। বেচু ঘরে ছিল না। অনেক খুঁজে দেখা গেল যে সে এক পানাপুকুরের জলে গা ডুবিয়ে বসে আছে। তারও চোখ দুটি জবাফুলের মতো লাল। পানাপুকুরের পচা পাঁক তুলে সে মাথায় দিচ্ছে।

আধকড়ি বেচুকে বললেন, ‘বেচু, তুমি ডমরুকে কী ওষুধ দিয়েছ ? তোমার ওষুধ খেয়ে ডমরু মারা পড়তে বসেছে।’ মাথায় কাদা দিতে দিতে বাজখাঁই স্বরে বেচু বলল, ‘বড়ি খেয়ে আমিই বা কোন ভাল আছি।’

চিকিৎসা-অচিকিৎসা-সুচিকিৎসার ছোট-বড় অনেক কাহিনী আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথের এ গল্পটির কোনও তুলনা নেই।

অন্য ধরনের একটা আধুনিক গল্প এ মুহূর্তে মনে পড়ছে।

এক রোগী গিয়েছিলেন ডাক্তার দেখাতে, বিখ্যাত দিকপাল ডাক্তার। রোগী ডাক্তারকে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, সন্ধ্যাবেলা বড় ক্লান্ত, অবসন্ন লাগে অথচ ঘুমও ভাল করে আসতে চায় না।’ ডাক্তারবাবু নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, ‘আপনার কিছু হয়নি। রাতে শোয়ার আগে একটু ব্র্যান্ডি খেয়ে শোবেন। ভাল হয়ে যাবেন।’

ছয় মাস পরে ওই রোগী আবার একবার ওই ডাক্তারবাবুকে দেখাতে এলেন। আবার ডাক্তারবাবু ভাল করে দেখলেন, তারপর বললেন, ‘আপনার কিছু হয়নি। রাতে শোয়ার আগে বড় এক গেলাস জল খেয়ে শোবেন। ভাল হয়ে যাবেন।’

বিমূঢ় রোগী বললেন, ‘কিন্তু মাত্র ছয় মাস আগে আপনি আমাকে শোয়ার আগে ব্র্যান্ডি খেতে বলেছিলেন, এখন বলছেন জল !’ ডাক্তারবাবু মৃদু হাসলেন, তারপর নিশ্চিন্ত কণ্ঠে রোগীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের কী দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে আজকাল, জানেনই তো, ছয় মাস কেন, দু’-তিন মাসের মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়মিত বদলে যাচ্ছে।’

তা বদলাক, অনবরত বদলাক। মূল অসুবিধা হল এই চিকিৎসার বদলের খবর ডাক্তারদের মতো বহু রোগীই রাখে। আজকাল বহু রোগীই এত ওয়াকিবহাল যে তারা শুধু ডাক্তারদের পক্ষেই বিপজ্জনক তা নয়, নিজেদের পক্ষেও বিপজ্জনক। অনেক রোগীই ডাক্তারের কাছে যায় নিজের বিদ্যাবুদ্ধি অনুযায়ী সে নিজের যে চিকিৎসা চালাচ্ছে তার প্রতি চিকিৎসকের অনুমোদন আদায় করতে। পেটেন্ট ওষুধের এই স্বর্ণযুগে যে কোনও ওষুধের দোকানে খোঁজ নিলেই জানা যাবে যে তাদের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ অর্থাৎ চার ভাগের তিন ভাগ ওষুধ বিক্রি হয় প্রেসক্রিপশনের বাইরে, অর্থাৎ অসুস্থ ব্যক্তি নিজের খেয়াল ও মর্জিমতো ওষুধ কেনে যতক্ষণ পর্যন্ত রীতিমতো মরণাপন্ন না হচ্ছে।

ডাক্তারি বিদ্যার সবচেয়ে ভাল সময় ছিল গত শতাব্দীর শেষ আর এই শতাব্দীর শুরুতে। সেই সময় চিকিৎসকেরা আর অনুমানে চিকিৎসার মধ্যে যাচ্ছেন না। চিকিৎসাশাস্ত্র শারীরবিদ্যা মোটামুটিভাবে চিকিৎসক সমাজের আয়ত্তে এসে গেছে কিন্তু রোগীরা তখনও কিছু জানতে পারেনি। তারা চিকিৎসকের ব্যবস্থার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এরপর ধীরে ধীরে সবাই সব কিছু জানতে লাগল, রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে, অ্যান্টিবায়োটিক সকলের হাতের আমলকী হয়ে গেল। রক্তে চিনি বা ইউরিয়ার অনুপাত নিয়ে বহুলোক এমন ভাষায় কথা বলে যা তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিষয়বস্তু ছিল।

বিদ্যাবুদ্ধির পক্ষে একটু গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। ত্রৈলোক্যনাথ দিয়ে আরম্ভ করেছিলাম, হালকা কথাতেই ফিরে যাই।

প্রথমে আমার নিজের ডাক্তার সাহেবের কথা বলে নিই। তিনি এই শহরের একজন কৃতবিদ্য চিকিৎসক, গভীর রাত পর্যন্ত ধনকুবের, ডাকসাইটে আমলা, অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে আর অভিজাত গৃহিণীকুলে তাঁর চেম্বার গমগম করে। বিশেষ প্রয়োজনে ছয় মাস বছরে তাঁর কাছে একবার যাই, এই বিশেষ প্রয়োজনটা হল দু’রকম। প্রথম হল, চিকিৎসার প্রয়োজন, দ্বিতীয় বিশ্রাম। অফিসে-বাড়িতে চাকরি করে, সাহিত্য করে, আড্ডা দিয়ে, সামাজিকতা করে, বাজার করে, নিজের ছেলে পড়িয়ে আমার কোনও বিশ্রাম জোটে না। শুধু কালেভদ্রে চার ঘণ্টা, আমার ডাক্তারের চেম্বারে আমার বিশ্রাম জোটে। যত অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই যাই ডাক্তার সঞ্জয় সেনের ওখানে আমাকে চার ঘণ্টা বসে থাকতে হয় এবং বহুদিন পর ওই চার ঘণ্টা নিথর বিশ্রামে আমি ভাল হয়ে যাই, ডাক্তার সেন যখন দেখেন তখন আমার ক্লান্তি নেই, উত্তেজনা নেই, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। তিনি আমাকে ‘ভেরি গুড’ সার্টিফিকেট দিয়ে ছেড়ে দেন।

এবার চিকিৎসা বিষয়ে একটা অতি পুরনো গল্প বলি। গল্পটা যদিও অনেকেরই জানা কিন্তু এত ভাল যে আরেকবার বলা যায়।

এক ব্যক্তির গোরু হারিয়েছে। সারাদিন ধরে সে বনে-বাদাড়ে, মাঠে-ঘাটে, ঝোপ-জঙ্গলে গোরু খুঁজেছে। তার হাঁটু ছড়ে গেছে, গোড়ালি কেটে গেছে, সারা শরীর বুনো কাঁটায় রক্তাক্ত। সে এল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারবাবু তাকে দেখলেন, দেখে দুটো ট্যাবলেট দিলেন, বললেন রাতে খেয়ে উঠে খেয়ে নিতে।

পরদিন সাতসকালে সেই রোগী এসে আবার হাজির, সে রীতিমতো উত্তেজিত, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি সাক্ষাৎ দেবতা, আপনার ওযুধের কী গুণ।’ এ রকম প্রশংসা শুনে ডাক্তারবাবু যথেষ্টই বিচলিত হলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপারটা কী, ব্যথাবেদনা সব সেরে গেছে !’ রোগী যা বলল সে এক তাজ্জব বৃত্তান্ত, ‘কাল রাতে শোয়ার আগে যেই ট্যাবলেট দুটো খেয়েছি, অমনি শুনি ঘরের পিছনে উঠোনে হাম্বা-হাম্বা ডাক। ছুটে গিয়ে দেখি, ঠিক তাই, ওষুধটা খাওয়ামাত্রই গোরুটা ফিরে এসেছে। আর এরপর কি গায়ে ব্যথা থাকে। ব্যথাও সেরে গেছে।’

তাঁর ওষুধের এই অত্যাশ্চর্য গুণ দেখে সেই ডাক্তারবাবু কতটা খুশি হয়েছিলেন সেটা অবশ্য বলা কঠিন।

চিকিৎসা সম্পর্কে অন্য একটা গল্প বলি, মার্কিনি গল্প। যথারীতি একটু সোভিয়েত বিরোধী। এক আমেরিকান শল্য-চিকিৎসক গেছেন মস্কোয় এক হাসপাতালে। সেখানে তিনি নানারকম অপারেশন দেখছেন, সমস্তই ঝকঝকে, তকতকে, সুচিকিৎসার অতি ভাল বন্দোবস্ত।

আমেরিকান ডাক্তার এক অপারেশন থিয়েটারে দেখলেন এক রোগীর কানের নীচে বিরাট অংশ কেটে নিয়ে ডাক্তাররা অত্যন্ত অভিনিবেশ সহকারে একটা বিরাট অপারেশন করছেন। তিনি রাশিয়ান ডাক্তারদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কীসের অপারেশন হচ্ছে ? রোগীর কানে কী হয়েছে ?’

স্বল্পভাষী রাশিয়ান ডাক্তার জবাব দিলেন, ‘এর কানে কিছু হয়নি।’ মার্কিনি চিকিৎসক বললেন, ‘তা হলে ?’ এবার রাশিয়ান ডাক্তার জানালেন, ‘রোগীর গলার টনসিল অপারেশন হচ্ছে।’ আমেরিকান ডাক্তার বেশ অবাক হলেন, ‘তা গলার টনসিল, এঁর কান কাটছেন কেন ?’

রাশিয়ান ডাক্তার কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘জানেন না, আমাদের এখানে মুখ খোলা বারণ। কাউকেই কোনও কারণেই মুখ খুলতে দেওয়া হয় না। তাই আমরা কানের পিছন দিক দিয়ে টনসিল অপারেশন করি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *