সুখ

সুখ

কাল নজরে পড়েনি; আজ পড়ল। কাল শুভেনদের পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। টাঙাঅলা লোকটা খুবই ভাল, তারই কথামতন স্টেশনের কাছে বাজার থেকে শুভেন কয়েকটা মোমবাতি, এক প্যাকেট চা, সামান্য চিনি, এবং টুকিটাকি আরও কিছু কিনে নিল। নিয়ে ভালই করেছিল, কেননা হলিডে হোমে পৌঁছে দেখল আলোটালো নেই, চৌকিদার-টৌকিদার কোথায় যেন উধাও হয়েছে। টাঙাআল বুড়োই ডাকাডাকি করে ধরে আনল মদনলালকে।

মীনার মন ভেঙে যাচ্ছিল। এ রাম, শেষ পর্যন্ত এত করে এই ঘুটঘুটে ভূতের জায়গায় বেড়াতে আসা? এর চেয়ে তাদের কলকাতাই ভাল ছিল। সত্যি, শুভেনের যা বুদ্ধি, যে যা বোঝায় তাই বিশ্বাস করে ফেলে।

ঘরে ঢুকে মীনার খানিকটা ভরসা হল। একেবারে জলে পড়ার মতন অবস্থা নয়। ঘরটা ভাল, মাঝারি ধরনের; দু পাশে দুটো খাট, একদিকে পুরনো আমলের দেরাজঅলা ড্রেসিং টেবিল, একটা ছোট আলনা। মস্ত মস্ত দুই জানলা ওপাশে। ঘরের পেছন-দরজার গায়ে বাথরুম। আলো পাখা দুই-ই আছে—কিন্তু এখন জ্বলছে না। টাঙাঅলা ঠিকই বলেছিল, জঙ্গলের দিকে তার-টার ছিঁড়ে প্রায়ই বিজলী বন্ধ হয়ে যায়।

দু-পাঁচ কথা বলার পর শুভেন মদনলালকে দুটো টাকা দেবার পর দেখা গেল মদন বেশ বশ হয়ে গেছে। ধোয়ানো চাদর এনে পেতে দিল বিছানায়, হলিডে হোমের বারোয়ারী টেবল-ল্যাম্প এনে দিল, বলল গোসলখানায় জল দিতে বলেছে।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?

রোটি, আণ্ডা, ভাত, ভাজি—সব হতে পারে । বাবু যা বলবেন মদনলাল বানিয়ে দেবে, লোক আছে। তবে ঘোড়া দেরি হবে।

দেরির জন্যে শুভেনের কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। হোক দেরি। তার আগে দু পেয়ালা চা দরকার।

শুভেন তার বাঙালী-হিন্দীতে বলল, “পহেলা চা পিলাও, মদনলাল। চা আউর পানি।” বলে চায়ের প্যাকেট, চিনি মদনের হাতে দিয়ে দিল।

জল এল প্রথমে। গ্লাস-দুই জল খেয়ে শুভেন উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “মিনু, খেয়ে দেখো, মার্ভেলাস জল! টেস্টই আলাদা।”

মীনাও জল খেল। সত্যি চমৎকার স্বাদ জলের।

মদনলাল গেল চা আনতে। জামাটা খুলে রেখে শুভেন একটা সিগারেট ধরাল। ধরিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল। বাইরে অন্ধকার। ক’দিন আগে দেওয়ালী গিয়েছে। তখন থেকেই এদিকে একটা ঝড়-বৃষ্টির ভাব ছিল—, টাঙাঅলা বলছিল। এখন আর কোনো চিহ্ন নেই বাদলার। একেবারে পুরোপুরি হেমন্তকাল। শীতের রেশ আসছে বাতাসে। হয়ত শিশিরও পড়ছে রাত থেকে। গাছপালার গন্ধ বেশ ভারি হয়ে আছে, সেই সঙ্গে কেমন এক শুকনো ভাব।

“এবার হোল্ডঅলটা খুলে ফেলি, কি বললা?” শুভেন বলল।

মীনার হতাশা ভাবটা ততক্ষণে কেটে আসছে। যেমনটি বলেছিল শুভেন সেই রকমই তো; থাকার কোনো অসুবিধে নেই, হোটেল বা ধর্মশালার ভিড়-ভাড়াক্কা থাকবে না, বেশ নিজের মতন ফাঁকায় ফাঁকায় থাকা যাবে, নাচো গাও ছোটাছুটি করো, বরের কোলে বসে গলা জড়িয়ে সোহাগ করো, চাই কি মাইরি—তুমি যদি তোমার সেই ইয়ের ড্রেসটা পরে থাকো সারাদিন—তাতেও কোনো আপত্তি নেই।

যা বলেছিল শুভেন সবই প্রায় ঠিক, শুধু যদি আলোটালোগুলো জ্বলত।

মীনা বলল, “হ্যাঁ, খোলো। চটিফটিগুলো বের করেনি। …আচ্ছা, শোনো—এদের এই তোশক চাদরে শোবে, না আমাদের বিছানা বালিশ বার করব?”

“কী দরকার। ধোয়া চাদর পেতে দিয়ে গেছে।”

“ওই বালিশ কিন্তু আমি মাথায় দিতে পারব না। নোংরা চিটচিটে দেখাচ্ছে।”

“তুমি সোনা আমায় বালিশ করে নিও, মাথা অ্যান্ড কোল বোথ—”, বলে শুভেন খোলা গলায় হেসে উঠল।

মীনাও ঘাড় বেঁকিয়ে ভেঙচি কাটল, “আহা কত শখ।”

শুভেন হোল্ডঅল খুলতে লাগল। দাঁতে সিগারেট। টেবল-ল্যাম্পটা আলোর চেয়ে শিস ছড়াচ্ছে বেশি। মীনা ঘরে ঢুকে জলের ফ্লাস্ক, বেতের ছোট বাহারী টুকরি, সিনেমার ছবিঅলা কাগজ, একটা ইংরেজি ডিটেকটিভ উপন্যাস দেরাজ-আয়নার ওপর জড় করে রেখেছিল। সেগুলো সরিয়ে গুছিয়ে রাখতে লাগল।

“এই—” মীনা বলল, “খাট দুটো জুড়ে নিতে হবে যে!”

শুভেন দুষ্টুমি করে বলল, “কেন আলাদা আলাদা থাক না—ইংলিশ স্টাইল…।”

“তাই নাকি, স্টাইল করবে?…বেশ করো—” মীনা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে জব্দ করার গলায় বলল, “আমাকে দেওয়ালের দিকে দেবে।”

“কেন, জানলার দিকে শুতে ভয়?”

“আজ্ঞে না, জানলার দিকে যে শোবে তাকে ভয়। তার তো ইংলিশ নেই।”

শুভেন আবার হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, “ভয়ের কিছু নেই। জানলাঅলা ফার্স্ট নাইট তোমার কাছে শোবে, তারপর ফিরে এসে নিজের বিছানায়, আবার ধরো লাস্ট নাইট তোমার বিছানায়—”

“কেন কেন?”

“বাঃ, এ তো স্বামীর কর্তব্য।”

“ক-র্ত-ব্য”, মীনা জীব ভেঙিয়ে সোহাগী গলায় বলল, “স্বামীটির কত কর্তব্যজ্ঞান রে! ওর বেলায় কর্তব্য টনটন করছে।” দুজনেই খোলা গলায় হেসে উঠল।

হোল্ডঅল খুলে ফেলেছে শুভেন। সিগারেটের টুকরোটা ঠোটে লাগছিল। জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে শুভেন বলল, “তুমি সোনা এবার অন্তত আমার কর্তব্যজ্ঞানের প্রশংসা করো। বলেছিলাম, এমন বিউটিফুল জায়গায় নিয়ে যাব—যেখানে তুমি-আমি ছাড়া কেউ থাকবে না। জাস্ট লাইক্‌ কপোত-কপোতী। বৃক্ষচূড়ে বাঁধি নীড় যুগলে করিব…করিব…ধ্যাত শালা নীড়ের সঙ্গে মিল লাগানো বড় ডিফিকাল্ট।”

মীনা উঁচু গলায় হেসে উঠল।

মদনলাল চা নিয়ে এল।

শুভেন বলল, “শুনো—ইয়ে বিস্তারা জোড়া লাগানো হোগা।” বলে হাত দিয়ে দুটো খাট জোড়া লাগাবার ইঙ্গিত করল। “হামারা হিন্দী থোড়া গলতি হ্যায়, ভাই। সামাল লেনা। লাগাও, হাত লাগাও।”

খাট জোড়া হল। মদনলাল কাছাকাছি কোথাও থেকে চাল ডিমটিম কিনে আনবে, রাত্রের খানা বানিয়ে দেবে। শুভেন টাকা দিল। চলে গেল মদনলাল।

দুজনে বিছানায় বসে বসে চা খেতে লাগল।

শুভেন বলল, “কেমন লাগছে তোমার?”

“জায়গাটা?”

“হ্যাঁ।”

“ভালই লাগছে। তবে বড্ড অন্ধকার লাগছে।”

“আলো চলে এলে আর লাগবে না।”

“কখন আসবে আলো?”

“কি করে বলব! যে-কোনো সময় চলে আসতে পারে। পাঁচ-সাত মিনিট পরে আসতে পারে, আবার মাঝরাতেও। আমার কিন্তু দারুণ লাগছে, মিনু। এই ঘর, চারদিকে কাম অ্যান্ড কোয়াইট, বাতাসটাই কী রিফ্রেশিং, বাইরে গাছপালা; অন্ধকার, আকাশে তারা…আর তুমি-আমি বিছানায় বসে বসে রাজার হালে চা খাচ্ছি। দারুণ ব্যাপার। শালা, কলকাতায় আমাদের ঘরটার কথা ভেবে দেখো, একেবারে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় যেন, হরদম সামনে দিয়ে লোক যাচ্ছে, পেছন দিয়ে আঁশটে গন্ধ আসছে আঁস্তাকুড়ের, পাশে বারোয়ারি পায়খানা…মরে যেতে ইচ্ছে করে। …আমি তোমায় বলছি, এখানে পনেরোটা দিন থাকার পর তুমি কলকাতায় ফিরে দেখো, মিনিমাম চার কেজি ওয়েট গেইন করেছ, তোমার গালটাল ফুলকো হয়ে যাবে মাইরি, ইয়েতেও মাংস লেগে যাবে…” বলতে বলতে শুভেন বাঁ হাতটা কোমরের দিকে বাড়িয়ে জাপটে ধরল। ধরে পেটের কাছে হাত রাখল। তারপর চোখ টিপে হেসে বলল, “আর তোমার ইয়ের যা গ্রোথ হবে—দেখবে।”

মীনা স্বামীর হাত সরাল না, চোখে শাসনের ভাব ফুটিয়ে বলল, “আমার ইয়েতে তোমার কী! যা আমার তা আমার।”

“বা বা, বেশ! এখন শুধু তোমার!…ভাল কথা সখি, কিন্তু তোমার ওই ইয়ের ব্যাপারে আমার কি কোনো অবদান ছিল না?” বলতে বলতে শুভেন মুখ টিপে দমক মেরে মেরে হাসছিল।

মীনা এবার হেসে ফেলে স্বামীর কাঁধে ধাক্কা মারল। “তোমার বড় মুখ খারাপ।”

শুভেন হাসতে হাসতে বলল, “অবদান শব্দটা ভাল বাংলা মাইরি, ওর মধ্যে কিছু খারাপ নেই।”

মীনা আর বসে থাকল না। চা খাওয়া শেষ। বাথরুমে যাবে। বলল, “আমায় একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দাও, বাথরুমে যাব।”

মোমাবাতি জ্বালিয়ে শুভেন নিজেই বাথরুমে দিয়ে এল। এসে বলল, “দারুণ বাথরুম আমাদের কলকাতার শোবার ঘরের চেয়েও সাইজে বড়।”

মীনা সাবান-টাবান নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।

শুভেন হোল্ডঅল থেকে আপাতত বাকি যা দরকার বের করে নিল। নিয়ে পা দিয়ে ঠেলে হোল্ডঅল খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিল। ছুটকো আরও কটা কাজ সেরে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল একটু। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল।

সেই কোন্ সকাল থেকে তোড়জোড় শুরু করেছিল, এতক্ষণে একরকম শেষ। খবু ভোরে ঘুম থেকে উঠে লেগে পড়েছিল তারা দুজনে। এটা নাও, ওটা নাও, কোন্‌টা লাগবে কোন্‌টা লাগবে না তা ঠিক করতে করতে দুজনেরই সময় চলে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে রোদ উঠে গেল। দশটা বাইশে ট্রেন। এখনও সুটকেস গুছোনো হল না। দাড়ি কামানো গান দুটো মুখে গোঁজা—কত কি যে রয়েছে ছাই। মীনাকেও না-না করে উনুন ধরিয়ে দু-মুঠো ভাতে-ভাত করতে হবে, তারপর ঝিকে দিয়ে বাসনপত্র ধুইয়ে আবার সব গুছিয়ে রেখে যেতে হবে। নিজের স্নান খাওয়া, সাজগোজ রয়েছে।

সোয়া ন’টা নাগাদ সব তৈরি।

ট্যাক্সি নিয়ে স্টেশনে পৌঁছতে পৌনে দশ। টিকিট কাটা ছিল, গাড়িতে চেপে বসতে বসতে দশটাই বাজল।

আর ধন্য আজকালকার ট্রেন। সময় বলে কিছু জানে না। হাওড়াতেই চল্লিশ মিনিট দেরি করে ছাড়ল। তার ওপর শালা এমন ঢিমে তালে চলল যে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেরি করতে করতে পাক্কা এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট লেট লেজুড় করে নিয়ে এখানে সন্ধের মুখে পৌঁছে দিল। সময়মতন এলে বিকেলে পৌঁছে যেত।

যাক্ যে, নিরাপদে এসে হাজির হওয়া গেছে এই যথেষ্ট। শুভেনের মনে এখন আর কোনো চিন্তা নেই। সে নিরুদ্বিগ্ন, নিশ্চিন্ত। আজ বছর দেড়েক ধরে মীনাকে সে বলছিল—দাঁড়াও না—একবার বিয়েটা করি তারপর দুজনে সেরেফ মাসখানেকের জন্যে এমন জায়গায় কেটে পড়ব—কোনো বেটা আমাদের পাত্তা পাবে না। তোমার দাদা-ফাদা, আমার যত জঘন্য পিসি-মাসির দলকে কাটিয়ে মাইরি অন্তত একটা মাস দুজনে একেবারে নিজেদের জীবন কাটাব। আওয়ার পারসোনাল অ্যান্ড প্রাইভেট লাইফ। এদের জ্বালায় নিজেদের কিছু নেই।

বিয়ের ব্যাপারটা চুকতে ঢুকতেই দেরি হয়ে গেল মাস সাতেক পিছিয়ে গেল। বিয়ের পর শুভেন পড়ল বাড়ির সমস্যায়। কিছুতেই একটা বাড়ি জোটে না—বাড়ি মানে একটা অন্তত ভদ্রলোকের থাকার মতন ঘর। বেড়ালছানার মতন বউকে আজ এখানে কাল ওখানে বয়ে বেড়িয়ে শেষে টালা ব্রিজের তলায় এক বন্ধুর দৌলতে একটা ঘর পেল দোতলার শেষ প্রান্তে। বারোয়রি বাড়ি। পুরনো আমলের। টিনের ছাদের তলায় রান্নাবান্না, আর এজমালি কল-পায়খানা।

কোনো উপায় ছিল না শুভেনের। মীনাও আর বেড়ালছানার মতন ঘুরতে রাজি নয়। টালার সেই বাড়িতে দাম্পত্য জীবন শুরু করার পর শুভেন রীতিমত অপরাধ বোধ করতে লাগল। কথা ছিল, বিয়ের পরই সে বউ নিয়ে মাসখানেক অজ্ঞাতবাস করবে—কোথায় সেই অজ্ঞাতবাস? মীনা ঠাট্টা করে বলত, ‘কি গো তোমার সেই প্রাইভেট লাইফের কী হল?’ শুভেন বলত, ‘দাঁড়াও, তালে আছি। দীঘা-টিঘা যেতে চাও তো এখুনি হয়ে যায়—আমি একটু ফাঁকায় আউট অফ দি অর্ডিনারি জায়গায় যেতে চাই।’ সেই জায়গা খুঁজে খুঁজে পাচ্ছিল না শুভেন। জায়গার দোষ নয়, অফিসের ছুটি, টাকাপয়সার ব্যবস্থা, এটা-সেটার ঝঞ্ঝাট লেগেই ছিল। শেষে দুম করে একটা সুযোগ জুটে গেল। শুভেনের এক বন্ধুর ভগিনীপতি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। তিনিই বললেন—ব্যবস্থা করে দেবেন, কোনো অসুবিধে হবে না।

ব্যবস্থা করতে দুটো মাসই লেগে গেল প্রায়। মীনার পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছে এ-সময়। শরীরটাও এলেমেলো করছিল তার। মাস দুয়েকেই সামলে নিল। ডাক্তারবাবু বললেন, যান না, এখন ভাল ক্লাইমেট ওঁকে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসুন। তাতে ভাল হবে। শি ইজ কোয়াইট নরম্যাল, কোনো ভয় নেই, কিচ্ছু হবে না, চলে যান।

শুভেন দেখল, মীনাও পা বাড়িয়ে রয়েছে।

আবার কখন কিসে ফেঁসে যাবে—কাজেই দ্বিধা না করে বউ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শুভেন। সাঁওতাল পরগনার অনেক খ্যাতি শুনেছে সে। আজ এসে দেখছে—সত্যিই সুন্দর। তাও এখন অন্ধকার, রাতও হয়ে এল; কাল সকালে বোঝা যাবে জায়গাটা কত ভাল।

মীনার ব্যাপারটা কি? শুভেন যতবার কান পাতে ততবার জল ঢালার শব্দ পায়। কারবার দেখেছ! এই নতুন জায়গায়, নতুন জলে এত সাবান ঘষার কী আছে? তারপর কালই গলাব্যথা, সর্দি জ্বর।

শুভেন উঠে পড়ে দরজায় ধাক্কা মারল, “এই—?”

ধাক্কা মারতেই দরজা খুলে গেল। আর মীনা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে উঠে বলল, ‘এই!”

“যা বাব্বা, দরজা খুলেই রেখেছ?”

“ছিটকিনিটা লাগাতে পারলাম না,” বলতে বলতে মীনা গা ঢেকে নিল।

শুভেন স্ত্রীকে দেখল। দেখে লোভ হল। দুষ্টুমি করে বলল, “আমি একবার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দেখি, বন্ধ করতে পারি কি?” বলে বাথরুমের ভেতরে ঢুকে শুভেন দরজা বন্ধ করতে গেল।

মীনা স্বামীর চালাকি বুঝতে পেরে গিয়েছিল, তাড়াতাড়ি আগোছালো হয়ে দরজা দিয়ে পালাতে গেল। “এই, শয়তানি করবে না!”

শুভেন ততক্ষণে বউকে ধরে ফেলেছে দু-হাতে জাপটে। ঠাণ্ডা গা, সাবানের টাটকা গন্ধ; শুভেন অনেকটা খেলাচ্ছলে বউকে চুমু খেতে লাগল।

কাল নজরে পড়েনি; আজ সকালে নজরে পড়ল। সকালবেলায় শুভেন মীনাকে জাগিয়ে দিয়ে বাইরে ফটকের পাশে পায়চারি করতে করতে আশপাশ দেখছিল। ফটকের গায়ে দু-পাশে দুই ইউক্যালিপটাস, মস্ত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির দিকে আর যা-তা কিছু মামুলি গাছপালা, যেমন: পেছন দিকে একটা কাঁঠাল গাছ—কম্পাউণ্ড ঘেঁষে, গোটা কয়েক পেঁপে গাছ, সামনের দিকে কলকে আর করবী, দু-চারটে রঙ্গন। বাড়িটা বাংলো গোছের দেখতে; আকার প্রায় ইংরেজি এল অক্ষরের মতন, মাথায় টালির ছাদ, ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। খড়খড়ি করা দরজা জানলা। নিশ্চয় পুরনো বাংলো-বাড়ি।

মীনা চোখমুখে জল দিয়ে গায়ে পাতলা চাদর জড়িয়ে বাইরে এলে স্বামী-স্ত্রী ফটকের সামনে রাস্তায় পায়চারি করতে লাগল। কাঁকুরে মাটির রাস্তা, অজস্র নুড়ি ছড়ানো, সামান্য লালচে। রাস্তাটা দু দিকেই সোজা চলে গেছে। দু-পাশে গাছ—আম আর দেবদারু। মাঝে মাঝে কাঁঠাল। পূবের দিকে মস্ত মাঠ ঢালু হয়ে নেমে গেছে তারপর কিছু ক্ষেতখামার। আরও দূরে জঙ্গল। সূর্য উঠে গিয়েছিল।

রাস্তার একটা দিক স্টেশনের দিকে চলে গেছে। অন্যটা কোথায় কে জানে। আশেপাশে অজস্র ঝোপ আর উঁচুনিচু মাঠ, দু-চারটে খাপরা-ছাওয়া কুঁড়ে। সারা রাতের হিমে শিশিরে সব কেমন ভিজে ভিজে । সকালের বাতাসে সতেজ স্বাস্থ্যকর গন্ধ ভেসে আসছিল। কিছু পাখিটাখি উড়ে যাচ্ছে। এক ঝাঁক বক উড়ল আকাশে। শুভেন মহা খুশি। চারদিক আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল মীনাকে। “দারুণ জায়গা, কি বলো?”

মীনাও খুশি। “সত্যি, বড় সুন্দর।”

“এই হল রিয়েল বিউটি, বুঝলে মিনু? যা এখানে আছে-সব ন্যাচারাল। লোকে যে সব জায়গায় গরুর পালের মতন ছোটে—সেই জায়গাগুলো এক-একটা বাজে হল্লার আখড়া। গুচ্ছের লোক, হোটেল, চায়ের দোকান, কাপ্তেনির কম্পিটিশন, বেপেল্লাপনা—! দূর দূর—কোনো সুখশান্তি আছে সেখানে গিয়ে। শুধু নাচতে যাওয়া। আর এখানে দেখো—কিছুই সাজানো গোছানো নেই। জাস্ট, মাঠ ঘাট জঙ্গল আকাশ রোদ বাতাস…। আর মাইরি তুমি-আমি।”

মীনা ঘুম ভাঙা চোখে হাসল। “তুমি গায়ে একটা কিছু দিয়ে এলে না কেন? ঠাণ্ডা পড়েছে।”

“আমার লাগবে না।”

“বাহাদুরি কোরো না। এটা অঘ্রাণ মাস মনে রেখো। এ তোমার কলকাতা নয়।”

“না হোক কলকাতা। আমার রক্ত গরম, বুঝলে সোনা।”

মীনা বেঁকা চোখ করে স্বামীকে দেখতে দেখতে হেসে বলল, “তা আর বুঝব না, কাল যা জ্বালিয়েছ সারা রাত।”

শুভেন প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, তারপর বুঝল—বুঝে এই সাতসকালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হো হো করে হেসে উঠল।

চায়ের জন্যে দুজনেই আবার বাড়ির দিকে ফিরতে লাগল।

ফটকের কাছে আসতেই দুজনেরই একই সঙ্গে এমন কিছু নজরে পড়ল যা কাল রাত্রে পড়েনি।

শুভেনদের ঘর ফটকের মুখখামুখি। মানে বাড়ির প্রায় পশ্চিম দিকে। দক্ষিণ দিকে যে টানা বারান্দা—মানে এল অক্ষরের লম্বা দিক—সেদিকের বারান্দায় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে পাজামা, গায়ে জামার ওপর চাদর, হাতে ছড়ি। মাথার চুল একেবারে সাদা, চোখে চশমা।

ভদ্রলোককে দেখে শুভেন অবাক হয়ে গেল। এ বাড়িতে আরও লোক আছে নাকি? যা শালা! এখানেও লোক। নাকি বুড়োটা অন্য কোথাও থেকে এমনি এসেছে?

“মিনু, ওই বুড়োটা কোথ্‌ থেকে এল?”

মীনাও দেখছিল। সেও বুঝতে পারছিল না।

আরও কয়েক পা এগিয়ে ফটকে ঢুকে শুভেনদের নজরে পড়ল, বেতের চেয়ারে এক বৃদ্ধা বসে রয়েছেন। মোটা থামের আড়ালের জন্যে তাঁকে দেখা যাচ্ছিল না আগে। বৃদ্ধার সামনে কাঠের ছোট চৌকি, তার ওপর বাটিটাটি কি যেন সাজানো। তাঁরও চোখে চশমা। গায়ে শাল জড়ানো, মাথার চুল সাদা।

মীনা বলল, “শুধু বুড়ো কি গো, বুড়িও রয়েছে। করছে কী বুড়িটা?”

শুভেন হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে নিল। তার তাকাতে ইচ্ছে করল না। এখানেও লোক? কোথাও কি একা থাকার উপায় নেই? শুভেন যেন কেমন ঘৃণা বোধ করল আচমকা ওই বৃদ্ধদের ওপর। ওদের দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

ঘরে এসে শুভেন বলল, “কাল তো ওদের দেখলাম না। আজ কোথ থেকে হাজির হল?”

মীনা বলল, “কাল ওদিকটা আর আমরা দেখলাম কোথায়? যা অন্ধকার—ভূতের মতন বসে থাকলাম নিজেদের ঘরে।”

বিরক্ত হয়ে শুভেন বলল, “মেজাজ খারাপ করে দিল ওই বুড়োবুড়ি এখন পেছনে লেগে থাকবে।”

মীনারও তেমন পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা; কিন্তু কিছু বলল না। কী আর বলবে?

চা খেয়ে জামা-কাপড় বদলে শুভেনরা বাজারের দিকে বেড়াতে বেরুল। ততক্ষণে মদনলালের কাছে সবই জানা হয়ে গেছে। ওই বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা দেয়ালীর আগে থেকেই এখানে আছেন—সপ্তাহ-দুই আরও থাকবেন। গত বছরও শীতের মুখে ওঁরা এসেছিলেন; তবে অল্প দিন ছিলেন সেবার। ওই বুড়াবাবুর ভাতিজা বিজলী-সাহাব।

শুভেন বুঝতে পারল, মদনলালের খাতিরের ঘটা ও-পক্ষে বেশি।

বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শুভেন বলল, “বুঝলে মিনু, ওই বুড়োবুড়িকে একেবারে পাত্তা দেবে না। পাত্তা দিয়েছ কি লাইফ হেল করে ছাড়বে।”

“কী আর হেল করবে?”

“ওরে ব্বাস, তুমি বুড়ো বেটাদের চেননা! আমি চিনি। প্রথমেই তোমার নাড়িনক্ষত্রের খবর নেবে, কোথায় বাড়ি, বাপঠাকুরদার নাম থেকে শুরু করবে—তারপর তোমার অফিসের চাকরি, মাইনে, বাড়িভাড়ায় এসে নামবে। এরপরই নিজেদের নাইনটিন ফোরটিন-এর গল্প শোনাতে লাগবে, বিগ বিগ কথা বলবে, দু-দশটা সাহেবের আমড়াগাছি করবে—তখন আট আনা সের মাছ পাওয়া যেত, একটা বেগুনের ওজন হত পাঁচ পো, বাবুরা রাত্রে এক বাটি করে ক্ষীর খেত—এই সব পট্টি ঝেড়ে তোমার মাথা ধরিয়ে দেবে। শালা বুড়োদের আর আমি চিনি না। মাল এক-একটা।”

মীনা বলল, “বুড়োমানুষেরা বড় বকবক করে।”

“শুধু বকবক? তুমি কিছু জানো না—! ওই বুড়ো প্রথমে তোমাকে বউমা বউমা করবে, তারপর বউমার ওপর আদরে গলে গিয়ে কত কীর্তিই যে করবে তা তো জান না—?”

“যাঃ!” মীনা স্বামীকে ধমক দিল।

“যাঃ নয়, একবার একটু বউমা বউমা করতে দাও—তারপর দেখবে, শ্বশুরের কত আহ্লাদ।”

মীনা স্বামীর হাতে চিমটি কেটে দিল। “অসভ্যতা কোরো না।”

শুভেন হেসে বলল, “কী করব ভাই, বুড়োহাবড়াদের কেসটাই হল ইয়ের—তখন আর কিছু থাকে না; পারভারসান নিয়ে বেঁচে থাকে—!”

“আহা, বুড়োর বুড়ি রয়েছে না?”

“বুড়ি থাকলে কি হবে—ছুঁড়ি তো নেই।”

মীনা এবার ধমকে উঠে স্বামীকে হাতের ব্যাগ দিয়ে মারল। শুভেন জোরে হেসে উঠল। হাসি শুনে মনে হল, তার বিরক্তি যেন কিছুটা কেটে গিয়েছে।

বাজারটা বড় কিছু নয়। পরিচ্ছন্নতাও কম। তবু শুভেনরা বেহারী ময়রার দোকানে বসে সকালের জলখাবারটা সেরে ফেলল। চা খেল মাটির খুরিতে। তরিতরকারির বাজার ছোট। গ্রাম থেকে আনা টাটকা দু-চারটে ফুলকপি ছিল, কাঁচা টমাটো, বেগুন, আলু, মুরগির ডিম। একটা লোক নদী থেকে মাছ ধরে এনে বিক্রি করে, তার কাছে সামান্য মাছ ছিল, ছোট ছোট মাছ।

বাজার সেরে ফিরতে ফিরতে সামান্য বেলা হল। মদনলালকে বাজারগুলো ধরিয়ে দিলেই চলবে। মদনের এক সঙ্গী আছে; রান্নাবান্না সেই করে। শুভেনরা আজ সকালে সবই জেনে গিয়েছে। মদনলাল আসলে হল চৌকিদার, তার জিম্মাতেই এই বাংলো-বাড়ির সব কিছু। দক্ষিণের দিকে বারান্দাটা হঠাৎ নিচু হয়ে নেমে ছোট ছোট যে গোটা-দুই খুপরি করেছে তার একটাতে থাকে মদনলাল; আর অন্যটায় কালী। পাশেই রসুইঘর। কালীই কখনো কখনো জল তোলার কাজ করে দেয়; নয়ত মদনলাল সামনের কুঁড়ে থেকে কাউকে ডেকে আনে ফাইফরমাস খাটার জন্যে, দু-একটা টাকা দেয়। সকালের দিকে অবশ্য বাঁধা জমাদার আসে ঝাড়ঝুড়ের জন্যে।

বাড়ির কাছে এসে শুভেন বলল, “মিনু, সেই যে একটা কথা আছে—ম্যান প্রপোজেজ গড ডিজপোজেজ—ব্যাপারটা তাই হল। কোথায় ভাবলাম আমরা দুই ছোঁড়াছুঁড়ি দিব্যি এখানে স্বর্গ টর্গ করে কাটিয়ে দেব, তা না শালা কোথা থেকে দুই বুড়োবুড়ি এসে হাজির হল! সব মজা মাটি করে দিল মাইরি।” বলে বিরস মুখে শুভেন হাতের সিগারেটটা মাঠে ছুঁড়ে দিল। তারপর বলল, “কত রকম ফুর্তি করতাম—আর করা যাবে না।”

“কেন?”

“দূর, পাশেই লোক। দেওয়ালের গায়ে গায়ে ঘর। একটু হইহুল্লোড় করলেই কানে যাবে, তেমন ধামসাধামসি আর করতে পারব না। মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

মীনা আড়চোখে চেয়ে হাসল। “তুমি কি সেই ছেলে নাকি? কিছুই ছাড়বে না।”

“ছাড়ব কেন—” শুভেন বলল, “আমি শালা একটা কেরানী। তিন বছর থেকে থেকে তোমায় বিয়ে করলাম। একটা ফোর্থ ক্লাস ঘর যোগাড় করতে মাস কয়েক লাগল। বায়োয়ারি বাড়িতে থাকি। কোনো প্রাইভেসি নেই, একটুও নির্জনতা চুপচাপ নেই, আমরা কোনো দিন গলা ছেড়ে গল্প পর্যন্ত করতে পারলাম না। ভাবলাম, এখানে ক’টা দিন রাজার মতন মেজাজ নিয়ে থাকব, তোমায় নিয়ে যা খুশি করব—তা না শালা, ঠিক কোথ্‌ থেকে এক ওল্ড বাম্বু ঢুকে গেল। হ্যাত্‌…।”

মীনা আর কত হাসবে। স্বামীকে সান্ত্বনা দেবার মতন করে বলল, “কী এল গেল পাশে কারা থাকল ভেবে। আমরা আমাদের মতন থাকব।’

“নিশ্চয় থাকব। ওদের ইগনোর করব। …সত্যি বলছি, তুমি দেখো, আমি ওই বুড়োকে কাছে ঘেঁষতে দেব না। আলাপটালাপই করব না। আর, তুমি সোনা দয়া করে ওহ বুড়ির কাছে গিয়ে মাসিমা মাসিমা কোরো না। বুঝলে?”

ততক্ষণে বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছে মীনারা। কম্পাউণ্ডওয়ালের ওপারে বাড়ির বারান্দায় বুড়ো-বুড়িকে দেখা গেল না। চেয়ার পাত রয়েছে। সামনের ফাঁকা জমিতে চওড়া লাল পাড়ের একটা শাড়ি ঝুলছে দড়িতে, একটা শেমিজ। আর বুড়োর পাজামা।

প্রথম দিনটা শুভেন খুব সতর্ক থাকল। কোনো রকমে দুপুর কাটতেই মীনাকে নিয়ে বাজারের দিকে বেরিয়ে পড়ল। সেখান থেকে টাঙা ভাড়া করে গেল মাইল-তিনেক দূরে এক কুণ্ড দেখতে। উষ্ণ জলের কুণ্ড। সেখানে এক দেহাতী মেলা চলছিল তখন। মেলায় বেড়িয়ে সন্ধের মুখোমুখি আবার ফিরে এল স্টেশনে। চা খেয়ে স্টেশনেই বিশ্রাম করল। দু-একটা গাড়ি দেখল। তারপর বেশ অন্ধকার হয়ে। যাবার পর বাড়ি ফিরল। শুভেন টর্চ নিয়ে বেরিয়েছিল আজ। দরকার তেমন হয়নি। এক ফালি চাঁদ উঠেছিল—কাল যে কখন কোথায় ওই চাঁদের ফালি হারিয়ে গিয়েছিল শুভেন বুঝতে পারল না।

আজ রাতি ছিল।

ঘরে এসে বাতি জ্বেলে শুভেন কিছু বলার আগেই দেখল মীনা বিছানায় কোমর এলিয়ে পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়েছে। ক্লান্ত।

শুভেন ক্লান্ত স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়ে বলল, “টাঙার ঝাঁকুনিতে তোমার কষ্ট হয়েছে?”

“না।”

“পেটে লাগেনি তো?”

“না।”

শুভেন বউয়ের ঘাড় আর চুলের গোড়ায় নাক মুখ ঘষতে লাগল। ঘষতে ঘষতে মনে হল, এখানকার মাঠঘাট জঙ্গলের অনেক ধুলো যেন মীনার চুলে আর গায়ে জড়িয়ে গেছে। শুভেন পরম আবেগে আস্তে আস্তে চুমু খেতে লাগল।

মীনা বলল, “দরজাটা বন্ধ করে দাও।”

শুভেন বলল, “থাক না—খোলা থাক; সমস্ত কিছু বন্ধ করেই তো জীবন কাটালাম। এখন খোলাই থাক।”

সামান্য পরে মীনা উঠল। কাপড়টাপড় ছাড়বে, গা-হাত ধোবে।

সন্ধের শেষ এবং রাতটুকুও চমৎকার কাটল। নিজেদের মতন করেই। অন্য কেউ এখানে আছে বোঝা গেল না। শুধু একবার শুভেন বাথরুমে থাকার সময় লক্ষ করল, তাদের বাথরুমের ওপাশে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। বুঝতে পারল, পাশের ঘরের বাথরুমও এর গায়ে গায়ে লাগানো।

দ্বিতীয় দিনের সকালেও শুভেন এক রকম সতর্কতার সঙ্গে বৃদ্ধদের এড়িয়ে গেল। বিকেলে আর পারল না, একেবারে বৃদ্ধের মুখোমুখি।

ডোরাকাটা জুট ফ্ল্যানেলের পাজামা পরনে, গায়ে বোধহয় মোটা সুতির গেঞ্জি, কটস্‌ উলের বুশ শার্ট, হাতে বাঁধানো লাঠি।

ভদ্রলোক কলকে ফুলের গাছটার কাছে পায়চারি করছিলেন। শুভেন লক্ষ করেনি, বিকেলে বেড়াতে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বেরিয়েছে, মীনা দরজায় তালা দিয়ে আসবে এখুনি—সিঁড়ির দু-তিনটে ধাপ নেমে মাঠে আসতেই ভদ্রলোকের সঙ্গে চোখাচুখি হলে গেল।

শুভেন ভেবেছিল চোখ ফিরিয়ে নেবে। পারল না। পারা যায় না।

ভদ্রলোকের মুখে কী ছিল শুভেন বুঝতে পারল না। লম্বা মুখ, লম্বা নাক, চওড়া কপাল, অল্প কিছু সাদা ধবধবে চুল মাথায়। বেশ দীর্ঘ চেহারা। স্বাস্থ্য অবশ্য তত মজবুত নয়। কত বয়স হবে? সত্তর? কিংবা কাছাকাছি। ভাঙা চেহারা, চামড়া কুঁচকে ভাঁজ পড়েছে—তবু এই বয়সের পক্ষে একেবারে অক্ষম শরীর নয়।

ভদ্রলোক এমন করে চোখেমুখে হাসলেন যেন তিনি শুভেনেরই অপেক্ষা করছিলেন; এবং শুভেনকে অন্তত চোখে চেনেন।

“আপনারাই পরশু দিন এসেছেন শুনলাম,” ভদ্রলোক কেমন পরিচিত গলায় বললেন, “কাল একবার দেখলাম। তারপর আর বোধ হয় ঘরে ছিলেন না?”

শুভেন হাসল না। গম্ভীর মুখে বলল, “না। রাত্রে ফিরেছি।” তার গলার স্বর নিস্পৃহ, ঠাণ্ডা। যেন আলাপটা তার পছন্দ হচ্ছে না।

“কোথা থেকে আসছেন? কলকাতা?”

ঘাড় নাড়ল শুভেন।

ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে বললেন, “জায়গাটা ভাল। শরীর-স্বাস্থ্যর পক্ষে বেশ ভাল। দু-চার দিন থাকলেই বুঝতে পারবেন।” বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে তাকালেন। তারপর সামান্য উঁচু গলায় বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও আমি আসছি।” বলে শুভেনের দিকে তাকিয়ে এই রকম আচমকা বিদায় নেবার জন্যে যেন লজ্জা প্রকাশ করলেন, “পরে আবার কথাবার্তা হবে…আচ্ছা…।” ভদ্রলোক যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

শুভেন এই বারান্দার দিকে তাকাল। বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। চওড়া পাড়অলা শাড়ি, গায়ে পুরোহাতা জামা, চোখে চশমা। ঘষা কাচ নাকি? দূর থেকে চোখ দেখা যাচ্ছে না।

ভদ্রলোক বারান্দায় উঠে বৃদ্ধা মহিলার হাত ধরলেন, তারপর সাবধানে আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে টেনে এনে ধাপগুলো নামাতে লাগলেন বলে বলে।

মীনা ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেও দেখছিল।

মীনা বলল, “ওভাবে সিঁড়ি নামাচ্ছেন কেন? উনি অন্ধ নাকি?”

শুভেন মুখ ফিরিয়ে নিল। “কী করছিলে তুমি এতক্ষণ?”

“বাথরুমে গিয়েছিলাম একটু, কেন?”

শুভেন হঠাৎ কেমন বিরক্তি বোধ করল। কেন কে জানে। বলল, “বাথরুমেই যাও দশবার করে। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।”

মীনা স্বামীর এই আচমকা বিরক্তি বুঝল না।

আজ হাঁটা-পথে অনেকটা বেড়ানো হল। হাঁটতে হাঁটতে সেই রাম-মন্দির পর্যন্ত এগিয়ে আবার বাজারের দিকে ফেরা। তারপর স্টেশন। অনেকক্ষণ স্টেশনে বেড়িয়ে আবার সন্ধের মখে বাড়ি ফেরা। তখনও আবার এক ফালি চাঁদ রয়েছে আকাশে।

বাড়ির কাছাকাছি এসে শভেন বলল; “মিনু, বুড়ো ভদ্রলোক যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন; আমি ওঁর নামটাও জিজ্ঞেস করলাম না। ব্যাপারটা বড় খাবার হল। অসভ্যতা অসভ্যতা লাগছে।”

মীনা প্রথমটায় জবাব দিল না। তারপর বলল, “আবার তো দেখা হবে, জিজ্ঞেস করে নিও।”

শুভেন কিছু বলল না। ফটকের সামনে এসে তাকাল। দক্ষিণের দিকে বারান্দায় আলো পড়েছে সামান্য। ভদ্রলোকেরা ঘরে রয়েছেন।

এখানকার আবহাওয়ায় শীত এসে পড়েছে বেশ বোঝা যায়। আজ হালকা কুয়াশা জমে গেছে এরই মধ্যে। বাতাসে শুকনো ঠাণ্ডা।

মীনা তালা খুলল ঘরের। শুভেন বাতিটা জ্বালিয়ে দিল। ঘরের মাঝমধ্যিখানে একটা আলো ঝুলছে, বাল্‌বটা মেরেকেটে ষাট পাওয়ারের, টিমটিম করে জ্বলে, আভা হলুদ মতন। একটা পুরনো পাখা, কালচে রঙ, মাথার ওপর স্থির হয়ে আছে।

মীনা বিছানায় বসল। বসে হাই তুলল একবার, ছোট হাই। “এখানে হাঁটাহাঁটি করলে পায়ের গোছে অত ব্যথা হয় কেন বলো তো?”

“উঁচু নিচু জায়গা বলে।”

“এই, একটু জল দাও,” মীনা আদর করে হুকুম করল।

শুভেন জল গড়িয়ে দিল।

মীনা জল খেল। “আজ আর রাত্তিরে খেতে হচ্ছে না!”

“কেন?”

“স্টেশনে একগাদা খাওয়ালে।”

“হজম হয়ে যাবে” শুভেন বলল গ্লাসটা রেখে দিতে দিতে, “এখানকার জল, সবে তো সন্ধে।”

জামাটামা ছাড়তে লাগল শুভেন। মীনা একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিল। শুভেনের হয়ে যাক—তারপর কাপড় ছাড়বে সে।

শুভেন পাজামা পরল, গায়ে পাঞ্জাবি। বাথরুমে গেল।

মীনা শুয়ে থাকল। পাশ ফিরল। আবার সোজা হল। কলকাতার বাড়ির কথা মনে পরল। মনে পড়লেই কেমন যেন লাগে। এ রকম একটা ঘর পেত তারা। নিরিবিলি, চুপচাপ। কী আরামই না লাগত। তা কি আর পাওয়া যাবে।

শুভেন বাথরুম থেকে বেরিয়েছে কি বাতি নিবে গেল। যাঃ।

“কী হল?” মীনা ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল;

শুভেন বলল, “দাঁড়াও, টর্চটা নিয়ে দেখি। আবার কারেণ্ট গেল নাকি?”

হাতড়ে হাতড়ে টর্চ নিল শুভেন, বাইরে গিয়ে দেখল। তারপর ফিরে এসে বলল, “কারেণ্ট গিয়েছে। এখানে এই হালে চলে নাকি? আচ্ছা তো!”

“মোমবাতি জ্বেলে দাও,” মীনা বলল।

মোমবাতি জ্বালাবার পর মীনা উঠে শাড়িটা ছাড়ল। গায়ের জামাও। শুভেন সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল বেঁকা ভাবে।

টর্চটা তুলে নিয়ে মীনা বাথরুমে চলে গেল।

শুভেন শুয়ে শুয়ে দেখছিল, প্রায় জানলা ঘেঁষে জ্যোৎস্না দাঁড়িয়ে আছে, ঝাপসা জ্যোৎস্না, ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে।

বাথরুম থেকে যেন একছুটে কোনো খবর দিতে বেরিয়ে এল মীনা। বলল, “এই, এদিকে এসো।”

“কী?”

“বুড়ি গান গাইছে।”

“গান?”

“বাথরুমের বাইরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াও না—শুনতে পাবে।”

“কী গান গাইছে।”

“কে জানে! গুন গুন শুনছিলাম।”

শুভেন আগ্রহ বোধ করে উঠল। বাথরুমে গেল। ফিরে এসে বলল, “ঠাকুর-দেবতার নাম করছে বোধহয়। ভজন-ভজন লাগল।”

ততক্ষণে হাত মুছে গায়ে জামা পরেছে মীনা। ঘরের শাড়িটা পরে ফেলেছে।

শুভেন এসে বিছানায় বসল। মীনা আয়নায় কোনো রকমে মুখ দেখে চুল গুছিয়ে নিল। নিয়ে স্বামীর পাশে এসে বসল।

সামান্য চুপচাপ। শুভেন বউয়ের হাত ধরে খেলা করতে লাগল। “বাইরে জ্যোৎস্নাটা দেখেছ? দিন পাঁচেক পরে ফার্স্ট ক্লাস জ্যোৎস্না হবে।” কোন্ হিসেবে শুভেন কথাটা বলল সেই জানে।

বিছানায় আড় হয়ে শুয়ে পড়ল শুভেন। বউকে টেনে বুকের ওপর নিল। ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল, কানের মধ্যে ফুঁ দিল আস্তে আস্তে। মীনার গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। শুভেন এই খেলাটা খুব পছন্দ করে। মীনার কানে ফুঁ দিলে তার গায়ে কাঁটা দেয়। মীনার গায়ে কাঁটা দিলে শুভেনের খুব আরাম লাগে। সে তখন বউয়ের হাত-পায়ে নিজের হাত পা ঘষতে থাকে।

আদর করে বউকে ক’টা চুমু খেল শুভেন।

মীনা স্বামীর মতিগতি জানে। কোমরের কাছে চিমটি কেটে বলল, “এখন ঐ সব কোরো না তো, ছাড়ো—!”

“এখন তা হলে কী করব?”

“কিছু করতে হবে না! শুয়ে থাকো।”

“চুপচাপ?”

“হ্যাঁ, চুপচাপ” —বলে মীনা আঙুলের খোঁচা মারল বুকে দুষ্টুমি করে।

শুভেন সামান্য চুপচাপ শুয়ে থাকল। তারপর হঠাৎ বলল, “মিনু?”

“উঁ!”

“চলো, ও-ঘর থেকে একটা ভিজিট দিয়ে আসা যাক।”

“এখন? এই অন্ধকারে?”

“কী হয়েছে? অন্ধকারই তো ভাল। বেশি গ্যাজোর গ্যাজোর করার চান্স পাবে না। ভদ্রতা করে একবার দেখা দিয়ে চলে আসব।”

মীনা কিছু ঠিক করতে পারছিল না।

শুভেন উঠে পড়ল, বলল, “অন্ধকারে ভূতের মতন বসে থেকেই বা কি হবে। চলো ঘুরে আসি। বুড়োবুড়িদের দেখার জন্যে আলোর দরকার হয় না।”

শুভেন উঠে দাঁড়াল দেখে মীনাও উঠল।

টর্চ নিল শুভেন, তালা নিল, তারপর মোমবাতি নিবিয়ে বাইরে এল। মীনা দরজার বাইরে।

একই ধরনের ঘর। এটা চওড়ার দিকে একটু বড়। সেই দুটো খাট। একটা নেয়ারের অন্যটা লোহার। শুভেনদের মতন কাঠের নয়। খাট দুটো কেমন করে যে জোড়া করা হয়েছে বোঝার উপায় নেই। আসবাবপত্রের মধ্যে একটা আর্মচেয়ার বেশি, বেতের মোড়াও আছে একটা। বড় ধরনের গোটা-দুই সুটকেশ একপাশে, বেশ কিছু টুকিটাকি। একটা টাইমপিস ঘড়ি আয়নার কাছে রাখা।

মীনারা ঘরের চৌকাঠে পা দিতেই আদর করে ভদ্রলোক ভেতরে ডেকে নিয়েছিলেন।

লণ্ঠন জ্বলছিল একপাশে। পরিষ্কার লণ্ঠন। বৃদ্ধা মহিলা নেয়ারের খাটে বসেছিলেন—কোল করে। তাঁর বিছানার পাশে কাঠের জলচৌকির ওপর ছোট মালসায় সামান্য কাঠকয়লার আগুন। কোলের ওপর উলের গোলা, কাঁটা, অথচ তাঁর চোখে যে চশমা তার একটা কাচ ঘষা, কিছু দেখা যায় না। অন্য কাচটা ভীষণ পুরু। কেমন করে উনি দেখছেন? শুভেন ওই কাচের মধ্যে দিয়ে এই আলোয় ভাল করে বৃদ্ধার চোখ দেখতে পাচ্ছিল না। যা দেখা যাচ্ছিল তাতে মনে হল, কাচের আড়ালে দুর্বল ঝাপসা ঘোলাটে এক চোখ।

ভদ্রলোক শ্বেতপাথরের খোল-নলচেতে কিছু যেন মাড়ছিলেন, আদর করে ডেকে বসতে বললেন—শুভেনকে আর্মচেয়ারে, মীনাকে বিছানায়। তারপর বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সুবর্ণ, এই ছেলেটি আর বউমাটি পাশের ঘরে উঠেছে গো। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছে।”

মীনা নেয়ারের খাটের এক পাশে বসেছে। বৃদ্ধাকে সে দেখছিল। পাকা সোনার মতন রঙ ছিল বোধ হয় গায়ের, বয়েসে চাপা পড়েছে, খানিকটা থলথলে চেহারা, মাথায় বোধ হয় বেঁটে, চাঁদের মতন গোল মুখ। মাথায় চুলের বারো আনাই সাদা, সিঁথির জায়গাটায় চুল উঠে চামড়া বেরিয়ে আছে, তারই ওপর মোটা করে সিঁদুর লেপা। মুখখানিতে জরার সমস্ত চিহ্ন স্পষ্ট, ঝুলে পড়া চিবুক, চামড়াগুলো ভাঁজ পড়া শুকনো, ঠোঁটদুটি এখনও পুরুষ্ট রয়েছে সামান্য।

সুবৰ্ণ যেন যারা এসেছে তাদের দেখার জন্যে ব্যগ্র হয়ে মাথা ঘোরাতে লাগলেন।

ভদ্রলোক বললেন, “ও এক রকম দেখতেই পারে না। একটা চোখের ছানি কাটাবার পর চোখটাই গেল। বাঁ চোখটায় ছানি পড়েছে কাটাবার ভরসা করতে পারছি না। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল, কি বলো সুনু?” ভদ্রলোক যেন স্ত্রীর সঙ্গে মজা করলেন।

শুভেন বুঝতে পারল, ভদ্রলোক স্ত্রীর ভাল নামটা আগে বলেছিলেন, পরে ডাকনামটা বললেন।

সুবৰ্ণ বিছানার ওপর হাতড়াচ্ছিলেন, মীনাকে যেন একটু দেখতে পেলেন। সারা মুখ হসিতে ভরে উঠল। “এসো মা, এসো। তোমাদের কথা উনি বলছিলেন। পরশু এসেছ?”

মীনা বলল, “পরশু সন্ধেবেলা। এসে দেখি অন্ধকার।”

“আজও দেখলে তো, বাতি চলে গেল। এখানে এই রকম রোজই হয় প্রায়। তোমাদের বাতিটাতি আছে?”

“মদনলাল একটা দিয়েছিল। মোমবাতিও রয়েছে।”

ভদ্রলোক খোল—নলচেটা দেখে নিলেন। তারপর কাচের ছোট গ্লাসে জল নিয়ে স্ত্রীর কাছে এলেন। “নাও খেয়ে নাও।” বলে স্ত্রীর হাতে খোলটা ধরিয়ে দিলেন।

ওষুধ খাওয়া হল। একটু জলও।

ভদ্রলোক বললেন, “সন্ধেবেলায় একটু করে মকরধ্বজ খাওয়াই। হাঁপের ধাত। ঠাণ্ডা একেবারে সইতে পারে না।” বলতে বলতে তিনি ওষুধের পাত্রটা ধুয়ে রেখে দিলেন।

শুভেন সবই লক্ষ করছিল। বলল, “এখানে শুনলাম বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। ওঁর তাহলে খুবই কষ্ট হবে।”

“না, খুব কষ্ট হবে না। এখানে শুকনো ঠাণ্ডা। শীত ঠিকমতন পড়তে পড়তে নভেম্বরের শেষ। তার আগেই আমরা চলে যাব। …আপনারা কত দিন থাকবেন?’

শুভেন অস্বস্তি বোধ করল। এই বৃদ্ধ তাকে আপনি-আপনি করে কথা বলছেন। সামান্য দ্বিধার গলায় শুভেন বলল, “আমায় কেন আপনি বলছেন। আমি কত ছোট।”

ভদ্রলোক বড় সরল মুখে হাসলেন। “বেশ, তুমিই বলি। …কত দিন থাকবে বাবা?”

“ইচ্ছে আছে দিন-পনেরো।”

“বাঃ! থেকে যাও। খুব ভাল জায়গা। কোনো ঝঞ্ঝাট নেই। জলহাওয়া বড় ভাল। আমি তো ওই বুড়িটিকে নিয়ে তিনবার এলাম। প্রথমবার আমার এক বেহারী বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলাম। অনেকটা দূরে। বড় আদর যত্ন করে রেখেছিল। সে বেচারি মারা যাবার পর এখানে এসে উঠি। গত বছর। এই সময়। এ বছরেও এলাম। কী জানি আসছে-বছর আবার পারব কি না?”

“আপনার ভাইপো শুনলাম এখানের—”

“হ্যাঁ আমার ভাইপো, শম্ভু বিহার স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের এঞ্জিনিয়ার, সে এখানে একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করে দিয়েছে।” ভদ্রলোক একটু হাসলেন, “বার-কয় এলাম বলে চেনাশোনা হয়ে গেছে। আমাদের কত যত্ন করে রাখে এরা। বড় ভালমানুষ মদনটদন।”

সুবর্ণ ততক্ষণে মীনাকে আরও কাছে বসিয়ে নিয়ে তার হাত নিজের হাতে নিয়ে আদর করে বোলাচ্ছেন। “তুমি মেয়ে রোগা নাকি খুব? হাতটাত ভরা কই? কলকাতায় খাও কী?”

মীনা হেসে ফেলল। বলল, “রোগা কোথায়? আপনি রোগা ভাবছেন!”

মাথা নাড়তে নাড়তে সুবর্ণ শুভেনের দিকে মাথা ঘোরালেন। “ও ছেলে, মেয়ে আমার রোগা না মোটা?”

শুভেন এমন অসঙ্কোচ ডাক, এমন আন্তরিক সম্বোধন যেন শোনেনি। আচমকা কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। সামলে নিয়ে হেসে বলল, “রোগাই বলতে পারেন।”

মীনা স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করতে যাচ্ছিল, ভদ্রলোকের সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেল।

সুবৰ্ণ যেন কত আনন্দ পেয়েছেন। মীনার মুখটি দেখার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।

শুভেন ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায় থাকেন?”

“আমি বাবা আগে মাইন্‌স ইন্সপেক্টার ছিলাম। বিহারের নানা জায়গায় কাজেকর্মে ঘুরেছি। তারপর রিটায়ার করে ধানবাদে একটা ছোট বাড়িটাড়ি করেছিলাম। ভুল হয়েছিল। বড় কনজাসটেড জায়গা হয়ে গিয়েছে। …ও, আমার নামটা তোমায় বলা হয়নি। বরদাকান্ত মুখুজ্যে। খাস ঘটি। আদি বাড়ি ছিল উত্তরপাড়ায়। তোমার নামটি কী?”

শুভেন তার নামধাম বলল।

মীনার সঙ্গে সুবর্ণ কথা বলছিলেন, “তোমার শ্বশুরবাড়িতে কে কে আছে মেয়ে?”

“কেউ না; নিজের কেউ নেই।”

“আহা! বাপের বাড়িতে?”

“দুই দাদা, মা। বাবা নেই।”

“না মেয়ে, তোকে সত্যি বলছি, মেয়েদের যদি বাপ না থাকে—তবে বাপু—কেমন হয় জানিস—কদর থাকে না। আমি মেয়ে হয়েই তোকে বলছি। মা ভাল, বাপ আরও ভাল। আমার বাবা আমার বিয়ের পর তিন রাত্তির খায়নি, শোয়নি। যখন বাপের বাড়ি গেলাম, বাবার সে কী আহ্লাদ…সে যদি কেউ দেখত ভাবত ছেলেমানুষ…”

বরদাকান্ত স্ত্রীর কথা শুনছিলেন। গলার শব্দ করলেন। তারপর আস্তে গলায় শুভেনকে বললেন, “বুড়ির পেছনে লাগি একটু—” বলে গলা উঁচু করে স্ত্রীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, “তোমার বাবার খুব সুখ্যাতি করছ। কিন্তু বলতে নেই, আমার শ্বশুরমশাই আর যাই করুন, জামাইকে অনেক অচল জিনিস চালিয়েছিলেন।”

সুবৰ্ণ কানে খাটো নন অন্তত, শুনতে পেলেন। বললেন, “একটাও চালায়নি। আমার বাবা অচল চালাবার মানুষ নাকি? মিথ্যে বোলো না।”

বরদাকান্ত শুভেনকেই যেন সাক্ষী মানছেন, বললেন, “তুমিই বলো, বিয়ের পর যদি তোমার বউ—ও বউমা, তুমি কিছু মনে কোরো না—, যা বলছিলাম হে, তুমি বলো—বিয়ের পর যদি তুমি দেখতে তোমার বউয়ের একটা পা ছোট, অন্যটা বড়—তোমার কী মনে হত?”

সুবর্ণ বাধা দিয়ে বললেন, “পা কেন ছোট হবে, একটা পায়ের গোড়ালি খুব কেটে গিয়েছিল, একটু গর্ত মতন ছিল।”

“বাঁ হাতের কনুই বেঁকা,” বরদাকান্ত হাসিচোখে বললেন গম্ভীর মুখ করে।

“কনুই বেঁকা নয়, হাড়টা একটু উঁচু।”

“নাকটা তো একটুও উঁচু নয়—”

“তা কি করব! ভগবান যার যেমন গড়ন দিয়েছেন। আমি বরাবরই খেঁদাখোঁদা।’

বরদাকান্ত থামলেন না। মজা করে বললেন, “বুঝলে শুভেন, আমার শ্বশুরমশাইয়ের এই মেয়েটিকে একদিন—বিয়ের পরটর হবে—আমার ঘড়িটাতে দম দিতে বলেছিলাম। পরের দিন দেখি আমার অমন দামি বিলেতী ঘড়ি আর চলছে না। দমের ঠেলায় স্প্রিং কেটে গিয়েছে।”

সুবৰ্ণ মীনার মুখটি নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, “আমি তার কী করব মেয়ে, বল? দম দেওয়া মেয়ে বিয়ে করলেই পারত বাবু। আমরা তো ওটা শিখিনি।”

ঘরের মধ্যে হাসি যেন ফেটে পড়ল। শুভেন অট্টহাস্য হেসে উঠল, মীনাও হাসতে হাসতে মুখে হাত চাপা দিল। হাসি আর থামছিল না। বরদাকান্তও হাসছিলেন, জোরে নয়, মুখ চেপে। তারপর শুভেনের দিকে তাকিয়ে এমন এক কৌতুকের ভঙ্গি করলেন, যেন তিনি হেরে গেছেন।

নিজের জায়গা ছেড়ে উঠলেন বরদাকান্ত। সুবর্ণর সামনে এসে মালসার নেবা-আগুন লক্ষ করলেন, তারপর মালসা উঠিয়ে নিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলেন।

এই প্রবল হাস্যের পর শুভেন খুব হালকা বোধ করছিল। বাস্তবিক পক্ষে শুভেন বুঝতে পারছিল এই বৃদ্ধ দম্পতির ওপর তার বিন্দুমাত্র আক্রোশ বা বিরক্তি আর নেই। নিজেকে অত্যন্ত সহজ অসঙ্কোচ লাগছে এখন।

মীনা হেসে বলল, “আপনি তখন গান গাইছিলেন, আমরা শুনতে পেয়ে চলে এলাম।”

“গান!..ও মেয়ে, বুঝেছি। গান কেন হবে, ঠাকুরের নাম করছিলাম—গীতগোবিন্দ…। আমি গানটান জানি না মা, উনি এক সময়ে চর্চা করতেন।”

মীনা ছেলেমানুষের মতন বলল, “আবার একটু গান না? ঠাকুরের নামই গান—?”

সুবৰ্ণ যেন কেমন লজ্জা পেয়ে বললেন, “যাঃ—খুনসুটি করিস না।”

আরও কটা কথা হল। সাধারণ। সাংসারিক। ততক্ষণে বরদাকান্ত আবার ফিরে এসেছেন। তাঁর হাতে এক কেটলি জল।

বরদাকান্ত প্রথমে একটা ছোট চায়ের পটে জল ঢাললেন। বাকি গরম জলটা ঢাললেন হট ওয়াটার ব্যাগে। তারপর গরম জলের ব্যাগটা স্ত্রীর হাঁটুর তলায় গুছিয়ে দিলেন।

শুভেন প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। পরে দেখল, বরদাকান্তর ঘরে নিজেদের চায়ের সরঞ্জাম আছে। তিনি নিজের হাতে দু কাপ চা করলেন। করে শুভেন আর মীনাকে দিলেন।

বড় অপ্রস্তুত বোধ করল শুভেন। “আপনি আবার চা করতে গেলেন কেন? আমরা বার-দুই খেয়েছি।”

“তাতে কি, খাও…।”

চা খেতে খেতে আবার গল্প শুরু হল। শুভেন প্রায় অসঙ্কোচেই কথা বলছিল।

“ওর শরীর ভাল থাকে না—আপনি কী করে ওঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান?” শুভেন জিজ্ঞেস করল।

“ওকে নিয়ে পারি,” বরদাকান্ত বললেন, “চল্লিশ বছর বয়েই বেড়াচ্ছি। শরীরের আর দোষ দেব কি বলো! সতেরো বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছে সুনুর—উনিশ বছর বয়েসে একা জীবন-মরণ সমস্যা দেখা দিল।” বলে গলা নামিয়ে বললেন, “ওভার গ্রোথ হয়ে গেল। ডেড চাইল্ড। অপারেশন করে বের করতে হল। ও-সবের আর কোনো আশা রইল না। সুনুও মরো-মরো। ছ’মাস বিছানায়। ওই ফাঁড়াটা কাটল তো আবার বছর সাতেক পরে গল ব্লাডার নিয়ে পড়ল। আবার অপারেশন। তারপর এই তোমার বুড়ো বয়েসে ঘাড়ের কাছে একটা টিউমার দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। আবার অপারেশন। তিন-তিনটে অপারেশনের ধাক্কা সামলে শরীরে কি থাকে বলো। খুচরো আধি-ব্যাধি তো আছেই। ছানি কাটিয়ে একটা চোখ গিয়েছে। অন্য চোখটা ওই তোমার নিবে আসা সলতের মতন রয়েছে, যে-কোনো সময় নিবে যেতে পারে। তার ওপর ডায়েবেটিস, বাত, নিঃশ্বাসের কষ্ট…”

সুবর্ণ সবই শুনছিলেন, শুভেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ও ছেলে, উনি যখন অচলের কথা বলেন—তখন এইসব ভেবে বলেন—বুঝলে তো?” বরদাকান্ত সরল স্নিগ্ধ গলায় বললেন “তা বলি। কিন্তু সুনু, এই অচলটুকু না থাকলে আমিও যে সচল থাকতাম না।”

সুবর্ণ চুপ করে থাকলেন। তাঁর মুখে দুঃখ নেই, ক্ষোভ নেই। পরিপূর্ণ তৃপ্ত এমন এক মুখ করে চেয়ে আছেন—যেন জীবনের সমস্ত প্রাপ্তি তাঁর মিটে গেছে। একটু পরে মীনার হাত নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “কে যে কাকে সচল রাখল জানি না, মা। ঠাকুর জানেন। তিনিই জানেন, কে কবে অচল হয়ে পড়বে…।”

বরদাকান্ত কথা বললেন না। শুভেন কেমন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। মীনার মুখ বেদনায় ভরে উঠল। কী এক বিষণ্ণতা—যার কোনো রূপ নেই, আকার নেই, সীমা নেই—এ প্রায়ান্ধকার ঘরে জমে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে।

এমন সময় মদনলাল এল। হাতে মালসা। নতুন করে আগুন করে এনেছে।

বরদাকান্ত উঠলেন। দেখলেন ধোঁয়া আছে; কিন্তু আগুনে। জলচৌকির ওপর নিজের হাতে রাখলেন। তারপর একটা শাল এনে স্ত্রীর পিঠে জড়িয়ে দিলেন। কোলের কাছ থেকে উলের গোলা, কাঁটা, সরিয়ে নিলেন যাবার সময়।

শুভেন সমস্ত দেখছিল। লণ্ঠনের ম্লান আলো যেন ম্লানতর হয়ে সুবর্ণর গায়ে পড়েছে। পিঠের ওপর কালো শাল। ফরসা জরা-জর্জরিত মুখে যেন কত তৃপ্তি মেশানো, অথচ এই তৃপ্তির কোথাও যেন এক বেদনার অস্পষ্ট স্পর্শ রয়েছে। কোথায়? চোখে? নাকি ওই চুল-ওঠা সিঁথির সিঁদুরের ওপারে—পাকা চুলের আড়ালে যা আর দেখা যায় না।

মীনা হঠাৎ সুবর্ণকে বলল, “আপনি মাসিমা, চোখে দেখতে পান না। তবু ওই উলের গোলা আর কাঁটা নিয়ে কী করছিলেন?”

সুকর্ণ বড় সুন্দর করে হাসলেন, “আজ আর দেখতে পাই না মা, বড় কষ্ট হয়। এককালে কত কী বুনতাম। উনি আমার বোনা ছাড়া জীবনে কখনও কিছু পরেছেন নাকি?…অভ্যেসটা তো রয়েছে মা, হাতে কাঁটা ধরলে ঠিক বুনতে পারি।”

“কী বুনছিলেন?”

সুবর্ণ একটু চুপ করে থেকে বরদাকান্তর দিকে আঙুল দেখালেন। “শীত পড়ে যাচ্ছে তো মা। আমার বুড়োর মাথায় চুল কই। ওর জন্যে একটা টুপ বুনতে বসেছি।”

মীনা হাসতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার হাসিটা গলার কাছে এসে পুঁটলি পাকিয়ে গেল। তারপর সমস্ত বুক টনটন করে উঠল। চোখে জল এসে গেল মীনার।

জ্যোৎস্না মরে গিয়েছে। জানলার বাইরে অন্ধকার। ঠাণ্ডা আসছিল। মীনা পাশ ফিরে চুপ করে আছে। তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল শুভেন। চারপাশ জুড়ে যত ঝিঁঝিঁ ডাকছে। অনেকক্ষণ আগে স্টেশনের দিক থেকে একটা গাড়ি চলে যাবার শব্দ ভেসে এসেছিল।

ঠাণ্ডা আর যেন সহ্য না হওয়ায় শুভেন বিছানায় বসে জানলা ভেজিয়ে দিল। আরও অন্ধকার হয়ে গেল ঘর। ঘুটঘুট করছে।

কেমন যেন বিরক্ত হয়ে শুভেন বলল, “ঘুমোলে নাকি?”

মীনা সাড়া দিল না।

শুভেন স্ত্রীর গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে বুকের কাছে টেনে নিল। মীনা ঘুমোচ্ছে না। অথচ নিঃসাড়। শুভেনও এতক্ষণ ওইভাবেই শুয়ে ছিল। সাড়াশব্দ না করে।

এখন বিরক্ত লাগছে কেন? বিষণ্ণ লাগছে কেন? বুকের মধ্যে এই ভার কেন জমছে? কেন তার শরীর সাড়া পাচ্ছে না? শুভেন যেন ক্রমশই বিরক্ত হয়ে উঠে নিজেকে স্বাভাবিক সচেতন করতে চাইল।

মীনার মুখে গাল ঘষল। চুমু খেল। কানে ফুঁ দিল। চোখের পাতায় জিবের আগা ছোঁয়াল। তারপর মীনার জামায় হাত দিল।

মীনা কোথাও কোনো বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু তার নিজের দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। তার গায়ে আজ তেমন করে কাঁটাও ফুটল না। পা গরম, হাতও উষ্ণ; তবু শুভেন অনুভব করল, মীনার সেই ব্যাকুলতা, তপ্ততা নেই। তার চুমুতে নেশার সেই তাত নেই; লবণাক্ত ও মিষ্টতার চেনা স্বাদও না।

শুভেনের মনে হল, ঠিক এখান থেকে সে ফিরে যেতে পারে না। ফিরে গেলে যে তার হার স্বীকার হবে। এই যৌবন, এই শরীর—এখানে হেরে যেতে নারাজ। কেন হারবে?

ঠোঁটের কাছ থেকে ভেজা আঙুলটা বের করে শুভেন মীনার কানের মধ্যে আস্তে আস্তে ঘোরাতে লাগল, যেন পালক দিচ্ছে কানে।

মীনা ঈষৎ কাঁপল।

“মিনু, মিনু—” শুভেন আদর করে বার বার ডাকতে লাগল, ফিসফিস করে; চুম্ব খেতে লাগল, গলা বুক ভরে গেল চুমুতে। কোমর, পেছন, উরুতে বুঝি নখের আঁচড় লাগল।

শুভেনের ভার বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে, শুভেন যখন আদরের শেষাশেষি—মীনা হঠাৎ বলল, “একদিন—আমি যখন বুড়ি হয়ে যাব—তুমি কী করবে?”

শুভেন বলল, “আমিও বুড়ো হব।”

“না, আমার কথা বললো! তখনও তুমি আমায় অমন করে ভালবাসবে?”

শুভেন বিন্দুমাত্র কিছু না বুঝেই বলতে যাচ্ছিল—বাসব—বাসব। তার আগেই তার সুবর্ণর সেই শাল জড়ানো তৃপ্ত ও বিষণ্ণ মুখ যেন চোখের ওপর আটকে গেল।

শুভেন কেমন অসাড় হয়ে গেল। একেবারে নিশ্চল। ক্রমে তার শরীর কেমন উদ্যমহীন, আবেগহীন, ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল।

মীনা যেন কেমন দুঃস্বপ্নের মধ্যে কথা বলার মতন করে বলল, “এত ভালবাসা—আমি আর দেখিনি। …একজন যদি আগে যায়—অন্যজনের কী হবে বলতে পার?”

শুভেন হঠাৎ যেন দেখল; বুড়ি চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে—খাটে শুয়ে, সাদা মাথায় সিঁদুর লেপা, গলায় গাঁদা ফুলের মালা। আর এই বেহারী গ্রামের মদনলালরা দড়ির খাটিয়া বয়ে নিয়ে চলেছে মাঠঘাট জঙ্গল নিয়ে। ভোমরার গুঞ্জনের মতন শব্দ উঠছে: রাম নাম স্যাত হ্যায়, রাম নাম স্যাত হ্যায়…। বরদাকান্ত পিছু পিছু চলেছেন। আস্তে আস্তে, একা একা, চোখ দুটি খাটের দিকে।

স্ত্রীর পাশে গড়িয়ে নেমে পড়ল শুভেন। বালিশে মুখ গুঁজল। সারা জীবন ধরে এত ভালবাসা বয়ে নিয়ে যাবার সাধ্য কি তার আছে?

শুভেন নিজেই বুঝতে পারল না—তার কাম কখন কান্নায় ধুয়ে যাচ্ছিল। বুকের মধ্যে, গভীরে, কোথাও শীতের বাতাসের শিস ধরানো তীক্ষ্ণ শব্দের মতন একটা হাহাকার করা ফোঁপানো কান্না পাক খাচ্ছে। খাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *