আট
অরুণ সত্যই কয়েকদিন খুব অসুখে ভুগল। টাইফয়েড একবার হয়ে সেরে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার রিলাপস করল। ডাক্তার চিকিৎসার সব রকম ব্যবস্থা করলেন, কয়েকদিনের জন্য একটা নার্স রেখে দিলেন। রজত বহু ব্যস্ততার মধ্যেও অরুণকে দিনে একবার দেখে যান। কয়েকদিন স্ট্রাইক চলার পর আবার স্কুল-কলেজ খোলায় মোমকে তার মা কলকাতায় নিয়ে গেছেন। মোম অবশ্য যেতে চায়নি, কিন্তু প্রতিমা দেবী মেয়ের রকম-সকম মোটেই পছন্দ করেননি।
অরুণ অস্বাভাবিক রকমের বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। অসুখের কষ্টের চেয়েও তার মন-মরা ভাব অনেক বেশি। সব সময় চুপচাপ শুয়ে থাকে, কথা বলতে চায় না। ডাক্তার সেন কিংবা রজত কোনও কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব সংক্ষেপে দুটো-একটা উত্তর দেয়। কলেজের অধ্যাপক বা দু-চারজন ছাত্রও আসে মাঝে মাঝে। তারা এসে নিজেদের মধ্যেই গল্প করে, অরুণ শূন্য চোখে চেয়ে থাকে। মনের মধ্যে যেন সে স্পষ্ট টের পেয়ে গেছে, তাকে চলে যেতে হবে। যদি হঠাৎ মৃত্যু আসে, তা হলে তো কথাই নেই। মৃত্যু না এলেও তাকে এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে। অধ্যাপক বন্ধুরা অরুণকে মহা উল্লাসের সঙ্গে শুনিয়ে যায় যে, যদিও অসুখের জন্য অরুণকে অনেক ছুটি নিতে হচ্ছে কলেজ থেকে, কিন্তু শিগগিরই শিক্ষক-অধ্যাপকদের টানা ধর্মঘট শুরু হবে, তখন আর অরুণকে ছুটি খরচ করতে হবে না, এমনিই বাড়িতে শুয়ে বিশ্রাম করতে পারবে। শুনে অরুণ একটু উদাসীন ভাবে হাসে।
অসুখের মধ্যে একটা নির্মম নিঃসঙ্গতা আছে, অরুণ অনুভব করতে পারে। এতদিন পর অরুণের মনে হয়, সে এতদিন বিষম ভুল করেছে। এই রকম ভাবে দিনের পর দিন নিজেকে বঞ্চিত করে লুকিয়ে রাখার সত্যি কোনও মানে হয় না। কলকাতার বন্ধু-বান্ধব এবং চেনা জগৎ ছেড়ে মফঃস্বলে আত্মগোপন করে সে ছেলেমানুষি ধরনে নিজের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। পাশ করার পর সে স্কটিশ চার্চ কলেজে চাকরির অফার পেয়েছিল, সেটা না নিয়ে চলে গেল আসামে। বন্ধু-বান্ধবরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। সকলেই কলকাতায় চাকরির জন্য উদগ্রীব, আর অরুণ সে সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিতে চায়। আসামে অরুণের প্রায় নির্বাসিতের মতন জীবন কেটেছে, শেষপর্যন্ত প্রায় অসহ্য হয়ে উঠেছিল। সেখান থেকে ডায়মন্ডহারবারে চলে এসেছিল বিশেষ কোনও প্রত্যাশা না নিয়েই। কিন্তু এখানে এসে প্রথম কিছুদিন বেশ ভালোই লাগছিল। অঙ্কের অধ্যাপকদের সঙ্গে ছাত্রদের সাধারণত হৃদ্যতা থাকে না, কিন্তু এখানকার ছাত্ররা মোটামুটি তাকে পছন্দ করেছিল। কলেজের এক উৎসবে ডাক্তার সেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই লোকটির নির্লোভ নিষ্ঠা অরুণকে আকর্ষণ করে। ডাক্তার সেনও অরুণকে হঠাৎ খুব পছন্দ করেছিলেন, প্রায়ই বাড়িতে ডেকে পাঠাতেন। সন্ধ্যার দিকে অরুণের সুন্দর সময় কাটত। তারপর দেখা হয়ে গেল রজতের সঙ্গে।
রজতকে প্রথম দিন একপলক দেখেই অরুণ চিনতে পেরেছিল। রজতকে দেখেই তার মনে এক ধরনের ভয় জেগে ওঠে। এ-এক রহস্যময় ভয়, এর ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না—অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাঁক ঘোরার মুখে যে রকম ভয় জাগে। রজতকে দেখেই অরুণ বুঝতে পেরেছিল, এবার তার জীবনে আবার একটা কিছু ঘটবে। সেই ঘটনা তার জীবনে কোনদিকে বাঁক নেবে, অরুণ জানে না। তার নিস্তরঙ্গ জীবনে আবার আলোড়ন জাগাবে। মালতীর প্রতি তীব্র অভিমান যখন তার মনে অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছিল, ঠিক সেই সময়েই মালতীর সঙ্গে আবার দেখা হল। না দেখা হলেই সবচেয়ে ভালো হত। অরুণ বুঝতে পারে, একথা তো অঙ্কের মতনই সত্য যে, সময়ে সব কিছুই নিষ্প্রভ হয়ে যায়—স্মৃতি, অভিমান, ভালোবাসা। মালতীকে ভুলে গিয়ে অরুণ হয়তো নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারত, কিন্তু এই সময়ে মঞ্চে মালতীর পুনঃপ্রবেশ।
অরুণ চোখ বুজে মালতীর মুখখানা মনে করার চেষ্টা করল। ডায়মন্ডহারবারে আসার আগে মালতীকে অরুণ শেষবার যখন দেখেছিল, তখন টানা রোগভোগে মালতীর মুখখানা শুকনো—চোখ দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, মাথার চুলে অনেকদিন তেলের ছোঁয়া লাগেনি, ঈদের চাঁদের মতন কৃশ করুণ সেই মূর্তি। শেষ সেইদিন মালতীর দুই গালে অরুণ হাত রেখেছিল মুহূর্তের জন্য। মালতী অস্ফুট গলায় বলেছিল, মনে আছে তো সেই প্রতিজ্ঞা? আমায় কখনও ছেড়ে চলে যাবে? অরুণ বেশি কথার বদলে শুধু বলেছিল, না। তারপর কাকদ্বীপের রাস্তায় জিপ গাড়িতে যেদিন দেখল আবার মালতীকে, সেদিন সে প্রস্ফুটিত মালতী। সেই অসুখের চেহারার সঙ্গে কোনও মিল নেই। বরং আগে, শান্তিনিকেতনে, বালি ব্রিজে যে মালতীকে দেখেছিল, যেন কোনও অলৌকিক উপায়ে সময়ের কাঁটা ঘুরিয়ে মালতী আবার সেখানে ফিরে গেছে। সেই প্রতিজ্ঞা গ্রহণের দিনে, প্রতিজ্ঞা স্মরণ করাবার দিনে নয়। সেইজন্যেই তো অরুণ অতখানি উদবেল হয়ে উঠেছিল। এই ক বছরে মালতীর চেহারা যদি একটু অন্যরকম হয়ে যেত, মুখের দু-একটা রেখা বদলাত, অরুণ বোধহয় তেমন আঘাত পেত না।
অরুণ মাঝে মাঝে নিজেই বুঝতে পারে, অনেকটা তার পাগলামি। জীবন এক রকম নয়। জীবনে সব প্রতিজ্ঞা টেঁকে না, সব কথা রাখা যায় না, বুকের ভিতরে রাখা মুখ বারবার ভেঙে গড়ে নিতে হয়। অতি সূক্ষ্ম, যে কোনও মুহূর্তে হারাবার ভয়ই ভালোবাসার রূপ, এবং তা সত্যি হারিয়ে যায়, ভেঙে যায়। তার পরেও যা থাকে, তা ভালোবাসা নয়, জেদ, অতৃপ্ত অহংকার, আর আহত পৌরুষের মর্মবেদনা। চিরস্থায়ী ভালোবাসা নিছক একটা উপকথা। ভালোবাসার চেয়েও বোধহয় বড় নিছক বেঁচে থাকা, শরীরের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য, সামাজিক সম্মান এবং কৃতজ্ঞতাবোধ। ভালোবাসা কিছুতেই নিরাপত্তা চায় না, সব কিছু ভাঙতে চায়।
অরুণের এসব মেনে নেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু কিছুতেই যে মনের মধ্যে একশোটা যুক্তি একমুহূর্তের জন্য শিকড় পায় না। সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক-একটা তীব্র অন্ধ অভিমান। অরুণ বুঝতে পারে, তার একমাত্র পথ, এখান থেকে চলে যাওয়া। কোথায়? তা সে জানে না।
আগের দিন সন্ধ্যাবেলা ডাক্তার সেন এবং রজত দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন। দিন কয়েকের জন্য একজন মধ্যবয়স্কা নার্স ছিল অরুণের কাছে, তার বাড়িতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হওয়ায় সে আর আসতে পারবে না। ডাক্তার সেন বললেন, আপনি বাড়িতে চিঠিপত্র লিখেছেন? বাড়ি থেকে কেউ এ সময়ে এলে ভালো হত। আমরা চিঠি লিখে দেব? আপনার মা বেঁচে আছেন?
অরুণ উত্তর দিয়েছিল, না। তা ছাড়া কোনও দরকার নেই। আমি তো এখন ভালো হয়ে উঠছি, আমার কোনও অসুবিধা হবে না।
না, তবুও সারাক্ষণ একা-একা থাকা—একটা চাকর শুধু ভরসা—ওতে মনের মধ্যে ডিপ্রেশন আসে।
আমার সেরকম কিছু হবে না। আমার একা থাকার অভ্যেস আছে।
আহা, কবি মানুষ, অন্য সময় একা থাকবেন বলে এ সময়েও? অন্তত দিদি কিংবা বউদি-টউদি কারওকে তো আসতে বলা যায়।
অরুণ ক্ষীণ হেসে বলেছিল আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি এই বেশ আছি।
রজত চুপ করেছিলেন। তাঁরও খুব অস্বস্তি লাগছিল। অসুখের সময় এই রকম একটা অন্ধকার একতলায় ঘরে সর্বক্ষণ একা শুয়ে থাকা, এই দৃশ্য তাঁর বিষম করুণ মনে হয়। অন্তত মালতীও যদি মাঝে মাঝে আসত! কিন্তু মালতী এই কথাটা কিছুতেই শুনতে চায় না, বার বার এড়িয়ে যায়। যেন অরুণের ওপর তার মারাত্মক এক ধরনের বিদ্বেষ জমে আছে। এই ব্যাপারটা রজতের দুর্বোধ্য লাগে, মানুষের সঙ্গে সহজ সাধারণ সম্পর্ক রাখতে ক্ষতি কী? দু-একটা সহানুভূতির কথা, একটু সেবা—এতে কারওরই কোনও ক্ষতি হয় না! আজ যদি দেশ জুড়ে কলেরা শুরু হয় এবং মালতী সেবার কাজে লেগে যায়, রজত কি রাগ করবেন? তিনি খুশিই হবেন। তা হলে একজন পরিচিত মানুষকে বিপদের সময় একটু সাহায্য করলে ক্ষতি কী?
অরুণ রজতের দিকে তাকিয়েছিল। রজতের চিন্তিত মুখ দেখে সে কুণ্ঠিত ভাবে বলেছিল, শুধু শুধু আপনাদের আমি দুশ্চিন্তায় ফেলেছি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, আমি এবার দু-চারদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে উঠব।
রজত হাসার চেষ্টা করে বললেন, আমাদের দুশ্চিন্তা করতে হত না, যদি আপনি আপনার আত্মীয়-স্বজন কারওকে এখানে আসার জন্য লিখতেন।
সেরকম কেউ নেই আমার যাকে অনুরোধ জানাতে পারি। আমি তো এমনিতেই ভালো হয়ে উঠছি। আপনাদের শুধু কষ্ট দিলাম।
না, কষ্ট আর কী! কষ্ট তো আপনিই পাচ্ছেন।
পরদিন শেষ-বিকেলে তখনও ভালো করে সন্ধ্যা হয়নি, কিন্তু আলো ম্লান হয়ে এসেছে, অরুণকে একেবারে চমকে দিয়ে মোম এসে উপস্থিত হল। অরুণ তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠে চা খাচ্ছে। অবাক হয়ে বলল, এ কী! তুমি তো কলকাতায় গিয়েছিলে? কবে এলে?
এইমাত্র। পালিয়ে এলুম কলেজ থেকে। এই দেখুন না বইখাতা।
পালিয়ে এলে? সে কী?
কলেজ থেকে বেরিয়ে, সোজা ট্রেনে চেপে….কেন, আমি বুঝি একলা আসতে পারি না?
কিন্তু এলে কেন?
ভালো লাগছিল না।
মা-বাবাকে খবর দাওনি? আগে বাড়িতে ঘুরে এসো।
যাব, যাব, একটু পরে যাব।
না মোম, ছেলেমানুষি করে না। আগে বাড়িতে যেতে হয়।
কী মুশকিল, স্টেশন থেকে আপনার বাড়িটাই তো কাছে, তাই এখানে আগে এলাম। এর পর বাড়ি যাব। আপনার অসুখ সারেনি? কী বিচ্ছিরি!
কীসের কী বিচ্ছিরি?
এই এতদিন অসুখে বিছানায় শুয়ে থাকা! আমার একদম ভাল্লাগে না।
বাঃ, তোমার বাবাই তো চিকিৎসা করছেন। তিনি যদি সারাতে না পারেন তো আমার কী দোষ?
বাবার উচিত ছিল ওষুধ দিয়ে আপনাকে একদম মেরে ফেলা!
অরুণ সচকিত হয়ে কনুই-এ ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠল। তারপর কৌতুক মিশ্রিত বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, উচিত ছিল আমাকে মেরে ফেলা? কেন বলো তো? তাতে তোমার কী লাভ হত?
অনেক লাভ হত। আপনি একটা গুড ফর নাথিং।
সত্যি মোম, আমি ঠিক তাই। কিন্তু তুমি কী করে ব্যাপারটা বুঝে ফেললে?
আপনাকে আমার বেশ একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করেছিল। ভেবেছিলুম, দুজনে বেশ একসঙ্গে বেড়াব, গল্প করব। আর সেই সময়েই আপনি বোকারামের মতন ঢিপ করে অসুখে পড়লেন!
অরুণ হাসতে হাসতে বলল, তাই নাকি, আমাকে তোমার ভালো লাগতে শুরু করেছিল? ইস, একথা আগে জানলে আমি কক্ষনও অসুখে পড়তুম না—সত্যি বলছি।
আপনি আমার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে দিলেন।
কী কী প্ল্যান ছিল শুনি?
প্রথমেই ভেবেছিলুম, বাবাকে বলে আপনাকে আমার প্রাইভেট টিউটর রাখব! সপ্তাহে দু’দিন—শনি-রবি, ওইদিন তো আমি এখানে থাকি। আর সেই সময় পড়ার বদলে আমরা খুব গল্প করতাম।
মোমের দুষ্টু-দুষ্টু চোখ, ছটফটে ভঙ্গি—কিন্তু একমুহূর্ত দেখলেই বোঝা যায়, কোথাও কোনও ভান নেই। তার যুবতী শরীর দিয়ে সে ন’-দশ বছরের মেয়ের মতন অবলীলাক্রমে কথা বলে যাচ্ছে। অরুণ অনেকদিন বাদে অসুস্থ শরীরে প্রাণ খুলে হাসতে লাগল। মোমের কথার উত্তরে বলল, কিন্তু তোমার বাবা যদি আমাকে টিউটর হিসেবে রাখতে রাজি না হন!
ইস, হবেন না মানে! বাড়িতে আমার কথা সবাইকে শুনতে হয় জানেন না? আমাকে বেশি রাগিয়ে দেওয়া বারণ। জানেন তো, আমি একবার পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। যদি রাগালে আবার পাগল হয়ে যাই?
মোম, তুমি সত্যি সত্যি পাগল হয়েছিলে? না সবার সঙ্গে ইয়ার্কি করেছিলে? পাগল সেজেছিলে?
মোম এবার চোখ-মুখে সিরিয়াস ভঙ্গি করে বলল, না সত্যিই! সত্যি! সত্যি! আমাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছিল। আমার তখন খুব কষ্ট হত মাথার মধ্যে। আমি কাঁদতুম—আমার সব কথা মনে নেই, কিন্তু আমি চাকরদের মুখে শুনেছি, আমি নাকি তখন খুব জিনিসপত্র ভাঙতুম—একবার রেডিয়োগ্রাম ভেঙে ফেলেছিলুম।
আচ্ছা, থাক ও কথা। কিন্তু মোম, আমি যদি রাজি না হই তোমার প্রাইভেট টিউটর হতে?
রাজি হবেন না? কেন? আমাকে আপনার ভালো লাগে না? বলুন সত্যি করে?
চেয়ার থেকে উঠে এসে মোম খাটের ওপর বসল। অরুণের বুকের খুব কাছে ঝুঁকে এসে বলল, সত্যি করে বলুন? খুব চিন্তিত তার মুখ।
অরুণ একটু বিব্রত হয়ে বলল, তা, ভালো লাগে নিশ্চয়। কিন্তু টিউটর হয়ে পড়াবার বদলে কি সেই সময় গল্প করা উচিত? মোটেই উচিত নয়।
মোমের মুখটা আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বলল, সব সময় গল্প করতুম না, একটু একটু পড়তুম অবশ্য। তা ছাড়া, আমরা বাইরে লুকিয়ে দেখা করতুম! কথাটা শেষ না করে মোম চোখ টিপে একটা ফাজিল ইঙ্গিত করল। সবুজ সিল্কের শাড়ি পরা মোমের উষ্ণ শরীর অরুণের খুব কাছে। খুবই সহজ ভঙ্গিতে অরুণের গায়ে মোম একটা হাত রেখেছে। হাতকাটা, খুবই ছোট সাইজের ব্লাউজ—শায়িত অবস্থায় অরুণের চোখের খুব সামনে মোমের দুটি সদ্য যৌবনবন্ত স্তন, বগলের কাছে ঈষৎ ঘামে ভেজা চুল। পেটের কাছে কোনও আবরণ নেই, মাখনের মতন নরম সেই জায়গাটায় ঘামের ছোট একটা রেখা। দেবী-মূর্তির মতন রূপ মোমের, কিন্তু দেবী-মূর্তির মতই হৃদয়হীন। অরুণ বেড সাইড টেবিল থেকে সিগারেট নেবার জন্য একটু সরে গিয়ে বলল মোম, তোমার বাবার অ্যাসিস্টেন্ট রতনবাবু সেদিন আমার কাছে তোমার কথা বলছিলেন। উনি বোধহয় তোমাকে—
রতন? ধুৎ! ও তো একটা ইতর!
কী বললে? ছিঃ, কোনও মেয়ের পক্ষে ওসব কথা বলা—
মোম খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, খারাপ কথা? আমাদের কলেজের অনেক মেয়ে বলে, সুপর্ণাকে একটা ছেলে রোজ ফলো করে। সুপর্ণা তো তার সম্বন্ধে আমাদের বলে, ছেলেটা একটা ইতর! রাম শয়তান!
ছিঃ, আর ও কথা উচ্চারণ কোরো না। ওইসব সুপর্ণার মতো মেয়েদের সঙ্গে তোমার মেশা উচিত নয়!
আপনি একটা খাঁটি মাস্টারমশাই! আমি আরও অনেক খারাপ কথা জানি। শুনবেন?
না, একদম শুনতে চাই না। রতনকে ও কথা বলা মোটেই উচিত নয় তোমার?
আহা, বলবে না! আমার যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল, ও কেন আমার বুকে স্টেথোসস্কোপ বসাবার সময় আমার…..
থাক, থাক। মোম, আমি এসব কথা শুনতে চাই না! তুমি বানিয়ে বানিয়ে এসব খারাপ কথা বলতে ভালোবাস।
বানিয়ে বানিয়ে! জিজ্ঞেস করবেন রতনকে। ও আমার হাত ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে কত কী সব বলেনি? ওকে শুধু ইতর বলা উচিত না, ওকে বলা উচিত অনেক কিছু।
অরুণ নির্বাক বিস্ময়ে মোমের মুখ থেকে ওইসব কথা শুনে গেল। একথা সত্যি, মোমের মুখ থেকে যখন ওইসব অবিশ্বাস্য খারাপ কথা বেরোতে লাগল, সেগুলোর উচ্চারণ এমন নরম আর মিষ্টি যে মনেই হয়, মোম ওর অধিকাংশ কথারই মানে জানে না। কলেজের বাথরুমের দেয়ালে কিংবা খারাপ মেয়েদের মুখে শুনেছে। সুন্দর মুখখানিতে কিছুতেই যেন পাপ স্পর্শ করে না। একটু বাদে অরুণ ক্লান্ত ভাবে বলল, মোম, তোমাকে অনেকেই বুঝি সুযোগ পেলে ওই রকম অন্যায় ভাবে আদর করে?
হ্যাঁ। অ-নে-কে! আমার তো ভালোই লাগে সেই সময়!
তুমি কাউকে ভালোবেসেছ কখনও মোম?
হ্যাঁ। আমি বাবাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। মাকে আমার ভালো লাগে না।
বাবা ছাড়া আর কাউকে? কোনও ছেলে….কারওর জন্য তোমার সব সময় মন কেমন করে?
উঁহু!
মোম, তোমার বাবা এত ভালোমানুষ, কিন্তু তাঁর কথা ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছে। এক ছেলে—তাকে জোর করে বিলেত পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর তুমি, তুমিও বাবাকে অনেক দুঃখ দেবে?
আমি মোটেই বাবাকে দুঃখ দেব না।
এই যে তুমি কাউকে না বলে কলেজ থেকে চলে এসেছ! উনি দুঃখ পাবেন না?
বাবা আমার ওপর রাগ করেন না। হঠাৎ আপনার সঙ্গে আমার দেখা করতে ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল, কারওর সঙ্গে আজ বিকেলে হাত ধরে বেড়াই! আমার কলেজের কত মেয়ের বেশ ছেলে-বন্ধু আছে, তাদের সঙ্গে ওরা কত কী করে। আমার একজনও নেই। অরুণদা, আপনি আমায় ভালোবাসেন?
না।
ভালোবাসেন না? কেন?
মোম একেবারে অরুণের বুকের ওপর ঝুঁকে পড়ল। খুবই ব্যগ্র আর উৎকণ্ঠিত তার মুখ। যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। তার শরীরের সমস্ত উত্তাপ এসে লাগছে অরুণের চোখে মুখে। ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞেস করল, আমাকে ভালোবাসবেন না? আমি খারাপ?
অরুণ মোমের পিঠের ওপর একটা হাত রেখে শান্ত ভাবে চেয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর বলল, অত কাছে এসো না। একটু সরে বোসো। অসুস্থ মানুষের এত কাছাকাছি বসতে নেই। তা ছাড়া হঠাৎ কেউ ঘরে ঢুকে দেখলে কী ভাববে?
যা ইচ্ছে ভাবুক! আপনি আগে বলুন!
কী বলব?
আপনি আমায় ভালোবাসবেন কি না!
তোমার মতন এত সোজাসুজি ভালোবাসার কথা যদি সবাই জিজ্ঞেস করতে পারত, আর এক কথায় উত্তর দেওয়া যেত, তা হলে পৃথিবীতে অনেক সমস্যাই থাকত না।
অত কথা শুনতে চাই না, আপনি বলুন।
মোম, সরে বোসো, লক্ষ্মীটি। আমার কষ্ট হচ্ছে। কেউ দেখে ফেললে তোমাকে আমাকে দুজনকেই খুব খারাপ ভাববে।
আমার বয়ে যাবে তাতে। আপনি তা হলে আমাকে ভালোবাসেন না?
না।
আমি খারাপ সেইজন্যে?
না। তুমি খারাপ নও। তুমি যদি এত সুন্দরী না হতে, এত ছটফটে না হতে, ছেলেবেলা থেকেই ওইসব অভিজ্ঞতা যদি তোমার না হত, তা হলে আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারতাম—তুমি যেরকম ভালোবাসার কথা বলছ তা নয়, অন্যরকম ভালোবাসা—
বুঝতে পেরেছি। আপনি আমাকে ঘেন্না করেন!
মোমের মুখে বিষাদের একটা পাতলা ছায়া পড়ল। আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে খাট থেকে নামতে গেল। মেঝেতে একটা জলের ডেকচি ছিল, সেটা তার পায়ে লাগতে মোম ‘দূর ছাই’ বলে একটা লাথি মারল। সারা মেঝেতে জল গড়িয়ে গেল। অরুণ ঝুঁকে এসে মোমের একটা হাত ধরে বলল, রাগ কোরো না। আমি মোটেই তোমাকে ঘেন্না করি না। তুমি খুব সুন্দর। তুমি বড় বেশি সুন্দর। তোমাকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার নেই।
থাক, আর বাজে বাজে কথা বলে আমাকে ভোলাতে হবে না।
না, সত্যি। আমার বুকের ভেতরটা একদম খালি। সব ভালোবাসা আমি আগেই একজনকে দিয়ে দিয়েছি। আর কাউকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার নেই।
কে? কাকে? আপনার বিয়ে হয়ে গেছে বুঝি?
না, বিয়ে হয়নি। একজনকে ভালোবাসতাম, কিন্তু সে এখন হারিয়ে গেছে।
মরে গেছে?
কী জানি মরে গেছে কি না? তবে হারিয়ে গেছে, আমি আর তাকে খুঁজে পাই না।
মোম ঘাড় কাত করে কী যেন ভাবল একটুক্ষণ। হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে অরুণের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বিছানা ছেড়ে মাটিতে নেমে আপন মনে কথা বলার সুরে বলল, একজনকে ভালোবাসলে তারপর বুঝি আর কাউকে ভালোবাসা যায় না? খুব যায়!
না, যায় না। জীবনে একবারের বেশি ভালোবাসা…..
বাজে কথা বলবেন না। আমি অনেক দেখেছি। আমার মা-ই তো আগে বাবাকে ভালোবাসত, এখন আর বাসে না। মা এখন সন্তুমামাকে ভালোবাসে। মা যখন কলকাতায় যায়—
মোম, তুমি আবার ওইসব খারাপ কথা বলছ?
ধমকাচ্ছেন কী? ভালোবাসতে পারবেন না, তা হলে আবার ধমক দেওয়া কেন? আমার যা খুশি বলব! ভাবছেন, আমি ছেলেমানুষ আমি কিছু বুঝি না? আমি সব বুঝি, সব দেখতে পাই।
তুমি একটু শান্ত হয়ে বোসো।
না, আমি বসব না! আপনার ন্যাকামি আমি বুঝেছি! একজনকে ভালোবাসলে আর ভালোবাসা যায় না! কত লোক একসঙ্গে দু’-তিনজনকে ভালোবাসছে, আমি দেখেছি।
আচ্ছা, আচ্ছা, অনেকে হয়তো পারে, আমি পারি না। সবাই তো সব জিনিস পারে না!
তা, আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়!
অরুণ এবার একটু হাসল। মোম হাসল না। সে ঘরের মধ্যে ছটফট করছে, এটা-ওটা নাড়াচাড়া করছে। ভুরু কোঁচকানো মুখে চাপা রাগ আর দুঃখ, যেন সে দারুণ অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে। অরুণ অনুনয় করে বলল, মোম, তুমি রাগ করছ! তোমাকে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগে। এসো না, দুজনে এমনি গল্প করি। কার্তিককে বলি চা বানাতে।
না, আপনার সঙ্গে গল্প করতে আমার বয়ে গেছে। রুগির ঘরে বেশিক্ষণ বসতে আমার বিচ্ছিরি লাগে। আমি এখন বাড়ি যাব, তারপর….
তারপর?
তারপর রতনকে ডাকব। আমি খারাপ….খারাপ লোকের সঙ্গেই আমি মিশব।
মোম, শোনো!
মোম ততক্ষণে হাতব্যাগ আর বইগুলো তুলে নিয়েছে। ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল। অরুণের দিকে আর পিছন ফিরে তাকালও না। অরুণ জানলার দিকে চেয়ে রইল। দরজা পেরিয়ে গলি দিয়ে যাবার সময় জানালা দিয়ে আবার মোমকে দেখা যায়। এবারও সে অরুণের দিকে তাকায়নি। তার সরল মুখে এমন জেদি অভিমান।
মালতীও একদিন এসেছিল। অরুণ তখন অনেকটা সেরে উঠেছে। সন্ধ্যাবেলা কোথাও নেমন্তন্ন আছে বোধহয়। খুব সেজেগুজে এসেছে মালতী—রূপ ও প্রসাধনে দারুণ উজ্জ্বলতা—নেমন্তন্ন রাখতে যাবার আগে অল্পক্ষণের জন্য রজত আর মালতী একটু দেখে যেতে এসেছে।
মালতী মিষ্টি হেসে বলল, আপনি তো সেরে উঠেছেন দেখছি! আমি আগে আসতে পারিনি, নানান কাজে ব্যস্ত ছিলুম—মাঝখানে কলকাতায় যেতে হয়েছিল একবার।
মালতীর মুখের প্রতিটি রেখা অরুণের চেনা। ঠিক বুঝতে পারে, মালতী কখন মিথ্যে কথা বলছে। চকিতে মালতীর সেই মুখ দেখে নিয়ে অরুণ নম্র ভাবে বলল, বিশেষ কিছু তো হয়নি, সামান্য জ্বর কয়েক দিনের—
রজত হাসলেন, হাসি মুখেই বললেন, এই সামান্য অসুখে আপনি কিন্তু বেশ রোগা হয়ে গেছেন! কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে এবার শরীরটা সারিয়ে ফেলুন। ছুটি নেবেন নাকি?
দেখা যাক, ছুটি আর পাওনা আছে কিনা।
এই সময় শরীরের অযত্ন করবেন না। টাইফয়েডের একটা ভালো দিক কী জানেন—সেরে ওঠার পর একটু ভালো খাওয়া-দাওয়া করলেই শরীর খুব ভালো হয়ে উঠে। আগের চেয়েও ভালো হয়।
আপনারা একটু চা খাবেন?
না, চা-টা খেয়েই বেরিয়েছি। আবার খেতে হবে মুখার্জি লজে। মিলু, তুমি বরং এখানে একটু বোসো, আমি চট করে একটু ঘুরে আসছি। একটা কেবলগ্রাম পাঠাতে হবে—বিশেষ জরুরি।
যাবার পথেই তো করা যায়।
না, উলটোদিক হয়ে যাবে। বোসো, আমার মিনিট দশেক লাগবে।
রজত আর কারওকে কোনও কথা না বলতে দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মালতী কী বলতে গিয়েও থেমে গেল। অরুণ অবাক হয়ে দেখল রজতের চলে যাওয়া।
জানলার কাছে চেয়ারে মালতী, অরুণ বিছানায় বাবু হয়ে বসেছে। দুজনে দুজনের দিকে সোজা তাকাল। তাকিয়েই রইল, কথা বলল না। এই রকম অনেকক্ষণ তাকালে চোখ জ্বালা করে। অরুণ সামান্য একটু হাসল, মালতীরও ঠোঁটে এল হাসির রেখা। মালতীই প্রথম কথা বলল।
তোমার অসুখের কথা শুনে আমি ইচ্ছে করেই দেখতে আসিনি।
জানি। ভালোই করেছ।
তুমি সত্যিই খুব রোগা হয়ে গেছ।
এ কথার জবাব দেবার আগে অরুণের হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে পায়ে চটি গলিয়ে এগিয়ে এল মালতীর দিকে। পাজামা আর গেঞ্জি গায়, অরুণের বুকের রোমরাজি পর্যন্ত দেখা যায়। অরুণ মালতীর কাছে এসে একটু দাঁড়াল, তারপর খানিকটা তীব্র গলায় বলল, তুমি বসো, আমি বাথরুমে যাচ্ছি। বাথরুমে আমার অনেকক্ষণ লাগবে—আশা করি ততক্ষণে রজতবাবু এসে যাবেন। তারপর তোমরা চলে যেয়ো!
কেন?
তোমার স্বামী কী চান?
তার মানে?
আমি রজতবাবুর ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। কেন উনি আমার সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার করছেন? কেন আমার এখানে এত আসেন? কেন তোমাকে বসিয়ে রেখে ইচ্ছে করে বাইরে চলে গেলেন?
হয়তো ভেবেছেন, তোমার সঙ্গে আমার কোনও গোপন কথা আছে।
সত্যিই আছে নাকি?
তুমি বলো।
না, কিছু নেই। আমি গোপন কিছু চাই না, আমি চুরি করে কিছু নিতে চাই না। স্বামীর আড়ালে কারওর স্ত্রীর সঙ্গে কোনও অন্যায় কথা বলতে চাই না।
অরুণদা, তোমার শরীর কাঁপছে। এত রাগ….
রাগ নয়। কিন্তু একটা অন্য ধরনের উত্তেজনা বোধ করছি। রজতবাবু যদি ভেবে থাকেন, আমি লুকিয়ে-চুরিয়ে কিছু চাই, তা হলে ভুল ভেবেছেন, অত্যন্ত ভুল ভেবেছেন! আমি কিছু চাই না। কিচ্ছু না।
ওর মনের মধ্যে কোনও প্যাঁচ নেই, উনি এ সব কিছু ভাবেননি। তুমি একটু শান্ত হয়ে বোসো, তোমাকে কয়েকটা কথা বলি।
না, আমি বসব না। তোমার সামনে একা ঘরে এরকম বসে থাকতে পারি না। তুমি জান না? তুমিই বোসো, আমি বাইরে যাচ্ছি।
অন্তত একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তুমি এখানে রয়েছ কেন?
অরুণ একটু থমকে দাঁড়াল, কিছু ভাবল। তারপর হতাশ ভঙ্গিতে বলল, আমি তো চলে যেতেই চাইছি। চলে যাবও! চেষ্টা করছি চারদিকে। একটা অন্য কোথাও চাকরি না পেলে কী করে যাই? হঠাৎ সব ছেড়ে চলে যাওয়া যায়? তবে তোমায় কথা দিচ্ছি, আমি শিগগিরই চলে যাব।
অরুণদা, একটা জিনিস বুঝতে পারছ, জীবনে অনেকগুলো জিনিস খুব বেমানান হয়ে যায়? আমার যখন অসুখ করল, তারপর সেই অসুখে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল। বেঁচে উঠলাম কেন? বেঁচে উঠে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। কিংবা, তুমিও যদি মরে যেতে, তা হলে এসবের একটা কিছু মানে থাকত। আমিও বেঁচে রইলুম, তুমিও বেঁচে রইলে, তবে মাঝখান থেকে অসুখটা হল কেন? তা হলে যে অসুখটা মিথ্যে হয়ে যায়।
না মিথ্যে নয়, অসুখটাই সত্যি। সুখগুলোই মিথ্যে, তাদের বিশ্বাস করা যায় না।
তারপর তোমার সঙ্গে ডায়মন্ডহারবারে আবার দেখা হল কেন? এটাও বেমানান নয়? তুমি আর আমি একই জায়গায় এরকম কাছাকাছি থাকা—
আমি চলে যাব।
অরুণদা, তুমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছ! তুমি আর কোনওদিন আমার মুখের দিকে তাকাবে না ঠিক করেছ? আমার কি কিছুই বলার নেই!
হয়তো আছে। নিশ্চয় আছে। কিন্তু বোলো না। সেসব আমার না শোনাই ভালো। আমি তো তোমার কেউ নই। আমরা আলাদা—
এগুলো অভিমানের কথা।
ঠিক বুঝতে পারি না। বুকের মধ্যে অভিমান ঈর্ষা এগুলো আর কোনওটাই আলাদা করে বুঝতে পারি না। মালতী, তুমি বোসো, আমি যাই।
মালতী দ্রুত উঠে এসে অরুণের গায়ে একটা হাত রাখল। অরুণ চমকে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল। প্রখর চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে ছুঁয়ো না কখনও?
আমার ওপর তোমার এতই ঘৃণা!
ঘৃণা নয়। আঃ, তুমি বুঝতে পারছ না? এটা ঠিক নয়। যদি একদিন আমার ধৈর্য নষ্ট হয়ে যায়? যদি একদিন হঠাৎ আমার এই মুখোশটা খুলে ফেলে তোমার সামনে ভয়ংকর ভাবে দাঁড়াই? যদি তোমার হাত ধরে টান দিয়ে বলি, এসো! কী প্রতিজ্ঞা করেছিলে মনে নেই? রাত্রিবেলা বালি ব্রিজে দাঁড়িয়ে, মাথার ওপরে আর নীচে দু-দুটো চাঁদ, ভয়ংকর ট্রেনের শব্দ, তুমি আমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিলে—
মালতী মুখ ফিরিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুট ভাবে বলল, না, আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমি সব ভুলে গেছি, সব!….. সে অন্য একজন মালতী, আমি নয়। একটা অসুখ আমাকে বদলে দিয়েছে, তোমাকেও বদলে দিয়েছে।
অরুণ র্যাক থেকে তোয়ালেটা এনে মালতীর দিকে এগিয়ে দিয়ে নম্র ভাবে বলল, রজতবাবু যদি এসে পড়েন, কী ভাববেন! তুমি চোখটা মুছে নাও। আমি কোনওদিন আর এসব কথা বলব না। তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না। সত্যিই আমরা অনেক বদলে গেছি। জীবন এখন অন্য রকম। চোখটা মুছে নাও।
মালতী হাত বাড়িয়ে তোয়ালেটা নিয়ে মুখ মুছল। মুছে তোয়ালেটা আবার ফিরিয়ে দিল অরুণকে। তোয়ালের ভিজে জায়গাটা অরুণ চেপে ধরল নিজের মুখে। দু’-একমুহূর্ত। তারপর অরুণ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, এবার যখন আমি চলে যাব, আর পিছন ফিরে তাকাব না। মিলু, তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ, এখন থেকে তোমার জীবনটা সুখী হোক, আমি তাই চাই।