সাত
বামপন্থীদের ডাকে সারা পশ্চিমবঙ্গে আজ হরতাল। ডায়মন্ডহারবারেও ইস্কুল-কলেজ কোর্ট-কাছারি বন্ধ। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে নানারকম ধ্বনি তুলে মিছিল যাচ্ছে। রজত তাড়াতাড়ি সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। শহরের অবস্থা মোটামুটি শান্তই ছিল, কিন্তু দুপুরের দিকে রেল স্টেশনে গণ্ডগোল বেধে গেল। যা হয়, একদল বদমাইশ ছেলে গিয়েছিল রেলের কামরা থেকে পাখা আর বালব চুরি করতে। রেল পুলিশের তাড়া খেয়ে কিছুদুর পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা রাজনৈতিক রূপ পেয়ে গেল। প্রচুর ইট বর্ষণ, লাঠি চার্জ, রেলের কামরায় আগুন, শেষপর্যন্ত গুলি—স্টেশনটা একটা তাণ্ডব ক্ষেত্রে পরিণত হল।
রজত সেখানে ছুটলেন গণ্ডগোল থামাতে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন, জনতা ঘিরে ধরল তাঁকে। পুলিশের জুলুম, সরকারের দালালি ইত্যাদি ধ্বনি উঠল। এই শহরে এই প্রথম প্রকাশ্যে রজত লাঞ্ছিত হলেন। হাসিখুশি ভালো মানুষ বলেই রজত এখানে পরিচিত ছিলেন। পুলিশের সাহায্য ছাড়াই একা এই উত্তেজিত জনতার মধ্যে প্রবেশ করা হয়তো রজতের হঠকারিতা হয়েছিল। ক্রমশ উত্তেজনা বাড়তে লাগল, লোকজনের ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কির মধ্য থেকে রজতকে জ্যান্ত কবর দেবার প্রস্তাবও শোনা গেল। নেতারা হাতজোড় করে নিরস্ত করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সব কিছু তাদেরও আয়ত্তের বাইরে। পুলিশের গুলিতে তিনজন আহত হয়েছে, সুতরাং রক্তের বদলে রক্ত চাই। রজত হাসিমুখেই অবিচলিত ভাবে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন, হঠাৎ একটা ইঁটের টুকরো তাঁর কাঁধে এসে লাগল।
ব্যাপারটা আরও কতদূর গড়াত বলা যায় না। পুলিশ বাহিনীও দ্রুত এসে পড়েছিল, কিন্তু সহজ নিষ্পত্তি করলেন ডাঃ সেন। খবর পেয়ে তিনি ছুটে এসে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গিয়ে রজতের পাশে দাঁড়ালেন। সাধারণত ডাক্তারকে সকলেই সম্মান করে, তা ছাড়া ডাঃ সেনের বাবা এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ লোক ছিলেন। সুতরাং এখনও কিছুটা সমীহ তাঁর প্রতি রয়ে গেছে। ডাঃ সেন রজতকে বার করে আনলেন। তারপর প্রস্তাব করলেন, রাজনৈতিক নেতারা কয়েকজন শুধু তাঁর বাড়িতে এসে রজতের সঙ্গে কথাবার্তা বলুন। কিন্তু তার আগে রজতের চিকিৎসা করার সময় দিতে হবে।
রজতের আঘাত বেশি কিছু নয়। কাঁধের কাছে কানের পিছন দিকটায় ইঁট এসে লেগেছে। খানিকটা রক্তও বেরিয়েছে। কিন্তু অপমানে রজতের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সেখানটায় ফার্স্ট এড দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে ডাঃ সেন বললেন, একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর কিছুক্ষণ নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিন। আপনার মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে ওরা এখন একটু মোলায়েম ভাবে কথা বলবেন ঠিকই। আপনার ইনজুরি বিশেষ কিছু না। শুধু তুলো লাগিয়ে রাখলেও হত, কিন্তু এটা আপনার মেক-আপ।
অন্যসময় হলে রজত এই কথায় হাসতেন, আজ হাসতে পারলেন না। রুষ্টভাবে বললেন, কিন্তু ওঁদের সঙ্গে কথা বলে লাভ কি হবে আর? ওঁরা তো বোঝালেও বুঝবেন না। গুলি চালাবার জন্য তদন্ত কমিশন বসাবার কী আছে এর মধ্যে, বলুন? শুধু-শুধু সময় আর টাকার অপব্যয়! গুলি চালানোটা অন্যায় হতে পারে, কিন্তু দিনের আলোয় গুন্ডামি-ডাকাতি হলেও গুলি চলাবে না? এ তো একটা বাচ্চা ছেলেও বোঝে।
বাচ্চা ছেলে বুঝলেও ওরা বুঝবে না। না বোঝাটাই ওদের স্বার্থের পক্ষে সুবিধে।
তা হলে আর কথা বলে লাভ কী?
কথাই তো সব।
না, তার চেয়ে বরং ওদের যা ইচ্ছে হয় তাই করুক, আমি যেখানেই বে-আইনি কাজ দেখব শক্তি দিয়ে আটকাব।
আপনি আজ সত্যিই বেশি রেগে গেছেন। আপনি যা বললেন, তাতে গণ্ডগোল আর তিক্ততা ক্রমশই বাড়বে। ওদেরও তো শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই, মানুষজন খেপে উঠছে আজকাল—খ্যাপবার যে যথেষ্ট কারণ রয়েছে, তা নিশ্চয়ই আপনিও স্বীকার করবেন!
কী মুশকিল, কিন্তু এ ব্যাপারে আমার সামর্থ্য কতখানি বলুন?
সেই তো! আসলে ওদেরও দাবির শেষ নেই, আপনারও তার একটা মেটাবার সামর্থ নেই। সুতরাং দু’পক্ষেরই একমাত্র উপায় কথা বলে সময় কাটানো। ওরা খালি একের পর এক শর্ত নিয়ে আলোচনা করবে, আর আপনি সব কিছুই বিবেচনা করে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাবেন। যান, বাইরের ঘরে ওরা বসে আছে, আমি ততক্ষণে মালতীর কাছে খবর পাঠাচ্ছি। সে হয়তো গুজব শুনে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। কী গুজবই রটে এ শহরে! গঙ্গার পাড়ে গেলে এক্ষুনি শুনতে পাওয়া যাবে যে, জনতার হাতে ইঁট খেয়ে আপনার মাথা দু ফাঁক হয়ে গেছে।
ব্যাপারটা চুকতে চুকতে আটটা বাজল। রজতের চোখ-মুখ বিভ্রান্তের মতন। ডাঃ সেনের কাছে বিদায় নিতে এসে দেখলেন, তিনি বেরোবার উদ্যোগ করছেন। রজত জানতে চাইলেন, এ সময় কোথায় যাচ্ছেন? পথে-ঘাটে এখনও উত্তেজনা রয়েছে।
ডাক্তার সেন বললেন, মোমটা সারাদিন বড় জ্বালাচ্ছে। একবার বেরোতেই হবে। অরুণকে দেখতে যাব।
কেন, অরুণবাবুর কি অসুখ নাকি?
কিছু না। সামান্য জ্বর। কাল বিকেলে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। তখনই গা-টা গরম গরম। বোধহয় ইনফ্লুয়েঞ্জা। ছ’টা ট্যাবলেট দিয়েছিলাম। মোম আজ সকাল থেকেই বলছে, যদি অরুণদার অসুখ বেড়ে থাকে। হরতালের দিন হয়তো একা-একা খুব কষ্ট পাচ্ছেন। একটা চাকরকে পাঠিয়েছিলাম খোঁজ নিতে। সেও এসে বলল, বাবু ভালোই আছেন। মোম তাও বিশ্বাস করে না। ওর ধারণা, চাকর কিছু বোঝে না। কিংবা অরুণবাবু লাজুক মানুষ, অসুখ বাড়লেও নিজের মুখে বলবেন না। জানেন তো মোমকে, একবার যা মাথায় ঢুকবে, কিছুতেই কারওর কথাতেই সেটা আর ওর মাথা থেকে তাড়ানো যাবে না।
মোম টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে বলল, আপনিই বলুন রজতদা, একবার দেখতে যাওয়া উচিত না!
রজত বললেন, বেশ তো, চলুন না ডাক্তার সেন, আমি আপনাকে ওই পথটুকু পৌঁছে দিচ্ছি। চট করে ঘুরে আসবেন।
মোমের মুখখানা মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বলল, যাবেন? তা হলে আমিও যাব।
না, না, মোম, তুমি না। হরতাল শেষ হয়নি—এখনও অবস্থা ভালো না।
তাতে কী হয়েছে, রুগির কাছেও মানুষ যেতে পারবে না?
রুগি আবার কোথায়? সামান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা।
কাল সামান্য ছিল, আজ অনেক বেড়ে থাকতে পারে।
তোর সঙ্গে আমি কথায় পারব না। তোর এখন কাপড়-টাপড় বদলাতে হবে, অনেক দেরি হয়ে যাবে।
কিছু দরকার নেই। আমি যা পরে আছি, এই রকম ভাবেই বেরোব। কী রজতদা, এরকম যাওয়া যায় না? খারাপ দেখাবে?
মোম একটা হালকা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পরে আছে। রজত বললেন, কেন যাবে না! বেশ তো সুন্দর দেখাচ্ছে।
গাড়িতে উঠে রজত মোমকে আবার বললেন, কী ব্যাপার মোম? আমার মাথা ফেটে গেল, তা নিয়ে তুমি একটাও কথা বললে না। আর অরুণদার সামান্য জ্বরের জন্য এত ব্যস্ত?
আপনার আবার মাথা ফেটেছে কোথায়?
বাঃ! এই যে ব্যান্ডেজ বাঁধা! তোমার বাবা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছেন।
ওঃ, এটা! তখন আমি ছাত থেকে সব দেখছিলাম। আমিই তো বাবাকে বললাম প্রথম। আপনার মোটে এইটুকু একটা ইট লেগেছে—ক’ ফোঁটা রক্ত পড়েছিল। ওকে বুঝি মাথা ফাটা বলে?
বাঃ, আমার বেলা এইটুকু, আর অরুণদার বেলায় সামান্য জ্বরও সামান্য নয়?
মোম ঝরঝর করে হেসে ফেলে বলল, বাবাঃ, কী হিংসুটে আপনি! আপনার তো বাড়িতে দেখবার লোক আছে। অরুণদার কেউ আছে?
রজত ইষৎ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, তা ঠিক!
আশ্চর্য! মোমের আশঙ্কাটা কিন্তু ঠিক। অরুণ বিষম জ্বরের ঘোরে কুঁকড়ে পড়ে আছে বিছানায়। চাকর দরজা খুলে ওদের ভেতরে নিয়ে গেল। অরুণের ভালো রকম চেতনা নেই। চোখ দুটো লাল, একটু একটু কাঁপছে শরীরটা। কপালে জলপটি লাগানো ছিল। কেউ সেটা ভিজিয়ে দেয়নি, সেটা শুকিয়ে খরখরে হয়ে আছে। মোম বাবার দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, তোমায় বলেছিলুম না সকালে আসতে?
ডাক্তার সেন চাকরকে জিজ্ঞেস করলেন, সকালে খবর দিসনি কেন? আমার লোক যখন এসেছিল, তাকেই বা কিছুই বলিসনি কেন? চাকর কাঁচুমাচু ভাবে উত্তর দিল যে, সকালে বাবু বলেছিলেন, ও বিশেষ কিছু না, এমনিই সেরে যাবে। বিকেল থেকেই বেশি বেড়েছে।
বিকেলে খবর দিসনি কেন তবে?
বাবু মানা করেছেন।
যেমন তোমার বাবু, তেমনি তুমি! উনুনে গরম জল চাপাও শিগগির!
মোম গিয়ে সোজা অরুণের খাটের পাশে বসে পড়েছে। বিনা দ্বিধায় অরুণের কপালে হাত রেখে বলল, অরুণদা, অরুণদা! কষ্ট হচ্ছে?
অরুণ ভালো করে চোখ মেলে তাকাবার চেষ্টা করল। এক মুহূর্তের জন্য যেন চেতনা ফিরে আসতেই ধড়ফড় করে উঠে বসতে গেল। ডাঃ সেন বললেন, উঠবেন না, উঠবেন না, কী মুশকিল!
মোম দু হাতের চাপ দিয়ে জোর করে শুইয়ে দিল অরুণকে।
রজত চেয়ে চেয়ে অরুণের সম্পূর্ণ ঘরটা দেখছেন। এই এক রকমের জীবন, এই জীবন সম্পর্কে রজতের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ঘরের মাঝখানে একটা খাট, একপাশে টেবিল ও কয়েকটা চেয়ার, একটা আলনা, একটা সুটকেস—শুধু এই নিয়ে একজনের সংসার—সব মিলিয়ে নিঃসঙ্গতা রয়েছে এখানে। রজত নিজেও খুব ছেলেবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন, কিন্তু আর্থিক কষ্ট কখনও সইতে হয়নি, স্নেহের অভাবও বোধ করেননি তেমন। রজতের বাবা ছিলেন আসামের একটি চা-বাগানের ম্যানেজার। ব্যাঙ্কে যথেষ্ট টাকা এবং বেশ কিছু শেয়ার রেখে গেছেন। রজতের কৈশোর কেটেছে ধনী আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। কাকা তাঁকে নিজের ছেলের মতন স্নেহ করতেন। এই রকম একটা নিরাভরণ ঘরে একা অসুখে ভোগার মতন অবস্থা রজতের কখনও হয়নি। অরুণের জন্য হঠাৎ রজতের খুব কষ্ট হল। চাকরের হাতে সেবার ভার। রোজ কি সে অরুণের বিছানার চাদর বদলে দেবে? অসুস্থ মুখে অরুচি হলেও কি সে অরুণকে জোর করে খাওয়াবে? কপালে একটা স্নেহের হাত না পড়লে কি অসুখ কখনও সারে? রজতের হঠাৎ খুব ইচ্ছে হল অরুণকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু অরুণ কি রাজি হবে? মালতী কি রাজি হবে? হয়তো ওরা দুজনেই তাঁকে ভুল বুঝবে।
আলোর সামনে থার্মোমিটারটা তুলে ধরে ডাক্তার সেন বললেন, একশো চার পয়েন্ট ছয়—একটু বরফ পাওয়া গেলে ভালো হত, কিন্তু আজ বোধ হয় হরতালের ঝঞ্ঝাটে পাওয়া যাবে না।
এ রকম হাই টেম্পারেচার, ইনফ্লুয়েঞ্জাই মনে হয়?
ঠিক বলা যায় না। ব্লাড টেস্ট করতে হবে, টাইফয়েড বলে সন্দেহ হচ্ছে।
টাইফয়েড যদি হয়, তা হলে এরকম ভাবে ওকে একা-একা ফেলে রাখা….
ডাক্তার সেন হেসে উঠে বললেন, তাতে কী হয়েছে? বিশেষ কিছুই না, টাইফয়েড হলে তো আজকাল অনেকে ডাক্তারই ডাকে না, নিজে নিজেই চিকিৎসা করে।
তা হলেও এত জ্বরের মধ্যে কোনও রুগিকে একা রাখা কি ঠিক?
আমি ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছি। রতনকে বলে দেব, সকালে এসে দেখে যাবে—ব্লাডটাও নিয়ে যাবে।
রজত তবু চিন্তিত ভাবে বললেন, তবু, একটা মানুষ একা-একা থাকবে? আচ্ছা, ওঁর বাড়ির লোকজনকে একটা খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করব? ঠিকানা-টিকানা জানলে….
ডাক্তার সেন বললেন, আপনাকে বাইরে থেকে দেখতে এত শক্ত, কিন্তু আসলে তো আপনি খুব দুর্বল লোক দেখছি! এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? হয়তো শেষপর্যন্ত দেখা যাবে ইনফ্লুয়েঞ্জাই। তার জন্য আগে থেকে বাড়ির লোককে খবর দিয়ে চিন্তিত করার কোনও মানে হয়? তা ছাড়া ওঁর একা থাকার অভ্যেস আছে, আমার কাছে কাল গল্প করছিলেন—ওঁর আসামে থাকার কথা—
রজত অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, কারওর অসুখ দেখলেই আমার কী রকম যেন ভয় করে। আমি নিজে তো কখনও গুরুতর অসুখে ভুগিনি।
আপনি নিজে না ভুগলেও বাড়িতে তো একজন গুরুতর রুগিকে একার চেষ্টাতেই ভালো করে তুলেছেন। তখন আপনার যেরকম ধৈর্য দেখেছি….
মোম হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, ঘাম হচ্ছে খুব! জামা-টামা ভিজে যাচ্ছে।
ডাক্তার সেন বললেন, ঠিক আছে। জ্বর কমছে। মোম, তুই একটু বিছানা থেকে উঠে আয় না, মা!
কেন?
যদি ফ্লু হয়ে থাকে, তবে ছোঁয়াচ লেগে তোরও নির্ঘাত হবে কিন্তু।
হোক গে।
ডাক্তার সেন মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েকে আর বলার সাহস তাঁর নেই। হঠাৎ যে মোম কখন কী কাণ্ড করবে, তা কিছুই বলা যায় না। মোম অত্যন্ত সহজ ভাবে খাটের ওপর সম্পূর্ণ উঠে বসে তোয়ালে দিয়ে অরুণের মুখ ও বুকের ঘাম মুছে দিচ্ছে। ডাক্তার সেন অরুণের চাকরকে বললেন, শোনো, কী নাম তোমার? কার্তিক? তুমি রাত্তিরে এখানেই থাক তো? ঠিক আছে, রাত্তিরে তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। তোমার বাবু সারারাত ঘুমোবেন, সকালে উঠে বাবুকে চা-টা খাইয়ে, বাবু যা খেতে চান, তাই খাওয়াবে। তারপর রতন ডাক্তারের কাছে যাবে।
অরুণের জ্ঞান ফিরে এসেছে সম্পূর্ণ। চোখ মেলে মোমকে দেখে সে যেন হতচকিত হয়ে গেল। তারপর পাশ ফিরে রজত ও ডাক্তার সেনকে দেখে সে উঠে পড়ল, বলল, একী!
মোম ধমকের সুরে বলল, আবার উঠছেন কেন? শুয়ে পড়ুন!
কেন? তোমরা, আপনারা হঠাৎ এই সময়ে—
আপনি তো আচ্ছা লোক। সকালবেলা বিষ্টুকে পাঠিয়েছিলুম, তাকে কিছুই বলেননি।
আমার তো বিশেষ কিছু হয়নি।
একশো সাড়ে চার ডিগ্রি জ্বর, আর বেশি কী হবে?
অরুণ ক্ষীণ ভাবে হেসে বলল, ও এমন কিছু নয়। আমার এরকম হয় মাঝে মাঝে।
ডাক্তার সেন এবার যথার্থ কৌতূহলী হয়ে বললেন, মাঝে মাঝে হয় মানে?
বছরে দু’বার আমার এরকম জ্বর হয়। বেশিদিন ভোগায় না, চার-পাঁচদিন থাকে, এই জ্বর আমার পোষা হয়ে গেছে।
বাঃ, বেশ, বেশ! শরীরে জ্বর পুষেছেন যখন তখন তো খুব বড় কাজ করেছেন। দেখি, জিবটা একটু দেখান তো! তবে, এবার মনে হচ্ছে টাইফয়েড হয়েছে!
টাইফয়েড?
অরুণ একটু দমে গেল। একটুক্ষণ চুপ করে আবার বলল, টাইফয়েড? টাইফয়েড তো শরীরটাকে খুব দুর্বল করে দেয়, তাই না? কিন্তু এখন যে আমার অনেক কাজ। এখন বিছানায় শুয়ে সময় নষ্ট করলে যে খুব মুশকিল হবে! ওকী রজতবাবু। আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন! আপনার মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?
ঠিক আছে, ঠিক আছে। ওটা কিছু না। সামান্য একটু কেটে গেছে।
মোম বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। হাত দিয়ে শাড়ির ভাঁজ ঠিক করল। এখন তার মুখখানা আবার বদলে গেছে। একটু আগে যে উৎকণ্ঠা আর উদবেগ ছিল, তার লেশ মাত্র নেই। বরং চোখের তারা দুটো চঞ্চল, বলল, না, আর বসে কী হবে! বাবা, তোমার খাবার সময় হয়ে গেল। …অরুণের টেবিলের বইগুলো একটু নেড়ে-চেয়ে পুনরায় বলল, কী সব কঠিন বই, ডিটেকটিভ বই নেই? চলো বাবা। মোম সঙ্গে সঙ্গে দরজার দিকে পা বাড়াল।
ডাক্তার সেন বললেন, দাঁড়া, একটু দাঁড়া, সব ব্যবস্থা করে যাই।
আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। খিদে পেয়েছে।
অরুণ বিস্মিত ভাবে মোমকে দেখছিল, তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমি এখন খুব ভালো আছি, আপনারা আর কেন কষ্ট করে—
ডাক্তার সেন বললেন, ঠিক আছে, আপনি এই ট্যাবলেট দুটো জল দিয়ে খেয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ুন। ওহে কার্তিক, বাবুর মাথার কাছে জল রেখে দাও, রাত্তিরে হয়তো তেষ্টা পাবে। আচ্ছা চলি, গুড নাইট।
রজতও বললেন, চলি। তারপর দুজনে বেরিয়ে এলেন। মোম কিছুই না বলে আগেই বেরিয়ে রাস্তায় গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছে। অরুণের বাড়ির দরজা দিয়ে বেরোতে বেরোতে ডাক্তার সেন রজতকে বললেন, ছোকরা এবার কিছুদিন ভুগবে। বছরে দুবার পোষা জ্বর, চালাকি!
রেকর্ড প্লেয়ারে ক্যালিপসো সুর বাজছে, মালতী বসেছিল বারান্দায় বেতের চেয়ারে। আজ সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ খানিকটা গরম পড়েছিল, এখন উঠেছে মনভোলানো হাওয়া। রজত দুপুরবেলা খেয়ে যাবার পর আর ফেরেনি। বিকেলে ডাঃ সেন টেলিফোন করে জানিয়েছে রজত কী এক জরুরি মিটিং-এ আটকে গেছে। সারা দুপুর ধরে মালতী একটা উপন্যাস পড়ছিল বিছানায় শুয়ে শুয়ে। বইটা শেষ হয়নি, কিন্তু আর পড়তে ভালো লাগছে না, চোখটা যেন টনটন করছে। বই মুড়ে রেখে মালতী অনেকক্ষণ ধরে বাথরুমে গা ধুয়েছে, তারপর হঠাৎ শখ হওয়ায় আলমারি খুলে একটা সিল্কের শাড়ি বার করে পরেছে। বুকে আর কানের লতিতে লাগিয়েছে দাবি সেন্ট। সেজেগুজে মালতী একা-একা বসে আছে।
শরীর সুস্থ থাকার একটা স্বাভাবিক আনন্দ আছে। বাথরুমে গা ধোওয়ার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মালতী ছেলেমানুষের মতন নাচের ভঙ্গি করছিল। অনেকদিন বাদে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের গতির মধ্যে সাবলীলতা এসেছে। ব্যথা নেই, দুর্বলতা বা আড়ষ্টতা নেই। মালতী অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে দেখছিল, দেখে যেন নিজেকে চিনতে পারল।
এতবড় দোতলা বাড়িটায় রান্নার ঠাকুর, একজন চাকর আর একজন বাগানের মালি—তারা সবাই নীচে। দোতলায় রয়েছে শুধু মালতী—কথা বলার কেউ নেই। এখন রজত কাজে খুবই ব্যস্ত থাকছে। এখন মালতীকে অনেকক্ষণ একা থাকতে হয়, সময় আর কাটে না। হাতে খুব বেশি সময় থাকলে, তখন বই পড়তেই ভালো লাগে না। কলেজে পড়ার সময় মালতী সারাবছরই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকত। এখন তার সেই পুরনো স্বাস্থ্য ও উদ্দীপনা ফিরে এসেছে, কিন্তু সারাদিন ধরে কোনও কাজ নেই বলে তার হাঁপ ধরতে শুরু করেছে। বড় বেশি কলকাতার কথা মনে পড়ছে।
খালের ধারে এদিকটায় মানুষজনও বেশি হাঁটে না পথ দিয়ে। সন্ধ্যা আটটা বাজলেই অসম্ভব নির্জন। নির্জনতার একটা সাঁ-সাঁ শব্দ আছে। মালতী সেই শব্দটাই যেন শুনতে পায়। মাঝে মাঝে গঙ্গা থেকে জাহাজের এই ডাক শুনলেই মালতীর একটু একটু মন খারাপ লাগে। হঠাৎ যেন বহুদূর, গত জন্মের কথা মনে পড়ে। আজ অবশ্য মালতীর মন ভালো আছে—আজ জাহাজের ডাককেও মনে হচ্ছে গানের একটা সুর। ক’দিন ধরে একটা বিশাল সুইডিস জাহাজ এসে মাঝ-গঙ্গায় দাঁড়িয়ে আছে। সেটা দেখার জন্য এ শহরের সবাই একবার গঙ্গার ধারে ঘুরে এসেছে। এত বড় জাহাজ ডায়মন্ডহারবারের গঙ্গায় আগে কেউ কখনও দেখেনি।
রেকর্ডটা বদলে দেবার জন্য মালতী উঠতেই গেটের কাছে রজতের জিপের আওয়াজ পাওয়া গেল। ছাদের আলসে ধরে দাঁড়াল মালতী, রেকর্ডের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুনগুন করে সুর তুলল। গেটের কাছে তেমন আলো নেই। রজত গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে কী যেন নির্দেশ দিলেন। তারপর ওপর দিকে না তাকিয়ে বাগান পেরিয়ে এলেন। রজতকে চমকে দেবার জন্য মালতী ছাদের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। চুপিচুপি রজতের ঠিক কানের পাশে মুখ নিয়ে হাঁ-উ করে চেঁচিয়ে উঠবে।
সিঁড়ি দিয়ে রজতের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। রজত এসে বসবার ঘরে ঢুকলেন। ততক্ষণে তাঁর শার্টের বোতাম খোলা হয়ে গেছে, অন্যমনস্ক ভাবে শার্টটা খুলে রজত ট্রাউজারের বেল্টে হাত দিলেন। শোবার ঘরের দরজাটা ভেজানো, সেই দিকে তাকিয়ে রজত মৃদু স্বরে ডাকলেন, মিলু! মিলু তুমি ঘুমোচ্ছ? ছাদ থেকে মালতী সাড়া দিল না। এবার শোবার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরটা দেখে নিয়ে রজত ছাদের দিকে এগোলেন। উঁকি দিয়ে দেখে মালতী প্রস্তুত হয়ে নেবে ভেবেছিল, কিন্তু এই সময় রজতের ব্যান্ডেজটা তার চোখে পড়ল। রজতকে ভয় দেখাবার বদলে মালতী নিজেই ভয় পেয়ে গেল। অন্য রকম ভাবে চেঁচিয়ে উঠল, ওকী!
মালতীর বিশেষ সাজ, শরীরে সুগন্ধ কিছুই রজতের মনোযোগ আকর্ষণ করল না যেন! চিন্তিত ভাবে বললেন, আজ অরুণের বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম।
মালতী ততক্ষণে রজতের বুকের কাছে চলে এসেছে। জিজ্ঞেস করল, একী, ব্যান্ডেজ কেন তোমার?
ও কিছু না। অরুণের খুব অসুখ। ডা. সেনের সঙ্গে গিয়েছিলাম।
কিছু না মানে? শুধু শুধু ব্যান্ডেজ বেঁধেছ? কী হয়েছে বলো!
কিছু না, সামান্য একটু কেটে গিয়েছিল।
সামান্য কাটলে ওরকম ব্যান্ডেজ বাঁধে? কী করে কাটল?
রজত মালতীর মাথাটা দু’হাতে ধরে বললেন, অত ভয় পাচ্ছ কেন? বাড়ি ফেরার আগেই ব্যান্ডেজটা আমার খুলে ফেলা উচিত ছিল, মনে পড়েনি। সত্যি ব্যান্ডেজ বাঁধার মতন কিছু না। বরং অরুণের খুব অসুখ। সাংঘাতিক জ্বর হয়েছে।
মালতী এমমুহূর্ত থমকে রজতের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ও, তাই বুঝি? তা তোমার ব্যান্ডেজটা খোলো, দেখব কতটা কেটেছে। ব্যান্ডেজ কে বেঁধে দিল?
ডাক্তার সেন স্বয়ং। আমার তো সামান্য কিছু হলেই দেখার অনেক লোক আছে, কিন্তু….
কই, তুমি ব্যান্ডেজটা খুলবে না? দেখি, খোলো।
এই তো খুলছি। এই দ্যাখো।
ওমা, এতখানি?
মোটেই এতখানি নয়। যাঃ! তুলোটা তুলে ফেলো….তোলো, আমার ব্যথা নেই একটুও। দেখলে? অরুণের বাড়িতে যখন গেলুম, তখন ও জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ। মানুষ চিনতে পারছে না, কপালের জলপটিটা শুকিয়ে গেছে, একটা শুধু বোকা-হাবা চাকর—
হাসপাতাল তো আছে! তোমার কী করে কাটল আগে বলো!
রাস্তায় ছেলেরা ইঁট ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করছিল। হরতালের দিন তো, হঠাৎ আমার গাড়ি এসে পড়তে একটা ছিটকে আমার গায়ে লেগে যায়। ইচ্ছে করে মারেনি।
কী সাংঘাতিক সব ছেলে! তুমি তখন কী করলে?
ছেলেরা নিজেরাই এসে ক্ষমা চাইল। ডাক্তার সেনও সেই সময় বাই চান্স ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন।
ডাঃ সেনের বাড়িতে কীসের মিটিং ছিল?
একটা টেনশান চলছে তো, তাই উত্তেজনা যাতে বেশি না ছড়ায়, শান্তি বজায় রাখা যায়, সেজন্য গণ্যমান্য নাগরিকদের নিয়ে…..। তোমার এসব জানার জন্য এত কৌতূহল কেন?
বাঃ, আমার জানতে ইচ্ছে করবে না?
আশ্চর্য!
কী আশ্চর্য?
অরুণের অসুখের কথা বললুম, সে সম্পর্কে তোমার কোনও আগ্রহই নেই?
কত লোকের অসুখের কথা আর শুনব? জ্বর তো অনেকেরই হয়।
রজতের মুখখানা হঠাৎ কঠোর হয়ে উঠল। খানিকটা আহত গলায় বললেন, মিলু, এটা তোমার খুব বাড়াবাড়ি। একজন মানুষ যত সামান্য চেনাই হোক, তার কোনও অসুখের কথা শুনলে, সে বিষয়ে আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। তুমি যেটা করছ সেটা অস্বাভাবিক। অরুণকে তুমি একসময় ভালোই চিনতে, অথচ এখন এমন নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছ, আমি জানি এর মানে কী?
মালতী নির্বাক হয়ে রজতের দিকে চেয়ে রইল। আকস্মিক আঘাতে তার মুখখানি বিবর্ণ হয়ে এসেছে, ঠোঁট দুটো অল্প অল্প কাঁপছে। খুব আস্তে আস্তে টেনে টেনে বলল, কী মানে? কী?
এর মানে, তুমি দেখাতে চাইছ, পাছে আমি কিছু মনে করি সেইজন্য। ছিঃ! আমাকে তুমি এত ছোট ভাব? আমি তোমায় বলিনি, অরুণের সঙ্গে তোমার কী রকম পরিচয় ছিল না ছিল, তাতে আমার কিছু যায় আসে না! ছেলেটাকে দেখলে আমার মায়া হয়। তার সঙ্গে খানিকটা ভদ্র ব্যবহার, একটুখানি মায়া-দয়া দেখানো….
দয়া? আমি ওকে দয়া করব?
রজতের কণ্ঠস্বর চড়ে গেছে, রীতিমতো ধমকের সুরে বললেন, কথাটা ও রকম বিদ্রুপের সুরে বলছ কেন? মেয়েদের কাছ থেকে সবাই দয়া-মায়া পেতে চায়, একটু দয়া দেখালে মেয়েদের মানায়। একসময় অত ভাব ছিল—তার সঙ্গে দুটো মিষ্টি কথা, অসুখ-বিসুখে একটু খোঁজখবর নেওয়া—এটাই তো উচিত। তা নয়, নিষ্ঠুরের মতন…..
তুমি আমাকে বকছ? তোমার কী হয়েছে আজ? তুমি মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে ঢুকলে, তারপর ঢুকেই অরুণদার অসুখের কথা বলতে লাগলে, এটাই তো অস্বাভাবিক। এ দুটোর মধ্যে কী যোগ আছে? তোমার মাথায় কিছু একটা ঢুকেছে। তুমি আমায়…..
আমার মাথায় কিছু ঢোকেনি। আমি যা স্বাভাবিক সেই কথাই বলছি।
মোটেই স্বাভাবিক নয়। মানুষের জ্বর হওয়াটা এমন কিছু আশ্চর্য ব্যাপার নয়, কিন্তু কারওর মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখলেই দারুণ উৎকণ্ঠা হয়।
ন্যাকামি কোরো না! আমি বললুম, অরুণ জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে আছে, তা শুনেও তুমি….একজন অচেনা মানুষ সম্বন্ধে এ কথা শুনলেও লোকের মায়া হয়, আর তুমি কি এমনই নিষ্ঠুর……
এইটুকু কঠিন কথাও রজত এর আগে মালতীকে কখনও বলেনি। হঠাৎ মালতীর দুচোখে জল এসে গেল। একটু আগে যে শরীরটা নতুন স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে ঝলমল করছিল, সেই শরীরই অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়ল। কিন্তু রজতের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুতেই চোখের জল ফেলবে না, ঠিক করে ফেলল মালতী। অস্ফুট গলায় শুধু বলল, আমি নিষ্ঠুর, আমি নিষ্ঠুর, আমার ন্যাকামি—
তারপর ছুটে চলে গেল বাথরুমে। রজত একটু থতমত খেয়ে প্রকৃতিস্থ হলেন। কিন্তু ততক্ষণে মালতী দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বেসিনের কল খুলে দিয়ে তার সঙ্গে চোখের জল মেশাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল মালতী। আর রজত দরজার বাইরে নিষ্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ডাকলেন না। কাঁদতে কাঁদতে মালতী আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। এত চোখের জলও ছিল! এই কয়েক বছর মালতীর বড় বেশি সুখে কেটেছে, কোনওদিনও কান্নার মুহূর্ত আসেনি। কিন্তু মানুষের জীবনে প্রতিদিনের জন্য নির্দিষ্ট চোখের জল বোধ হয় শরীরের কোনও এক অন্ধকার প্রান্তে জমা থাকে।
প্রায় আধঘণ্টা বাদে বেরোল মালতী, অনেকখানি শান্ত হয়ে। চোখ-মুখ পরিষ্কার করেছে। ধীর ভাবে রজতকে বলল, তুমি খেয়ে নাও, আমি আজ আর খাব না। তারপর শাড়ি না বদলেই অন্য ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।
রজত একটু পরেই এলেন বিছানার কাছে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা মালতীর মাথায় হাত ছুঁইয়ে বললেন, রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি, আমি তোমাকে আঘাত দিয়ে চাইনি। এসো, খেয়ে নাও।
মালতী মুখ ফেরাল। শুকনো চোখ, সেখানে আর কান্না নেই, মুখে কোনও অভিব্যক্তিও নেই। ভাবহীন গলায় বলল, না, রাগ করিনি। কিন্তু সত্যি আজ আমি খাব না।
না, এসো।
খিদে নেই, সন্ধ্যাবেলা অনেক খেয়েছি, তা ছাড়া—
তবু আমার সঙ্গে বসবে চলো। না এলে বুঝব তুমি এখনও রাগ করে আছ।
মালতী উঠে বসে বলল, ঠিক আছে, চলো যাচ্ছি।
মালতীর সেই আবেগগহীন গলার স্বর শুনে এবং সংযত মুখের দিকে তাকিয়ে রজত একটুখানি থেমে রইলেন। তারপর বললেন, সত্যি তুমি খাবে না? তা হলে তোমাকে আর উঠতে হবে না। তুমি শুয়ে থাকো, আমি এক্ষুনি আসছি।
রজত যখন খেয়ে ফিরে এলেন, তখন মালতীর শোয়ার ভঙ্গিটি ঘুমন্ত নারীর মতন। কিন্তু এও দেখলে বোঝা যায়, তখনও সে ঘুমোয়নি। রজত সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় এসে বসলেন। নরম ভাবে মালতীর পিঠে হাত রেখে মৃদু ভাবে বললেন, মিলু, আজ তুমি কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলে?
মুখ তুলল না মালতী, বলল, না।
বাড়িতে কেউ এসেছিল?
না।
তা হলে এরকম দামি শাড়ি পরে আছ যে?
এমনি।
মিলু, আমার সত্যি দোষ হয়ে গেছে। তুমি এমন সুন্দর সেজেছিলে আজ, আমি তা না দেখেই শুধু বাজে বাজে কথা—
বাজে কথা তো তুমি বলনি!
আমার দিকে একটু মুখটা ফেরাও না! অন্য দিকে চেয়ে কথা বলছ কেন?
দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে হল না। মালতী সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফেরাল। সেই অভিব্যক্তিহীন মুখ, শুকনো চোখ। বলল, আলো নিবিয়ে দেবে না? তোমার ঘুম পায়নি?
মোটে তো দশটা বাজে এখন! চলো না, বারান্দায় গিয়ে বসি একটু।
আমার খুব ঘুম পেয়েছে।
আচ্ছা ঠিক আছে, আলো নিবিয়ে দিচ্ছি। তার আগে এই সিগারেটটা শেষ করে নিই।
সিগারেট শেষ হওয়া পর্যন্ত আর কোনও কথা হল না। কোনওরকমে কথার সূত্র খোঁজার জন্য রজত মাথা ঘামাতে লাগলেন। কিছুই মনে আসে না। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রজত বললেন, মিলু, তুমি জল খাবে? কিংবা তোমার রাত্তিরের দুধও খাবে না?
না!
দুধটা নষ্ট হবে?
ঠাকুর দই পেতে রাখবে এখন। নষ্ট হবে না।
মিলু, যাঃ, কী করছ তুমি? এভাবে কতক্ষণ থাকবে? কথা বলো, আমাকে কী শাস্তি দিতে চাও, দাও।
আমার সত্যিই আজ খুব ঘুম পেয়েছে।
রজত এবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একাই ছাদে পায়চারি করলেন খানিকক্ষণ। দু-একটা টবের গাছে ফুলের গন্ধ শুঁকলেন। মনের মধ্যে বেশ খানিকটা অস্বস্তি রয়েছে। সারাদিন আজ অনেক কিছু ঘটনার পর, মালতীর সঙ্গে কথার ভঙ্গি সত্যিই বেশি কর্কশ হয়ে গেছে। মালতী সাজপোশাক করে হয়তো প্রতীক্ষায় ছিল রজতের সঙ্গে গল্প করবে। তার বদলে এরকম রুক্ষ ব্যবহার—
রজত ঘরে ঢুকে নাইট সুট পরে নিলেন। চোরা চাহনিতে মালতীকে আর একবার দেখে দরজায় ছিটকিনি দিয়ে, বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুমন্ত মানুষের নিশ্বাসের শব্দ অন্যরকম। সেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়, কিন্তু এখন অন্ধকারে কোনও শব্দ নেই। মালতীর শরীরের আবছা আভাস দেখা যাচ্ছে। রজত কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে পড়লেন চোখ বুজে। ঘুম এল না, এলোমেলো কথা মনে আসতে লাগল। রেলের কামরায় আগুন, উত্তেজিত জনতা, নেতাদের কপট কথা, সার্কল অফিসারের উদবিগ্ন মুখ, বাস-স্ট্যান্ডের কাছে একদল শীর্ণ মানুষের জল দিয়ে ভিজিয়ে মুড়ি খাওয়ার দৃশ্য, ভিড়ের মধ্যে থেকে চিৎকার—’সরকারের দালালকে কবর দাও’, ডাঃ সেনের নির্লিপ্ত হাসি, এবং এই সবকিছু ছাপিয়ে মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে মালতীর জলভরা চোখ দুটি। বিছানায় এমন নীরব শুয়ে থাকা এর আগে আর কখনও হয়নি।
একটু সরে এসে রজত বিছানায় মালতীর হাতখানার ওপর নিজের হাত রাখলেন। ডাকলেন, মিলু! মালতী কোনও সাড়া দিল না, তার হাতখানা ঘামে ভিজে। রজত নিজের হাতখানা এবার মালতীর মুখের ওপর রাখলেন। এবার নিশ্চিত বুঝতে পারলেন মালতীর চোখের পাতা দুটো সম্পূর্ণ খোলা, মালতী ঘুমোয়নি। রজত হাতখানা সরিয়ে আনলেন মালতীর বুকের ওপরে। সমান নিশ্বাসে মালতীর বুক ওঠানামা করছে। স্তন দুটির ওপর আড়াআড়ি রাখা রজতের চওড়া হাত। মালতী সে হাত সরিয়ে দিল না, তার স্তনে উষ্ণতাও এল না—সেইরকমই চুপচাপ শুয়ে রইল মালতী। রজত এবার আরও কাছে এসে মালতীর চিবুক দু’হাতে ধরে বললেন, প্লিজ মিলু, এরকম কোরো না, একটা কথা বলো। আমি তোমাকে খুব খারাপ কথা বলেছি? আমার অন্যায় হয়েছে, সত্যি অন্যায় হয়েছে—এরকম ভাবে থেকো না।
সারাদিন তোমার এত পরিশ্রম গেছে, তোমার এখনও ঘুম পায়নি?
না! তুমি এরকম করলে সারা রাত্তিরে আমার এক ফোঁটাও ঘুম আসবে না।
আচ্ছা বেশ, এসো তা হলে দুজনে কিছু কথা বলি।
মালতী ধড়মড় করে উঠে কনুইতে ভর দিয়ে হাতের ওপর চিবুক রাখল। তারপর অন্ধকারে রজতের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে, সত্যি করে বলো তো?
আমার আবার কী হবে? তুমিই তো—
না। তোমার কিছু হয়েছে। তুমি আজকাল বার বার অরুণদার কথা বলো কেন? আমাকে তুমি পরীক্ষা করতে চাও? আমাকে তুমি অবিশ্বাস কর?
অবিশ্বাস? তুমি কী বলছ মিলু? অবিশ্বাসের কী আছে এর মধ্যে? তুমি আমাকে এত ছেলেমানুষ ভাব?
তুমি তা হলে বার বার অরুণদার কথা বল কেন?
ভদ্দরলোক এখানে আছেন, প্রায়ই দেখা হয়, সেইজন্য! অবশ্য মাঝে মাঝে তোমাকে রাগাবার জন্যও ঠাট্টা করে বলি। আমার মনে হয় এইটাই স্বাভাবিক। তুমিই কৃত্রিম ভাবে এড়িয়ে যেতে চাইছ।
কৃত্রিম ভাবে?
একজন চেনা লোকের সঙ্গে কেউ অমন নির্লিপ্তের মতন ব্যবহার করে না।
সব চেনা লোকের সঙ্গেই মানুষ সারাজীবন একই সম্পর্ক রাখতে চায় না।
মিলু, আসলে তুমিই আমাকে সন্দেহ করছ। তুমি ভাবছ, আমি একটা সন্দেহ-প্রবণ বাতিকগ্রস্ত স্বামী। আমার মনটা কুটিল—
না, না, সে কথা কখনও ভাবিনি। তুমি তো জানো, অন্তত একদিন—
মিলু। লক্ষ্মী সোনা, এখন ওরকম কিছু মনে স্থান দিয়ো না। তুমি আমার সঙ্গে ঝগড়া করবে, রাগ করবে, একথা আমি ভাবতেই পারি না। সারা দেশ জুড়ে এত অশান্তি, এত ঝগড়া—বাড়িতেও যদি সেই রকম….না, না, এসো, আমরা এসব আবার ভুলে যাই….এসব ভুল বোঝাবুঝি—
তুমি আমাকে সত্যিই অবিশ্বাস কর না?
মিলু, তুমি পাগল হয়েছ? তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, ওসব কথা আমার একবারও মনে আসেনি। অবিশ্বাস! তোমাকে যদি অবিশ্বাস করি, তা হলে আমার বেঁচে থাকার আর মানে কী রইল?
মানুষ ইচ্ছে করেই তো নিজের জীবনটা জটিল করতে চায়। আমি তা চাই না। আমি এখন যেমন সরল সুখে বেঁচে আছি, এইরকমই বাঁচতে চাই।
তুমিও আমার ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখবে, বলো?
মালতী এবার রজতের কপালে হাত রেখে বলল, তোমাকে অবিশ্বাস করলে আমারও আর বেঁচে থাকার কোনও মানে থাকে না!
রজত এবার সর্বশক্তি দিয়ে মালতীর শরীরটা আকর্ষণ করলেন। আঁচল সরিয়ে মালতীর বুকে মাথা গুঁজে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। হঠাৎ আবিষ্কারের খুশিতে বলে উঠলেন, মিলু, তোমার বুকে কী সুন্দর গন্ধ!
মালতী রজতের চুলে বিলি কাটতে লাগল।