পাঁচ
সকালবেলা মেয়েদের কলেজ। তবু কলেজের গেটের কাছে এসে তিনজন যুবক দাঁড়িয়েছে। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। যুবকদের কাঁধে ঝোলানো শৌখিন ব্যাগ। দেখলেই বোঝা যায় স্থানীয় লোক নয়। চোখের দৃষ্টি চঞ্চল। তারা দরোয়ানকে ডাকাডাকি করতে লাগল। দরোয়ান আসতে তারা বলল, দুপুরে পড়ান অরুণ চ্যাটার্জি, তার বাড়ির ঠিকানাটা জেনে এসো তো! দরোয়ানের ওপর নির্দেশ দেওয়া আছে, সকালের দিকে কোনও ছেলে ছোকরাকে কলেজের সীমানায় ঘেঁষতে দেবে না। সে শুধু সেইটুকুই জানে, সে ওদের কোনও পাত্তাই দিলে না।
মেয়ে কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল মিসেস দাশগুপ্তা সেই সময় বেরোচ্ছিলেন, তিনি ওদের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। যুবকদের মধ্যে একজন তাঁর দিকে এগিয়ে এল। বেশ সপ্রতিভভাবে বলল, আচ্ছা, দুপুরের কলেজে অঙ্কের লেকচারার অরুণ চ্যাটার্জিকে চেনেন আপনি?
চিনি না, তবে ওই নামে একজন আছেন জানি।
তার বাড়ির ঠিকানাটা কি জানা সম্ভব হবে?
না, সম্ভব নয়। দুপুরে আসবেন। এখন এখানে ভিড় করবেন না!
দুপুর পর্যন্ত আমরা কোথায় অপেক্ষা করব? তা ছাড়া ওর কটায় ক্লাস তাও জানি না। মানে, আমরা ওর বাড়িতেই উঠব বলে এসেছি।
ঠিকানা না জেনেই এসেছেন যখন, তখন একটু কষ্ট করুন। এখান থেকে সরে যান এখন, এক্ষুনি মেয়েদের ছুটি হবে।
দেখুন, আপনি ইচ্ছে করলে বোধহয় ঠিকানাটা যোগাড় করে দিতে পারবেন। আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে…..
কী মনে হচ্ছে আমাকে দেখে?
মনে হচ্ছে, মানে, আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়, আপনার বাইরের ব্যাপারটা একটু কঠিন বটে, আপনার ভেতরটা খুব নরম। মানে, আপনি মানুষের উপকার করতে খুব ভালোবাসেন।
মিসেস দাশগুপ্তা একটা অপ্রত্যাশিত কাজ করলেন। তার চাকরি জীবনের ইতিহাসে এই প্রথম তিনি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন যুবকের কথা শুনে হাসলেন। হেসেই বললেন, মানুষের উপকার করতে চাই বটে, কিন্তু মানুষে সেটা বোঝে না।
মিসেস দাশগুপ্তা আবার ভেতরে চলে গেলেন। প্রত্যেক অফিসেই এমন একজন বেয়ারা থাকে, যে সবজান্তা। অফিসের প্রতিটি লোকের হাঁড়ির খবর তার নখদর্পণে। ভাইস প্রিন্সিপাল গুপি নামের সেইরকম একটি বেয়ারাকে পাঠিয়ে দিলেন। সে এসে সব জানিয়ে দিয়ে গেল, গঙ্গায় যাবার রাস্তার একেবারে গঙ্গার কাছাকাছি যে বড় মিষ্টির দোকান, তার পাশ দিয়ে গলি। গলিতে ঢুকে তিনখানা বাড়ির পরে সাদা রঙের বাড়ি।
অরুণ তখন আয়নাটাকে জানলার দিকে হেলান দিয়ে রেখে দাড়ি কামাচ্ছিল। যুবক তিনটিকে দেখে খুব চমকে উঠল। খুব খুশি হল কিনা বোঝা গেল না। বলল, কীরে, তোরা এখানে? হঠাৎ কী করে চলে এলি?
এলুম তোর খোঁজ নিতে। তিন মাস ধরে ডায়মন্ডহারবারে আছিস, এর মধ্যে একবারও কলকাতায় যাসনি, চিঠিও লিখিসনি, কী ব্যাপার তোর? কলকাতা এত কাছে, অথচ তোর পাত্তাই নেই? ডায়মন্ডহারবারে কী মধু পেয়েছিস?
মধু কিছু পাইনি। সবই তেতো আর পচা। একেবারে অলস হয়ে গেছি, কোনও জায়গা থেকেই আর নড়তে ইচ্ছে করে না।
আমাদেরও তো আসতে বলিসনি কখনও।
না বলতেই এই উইক ডে-তে চলে এলি? ছুটির দিন দেখে এলে পারতিস তোরা। আজ যে আমার কলেজ।
ওদের মধ্যে আর একজন বলল, কী রে, অরুণ যেন আমাদের আসাটা অপছন্দ করছে মনে হচ্ছে! ওর বাড়িতে থাকতে দেবে তো?
অন্য একজন বলল, ধ্যাৎ! আজ আবার কলেজ কী? ছুটি নিয়ে নে আজ, অরুণ, দু’দিনের জন্য আমরা তোর ঘাড় ভাঙতে এসেছি।
কলকাতার জীবন এমনই, একবার ছেড়ে গেলে কিছুতেই পরে আর তার সঙ্গে জোড় মেলানো যায় না। এই তিনজন একসময় অরুণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। দিনের পর দিন ওরা এক সঙ্গে কাটিয়েছে, কত রাত ভোর করে ওরা দল বেঁধে আড্ডা জমিয়েছে। তারপর অরুণ চলে যায় গৌহাটিতে, সেখানে বছর তিনেক থেকে তারপর এসেছে ডায়মন্ডহারবারে। অনেকদিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়নি তেমনভাবে। এই মাঝখানে ক’বছর একা থেকে থেকে অরুণ নিজেকে অনেকখানি গুটিয়ে নিয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে আর সেরকম ভাবে নিজেকে মেলাতে পারছে না। বন্ধু তিনজনের নাম সুবিমল, অবিনাশ, আর সুনীল। অবিনাশের বাঁ হাতে একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা।
ওরা আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসল। ব্যাগ থেকে বেরোল মদের বোতল, তাস, শুয়োরের মাংস, কবিতার বই। অরুণের চাকরকে মাছ কিনতে আবার বাজারে পাঠানো হল। চিৎকারে বাড়িটা সরব হয়ে উঠল, জানলা দিয়ে উঁকি মারতে লাগল পাড়ার বাচ্চা ছেলেরা।
সুবিমল বলল, অরুণ, তোদের কলেজের প্রিন্সিপাল কী রকম? খুব কড়া? আগে থেকে ছুটি না নিলে রাগারাগি করে নাকি?
অরুণ উত্তর দিল, না, একদিন আধদিনের জন্য ক্যাজুয়াল লিভ…
একদিন নয়, দুদিন। আমরা আজ বিকেলে কাকদ্বীপ কিংবা নামখানায় যাব, যে ডাকবাংলোয় জায়গা পাওয়া যায়। ইচ্ছে হলে ফ্রেজারগঞ্জেও যেতে পারি।
সুনীল বলল, আমার ফ্রেজারগঞ্জটাই দেখার ইচ্ছে। অরুণ, তুই একটা গাড়ি যোগাড় করতে পারবি? এখানে সে রকম কেউ চেনাশুনো নেই?
অরুণ ফ্যাকাশে হয়ে বলল, না, সে রকম কেউ চেনাশুনো নেই। ভাড়া পাওয়া যেতে পারে হয়তো—তাও বোধহয় অনেক টাকা লাগবে।
কিন্তু গাড়ি না হলে এসব জায়গায় বেড়িয়ে সুখ নেই।
অরুণের বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়েছিল অবিনাশ। সে বলল, রজতকে বললে সে কোনও ব্যবস্থা করে দিতে পারে না?
অরুণের সর্বাঙ্গ চমকে উঠল। তবু মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন কর, রজত….মানে কার কথা বলছিস?
শশাঙ্কর বোন মালতীর সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছে….সে তো শুনেছি এখানকার এ.ডি.এম, না কী যেন বড় চাকরি করে—তার সঙ্গে তোর পরিচয় হয়নি?
অরুণ সংক্ষেপে বলল, সামান্য পরিচয় আছে। তারপরই প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য বলল, তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন, অবিনাশ?
অবিনাশ নিজের বিষয়ে কথা বলতে চায় না। মুখ কুঁচকে বলল, এই খানিকটা কেটে গেছে। রজতের সঙ্গে পরিচয় আছে যখন, বলে দ্যাখ না একটা গাড়ি….ওরা সরকারি চাকুরে, ওরা সব পারে।
না, রজতবাবুর সঙ্গে আমার যে-টুকু পরিচয়, তাতে গাড়ি চাওয়া যায় না। তোর হাতটা কাটল কী করে?
মারতে গিয়েছিলুম একটা লোককে, সে শালা ছুরি তুলল…যাকগে, তুই যে ডায়মন্ডহারবারে আছিস জানলুম কী করে জানিস? শশাঙ্কই বলল, ওর বোন মালতী এখানে আছে। তার সঙ্গে নাকি তোর একদিন দেখা হয়েছিল রাস্তায়।
শশাঙ্ককে এ কথা কে বলল? শুনলুম, শশাঙ্কর সঙ্গে ওদের আর কোনও সম্পর্ক নেই।
অবিনাশ নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিল, কে জানে, কে বলেছে? অত কি জিজ্ঞেস করেছি? সুনীলটা অনেকদিন থেকে ফ্রেজারগঞ্জে আসার কথা বলছিল। শুনলুম যখন তুই এখানে আছিস….চিনিস তো রাস্তাটা?
আমি নিজে কখনও যাইনি।
খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোতে বিকেল হয়ে গেল। এ সময় ফ্রেজারগঞ্জে যাবার কোনও বাস নেই। অগত্যা ওরা কাকদ্বীপেই যাওয়া ঠিক করল। বাস ছাড়তে তখনও একটু দেরি আছে। ব্যাগগুলো ভেতরে রেখে ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, দূর থেকে মন্থর পায়ে হেঁটে আসছে মোম, সঙ্গে অন্য একটি মেয়ে। মোম আজ কালো রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে, কানে সেই নতুন পাওয়া মুক্তোর দুল। সঙ্গের মেয়েটির পরনে সাধারণ তাঁতের শাড়ি। অরুণ প্রথমে দেখেনি, মোমই প্রথম দেখতে পেয়ে কলস্বরে বলে উঠল, এই অরুণদা, এখানে কী করছেন? বাসে চেপে কোথায় যাচ্ছেন?
অরুণ ফিরে তাকিয়ে মোমকে দেখে মুগ্ধ হয়ে লঘু গলায় বলল, একটু কাকদ্বীপ যাচ্ছি। তুমি কোথায় যাচ্ছ?
আমি গঙ্গার ধারে একটু বেড়াতে যাচ্ছি।
বেড়াতে যাচ্ছ? এত সেজেছ, মনে হচ্ছে কোথাও নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছ।
বেড়াতে যাবার জন্য বুঝি কেউ সাজে না?
তা সাজে নিশ্চয়ই। কিন্তু বাড়ির এত কাছে—
আমার এক-একদিন এমনিই সাজতে ইচ্ছে করে। আমার তো রোজ বেড়াতে ইচ্ছে করে না। আপনিও চলুন না আমাদের সঙ্গে—যেতে হবে না কাকদ্বীপ। সামনের রবিবার বাবাকে বলে আমরা সবাই না হয় কাকদ্বীপ যাব, আজ আপনি আমার সঙ্গে বেড়াতে চলুন।
আমি যে আমার বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছি। এসো, আলাপ করিয়ে দিই। সুবিমল, এই হচ্ছে মোম, ভালো নাম মালবিকা সেন, ব্রেবোর্নে পড়ে। মোম এখানকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে—আর এরা আমার বন্ধু সুবিমল চক্রবর্তী, সুনীল গাঙ্গুলী, অবিনাশ মিত্র—এরা সব নামকরা লেখক, বুঝলে।
মোমের সঙ্গের মেয়েটি লাজুক মুখে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। মোম তার সঙ্গে ওদের আলাপ করিয়ে দেবার কোনও চেষ্টাই করল না। অরুণের বন্ধুদেরও তেমন গ্রাহ্য করল না, নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতও তুলল না। অরুণের দিকেই তাকিয়ে বলল, বাঃ, বেশ! রতনদাকে বললুম, রতনদাও কাজে ব্যস্ত আর আপনিও কাকদ্বীপে চললেন!
অরুণ পরিহাসের সুরে বলল, আমাকে তো আগে বলনি। আমি কী করে জানব?
আমি বলব কেন? আপনিই তো আমাকে বেড়াতে আসার কথা বলবেন!
তারপর অরুণের বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল, আপনারা নিজেরাই চলে যান না, অরুণদা থাকুক।
অবিনাশ বলল, তা কি হয়! তার চেয়ে এক কাজ করা যাক না, আপনিই বরং আমাদের সঙ্গে কাকদ্বীপ চলুন! সবার এক সঙ্গে তা হলে বেড়ানো হবে।
মোমের মুখখানা সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। যেন সে একটা চমৎকার খেলার জিনিস পেয়ে গেছে হঠাৎ। বলল, তা হলে তাই চলুন! বেশ মজা হবে। এক্ষুনি বাস ছাড়বে?
মোম আর দ্বিরুক্তি না করে বাসের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অরুণ অবিনাশের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই জানিস না, ও মেয়ে সত্যি সত্যি চলে যেতে পারে আমাদের সঙ্গে।
অবিনাশ নির্লিপ্তভাবে বলল, তা বেশ তো, চলুক না।
বাসের সিঁড়িতে পা দিয়ে মোম বলল, চলুক না মানে, যাচ্ছিই তো! সত্যি বেশ মজা হবে।
অরুণ এগিয়ে এসে বলল, মোম, তা কি হয়! তোমার বাবা কী ভাববেন?
ওই তো নন্দিতা গিয়ে বাড়িতে খবর দিয়ে দেবে। কিচ্ছু ভাববে না।
না, তা হয় না। আমরা হয়তো আজ রাত্রে ফিরব না।
আমিও ফিরব না। আমার এখন কলেজ ছুটি।
বাস এবার ছাড়বে, মোম বাসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণের বন্ধুরা মিটিমিটি হাসছে। অরুণ বিব্রতভাবে মোমকে বার বার নেমে আসতে অনুরোধ জানাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত মোমের হাত ধরে জোর করতে হল তাকে। মোম জেদি ভাবে দাঁড়িয়েই রইল, কিছুতেই নামতে চায় না। তখন দীর্ঘ চেহারা নিয়ে অবিনাশ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বলল, কী আর করা যাবে বলুন, অরুণ কিছুতেই আপনাকে নিয়ে যেতে চায় না। সত্যি, আপনি গেলে খুবই ভালো হত! এই কথাতেই মোমের মুখের রূপান্তর ঘটল। তার মুখখানা এমনই শিশুর মতন যে, প্রতিটি অভিব্যক্তি স্পষ্ট দেখা যায়। এতক্ষণ যেখানে জেদ আর অভিমান ছিল, এখন সেখানে ফুটে উঠল গভীর দুঃখ। অরুণের দিকে তাকিয়ে বলল, অরুণদা, আপনি এরকম। মোম নেমে গেল।
বাস ছাড়ার পর পিছনের সিটে ওরা চারজন বসেছে। অরুণ বেশ ঝাঁজালো বিরক্ত গলায় অবিনাশকে বলল, কী যে ইয়ার্কি করিস মাঝে মাঝে, কোনও মানে হয় না। কী ঝঞ্ঝাটেই পড়েছিলুম।
অবিনাশ হালকাভাবে বলল, কী আর ক্ষতি হত ও গেলে? না হয় আমরা রাত্তিরের আগেই ফিরে আসতুম।
কাকদ্বীপ পৌঁছোতেই দেড় ঘণ্টা লাগে।
তাতে কী হয়েছে? রাত আটটা-ন’টার মধ্যে ফিরে আসতুম।
ও খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। এরকম ভাবে না-বলে-কয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না।
সম্ভ্রান্ত পরিবার? খুব চতুর হয়েছিস তো অরুণ।
এরকম ছোট মফঃস্বল শহরে তো থাকিসনি, তা হলে বুঝতিস। এই নিয়েই এতক্ষণ সারা শহরে কত রকম গল্প রটছে তার ঠিক নেই।
সুনীল এবার হাসতে হাসতে ঘোষণা করল, এতক্ষণে বুঝতে পারা গেল, অরুণ কীসের টানে ডায়মন্ডহারবারে আটকে আছে!
অরুণ আরও গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল, তোর আরও অনেক কিছু বোঝার মতন এই বোঝাটাও ভুল।
কেন, বেশ চমৎকার তো মেয়েটা।
থাক। এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না।
আহা, রাগ করছিস কেন? মেয়েটা তোর প্রেমে পড়ে একেবারে—
এই ধারণাটাও ভুল। মেয়েটা পাগল, ওর ব্যবহারের কোনও ঠিক নেই।
প্রেমে পড়লে সব মেয়েই একটু একটু পাগল হয়।
কী যা-তা বলছিস! একটা বাচ্চা মেয়ে—
বাচ্চা? আহা, এরকম একটা বাচ্চা মেয়ে যদি আমাকে ভালোবাসত?
একটা লোককে চাপা দেবার পূর্বমুহূর্তে বাস ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যেতেই ওদের কথার প্রসঙ্গ ঘুরে যায়। গঙ্গা থেকে হঠাৎ ভেসে আসে স্টিমারের উদাসীন বাঁশি। পিকনিক থেকে ফেরার পথে মোটর গাড়ির মধ্যে একদল ছেলেমেয়ে গান গাইতে গাইতে চলে যায়। খালের ধারে অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় একদল চাষি গোল করে বসে কীসের পরামর্শ করে। ফসলকাটা শূন্য মাঠে একপাল গরু কাঁটা-ঝোপ চিবিয়ে খাচ্ছে। একঝাঁক ছাতারে পাখির ঝগড়ার পাশে একটা সাদা বক ধর্মাবতারের মতন চুপ করে বসে আছে। চেকপোস্টে পুনরায় বাস থামে।
কাকদ্বীপের নতুন ডাকবাংলোটা ছবির মত ঝকঝকে। ফুলবাগান পেরিয়ে ওরা এসে উঠল প্রশস্ত বারান্দায়। ঘর পেতে তেমন অসুবিধে হল না।
সেই পুরনো বন্ধুত্বের নিবিষ্টতা আর নেই। উল্লাস ভরে মুরগির ঝোল খাওয়া, অন্ধকার রাস্তায় টর্চ হাতে বেড়ানো, নদীর পাড়ে গান, বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিন্দা—সবই চলছে, তবু অরুণ যেন ওদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছে না। সব সময়েই মনে হচ্ছে, না এলেই তার ভালো হত। তার দীর্ঘকালের একাকীত্ব যেন একটা কাচের দেয়াল ঘেরা অস্তিত্বের মতন তৈরি হয়েছিল। বড় প্রিয় সেই অবস্থাটা, এদের সংস্পর্শে যেন সব সময় সেটা ভেঙে যাবার ভয়।
ঘরের মধ্যে এসে, কাচের গেলাসে মদ ঢালছিল সুবিমল। অরুণের দিকে একটা গেলাস বাড়িয়ে দিতেই অরুণ বলল, না, থাক আমাকে নয়।
সুবিমল অনুনয় করে বলল, একটু খেয়ে দ্যাখ—
না।
অরুণ, তোর কী হয়েছে বল তো?
কিছুই হয়নি তো।
হ্যাঁ, হয়েছে। তুই বদলে গেছিস একেবারে। কী রকম যেন ম্যাদামারা হয়ে যাচ্ছিস। ব্যাপারটা কী?
কিছুই না।
লুকোচ্ছিস কেন আমাদের কাছে? তুই অনেকদিন কিছুই লিখিস না, চিঠি দিলে উত্তর দিস না। একা-একা মফঃস্বলে পড়ে থাকিস। ব্যাপারটা কী রকম যেন….
অবিনাশ বিরক্ত ভঙ্গিতে সুবিমলের দিকে হাত নেড়ে বলল, থাকতে দে না, ওর যে-রকম ইচ্ছে। সন্ধ্যাবেলা জেলেপাড়ার পাশ দিয়ে আসবার সময় একটা মেয়েকে লক্ষ করেছিলি? লাল ডুরে শাড়ি পরা, মাথায় চুবড়ি ছিল? কী দারুণ স্বাস্থ্য! দেখলেই লোভ হয়।
সুবিমল বলল, বাংলোর চৌকিদারকে একবার বাজিয়ে দেখব নাকি? বাংলোগুলোতে তো এসব ব্যবস্থা খুব থাকে?
ওরকম মেয়ে চৌকিদারের কথায় আসবে না কক্ষনও। নিজেরা চেষ্টা করলে হতে পারে।
চল, এই বোতলটা শেষ করে আরেকবার বেরোব। জায়গাটা একটু বাজিয়ে দেখা যাক।
অরুণ খাট থেকে নেমে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সুনীল চুপচাপ গেলাসে চুমুক দিচ্ছিল। এবার মৃদু হেসে বলল, তোদের এসব আলোচনা অরুণের ভালো লাগছে না। মুখখানা দ্যাখ বেগুন ভাজার মতন কালো করে ফেলেছে।
অবিনাশ সেই দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। আপন মনে বলল, সত্যিই ছেলেটার কিছু একটা হয়েছে! তারপর হঠাৎ যেন মনে পড়া ভঙ্গিতে অবিনাশ অরুণকে জিজ্ঞেস করল, অরুণ তোর সঙ্গে রজতের সম্পর্ক কী রকম রে? ভালো করে কথা-টথা বলে?
অরুণ চমকে ঘুরে বলল, কেন, হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
না, তুই শশাঙ্কর বন্ধু তো—জানিস নিশ্চয়ই। লোকটা তো শুনেছি বিষম কাঠখোট্টা আর অভদ্র। মালতীর মতো মেয়ে যে কেন ওকে বিয়ে করল?
তোকে একথা কে বলেছে?
শশাঙ্ক। শশাঙ্ক বলল, ওই অসভ্যটাকে বিয়ে করেছে বলে জীবনে ও আর মালতীর মুখই দেখবে না!
অরুণ বেশ মৃদুস্বরে বলল, শশাঙ্ক খুবই ভুল ধারণা করে আছে। রজতবাবুর মতন এমন ভদ্র এবং উদার লোক আমি খুবই কম দেখেছি!
সে কী রে? শশাঙ্ক যে বলে….
শশাঙ্ক সম্পূর্ণ ভুল জানে। শশাঙ্কর নিজের বোনের বর একজন বড় সরকারি অফিসার। এতে শশাঙ্কর পার্টির কাছে তার লজ্জা করতে পারে, এতে তার বিপ্লবের ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে রজত রায়চৌধুরীকে ছোট করার কোনও মানে হয় না। রজতবাবু ঠিক সময় উপস্থিত না হলে আজ শশাঙ্কর বোন বেঁচে থাকত কি না তাই সন্দেহ। শশাঙ্কর আদর্শবাদ তার বোনকে বাঁচাতে পারত না!
অবিনাশ বলল, আমি ব্যাপারটা খুব বেশি জানি না। তবে শশাঙ্ককে খুব রাগারাগি করতে দেখেছি। আমি তো শুনেছি লোকটা ভুলিয়ে ভালিয়ে মালতীকে বাড়ি থেকে ইলোপ করেছিল—শশাঙ্ক তখন জেলে।
আর মালতী তখন মৃত্যুশয্যায়। একটি মুমূর্ষু মেয়েকে নিয়ে যে লোক ইলোপ করে, সেই লোকের চরিত্র কত মহৎ, আশা করি তুই বুঝতে পারবি।
বিয়ের আগে মালতীর সঙ্গে তোরও তো চেনাশুনো ছিল।
কোণের চেয়ার থেকে সুনীল বলল, শুধু চেনাশুনো কেন? আমি তো জানি, মালতী একসময় অরুণকে গভীর ভাবে ভালোবাসত। অরুণও মালতী ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেনি। সেইজন্যেই অবাক হয়ে যাচ্ছি, অরুণ কী করে রজতের এত প্রশংসা করছে। যতই ভালো হোক, প্রেমিকার স্বামীকে ভালো চোখে দেখা কী করে সম্ভব?
প্রশংসার যে যোগ্য, তাকে সব সময়ই প্রশংসা করা উচিত।
সুবিমল বলল, মালতীর সঙ্গে অরুণের যখন এরকম সম্পর্ক ছিল, তা হলে রজত মাঝখান থেকে এল কী করে? অরুণ, তুই মালতীকে বিয়ে করিসনি কেন? কী রে, বল না?
অরুণ একটুক্ষণ উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বুঝতে পারল ওটা ভুল। তাই পরক্ষণেই একটু হাসার চেষ্টা করল। মুখে সেই সামান্য হাসির আভাস, গলার আওয়াজ তবু কাতর। অরুণ বলল, আমি পারিনি। আমি হেরে গেছি!
কীরে অরুণ, তোর যে চোখ দিয়ে জল পড়বে মনে হচ্ছে! কী হয়েছিল কী?
অরুণ এবার আরও প্রকাশ্য হাসির চেষ্টা করে বলল, বিশেষ কিছু হয়নি। বললুম তো, আমি হেরে গেছি!
কেন, হেরে গেলি কেন? রজত বুঝি গায়ের জোর দেখাল? কিংবা টাকার জোর?
ছিঃ! রজতবাবু সেরকম মানুষই নন।
তা হলে? মালতী বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল? মেয়েরা….,.
না, বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সময়। শশাঙ্ক যখন জেলে গেল, ঠিক সেই সময়েই মালতীর ওরকম কঠিন অসুখ হল কেন? মালতীর বাবা কেন ওরকম উদাসীন পাগল ধরনের? মালতীর সৎমা কেন হিংসুটে, হৃদয়হীন? সে সময় কেন আমি অত লাজুক ছিলাম? কেন আমার অত অর্থকষ্ট ছিল? মালতীর অসুখের সময় আমি কিছুই করতে পারিনি, শুধু ব্যাকুল হয়েছি, আর কবিতা লিখেছি কাপুরুষের মতন। পুরুষের যোগ্য কোনও কাজই করতে পারিনি। নিছক ভালোবাসার কোনও মূল্য নেই। মালতীও আমাকে ভালোবাসত, কিন্তু ভালোবাসার জন্য যদি মালতী শেষপর্যন্ত মরে যেত, তা হলে শেষ পর্যন্ত আমিও সেটাকে গৌরবময় বলতে পারতুম না। রজত এসে মালতীকে বাঁচিয়েছিল।
রজত কী করে মালতীকে চিনল? কী করেই বা সে বাঁচাল?
তার সবটা আমিও জানি না। কিন্তু বাঁচিয়েছে একথা খুবই সত্যি!
অবিনাশের চরিত্র বেশ খানিকটা নিষ্ঠুর আর রুক্ষ ধরনের। কিন্তু এক-একসময় তার ব্যবহার হয় অপ্রত্যাশিত রকমের। অবিনাশ উঠে এসে অরুণের কাঁধে তার চওড়া হাত দুখানি রেখে ভারী কোমল গলায় বলল, অরুণ, তুই মালতীকে এখনও ভুলতে পারিসনি?
না।
তুই ওকে এখনও সেইরকম ভালোবাসিস?
মালতী ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের কথা আমি মনেই করতে পারি না। তুই বিশ্বাস কর অবিনাশ।
তুই যে ব্যর্থ হয়েছিস, তুই যে সময় মতন পৌরুষের পরিচয় দিতে পারিসনি, সেইজন্যেই হয়তো তুই মালতীকে ভুলতে পারছিস না। পারবিও না আর কখনও, যদি না এর মাঝখানে কিছু একটা না ঘটে।
অরুণ ধীর স্বরে বলল, আর কিছুই ঘটবে না, আমি জানি।
তা কে বলতে পারে? আচ্ছা, মালতী তোকে এখনও ভালোবাসে?
জানি না।
অবিনাশ অরুণের কাঁধ ছেড়ে দিয়ে ফিরে এল। গেলাসে আরও কিছুটা মদ ঢেলে এক চুমুকে শেষ করে হাতের উলটোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছল। তারপর বলল, অরুণ, তোকে আমি অ্যাডভাইস দিতে চাই না, কিন্তু তোর মতন অবস্থা যদি আমার হত, তা হলে আমি এখন কী করতুম, বলব? আমি মালতীর সঙ্গে দেখা করে জেনে নেবার চেষ্টা করতুম, মালতী এখনও আমাকে ভালোবাসে কিনা। যদি ভালোবাসে, তবে এবার আর আমি কোনও ভুল করতুম না। আমি রজতের কাছ থেকে জোর করে মালতীকে কেড়ে আনতুম। ভালোবাসার অপূর্ণতা জীবনটা ছারখার করে দেয়! নিছক ভদ্রতার জন্য মুখ বুজে থাকার কোনও মানে হয় না। রজত মালতীর প্রাণ বাঁচিয়েছে, এটাই মালতীর জীবনের সব কিছু হতে পারে না! কৃতজ্ঞতারও তো একটা সীমা আছে! মালতী অনায়াসেই রজতকে এখন ডিভোর্স করতে পারে। আশা করি, তোর কোনও প্রেজুডিস নেই?
অরুণ শান্ত ভাবে বলল, তুই যা বললি, তা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
কেন?
ভালোবাসার ব্যাপারে আমি কোনও জোর করতে পারি না। আমার সে ক্ষমতাই নেই। তা ছাড়া, আমি মনস্থির করতে পারি না। বিয়ের অনেক আগে, মালতী আমার কাছে একটা দারুণ প্রতিজ্ঞা করেছিল।
কী প্রতিজ্ঞা!
সেটা আমি বলব না তোদের। যাই হোক, যখন আমি ভাবি যে, মালতী সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙেছে, তখন বিষম অভিমানে আমার বুক ভরে যায়। আবার যখন ভাবি, কী অবস্থায় পড়ে মালতী রজতের সঙ্গে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল, তখনও মালতীকে একটু দোষ দিতে পারি না। ব্যর্থতাটা শুধুই আমার একার।
তবু আমার মনে হয়, মালতী তোকে এখনও সেই রকম ভালোবাসে কি না, তা তোর জানার চেষ্টা করা উচিত।
আমি পারব না, অবিনাশ। আমি গুপ্তচরের মতো আমার আসল উদ্দেশ্যটা গোপন করে রজতবাবুর বাড়িতে ঢুকব, তারপর ভালোবাসার খবর জানার চেষ্টা করব, এ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমার দ্বারা সম্ভব নয়, রজতবাবুর মতন একজন মহৎ ভালো মানুষকে ঠকাতে কিংবা মনে দুঃখ দিতে। মালতী এখন কী রকম সুন্দর সুখের সংসার পেতেছে, আমি কিছুতেই পারব না সেই সংসারে ফাটল ধরাতে। আমার আজকাল একটা কথা প্রায়ই মনে হয়, ভালোবাসাটা বোধহয় সব সময় একজনেরই আলাদা ব্যাপার—একজনই ভালোবাসার নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে—দুজনের মিলিত জীবনের পক্ষে ভালোবাসার মূল্য তেমন কিছু বেশি নয়। সেখানে কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ববোধ এগুলোরই মূল্য বেশি।
না, একথা ঠিক নয়। আমি হলে কিন্তু মালতীর মন জানার চেষ্টাই আগে করতুম।
তুই হয়তো পারতিস। সবাই সব জিনিস পারে না।
সুনীল খাটের ওপর লম্বা হয়ে শুয়েছিল, এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। আলো আড়াল করার জন্য হাত দিয়ে চোখ চাপা। দেখে মনে হয়, ও ঘুমিয়েই পড়েছে। কিন্তু এবার বলল, অরুণ ঠিকই বলছে।
অবিনাশ জিজ্ঞেস করল, কী ঠিক বলছে?
সবাই সব জিনিস পারে না। তা হলে পৃথিবীটা একঘেয়ে হয়ে যেত। অরুণের অবস্থাটা বুঝতে পারছি।
সুবিমলের এরই মধ্যে খানিকটা নেশা হয়েছে। সে একটু জড়ানো গলায় বলল, বেশ নাটকের মতন শোনাচ্ছে। থামিস না।
সুবিমলের কথা কেউ গ্রাহ্য করল না। সুবিমল আবার বলল, আমি হলে কিন্তু বাওয়া মালতী-ফালতীকে ভুলে গিয়ে ওই মোম বলে মেয়েটার দিকে মন দিতুম! কী চমৎকার ঝকঝকে মেয়ে, আর কত কম বয়স!
অবিনাশ বলল, এ কথাটা কিন্তু সত্যি অবাস্তব নয়। অরুণ তো যা অবস্থা, তোর তা হলে এখন মালতীকে ভুলে যাওয়া চেষ্টা করাই উচিত। এ শহরে ওর এত কাছাকাছিই বা পড়ে আছিস কেন?
আমি জানতুম না, ওরা এখানে আছে।
সুবিমল বলল, কেন ভাঁওতা দিচ্ছিস! নিশ্চয়ই জানতিস। ব্যর্থ প্রেমিকদের আমার চিনতে বাকি নেই।
সত্যি জানতুম না, বিশ্বাস কর।
অবিনাশ বলল, তুই কিন্তু ভাগ্যবান। মোমের মতন অমন একটা ফার্স্টক্লাস মেয়ে তোর মতন একটা ভ্যাগাবন্ডের দিকে ঝুঁকেছে। তুই চেষ্টা করে দ্যাখ না, যদি ওর দিকে—
অরুণ এবার সত্যিকারের কাতর গলায় বলল, ও কথা আমাকে বলিস না। আমি পারি না। মালতী ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের মুখ আমার একবারও মনে পড়ে না। তোরা এটাকে আমার অসুখ বলতে পারিস; কিছুতেই আমি অন্য কোনও মেয়ের কথা ভাবতে পারি না। একা থাকলেই মালতীর মুখ—
সুনীল ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, থাক, এ নিয়ে আর কথা বলার দরকার নেই। এ সমস্যাটা এতই ব্যক্তিগত যে, এখানে বন্ধুদের কোনও উপদেশ দেওয়া মানায় না। চল, বরং একটু বাইরে ঘুরে আসি।
সুবিমল বলল, এত রাত্তিরে? বারোটা-একটা বাজে বোধহয়! এসব জায়গা আবার সাপখোপে ভর্তি।
অবিনাশ বলল, ধুৎ, সাপে কী করবে! চল, একটু ঘুরেই আসি। চল অরুণ, এখন শুয়ে পড়লে তোর সারা রাত ঘুমই আসবে না।
সন্ধ্যার দিকে খানিকটা জ্যোৎস্না ছিল, এখন পাতলা অন্ধকার। নোনতা হাওয়ায় কিছু কিছু ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। আসলে রাত খুব বেশি হয়নি। সুবিমলের ইচ্ছে, বাজারের দিকে গিয়ে আরও একটু পানীয় যোগাড় করা। কিন্তু বাজার বেশ খানিকটা দূরে, অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে যেতে পারে। বরং অন্ধকারেও নদী চিনতে পারা সহজ। ওঁরা নদীর দিকেই হাঁটছিল, কিন্তু নিস্তব্ধতার মধ্যেও মাঝে মাঝ দূর থেকে ভেসে আসা কয়েকটি তীব্র গলার স্বর ওরা শুনতে পায়। কোন একজন পুরুষ হুংকার দিচ্ছে, দু-তিনটে মেয়েলি গলায় কাতরতা। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনেই ওরা বুঝতে পারল, কাছেই কোথাও যাত্রা হচ্ছে। শব্দ অনুসরণ করে সেদিকেই গেল ওরা চারজন।
জেলেপাড়ার পাশের চত্বরটা ওরা সন্ধ্যার দিকেও ফাঁকা দেখে গেছে। এখন সেখানে চার-পাঁচটা হ্যাজাকের পুরু আলো, দু’তিনশো দর্শক… আর মাঝখানে চৌকি পাতা উন্মুক্ত মঞ্চে রং-মাখা মুখে কেদার রায়ের তীব্র গর্জন। মঞ্চে দুটি মেয়েও আছে। তাদের সত্যিকারের মেয়ে বলেই মনে হয়। গোঁফ কামাবার চিহ্ন নেই, বুকে নারকোল মালাও নেই। ভিড় ঠেলে ওরা চারজন সামনের দিকে গিয়ে দাঁড়াল। মঞ্চ থেকে কেদার রায় ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে আরও নিবিড় ভাব দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘যদি বাহুতে বল থাকে, যদি রিদয়ে মাত্যিভক্তি থাকে, যদি শিরায়-শিরায় পূর্বপুরুষের রক্ত থাকে, তবে কেদার রায়ের এই প্রভঞ্জনতুল্য তলোয়ার…..’
অবিনাশ ফিসফিস করে বলল, অনেকদিন যাত্রা দেখিনি। সত্যি, অনেক বদল হয়েছে কিন্তু—
সুনীল বলল, কী বদলেছে?
সব কিছু, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে অভিনয়—এখন দেখলে তো হাসি পায় না, বরং বেশ উত্তেজনাই জাগছে। কী রকম তলোয়ার ঘোরাচ্ছে দ্যাখ, এক্সপার্টের মতন। হিন্দি সিনেমায় এর তুলনায় অনেক খারাপ থাকে।
সুবিমল বলল, বীর কেদার রায় কিন্তু এর মধ্যেই হাঁপাচ্ছে।
চুপ! অত জারে বলিস না।
আর একটা জিনিস লক্ষ করেছিস, ডায়ালগে কী রকম সব শক্ত-শক্ত সংলাপ ব্যবহার করছে, অথচ লোকে শুনছেও চুপ করে। আমরা যে ভাবি এই সব অশিক্ষিত লোকেরা কিছুই বোঝে না—
সব বোঝে আজকাল। আমাদের চেয়ে বেশি বোঝে, ওই দ্যাখ, দ্যাখ, এবার ইশা খাঁ ঢুকল—এর চেহারাটা কিন্তু দারুণ—
অবিনাশ শুধু যাত্রাই দেখছিল না, ঘাড় ঘুরিয়ে দর্শকদেরও দেখছিল। একসময় সুনীলকে ঠেলা দিয়ে বলল, ওই দ্যাখ সেই মেয়েটা, সন্ধ্যাবেলা যাকে দেখেছিলাম। চেহারাখানা একবার দ্যাখ—উফ।
আগে দেখাসনি! মেয়েটা উঠে যাচ্ছে যে! এই দারুণ ক্লাইমাক্সের সময় যাচ্ছে কোথায়?
এই তো সময়! চল, বেরিয়ে গিয়ে দেখা যাক মেয়েটা কোথায় যায়! সুবিমল যাবি?
অরুণ বলল, আমি যাব না। আমি বাংলোয় ফিরে যাব। আমার ঘুম পাচ্ছে।
অবিনাশ বলল, আচ্ছা, তুই ফিরে যা। আমরা দেখি, যদি কিছু অ্যাডভেঞ্চার করা যায়। এই রে! মেয়েটা কোনদিকে গেল?
ওদের কোনওদিকেই যেতে হল না। একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার যাত্রার আসর পর্যন্ত এসে পৌঁছোল। শালা মেতু, আজ তোকে কাঁপে পেইছি। তুই শালা আমার হেঁসেলে হুলো বেড়াল হয়ে ঢুকিচিস! গোলমাল শুরু হল, যাত্রার আসর থেকে কিছু লোক ছুটে গেল। মঞ্চে স্বয়ং কেদার রায় একমিনিট ভুরু কুঁচকে থেমে রইলেন। অবিনাশরাও সেইদিকে এগিয়ে গেল।
তিন-চারজন লোক লাঠি হাতে নিয়ে ঘিরে ধরেছে এক বলিষ্ঠ যুবাকে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। এক হাতে বালা। এই যুবক আমাদের পূর্ববর্ণিত মিত্যুঞ্জয় বাড়ুড়ি। কাছেই সেই জেলেনি। ওরা দু’জনে চুপিচুপি যাত্রার আসর থেকে উঠে অন্ধকারের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় ধরা পড়েছে। একজন রোগা মতন লোক মেতুর সামনে তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে আস্ফালন করছে। বোঝা যায়, সে-ই জেলেনির স্বামী। ব্যাপারটা বেশ জমে উঠল। যাত্রা থেকে ক্রমশই বেশি লোক এদিকে চলে আসতে লাগল। শেষপর্যন্ত কেদার রায়ের চেয়েও বেশি বীর বিক্রমে মেতু ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, বেশ করিচি, যা করবি কর গে যা। শালা ভেড়োর ভেড়ো, নিজের মাগ সামলাতে পারে না—
অবিনাশ অরুণের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সে হাসি বাঙ্ময়, যেন বলতে চায়, দেখলি তো!
উত্তরে অরুণও হাসল একটু ম্লান ভাবে! যেন বলল, সবাই সব জিনিস পারে না।