তিন
সকালবেলা রজতের কাছে অনেক লোকজন আসে। ঘুম থেকে উঠে চা খেতে খেতে যে অনেকক্ষণ ধরে আরাম করে কাগজ পড়বেন, সে বিলাসিতা করার সময়ও তাঁর নেই। ভোরেই বিছানা ছেড়ে ওঠা তাঁর অভ্যাস। সেই ছেলেবেলায় যখন কাকার বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করতেন, তখন কাকা তাঁকে প্রত্যেক দিন ভোরবেলা ডেকে দিতেন। বলতেন, আগে খানিকটা ব্যায়াম করো, তারপর পড়তে বসবে। চা খাবে ঘুম ভাঙার দু’ঘণ্টা পরে। কাকা বলতেন, আমি বাপু সব মানুষকেই সাধু-সন্ন্যাসী হতে বলি না, কিন্তু বিষয়-সম্পদ ভোগ করার জন্যও নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়। অলস লোকেরা আসলে কোনও কিছুই, ভোগ করতে পারে না। অনেক ধনী লোককেই দেখবি, হার্টের অসুখে ভুগছে। দূর দূর। তা হলে ধন থেকে লাভ কী?
কাকার নিজের কোনও সন্তান ছিল না, রজতকেই তিনি নিজের সন্তানের মতন মানুষ করেছেন। খুব কড়া নিয়ম-কানুন ছিল তাঁর। রজতের স্বাস্থ্য আর বিদ্যা দুটোর জন্য তিনি কাকার কাছে ঋণী।
এখন অবশ্য আর ঘুম থেকে উঠেই স্নান করার অভ্যাস নেই, কিন্তু ভোরে ঘুম ভাঙার অভ্যাস এখনও আছে। মালতী তখনও ঘুমিয়ে থাকে, রজত তাকে ডাকেন না। সকালের প্রথম আলোয় মালতীর গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা চেহারাটার দিকে তাকিয়ে তিনি একটা খুশির নিশ্বাস ফেলেন, তারপর উঠেই মুখ-টুখ ধুয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে। প্রত্যেক সকালে মাইল দুয়েক হেঁটে বেড়ানো তাঁর অভ্যেস। ফিরে এসে বাইরের ঘরে বসে দু’একটা কাগজ ওলটাতে না ওলটাতে লোকজন আসতে শুরু করে। থানার দারোগা, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে কোনও গ্রামের মণ্ডল প্রধান—নানান ধরনের মানুষ, নানান রকমের আরজি। কার্যত এখনও সেই ঘুম ভাঙার দু’ঘণ্টা পরই তাঁর চা খাওয়া হয়। ওরই মধ্যে একবার উঠে গিয়ে চা-খাবার খেয়ে এসে পাইপ ধরিয়ে বসেন।
কয়েকদিন ধরেই রজত কিছুটা বিব্রত ও ব্যস্ত। চালের দর হু-হু করে বাড়ছে, ধানের দাম উঠেছে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ টাকা। চাল একটাকা ষাট-পঁয়ষট্টি করে কিলো, তাও পাওয়া যাচ্ছে না। মডিফায়েড রেশনিং এলাকাগুলোতে দোকানে চাল নেই, খোলা বাজারে চাল কেনার পয়সা নেই সাধারণ মানুষের। জেলেদের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ—নদীর মেজাজ-মর্জি একেবারে বদলে গেছে। অধিকাংশ দিনই আজকাল মাছ ওঠে না। ইলিশের ঝাঁক বুঝি এবার সমুদ্র ছেড়ে নদীতে ঢোকেনি, ওরা বুঝি এ বছর আর মরতে চায় না, কিংবা মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। দিনের পর দিন জেলেদের জালে মাছ ওঠে না, তারপর একদিন মাছ উঠল তো প্রচুর মাছ। নৌকো ভর্তি ইলিশ জমা হচ্ছে গোসাবা কিংবা কাকদ্বীপে। সেসব মাছ কলকাতার বাজারে চালান দেবার আগেই পচে যাচ্ছে। যথেষ্ট বরফ পাওয়া যায় না, ইলিশ মাছ একটুক্ষণ বরফ ছাড়া রাখলেই তো নষ্ট। কয়েকটা বরফ-কল খোলার জন্য খুব লেখালেখি করছেন রজত। সম্প্রতি আর একটা মুশকিল হয়েছে। কেরোসিন বাজার থেকে উধাও। গত সপ্তাহে কেরোসিনের দাম চচ্চড় করে বাড়ছিল, এ সপ্তাহে কোথাও এক ফোঁটা কেরোসিন নেই। গ্রামের পর গ্রাম সন্ধ্যা থেকেই অন্ধকার। এসব অঞ্চলে সাপের বিষম উপদ্রব, সন্ধ্যার পর আলো ছাড়া কেউ ঘর থেকেই বেরোতে ভয় পায়, কিন্তু কেরোসিন নেই, টর্চের ব্যাটারির দামও বাড়ছে সুযোগ বুঝে।
গতকাল সন্ধ্যাবেলা পীরপুরের এক ব্যবসায়ীর বাড়ি ক্রুদ্ধ জনতা ঘিরে ধরেছিল। সেই বাড়িতে কেরোসিন লুকিয়ে আছে এই সন্দেহে। ব্যবসায়ীটি কিছুতেই কেরোসিন লুকোনোর কথা স্বীকার করেনি। তখন কে যেন সে-বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মুহূর্তে দপ করে সারা বাড়িতে জ্বলে ওঠে আগুন—সেই আগুনের তেজ ও হলকা দেখে লোকের আর সন্দেহ থাকেনি যে, সত্যিই বহু কেরোসিন লুকোনো ছিল। পীরপুর থানার দারোগা সুখেন্দু হালদার সেই রিপোর্ট নিয়ে আজ এসেছে রজতের কাছে।
খবরটা শুনে রজত কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। আজকের কাগজে খবরটা বেরোয়নি, কাল নিশ্চয়ই বেরোবে, তারপর অ্যাসেম্বলিতে কোশ্চেন উঠবে, মুখ্যমন্ত্রী তখন তলব করবেন আলিপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ রক্ষিত জরুরি টেলিফোন করবেন রজতকে, রজতের কর্তব্য তখন পীরপুরের থানার দারোগাকে ডেকে ধমকানো—সেই সব আগে থেকেই বুঝে নিয়ে পীরপুর থেকে এত ভোরবেলা সুখেন্দু হালদার ছুটে এসেছে রজতের কাছে। এই সমস্যাবহুল জায়গাটাতে সুশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যই স্পেশাল ডিউটিতে রজতকে এখানে পাঠানো হয়েছে। রজত চুপ করে থেকে ভাববার চেষ্টা করলেন, সেই ব্যবসায়ীর বাড়িতে জমানো কেরোসিন তেলে একসঙ্গে আগুন লাগায় কতখানি জায়গাতে আলো হয়েছিল। কতখানি কেরোসিন জমা ছিল—একশো, দুশো ড্রাম? কতক্ষণ লেগেছিল পুড়তে—বড় জোর এক ঘণ্টা?
সুখেন্দু হালদার বলল, স্যার আমাদের একজন কনস্টেবল আহত হয়েছে।
রজত এদিকেই তাকিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু চোখে ভাসছিল সেই আগুনের দৃশ্য। এবার চোখের পলক ফেলে আগুনের দৃশ্য মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সিরিয়াস? ক’জন কনস্টেবল ছিল সেখানে?
তিনজন। ‘মব’ আনরুলি হয়ে ওঠে। মির্জা ইসমাইলের বাড়ির সামনেই যে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের অফিস তৈরি হচ্ছে—সেই ইট আর খোয়া ছুঁড়তে শুরু করে কনস্টেবলদের দিকে—তিনজনই ইনজিয়োর্ড হয়েছে, একজনের বেশ সিরিয়াস।
আপনি ছিলেন না সেখানে?
আমি তখন—
রজত হঠাৎ রেগে উঠলেন। বললেন, আপনি নিজে না গিয়ে শুধু কনস্টেবলদের পাঠিয়েছিলেন? ভয় পেয়েছিলেন বোধহয়?
না স্যার। আমি তখন—
আপনি নিজে যাননি কেন? সারাবছরই আরামে কাটাবেন?
না স্যার, শুনুন—
সুখেন্দু হালদার রজতের চোখের দিকে তাকাতে ভয় পায়। মুখ নিচু করে বলে, না স্যার, আমি প্রথমে গিয়েছিলাম, তারপর অবস্থা খারাপ দেখে থানায় ফিরে এসে…..
লুকিয়ে রইলেন?
থানায় ফিরে এসে এখানে ফোন করলুম। আমাদের ওখানে তো টিয়ার গ্যাসের শেল নেই, তাই মব ডিসপার্স করা জন্য কী করব, সেই অর্ডার নেবার জন্য—
লাঠি চার্জ করতে পারতেন।
স্যার, ওটা ছোট থানা, তিনজন মাত্র জমাদার। লাঠি চার্জ করলে ফল খারাপ হতে পারত—অত লোকের সামনে—ফায়ারিং-এর জন্য তৈরি থাকা দরকার—তাই কী করব হুকুম নেবার জন্য টেলিফোন করেছিলুম। এখানকার ও.সি. বলল, আপনার কাছ থেকে অর্ডার নিতে হবে। আপনাকে ফোন করা হয়েছিল।
কখন?
তখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে এগারো মিনিট। আপনাকে টেলিফোনে পাওয়া গেল না, তাই আমরা তো কেউ দায়িত্ব নিতে পারি না।
কাল সন্ধ্যাবেলা রজত মালতীকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। সাতটা বেজে এগারো মিনিটের সময় তিনি কোথায় ছিলেন? ওই সময়ে গাড়িটাকে একেবারে গঙ্গার পাড় পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে অন্ধকার জলের দিকে তাকিয়েছিলেন। মালতী গান গাইছিল। ভারী সুন্দর সুরটা। অতুলপ্রসাদের গান—প্রবল হাওয়ায় সুরটা যেন এলোমেলো হয়ে ওড়াওড়ি করছিল। রজত স্টিয়ারিংয়ের ওপর গাল রেখে আবিষ্ট ভাবে শুনছিলেন। ঠিক সেই সময়েই টেলিফোনে তাঁকে খোঁজা হল—পীরপুরে মির্জা ইসমাইলের বাড়িতে লুকানো কেরোসিনের ডিপোয় দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে, ক্রুদ্ধ খ্যাপাটে মানুষ ইট-পাথর ছুঁড়ছে পুলিশের দিকে, তিনজন মাত্র পুলিশ, ভয়ে কাঁপছে—টেলিফোনে দারোগার ব্যাকুল কান্না—এসব কিছুই সেই নদীর পাড়ে রজতের তন্ময়তা ভাঙতে পারেনি। ব্যাপারটা ভেবে রজত একটু লজ্জিত হলেন। এক পলক তাকিয়ে বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন। সুখেন্দু হালদার যেন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে—আসলে লোকটা তাঁকে ব্যঙ্গ করছে কি না। কিন্তু রজত ভাবলেন, তাঁর কী দোষ? মানুষ কি চব্বিশ ঘণ্টা টেলিফোনের আওতায় থাকবে নাকি, বেড়াবে না? গান শুনবে না?
রজতের মেজাজটা আবার উষ্ণ হয়ে উঠল। তীব্র গলায় জিজ্ঞেস করলেন, মির্জা ইসমাইলের বাড়িতে যে কেরোসিন হোর্ড করা রয়েছে, তা আপনারা আগে থেকে খবর পাননি।
হ্যাঁ পেয়েছিলাম। কিন্তু কোনও ব্যবসায়ী বাড়িতে কেরোসিন রাখতে পারবে না, এমন কোনও অর্ডার তো পাইনি।
আন-অফিসিয়ালি দু’চারবার তাকে ধমকে তো ভয় দেখাতে পারতেন। কেরোসিন না পেলে মানুষ তো খেপে উঠবেই। এ সময়টা আবার সব ছেলেদের পরীক্ষা, তা ছাড়া সন্ধ্যৃা থেকেই সব কাজকর্ম বন্ধ—এ কি সহ্য করা যায় নাকি? লোকেরা মির্জা ইসমাইলকে কিছু বলেনি?
সে বাড়িতে ছিল না। বাড়ি থেকে সবাই পালিয়েছিল।
চলুন, আমি পীরপুরে যাব।
আপনি যাবেন? ওখানে এখনও খুব টেনশন।
আমি যাব। আপনি বসুন, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
রজত ওপরে উঠে এসে দেখলেন, মালতী আলমারি গুছোচ্ছে। হালকা ভাবে মালতীর কাঁধ ছুঁয়ে বললেন, মালতী, আমি পীরপুর যাচ্ছি। দুপুরে হয়তো খাবার জন্য না-ও আসতে পারি।
মালতী ফিরে রজতকে দেখে বলল, তোমার মুখটা গম্ভীর। খারাপ খবর-টবর এসেছে বুঝি?
হ্যাঁ, ওদিকে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। চাল পাওয়া যাচ্ছে না, মানুষ খেতে পাচ্ছে না, তার ওপর কেরোসিনও অদৃশ্য হয়েছে—এবার তো গোলমাল শুরু হবেই।
তুমি যাচ্ছ, কোনও ভয়-টয় নেই তো?
না, ভয়ের কী আছে। ওখানে গিয়ে ‘অন দা স্পট’ এনকোয়ারি করা দরকার। কাল হয়তো কলকাতা থেকে আমার ডাক পড়বে।
তুমি সাবধানে থেকো।
রজত হাসলেন। চিরুনিটা দ্রুত মাথায় চালাতে চালাতে বললেন, তুমি একদম চিন্তা করবে না। এসব জায়গায় কী করে ট্যাকল করতে হয়, সে সম্বন্ধে আমাদের ট্রেনিং নেওয়া আছে। তুমি একদম আমার জন্য চিন্তা করবে না।
মালতী রজতের শার্টের বোতামগুলো আটকে দিল। বলল, যত কাজই থাক, সন্ধ্যার মধ্যে ঠিক ফিরে এসো। সন্ধ্যাবেলা আমার একা থাকতে ভালো লাগে না।
জিপে পীরপুর পৌঁছোতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগল। অল্প মেঘলা মেঘলা দিন, ভোর রাত্রের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে। চার পাশের দৃশ্যের মধ্যে কী রকম একটা নরম সৌন্দর্য আছে। রজত যাবার পথে ভাবলেন, কলকাতায় বোঝা যায় না, কিন্তু গ্রামের রাস্তায় ঠিক টের পাওয়া যায় এখন প্রায় বসন্তকাল। গাছগুলোর পাতা এখন কী রকম কচি কচি সবুজ! এক-একটা গাছের সবুজ এক-একরকম। খালের জলে অজস্র কচুরিপানার ফুল ফুটে আছে। বলা যায় নিখুঁত পল্লি-প্রকৃতি। যে-কোনও দিকেই তাকাতে ভালো লাগে, অথচ এখানে মানুষের মনে আনন্দ নেই, বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট খাবার নেই, আলো নেই। পাশাপাশি দুটো খড়ের ঘর চোখে পড়ল। একটা মাঠের ঠিক মাঝখানে দুটি মাত্র ঘর। ঝকঝকে তকতকে, গোবর লেপা উঠোন, প্রহরীর মতন দুটো নারকোল গাছ, দেখতে কী ভালো লাগছে, অথচ ওই বাড়ি দুটোর মানুষ হয়তো এখন খাবার জোটাবার চিন্তায় পাগল। রজত ভাবলেন, আমার যদি উপায় থাকত, আমি এদের সবার দুঃখ দূর করে দিতাম। কিন্তু আমি কী করব, আমার কতটুকু সাধ্য? চারপাশে এত দুঃখ-কষ্ট দেখলে, আমি যে ঠিকমতো খেতে পাচ্ছি, আর সুখে আছি, এর জন্যও লজ্জা হয়।
যাবার পথে মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে রজত মোমবাতি কিনলেন। সব মিলিয়ে কুড়ি-পঁচিশ টাকার মোম কেনা হল।
পীরপুর থানার সামনে একটা ছোটোখাটো জটলা। রজতের জিপ থামতেই জনতা সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিল। কী এক অলৌকিক উপায়ে যে খবর এসে যায়, বোঝা যায় না। কেন না, রজত স্পষ্ট টের পেলেন, ওখানকার প্রত্যেকটি লোক তাঁর আগমনেরই প্রতীক্ষা করছিল। এক ব্যক্তির মাথা-জোড়া টাক, কিন্তু কানের পাশে যে-টুকু চুল আছে, সেই চুল তেল চুপচুপে, কাঁধে মুগার চাদর ও মুখময় হাসি। লোকটি এগিয়ে এসে রজতের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, নমস্কার স্যার। আমিই এখানকার মণ্ডল কংগ্রেস আর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট, আমার নাম হরিহর লস্কর।
রজত প্রতি-নমস্কার করে বললেন, আচ্ছা, আপনি একটু বসুন, আগে থানায় গিয়ে লোকাল রিপোর্ট সব নিয়ে নিই, তারপর আপনার সঙ্গে কথা বলব।
হরিহর লস্কর সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল, সেসব পরে হবে স্যার। আগে চান-খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে নিন। ছায়া ছোট হয়ে গিয়েছে, বেলা প্রায় বারোটা একটা হল। আমার বাড়িতে ব্যবস্থা করেছি, সামান্য কিছু—
রজত বিব্রত হয়ে বললেন, না, না, তার দরকার নেই।
সে কী স্যার, তা বললে কি হয়? কাজ আগে, না শরীর আগে? গরিবের বাড়িতে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে—
আপনি বললেন, সেজন্য অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমি অন্যের বাড়িতে খাই না।
আমার বাড়িতে গিয়ে আপনার নিজের বাড়ির মতন মনে হব। কত দারোগা ম্যাজিস্ট্রেট এসে আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছেন, এমনকী সাহেবি আমলেও বড় বড় সাহেবরা—
কী মুশকিল, বলছি তো আমার দরকার নেই। আমি যা হোক একটা ব্যবস্থা করে নেব। এখানে তো আমি আপ্যায়ন নিতে আসিনি।
কিন্তু আমাদের এ গাঁয়ে তো হোটেল-পাট কিছু নেই, তাই এই গরিবের বাড়িতে—
রজত এবার আচমকা প্রশ্ন করলেন, লস্কর মশাই, আপনার কীসের ব্যবসা? আসুন, আগে সেই সম্পর্কে কিছু কথা বলি।
হরিহর লস্কর বিনয়ে সংকুচিত হয়ে বললেন, আমাদের আবার ব্যবসা কী স্যার? সামান্য গ্রাম্যচাষা, দু’-দশ বিঘে ধানজমি আছে, আর কয়েকটা পুকুর ইজারা নিয়েছি, বাজারে একটা ছোট্ট দোকান—
রজত এবার তাকে পাশ কাটিয়ে থানার বারান্দায় উঠলেন। তারপর ঘুরে বললেন, লস্কর মশাই, আপনি এখানকার পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট, এখানকার লোক নিশ্চয়ই আপনাকে মানে। আপনি একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন? গ্রামের প্রধান লোকদের বলবেন, বেলা তিনটের সময় এখানে আসতে? আমি সবার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
তিনটের সময় কী করে হবে স্যার? তখন তো অনেকেই কাজে-কম্মে ব্যস্ত থাকবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে, পাঁচটা কি ধরুন সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। তখন তো আবার বেলা পড়ে আসবে।
তা বলতে পারি সকলকে। কিন্তু সাড়ে পাঁচটায় আবার সন্ধে হয়ে আসবে। এখন তো কারওর বাড়িতে লণ্ঠন জ্বলে না, এই আঁধার রাতে সাপ-খোপের রাস্তা দিয়ে হাঁটা—
রজত বুঝলেন, লোকটি অতিশয় বাক্যবাগীশ। এর সঙ্গে কথা বললে অনর্থক শুধু সময়ই নষ্ট হবে। তা ছাড়া, এসব গ্রাম্য রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথায় তিনি পারবেন না। তাই বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমিই যা ব্যবস্থা করার করব তা হলে। আপনার বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা আলো জ্বলে তো?
আজ্ঞে না, কেরোসিন যা ছিল ছিটেফোঁটা, কাল পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে স্যার। আজ থেকে তুলসীতলায় রেডির তেলের পিদিমটুকু শুধু জ্বলবে। আমার আবার প্রতি রাতে রামায়ণ পাঠ অভ্যেস।
ঠিক আছে, দুটো মোমবাতি নিয়ে যান এখান থেকে। আজকের সন্ধ্যাটা তো চলুক।
এই গ্রাম দেশে কি আর মোমবাতি চলে? সেসব চলে আপনাদের শহরের কাচের জানালা দেওয়া ঘরে। এখানে এক-একখান হাওয়ার ঝাপটা আসবে আর ফুড়ুৎ করে নিববে। দিয়াশলাই জ্বালতে জ্বালতে সে আপনার ঢাকের দায়ে মনসা বিকোবে। কেরোসিনের ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হবে স্যার।
দেখি কী করতে পারি।
আপনার জন্য খাবার তৈরি করলুম, সব নষ্ট হবে। বাড়ির মেয়েছেলেরা বড় দুঃখ পাবে—হাজার হোক আপনি ব্রাহ্মণ। বাড়িতে না খান, এখানে পাঠাব?
কতবার আর প্রত্যাখান করা যায়। লোকটি কিছুতেই ছাড়বে না, আসল কাজই এখন পর্যন্ত আরম্ভ করা যাচ্ছে না। রজত বললেন, কী মুশকিল, আমাকে না জিজ্ঞেস করে খাবার তৈরি করালেনই বা কেন? আমি যে আসব জানলেন কী করে। ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিন এখানে। বাজারে আপনার দোকান আছে বলছিলেন, কীসের দোকান?
সে সামান্য মুদিখানা, চাল-ডালের কেনা-বেচা হয়। সেও তো এখন চাল বাড়ন্ত।
আপনার বাড়িতে কত চাল জমা আছে? এখন আপনার বাড়িতে খেতে যেতে পারছি না বটে, তবে বিকেলের দিকে আপনার বাড়িতে একবার বেড়াতে যাব।
নিশ্চয়ই আসবেন হুজুর, পায়ের ধুলো দেবেন। আমার বাড়িতে যদি চাল থাকত, তবে আজ গাঁয়ের লোকের এই দুরবস্থা হয়? আমার পিতাঠাকুর ছিলেন নামকরা সদাশয় ব্যক্তি। আপনি লোককে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তেনার আমলে সেই যখন পঞ্চাশ সনের দুর্ভিক্ষ হল—
রজতের ক্লান্তি লাগতে লাগল। প্রথম দর্শনেই তিনি বুঝেছিলেন, হরিহর লস্কর লোকটি অতিশয় ধুরন্ধর। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল, লোকটির মুখের ওপর একটা প্রচণ্ড ধমক লাগাই, কিন্তু বুঝতে পারেন তাতে কোনও ফল হবে না। সুতরাং নিজের মেজাজ দমন করতে গিয়ে অনর্থক ক্লান্তি আসে। অথচ এই লোকটির প্রতিটি কথার মধ্যে স্বার্থের প্যাঁচ চলছে—রজত অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারেন। এই সমস্ত ছোট গাঁয়ে সাধারণত দু-তিনটে লোক থাকে সমস্ত গণ্ডগোলের মূল—তাদের এক নজরে চিনতে পারা যায়। লোকগুলোকে প্রকাশ্যে শাস্তি দিলে উচিত শিক্ষা হয়। কিন্তু মুখের ওপর কোনও লোককে অপমান করতে রজতের রুচিতে বাধে। তা ছাড়া শাস্তি দেবার ক্ষমতাও তাঁর হাতে নেই। শাসনতন্ত্রের মধ্যে কী রকম ভাবে যেন অদ্ভুত জট পাকিয়ে গেছে—আইন শৃঙ্খলার অস্ত্রগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রতিষেধক খুঁজে নিয়েছে। এখন মানুষজন খেপে উঠে দাঙ্গা করতে চাইলে রজতের ক্ষমতা আছে তাদের ওপর টিয়ার গ্যাস, লাঠি এবং গুলি চালনার হুকুম দেবার, কিন্তু মানুষজন যাতে খেপে না ওঠে, সে-রকম কোনও ব্যবস্থা করার ক্ষমতা তাঁর হাতে নেই।
আগেকার এ ডি. এম. তরফদার যখন বদলি হয়ে যান, তখন চার্জ হ্যান্ডওভার করে দেবার সময় তিনি রজতকে বলেছিলেন, মিঃ রায়চৌধুরী, একটা কথা আপনাকে বলে যাই, এসব দক্ষিণের লোকদের মধ্যে আপনি একেবারে ভালোমানুষ সাজবার চেষ্টা করবেন না। আপনি যত ভালো হবেন, এরা তত আপনাকে পেয়ে বসবে। যত পাজি হবেন, তত এরা আপনাকে মানবে। আর যদি চাকরি এবং পৈতৃক প্রাণ বজায় রাখতে চান, তবে ওসব দুর্নীতি উচ্ছেদ-টুচ্ছেদের শুভ উদ্দেশ্য একেবারে ত্যাগ করুন। আপনি পারবেন না, কেউ পারবে না, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী এলেও পারতেন না। খালি দেখবেন, যা চলছে, তাই চলুক। বেশি যেন আর বেড়ে না যায়।
কথাগুলো শুনে রজত স্মিত হাস্য করেছিলেন। একজন মানুষ কী করে ইচ্ছে করে পাজি হতে পারে? কী করে ইচ্ছে করে বেদমেজাজি হতে পারে? তরফদার সাহেব নাকি যে-কোনও থানায় ইন্সপেকশানে গিয়ে প্রথমেই সামনে যাদেরই পেতেন তাদের মধ্যে দু’তিনজনকে বেছে নিয়ে বেধড়ক ধমক লাগাতেন। এমনকী নিজের হাতে কান মুলে চড়-চাপড়ও নাকি লাগাতেন কাউকে কাউকে—তাই তাঁর ভয়ে সবাই কাঁপত। সেই কথা ভেবে রজতের সামান্য হাসিও পেল আবার। না, তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় ওসব। সবাই তো সব জিনিস পারে না।
কিন্তু রজত পদে পদে নিজের অসহায়ত্ব টের পেতে লাগলেন। পীরপুর থানার বারান্দায় ২০/২৫ বস্তা চাল পড়ে আছে। বৃষ্টি-বাদলে ভিজে সেগুলো পচতে শুরু করেছে। শুনলেন, এখানকার ফেয়ার প্রাইস শপের মালিক নাকি বে-আইনি ভাবে বেশি দামে চাল বেচছিল, কমপ্লেন পেয়ে পুলিশ সেই চাল সিজ করে নিয়ে আসে। সে চালের এতদিন কোনও বন্দোবস্ত হয়নি কেন? হয়নি, তার জন্য দায়ী আইন। থানা থেকে চাল বিলি করবার এক্তিয়ার নেই। ধৃত চাল জমা দিতে হবে ফুড ডিপার্টমেন্টকে, সেখান থেকে আবার ঘুরে আসবে। এদিকে কেন্দ্রীয় ফুড করপোরেশন এখন গ্রামাঞ্চল থেকে চাল সংগ্রহ করছে। সুতরাং এই চাল কে নেবে, পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যবিভাগ, না কেন্দ্রীয় ফুড করপোরেশন—তার এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সে সংকটে ফাইলে লেখালেখি চলছে, ততদিন এ পঁচিশ বস্তা চাল থানার বারান্দাতেই জমা থাকবে।
ভালো করে লক্ষ করে রজত আরও আইনের ফুটো দেখতে পেলেন। বারান্দায় প্রত্যেকটি চালের বস্তা ফুটো! সন্দেহ কী, থানার প্রতিটি লোক—দারোগা থেকে নিম্নতম কনস্টেবলটি পর্যন্ত—যখন যার যেমন ইচ্ছে—ফুটো করে চাল বার করে নিয়েছে। ওদের কৈফিয়ত তলব করলে, উত্তর সোজা। থানার লোক চোর-ডাকাতদের পাহারা দিতে জানে, কিন্তু ইঁদুর-পোকামাকড় পাহারা দেবে কী করে? সব বুঝেও থানার লোকদের ধমক দিতে ইচ্ছে হল না রজতের। কোনটা যে দোষ, তা ঠিক নির্ণয় করাও যে যায় না। বৃষ্টিতে ভিজে চালগুলো অখাদ্য হয়ে এসেছে, আর দু’-চারদিন বাদেই সম্পূর্ণ অব্যবহার্য হয়ে যাবে—সেটা অন্যায়, না এর থেকে যদি থানার লোকজন গোপনে কিছু বার করে নিয়ে খেয়ে থাকে, সেটা অন্যায়? রজত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর ক্রমশ অসহায় বোধ হতে লাগল।
মির্জা ইসমাইলের বাড়ি পোড়ানোর ঘটনার ফলে গ্রামের অবস্থা বেশ থমথমে। এ গ্রামে প্রায় অর্ধেক অর্ধেক হিন্দু-মুসলমানের বাস, সুতরাং হঠাৎ একটা দাঙ্গা লেগে যাওয়া আশ্চর্য নয়। রজত যখন বললেন, তিনি স্পট দেখতে যাবেন, তখন হেড কনস্টেবল বিপিন তাঁকে বলল, স্যার, আপনার ওখানে আজ না যাওয়াই ভালো। ইসমাইল সাহেব তার নিজের জাতের লোকজন নিয়ে দল পাকাচ্ছেন আজ। আবার কিছু হলে ওরা কাজিয়া করবে।
রজত জিজ্ঞেস করলেন, ইসমাইল সাহেবের নিজের জাতের লোকেরা কেরোসিন পাচ্ছিল?
আজ্ঞে না, হুজুর। এখানকার মুসলমানরাও তো সব অধিকাংশই গরিব। পাঁচসিকে বোতল কেরোসিন কিনবে সে খ্যমতা নেই।
আমি সেখানে যাব। চলো আমার সঙ্গে। রেডি হও।
জি, সরকার।
ইসমাইল থানার ডায়েরি করেছে কারওর নামে?
হ্যাঁ, হুজুর। পাঁচজনের নামে। তার মধ্যে একজন ওই হরিহর লস্কর।
রজত দারোগার দিকে ফিরে বললেন, আপনি ফুল এনকোয়ারি করে আজই রিপোর্ট পাঠাবেন। কোনও রকম গাফিলতি করবেন না।
মির্জা ইসমাইলের বাড়ির আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বীভৎস ধ্বংসস্তূপ দেখেই বোঝা যায়, প্রচুর দাহ্য পদার্থ না থাকলে এমন নিঃশেষে কোনও বসতবাটি পুড়তে পারে না। আশেপাশে আর কোনও বাড়ি নেই, কিন্তু ইসমাইলের বাগানের আমগাছগুলো পর্যন্ত কালো হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু কালো রং আর ছাই, আর বিশ্রী দুর্গন্ধ, লেপ-তোষকের গাদা থেকে এখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে ধোঁয়া উঠছে। একটা ছোট ফুলের বাগান ছিল, মানুষের পায়ের চাপেই সেটার অপমৃত্যু ঘটেছে, আগুনে পুড়তে হয়নি।
মির্জা ইসমাইল লোকটি শক্ত ধরনের। কঠিন লম্বা চেহারা, চোখ দুটো এক রাত্রেই গর্তে ঢুকে গেছে, কিন্তু হাউমাউ করে কাঁদছে না মোটেই। কী জানি, কোনও একসময় এসে একা সে খানিকটা কেঁদে নিয়েছে কিনা। কিন্তু এখন মুখখানা নিরেট, চোখে দৃষ্টি স্থির। রজত ও সঙ্গের পুলিশদের দেখে সে একটি ছোট্ট দলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।
লোকটিকে দেখে রজতের মিশ্র অনুভূতি হল। একটি লোকের বাস্তুভূমি পুড়ে গেছে, যথাসর্বস্ব গেছে কিনা তার ঠিক নেই, এমন লোককে দেখে মায়া এবং করুণা জাগাই উচিত। রজতেরও সেই রকম অনুভূতি জেগেছিল, কিন্তু এ কথাও ভুলতে পারছে না, এই লোকটা গরিব লোকদের আলো থেকে বঞ্চিত করে নিজের বাড়িতে সব কিছু লুকিয়ে রেখেছিল। লোকটা লোভী। কিন্তু কত মানুষই তো লোভী, সবাই কি এ-রকম ভয়ংকর শাস্তি পায়? লোকটার শাস্তির চেহারাটাও যেমন বীভৎস, লোভের চেহারাও সেই রকম। রজত বুঝতে পারলেন না, তিনি কোন দিকটা সমর্থন করবেন।
যাই হোক, রজত ভাবলেন, তিনি তো আর বিচারক নন। সকলে সমান বিচারের সুযোগ পায় কিনা, তাঁর কাজ শুধু তাই দেখা। মির্জা ইসমাইলের কাছে তিনি পুরো ঘটনার বিবরণ শুনলেন, কোনও মন্তব্য করলেন না। মির্জা ইসমাইলের বক্তব্য, তার বাড়িতে মাত্র এক টিন কেরোসিন ছিল নিজের ব্যবহারের জন্য। হরিহর লস্করই তার বিরুদ্ধে লোকদের উসকে দিয়েছে, কারণ মির্জা ইসমাইল এবার পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট হবার জন্য মনস্থ করেছিল। তা ছাড়া গতমাসে সে নতুন খালটায় মাছ ধরার ইজারা নিলামে ডেকে নিয়েছিল লস্করের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে। সেই রেষারেষিতে—
অপরপক্ষে গ্রামের কিছু লোক জানাল, তারা যদিও দুর্ঘটনার সময় ধারে-কাছেও ছিল না, কিন্তু একথা ঠিক, মির্জার বাড়িতে আড়াইশো-তিনশো টিন কেরোসিন জমা ছিল। অনেকেই লরি থেকে মাল খালাস করতে দেখেছে। বর্ধিষ্ণু লোকদের সে বেশি দামে বিক্রি করছিল, গরিব লোকদের এক ফোঁটাও দেয়নি। ওই হরিহর লস্করকেই তো সে কদিন আগে বিক্রি করেছে দু’টিন।
এসব শুনে রজতের ক্লান্তি আরও বেড়ে যায়। নিজের মনকে তিনি বারবার বোঝাতে চান, আমি তো আর বিচারক নই। আমার কাজ শুধু দু’পক্ষেরই বক্তব্য শুনে রিপোর্ট করা। বাজার অঞ্চল ঘুরলেন, কিছু কিছু লোকের সঙ্গে দেখা করলেন। যা জানতে পারলেন, তার জন্য তাঁকে এখানে না এলেও চলত। সেই পুরনো কাহিনী—জিনিসপত্রের যখন অনটন, তখন যাদের বেশি টাকা তারাই শুধু পাবে, যাদের টাকা নেই তারা পাবে না। এই তো পুরনো নিয়ম—সব জায়গাতেই এক রকম। নতুন যে-টুকু তা ওই আগুন ধরানো কিংবা লুটপাটের চেষ্টা, এখানেই রজতের দায়িত্ব। তিনি লুটপাট থামাবেন এবং লুটপাটকারীদের শাস্তি দেবেন। শাস্তি দেওয়া তাঁর পক্ষে তবু সহজ, কিন্তু থামানো?
ঘুরে এসে থানার বাইরে টেবিল পেতে বসে রজত চা খাচ্ছিলেন। এই সময় কমুনিস্ট পার্টির ছোটখাটো একটি শোভাযাত্রা এসে পৌঁছোল। খানিকক্ষণ কিছু দূরে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্লোগান দেবার পর, দু-একজন এল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাদের দাবি মজুতদারের শাস্তি চাই, পুলিশি জুলুম চলবে না, চাল চাই—কেরোসিন চাই। ক্লান্তি গোপন করে রজত উঠে দাঁড়িয়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে হাসি মুখে তাদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। অবিলম্বে অবস্থা আয়ত্তে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেললেন। রজত বললেন, বিকেলবেলা থানার সামনে একটি মিটিং-এর আয়োজন করেছেন তিনি। এই শোভাযাত্রাকারীরাও যেন তাতে যোগ দেয়। সকলের সহযোগিতা ছাড়া তো এখন দেশের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।
বিকেলবেলার মিটিং-এ লোক মন্দ হল না, শ’ খানেক তো বটেই। সেখানে রজত বেশ আবেগের সঙ্গে একটি বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। বললেন, দেশের এখন দুর্দিন, খাদ্যদ্রব্যের জন্য বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কেরোসিনও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এই অবস্থায় যখন যা পাওয়া যায়, সবাইকে সমান ভাবে ভাগ করে নিতে হবে। যে-সব ব্যবসায়ী অতিরিক্ত লাভের লোভ করছেন, তাঁরা দেশের শত্রু। দেশের এ দুর্দিনে তাঁদের সুমতি হওয়া উচিত, তাঁরা অসৎ পথ ত্যাগ করুন। আর, অন্যদের প্রতি অনুরোধ, তাঁরাও যেন সামান্য কারণে আইন শৃঙ্খলা লঙ্ঘন না করেন, তা হলে দেশের আরও ক্ষতি হবে। বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে দেশের কোনও উন্নতি হতে পারে না।
শহুরে লোকের চেয়ে গ্রামের মানুষ বক্তৃতা বেশি মন দিয়ে শোনে। রজতের বক্তৃতার মধ্যে কেউ কোনও বাধা দেয়নি, কেউ নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কথা পর্যন্ত বলেনি। রজতের শুদ্ধ ও নির্ভুল বাংলা তারা মন দিয়ে শুনছিল। বক্তৃতা শেষ হবার পর, পিছনের সারি থেকে শুধু কে যেন বলল, তা তো হল স্যার, কিন্তু আমাদের কেরোসিনের কী হবে?
রজত বললেন, আমি কলকাতায় যাচ্ছি কেরোসিনের তদ্বির করতে। তার মধ্যে, এখানে যদি কারওর কাছে কেরোসিন এখনও মজুত থাকে, ন্যায্য দামে সকলের মধ্যে বিলি করে দিন।
হরিহর লস্কর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এ গাঁয়ে আর একছিটে তেল নেই। আপনি তেলের ব্যবস্থা করুন।
এখন হরিহর লস্করের কণ্ঠস্বর অন্য রকম। যেন সে এ গ্রামের নেতা হিসেবে এখন কথা বলছে। কোনও দারোগা বা হাকিমকে সে গ্রাহ্য করে না। রজত তার দিকে শান্ত চোখে চাইলেন। মনে মনে ভাবলেন, কী ভাগ্যিস, ওই লোকটির বাড়ির খাবার তিনি স্পর্শ করেননি। তার কথার উত্তরে বললেন, কেরোসিন তেল দেবার মালিক আমি নই। আমার দায়িত্ব সবাই ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা তাই দেখা। আমি কলকাতায় যাচ্ছি তেলের সাপ্লাই কেন বন্ধ হল তাই দেখতে। এর মধ্যে, আমি সঙ্গে কিছু মোমবাতি এনেছি, তাই দিয়ে কিছুটা কাজ চালান।
মোমবাতিতে কী হবে?
মোমবাতিতে যতটুকু হবার তাই-ই হবে। এর বেশি কিছু করার সাধ্য আমার এখন নেই।
থানার জমাদার মোমবাতিগুলো বিলি করল। নিতে কারও আপত্তি দেখা গেল না। মোমবাতিগুলো শেষ হবার পর দেখা গেল, অদূরে কিছু যুবক হাসাহাসি করছে। একজন বলল, মোমবাতি পেয়েছিস, লে, লে, আর ভাবনা কী? আয়, আজ রাত্রিতে জলসা করি।
আরেকজন বলল, এইটুকুন বাতিতে কী হবে মাইরি? তার চেয়ে চল, এগুলো নিয়ে মির্জা ইসমাইলের বাপের কবরে বাতি জ্বেলে আসি!
আবার সকলের হো-হো হাস্য। আরেকজন বলল, না-না, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যাবে, রাস্তায় বাতি ধরবে কে? আয় শালা, আমরা রাস্তায় মশাল ধরে দাঁড়াই!
দারোগা সুখেন্দু হালদার রজতের চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। রজত মুখ নিচু করলেন। মানুষের কাছ থেকে সম্ভ্রম ও ভয় দেখতে পাওয়াই তার অভ্যেস হয়ে গেছে। অথচ এখানে এই সামান্য একটা গ্রামের ছেলে-ছোকরারা প্রায় তাঁর নাকের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে অপমান করছে। অপমানে রজতের নাকের ডগাটা কাঁপছে। মোমবাতি তিনি নিজের টাকায় কিনে এনেছিলেন। ভেবেছিলেন, সামান্য এই উপহারটুকু পেয়ে গ্রামবাসীরা খুশি হবে। তাকিয়ে দেখলেন, যুবকেরা সেই মোমবাতিগুলো নিয়ে লোফালুফি করছে, আর কিছু লোক তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। এদের খুশির ধরন আজকাল বদলে গেছে।
হঠাৎ রজতের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে রজত বললেন, আপনারা থানার কম্পাউন্ড খালি করে দিন। যান চলে যান। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি এ জায়গা খালি দেখতে চাই!