দুই
এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা, রজতের জিপ বার বার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। মালতী একটা চড়া হলুদ রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। হাওয়ার উড়ছে শাড়ির আঁচল আর চুল। অনেক দিন বাদে মালতীর মুখ সম্পূর্ণ উজ্জ্বল, কোথাও রোগের ক্লিষ্টতা নেই। তাকে দেখলে মনে হয়, সে আবার সম্পূর্ণভাবে বেঁচে উঠছে। সে গত সাতদিন কোনও ওষুধ খায়নি। গত চারবছরের মধ্যে এই প্রথম সাত দিন।
রজত জিজ্ঞেস করলেন, তোমার লাগছে না তো? গাড়িটা এমন লাফাচ্ছে।
মালতী উৎফুল্ল গলায় বলল, না, একটুও না। বেশ মনে হচ্ছে, একই সঙ্গে ঘোড়ায় চাপা আর গাড়ি চড়া দুটোই হয়ে যাচ্ছে।
তোমারই তো শখ মাঠের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঘোরা!
তা ছাড়া আর ফাঁকা কোথায়? বড় রাস্তায় তো অনবরত গাড়ি যাচ্ছে। খুব ভালো লাগছে, কিন্তু, ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে গান গাই। মাঠের মধ্যে কে আর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বউ-এর পাগলামি দেখতে আসছে।
তা গাও না। অনেকদিন তোমার গান শুনিনি।
কোন গানটা গাইব?
যেটা তোমার ইচ্ছে।
মালতী গুনগুন করে গানের সুর মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। মাঝে মাঝে উঁহুঁ, এটা মনে নেই। কী যেন দ্বিতীয় লাইনের কথাটা?
ঝকঝক করছে রোদ, অথচ গরম লাগছে না। ধান কাটা হয়ে গেছে, যতদূর দেখা যায় রুক্ষ মাঠ। রজত একটা দিশি আমড়া গাছের নীচে গাড়ি থামালেন। গাছটায় একটাও পাতা নেই, কিন্তু সব কটা ডালের ডগায় থোকা থোকা সাদা ফুল ফুটে আছে। রজত বললেন, সেই গানটা গাও, ‘চির সখা হে, ছেড়ো না!’
মালতী মুখ তুলে মৃদু হেসে লজ্জিতভাবে বলল, তোমার মনে আছে?
পুরীর সমুদ্র পাড়ে বসে এই গানটা গাইতে গাইতে মালতী কেঁদে ফেলেছিল। বিয়ের ঠিক একমাস পর, বাড়ি থেকে মালতীকে নিয়ে পালিয়ে আসবার ঠিক একমাস পর। সেই থেকে এ গানটা রজতের খুব প্রিয়। মালতী শুরু করেছিল, রজত বললেন, অত আস্তে কেন, গলা ছেড়ে গাও না!
যাঃ! লজ্জা করছে! কত দিন অভ্যেস নেই।
সত্যি, লজ্জা পেলে তোমায় এত সুন্দর দেখায়?
তৎক্ষণাৎ ঠোঁট-লোভী হয়ে রজত মালতীকে আঁকড়ে ধরার জন্য হাত বাড়ালেন। কী আছে ওই দুটি পাতলা ঠোঁটে, বার বার স্পর্শ করেও তৃপ্তি হয় না। ওই তন্বী দুর্বল শরীরখানি বুকে জড়িয়ে ধরলেই বুক ভরে যায়। মালতীর ঠোঁট দুটি সব সময় ভিজে ভিজে। হলুদ চকচকে শাড়ি পরেছে আজ, এই হলুদ রোদের নীচে ওর সমস্ত শরীরটাকেই মনে হয় জ্বলন্ত শিখার মতন।
মালতী ত্রস্তে সরে গিয়ে বলল, একী, একী শুরু করলে লোকজনের সামনে।
রজত ওকে মুক্ত না করেই বললেন, এখানে আবার লোকজন কোথায়? শুধু তো গাছ কয়েকটা।
তবু কোথা থেকে কে দেখে ফেলবে।
দেখুক। আমি এখানকার সম্রাট, আমি যা খুশি তাই করতে পারি এখানে।
কিন্তু সম্রাট, আপনি যা খুশি করতে পারেন বটে, কিন্তু এই রকম ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকলে এই বাঁদির পক্ষে তো গান করা সম্ভব নয়!
হাসতে হাসতে দুজনে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মালতী বলল, তুমি বরং আমায় এই গাছের কয়েকটা ফুল পেড়ে দাও।
রজত ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ ফুলগুলো ছিঁড়ে নষ্ট করব? এ ফুল থেকেই তো পরে ফল হবে।
ফুল মাথায় গোঁজা মানে নষ্ট করা নাকি?
এগুলো আমড়া ফুল। আমড়া ফুল কেউ কখনও খোঁপায় গোঁজে, তাও অবশ্য আমি কখনও শুনিনি।
না শুনলেই বা। যে ফুলই হোক, দেখতে সুন্দর হলেই হল।
মেয়েদের খোঁপায় সবচেয়ে ভালো মানায় বন তুলসীর ফুল। সে ফুল আর অন্য কোনও কাজেই লাগে না!
তুমি এই ফুলগুলো পাড়তে পারবে না, তাই বলো। বন তুলসী আর এখানে কোথায় পাচ্ছি?
সত্যি, যে গাছের ফল হয়, সে গাছগুলো সাধারণত একটু চালাক হয়। নীচের দিকে কোনও ডাল থাকে না। রজতের পক্ষে হাত বাড়িয়ে সে ফুল পাড়া শক্ত। রজত তবু হার না মেনে, গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে এলেন একেবারে গাছটার গুঁড়ির কাছে। তারপর গাড়ির ওপর উঠে দাঁড়িয়ে অনায়াসে একগুচ্ছ ফুল পেড়ে নিলেন। লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বললেন, আমি ভুল বলেছিলাম। আমি সম্রাট নই, আমি তোমার মালঞ্চের মালাকর!
গাড়ি আবার পিচের রাস্তায়। রজত বললেন, চলো, কাকদ্বীপের ডাকবাংলো পর্যন্ত ঘুরে আসি। ওখানকার এস-ডি-ও চা খাওয়াবেন নিশ্চয়ই।
কিন্তু সে যে অনেক দূর।
গাড়িতে আর কতক্ষণ? রজত চওড়া কবজিতে স্টিয়ারিং ধরে আছেন। মালতী তখন চুপ করে আছে। কিন্তু মনে মনে যে তখন সেই গানটা গেয়ে চলেছে বোঝা যায়, চির সখা হে, ছেড়ো না।
ডাকবাংলোর সামনে জেলেরা মাছ বিক্রি করছে। চকচকে ভেটকি মাছ, আর বিরাট বিরাট গলদা চিংড়ি। মাছ দেখে মালতী খুশি হয়ে ছুটে গেল। মাছ কত করে? সাড়ে তিন টাকা? কেন, আড়াই টাকা হবে না?
দু’রকম মাছই অনেকগুলো কিনে ফেলল মালতী। রজত পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। দরদাম করে আট আনা, চার আনা কমাতে পেরে শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠল মালতী। বলল, দ্যাখো, কত সস্তা? …যদিও বুঝতে পারেনি যে, আসলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বউকে চিনতে পেরেই জেলেরা ইচ্ছে করে দাম কমাচ্ছে। যার কাছ থেকে মাছ কেনা হচ্ছে, সে-ই ধন্য হয়ে যাচ্ছে।
এস-ডি-ও’র বাড়ি আর যাওয়া হল না। মাছ যখন কেনা হল, তখন তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে এগুলোর রান্নার ব্যবস্থা করা দরকার। ডাকবাংলোর বারান্দাতেই বসে রজত চট করে দু’পেয়ালা চা আনিয়ে নিলেন। ওদের দেখার জন্য একটু দূরে একটা ছোটখাটো ভিড় জমে গেল। ভিড়ের মধ্যে কী নিয়ে যেন ফিসফাস। সে দিকে একপলক তাকিয়ে রজত বললেন, এই রে, এখানে না বসলেই ভালো হত। এখুনি হাজার গণ্ডা নালিশ শুরু হবে।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি যুবতী জেলেনি সত্যিই ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। গাছকোমর করে শাড়ি পরা। মেয়েটির চেহারায় একটা তেজি ভাব আছে। সে বলল, হুজুর, মেতু আমার ওঁয়াকে মেরেছে, আপনি এর একটা বিহিত করুন।
মুহূর্তে রজতের মুখের চেহারাটা বদলে গেল। তোয়ালে দিয়ে মুখ থেকে হাসি মুছে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের জুতো দেখতে লাগলেন। মুখ না তুলেই গম্ভীরভাবে বললেন, কেন মেরেছে?
কী গমগমে, রাশভারী এখন রজতের গলার আওয়াজ। মালতী এ গলা কখনও শোনেনি। অবাক হয়ে মালতী একপলক রজতের দিকে তাকিয়ে আবার জেলেনিকে দেখল। গড়া-পেটা শক্ত শরীর মেয়েটার। একটু বেশি লোক দেখানো, কপালের বাঁদিকে একটা পুরনো ক্ষত, এ ছাড়া মেয়েটার চেহারায় কোনও খুঁত নেই বলা যায়।
জেলেনি বলল, ও লোকটা গুন্ডো, আপনি পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করুন! যখুন তখুন হেথা হোথা লোককে মারছে, আপনি পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করুন। আমার ওঁয়াকে মেরে মাথা ফাট্টে দিইচে।
এমনি এমনি মারল?
পউশু দিন বাজার-হাট থেকে ফিরছিলুম সনঝেবেলা, ওই মেতুটা মদ খেয়েসে হামলা করছিল তখুন, আপনি পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করুন। উনি যেই বারণ করতে গেলেন, ওই গুন্ডোটা ডান্ডা দিয়ে—
মেতু কোথায়—
ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন শোনা গেল সাহেব মেতুকে ডাকছেন, সাহেব মেতুকে ডাকছেন। এই মেতু আশ্চর্য, মেতুর নামে অভিযোগ, সে কিন্তু কাছাকাছিই ছিল। আস্তে আস্তে সে ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়াল। শক্ত-সমর্থ জোয়ান, পাঞ্জাবিদের ধরনে হাতে একটা লোহার বালা পরেছে। ওদের সামনে এসে, সে একবার কটমট করে জেলেনির দিকে তাকাল। জেলেনি ভ্রূভঙ্গি করে মুখ ফেরাল অন্যদিকে লোকটা নমস্কার করল সাহেবকে।
রজত লোকটির আপাদমস্তক দেখলেন একবার, তারপর কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, নাম কি তোর?
মিতুঞ্জয় বাড়ুরি, হুজুর।
কী কাজ করিস?
ইঁটখোলায় কাজ করি, হুজুর।
তারপর আচমকা খুব খেলাচ্ছলে রজত জিজ্ঞেস করলেন, জেলে যেতে চাস?
লোকটা স্পষ্টই কেঁপে উঠল। তৎক্ষণাৎ হাতজোড় করে বলল, না সাহেব, আমি কোনও দোষ করিনি।
ওর স্বামীকে মেরেছিস কেন?
না হুজুর, মারিনি।
জেলেনি ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, হ্যাঁ হুজুর, আলবাত মেরেছে, পাঁচজনা সাক্ষী আছে, মেরে মাথা ফাট্টে দিয়েচে।
রজত আবার কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কেন, মেরেছিস কেন?
ও লোকটার মুখ খারাপ, আমার বাপ-মা তুল্লে—
রজত প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, বেশ করেছে তুলেছে। খুব গুন্ডা হয়েছিস না? জেলে যেতে চাস?
না হুজুর। আর কখনও করব না।
নাকখত দে।
অতবড় জোয়ান লোকটা টিপ করে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর সারা বারান্দায় নাক ঘষতে ঘষতে একেবারে চলে এল মালতীর পায়ের কাছে। মাটিতেই মুখ রেখে বলতে লাগল, মেমসাহেব, আমায় জেলে পাঠাবেন না, আমি আর করব না, আমায়—
মালতী এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। লোকটার মাথাটা একেবারে নিজের পায়ের কাছ দেখে, চমকে পা সরিয়ে নিয়ে বলল, একী, একী! থাক, থাক, আরে—
রজত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আর যদি কখনও শুনি—। মাছগুলো আমার গাড়িতে তুলে দে।
গাড়ি আবার মেটাল রোডে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে বলে গাড়িতে উঠেই রজত বেশি স্পিড দিয়েছেন। মালতী বলল এ কী রকম বিচার হল? তুমি মেয়েটার সব কথা বিশ্বাস করলে। কোনও প্রমাণ নিলে না?
রজত হাসতে লাগলেন। গলার আওয়াজ আবার বদলে কোমল হয়ে গেছে। বললেন, দোষ ওদের সবারই আছে কিছু না কিছু। একজনকে শুধু শাস্তি দিয়ে ভয় দেখানো। মেয়েটার বদলে পুরুষকে শাস্তি দেওয়াই ভালো না?
মালতী সামান্য হেসে বলল, সত্যিই, তুমি দেখছি এখানকার সম্রাট! এই রকম জোয়ান লোকটা তোমার এক ধমকে ঢিপ করে মাটিতে পড়ে নাকখত দিতে লাগল! আমি কখনও এর আগে কোনও লোকের নাকখত দেওয়া দেখিনি! বিচ্ছিরি লাগছিল।
রজত গুরুত্বপূর্ণভাবে বললেন, সত্যিই আশ্চর্য এই জাত, একটুও ইয়ে নেই।
জাত আবার কী? ওরা, আমরা আলাদা নাকি! একই তো—
রজত ঘাড় ফিরিয়ে মালতীর দিকে তাকালেন। বেশ কিছু সময় চেয়ে থেকে খুশিতে তাঁর মুখ ভরে গেল। বললেন, ঠিকই বলেছ, ওরা আমরা একই। কিন্তু তবু মনে হয় কত আলাদা, না? ওদের কাছে আমাদের মনে হয় বিদেশি, সব কিছুর এত তফাত, তাই না? অন্য কোনও দেশে, মানুষে মানুষে এত তফাত নেই! ওরা আমাদের আপনি বলবে, আমরা ওদের তুই বলব, এইটাই নিয়ম হয়ে গেছে।
আজ প্রথম তোমার হাকিমি দেখলুম। বাবাঃ, কী রাশভারি হয়ে যাও তখন!
শেষ বিচার তো তুমিই করলে। তোমার কাছেই তো লোকটা রায় চাইল।
যাঃ!
তা বলে লোকগুলোকে কিন্তু বোকা ভেবো না। ওদের মধ্যে আসল ব্যাপারটা কী হয়ে গেল জান তো? এসব আমি এত দেখেছি! ওই জেলেনিটার সঙ্গে ওই ছোঁড়াটার আসলে বেশ ভাব। বোধহয় একটু বেশিই ঘনিষ্ঠতা আছে, তাই নিয়েই ওর স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া। কিন্তু প্রকাশ্যে ছেলেটাকে শাস্তি দিইয়ে ওদের সমাজের মুখ বন্ধ করা হয়ে গেল। প্রমাণ করাও হল, দুজনের মধ্যে কোনও ভাব নেই। আমি স্পষ্ট দেখেছি, ছেলেটাকে নাকখত দিতে জেলেনিটাই চোখ দিয়ে ইশারা করছে।
যাঃ! সত্যি।
ওদের ভাবভঙ্গি দেখলেই বুঝতে পারি। সাত বছর সার্ভিস হয়ে গেল। আরে, তোমার খোঁপা থেকে ফুলগুলো পড়ল কখন?
ওমা, তাই নাকি?
চেক-পোস্টে গাড়ি দাঁড় করাতে হল। রজতকে দেখে রক্ষীরা সেলাম জানিয়ে দ্রুত পথ ছেড়ে দিল। তার একটু পরেই রাস্তার দু’দিকে দুটো ভারী ট্রাক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পথ জুড়ে ঝগড়া করছে। রজত খুব জোরে হর্ন বাজাতে লাগালেন। দুই ট্রাকের ড্রাইভার ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে রজতকে চিনতে পারল। তারপর কী এক জাদুবলে সেই মুহূর্তে তাদের ঝগড়া মিটে গেল, তখনই স্টার্ট নিয়ে দুটো ট্রাকই উধাও হয়ে গেল দু’দিকে। রজত গাড়ির স্পিড তুললেন ষাট মাইল, সত্তর মাইল। একবার শুধু বললেন, তোমার ভয় করছে না তো?
মালতী বলল, উঁহু, আমার এরকমই ভালো লাগে। এবার রজত নিজেই গুনগুন করে কী একটি গান গাইতে লাগলেন।
রোগা, লম্বা মতন একজন লোক আসছিল উলটো দিক থেকে, ছাতায় মুখ ঢাকা। গাড়িটা তাকে পেরিয়ে যাবার সময় রজত চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে, ওই তো অরুণ! খুব ঝুঁকি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলেন তিনি। গাড়িটা কেঁপে উঠল একবার। তারপর রজত গাড়িটা আবার ব্যাক করতে করতে বললেন, ওই অরুণ চ্যাটার্জি যাচ্ছে।
মালতীর পাশ দিয়েই অরুণ পার হয়ে গেছে, মালতী দেখতে পায়নি। কী জানি, হয়তো মালতী তখন মনোযোগ দিয়ে দূরের কোনও জিনিস দেখছিল। চোখে যতদূর দেখা যায়, তার থেকেও দূরের কোনও জিনিস। রজত বাইরে মাথা ঝুঁকিয়ে ডাকলেন, অরুণবাবু, অরুণবাবু!
লম্বা লোকটা থেমে গিয়ে পিছন ফিরে চাইল। তারপর সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। রজত গাড়িটা আরও খানিকটা ব্যাক করে এনে বললেন, কী খবর? সেদিন বাড়িতে আসতে বললুম, একদিনও তো এলেন না এর মধ্যে?
অরুণ স্মিত হেসে বলল, হ্যাঁ ভাবছিলুম, যাব এক দিন।
আমার স্ত্রীকে চিনতে পেরেছেন তো? চেহারা অবশ্য অনেক বদলে গেছে, আগের থেকে অনেক ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে।
হ্যাঁ, বদলে তো অনেক গেছেই। কুমারী চেহারা আর বিবাহিতা চেহারার এমনিতেই অনেক তফাত। সিঁথির মাঝখানে ওই যে লাল সিঁদুরের রেখা, ওতেই মুখের রূপ আলাদা রকম হয়ে যায়। কুমারী জীবনের চেয়ে বিবাহিতা জীবনে চোখের পাতা একটু দেরি করে পড়ে। শরীরের মধ্যে কোনও ছটফটানি নেই, বসে থাকার ভঙ্গি কী রকম শান্ত! মালতী এখন আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করছে।
অরুণ মালতীর দিকে একবার তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। তারপর কপালের কাছে হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে বলল, আপনি এখন ভালো আছেন?
মালতী অন্যমনস্কভাবে নমস্কার করে উত্তর দিল, হ্যাঁ, আপনিও ভালো তো?
রজত অরুণকে বললেন, কোথায় যাচ্ছিলেন এদিকে? আসুন না আমাদের সঙ্গে, টাটকা মাছ কিনেছি—দুপুরে আমাদের সঙ্গেই খেয়ে নেবেন।
না, আজ থাক। আর একদিন যাব, আজ আমার একটু কাজ আছে।
আজ রবিবার, আজ তো ইস্কুল নেই! কাজ অন্য দিন করবেন।
না, মানে, আজ আমার একটা নেমন্তন্ন আছে।
রজত হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, পারলেন না! এক্সপ্রেশান একদম ঠিক হল না। আপনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নেমন্তন্নের কথাটা এইমাত্র বানিয়ে বললেন। আসুন, আসুন! মিলু, তুমি একটু বলো না!
হ্যাঁ, আসুন না, আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না।
যাঃ, এইভাবে কেউ বলে? অসুবিধে কীসের? অরুণবাবু এলে আমরা খুশিই হব। রবিবারের দুপুরে একটু আড্ডাও দেওয়া যাবে।
মালতী এবার অরুণের দিকে সম্পূর্ণ তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আসুন, আপনি এলে আমরা খুশি হব।
রজত বললেন, উঠে পড়ুন।
জিপে রজত ও মালতীর পাশে অল্প একটু জায়গা। ওখানে বসলে মালতীর সঙ্গে খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে হয়। আর পিছনের সিটে যেতে হলেও যেতে হয় ওদের ডিঙিয়ে। অরুণ দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল, মালতী নিজেই পিছনে চলে গিয়ে বলল, আপনি সামনে বসুন।
গাড়ি আবার স্টার্ট দিয়ে রজত বললেন, আজকের ওয়েদারটা চমৎকার, না? এ পারফেক্ট পিকনিক ডে!
অরুণ জানাল, হ্যাঁ, আজকের দিনটা ভারী সুন্দর।
আপনার কেমন লাগছে এখানে থাকতে? শহর ছেড়ে থাকতে আপনাদের বোধহয় লোনলি লাগে? না?
না! বেশিদূর তো নয়, কলকাতা থেকে বন্ধুরা প্রায়ই আসে। তা ছাড়া আমি অনেকদিন কলকাতা ছাড়া, বছর চারেক ছিলুম আসামে, গৌহাটিতে। তারপর এখানে চাকরিটা পেলাম।
আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আমার এখানেই পোস্টিং হয়ে গেল তিনবছর। আমরা এখানে ঠিক কবে এসেছি, মিলু?
মালতী বোধহয় ওদের কথাবার্তা শুনছিল না, তাই রজতের প্রশ্ন শুনতে পায়নি। সে কোনও উত্তর দিল না। রজত ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা ঠিক কবে এসেছি, মিলু?
মালতী সচকিত হয়ে বলল, এখানে? তেষট্টি সালের মার্চ মাসে।
হ্যাঁ। ডাক্তার বলেছিলেন, ওকে সমুদ্রের পারে কোথাও রাখতে। তা, এখানে গঙ্গাও তো হাফ সমুদ্র, কি বলুন? আমার সমুদ্রের চেয়ে গঙ্গা দেখতেই বেশি ভালো লাগে।
অরুণ এ-কথার উত্তরে ঠিক কী বলতে হবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। যেন নদী আর সমুদ্র এ দুটোর মধ্যে কোনটা দেখতে ভালো, এ সম্পর্কে সে কোনওদিনই ভেবে দ্যাখেনি।
প্রসঙ্গ বদলে রজত হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আপনি ছাতা নিয়ে বেরিয়েছেন কেন? এই শীতের সময়ও বৃষ্টির ভয় করেন নাকি?
না, মানে, রোদ….
এই রোদ তো গায়ে লাগলে ভালো লাগে। রোদের জন্য ছাতা লাগে?
পিছনের সিটে মালতির খুসখুসে হাসির আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল। সেই হাসি শুনে উৎসাহিত হয়ে রজত বললেন, সত্যি, শীতকালে ছাতা নিয়ে বেরোনো অদ্ভুত, না? না কি, অধ্যাপক হলে ছাতা নিতেই হবে? ছাতা আর কাঁধে চাদর—শীত গ্রীষ্ম সব সময়!
অরুণ এবার উত্তর দিল, চোখে রোদ লাগলে আমার অসুবিধে হয়। আমার অনেক দিন থেকেই চোখের অসুখ।
আপনি চশমা পরেন না কেন?
আমার দৃষ্টিশক্তি খারাপ নয়, আমার চোখের অসুখ…..
সান-গ্লাস পরলেও কাজ হয় না?
মালতী পিছন থেকে বলল, ছাতার চেয়ে সান-গ্লাসই ভালো।
অরুণ মুখ ফেরাল না, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল যেন….যেন কোনও একটা উত্তর তার তৈরি ছিল, কিন্তু সে-কথা না বলে, সাধারণ ভাবে বলল, এই চলে যাচ্ছে যখন। আপনার গাড়ি চালানোর হাত কিন্তু খুব সুন্দর।
হ্যাঁ, ছেলেবেলা থেকেই কাকার গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে হাত রপ্ত করেছি।
বাড়িতে পৌঁছোতে বেশি দেরি হল না। রজত অরুণকে নিয়ে এলেন সোজা দোতলায় বসবার ঘরে। মালতী দোতলা পর্যন্ত না এসেই চলে গেল রান্নাঘরে। রজত জামা খুলতে খুলতে বললেন, আগে স্নানটা সেরে আসি। যা ধুলো! আপনিও স্নান করবেন তো?
না, আমি স্নান করেই বেরিয়েছি।
আচ্ছা, তা হলে ঘুরে আসি? আমি আবার স্নান না করে বেশিক্ষণ থাকতেই পারি না। বসে একটু বই-পত্র দেখুন। আমি বরং মালতীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি গল্প-টল্প করবে!
অরুণ খুব সংকুচিত হয়ে বলল, না, না, কোনও অসুবিধে হবে না। আমি বই-টই দেখছি।
ঘরের পাশের বাথরুমে না গিয়ে রজত তোয়ালে কাঁধে নীচে নেমে এলেন, এসে ঢুকলেন রান্নাঘরে। মালতী ততক্ষণ তদারকি শুরু করে দিয়েছে। রজত বললেন, তুমি অমনি রান্না নিয়ে মেতে উঠলে? ভদ্রলোক একা বসে রইলেন, একটু গিয়ে গল্প-টল্প করো না! আমি ঝপ করে পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আসি।
কেন, পুকুরে কেন? লক্ষ্মণকে বলছি বাথরুমে জল দিতে।
না, এত ধুলো মেখেছি গায়, পুকুরে ডুব দিতেই ভালো লাগবে। তুমি ওর সঙ্গে এত আড়ষ্ট ব্যবহার করছ কেন?
চিংড়িমাছগুলো ভাজা হবে, না মালাইকারি করব?
আবার কথা এড়িয়ে যাচ্ছ? ওকী, মুখ লাল হয়ে উঠল কেন? সত্যিই একটু সহজ ভাবে কথা বললেই ভদ্রলোক খুশি হতে পারেন। তোমার উচিত ওকে একটু খুশি করা।
যাও, পাগলামি কোরো না!
মিলু, তুমি আর অরুণ কিন্তু আগে দুজনে দু’জনকে তুমি বলে ডাকতে। এখন আপনি বলছ কেন?
তাই নাকি? তুমি বলতুম? মনে নেই তো!
আমার কিন্তু সব মনে আছে।
অত বেশি মনে থাকা ভালো নয়। তোমার কী হয়েছে?
তুমি ব্যাপারটাকে এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছ কেন? তোমার ভয় নেই খুকুমণি, একটা কুটিল সন্দেহপ্রবণ স্বামী তোমার ঘাড়ে চাপেনি। বুঝলে?
আঃ, তুমি এমন ছেলেমানুষি কর! বাইরের লোকের সামনে ওরকম গম্ভীর সেজে থাক কী করে, বুঝতে পারি না!
ভদ্রলোককে বাড়িতে ডেকে এনে একা বসিয়ে রাখা খারাপ দেখাচ্ছে।
থাকুক একা বসে।
তুমি একটু গিয়ে গল্প করো।
কী গল্প করব? আমার লজ্জা করছে।
একটু যাও না, আমি এক্ষুনি আসছি।
অরুণ ঘুরে ঘুরে আলমারির বই দেখছে। বই খুব কম নয়। অধিকাংশই রাজনীতি আর ইতিহাসের বই। গল্প-কবিতা খুব কম। রজতের বই পড়ার সময় আছে কিনা কে জানে? তবে, মালতী এক সময় বই পড়তে খুব ভালোবাসত। অরুণের কাছ থেকে প্রায়ই বই চেয়ে নিত। বি.এ. পাশ করার পর মালতী ঠিক করেছিল ফিলসফিতে এম.এ পরীক্ষা দেবে, সেই সময় অসুখ হয়। কে জানে, তারপর আর প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়েছে কিনা? অরুণ সন্ধানী চোখে প্রতিটি বইয়ের নাম পড়ার চেষ্টা করে। না, আধুনিক সাহিত্যের বই-টই বেশি নেই। অরুণ অবশ্য আশাও করেনি, তার লেখা কোনও বই এখানে থাকবে। দুটোই তো মাত্র বই বেরিয়েছে তার—ক’জনই বা পড়েছে। কিন্তু ওই তো আছে! অরুণের প্রথম কবিতার বইটা আলমারির এক কোণে জ্বলজ্বল করছে যেন। অরুণ সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। গা ছমছম করতে লাগল তার। পরের বাড়িতে হঠাৎ নিজের লেখা বই দেখলে এই রকমই হয়। রজতই বইটা কিনে এনেছে? ইচ্ছে হল, একবার আলমারি খুলে বইটা নিজের হাতে নিয়ে দেখে। কিন্তু সে যেন চুরি করা হবে।
কী রকম দেখছেন?
অরুণ চমকে ঘুরে দাঁড়াল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মালতী। উনুনের কাছে ছিল, তাই মুখ লালচে। চুল এলো করা। অরুণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মালতীর দিকে, মালতীও চোখ ফেরায়নি। সেই ছেলেবেলার স্ট্যাচু খেলার মতন। পরস্পরকে ‘স্ট্যাচু’ বলে, পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ অনড় হয়ে তাকিয়ে থাকা। এই রকম বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে, হয় বার বার চোখের পলক ফেলতে হয়, অথবা চোখ জ্বালা করে জল এসে যায়। মালতীর চোখে কিন্তু হাসির আভাস। মালতী আবার বলল, কী রকম দেখছেন?
অরুণ মুখ নিচু করে চোখ ফিরিয়ে বলল, ভালো। আপনার স্বামী চমৎকার লোক।
আর এই আমার বাড়ি, আমার সংসার—এসব?
এসবও সুন্দর।
হ্যাঁ, সবই সুন্দর। তুমি ভালো আছ?
হ্যাঁ। মালতী, তুমি ভালো আছ? তুমি সুখী হয়েছ তো?
আমি ভালো আছি, আমি ভালো আছি। আর তুমি?
মালতী, আমিও ভালো আছি।
আচ্ছা, আপনি একটু বসুন। আমি রান্নার দিকটা একটু দেখে আসি।
মুহূর্তে ঘর আবার সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল। মালতী তো ঘরে ঢোকেইনি, দরজার ওদিকে দাঁড়িয়েছিল। তাতেই তখন মনে হচ্ছিল, ভর্তি হয়ে গেছে এ-ঘর। আবার ও চলে যেতেই ঘরটা একেবারে খালি। এই এক রহস্যময় ভর্তি আর খালি হওয়া।
বারান্দা পেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে নামতে লাগল মালতী। রান্নার দিকটা তাকে নিজেকে তদারকি করতে হবে, ঠাকুরটা আবার নষ্ট করে না ফেলে। তার এখন একটুও সময় নেই। সারা শরীরে তার এখন গরম লাগছে, ব্লাউজ-ব্রেসিয়ার ভিজে গেছে ঘামে, তবু উনুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তার ভালো লাগবে।
অরুণ তখন আলমারির কাছে দাঁড়িয়ে। দরজার দিকে তাকিয়ে মালতীর সঙ্গে কথা বলছিল, এখন আস্তে আস্তে চোখ ফেরাল। দেয়ালে একটি মাত্র ক্যালেন্ডার, উলটোদিকের দেয়ালে যামিনী রায়ের ছবি বাঁধানো, এ ছাড়া হালকা নীলরঙা পরিচ্ছন্ন দেয়াল। ভারী সুন্দর ছিমছাম ঘরখানি। অরুণ বইয়ের আলমারি খুলে দেখল না। অপরের বাড়ির আলমারি সে কেন খুলবে? সেখান থেকে সরে এসে, চেয়ারে বসে অরুণ একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা তুলে নিল।
চিংড়িমাছের মালাইকারির বাটিতে আঙুল ডুবিয়ে একটু চেখে দেখেই রজত চেঁচিয়ে উঠলেন, ইস এটা নিশ্চয়ই তোমার রান্না, মালতী?
মালতী লাজুক ভাবে হেসে বলল, কেন, খুব খারাপ হয়েছে বুঝি?
সে কথা হচ্ছে না! তুমি আবার রান্না করতে গেছ কেন? এতক্ষণ আগুনের আঁচ লাগানো মোটেই ভালো নয় তোমার!
আঃ! আবার ওই কথা! খেতে কী রকম হয়েছে বলো না। একদম ভালো হয়নি বুঝি?
সে-কথা আমি বলব কেন? অতিথিকে জিজ্ঞেস করো। কিন্তু তোমার হাতের রান্না আমি একটু মুখে দিলেই বুঝতে পারি। দেখি, হাত দেখি, তুমি মশলাও বেটেছ?
মালতী তাড়াতাড়ি ভিতু মেয়ের মতন হাতের মুঠো খুলে দেখাল। সাদা হাত। তবু ওর মুখ অন্যায় করে ধরা পড়ে যাওয়ার মতন। বলল, না, মশলা ঠাকুরই বেটেছে, আমি শুধু একটু নাড়াচড়া করেছি। কিন্তু কেমন হয়েছে, সে কথা একবারও বলছ না।
আমার কাছে তো অপূর্ব! কী অরুণবাবু, কেমন হয়েছে খেতে?
অরুণ নিঃশব্দে মুখ নিচু করে খাচ্ছিল। এবার সামান্য মুখ তুলে বলল, হ্যাঁ, বেশ ভালো। চমৎকার।
আপনি আগে মালতীর হাতের রান্না খেয়েছেন?
না।
মালতী বলল বিয়ের আগে আমি রাঁধতুমই না। এখানে ঠাকুরের কাছে রান্না শিখেছি। আমার মা অবশ্য খুব ভালো রাঁধতেন, কিন্তু আমাদের রাঁধতে দিতেন না। দু’একবার পিকনিকে গিয়েই যা রেঁধেছি, একবার সেই চম্পাহাটিতে—
এমনও হতে পারে, সেইসব পিকনিকে অরুণও হয়তো গিয়েছিল মালতীর সঙ্গে। তখন কি আর অরুণ মালতীর হাতের রান্না খায়নি? চম্পাহাটিতে মালতীদের একটা বাগানবাড়ি ছিল, শশাঙ্ক অরুণকে প্রায়ই সেখানে নিয়ে যেত। কিন্তু সে সব যেন কিছুই অরুণের মনে পড়ল না। অন্তত রান্নার ব্যাপারে তার কোনও উৎসাহও নেই দেখা গেল। সে হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে জিজ্ঞেস করল, শশাঙ্ক এখন কোথায় আছে?
প্রশ্নটা এমন ভাবে করা—রজত কিংবা মালতী যে-কোনও একজনকে উদ্দেশ্য করেই হতে পারে। অবশ্য, এ প্রশ্ন মালতীকেই জিজ্ঞেস করা উচিত, কেন না শশাঙ্ক মালতীর দাদা। একসময় অরুণের খুব বন্ধু ছিল। অরুণের সঙ্গেই কলেজে পড়ত শশাঙ্ক, তারপর রাজনীতি নিয়ে মেতে ওঠে। মাঝখানে কিছু দিন জেলও খেটেছে, সে-সময় মালতীর খুব অসুখ।
রজত বললেন, শশাঙ্ক? কী জানি, নাগপুরের দিকে চাকরি নিয়ে সেখানেই আছে যেন শুনেছিলাম। খবর রাখি না। আপনি বোধহয় জানেন না, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমাদের আর কোনও যোগাযোগ নেই।
অরুণের চোখে প্রশ্ন, কিন্তু মুখে শুধু বলল, ও!
রজত বোধহয় সেই প্রশ্নটা দেখতে পেলেন। তাই হাসতে হাসতে বললেন, আমাদের বিয়ের সময় তো শশাঙ্কবাবু জেলে। তারপর জেল থেকে ছাড়া পাবার পর একদিন আমাদের বাড়িতে এসে খুব রাগারাগি করেছিলেন।
কেন? রাগারাগি করেছিল কেন?
বাঃ, রাগ করবে না? আমি তখন আলিপুরে পোস্টেড, শশাঙ্কবাবুও তখন আলিপুর জেলে ছিলেন। আমি হচ্ছি শাসক সমাজের প্রতিনিধি, ম্যাজিস্ট্রেট—এখন জেল খেটে বেরিয়ে এসে বর্বর পুলিশ সমাজের একজন প্রতিনিধিকে নিজের ভগ্নীপতি হিসেবে কে দেখতে চায় বলুন? রাগ তো হবেই। তা ছাড়া আমাদের বিয়ের ধরনটাও ওঁর বোধহয় পছন্দ হয়নি। আপনি আমাদের বিয়ের ঘটনাটা জানেন?
অরুণ এবার চোখ তুলে রজতের দিকে তাকাল, কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে সংক্ষেপে শুধু বলল, না।
রজত মুখ খোলার আগেই মালতী বলল, থাক, ওসব এখন তোমায় বলতে হবে না!
রজত বললেন, কেন, বলি না? কী হয়েছে?
বাইরের লোককে ডেকে এনে বুঝি কেউ নিজের বিয়ের গল্প শোনায়?
আহা, আমাদের ব্যাপারটা যে অন্যরকম। আর অরুণবাবু আমাদের অনেককালের বন্ধু, বাইরের লোক কীসে? কী অরুণবাবু, আপনার শুনতে আপত্তি নেই তো?
না, না। বলুন না।
সে খুব রোমাঞ্চকর ঘটনা। এ নিয়ে আপনি একটা গল্পও লিখে ফেলতে পারেন। অনেকদিন একটানা অসুখে ভুগে মিলুর শরীর তখন খুব কাহিল। ডাক্তার বলছেন, কিছুদিন সমুদ্রের ধারে ঘুরে না এলে শরীরটাকে জোরালো করার কোনও উপায় নেই। ওদের সেই বিশ্রী গুমোট অন্ধকার ঘরে ও দিনদিন একেবারে নির্জীব হয়ে পড়ছিল। ওষুধ-পত্তর তখন কিছুই গায় লাগছে না। অথচ ওর বাড়ির লোকদের কথা তো জানেন, কেউ কিছু ব্যবস্থা করবে না। দাদা জেলে, বাবা পাগল, সৎ-মা হিংসুক। আমার এসব দেখে সহ্য হচ্ছিল না। একটা মেয়েকে ইচ্ছে করে মেরে ফেলা হচ্ছে! ক্রিমিনাল ব্যাপার! তারপর আমি মালতীর সঙ্গে একদিন কথা বলে ওর মত জানতে চাইলুম। মালতীও তখন ও-বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে বাঁচে। মাসের পর মাস খাটে শুয়ে আছে, একটা কথা বলার লোক নেই, সান্ত্বনা দেবারও মানুষ নেই—ভেবে দেখুন কী অবস্থা! একটা কিছু তখন না করলে সত্যিই হয়তো ওকে বাঁচানো যেত না। সুতরাং ওর মত জেনে নিশ্চিন্ত হবার পর, পুরীর ট্রেনে দু’খানা সিট রিজার্ভ করে এলুম। সেইসঙ্গে অন্য একটা ব্যবস্থাও করেছিলাম। একদিন খুব ভোরে, মালতী কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। আঃ, তখন যদি আপনি দেখতেন ওকে! রোগা, বিবর্ণ শরীর, যেন হাওয়ার ধাক্কায় পড়ে যাবে। কোনও রকমে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে, হাতে শুধু একটা ছোট্ট সুটকেস। কাছেই এক বন্ধুর সঙ্গে গাড়ি নিয়ে আমি অপেক্ষা করছিলুম। বিষম কাঁদছিল তখন ও। বার বার বাড়ির দিকে তাকিয়ে কাঁদছিল, আমি ওকে সোজা নিয়ে এলুম সেই বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধুর বউ ওকে সাজিয়ে দিল, আমরা গিয়ে রেজিস্ট্রারকে ডেকে আনলুম। আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়ে গেল, আর সেই রাত্রেই পুরী। সেই দিনটা ছিল এগারোই ফেব্রুয়ারি, তাই না?
কথা থামিয়ে রজত একটা হাত বাড়িয়ে মালতীর বাহু চেপে ধরলেন। মালতী এতক্ষণ চুপ করে আছে, আঙুল দিয়ে থালার ভাত নাড়াচাড়া করছিল শুধু। এখনও মুখ তুলে চাইল না। অরুণের খাওয়া শেষ, পাতিলেবুর টুকরোয় নুন মাখিয়ে জিভে চেপে ধরেছে। এখন তার সমস্ত মনোযোগ ওই লেবুর টুকরোটা থেকে সবটুকু রস টেনে বার করে নেবার দিকে। অরুণ নিজের হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে।
রজত গভীর তৃপ্তির সঙ্গে শ্বাস টেনে আবার বললেন, এখন ওর শরীর সম্পূর্ণ সেরে গেছে। অসুখের আগে ওর চেহারা কী রকম ছিল আমি অবশ্য দেখিনি। কিন্তু আগের স্বাস্থ্যই ফিরে এসেছে, কী বলেন?
স্বাস্থ্য ফিরে এসেছে কি না তা বলার জন্য তো সম্পূর্ণ শরীরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু স্বামীর সামনে স্ত্রীর দিকে পুরো চোখ মেলে তাকানো অসভ্যতা। তাই, অরুণও মালতীর দিকে না তাকিয়েই বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আগের চেয়েও ভালো হয়েছে মনে হয়।
এখন আর কোনও অসুবিধেই নেই। একমাত্র ওর সময় কাটানো নিয়ে হয়েছে মুশকিল। ও আবার অফিসারদের বউদের সঙ্গে মেশা পছন্দ করে না। আমারও অফিসের যা কাজ, কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। এক-একদিন ফিরতে আটটা-ন’টা বেজে যায়। মাঝে মাঝে আবার যেতে হয় ইন্সপেকশানে। আপনি আসবেন মাঝে মাঝে? তা হলে একসঙ্গে গল্প-টল্প করা যায়।
হ্যাঁ, সময় পেলে আসব মাঝে মাঝে।
সময়ের অভাব কী, এখানে তো সময় কাটানোই সমস্যা।
হ্যাঁ, আসব।
এক কাজ করলেও তো হয়। মালতীর ইচ্ছে ছিল প্রাইভেটে এম.এ পরীক্ষা দেবার। এখন আরম্ভ করতে পারে। আপনি যখন এখানে আছেন, আপনি ওকে একটু দেখিয়ে-টেখিয়ে সাহায্য করতে পারেন। আমি থাকি না থাকি, একটা বেশ নিয়ম করে—
অরুণ আর মালতী দু’জনেই রজতের দিকে তাকাল। দু’জনেই যেন তন্নতন্ন করে দেখতে চাইল রজতের মুখের প্রতিটি রেখা। চওড়া, ফরসা মুখ রজতের। দাড়ি কামাবার পর নীলচে আভা ফোটে, সে-মুখে কোনও মলিনতা নেই, নেই সামান্যতম তির্যক ভঙ্গি। প্রশস্ত উজ্জ্বল রজতের দৃষ্টি।
অরুণ সামান্য হেসে বলল, এম.এ, পড়াবার বিদ্যে আমার নেই। আমার নিজেরই রেজাল্ট খুব খারাপ। আপনিই তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন শুনেছি।
কিন্তু আমার তো চর্চা নেই। আপনারা শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত আছেন, আপনি যতটা সাহায্য করতে পারবেন, আমি তার কিছুই পারব না।
আমার যতদূর মনে আছে, আপনার স্ত্রী আর্টসের ছাত্রী ছিলেন। আমি সায়েন্সের। আমার বিষয় হচ্ছে অঙ্ক—অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস।
মালতী বলে উঠল, আমার আর পরীক্ষা-টরিক্ষা দেবার ইচ্ছে নেই! কী হবে এম.এ. পাশ করে!
রজত সচকিত হয়ে বললেন, পড়বে না। তা হলে তো কথাই নেই।
কিন্তু অরুণের শেষ কথাটা নিয়ে রজতকে বেশ চিন্তিত দেখা গেল। অরুণের দিকে ফিরে বললেন, অঙ্ক? আপনি সাহিত্যিক লোক হয়ে অঙ্কের মতন নীরস বিষয় নিয়েছেন। আমি কোনও অঙ্ক জানা লেখকের কথা এ পর্যন্ত শুনিনি।
অরুণ হাসি মুখে বলল, আমি অঙ্কও ভালো জানি না। এখনও অনেক অঙ্ক মেলাতে পারি না।
নতুন কী লিখলেন? আপনার কোনও নতুন বই বেরিয়েছে?
না।
এখন কিছু শুরু করেছেন?
না, লেখা-টেখা এখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছি বলা যায়। ওসব ছেলেবেলায় শখের ব্যাপার ছিল, এখন আর….
আমি আপনার লেখা পড়েছি। খুব পাওয়ারফুল, আপনি লেখা ছাড়বেন কেন?
মালতী খাবার টেবিলে অরুণের সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। কিছু একটা তো বলা উচিত, নইলে কেমন বেমানান দেখায়। তাই এবার সোজাসুজি অরুণের দিকে চোখ চেয়ে কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করল, আপনি সত্যিই এখন কিছু লিখছেন না?
অরুণ আলতোভাবে উত্তর দিল, না, ইচ্ছে করে না।
অরুণকে একটা বাড়িয়ে দিয়ে রজত নিজেও সিগারেট ধরালেন। বসবার ঘরে সোফায় বসে বললেন, আপনি তাস খেলতে জানেন, অরুণবাবু? তা হলে সার্কেল অফিসারকে ডেকে পাঠানো যায়, ব্রিজ খেলা যেত। কিংবা তিনজনে কাটথ্রোট খেললেও হয়। খেলবেন? নাকি আপনারা, লেখকরা আবার তাস-টাস খেলা পছন্দ করেন না! বুদ্ধদেব বসুর একটা লেখায় পড়েছিলুম, তাসখেলার দৃশ্য নাকি তাঁর কাছে নরক দৃশ্যের মতন জঘন্য! হাঃ-হাঃ!
অরুণ সহজ গলায় বলল, না, আমি তাস খেলা জানি। তবে ব্রিজ ভালো জানি না। একসময় তিন তাস খেলতাম খুব।
তিন তাস? মানে তো জুয়া?
হ্যাঁ। পয়সা দিয়ে খেলতে হয়। তিনখানা করে তাস নিয়ে—
শুনেছি খেলাটার কথা, তবে জানি না। ইন্টারেস্টিং! শিখে নিলে হয়, মালতী এসো না, তুমি আর আমি শিখে নিই খেলাটা।
মালতী বলল, আমি ও খেলা জানি। দাদা শিখিয়েছিল।
সে কী! তোমার দাদা তোমায় জুয়া খেলতে শিখিয়েছিল।
মালতী হাসতে হাসতে বলল, জুয়া এমন কিছু ভয়ংকর নয়। খুচরো পয়সা দিয়ে খেলতে হয়, কিন্তু খুব ইয়ে লাগে, মানে একসাইটিং।
বাঃ, তোমরা দু’জনেই যখন জান, তখন আমাকে শিখিয়ে দাও, তিনজনে মিলে খেলি! এইসব জুয়া-টুয়ার মতন ভালো ভালো জিনিস ছেলেবেলায় না শিখে শুধু বাজে পড়াশুনো করেছি! কী ভাবে খেলতে হয়? এসো না, শুরু করি।
একদিনে শেখা যায় না। নতুন শিখে এ খেলা খেলাও যায় না। তা হলে তুমি অনবরত হারবে।
কত আর হারব? দেখাই যাক না।
একেবারে ফতুর হয়ে যাবে! জেনে-শুনে কাউকে হারানো যায় নাকি! খেলা তা হলে ভালো হয় না।
কিন্তু খেলতে খেলতেই তো আমি শিখব। আরম্ভ করাই যাক না।
আজ না।
অরুণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তা ছাড়া আমাকে এখন যেতে হবে। আমার সত্যিই লাইব্রেরিতে একটা কাজ আছে। রজতবাবু, নেমন্তন্নর জন্য ধন্যবাদ।
এক্ষুনি কেন? আর একটু বসুন! খেয়ে উঠেই এই রোদ্দুরের মধ্যে কেউ হাঁটে?
আপনারাও তো এখন একটু বিশ্রাম করবেন। আমাকে যেতেই হবে। অশেষ ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আমাকে কেন, গৃহকর্ত্রীকে জানান।
অরুণ মালতীর দিকে ফিরে তাকাল। মালতীর নাম উচ্চারণ না করে শুধু বলল, সত্যিই খুব ভালো লাগল। যাই এবার।
মালতী মুখে কিছু না বলে ঘাড়টা সামান্য হেলাল। জানলার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল মালতী, একটা রোদ্দুরের রেখাকে আড়াল করে। যেই সে মাথাটা হেলাল, অমনি রোদটা এসে পড়ল অরুণের চোখে, আবার মালতীর মাথাটা সোজা হতেই রোদটা চলে গেল। রোদ্দুরে মালতীর চূর্ণ চুলগুলোকে মনে হচ্ছে সোনালি। সেই দিকে একপলক তাকিয়ে অরুণ বেরিয়ে গেল।
রজত বললেন, মিলু, তুমি নিজের মুখে ভদ্রলোককে একবারও আবার আসতে অনুরোধ করলে না?
না বললেও ওকে আসতে তো হবেই।
কেন?
মালতী এবার হাসতে হাসতে দুলে উঠল। আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ছাতা ফেলে গেছে যে!
তাই নাকি! ইস, ছি ছি! ভদ্রলোককে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
আমার কি আগে মনে পড়েছে নাকি! এইমাত্র চোখে পড়ল।
রজতও হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ইস, ছাতা ছাড়া ওঁর অসুবিধে হবে রোদ্দুরে, ওঁর চোখের অসুখ—
চোখের অসুখ না ছাই—
চোখের অসুখ নয়? তা হলে এই শীতকালে—
ছাতা নিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা। দেখছিলে না, সব সময় উনি কী রকম অস্তস্তির মধ্যে ছিলেন।
সত্যি, ভদ্রলোক কিছুতেই সহজ হতে পারছিলেন না। তা ছাড়া বেশ লাজুক লোক, বেশির ভাগ সময়ই মুখ নিচু করে থাকেন। কলেজে পড়ান কী করে? আজকাল যা সব গুন্ডা ছেলেরা পড়ে।
তা বলে কি কলেজেও লাজুক থাকেন নাকি? তখন ঠিক হয়ে যায়। তুমি যে বাড়িতে এত ছেলেমানুষ, অফিসে গম্ভীর থাক কী করে? মানুষ এক-এক জায়গায় এক-একরকম।
অরুণকে দেখে তোমার কী রকম লাগল?
কী রকম আবার লাগবে?
এই, বুক-টুক কেঁপে উঠল না একবারও? দীর্ঘশ্বাস পড়ল না? এতদিন পর সেই ছেলেবেলার প্রেমিককে দেখে—
যাঃ।
সত্যি বলো না, ওর জন্য তোমার মনে এখন একটুও ভালোবাসা নেই? বলো, সত্যি আমি কিছু মনে করব না। বিশ্বাস করো! আগে একজনকে ভালোবেসে পরে আর কাউকে ভালোবাসা যায় না, তা আমি বিশ্বাস করি না। অরুণকে তো দেখে মনে হল, ও তোমার কথা প্রায় ভুলেই গেছে।
তাই তো স্বাভাবিক। ছেলেবেলার ওসব ছেলেমানুষি ব্যাপার কে আর সারাজীবন মনে রাখে। মনে না রাখাই ভালো।
তোমার না মনে থাক, অরুণও যে তোমাকে মনে রাখেনি, এতে তোমার অভিমান হল না?
কেন, অভিমান কেন হবে? আমি তো একজনকে পেয়েছি, আর কী চাইব?
তবু ভুলে যাওয়াটা অন্যায়। আমার মনে হয়, এ যেন প্রেমের অপমান। ওই সব মধুর স্মৃতির কথা ভুলে যাওয়া…..কী জানি, আমার তো অভিজ্ঞতা নেই! মিলু, তুমি সত্যি সুখী হয়েছ?
কী আকস্মিক এই প্রশ্ন। সুন্দর দুটি চোখে বিস্ময় নিয়ে মালতী তাকাল রজতের দিকে। তারপর কাছে এগিয়ে এসে বলল, কেন বার বার এ কথা জিজ্ঞেস করছ? তুমি কি জান না, আমি সুখী? কোনও ভাবনা নেই, চিন্তা নেই, স্বাধীন জীবন, তুমি আছ আমার কাছে—এর চেয়ে অন্য আর কী হতে পারে?
আমার ভালোবাসা কি তোমার সব অভাব মেটাতে পারে?
আমার আর কী অভাব? তোমার ভালোবাসাই তো আমার জীবন দিয়েছে, আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছে!
মিলু, তোমার এই কথাটা যেন কেমন কৃতজ্ঞতার মত শোনায়। কৃতজ্ঞতার চেয়েও ভালোবাসার জন্যই মানুষের কিন্তু বেশি লোভ।
দেখো, ভালোবাসা জিনিসটা যে ঠিক কী, তা অনেক সময়ই বোঝা যায় না, কিন্তু কৃতজ্ঞতা একেবারে সারা বুক জুড়ে থাকে। কৃতজ্ঞতাবোধ না থাকলে বোধহয় ভালোবাসার বোধও জন্মায় না। যে-ভালোবাসা অকৃতজ্ঞ, তা ব্যর্থ ভালোবাসা।
যাই বল, আমি যদি অরুণ হতাম, তোমাকে আমি কোনওদিনই ভুলতে পারতাম না। তোমার মতন একটা মেয়ে বাংলা দেশে এক লক্ষর মধ্যেও একটা নেই। শুধু রূপের জন্য নয়….
কী আছে আমার মধ্যে?
তোমার মুখে একটা জ্যোতি আছে।
থাক। আর না!