সুখে থাকার কায়দা
একটু চেষ্টা করলেই আমরা সুখে থাকতে পারি। মানসিক অশান্তিতে ভুগতে হয় না। ইংরেজিতে
একটা কথা আছে to call a spade a spade। কোদালকে কোদাল বলতে শেখা। আমাদের ভাবনার সামান্য একটু হেরফের করতে পারলেই, অফুরন্ত অপার শান্তি। বোকা আর রোমান্টিক হয়েছ কী মরেছ। পৃথিবীতে ঠিক ঠিক দেখতে শিখলেই আর কোনও অশান্তি থাকে না। যেমনঃ
(এক) দেহধারণ করলেই অসুখ করবে। পশ্চিমবাংলার প্রধান-প্রধান অসুখ, থেকে-থেকে সর্দি, কাশি, জ্বর। মাঝে-মাঝে আধকপালে! মাঝে-মাঝে ফুলকপালে। বছরে একবার চোখে জয়-বাংলা। ফাল্গুন, চৈত্রে বসন্ত ঋতু নয়, বসন্ত রোগের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা। অম্বল, বদহজম, অ্যামিবায়সিস, জিয়ার্ডিয়াসিস। গেঁটে বাত। দন্তশূল। একবার ফ্লু, একবার ডেঙ্গু। বরাত ভালো হলে ফ্লু, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মিকশ্চার।
(দুই) পাশটাশ করলেই যে চাকরি জুটবে এমন কোনও নিশ্চয়তা এ দেশে নেই। দীর্ঘকাল বেকার বসে থাকার সম্ভাবনা আছে। বেকার থেকে সাকার না হওয়া পর্যন্ত যা-যা করতে হবে, (ক) সপ্তাহে একবার র্যাশনের দোকানে লাইন, (খ) সপ্তাহে দুবার কেরোসিনের লাইন, (গ) সপ্তাহে একবার দাদা, বউদির জন্যে লাইন দিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা করে সিনেমার টিকিট কাটা, (ঘ) ভোরের কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে হরিণঘাটার দুধ আনতে যাওয়া ও বাজার, (ঙ) ঠিক সময়ে সংসারের হাতে বাজার ধরাতে না পারায় বাক্যবাণে জর্জরিত হওয়া, (চ) দু’ফুটের চা পান, (ছ) ভাইপো অথবা ভাইঝির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে স্কুলে দিয়ে আসা, পুনরায় নিয়ে আসা, (জ) মাঝেমধ্যে বউদির জুতোর ছেঁড়া স্ট্র্যাপ সেলাই করিয়ে আনা, (ঝ) পাড়াতুতো বউদিদের ফাইফরমাশ খাটা, (ঞ)বাড়িতে যখনই অভ্যাগত আসবে দোকানে ছোটা ও সিঙাড়া আনা এবং সেই সিঙাড়া গরম হওয়া চাই, (ট) সংসারে যখনই কিছু ফুরোবে তখনই অম্লানবদনে বাজারে ছোটা, (ঠ) সবার শেষে বাথরুমে প্রবেশাধিকার, (ড) সপ্তাহে একবার নিজের জামাকাপড় ধোলাই, (ঢ) মাঝে-মাঝেই বউদির শাড়ি ইস্ত্রি করিয়ে আনা, (ণ) দাদার সাইকেল থাকলে সপ্তাহে একবার চেন পরিষ্কার ও জায়গামতো তৈল প্রয়োগ, (ত) সেলাইমেশিন ও ইলেকট্রিকের জন্যে প্রায়ই মিস্ত্রি ধরে আনা, (থ) ডাক্তার কাউকে দেখে যাওয়ার পর ডিস্পেনসারিতে গিয়ে লাইন দিয়ে মিকশ্চার আর পুরিয়া আনা, (দ) মাসে একবার লাইন দিয়ে ইলেকট্রিক বিল জমা দিয়ে আসা, (ধ) ভোরবেলা কাজের লোক কড়া নাড়লে দরজা খুলে দেওয়া, (ন) সাকার কারুর কুকুর পোষার শখ থাকলে চেনে বেঁধে সেই কুকুরকে সকালে আর রাতে বাইরের ল্যাম্পপোস্টে হিস করিয়ে আনা এবং জেনে রাখা কর্মটি খুব ধৈর্য্যের। উক্ত কর্ম কুকুর সহসা সম্পন্ন করে না। বহুত ন্যাজে খ্যালে।
ধরে নিতে হবে, চাকরি পাওয়া আর ঈশ্বরকে পাওয়া এক জিনিস। সুতরাং সেই ধরনের নিষ্ঠা আর সাধনা চাই। সপ্তাহে দশবারোটা, ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফ্রম এ রিলায়েবল সোর্স’ ছাড়তে হবে। আর রবিবার -রবিবার ঘোলার ছেলেকে ঘুঘুডাঙায় গিয়ে পরীক্ষায় বসতে হবে।
রোজগার যেমনই হোক একটা বয়সে বিবাহের বাসনা হবেই। দেশে মেয়ের অভাব নেই। হয় মেয়ে নিজেই ধরবে, নয়তো পাত্রীপক্ষ। জ্যোতিষী রায় দেবেন, স্ত্রীভাগ্যে ধন। অবশেষে ছাদনাতলায় চারচক্ষুর মিলন। মনে রাখতে হবে, সেকাল আর নেই, একালের মেয়েরা চাদরের তলায় চারচক্ষুর মিলনের সময় কটমট করে তাকাতে পারে। তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বুঝে নিতে হবে, পাত্রীর নিজস্ব নির্বাচিত কেউ ছিল, পাত্রীপক্ষ জোর করে পিঁড়েতে বসিয়ে দিয়েছে, পোষ মানাতে একটু সময় লাগবে—এই আর কি!
আরও মনে রাখতে হবে, স্ত্রীরা কখনই পোষ মানে না। নিজেকেই পোষা হতে হয়। সারাদিনে বারতিনেক ফাটাফাটির জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। পৃথিবীতে গোটাকতক জিনিস আছে যাতে নিজেকে ফিট করে নিতে হয়। যেমন চশমায় চোখ ফিট, জুতোয় পা ফিট, স্ত্রীতে নিজেকে মানানসই। শাসনব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো।
কেউ কারুর কথা শুনবে না, এইটাই দুনিয়ার নিয়ম, যদি না প্রাণ যাওয়ার ভয় থাকে। স্ত্রী স্বামীর কথা শুনবে না। স্বামী স্ত্রীর কথা সময় সময় শুনবে প্রাণ যাওয়ার ভয়ে। দুম করে মারবে না, তিলে-তিলে মারবে, গান্ধীজির নন-কোঅপারেশান টেকনিকে। সেই টেকনিকটা জেনে রাখা ভালো, যেমন (১) মুখ তোলো হাঁড়ি। (২) সব কথা জানি না বলা (৩) সকলকে ভুরিভোজ করিয়ে নিজে উপবাস করা (৪) শিশুপুত্রকে কথায়-কথায় ধরে কিলনো। (৫) বাপের বাড়িতে চিঠি লিখতে বসা (৬) কাজের লোক বা বাইরের লোক সাংসারিক প্রশ্ন করলে বলা, ওই তো বসে রয়েছে জিগ্যেস করো। (৭) স্বামীর মাকে কথায়-কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠা। অর্থাৎ শ্রেণিসংগ্রামের বীজ বোনা। (৮) অসুস্থ থাকলে ওষুধ না খাওয়া।
ছেলেমেয়েরা কথা শুনবে না। সাধারণ অবস্থায় না শোনাই স্বাভাবিক, কিছু পাওয়ার আশা থাকলে সাময়িকভাবে ন্যাওটা হবে। পাওনাগণ্ডা মিটে গেলে যেযার পথে নেচে-নেচে চলে যাবে। বসবাসের বাড়ি কোনও সময় শব্দশূন্য হবে না। রেডিও বাজবে। রেকর্ডপ্লেয়ার, টেপরেকর্ডার গাঁকগাঁক করবে। টিভি চলবে। তারই মাঝে ছেলে পড়বে, মেয়ে গলা সাধবে, গৃহিণী কাজের মেয়েকে দাবড়াবে, কর্তা স্তোত্রপাঠ করবে, কেউ আবার জপের মালা ঘোরাবে। শব্দশূন্য পল্লির আশা দূরাশা। মধ্যরাতেও শান্তি মিলবে না। কুকুরে কনসার্ট জুড়ে দেবে।
বাথরুমে যে ঢুকবে জীবনে সে আলো নেভাবে না। আর একজনকে নেভাতেই হবে। এ নিয়ে অশান্তি না করাই ভালো। এইটাই জগতের নিয়ম। ওষুধের শিশির ছিপি যে খুলবে সে প্যাঁচ মেরে কোনওদিনই বন্ধ করবে না। কলের মুখ পুরো বন্ধ করবে না। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তেই থাকবে। ওয়াশবেসিনের কল খোলাই থাকবে। সংসারের নিয়ম, তুমি বিদ্যুৎখরচ করে পাম্প চালিয়ে ট্যাঙ্ক ভরবে, অন্যে কলের মুখ খুলে রেখে খালি করে দেবে।
সাবানদানিতে জল থইথই করবে। পাউডার মাখলে পালিশ করা টেবিলে এক পরদা পড়ে থাকবেই। মেয়েদের চিরুনিতে চুল জড়িয়ে থাকবেই এবং দুই মহিলায় এই নিয়ে খ্যাচাখেচি হবেই। সেফটিফিন, মাথার কাঁটা, পাঞ্জাবির বোতাম একবার মাত্র ব্যবহারের জন্যে। দ্বিতীয়বার আর পাওয়া যাবে না।
মেয়েদের চোখের চশমা, আঙুলের আংটি, কানের দুল সারাদিনে বারকয়েক হারাবেই। চশমা সাধারণত খাটের তলা থেকে পাওয়া যাবে। আংটি পাওয়া যাবে সাবানদানিতে। দুল বেরোবে বালিশের ওয়াড়ের ভেতর থেকে। এই সময় জনেজনে চোর সাব্যস্ত হবে, কিন্তু সবকিছুই মেনে নিতে হবে রসিকের দৃষ্টিতে।
DARUN