সুখী মানুষ

সুখী মানুষ

মানুষ যেমন পোশাক বদলায়, আব্দুল কুদ্দুস বদলায় নাম। রাগ করে যে বদলায় তা না, বিপদে পড়ে বদলায়। দীর্ঘদিন এক নামে চলাফেরা করা তার জন্যে বিপদজনক। গত এক মাস ধরে আব্দুল কুদ্দুসের নমি আলফ্রেড গোমেজ। এই প্রথম সে খ্রিস্টান নাম নিয়েছে। নামের সঙ্গে লেবাসে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কালো সুতোয় বাঁধা রূপার একটা ক্রশ গলায় ঝুলিয়েছে। কোটের পকেটে মথি লিখিত সুসমাচার নামের চটি একটা বই। খ্রিস্টানরা কথাবার্তায় বিনয়ী হয়-সে বিনয়ী হবার চেষ্টা করছে। চেষ্টা তেমন সফল হচ্ছে না। ফট করে রাগ উঠে যাচ্ছে।

আব্দুল কুদ্দুস অর্থাৎ আলফ্রেড গোমেজ সাহেবের পেশা পাথরের মূর্তি বেচাকেনা। যেখানে বৎসরে একটা মূর্তি বেচতে পারলেই হয় সেখানে সে চারপাঁচটার মতো মূর্তি বিক্রি করে ফেলে। আগে তার প্রধান খদ্দের ছিল আমেরিকান সাহেবরা এখন জাপানিরা। জাপানিদের সঙ্গে ব্যবসা করার অনেক যন্ত্রণা। তারা মূর্তির ছবি দেখে সন্তুষ্ট না। তাদেরকে জিনিস দেখাতে হয়। সেই জিনিস তারা যে দেখেই সন্তুষ্ট হয় তা না, নানানভাবে হাতাপিতা করে। শিরিষ কাগজের মতো সবুজ রঙের কাগজে মূর্তি ঘসাঘসি করে। তারপর সেই কাগজ বড় সাইজের ক্যালকুলেটরের মতো যন্ত্রে ফেলে দেয়। যন্ত্রের ভেতর থেকে কটকট কটকট করে শব্দ হবে। কী সব লেখা বের হবে। তারপর এমনভাবে মাথা নাড়তে থাকবে যেন আব্দুল কুদ্দুস নকল মাল গছিয়ে দিতে এসেছে। মাছি তাড়াবার মতো ভঙ্গি করে বলকেনো নো নো। নো ডিল। ইউ গো।

কাস্টমারদের এইসব অভিনয় কুদ্দুস খুব ভালো বোঝে। সে সঙ্গে সঙ্গে তার জিনিসপত্র গুটিয়ে ফেলে। কাপড়ের ব্যাগে মাল সামলে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ায়। হাসি মুখে বলে ওকে বাই। বলেই দাঁড়ায় না। দরজার দিকে হাঁটা দেয়। জাপানি খদ্দের তখন ব্যস্ত ভঙ্গিতে কুদ্দুসের চেয়েও খারাপ ইংরেজিতে বলে-এটা ছাড়া তোমার কাছে আর কী আছে? কুদ্দুস বলে, আরো আছে তবে তোমাদের সঙ্গে কোনো বিজনেস আমি করব না। তোমরা আসল নকল বোঝ না।

অন্য মালামাল কী আছে দেখি।

না আপনাদের কিছু দেখাব না।

এই বলে কুদ্দুস অপেক্ষা করে না, লম্বা পা ফেলে বের হয়ে আসে। গরজ তার, গরজ সাহেবদের। ঠিকই তাকে খুঁজে বের করবে। গলি তস্য গলি পার হয়ে উপস্থিত হবে শাহ সুরী রোডে। এটা কুদ্দুসের অপছন্দ। সাহেব সুবোরা তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করলে লোকজনের চোখ পড়বেই। চোখ কপালে তুলে ভাববে-বিষয়টা কী? এই বাড়িতে এত সাহেবের আনাগোনা কেন?

মূর্তি বেচাকেনার ব্যবসাটা কুদ্দুসের পছন্দ। রিস্ক আছে তবে বড় রিস্ক না। বাংলাদেশের মানুষ মূর্তি নিয়ে মাথা ঘামায় না। পত্রপত্রিকায় মাঝে মধ্যে ভিতরের পাতায় সংবাদ ছাপা হয় তা দেশের অমূল্য সম্পদ পাচার খুবই ফালতু। এই জাতীয় খবরে কেউ মাথা ঘামায় না। যে দেশের মানুষই পাচার হয়ে যাচ্ছে, সে দেশে মূর্তি পাচার কোনো ব্যাপারই না। মূর্তির দাম নিশ্চয়ই মানুষের চেয়ে বেশি না।

 

আব্দুল কুদ্দুস পর্যটনের হোটেলের একটা কামরায় চুপচাপ বসে আছে। মেঝেতে চেয়ারের পাশে ক্যাম্বিসের সবুজ রঙের পেট মোটা ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর প্রথমে টাওয়েল তারপর খবরের কাগজ এবং পলিথিন দিয়ে মোড়া জিনিস। কুদ্দুসের মুখোমুখি বসে আছে চশমাপরা বাঙালি এক ভদ্রলোক। ব্যবসায়িক লেনদেন সে করবে এটা বোঝা যাচ্ছে। আব্দুল কুদ্দুস সামান্য শংকিত-এই বাঙালি বাবু কমিশন কত খাবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ইশারা ইঙ্গিতে যদি লোকটাকে বলা যেত যে কমিশন দেয়া হবে তাহলে মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকা যেত। টেন পারসেন্ট কমিশন। যত বেশি দামে বিক্রি হবে তত কমিশন। এইসব ক্ষেত্রে দালালরা দাম বাড়াতে সাহায্য করে। চশমাপরা লোকটাকে হাতে রাখতে পারলে ভালো হত। তেমন সুযোগ এখনো হয় নি। মূল খদ্দের টয়লেটে ঢুকেছে এখনো বের হচ্ছে না। একটু পরপর বাথরুম থেকে ফ্ল্যাশ টানার শব্দ আসছে। সাহেবের বাংলাদেশী খাবার খেয়ে পেট নেমে গেছে কি-না কে জানে? ওরস্যালাইন চলছে? চশমা পরা এসিসটেন্ট ওরস্যালাইন এনে দিচ্ছে না কেন?

ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে বললেন, আমার নাম জুবায়ের খান। যে হাতটা বাড়িয়েছেন সেই হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট। হাল্ডসেক করতে গেলে সিগারেটের ছ্যাকা খাওয়ার সম্ভাবনা। কুদ্দুস বিরস মুখে জুবায়ের খানের আঙুলগুলি শুধু স্পর্শ করল।

কুদ্দুস গম্ভীর গলায় বলল, আমার নাম আলফ্রেড গোমেজ।

আপনি খ্রিস্টান?

জ্বি।

মূর্তি কেনাবেচার ব্যবসা কতদিন ধরে করছেন?

কুদ্দুসের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মুখ বাঁকিয়ে কী বিশ্রী ভঙ্গিতেই না প্রশ্নটা করেছে। যেন কুদ্দুস বাংলাদেশের সবচে বড় চোর। দেশের অমূল্য সম্পদ পার করে দেশকে শেষ করে দিচ্ছে। আর সে মহা সাধু। কুদ্দস মনে মনে বলল—তুই যতদিন ধরে দালালি করছিস আমার ব্যবসা ততদিনের।

স্যাম্পল এনেছেন?

কুদ্দুস হ্যাঁ না কিছুই বলল না। সে লক্ষ করল হঠাৎ তার রাগ উঠে গেছে।

স্যাম্পল কী এনেছেন আমাকে দেখান।

কুদ্দুস বলল, যে কিনবে সে দেখুক। আপনি দেখে কী করবেন?

আগে আমি দেখব। আমি দেখে যদি ইয়েস বলি তবেই স্যার দেখবেন। মৃর্তির কোয়ালিটি তার প্রাইস এইসবে আমার সামান্য অভিজ্ঞতা আছে।

কুদ্দুস নিতান্ত অনিচ্ছায় তার ক্যাম্বিসের ব্যাগ খুলল। মোটা টাওয়ালে জড়ানো মূর্তি বের করল। ভদ্রলোক ঝুঁকে এলেন। শুকনো গলায় বললেন—কী মূর্তি?

কুদ্দুস বলল, কি মূর্তি তা জানি না। আমি আপনার মতো এক্সপার্ট না। মেয়ে মানুষের মূর্তি এইটা বলতে পারি। হিন্দুদের কোনো দেবী টেবি হবে। এদের তো কয়েক লক্ষ দেবী। কয়েক লক্ষ দেবীর একজন।

উহুঁ, কোনো দেবী মূর্তি না। অপ্সরাদের মূর্তি হতে পারে। রম্ভা, মেনকা। স্যার ইন্টারেস্টেড হবেন বলে মনে হয় না।

কেন ইন্টারেস্টেড হবে না, মূর্তি খারাপ?

বেশিদিন আগের মূর্তি না। কাট দেখেই বোঝা যাচ্ছে বয়স পাঁচশ বছরের বেশি না। পাথরের গ্রেইন বড় বড়। দাম কত চান?

ডলারে দাম বলব ন বাংলাদেশী টাকায় বলব?

ডলারেই বলুন।

দশ হাজার ডলার।

বলেন কী?

জুবায়ের খান চোখ কপালে তুলে ফেলল। কুদ্দুস বলল, আপনার জন্যে দশ পারসেন্ট কমিশন আছে। দশ হাজার ডলারে আপনি পাবেন এক হাজার।

আমার কমিশনের কোনো দরকার নাই। পাঁচশ টাকা। এই জিনিসের দাম দশ হাজার ডলার এমন কথা আমার পক্ষে স্যারকে বলা সম্ভব না। তাও মূর্তি যদি কষ্টিপাথরের হত একটা কথা হত।

কুদ্দুস বলল, তাহলে আর কি উঠি। বলতে বলতে সে তোয়ালে দিয়ে মূর্তি জড়িয়ে ফেলল। আর তখন জাপানি সাহেব ঘরে ঢুকলেন। জুবায়ের হরবড় করে কী যেন বলল। জাপানি ভাষা। বাঙালি ছেলের মুখে জাপানি ভাষা শুনতে অদ্ভুত লাগে। উত্তরে জাপানিও কিছুক্ষণ কিচকিচ করল। জুবায়ের কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার মূর্তি দেখতে চাচ্ছে।

কুদ্দুস উদাস গলায় বলল, দেখে কী হবে?

জুবায়ের বলল, দেখে কিছুই হবে না। স্যার যদি এক হাজার ডলারেও এই মূর্তি কিনতে চায় আমি নিষেধ করব। তবু দেখতে চাচ্ছে দেখান।

কুদ্দুস টাওয়েল সরাল। সাহেব কাছে এগিয়ে এলেন। আরো কিছুক্ষণ কিচকিচ করলেন।

জুবায়ের বলল, স্যার বলছেন মূর্তি দেখতে খারাপ না, তবে ঠোট ভাঙা। এই দেখেন নিচের ঠোটের একটা অংশ ভাঙা।

কুদ্দুস দেখল। আসলেই ভাঙা। পুরানো আমলের এইসব জিনিসের মূল্য ভাঙা থাকলেই বাড়ে। তারপরেও খুঁতভো বটেই। কেনার সময় আরো দেখে শুনে কেনা উচিত ছিল। তবে ঠোট ভাঙার কারণে মূর্তিটা দেখতে খারাপ লাগছে না। কুদ্দুস এই মূর্তি আগে ভালোমতো দেখেনি। এই প্রথম দেখছে। যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। পাথরের মূর্তি বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে জীবন্তু কোনো মেয়ে। যে-কোনো কারণে লজ্জা পেয়েছে বলে চোখের দৃষ্টি হঠাৎ নত হয়েছে। গাল হয়েছে ঈষৎ লাল। খুবই আনমনা মেয়ে।

জুবায়ের বলল, স্যার দাম জানতে চাচ্ছেন।

দামতো বলেছি।

সেতো কথার কথা। এখন ঠিক দাম বলেন। ক্যাশ পেমেন্ট হবে। জাপানিরা অল্প কথার মানুষ। এক হাজার ডলার অনেক বেশি হয়ে যায়। তারপরেও অপিনি কষ্ট করে এসেছেন স্যারকে এক হাজার ডলার বলে দেখি। রাজি হবে বলে মনে হচ্ছে না।

কুদ্দুস মূর্তি তীর ব্যাগে ভরে ফেলল। ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে বললবলেছি বলেছি। আপনার স্যার যেমন এক কথার মানুষ। আমিও সে রকম এক কথার মানুষ।

আপনি কি ফিক্সড প্রাইস শপ খুলেছেন না-কি?

জ্বি ফিক্সড প্রাইস।

সাহেব আবারো কিচকিচ করা শুরু করেছে। তার কিচকিচানির মধ্যে একধরনের উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। একবার মনে হল জাপানি ভাষায় জুবায়েরকে ধমকও দিলেন। তারপর কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললেন সিট ডাউন।

কুদ্দুস বসল। মনে হচ্ছে বাণিজ্য হবে। পুরানো আমলের জিনিস একবার কারো মনে ধরে গেলে বিপদ আছে। একবার মনে ধরা মানে বড়শিতে গেঁথে যাওয়া! সেই বড়শি থেকে বের হওয়া অতি কঠিন। সাহেব কি বড়শিতে গেঁথেছে? মনে হয় গেঁথেছে?

মৃর্তিটা বিক্রি করা কুদ্দুসের জন্যে অতি জরুরি। গত এক বছরে সে কিছুই বিক্রি করতে পারেনি। হাসমত একটা বিষ্ণুমূর্তি এনে দেবে বলে সত্তর হাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিল। হাসমতের কোনো খোঁজ নেই। লোকমুখে শুনেছে সে মূর্তি ঠিকই জোগাড় করেছে, বিক্রি করেছে অন্য জায়গায়। কুদ্দুসের বিরাট সংসার। চার ছেলেমেয়ে স্ত্রী। তার দুই শালাও তার সঙ্গে বাস করে। দেশে টাকা পাঠাতে হয়। এক বোন সম্প্রতি বিধবা হয়েছে। তাকেও টাকা পয়সা দিতে হয়। শুধু টাকা দিয়ে মনে হয় পার পাওয়া যাবে না। এই বোনও তার সংসার নিয়ে কুদ্দুসের বাসায় উঠবে। আজ মূর্তিটা বিক্রি করতে পারলে হত।

জুবায়ের বলল, স্যার বলছেন মুর্তিটা বের করতে।

কুদ্দুস মূর্তি বের করল। আগে মনে হচ্ছিল মূর্তির মেয়েটা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করেছে। এখন মনে হচ্ছে তা-না। মেয়েটা রাগ করে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। খুবই তুচ্ছ কোনো কারণে রাগ করেছে। কিছু কিছু মেয়ে আছে রেগে গেলে চোখে পানি এসে যায়, এই মেয়ে সেই জাতের। এখনি হয়ত কেঁদে ফেলবে।

জুবায়ের বলল, আপনার দাম শুনে স্যার প্রায় ভিরমি খেয়েছেন। যাই হোক স্যার একটা দাম বলেছেন। এর বেশি একটা পয়সাও দেবেন না। ক্যাশ ডিলিং হবে। আপনি মূর্তি রেখে যাবেন, ডলার পকেটে ভরবেন। স্যার বলছেন সর্বমোট চার হাজার ডলার।

কুদ্দুস অতি দ্রুত চিন্তা করছে। চার হাজার ডলার খারাপ না। ভালো। বেশ ভালো। ডলারে একান্ন টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে। চার হাজার গুনন একান্ন-কত হয়? দুই লাখ চার হাজার। এই মূর্তির পেছনে তার খরচ হয়েছে খুবই সামান্য এগারো হাজার টাকা। লাভ এক লাখ তিরানব্বই। খারাপ না, ভালো।

জুবায়ের বলল, চুপ করে আছেন কেন? কিছু বলেন।

কী বলব?

স্যার একটা প্রাইস বলেছেন। হ্যাঁ-না, কিছু বলেন।

কুদ্দুস মূর্তির দিকে একঝলক তাকাল। ধ্বক করে বুকে ধাক্কার মতো লাগল। মূর্তি মেয়েটা মনে হয় কথাবার্তা শুনছে। তাকে নিয়ে দরদাম করা হচ্ছে মেয়েটা যে চোখ নিচু করে আছে এই লজ্জাতেই নিচু করে আছে।

জাপানি কিচকিচ করে ইঁদুরের মতো কীসব যেন জুবায়েরকে বলছে। হাত নাড়ছে। হাত নেড়ে কথা বলার অভ্যাস হল বাঙালির অভ্যাস। মাঝে মাঝে বিদেশীদের মধ্যেও এই অভ্যাস দেখা যায়।

আলফ্রেড গোমেজ সাহেব।

জি।

স্যারের সঙ্গে লাস্ট কথা হয়েছে। উনি আজ রাতের ফ্লাইটে চলে যাচ্ছেন। সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনস। উনি সময় নষ্ট করতে চান না। আরো পাঁচশ ডলার ধরে দিয়েছেন। আশা করি এর পরে আর কোনো আপত্তি থাকার কথা না।

কুদ্দুস উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, মূর্তি বেচব না।

জুবায়ের বলল, গোমেজ সাহেব আপনি একটা ভুল করছেন, স্যার সামান্য আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে আপনি ভেবে নিচ্ছেন স্যারের খুবই গরজ। উনার এত গরজ নাই। দরাদরি উনি খুবই অপছন্দ করেন বলেই ঝামেলা কমাবার জন্যে পাঁচশ টাকা এক্সট্রা দিতে চেয়েছেন। আমি নিজে বাঙালি। বাঙালি চরিত্র আমি ভালো জানি। আপনি হোটেল থেকে এক পা বের হয়ে আবার ফিরে আসবেন তখন কিন্তু আমরা পাঁচশ ডলার কম দেব। এটা মনে রাখবেন। আপনি যেমন ত্যাঁদড় আমিও ত্যাঁদড়।

কুদ্দুস ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমি ফিরে আসব না।

হোটেলের বাইরে কুদ্দুসের পোষা বেবিটেক্সি। বিজনেসে বের হলে কুদ্দুস সবসময় সারাদিনের জন্য একটা বেবিটেক্সি নিয়ে নেয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরবে পাঁচশ টাকা। সন্ধ্যার পর কুদ্দুস হল ফ্যামিলি ম্যান। দুই ছেলেমেয়েকে পড়ায়। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ছবি দেখে। অনেকগুলি চ্যানেল ফ্যানেল হওয়ায় খুব সুবিধা হয়েছে-বোতাম টিপলেই কোনো না কোনো ছবি পাওয়া যাবেই। সবই খুব সস্তা ধরনের ছবি। তবু বিনা পয়সায় দেখা যাচ্ছে-খারাপ কি? মাগনার সব জিনিসই ভালো। মাগনা আমার ভাগনা। ভাগ্নের সবই ভালো।

বেবিটেক্সিতে ওঠার সময় কুদ্দুস দেখল জুবায়ের সাহেব হোটেলের সিঁড়িতে চলে এসেছেন। তাঁর মুখ অসম্ভব বিরক্ত। তিনি হাত ইশারায় কুদ্দুসকে ডাকলেন। বেবিটেক্সিওয়ালা বলল, স্যার আপনারে ডাকে। কুদ্দুস উদাস গলায় বলল, ডাকুক। তুমি চালাও।

আজকের বাণিজ্যটা হয়নি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তার জন্যে কুদ্দুসের মোটেও খারাপ লাগছে না। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল তাতে তো মনে হচ্ছিল মূর্তিটা হাতছাড়াই হয়ে যাবে। দশ হাজারে রাজি হয়ে গেলে-কুদ্দুসের হা বলা ছাড়া উপায় ছিল না। তেমন টাকা পেলে মানুষ তার স্ত্রী পুত্র বেচে দেয় আর এতো সামান্য মূর্তি।

সন্ধ্যা অনেকক্ষণ হল মিলিয়েছে। কুদ্দুস তার বাসার বারান্দায় বসে আছে। এই জায়গাটা তার অতি প্রিয়। যদিও প্রিয় হবার মতো কিছু নেই। ফ্ল্যাট বাড়ির বারান্দাগুলি যেমন হয়-এক চিলতে জায়গা, একটা চেয়ার বসালে মানুষ হাঁটার জায়গা থাকে না। তারচেয়েও ভয়াবহ কথা হল বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যায় না-পাশের ফ্ল্যাটের দেয়াল দেখা যায়। কুদ্দুসের নিজের কিছু ট্রাংক বারান্দায় রাখা। বালিশসহ একটা পাটি পাতা আছে। চিকের পর্দা টেনে বারান্দায় শুয়ে আরামের ঘুম দেয়া যায়। ছেলেমেয়েদের চিৎকার হৈ চৈ কিছুই কানে আসে না।

বারান্দায় বাতি জ্বলছে। কুদ্দুসের হাতে চায়ের কাপ। তার পাশেই পাটিতে মূর্তিটা শোয়ানো। কুদ্দুস তাকিয়ে আছে মূর্তিটার দিকে। কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার স্ত্রী আমেনা এসে উঁকি দেবে। খুটখাট শব্দ হওয়া মাত্র কুদ্দুস চমকে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। যদিও এই চমকানোর কোনোই মানে হয় না। আমেনা এসে দেখলেও কিছুই যায় আসে না। এমনতো না যে তার পায়ের কাছে সত্যি কোনো মেয়ে লজ্জা লজ্জা চোখে শুয়ে আছে। পাথরের মূর্তি। পাথরের মূর্তি তার কাছে থাকতেই পারে। তার ব্যবসাই মূর্তি নিয়ে।

তারপরেও এমন অস্বস্থি লাগছে কেন? মূর্তিটা বার বার হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করছে। পাথরের মূর্তি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা কোনো ব্যাপার না। তাছাড়া মূর্তির গায়ে ধুলাবালি আছে। ধুলাবালি পরিষ্কার করার জন্যেও গায়ে হাত দেয়া যায়। কুদ্দুস হাতের চায়ের কাপ নামিয়ে মূর্তিটা কোলে নিল। পরিষ্কার করতে হবে। আর তখনি বারান্দার দরজার দিকে আমেনা আসছে এমন শব্দ পাওয়া গেল। কুদ্দুস অতি দ্রুত টাওয়েল দিয়ে মূর্তি ঢেকে ফেলল। আশ্চর্যের ব্যাপার তার কপালে সামান্য ঘামও জমে গেল।

কী করছ?

চা খাচ্ছি আবার কি করব?

তোমার কোলে কি?

কুদ্দুস বিরক্ত গলায় বলল, কিছু না। মেয়েদের অতিরিক্ত কৌতূহল তার কাছে অসহ্য লাগে। তার কোলে কি তা দিয়ে আমেনার দরকার কি? সে তো মেয়ে মানুষ কোলে নিয়ে বসে নেই। এই জাতীয় বদচিন্তা সে কখনো করে না। পুরুষ মানুষে অনেক বদঅভ্যাস থাকে। আজে বাজে জায়গায় যাওয়া, লাল পানি খাওয়া। তার কোনোটাই কুদ্দুসের নেই। তারপরেও এত সন্দেহ। কেমন চোখ সরু করে বলছে— তোমার কোলে কি? আবার চলেও যাচ্ছে না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

তোমার কাছে কে যেন এসেছে।

আসছি। একটা সার্ট এনে দাও।

আমেনা সার্ট আনতে গেল। এই ফাঁকে অতি দ্রুত কুদ্দুস মূর্তি সামলে ফেলল। টাওয়েল দিয়ে ঢেকে ব্যাগের ভেতর পাচার। ভালো একটা তালা আজই কিনতে হবে। ব্যাগে তালা দিয়ে রাখতে হবে। মূর্তি নিয়ে কুদ্দুস যখন বের হয় তখন ব্যাগে তালা থাকে না। তালা মানেই সন্দেহ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তালা লাগবে।

বসার ঘরে শুকনো মুখে জুবায়ের খান বসে আছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। এই গরমেও স্যুট পরে এসেছে। কুদ্দুসকে ঢুকতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল না, নড়ে চড়ে বসল। কুদ্দুস বলল, আপনি বাসা চিনলেন কি ভাবে? ঠিকানা কোথায় পেয়েছেন?

জুবায়ের খান বিরক্ত গলায় বলল, জোগাড় করেছি। কি ভাবে জোগাড় করেছি সেই লম্বা স্টোরি বলার সময় নেই। আমি আপনার টাকা নিয়ে এসেছি মূর্তিটা প্যাক করে দেন।

কি মূর্তি?

কি মূর্তি মানে? আজ সকালে যেটা নিয়ে হোটেলে গিয়েছিলেন।

ও আচ্ছা।

যা চেয়েছেন তাই নিয়ে এসেছি। দশ হাজার। ট্রেভেলার্স চেকে পেমেন্ট হবে। অসুবিধা নেই তো?

জি না অসুবিধা নাই।

বসে আছেন কেন? যান মাল নিয়ে আসুন। আমার হাতে সময় নেই। স্যারের রাতের ফ্লাইট।

চা খাবেন?

না চা খাব না। এক গ্লাস পানি খেতে পারি। ফুটন্ত পানি আছে তো?

আছে, ফুটন্তু পানি আছে।

যান ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি নিয়ে আসুন। আর মূর্তিটা আনুন।

কুদ্দুস ঘরে ঢুকল। পানি নিয়ে ফেরত এল। পানির গ্লাস টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে। মূর্তিটা আমার সঙ্গে নাই।

সঙ্গে নেই মানে?

এইসব জিনিস তো সাথে নিয়ে ঘুরি না সবসময় সামলায়ে রাখতে হয়।

যেখানে সামলে রেখেছেন সেখান থেকে নিয়ে আসুন। চলুন আমি সঙ্গে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে কোন অসুবিধা নেই।

মূর্তি চলে গেছে রাজশাহী।

রাজশাহী চলে গেছে মানে কি?

আমার পাটনার সকালবেলা নিয়ে চলে গেছে। ইন্ডিয়াতে পাচার হবে। দেবদেবীর দেশ তত। ওদের এইসব জিনিসের আলগা কদর। পূজার ঘরে রেখে পূজা-টুজা করে।

গোমেজ সাহেব।

জ্বি।

আপনি ঠিক করে বলুন তো। আপনি কি মোচড় দিয়ে জিনিসটার দাম বাড়াতে চাচ্ছেন? সত্যি করে বলুন। আমি না হয় স্যারের সঙ্গে মোবাইলে টেলিফোন করে আরো কিছু দেব।

সত্যি কথা বলছি। ক্রশ ছুঁয়ে বলছি। কোন খ্রিস্টান ক্রশ ছুঁয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারে না।

 

কুদ্দুস হল বালিশ ঘুম টাইপ মানুষ। বালিশে মাথা ছোয়ানো মানেই ঘুম। আজ রাতে কি যে হয়েছে কুদ্দুস বিছানায় গড়াগড়ি করছে। ঘুম আসছে না। ফ্যানের বাতাসে গরম লাগছে। বিছানা থেকেও মনে হয় গরম ভাপ আসছে। একটু পর পর পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। যতবার সে পানি খেতে উঠছে ততবারই ঘুম ঘুম গলায় আমেনা বলছে কে? আমেনার খুবই সজাগ ঘুম। সামান্য কাশির শব্দেও সে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে বলবে—কে কাশে? আমেনার ঘুম একটু যদি গাঢ় হত তাহলে সে বারান্দায় চলে যেত। ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে মেয়েটাকে বের করত। মেয়েটাকে খুবই দেখতে ইচ্ছা করছে। কুদ্দুসের কাছে খুব খারাপও লাগছে। সে দিব্যি ফ্যানের নিচে আরামে বিছানায় শুয়ে আছে অথচ আরেকজন…শেষরাতে মানুষের ঘুম গাঢ় হয়। আমেনারও নিশ্চয়ই গাঢ় ঘুম হবে। তখন বারান্দায় চলে গেলেই হবে। মেয়েটাকে খুবই দেখতে ইচ্ছা করছে। কুদ্দুস বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে শেষ রাতের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

পাঁচ বছর পরের কথা।

আব্দুল কুদ্দুস আবারো নাম পাল্টেছে। এখন তার নাম মুনশি হাবীবুল্লাহ। নামের সঙ্গে চেহারা এবং পোষাক পরিবর্তন করতে হয়, সেটাও করা হয়েছে। দাড়ি রেখেছে। মাথায় নেপালীদের রঙ্গিন টুপি। গায়ে ফতুয়া এবং পাঞ্জাবির মাঝামাঝি জাতীয় একটা পোষাক। মূর্তির ব্যবসাতেই সে আছে। বেশ জুড়ে সুড়েই আছে। ব্যবসা বেড়েছে। এখন ইন্ডিয়া থেকেও মাল আসে। তাকে সারা বছরই ব্যস্ত থাকতে হয়। আজ রাজশাহী, পরশু দিনাজপুর। কাজের সুবিধার জন্যে একজন ফুল টাইম এসিসটেন্ট রেখেছে। ইংরেজিতে এম.এ. পাশ চৌকস ছেলে। চোখে মুখে কথা বলে। বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ সেই করে। এর মধ্যেই জাপানিদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে জাপানি ভাষা শেখার চেষ্টা করছে। হীরের টুকরা ছেলে। ঘরে বড় মেয়ে থাকলে জামাই করে রাখার মত ছেলে।

ক্যাশ টাকা আব্দুল কুদ্দুসের কখনো হাতে থাকে না, তবে এ বারে সে ক্যাশ টাকা আটকে ফেলেছে। ঝিকাতলায় এক হাজার স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে। ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকার জন্যে ফ্ল্যাটটা খুবই ছোট সে জন্যেই হয়তবা আব্দুল কুদ্দুস একাই মাঝে মধ্যে এসে ফ্ল্যাটে থাকে। সুন্দর করে সাজানো ফ্ল্যাট। টিভি আছে, ফ্রিজ আছে। বসার ঘরে সোফা সেট। শোবার ঘরে ডবল খাট, ড্রেসিং টেবিল। মেঝেতে কার্পেট। বারান্দায় বেতের দুলুনি চেয়ার।

আব্দুল কুদ্দুস তার ফ্ল্যাটে কখনো দিনে দুপুরে আসে না। রাত আটটা-নটা, মাঝে মাঝে তারা পরে উপস্থিত হয়। মাথায় চাদর দিয়ে রাখে বলে তার মুখও পরিষ্কার দেখা যায় না। ফ্ল্যাটের লিফট এখনো চালু হয়নি বলে তাকে হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি ভেঙ্গে সাত তলায় উঠতে হয়। এই সময় তার খুব চেষ্টা থাকে কেউ যেন তাকে দেখে না ফেলে। যেন নিজের ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকাটা ভয়ংকর নিষিদ্ধ ধরনের কোন অন্যায়।

চাবি খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকেই আব্দুল কুদ্দুসের মন ভাল হয়ে যায়। অনেক সময় নিয়ে নিজেই ঘর ঝাঁট দেয়, পালকের ঝাড়ন দিয়ে সোফার ধুলা ঝাড়ে। রান্নাঘরে ঢুকে চা বানিয়ে চা খায়। রাত আরো গভীর হলে শোবার ঘরে ঢুকে। তখন তার গা ছমছম করতে থাকে। অদ্ভুত রোমাঞ্চ হয়। বক্সখাটের ড্রয়ার থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে সে তার ক্যাম্বিসের ব্যাগটা বের করে। এই সময় তার বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। মনে হয় এই বুঝি সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। মূর্তিটার দিকে তাকানোর পরই একটা শান্তি শান্তি ভাব আসে। মনে হয় এই পৃথিবীতে তারচে সুখী মানুষ কেউ নেই।

নির্জন ফ্ল্যাট বাড়িতে শুধু সে এবং তার অতি প্রিয় একজন। সারারাত সে যদি সেই প্রিয় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলেও কারোরই কিছু বলার নেই।

আব্দুল কুদ্দুস জানে তার ভয়ংকর কোনো অসুখ করেছে। যত দিন যাচ্ছে অসুখটা ততই বাড়ছে। পৃথিবীর সব অসুখেরই কোনো না কোনো চিকিৎসা আছে, এই অসুখেরও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সে চায় না এই অসুখের চিকিৎসা হোক। বরং সে উল্টোটা চায়। সে চায় অসুখটা আরো বাড়ক। তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলুক।

মূর্তিটার জন্যে আব্দুল কুদ্দুস আজ একটা উপহার নিয়ে এসেছে। পাথর বসানো গলার হার। সে খুব যত্ন করে হারটা মেয়েটাকে পরাল। তারপর ফিস ফিস করে প্রায় জড়ানো গলায় বলল— জান সোনা গো! হারটা পছন্দ হয়েছে?

এই কথাগুলি বলতে গিয়ে তার চোখে পানি এসে গেল। তার কাছে মনে হল এই পৃথিবীতে সে সবচে সুখী মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *