সুখীরাম

সুখীরাম

এইসব অঞ্চলে ছাগলই ব্যাংক। ব্যাংকই ছাগল।

এই যে বাহাকুটরি গ্রাম, থানা বান্দোয়ান, জিলা পুরুলিয়া, এখানে আশি ঘর মানুষের বাস, আর শ’পাচেক ছাগল। একটা ছাগলের দাম শ’পাঁচেক টাকা ধরলেও আড়াই লক্ষ টাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই গাঁয়ে। প্রায় সব ঘরেই ছাগল আছে। যার ঘরে দশটা ছাগল, তার পাঁচ হাজার টাকা জমা আছে বলা যায়। বিপদে আপদে ছাগল বেচে দিলেই হল। প্রতি সপ্তাহে এদিকে ছাগল ব্যাপারি আসে ছাগল কিনতে। ব্যাপারিরা এই অঞ্চলটার নাম রেখেছে মেরম টাঁড়। মেরম মানে ছাগল।

এই অঞ্চলের মানুষদের ছাগল অভ্যেস করিয়েছে স্বয়ম্ভর নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বুঝিয়েছে একটি ছাগল রাখলে বছর ঘুরতেই চারটে। তিন বছরে পঞ্চাশ-ষাটটা। ছাগলের জন্য খাবার কিনতে হয় না। নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেয়। দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যেই জঙ্গল। কয়েকটি বাগাল ছেলে আছে যারা ছাগল নিয়ে জঙ্গলে যায় চরাতে। সন্ধ্যার সময় বাহাকুটরিতে ধুলো ওড়ে। রাঙাধুলো ওড়াতে ওড়াতে ছাগলের দল ঘরে ফেরে। নিঃশব্দ গাঁয়ে তখন আনন্দ ভ্যাঁ। ঘরে ফেরার শব্দ। ভ্যাঁ-ভ্যাঁ শব্দের মধ্যেই কোনও কোনও বাড়িতে বেজে ওঠে শাঁখ।

সুখীরামের ঘরে শাঁখ বাজে না। সুখীরামের ঘর আছে ঘরণী নেই। ছিল, চলে গিয়েছে বছর পাঁচেক হয়ে গেল। সুখীরামও সন্ধ্যার ভ্যাঁ শোনে। ও বোঝে, আজকের মতো কাজ শেষ হল ওর। বাইরে এসে দাঁড়ায়। জঙ্গলের গন্ধ মাখা ছাগলের পাল দেখে। ছাগলছানার তিড়িং বিড়িং দেখে। সুখীরামের ছাগল নেই। ও ছাগল করেনি। কী হবে ছাগল করে?

সুখীরাম হল লোহার। এই গাঁয়ে এখন এই একঘর লোহারই রয়ে গিয়েছে। আগে এই গাঁয়ে ছিল সবই খুটকাটি জমি। জঙ্গল হাসিল করা। জঙ্গলের অবশেষ হিসাবে কয়েকটা প্রাচীন বৃক্ষ রয়ে গিয়েছে এখনও। একটা বহুদিনের পুরনো কাঁঠাল গাছের ছায়াতেই সুখীরামের কামারশালা। গত কয়েক বছর ধরে কাঁঠাল আর ফলছে না তেমন। সুখীরাম ওর ছোটবেলায় দেখেছে সর্বাঙ্গে কাঁঠালের গয়নায় নিজেকে সাজিয়ে ডাল দুলিয়ে কাঁঠাল গাছ নাচছে। কাঁঠাল গাছটাকে মনে হত সাক্ষাৎ মা ষষ্ঠী ঠাকরুন। কোলে কাঁখে ধারণ করে আছে খোকা-খুকি। এখন এই গাছ রাঁড়ি। সবারই এই গতি।

সন্ধে হলেই এই কাঁঠালতলায় গাঁয়ের আলুকুড়া, পর-পঁচিয়াগুলি হাজির হবে। মহুয়ার মদ গিলবে দমে, আর চাঁই-চণ্ডুল করবে। সুখীরামও গেলে। না গিলে করবে কী? কোলেতে বাচ্চা নয়, একটা রেডিয়ো থাকে ওর। অঁকবঁক হতেই থাকে। ঝিঝির শব্দের সঙ্গে রেডিয়োর অঁকবঁক আর মানুষ ক’টার ভেনভেনা মিলেই তো কাঁঠালতলার সন্ধ্যারাত।

এই আড্ডায় আসে মাকু হারানো তাতি বিশু আর ধনা। বিশু আসলে বিশ্বকর্মা, ধনা মানে ধনঞ্জয়। ওরা এখন বাবুই ঘাসের দড়ি পাকায়। আসে নয়নচাদ। ও হল রুইদাস। মানে মুচি। ওর এখন দুটো পয়সা হয়েছে। ছাগলের চামড়া বেচে। পঞ্চাননও আসে। ঘর ঘর থেকে মুড়ি কিনে নিয়ে মহাজনের ঘরে দেয়। সবারই মোটামুটি ডাল ভাত জুটে যায়। এই গাঁয়ের ও-ধারে পঞ্চাশ-ষাট ঘর সাঁওতাল। সুখীরামের ঠেকে ওদের কেউ বড় একটা আসে না।

গ্রামটা পত্তন করেছিল সাঁওতালরাই। নাম শুনেই বোঝা যায়। বাহা মানে ফুল, কুটরি মানে ঘর। জঙ্গল হাসিল করে তো গাঁ পত্তন হল। চাষের জমি হল। কিন্তু চাষ হবে কী করে? কোথায় পাওয়া যাবে লাঙল? দা-কাস্তে-কোদাল-হাসুয়া? তাই, সাঁওতালরা গাঁয়ে বসায় একঘর লোহার। লোহাররা এদিকে প্রায়শই মাহাত হয়। এই সুখীরামও মাহাত। সুখীরামের জ্ঞাতিগুষ্টিতে কেউ আর লোহার নেই। কেউ চলে গিয়েছে মেজিয়ার কয়লাখাদানে, কেউ গিয়েছে টাটায়, সুখীরামের বড়দাদা মরে গিয়েছে, ছোটভাই টাটানগর থাকে। সাইকেল সারাইয়ের কাজ শিখে এখন নিজেই ঝুপড়ি দোকান করেছে ওখানে। ওর ছেলেমেয়েরা গলায় টাই বেঁধে ইস্কুলে যায়। সুখীরাম এখন এ গাঁয়ে একা লোহার। সঙ্গে যে ছেলেটা কাজ করে, সে জাতে লোহার নয়, তাঁতি। তাঁত জানে না, এখন লোহা শিখছে। কলিতে সবই এলোমেলো।

কাঁঠালতলার সন্ধ্যারাতে একে একে এসেছে সবাই। কামারশালার কয়লার শরীর থেকে এখনও লাল আভা বেরুচ্ছে। নয়নচাঁদ দু-চারটি সক্কর কন্দ, মানে রাঙা আলু কয়লার ভিতর গুঁজে দেয়।

নয়নচাঁদ বলল, ইবার একটা ভটভটি কিনবার মন করছে। একটা সেকেনহ্যান খবর পেলে খবর দিয়ো।— শুঁড়ির ব্যাপারি পঞ্চাননকে বলে। সুখীরাম মনে ভাবে এরেই বলে কলি। মুচি ঘরের ছেলে বলছে ভটভটি কিনবে।

তুমিও একটা কিন্যে লাও তো, দুটা ভটভটি হলে ছ’জনে মিলে ঘুরে বেড়াতে পারব। পুরুল্যে শহর যাব, অযোধ্যা পাহাড়, চাই কি ডিমলা লেক.., তোমার কী আছে। এমন ভসকো মেরে থাকলে চলবে?

সুখী বলে, গরবে পরব দেখছ? ভটভট কিনব হামি? ঘর ভংভং, দুয়ারে কুলুক।

ঘর ভংভং কেন বলছ হে? ডেলি শ’টাকা উপর কামাই করো। বউএর ফুলি ত্যালের খরচা নাই, খঁকাখুকির লজেন খরচা নাই।

পঞ্চানন ফুট কাটল, আলুপটলের খরচা নাই।

একদম ইমপটেন কথা— বিশু বলল।

সুখীরাম সবই বুঝল। আলুপটলও বুঝল, ইমপটেনও বুঝল। এসব নিয়ে রাগ করে না আর। রাগ করে লাভ নেই। নিভন্ত আংরায় একটু হাপর চালিয়ে এল। রাঙা আলুগুলো নরম করতে হবে। মহুয়ার সঙ্গে দরকার।

‘ইনপটেন’ শব্দটা হাটের কবিরাজি ওষুধের ক্যানভাসারদের কাছ থেকে শিখেছে ওরা। লিঙ্গ লরোম, ধাত পাতলার ওষুধ ব্যাচে যারা তারা বক্তৃতায় ওই শব্দটা খুব বলে। একদিন ইমপটেন কথাটার মানে নিয়ে খুব তর্কও হয়েছিল। পঞ্চানন বলেছিল, ইটার দুটা অর্থ আছে। একটা ইস্কুলের ম্যাসটররা বলে। এই অঙ্কটা ইমপটেন বটে, এই খবরটা ইমপটেন বটে। আর একটা কবিরাজ ডাক্তারটা বলে। যন্তরটা ল্যাংপ্যাং হয়ে যাওয়াটাকেও ইংরাজিতে বলে ইমপটেন। যেমন আমাদের এই সুখীরাম।

সুখীরাম কিন্তু মনে মনে দুখীরাম। সবাই জানে ওর বউ চলে গিয়েছে কেন। সবাই জানে ওর যন্তর ল্যাংপ্যাং। ওর স্যাঙাৎরা ওকে ভোস্‌কা বলে ডাকে। কথায় কথায় ওকে শুনিয়ে ইমপটেন বলে। ওর হাতের পেশি যেন মিছামিছি। বুকের খাঁজ থেকে যে ঘাম ঝরে, সেটা যেন চোখের। এই যে হাপর টানে, শব্দ করে পুরুষ শব্দ বের হয় ফুসফুস থেকে, ওটাও মিছামিছি। লাল ওগলানো আঙারের ভিতর থেকে লোহা টেনে এনে হাতুড়ির ঘা মারে, বলে, হেই মারো ইমপটেন, শালা মারো ইমপটেন, মারো জোরে ইমপটেন….

রাঙা আলুক’টা নিয়ে এল সুখীরাম। পঞ্চানন যে তখন বলেছিল তুমার আলুপটলের খরচা নাই, সিটা খোঁচামারা কথা। চুম মেরে থাকাই ভাল। ঢেলায় ঢেলা ভাঙার দরকার নাই। আমি আলুবাজি করি না তো তর কী? মেয়াছেলা দেখে ছঁকছঁক করা কি ভাল? গ্লাসে মহুয়া ঢালে সুখীরাম। বলে, হামার দেখি কান তলে উকুনের ডেরা। হামার পয়সার মাল খেঞে হামাকেই খঁটা দিছিস। হামার ইমপটেন তো আমি কী জানি? হেঁতরাপী ভগবান। সে যা কইরেছে সে বুঝে। ইসব উঠাসনি। হামি সুখীরাম তখন দুখীরাম বনে যাই।

নয়নচাঁদ বলে, বটে, বটে। উসব যাক কেনে। লৈতন কথা বল, ভটভটি-টডভটি সব হল গে চটপটি কথা। একটা বুদ্ধি দিছি। তুইও একটা বকরি রাখ কেনে।

হামি বকরি রাখে কী করব? হামার ঘরে কি ছুটকা-ছুটকি আছে যে দুধ লাগবে?

নয়ন বলে, তা কেনে, তুমি লিজে খাবে, তাগদ হব্যেক।

বিশু বলে, দু’বচ্ছর ঘুরলে কতগুলান ট্যাকা।

পঞ্চানন বলে, দিদিমণির লেখেন বলার কী দরকার। আসল কথাটা হল বোদা হলে উটা মেরে আমরা খাব।

কেনে? তুরা তদের ঘরের বোদাটা মারতে পাছিস না? সুখীরাম বলে।

হামদিগের যে পরিবার আছে। হামাদিগের যে হিসাব আছে। হামদিগের বোদার কেজি দর। তোর বোদা সভার ঘর।

সুখীরাম বলে, আমার অত হ্যাপার দরকার নাই। ভালা বঠি, হাপর টানি, মাল্লু খাই, বোদা রেখ্যে কাম নাই।

পঞ্চানন বলে, ওর হ্যাপা কই। এতবড় কাঁঠালগাছটা, দুটো ডাল ভাঙবি আর ছাগল বকরির খুশি দেখবি। খুশি দেখতে মন করে না? পঞ্চানন গেয়ে ওঠে—

আকাশের ওই ম্যাঘের মাঝে

হামার কিষ্টো ওই বিরাজে

বলি চন্দ্রাবলী দেখবি যদি আয়—

সুখ ফুটেছে কদম ডালে

সুখের লাউটা ঘরের চালে

বলি চন্দ্রাবলী সুখ দেখবি আয়—

হামার কিষ্টো ছাগল বাঁটে

দিঘির জলে, ধানের মাঠে

বলি চন্দ্রাবলী দেখবি যদি আয়…

কামারশালার কোদাল শাবল দিয়ে বাকিরা তাল দিতে থাকে।

এবারে নয়নচাঁদ শুরু করে দেয় ওর স্বরচিত ঝুমুর—

সুখ রয়েঁছে মাল গিলাসে

সুখ রয়েঁছে বোঁদার মাঁসে

বলি চন্দ্রাবলী কিষ্টো লিবি আয়…

ক’দিন পর জিপ হাঁকিয়ে সুখীরামের কাছে দু’জন হাজির। এক দিদিমণি, অন্যজন একটা স্যার। এইসব দিদিমণিদের বে-থা হয়েছেন কি না-হয়েছে বুঝা যায় না। শাঁখা তো মোটে পিন্ধে না। সিঁদুর কারুর কারুর চুলের ভিতরে জঙ্গলের ভিতু খরগোশের মতো লুকিয়ে থাকে। এরা হল এনজিও দিদি। দিদিমণি বললে, কী সুখীরাম, গাঁয়ের সব্বাই ছাগল নিয়েছে তুমি নিলে না কেন?

সুখী বলল, আমার আর ঝামেলা ভাল লাগে না। ভালই তো খাকরিতেলা আছি।

না, ওসব শুনব না। সবাই নিয়েছে, তোমাকেও নিতে হবে। তোমার ছাগল কেনার পয়সা নেই— এটা বলতে পারবে না। একটা ভাল জাতের মাদি ছাগল দিয়ে যাব। মাসে একশো টাকা করে শোধ করবে।

সুখীরাম মাথা নাড়ায়।

দিদিমণি ওর গায়ে হাত দেয়। বলে, সবাই না-না করেছিল প্রথমে। এখন দ্যাখো, এ গাঁয়ের সবাই ছাগল বেচা টাকায় কেমন বোলচাল পালটে ফেলেছে। তোমার তো কিচ্ছু ঝামেলা নেই, ছাগল চরাবার লোক আছে। আরে, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করার মতোই তো। দরকারমতো বেচে দেবে।

গায়ে একটু ঝাঁকুনি দেয় দিদিমণি। দিদিমণির গায়ের সুবাস, প্যাঁচ দিয়ে পরা শাড়ি, চশমার ভিতরের উড়িংফড়িং চোখ, সব নিয়ে বিবশ মতন হয়ে যায় সুখীরাম। চুম মেরে থাকে।

তোমার স্যাঙাৎরাই তো আমায় পাঠাল। বলল, সুখীকে রাজি করান গে যান।

সুখী সব বুঝল। ওকে মুরগি নয়, পাঁঠা করা হচ্ছে। কিন্তু দিদিমণিকে নিষেধ করতে পারল না।

দিদিমণি একটা কাগজ দিল। ওটা দেখালে সেন্টার থেকে ছাগল পাওয়া যাবে। ইচ্ছে করলে গ্রাম থেকেও মাদি ছাগল কেনা যায়, কিন্তু ওরা সেন্টার থেকেই কিনতে বলে। ওইগুলো হল ভাল জাতের পাঁঠার পাল খাওয়ানো ছাগল। ওরা বলে বটে ছাগল সেয়ানা হলে, ডাক ছাড়লে, সেন্টার থেকেই পাটনাই পাঁঠার পাল খাইয়ে আনতে। কিন্তু ওসব হয় না। ছাগল যখন চরতে যায়, তখন পালের পাঁঠারা ছাড়বে কেন?

ছ’কিলোমিটার দূরে বান্দোয়ান। সুখীরাম একটা মেয়ে ছাগল পেল। ছাগলের গলায় একটা লকেট। টিনের পাতে নম্বর। ৬৩২। সব ছাগলই কালো রং-এর। দেখতে একরকম। ছাগল যেন গণ্ডগোল না হয়, তাই এই নম্বর। আস্তে আস্তে ছাগল বাড়ি চিনে যাবে। তার পর ছাগল যখন মা হবে, তখন ছাগলের সন্তানরা মায়ের গা ঘেঁষেই থাকবে। মা ছাগল যেখানে, ছা ছাগলও সেখানে।

একট বস্তায় ভরে ছাগলটাকে রডে বসিয়ে নিল সুখীরাম। সাইকেল চলছে। গলায় গয়না পরা ছাগলটা মাথা উঁচিয়ে মিহি মিহি ডাক ছাড়ছে। মাঝে মাঝে মুখ বার করে সুখীরামের দিকে লাজুক তাকাচ্ছে। সুখীরাম বেশ বুঝতে পারে ছাগলটা বলছে, এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমুন হত তুমি বলো তো।

সুখীরাম বলল, তুমিই বলো।

ছাগল বলল— চিঁহি।

সুখীরাম ছাগলটার নাম রাখল দুলি। দুলি ওর ছেড়ে যাওয়া বউ-এর নাম।

সুখীরামের বিয়ে দিয়েছিল ওর বাবা। সুখীরামের বয়স তখন ছিল বাইশ, দুলির পনেরো বছর। রোগাপানা দেখতে, ইক্কেবারে লেদাগাছটা, কিছুই বুঝত না, জানত না। সুখীরামই ওকে বুঝা করাল, জানা করাল। যখন বুঝদার হল, তখন সে ঘুঙুরের লেখেন ঝপলা। তখন সে মুখড়। তার জাঙে মাস লেগেছে, ছাতি হয়েছে পদ্মফুলের লেখেন। আর সুখীরাম অবাক দেখত, ঘাঁটাঘাঁটি করত। চুমা, আদর— কিন্তু দুলির ভিতরে অঙ্গ দিতে পারত না। ওর অঙ্গ যেন লতানো পতানো।

সুখীরামের যে এরকম হবে ও জানত না। ওর তো ঠিকই ছিল। বিড়ি খাওয়ার বয়সে সবাই যা করে, সুখীরামও করেছে। তখন তো বোঝেনি কিছু। আর বিয়ের আগে কখনও কোনও মেয়েছেলের শরীরে ঘষেনি। যা কিছু বে-থার পরে।

সুখীরামের ইচ্ছাগুলা, শরীরের বাইরে বর্ষার ব্যাঙের মতোই গঙায়, কিন্তু লাফ দেয় না। দুলির তাতা শরীর যখন দরজা খুলে দেয়, সুখীরাম ঘাড় কাত করে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।

কাউকে বলতে পারে না সুখীরাম। কাঁচা মুরগির ডিম খায়, রুইদাসদের ঘরে গিয়ে শুয়োরের মাংস খায়, হাটের জড়িবুটিও। হাটের কবিরাজের কাছ থেকে প্রতি হাটবারে ওষুধ নিয়েছে। তখনই জানাজানি হতে থাকে।

শেকড়ও বেঁধেছে কোমরে। একবার লজ্জার মাথা খেয়ে বান্দোয়ানের লাল তেকোণ আঁকা সরকারি হাসপাতালেও গেল। সেখানে ডাক্তার ছিল এক দিদিমণি। কিছু বলতে পারেনি সুখীরাম। এক বছর পর শুনল হাসপাতালে ব্যাটাছেলে ডাক্তার এসেছে। আবার গেল। লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলল স্তিরির সঙ্গে শোয়াশুয়ি হয় না। ডাক্তার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল কত কিছু। সুখীরামের সামনে পিছনে কত রুগি। সুখীরাম চোখবুজে সবই বলল। ডাক্তারবাবু বলল, তোমার মনের ভিতর ভয় আছে। ভয়টা তাড়াও। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কই, ঠিক তো হল না। কীসের ভয়? নিজের বিয়ে করা বউয়ের সঙ্গে ভয় কীসের? চার বছর ছিল দুলি। ও বড় ভাল মেয়ে। ও যাবার সময় কেঁদেছিল। বলেছিল, আমি কী করি বল, মা বলছে সাঙা দেবে।

চার বছরেও দুলির কোলে কেন ছা এল না, এ নিয়ে দুলির বাপের বাড়িতে যখন কথা ঘাঁটা হচ্ছিল, তখন দুলি বলে দিয়েছিল, ও পারে না। দুলির দাদা এসে যখন জিজ্ঞেসা করল সুখীকে, সুখী ‘হ’ কেড়েছিল। তার পর দুলিকে নিয়ে গেল। সাঙা দিল।

দুলির সঙ্গে এরপর দেখা হয়নি। পঞ্চানন মুড়ির কারবারি। ও দেখেছে দুলিকে। দুলির কোলে ছা ।

সুখী এখন জানে ও ‘ইমপটেন’। ও জানে ওর আর বাপ হওয়া হল না। মকর পরবে ওকে জামা-পিরান কিনতে হয় না, মেলা পরবে নাগরদোলা মিছামিছি ঘুরে যায়। জিলিপি গজার ব্যাপারিরা মিছাই ডাকাডাকি করে। কার জন্য কিনবে ও? অ্যাসিসটেন ছেলেটাকে লোহার কাজ শেখায়, ওকে মাইনে ছাড়াও দু-পাঁচ টাকা হাত খরচা দেয়। আর কোলে রেডিয়ো নিয়ে বসে থাকে। অঁকবঁক শোনে।

বাড়িতে ছাগল এল ভ্যাবভ্যাবিয়ে। গায়ে হাত বুলিয়ে কাঁঠালপাতা খাওয়াল। ভাত রান্না করে দুটো ভাতও দিল ওকে। গলার লকেটে ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

দু’দিন ওকে চরতে পাঠাল না। বাড়িতেই রাখল। তারপর বাগালকে দিল। বাগাল ছেলেটাকে বলল, দ্যাখ উকে মারাধরা করবি না। ছাগলটা সন্ধের সময় ফিরে সুখীকে তার সারাদিনের ভ্রমণ কাহিনি শোনায়।

ওর নাম দুলি রাখলেও সবার সামনে দুলি নামে ডাকে না সুখীরাম। লজ্জা করে। সবার সামনে ওকে ডাকে ভুলি। কিন্তু যখন সন্ধ্যার মাল খাওয়ার ঠেক সাঙ্গ হলে ভুলির গায়ে হাত বুলোয়, তখন ওকে দুলিই ডাকে। ছাগলটাও জানে ওর দুটো নাম আছে। একটা নাম মাঠের দুব্বোঘাস— ভুলি, আর একটা নাম কাঁঠালপাতা, — দুলি।

এই দুলি কিংবা ভুলিকে নিয়ে স্যাঙাৎদের কোনও উৎসাহ নেই। ওদের উৎসাহ ছাগলটার কবে বাচ্চা হবে, পাঁঠা হলে ফিস্টি হবে।

দুলি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। পালটে যাচ্ছে ওর জাং, ওর টুটি। নম্বর দেওয়া চাকতির দড়িটা টুটিতে আঁটো হচ্ছে। ওটা খুলে ফেলেছে সুখীরাম। ওর গলার স্বর পালটে গিয়েছে। ওর গায়ে কেমন বড়দের মতো গন্ধ হয়েছে। কড়াইদানার মতো বাঁটগুলো পুরুষ্ট হচ্ছে। ওর লেজের তলায় কী সুন্দর একটা লাড়িলুকু তৈয়ার হয়েছে। বাহারে যৈবন।

সুখীরাম এক টুকরো লোহাকে ফুল বানাল। ভিতরে ছিদ্র করে বাবুই দড়ি গলিয়ে দুলির গলায় পরিয়ে দিল। গায়ে লোহা থাকা ভাল। নজর লাগে না। দুলির সর্বাঙ্গে হাত বুলোয়। লুকুটাতেও। দুলি কিছু বলে না। আদর খায়।

একদিন ভোররাতে দুলি ডাক ছাড়তে লাগল। এ ডাকের মর্ম সুখীরাম বোঝে। একটা লম্বা দড়িতে বেঁধে দুলিকে কাঁঠালগাছে বেঁধে দিল সুখীরাম। পুলিশ গাড়ির মতো ভুস করে ধেয়ে এল এক মস্তান পাঁঠা। দুলির অঙ্গে অঙ্গ দিল। কামারঘরে বসে বসে সকালবেলায় ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে সুখী বোঝে ওর বুকের নেহাইয়ে হাতুড়ি পড়ছে। সুখীরাম বেশ বোঝে, ওর শরীরের ভিতরে কিছু হচ্ছে। জাগছে। ওর অঙ্গ তো তবে মরেনি। আবার কি ঠিক হয়ে যাবে সব? রতিরত পাঁঠাটির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয় সুখীরাম। হে রংকিনী মা, আমাকে মর্দানি দাও। তুমায় আমি বোদা চড়াব। এই দুলির গর্ভের বোদা। হুট করে মানত করে ফেলল ঈর্ষান্বিত সুখীরাম।

সুখীরাম এর আগে কখনও মানত করেনি। আজ এই রতিক্রিয়া দেখতে দেখতে মানত করে ফেলল।

রংকিনী মা নাকি খুব জাগ্রত। ওই মা রক্ত চায়। ভেড়া, পাঁঠা, হাঁস, মুরগি যে যা পারে বলি দেয় মকরের দিনে। সব মানসিকের বলি। আগে মানসিক পূরণ, পরে বলি নয়, বলি দিয়ে মানসিক করতে হয়। কত দূর দূর থেকে মানুষ যায় মায়ের পাহাড়ে। মকরের দিনে ইসপেশাল বাস যায়। এখান থেকে দু’ঘণ্টার পথ।

মানসিক যখন করাই হল, তখন প্রণাম করা হোক। দু’হাত জোড় করে প্রণাম করল। কেউ দেখে ফেললে অবাক হয়ে দেখত— রতিরত ছাগ যুগলকে ভক্তিভরে প্রণাম করছে সুখীরাম।

এক মুখ সুখ নিয়ে দুলি সুখীর কাছে এল। সকালের রোদুর পড়েছে ওর গায়ে। এবার চরতে যাবে দুলি।

বাগালটা ছাগল চরিয়ে এসে বলল, তুমার ছাগল আজ পাল খিঞেছে।

সুখীরাম দুলিকে মনে মনে বলল, কীরে দুলি, আবার? দুলির চোখে সুখী পড়তে পারল—‘বেশ করেছি… করবই তো।’

সুখীরাম দুলির যত্ন করে। কাঁঠালপাতাই শুধু নয়, মাঝে মাঝে খোল খাওয়ায়, গুড়জল খাওয়ায়। দুলির ক্রমশ পেট ফুলতে থাকে।

সাত মাস গভভো ধারণ করার পর দুলি তিনটে বাচ্চা দেয়, একটা পাঁঠা, দুটো পাঁঠি।

একদিন দিদিমণিদের গাড়ি এসেছিল। বলল, কী? দেখলে তো, ছিল পাঁচশো, এখন দু’হাজার, হিসেব করছ ক’মাসে?

এসব হিসাব করেনি সুখীরাম। এসবের কি হিসাব হয়? এই যে মায়ের দুধ খাচ্ছে ছানাগুলান, এ দৃশ্য দেখলে পুণ্য হয়। এই ছানাগুলার তিড়িং বিড়িং, বিনা কারণে আনন্দ, ইসব দেখলে আনন্দ হয়। ইসব দেখলে পয়সা লাগে না, আবার পয়সায় ইসব পাওয়া যায় না। সুখীরামের মনে হল এইবার যেন একটা সংসার হল। সকালের উঠানটা যেন এক গান। প্রভাত সময়ে সুখীর উঠানে ছাগল ছানাগুলি লাফায় রে।

তিনটে ছাগলছানার একটা বোদা। সুখীরামের স্যাঙাৎদের বোদাটার দিকেই নজর। যেন পৃথিবীতে পেঁয়াজ রসুন গরম মশলার জন্ম হয়েছে পাঁঠা খাবার জন্য। ক’দিন আগে একটা ফিস্টি হল গদাধরের বোদায়। গদাধরের ছেলে মাধ্যমিক পাশ দিয়েছে। একটা মওকা হলেই হল। হায়রে, বোদাগুলির জীবন শুধু মানুষের লুলুপুসু মিটানোর জন্য।

মানুষের আশা আকাঙক্ষাগুলি সব এক একটা বোদা। জন্ম হয়। কিন্তু বাঁচে না। মানুষই খেয়ে নেয়।

স্যাঙাৎরা বলে, কী হে সুখী, কবে হচ্ছে পাট্টি?

ভোজের নাম পালটে হয়েছিল ফিস্টি। এখন নয়া আমদানি হল পার্টি।

সুখীরাম বলে, এত ব্যস্ত কেন, গতরে মাস লাগতে দাও।

দুর্গাপুজোর টাইম এল। কালো পাঁঠার দাম চড়ল। পাঁঠার পাইকার ভাল দাম দিতে চাইল। সুখী বেচল না। বেচবে কী করে? ওটা তো রংকিনীর। স্যাঙারাতাগাদা দিল। বলল, তোমার বোদা তো গায়ে গতরে ভালই হয়েছে। কচি থাকতে থাকতে খাওয়া ভাল। তা ছাড়া শীতও পড়ল। কবে হবে?

সুখীরাম বলল, ওটা রংকিনী মায়ের কাছে মানসিক করা আছে। মকরে মাকে দিই, তার পর তুদের সবার পেসাদ দূব।

রংকিনী মায়ের সঙ্গে ইয়ারকি নয়। মানসিক যখন করাই আছে, তবে বলিটা হয়ে যাক।মা তো পাঁঠাটাকে খেয়ে নিচ্ছে না। শুধু মুড়াটা ওখানে দিয়ে আসতে হয়।

স্যাঙাৎরা বলল, তোমার আবার মানসিক কী? কার জন্য? জিজ্ঞেস করল, কীসের কারণে মানসিকটা বলল শুনি।

সুখীরাম বলল, মানসিকের কথা কি কাউকে বুইলতে হয়?

রংকিনীর মন্দিরটা ঝাড়খণ্ডের ভিতর পড়েছে। যদুগোড়ার কাছে যে রংকিনী, সেটা নয়, এটা অন্য একটা। বান্দোয়ান থেকে টাটা যাবার রাস্তায় সুটিয়া পাহাড়ের মাথায় রংকিনীর থান। পুরুলিয়া, দুমকা, সিংভূম, মেদিনীপুর এমনকী ময়ূরভঞ্জ থেকেও মানুষ আসে ওখানে। এই সমস্ত কাঁকুড়ে জঙ্গুলে মানভূম এলাকার মানুষদের জীবনযাপন, ধর্ম বিশ্বাস, গান বাজনা, খাওয়াদাওয়া, মান অভিমান যতই প্রদেশ ভাগ, জেলা ভাগ, ব্লক ভাগ হোক না, একইরকম। একইরকম জাঁত-করম বাঁদনা-মকর। ঝুমুর-ঢুয়া-বাহা। মহুয়া-হাঁড়িয়া-কুকড়া লড়াই। এ-ধারে ও-ধারে শুধু সরকারি অফিসের মোহর পালটে যায়, আর কিছু নয়।

মকরের ক’দিন আগে থেকে গাঁয়ে টুসু গায় মেয়েরা। এ বছর একটা নতুন টুসু গান হয়েছে—

হামার টুসু এই মকরে

সিলিক শাড়ি পিনিছে

স্বয়ম্ভরের ছাগল বিকে

হাজার টাকা পেয়েছে।

গত রাত্রে সারা গাঁয়ে বাটনা বাটার শব্দ। মকরের পিঠা। বাড়িঘর সব লেপাপোঁছা। কেউ কেউ ঘরে চিতর দিয়েছে। ছোটবেলায় মকরের ভোরে ফুলপাতান দেখেছে সুখী। স্নান করে এসে দুটো ছেলে ফুল পাতান দিত। মানে দোস্তি। ইয়ে দোস্তি হম নেহি ছোড়েঙ্গে। মেয়েরা সই পাতান করত। ভোরবেলায়, যখন সূর্য উঠব উঠব করছে, পুকুরে গিয়ে স্নান করে নিল সুখী। কয়েকটা গ্যাঁদা ফুল তুলল। দুটো মালা গাঁথল। একটা নিজে পরল, আর একটা পাঁঠার গলায় পরাল। একটা কাচা কাপড় আর নতুন কেনা শার্ট পরে নিল। বোদাটাকে কাঁধে চড়িয়ে বড় রাস্তার দিকে চলল সুখীরাম। কাঁচা রাস্তা দিয়ে তিন কিলোমিটার মতো পথ হেঁটে পিচ রাস্তায় যখন পৌঁছল তখন রাস্তার মোড়ে সুফলা ইউরিয়া আর কনডোম লেখা টিনের পাত শীতের রোদে ঝিলিক দিচ্ছে।

এই পিচ রাস্তায় টাটা বান্দোয়ানের বাস চলে। আজকে ইসপেশাল বাসও আছে। সুখীরাম বাসের জন্য দাঁড়িয়ে, কাঁধে বোদা। সুখীরামের মতো আরও দু-তিন জন দাড়িয়ে। ওদেরও কাঁধে বোদা। ওরা ভিন গাঁয়ের।

সুখীরাম একাই যাচ্ছে। স্যাঙাৎরা কেউ গেল না। পঞ্চানন অন্য মেলায় মুড়ির মোয়া বেচবে। নয়নচাঁদের তো আজকেই দিন। পৌষ পরবে কত পাঁঠা মারা হবে। কত চামড়া পাওয়া যাবে আজ। অন্যরাও সব যে যার মতো ব্যস্ত। ওদের বলা আছে সন্ধের মধ্যে ফিরে আসবে সুখী। রাত্রে কিছুটা হবে, বাকিটা মশলা মাখিয়ে রাখা হবে। আগামিকাল আবার হবে। ওরা বলেছিল, মকরের মধ্যেই কেন ফেললি, মকরে তো এমনিতেই হয়ে যায়। তবে রংকিনী মায়ের কাছে যখন বলা হয়েই গেছে, তখন আর কিছু বলার নাই।

একটা বাস এল। বাসের কাচের গায়ে চুন দিয়ে লেখা ‘জয় রংকিনী মা’। বাস ভরতি। ছাদেও লোক। পিছনের সিঁড়ি বেয়ে ছাতে উঠল। দু’জন লোক সুখীরামকে সাহায্য করল। বোদাটা ধরল।

বাসের ছাদে অনেক লোক, আর অনেক পশুপাখি। পাঁঠা, ভেঁড়া, হাঁস, মুরগি। ভ্যা, প্যাক প্যাক, কোঁকড় কো।

বাসের ছাদে যে যার জানোয়ার জড়িয়ে ধরে বসেছে। সুখীরাম ভাবে এইসব পশুপাখিদের কপালে লেখা একই দিনে মরণ।

তবে এই মরণ তো এনা-তেনা মরণ নয়। মা চাইছে তাই।

শীতের হাওয়া। বনবাদাড় অন্যরকম। কত গাছের পাতা ঝরে গেছে। জঙ্গল পাতা পড়ে যাওয়া গাছের ডালে ডালে চুপ মেরে আছে হায় হায়।

বাসের ছাদে শীতের হাওয়া একটু বেশিরকম। হাওয়া ঢুকছে চাদর ফুঁড়ে। যে যার পাঁঠাগুলিকে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরে। সুখীরামের পাঁঠাটিও সুখীরামের কোলে গাঢ় হয়। পাঁঠাটি চোখ বোজে।

ঢেউ খেলানো মাঠ। মাঠে এখন ধান নেই। আছে ধান কাটার চিহ্ন। মাঠ চিরে একটা পেঁচানো কালো ভাঙা রাস্তায় লাফাতে লাফাতে চলে মেলার বাস। বাস ভরতি আশা আকাঙক্ষা ঠাসা।

নিজের বোদাকে জড়িয়ে ধরেছে সুখীরাম। আশা আকাঙক্ষা। কামনা বাসনা। এই বোদাটা আজ মায়ের ভোগে যাবে।

বাসটা যেখানে থামল, সেখান থেকে মায়ের পাহাড় আধ কিলোমিটার মোরাম ফেলা পথ। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ যাচ্ছে মায়ের পাহাড়ে। এই রাস্তায় বাস চলে না। কিন্তু জিপ যাচ্ছে, একগাড়ি পুলিশ চলে গেল। পুলিশেরও তো কামনাবাসনা আছে।

মোরাম রাস্তার ধারে ধারে গাছের তলায় চকচকে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি সাজিয়ে মেয়েরা বসেছে। ওরাও নতুন কাপড় পরেছে। কেউবা নতুন ম্যাকসি। সুখীরামের একটু রসি খাবার ইচ্ছে হল। রসি হচ্ছে ভাত গেঁজানোর পর যে জলটা তৈরি হয় সেটা। সেই জলের মধ্যে গেঁজানো ভাত চটকে মেখে নিলে হয় হাঁড়িয়া।

বলি চড়াতে গেলে উপোস করে থাকাই ভাল। কিন্তু রসি হাঁড়িয়া খেলে দোষ নেই। উপোসে চা খেলেও দোষ নেই। বামুনরাই তো বলে। শারুল-করমে পনরা তো টুকুস হাঁড়িয়া খেয়েই আসে। অনেকেই তো বসেছে। হাঁড়িয়া খাচ্ছে। ওদের সঙ্গেও তো বোদাটোদা রয়েছে। সুখীরাম একটা হাঁড়িয়া ঠেক পছন্দ করে নেয়। একটু পছন্দসই মেয়েরা যেখানে আছে। রসি আর নেই। শেষ। এতক্ষণ কি থাকে? হাঁড়িয়াই সই। প্রথম বাটিটা এক চুমুকেই শেষ করল সুখীরাম। টাটকা শালপাতায় দেওয়া নুনে আঙুল ডুবিয়ে জিভে ছোঁয়ায়। দ্বিতীয় বাটিটা প্রায় শেষ করে ছাগলছানাটার মুখের সামনে ধরে। ছানাটা একটু গন্ধ শোঁকে। সুখীরামের দিকে তাকায়। চোখে জিজ্ঞাসা। সুখীরাম বলে, মেরে লে, জীবনে সব কিছু করে লেয়া ভাল। ছানাটা একটু চোখ পিটপিট করে চুমুক মেরে খেয়ে নেয়। থুতনির নোম বেয়ে দু-চার ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে। নাকের উপর সদ্য ওঠা গোঁফেও হাঁড়িয়া চিহ্ন। আরও দু’বাটি হাঁড়িয়া চেয়ে নিল সুখীরাম। মেয়েটা এক মুখ হাসিও দিল। পয়সা লাগে না। একবার সাজানো ছোলা মটরের দিকে আঙুল উঁচাল। সুখীরাম মাথা নাড়ল। উপোস থাকতে হয় কিনা। এবার ছানাটা বায়না করল। ছোলা খাবে। সুখী বলল, না, উপোস থাকতে হয়। বলি হবে না? বরং হাঁড়িয়া খা। দোষ নেই। ছাগটা জিভ দিয়ে চেটে চুকচুক করে হাঁড়িয়ে খেল আর একটু। মেয়েগুলি হেসে উঠল।

ছানাটাকে কোলে তুলে নিল সুখী। এগিয়ে চলল সামনে।

পাহাড়তলার মাঠে কত দোকান। পশরা। কুমোরের হাঁড়িকুড়ির পাশে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি। ওখানেই ভিড়। প্লাস্টিকের বালতি, প্লাস্টিকের গামলা। কত রং। দা-বঁটি-ছুরি নিয়েও বসেছে ক’জন। কাচের চুড়ি, প্লাস্টিকের চুড়ি। কদমতলে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে চোখে নীল চশমা পরা ঝাঁকড়া-চুলো। তেলের মধ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে ফুলুরি-বেগুনি। মাছিরা সব পার্টির মিটিন বসিয়েছে জিলিপির উপর।

অনেক পুলিশ, দমকলের লাল গাড়ি, সাহেব অফিসারদের গাড়ি। মাইকে হিন্দিতে বলছে ঝাড়খণ্ড কা আদরণীয় বিত্তমন্ত্রী আজ মাতৃপূজা কে লিয়ে আয়েঙ্গে। সুখীরাম বুঝতে পারল কেন এত পুলিশ, এত গাড়ি। সুখী ভাবে মন্ত্রীর আবার কী কামনা বাসনা পূর্ণ হতে বাকি আছে। ও জানবে কী করে? মন্ত্রী কি ওর কামনা বাসনা জানে?

হিন্দিতে অনেক কথা বলছে মাইকে। এটা তো ঝাড়খণ্ড রাজ্য। বাসে আসার সময় কখন যে পশ্চিম বাংলা ছেড়ে ঝাড়খণ্ডে ঢুকে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। একই তো মাঠঘাট গাছ বনবাদাড়। এখানে যারা কথা বলছে, জিলিপি দোকানে, হাড়িয়ার ঠেকে, তারা কেউ হিন্দি বলছে না, ছবিওলাটা হাঁকছে আসেন, আসেন, ভালেন, মাধুরী, রানি, ঐসরজ, শতাব্দী, জোতি বোস, অর্জুন মুণ্ডা, বাজপেয়িজি, শাহরুক…। ও-ধারে হাঁকছে— আশ্চর্য ইলেকট্রিক মেয়াঁছেলে, হাত দিলে কারেন মারে….।কিন্তু এ-ধারের সরকারি মাইকে যা বলাবলি হচ্ছে সব হিন্দিতে। যা হোক গে যাক। সুখী এবার পাহাড়ে উঠবে।

পাথর কেটে কেটে সিঁড়ি করা হয়েছে। আঁকাবাঁকা সিঁড়ি উপরে উঠে গিয়েছে। দু’ধারে বাবলাগাছ, কুরচি, বুনো গন্ধরাজ, কেঁদ। আরও কত গাছ, সব গাছের নাম জানার দরকার কী? গাছ আলাদা, ওদের ছায়ারাও আলাদা। ছায়া মাখতে মাখতে উপরে ওঠে ওরা। অনেক লোক উঠছে। প্রায় সবার কাঁধেই একটা করে মনস্কামনা। অনেকে নামছেও। ওই তো, একটা লোক নামছে। ওর কাঁধে নেতিয়েপড়া একটা দেহ। দেহটা ভেড়ার। মুণ্ডুহীন মনস্কামনা। বলি হয়ে গিয়েছে। মুণ্ডুটা মায়ের থানে থাকে। লোকটার জামায় রক্ত। রক্তে মাছি। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়াচ্ছে। রংকিনী পাহাড়ের বাতাস চাটছে ওই রক্ত। রংকিনী পাহাড় আজ হাপুটে। আজ মায়ের উত্থান।

খাড়াই সিঁড়ি। হাঁফ ধরে। একটু উপরে উঠে একটা বড় পাথর। ওখানে একটু জিরেন করা যায়। অনেকে বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। একটু বসল সুখীরাম। একজন লোক রংকিনী মায়ের মাহাত্ম্য-কথা বলছে। বলছে রংকিনী মায়েরা হল চাইর বহিন। বড়কা বহিন রংকিনী মা। মাঝলা বহিন তারিণী মা। ঘটগাঁয়ে হল উনার থান৷ তিসরা বহিন কেঁড়া মা। চক্রধরপুরের কাছে উনার থান। ছোটকি বহিন আকর্ষণী। সরাইকেলার কাছে উনার থান। আজ এই পাহাড়ে চাইর বহিন এসে মিলেন। উনাদের মিতমিতানরাও সব আসেন। রাতের বেলা চাইর বহিন মিলে ঝুমুর গাইবেন। বাজা বাজাবে গাছপালা, পশুপক্ষী। আজ রাতে ঝিমা জঙ্গলের জাগন। আর মা আজ ডাহিডুলা। ভক্ত যা চাইবে ‘হ’ বলবেন।

তারপর একজন একটা গান ধরল, অন্যরা সবাই গানের শেষে একসঙ্গে বলতে থাকল বোড়াম।

মারাং মা, বড়কা মা

বোড়াম।

বিলান বিত্‌তা টুয়া লাগা

বোড়াম।

চেরাই মেরাই কত দূর যাই

বোড়াম।

মকর দিনে ফুলের মালা

বোড়াম।

গাই ধলা ছেঁড়ি কালা

বোড়াম।

লাল বনে চুমচুমি

বোড়াম।

বুঢ়ি আইলেন গুমগুমি

বোড়াম।

মায়ের থানে ধূপধুনা

বোড়াম।

কঁকাকুয়া হীরা মনা

বোড়াম।

লালবন ভেঙ্গে যাই

বোড়াম।

মায়ের দয়া যদি পাই

বোড়াম…।

চরণ সুখী খকা খুকি

বোড়াম।

সর্ব অঙ্গ দন্ডবতী

বোড়াম…।

পাথর চাতালে প্রণাম ঠোকে সবাই। সুখীরাও প্রণাম ঠুকতে ঠকতে বলে, কী কারণে এসেছি মা তুমি তো জানো। ভিতরের কথা। বাবা ডাক শুনার বড় শখ।

সুখীরাম ওঠে। পাঁঠাটাকে কাধে তুলে নেয় ফের। উঠতে থাকে। একটু একটু পা টলছে।

পাঁঠাটা বলল, কুথা লিয়ে যাচ্ছে হামাকে বলো দেখি?

মায়ের কাছে।

কেনে?

ইখনও বুঝিস লাই? তোর বলি হবে।

পাঁঠাটা চুপ। পাঁঠাটাকে কাঁধে চাপিয়ে দু-হাতে ঠ্যাংগুলান চেপে ধরে উঠতে থাকে সুখীরাম।

গাছগাছালির ছায়া মাখানো রোদুর। পাখির ডাক। কাঁঠালগাছ।

পাঁঠাটা হঠাৎ বলল, মইরতে চাহি না আমি সোন্দর ভুবনে।

বাব্বুস? কী হল রে তোর? ওইটুকুস হাঁড়িয়ে খেঁঞে ইতত বড় কথা হাঁকড়াইছিস!

বড় কথা বুলছ কেনে? ইটা ত একটা খুব ছুট কথা গো—বাঁইচব।

মরা বাঁচার আমি কী জানি? উসব তো ভগবানের হাতে।

ভগবানটা কী বটে!

মাথা চুলকোয় সুখীরাম। কী করে বোঝায়? বলে, ভগবান হলেন গিয়ে ইসব জমির জমিদার। সব গাছপালা পাহাড়ের মালিক। তোর হামার মালিক। জীবন তেনার হাতে।

কিন্তু হামার ছাগল-জীবন যে রইল পতিত, আবাদ কইরলে…

তুই আবার কী আবাদ করবি রে পাগল! তোর ছাগল-জীবন তো পরের লেইগ্যে।

এ জীবনটা কী বটে? এ জীবন লিঞে কী কইরতে হয়?

মাথা চুলকোয় সুখীরাম। বড় কঠিন কঠিন প্রশ্ন শুধাচ্ছে ছাগলটা। পাগলটা। ওহ্‌, ছাগল যদি তত্ত্বকথা ছাড়ে তবে হামিও ছাইড়ব।

সুখী বলে, জন্মিলে মরিতে হবে। অমর কে কুথা কবে?

ছাগল বলে, জীবন, জীবন রে। তুই ছেইড়ে পলাইলে বল সোহাগ করব কারে।

দেহটা হল গিয়ে ঢাকনা। লাউ-এর খোলার ভিতরে আছে আসল বীজ। খোলা দিয়ে টুংটুঙি হয়, ওটা কিছু না। তোর চামড়া দিঞে জুতা হবে, তবলা-ঢোলের ছানি হবে, তোর মাংস দিয়ে ভোজি হবে, পাট্টি হবে। উটাও কিছু না। পঞ্চভূত। আসল কথা তোর আত্মা যাবে সগ্‌গে।

উটা কোথায়?

অনেক দূরে। ভাল জায়গা।

সগগের কথা বলছিল বটে এক বুড়া ইদুর। জঙ্গলে। বলছিল, উলুখুলু পাকা ধানের জমিন থেকে দাঁতে কেটে যখন ধানের শিষ গর্তে ভরে, সেই গর্তের মধ্যে লুটাপুটি খায়, সিটাই সগ্‌গ।

—তোর সগ্‌গেও কাঁঠালগাছ আছে। অনেক কাঁঠালপাতা।

—আর তুমার সগ্‌গে?

চুপ মেরে যায় সুখীরাম। কী আছে ওর স্বর্গে? বাবা ডাক?

সুখীরাম পাঁঠাটির ঠ্যাং ক’টি চেপে ধরে পাহাড়ের উপর উঠতে থাকে। মৃত্যু উপত্যকার দিকে উঠতে থাকে।

পাঁঠাটি আবার বলে, তবে আমাকে মারতেই লিচ্ছ?

সুখীরাম বলে, হামি কে? কুছু না। হেঁতরূপী ভগবান। যার যেমন পরমায়ু তার তেমন গতি।

—বুঝলাম। পাঁঠাটি চুপ করে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, মরণ রে তু আমার কাঁঠালের পাতা।

বাঃ। বেশ মরণকে মেনে নিয়েছে পাঁঠাটা। চুপচাপ বসে আছে ঘাড়ে। মোটেই ছটফট করছে না আর।

ওই তো পাহাড়ের মাথা দেখা যাচ্ছে। ঘণ্টার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মানুষের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। জয় রংকিনী মা শোনা যাচ্ছে, বোড়াম রংকিনী মা শোনা যাচ্ছে।

সুখীরাম পাঁঠাটার পায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, হামাকে খারাপ ভাবিস না। হামি ইখেনে না আনলেও মরতিস। সাপে খালেঅ খাবেক আর বাঘ খালেঅ খাবেক। হামার স্যাঙাৎরা কি তুকে ছেড়ে দিত পাগল? তুকে দিচ্ছি মায়ের কাছে। মা খুশি হলে বাবা ডাক শুনব। বাবা ডাকে পাপ কাটে। হামারলাগি নয় টুকুস উপকারটা করলি।

পাহাড়ের মাথায় উঠে গেল সুখীরাম। ওখানে একটা বিরাট বড় পাথর। সেই পাথরটাই হল রংকিনী মায়ের থান। ওই পাথরটার সামনে হাঁড়িকাঠ। হাঁড়িকাঠের সামনে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। গলায় জবার মালা পরা ‘ভলেনটার’ লাইন ঠিক করছে। সুখীরামও লাইনে দাঁড়ায়। লাইন এগিয়ে যাচ্ছে হাঁড়িকাঠের দিকে। লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলির কোলে কাঁখে কাঁধে সেঁধিয়ে আছে যারা, তারা ক্রমশ এগুচ্ছে হাঁড়িকাঠের দিকে। রংকিনীর থান লালে লাল। হাঁড়িকাঠ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত পাথর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নীচে। তারপর থ মেরে গিয়েছে রক্ত নিজেই। জমা রক্তের উপর কাক বসেছে। পাথরের এক পাশে স্তুপ হয়ে গিয়েছে পাঁঠা ভেড়া হাঁস মুরগি কবুতরের মাথা। সব মাথাগুলি মিলে একটা স্তৃপ। এর মধ্যে কোনটা কালুর, কোনটা ভুলোর, কোনটা লালুর, কোনটা ছানুর বোঝা যায় না। মাথার উপরে সূর্য। হাওয়া। হাওয়ায় পাতা খসে সুখীর ছাগলছানাটার গায়ে পড়ে। ধানদুব্বো। সামনে আর দু’জন মাত্র। একটা বলি সমাধা হতে এক মিনিটও লাগে না। কোলের ছাগল ছানাটার দিকে তাকাল সুখীরাম। আর দু’মিনিট। ছাগল ছানাটা আকাশের নীলের দিকে তাকাল। কুরচি ফুলের গাছের দিকে, ঝরা পাতার ঘূর্ণি নাচের দিকে, পাহাড়ের তলার রোদ পোহানো মাঠের দিকে তাকাতে লাগল। সুখীরাম শুনতে পেল, আমার সাধ না মিটিল আশা না মিটিল সকলই ফুয়ে যায় মা…

জয় মা রংকিনী। হুংকার উঠল সামনে। হাঁড়িকাঠের সামনে থেকে রক্তমাখা হাত এগিয়ে এল সামনে। সুখীরাম ছাগলছানাকে তুলে দিল ওই হাতে। ছাগলছানাটা সুখীরামের দিকে তাকিয়ে ডাকল বা-বা…। একটা লোেক ছানাটার পা দুটো ধরল। হাঁড়িকাঠের ভিতরে মাথাটা ঢুকিয়ে আটলটা পরিয়ে দিল। আর একটা লোকের হাতে উদ্যত খাড়া। তখনও আবার বাবা ডাক শুনল সুখীরাম। তীব্র, স্পষ্ট। ছানাটা চিৎকার করছে বা-ব্বা…. ।তখন উদ্যত খড়গ। সুখীরাম ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সুখীরাম ফিরছে। নেমে আসছে পাহাড় থেকে। যারা নেমে আসছে, সবার কাঁধেই একটা করে কবন্ধ শরীর। শুধু সুখীর কাঁধেই একটি প্রাণ।

হাঁড়িয়ার ঠেকের কাছে এসে পাঁঠাটা কাঁধ থেকে নামায়। বলে, ছোলা খাবি? খা। আর দোষ নাই।

শারদ সংবাদ প্রতিদিন ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *