সুকুমার সেন-লিখিত ভূমিকা
[শরদিন্দু অম্নিবাস ষষ্ঠ খণ্ডে সুকুমার সেন-লিখিত ভূমিকায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক গল্প সম্পর্কিত অংশটুকু এখানে প্রাসঙ্গিকতা সূত্রে পুনর্মুদ্রিত হল। ]
গল্পের (এবং উপন্যাসের) প্রধান গুণ— একমাত্র গুণ হ’লেও ক্ষতি নেই— মনোহরণ-সামর্থ্য। যত বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন সমাজের ব্যক্তির এবং যত বেশি ব্যক্তির ভালো লাগবে গল্পের গুণ ততই স্বীকৃত হবে। এই মাপে বিচার করলে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের মান ও মর্যাদা উঁচুদরের। একদা গল্প লেখা হত পদ্যে। তখন গল্পের কোনো পাঠক ছিল না, ছিল শ্রোতা, এবং শ্রোতাদের অবসর ও ধৈর্য এখনকার পাঠকের মতো পরিমিত ছিল না। তাই কথকের চেষ্টা ছিল গল্পের সূত্রকে পাকিয়ে পাকিয়ে যতদূর পারা যায় টেনে যাওয়া। এই কাজে সহায়ক ছিল ভাষা এবং সে ভাষার বাহন সঙ্গীত। একালের গল্প-কবিতা সঙ্গীতের নভোযানে আবির্ভূত হয় না, তাকে যেতে হয় ছাপা বইয়ের পৃষ্ঠায় প্রবহমান গদ্যের রাজপথে। সে পথ যতই অবন্ধুর ও সরল হবে গল্পের গতি ও আকর্ষণ ততই বাড়বে। শরদিন্দুবাবুর গদ্যরীতির অনায়াস-সৌষম্যের কথা আগে বলেছি তাঁর ডিটেক্টিভ গল্পের প্রসঙ্গে। এখানে সে কথা তুলছি এইকারণে যে অত্র ষষ্ঠ খণ্ডে শরদিন্দুবাবুর প্রথম দিকের রচনা অনেকগুলিই আছে। সে সব রচনাতেও তাঁর প্রসন্ন-বাহিনী লেখনীর টানা স্রোত ব’য়ে চলেছে। এ গল্পগুলির অধিকাংশই ঐতিহাসিক-রঙা।
ইতিহাসের কাহিনী নিয়েই আমাদের দেশে গদ্য গল্পের সূত্রপাত। বিগত শতাব্দীর ঠিক মাঝখানে শশিচন্দ্র দত্ত ইংরেজীতে কিছু গল্প লিখেছিলেন ইতিহাস অবলম্বনে। শশিচন্দ্রের পথ অবলম্বন ক’রে ভূদেব মুখোপাধ্যায় বাংলায় দুটি গল্প লিখেছিলেন। তার মধ্যে একটি ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীতে কিঞ্চিৎ ছায়া ফেলেছে। বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসকে পশ্চাৎপট ক’রে তাঁর রোমান্সগুলির গল্প জমিয়েছেন। তার পর শশিচন্দ্রের স্নেহলালিত ভ্রাতুষ্পুত্র রমেশচন্দ্র দত্ত রীতিমত ইতিহাস-অনুগত উপন্যাস লিখলেন। ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হ’ল। ঐতিহাসিক উপন্যাসেরই খণ্ড ছিন্ন রূপ দেখা গেল হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের গল্পে। তার পর এলেন যদুনাথ ভট্টাচার্য। ইনি বাংলার ইতিহাস থেকে কিছু বীর পুরুষ বেছে নিয়ে কল্পনা সংযোগে উপন্যাস লিখলেন। তা স্বদেশী এবং ঐতিহাসিকও হ’ল বটে কিন্তু ঠিক উপন্যাস হ’ল না, অর্থাৎ পাঠকের মন ভোলাতে পারে নি। তার পরে এলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় পূর্বগামীদের সঙ্গে এঁর কিছু পার্থক্য ছিল। রাখালদাস ইতিহাসের পাঠক ছিলেন না, ছিলেন ইতিহাসের গবেষক এবং ইতিহাসের লেখক। ইনি ইতিহাস বিদ্যাকে অধিগত করেছিলেন, তাই তাঁর উপন্যাসের ঐতিহাসিক মালমশলা টাটকা সবজির মতো স্বাদু। রাখালদাসের উপন্যাস পড়লে ইতিহাস পড়ার ফল হয়। গল্পরসও আছে, কিন্তু সে রস খাঁটি হ’লেও নবীন নয়। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রেরই জের টেনেছিলেন। সাধারণ পাঠকের কাছে রাখালদাসের উপন্যাস— বোধ করি ‘ময়ূখ’ ছাড়া— যতটা সমাদর পাওয়া উচিত ছিল ততটা পায় নি। সে দোষ হয়ত সম্পূর্ণ সাধারণ পাঠকের নয়।
তার পরে এলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি ঐতিহাসিক ছিলেন না। ভারতবর্ষের ইতিহাস উদ্ধারের কোন মহৎ ব্রত ইনি অবলম্বন করেন নি। শরদিন্দুবাবু ছিলেন ইতিহাস-পিপাসু পাঠক, ভক্ত। আগেকার লেখকদের মতো শরদিন্দুবাবু দূরবীনের চোঙার মধ্য দিয়ে কিংবা নাকে দূরদৃষ্টির চশমা এঁটে ইতিহাস হাতড়ান নি বা খোঁজ চালান নি। ইনি যেন চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স লাগিয়ে ইতিহাসকে হাতের নাগালে পেয়েছিলেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত শরদিন্দুবাবুর ঐতিহাসিক গল্পের কালপ্রসার। এর মধ্যে কোথাও গল্পের পরিবেশ গল্পরসের তীক্ষ্ণতার হানি করে নি। দূরের দৃশ্যপটকে নিকটে এনে দূরের মানুষকে কাছের মানুষ করতে পেরেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এইখানেই ঐতিহাসিক গল্পলেখক রূপে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব।
আগেকার ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসে মোগল-অন্তঃপুর, শাহী দরবার, আরাবল্লীর গিরিদুর্গ— এসব নিয়ে অনেক অনেক লেখা হ’য়েছে। শরদিন্দুবাবু তাই মুসলমান অধিকার কালে তিন-চারটির বেশি গল্প ফাঁদেন নি। দুটি গল্পের কাল আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে (‘শঙ্খ-কঙ্কণ’ ও ‘রেবা রোধসি’), একটি শিবাজীর বিষয়ে (‘বাঘের বাচ্চা’) আর একটির কাল শাহ সুজার সময়ে (‘তক্ত্ মোবারক’)। দুটি গল্পের কাল পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী (‘রক্ত-সন্ধ্যা’ ও ‘চুয়াচন্দন’)। তিনটি গল্পের কাল চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে (‘মৃৎপ্রদীপ’, ‘অষ্টম সর্গ’ ও ‘মরু ও সঙ্ঘ’) এবং তিনটি খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দীতে কল্পিত (‘অমিতাভ’, ‘বিষকন্যা’ ও ‘সেতু’)। একটির কাল হ’ল আর্যদের আগমনের গোড়ার দিকে (‘প্রাগ্জ্যোতিষী’), একটির কাল তারও আগে (‘ইন্দ্রতূলক’)। একটির কাল প্রাচীন তবে অনির্দেশ্য (‘রুমাহরণ’)। আর একটির বীজ মিশরের প্রাচীন ইতিহাস থেকে নেওয়া (‘আদিম’)। বাকী ঐতিহাসিক গল্পটির কাল রচনার (১৯৩৬) প্রায় সমসাময়িক (১৯৩৪— ‘চন্দন-মূর্তি’)।
দূর-কালের ইতিহাসকে বর্তমান কালের গোচরে আনবার যে অভিনব কৌশলটি শরদিন্দুবাবু অবলম্বন করেছেন তা হ’ল জাতিস্মর কল্পনা। শরদিন্দুবাবু জাতিস্মর ঘটনায় বিশ্বাসী ছিলেন কি না ঠিক জানি না— বোধ হয় ছিলেন। কিন্তু সে যাই হোক তিনি যে গল্প রচনায় স্বীয় জাতিস্মরতা প্রতিপন্ন করেছেন তা সহৃদয় পাঠক অবশ্যই স্বীকার করবেন। শরদিন্দুবাবুর জাতিস্মর সাহিত্যদৃষ্টিই ভূতকালের ভূতত্বের সপিণ্ডীকরণ ক’রেছে।
অত্র খণ্ডে সঙ্কলিত ত্রিশটি গল্পের মধ্যে সতেরটি ঐতিহাসিক। তার মধ্যে পাঁচটি ‘বৌদ্ধ’ কালের। বৌদ্ধধর্মের ও ‘বৌদ্ধ’ যুগের ইতিহাসের উপর শরদিন্দুবাবুর টান একটু বেশি ছিল। তার কারণও আছে। এঁর জীবনের পূর্বাংশ কেটেছিল দক্ষিণ মগধ অঞ্চলে। পাটলিপুত্র, রাজগৃহ, শ্রাবস্তী এঁর সবিশেষ পরিচিত ছিল। শরদিন্দুবাবুর আগে গুপ্ত যুগের আগেকার ইতিহাস নিয়ে কেউ গল্প-উপন্যাস লেখেন নি (অবশ্য নাটক লেখা হয়েছিল আলেকজাণ্ডারের ভারত-আক্রমণ ও তার পরবর্তী ঘটনা নিয়ে, বুদ্ধের জীবনী নিয়েও। কিন্তু সে-সবের কাহিনী চর্বিত চর্বণ ছাড়া কিছু নয়। রাখালদাসের ‘হেম-কণা’ বা ‘পাষাণের কথা’ ঠিক গল্প উপন্যাস নয়। ) ‘বৌদ্ধ’ ইতিহাসে শরদিন্দুবাবুর আগ্রহ যে কতটা গভীর তার পরিচয় রয়েছে ‘মরু ও সঙ্ঘ’ গল্পে। চীনীয় তুর্কিস্থান একদা সরস উর্বর ভূখণ্ড ছিল। সেখানে বৌদ্ধধর্মের বিশেষ চর্চা হ’ত। কালক্রমে গোবি মরুভূমির বালিরাশি সে ভূখণ্ডকে গ্রাস ক’রে ফেলে এবং সব কিছুই বালিতে চাপা পড়ে যায়। বর্তমান শতাব্দীর প্রারম্ভে চীনীয় তুর্কিস্থানের মরুভূমি খুঁড়ে প্রাচীন শহরের ও বিহারের ভগ্নস্তূপ এবং বহু লেখ পাওয়া যায়। তাতে সে দেশের ইতিহাস, সে দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্বন্ধ এবং তত্র বৌদ্ধধর্মের পরিণতি সম্বন্ধে অনেক তথ্য মিলেছে। চীনীয় তুর্কিস্থানের এই মরুগ্রাস ঘটনাকে অবলম্বন ক’রে এই গল্পটি লেখা হয়েছে।
আমার সব চেয়ে বিস্ময় লেগেছে ‘অষ্টম সর্গ’ গল্পটির অসাধারণ কৌশলে ও দক্ষতায়। কালিদাস তাঁর কুমারসম্ভব কাব্য ক’ সর্গ পর্যন্ত লিখেছিলেন তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে দু-চার শ’ বছর ধরে বিতণ্ডা চলে এসেছে। কতক পণ্ডিত বলেন কালিদাস সপ্তম সর্গে শিব-পার্বতীর বিবাহ ঘটিয়ে দিয়েই কাব্যটি শেষ করেছিলেন। কতক পণ্ডিত মনে করেন যে অষ্টম সর্গটিও কালিদাসের লেখা। এঁদের যুক্তি হ’ল, অষ্টম সর্গের রচনায় কালিদাসের লেখনীর স্পর্শ যেন বোঝা যায়, এবং মল্লিনাথও অষ্টম সর্গ পর্যন্ত ব্যাখ্যা লিখে গেছেন। নবম থেকে সপ্তদশ সর্গ পর্যন্ত অংশটি যে কালিদাসের লেখা নয় তা বুঝদার পণ্ডিত মাত্রেই স্বীকার করেন। কয়েকজন নেই-আঁকুড়ে অবশ্য এ নয় সর্গও কালিদাসের রচনা ব’লে মানেন। শরদিন্দুবাবু গল্পটির মধ্যে দেখাতে চেয়েছেন যে কালিদাস সাত সর্গ পর্যন্ত লিখে থেমে গিয়েছিলেন। কারণ আমাদের অলঙ্কার শাস্ত্রমতে বিবাহঘটনার পরবর্তী দাম্পত্য সহবাস কাব্যে অথবা নাট্যে বর্ণনীয় বিষয় নয়। কাব্যনামটির কথা স্মরণ ক’রে কবির মন বাসরঘরের চৌকাট অবধি এসে থেমে যাওয়ায় মন সরছিল না। যেভাবে তাঁর কবিদৃষ্টি দেবদম্পতির দ্বারপ্রান্ত থেকে উঁকি দেবার ঔৎসুক্য পেয়েছিল। তাই-ই রচনাটির গল্পসত্ত্ব।
— যবে অবশেষে
ব্যাকুল শরমখানি নয়ননিমেষে
নামিল নীরবে, কবি, চাহি দেবী-পানে
সহসা থামিলে তুমি অসমাপ্ত গানে ॥
— রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই ইঙ্গিতটুকু শরদিন্দুবাবু অত্যন্ত সহৃদয়তায় ও দক্ষতায় তাঁর গল্পে এঁকে দিয়েছেন।
একটি ঐতিহাসিক গল্পেও লেখকের নিপুণ কুশলতা দেখিয়ে দেওয়া আবশ্যক। ‘চন্দন-মূর্তি’ গল্পটিতে ‘বৌদ্ধ’ যুগ প্রায় গল্প-রচনার কাল পর্যন্ত টেনে আনা হ’য়েছে। গল্প-সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কালেরও পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন শরদিন্দুবাবু সমসাময়িক বিহার ভূমিকম্পকে উপলক্ষ্য ক’রে। লেখক নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অভিনবত্ব দেখিয়েছেন।
ঐতিহাসিক গল্পগুলির মধ্যে ‘আদিম’ একটু দুর্বল। তার কারণ এ গল্পের কাহিনীতে ইতিহাসের খেই ঠাসবুনোনি গাঁথতে পারে নি। ইতিহাস প্রাচীন মিশরের। সে ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের মনের সম্পর্ক কিছু নেই। প্রাচীন মিশরের রাজ-সংসারে ভাইবোনের বিয়ে হ’ত প্রধানত রাজবংশের বিশুদ্ধি রাখবার জন্যে। সাধারণ সমাজে ভাইবোনের বিয়ে কতটা চলত তা জানি না, তবে কিছু হয়ত চলত। তবে আমাদের কাছে এ ব্যাপার অত্যন্ত ঘৃণ্য ঠেকে। শরদিন্দুবাবু গল্পটিতে দেখাতে চেয়েছেন, যে ভালোবাসা জন্মাবধি তা রক্তের মধ্যে রয়ে যায়। তাই সোমভদ্র শেষ পর্যন্ত শফরীকে পরিপূর্ণ ভালোবেসেই বিয়ে করলে।
বর্তমান মুহূর্তে রামায়ণের ঐতিহাসিক আলোচনা-প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে যে পালি জাতকে রামের গল্পে সীতাকে তাঁর ভগিনী এবং ভার্যা বলা হয়েছে। এই সূত্রে কেউ কেউ বলছেন যে আমাদের দেশে সুপ্রাচীন কালে হয়ত ভাইবোনের বিয়ে অজ্ঞাত ছিল না। শরদিন্দুবাবুর গল্পটির প্রসঙ্গে এই অনুমানের বিষয়ে আমার মন্তব্য এখানে উপস্থাপিত করলে আশা করি উৎকটরকম অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
বৈদিক দেবতাদের কারো কারো আচরণে ভগিনীবিবাহের মতো অত্যন্ত অবৈধ প্রচেষ্টার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু বৈদিক মিথলজি এত প্রাচীন এবং এমন জটিল যে তার থেকে কোন বিশেষ মানবগোষ্ঠীর সামাজিক রীতিনীতির কোন নিষ্কর্ষ পাওয়া যায় না। ঋগ্বেদের অর্বাচীন অংশে যে যম-যমী সূক্ত আছে তার থেকে উল্টা সিদ্ধান্তই করতে হয় যে ভাই-ভগিনীর বিবাহ আর্যসমাজে অত্যন্ত ঘৃণ্য ব্যাপার গণ্য হ’ত। যমী যমকে বিবাহ করতে চায়, যম কিন্তু কিছুতেই রাজি নয়, সে বলে সূর্যের চোখ মুহুর্মুহু উন্মীলিত হয়ে দিন রাত্রি করছে, স্বর্গ ও মর্ত্য মিথুন, আত্মীয়, আর যমী যমের সঙ্গে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করবে।
ভ্রাতা-ভগিনীর সংলাপের ফল যে কী হয়েছিল তার কোন হদিস নেই ঋগ্বেদে। তবে পরবর্তী বৈদিক ঐতিহ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে যমের মৃত্যু ঘটেছিল। এখনকার গল্প হ’লে যমীর আক্রমণ এড়াতে যম আত্মহত্যা করত।
মনে হয় পালি জাতকের গদ্য অংশে ভুল ক’রে সীতাকে রামের পত্নী করা হয়েছে। আসলে হয়ত সীতা ভগিনীই। তার কারণ বলছি। খ্রীস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চীনা ভাষায় অনুবাদ করা একটি জাতকে— এই জাতকের মূল পালিতে পাওয়া যায় নি— রাম-কথা আছে। সেখানে রাম লক্ষ্মণ ও সীতা ভাইবোন। বনবাস অন্তে অযোধ্যায় ফিরে এসে রাম ও সীতা সিংহাসনে বসলেন এবং তাঁদের বিবাহ হ’ল। এইখানেই গোল বেধেছে। রাম-সীতা পতি-পত্নী হ’লে আগেই উল্লেখ থাকত। তা নেই। মনে হয় ভাইবোনে যুগপৎ রাজ্য করেছিল, তারা রাজা ও রানী। জাতকটি যিনি লিখেছিলেন তিনি রাজা ভাই ও রানী বোনকে প্রচলিত প্রথায় স্বামী-স্ত্রী ক’রে দিয়েছেন।
ঐতিহাসিক গল্পগুলির অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। সাধারণ পাঠক স্বচ্ছন্দো ‘ঐতিহাসিক’ মন্তব্যটুকু বাদ দিতে পারেন। তাতে গল্পগুলির ঘটনার বৈচিত্র্য ও নাটকীয়তার এবং বর্ণনার জাদুর কিছুমাত্র খর্বতা ঘটবে না। গল্পগুলি শিক্ষাগর্ভ নয়, গল্পগুলিতে পাণ্ডিত্যের কর্কশতা নেই, এগুলি বিশুদ্ধ রোমান্টিক এবং সহৃদয় ও উপাদেয় গল্প।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বগামী লেখকদের ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসে ‘জীবন্ত’ ভূমিকা যে মেলে নি এমন নয়। কিন্তু সে-সব ভূমিকা জীবন্ত হয়েছে বাইরের আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হওয়ায়, অর্থাৎ লেখকের উজ্জ্বল বর্ণনায় উদ্ভাসিত হওয়ার ফলে। শরদিন্দুবাবুর গল্পের ভূমিকাগুলি জীবন্ত হয়েছে বাইরের থেকে আলোকসম্পাতে নয় তাদের অন্তরের জ্যোতি থেকেই। শরদিন্দুবাবুর বর্ণনা নয় তাঁর দৃষ্টিই ভূমিকাগুলিকে ইতিহাস-মঞ্চের পুতুলীবাজি থেকে নামিয়ে এনে যেন সমসাময়িক জীবনে ভূমিষ্ঠ করিয়েছেন। …(২৮.২.১৯৭৬)
.
গ্রন্থ-পরিচয়
ছেলেবেলা থেকেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে ইতিহাস সম্পর্কে একটা মোহ ছিল। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেছেন : ‘ঐতিহাসিক গল্প লেখার প্রেরণা পাই বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে শিখেছি ভাষার মধ্যেই বাতাবরণ সৃষ্টি করা যায়— বিশেষ করে ঐতিহাসিক বাতাবরণ। ইতিহাস থেকে চরিত্রগুলো কেবল নিয়েছি; কিন্তু গল্প আমার নিজের। সর্বদা লক্ষ্য রেখেছি কি করে সেই যুগকে ফুটিয়ে তোলা যায়। যে সময়ের গল্প তখনকার রীতি নীতি, আচার ব্যবহার, অস্ত্র, আহার, বাড়িঘর ইত্যাদি খুঁটিনাটি সব না জানলে যুগকে ফুটিয়ে তোলা যায় না। এরপর আছে ভাষা। ঐতিহাসিক গল্পের ভাষাও হবে যুগোপযোগী।’
তিনি স্বীকার করেছেন, ‘ইতিহাসের গল্প লিখেই বেশি তৃপ্তি পেয়েছি। মনে কেমন একটা সেন্স অব ফুলফিলমেন্ট হয়। গৌড়মল্লার ও তুঙ্গভদ্রার তীরে লেখার পর খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম। চুয়াচন্দন লিখেও তাই হয়েছিল।’ (জীবনকথা, শরদিন্দু অম্নিবাস, দ্বিতীয় খণ্ড)
শরদিন্দুবাবুর ইতিহাস্য-আশ্রিত গল্প ও উপন্যাসের সংখ্যা হল যথাক্রমে সতেরো এবং পাঁচ। এই কাহিনীগুলি বর্তমান গ্রন্থের দুই অংশে রচনাকাল অনুসারে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে।
শরদিন্দু অম্নিবাস ষষ্ঠ খণ্ডে সুকুমার সেন মহাশয়ের লেখা ভূমিকা থেকে শরদিন্দুবাবুর ঐতিহাসিক গল্পগুলি সম্পর্কে মন্তব্য বর্তমান সঙ্কলনের পরিশিষ্ট অংশে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
জাতিস্মর। রমেশ ঘোষাল। ৩৫ বাদুড়বাগান রো, কলিকাতা। দ্বিতীয় সংস্করণ, শ্রাবণ ১৩৫১। পৃ. [৪] + ১০৩। মূল্য দুই টাকা।
প্রথম প্রকাশ— ফাল্গুন, ১৩৩৯।
সূচী ॥ অমিতাভ; মৃৎপ্রদীপ; রুমাহরণ।
‘তিনটি ইতিহাসগন্ধী গল্প এই গ্রন্থে স্থান পাইল। সবগুলিই ইতিপূর্বে সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে; স্থানে স্থানে সামান্য পরিবর্তন করিয়াছি।
জাতিস্মর শ্রেণীর গল্প বাংলাভাষায় নূতন হইলেও বিদেশী সাহিত্যে নূতন নয়। আমি যতদূর জানি, বিখ্যাত মার্কিন গাল্পিক জ্যাক্ লণ্ডন্ ও সর্ববিদিত ইংরাজ সাহিত্যিক স্যার আর্থার কোনান্ ডয়েল্ এ-বিষয়ে পথপ্রদর্শক; জাতিস্মরের মুখ দিয়া গল্প বলাইবার চেষ্টা তাঁহাদের পূর্বে আর কেহ করেন নাই। এই দুই স্বর্গীয় লেখকের নিকট আমার ঋণ কৃতজ্ঞ হৃদয়ে স্বীকার করিতেছি।
‘অমিতাভ’ গল্পের মূলে একটুখানি পৌরাণিক কিংবদন্তী ছাড়া আর কিছুই নাই। ‘মৃৎপ্রদীপ’-এর আখ্যান-বস্তু সম্পূর্ণ কাল্পনিক— কেবল কুমারদেবী, চন্দ্রগুপ্ত, চন্দ্রবর্মা, সমুদ্রগুপ্ত এই নামগুলা ঐতিহাসিক। চন্দ্রবর্মার দিগ্বিজয় যাত্রাও সত্য ঘটনা। ‘রুমাহরণ’ গল্পে মানবসভ্যতার গোড়ার কথাটা বলিবার চেষ্টা করিয়াছি।
ইতিহাসের ঘটনাকে যথাযথ বিবৃত করাই ঐতিহাসিক গল্পের উদ্দেশ্য বলিয়া আমার মনে হয় না। তৎকালিক আবহাওয়া যদি কিছুও সৃষ্টি করিতে পারিয়া থাকি, তবেই উদ্যম সার্থক হইয়াছে জানিব। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও বাৎস্যায়নের কামসূত্র হইতে এই বিষয়ে অনেক সাহায্য পাইয়াছি।’— ভূমিকা
প্রচ্ছদপটের উপর পুষ্পপাত্র, শনিবারের চিঠি ও আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এবং ভিতরে ফরওয়ার্ড ও প্রবাসীতে প্রকাশিত সমালোচনার অংশবিশেষ উদ্ধৃত। গ্রন্থশেষে ‘প্রাচীন শব্দের অর্থ’ দেওয়া আছে।
নূতন সংস্করণ ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত; ৭ই আষাঢ় ১৩৬৩।
দ্বিতীয় সংস্করণ, ভাদ্র ১৩৬৪। পৃ. [১০] + ১১৭। মূল্য দু টাকা আট আনা। গ্রন্থারম্ভে ‘প্রাচীন শব্দের অর্থ’ দেওয়া আছে।
অমিতাভ গল্পটি ‘শ্রেষ্ঠ গল্পে’ ও যুক্ত।
মৃৎপ্রদীপ গল্প সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য : ‘কুমারহারে প্রাচীন পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় জঞ্জালস্তূপের মাঝে একটি মাটির প্রদীপ কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। মুখের কাছে একটু যেন পোড়া দাগ লেগে রয়েছে। খননকারীরা হয়তো এটা ফেলে গেছেন কিম্বা তাঁদের নজরে আসেনি। সেটি কুড়িয়ে এনে বাড়িতে টেবিলের উপর রেখে দিলাম এবং রাত্রে সেটি জ্বালালাম। কয়েকদিন ওই জ্বলন্ত প্রদীপটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ‘মৃৎপ্রদীপ’ গল্পটি মাথায় আসে।’ (জীবনকথা, শরদিন্দু অমনিবাস, দ্বিতীয় খণ্ড)
বাঘের বাচ্চা, রক্ত-সন্ধ্যা ও চুয়াচন্দন এই তিনটি গল্প অন্যান্য গল্পের সঙ্গে ‘চুয়াচন্দন’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল।
চুয়াচন্দন। রমেশ ঘোষাল। দ্বিতীয় সংস্করণ, ফাল্গুন ১৩৫২। পৃ. [৪] + ১৫৮ + ৪। মূল্য তিন টাকা।
প্রথম প্রকাশ— অগ্রহায়ণ ১৩৪২।
“…‘রক্ত-সন্ধ্যা’য় ভাস্কো-ডা-গামার চরিত্র সম্পূর্ণ ইতিহাসসম্মত, কোথাও রং চড়াইবার চেষ্টা করি নাই। যাঁহারা এই ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ব্যক্তিটির সম্বন্ধে সবিশেষ জানিতে উৎসুক, তাঁহারা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের অমূল্য পুস্তক ‘ফিরিঙ্গি-বণিক’ পাঠ করিয়া দেখিতে পারেন।
এই গল্পে ‘ফিরিঙ্গি’ শব্দ মূল্য অর্থে (Frank = ফিরিঙ্গি = য়ুরোপীয় যে কোন জাতি) ব্যবহৃত হইয়াছে; বর্তমানের কোনও সম্প্রদায় বিশেষকে কটাক্ষ করা হয় নাই। বলা বাহুল্য, যে-সময়ের গল্প সে-সময়ে উক্ত সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না।
‘চুয়াচন্দনে’র একটি ঘটনার জন্য বিদ্যাপতি ঠাকুরের নিম্নোদ্ধৃত পদটির নিকট আমি ঋণী—
‘তঁহি পুন মোতি-হার টুটি পেলল
কহত হার টুটি গেল।
সব জন এক এক চুনি সঞ্চরু
শ্যাম দরশ ধনি কেল’। …”— ভূমিকা
শেষের চারটি পৃষ্ঠায় প্রমথনাথ বিশীর লেখা ‘চুয়াচন্দন’ গ্রন্থের সমালোচনা (শনিবারের চিঠি, আষাঢ় ১৩৪৩) মুদ্রিত।
তৃতীয় সংস্করণ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স কর্তৃক প্রকাশিত; অগ্রহায়ণ ১৩৬২। পৃ. [৮] + ১৬৯ + √ .। মূল্য তিন টাকা।
চতুর্থ সংস্করণ, অগ্রহায়ণ ১৩৬৮। পৃ. [৬] + ১৫৮। মূল্য তিন টাকা পঁচিশ নয়া পয়সা।
এই সংস্করণে প্রমথনাথ বিশীর সমালোচনা বাদ দেয়া হয়।
গল্প তিনটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য : “বাঘের বাচ্চা’র মূল কথাটি Elphinstone-এর History of India-র একটি পংক্তিতে পাওয়া যায়। অন্য কোথাও উহার উল্লেখ আছে কিনা জানি না। স্যার যদুনাথের ‘শিবাজী’তে কিছু নাই।’ (লেখকের নোটস)।
“চুয়াচন্দন’ লিখে [খুব তৃপ্তি] হয়েছিল। মুঙ্গেরে স্কুলের টিচার কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে একটি বই পড়তে দেন। সেটি পড়েই চৈতন্যের গোড়ার জীবন নিয়ে গল্প লেখার ইচ্ছা হয়। চুয়াচন্দন ছ’বার লিখেছিলাম। যতক্ষণ না লিখে তৃপ্তি হচ্ছে শান্তি নেই। (জীবনকথা, শরদিন্দু অম্নিবাস, দ্বিতীয় খণ্ড)
[‘রক্ত-সন্ধ্যা’] : ‘আমি মুঙ্গেরে থাকি। সন ১৩৩৭ সাল। তখন সবে মাত্র গল্প লিখতে আরম্ভ করেছি, বড় জোর পাঁচ-ছটা লিখেছি। বেশীর ভাগই বর্তমান কালের গল্প, কেবল একটি জাতিস্মর জাতীয় প্রাচীনকালের কিংবদন্তী মূলক কাহিনী। তাতে ভগবান বুদ্ধ পলকের জন্য দেখা দিয়েছেন।
নতুন ধরণের কিছু লেখার ইচ্ছা, কিন্তু উপযুক্ত বিষয়বস্তু পাচ্ছি না। জাতিস্মরের আইডিয়া তখন মাথায় চেপে বসেছে। কিন্তু অভিনব উপকরণ না পেলে তো ও জাতীয় কাহিনী লেখা যায় না। মনটা ছটফট করছে।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের ফিরিঙ্গি বণিক বইখানা কি করে আমার হাতে এল এতদিন পরে আজ আর তা মনে নেই। ইতিহাসের উপর আমার চিরদিনের ঝোঁক, বইখানা হাতে পেয়েই পড়তে শুরু করে দিলাম।
পড়তে পড়তে মনে হল জীবন্ত চিত্রের প্রবাহ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কালিকট নগর, সমুদ্রতীরের বন্দর, ভাস্কো-ডা-গামার প্রথম ভারতে পদার্পণ; তারপর লোভী নিষ্ঠুর ফিরিঙ্গির সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান বণিকের সংঘাত। বই যখন শেষ হল তখন রক্ত-সন্ধ্যা গল্পটিও আমার মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে।
লিখতে আরম্ভ করলাম। ঐতিহাসিক সত্যের ওপর কল্পনার প্রলেপ দিয়ে, নতুন চরিত্র ও ঘটনা তৈরি করে জাতিস্মরতার ফ্রেমে তাকে বসালাম। মনে আছে গল্পটা লিখতে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, সহজে লেখা বেরোয়নি।
সে আজ চৌত্রিশ বছর আগেকার কথা। রক্ত-সন্ধ্যা প্রথম মাসিক বসুমতীতে বেরিয়েছিল। অর্বাচীন লেখকের রচনা রসিকজনের কাছে আদর পেয়েছিল ভেবে আজও আনন্দ পাই।’(ডায়েরি, ২৫ জুন ১৯৬৪)
বিষকন্যা। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স। দ্বিতীয় সংস্করণ, ভাদ্র ১৩৫২। পৃ. [৬] + ১৯৭। মূল্য দুই টাকা আট আনা।
প্রথম প্রকাশ— ১৩৪৭।
সূচী ॥ চন্দন-মূর্তি; সেতু; মরু ও সঙ্ঘ; অষ্টম সর্গ; বিষকন্যা; প্রাগ্জ্যোতিষ।
‘সাত বৎসর পূর্বে যখন আমার প্রথম পুস্তক ‘জাতিস্মর’ প্রকাশিত হইয়াছিল তখন কল্পনা করি নাই যে রসিক-সমাজে উহা সমাদৃত হইবে। তারপর মাঝে মাঝে প্রাচীনকালের যে গল্পগুলি লিখিয়াছি সেগুলি এতদিন মাসিক পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই আবদ্ধ ছিল। এখন সেগুলি পুস্তকাকারে সংগৃহীত হইবার মত কলেবর লাভ করিয়াছে দেখিয়া তাহাদের একযোগে বিদগ্ধ মণ্ডলীর সম্মুখে উপস্থাপিত করিলাম।
ছয়টি গল্পের মধ্যে কেবল ‘বিষকন্যা’ গল্পটি জাতিস্মর জাতীয়। ‘চন্দন-মূর্তি’ ও ‘সেতু’ বর্তমান কালের গল্প। তবু যে এগুলিকে একসূত্রে গ্রথিত করিলাম তাহার কারণ সবগুলিতেই দূর অতীত কালের স্পর্শ কাছে। ‘প্রাগ্জ্যোতিষ’ গল্পের জাতি সম্পূর্ণ আলাদা হইলেও উহাকে এই পর্যায়ভুক্ত করিবার ইহাই কারণ।
‘অষ্টম সর্গ’ গল্পে যে-যুগের অবতারণা করিয়াছি সে যুগের কোনও স্পষ্ট ইতিহাস নাই, বিভিন্ন মতাবলম্বী অনুমান মাত্র আছে। যে মানুষগুলিকে এই গল্পে অবতারিত করা হইয়াছে তাঁহারা কোন্ শতকের লোক ছিলেন এবং একই কালে জীবিত ছিলেন কিনা, এই ক্ষুব্ধ প্রশ্নের মীমাংসা করা গল্পের বিষয়ীভূত নয়। ইতিহাসের অস্পষ্টতার সুযোগ লইয়া আমি তাঁহাদের সমসাময়িকরূপে কল্পনা করিয়াছি। কুমারসম্ভব কাব্যের অষ্টম সর্গ যে স্বয়ং কালিদাসের রচনা তাহা এই কাহিনীর প্রতিপাদ্য না হইলেও মুখ্য বক্তব্য বটে।’— ভূমিকা (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৭)
চতুর্থ সংস্করণ, আশ্বিন ১৩৬৩। পৃ. [৪] + ১৮৩। মূল্য তিন টাকা।
এই গ্রন্থটি পরে ‘ধরণী যখন তরুণী ছিল’ নামে আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত হয়। নূতন সংস্করণ, মে ১৯৬৪। পৃ. ১৮৩। মূল্য চার টাকা।
‘এই গল্পগুলি ইতিপূর্বে ‘বিষকন্যা’ নামে প্রচারিত ছিল। এখন নূতন নামে প্রকাশিত হইল।’— ভূমিকা
তৃতীয় মুদ্রণ, অগস্ট ১৯৬৯। পৃ. ১৬৮। মূল্য চার টাকা।
‘সেতু’ ও ‘প্রাগ্জ্যোতিষ’ গল্প দুটি ‘শ্রেষ্ঠ গল্পে’ ও যুক্ত।
তক্ত্ মোবারক ও ইন্দ্রতূলক গল্পটি অন্যান্য গল্পের সঙ্গে ‘শাদা পৃথিবী’ গ্রন্থে প্রকাশিত।
শাদা পৃথিবী। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স। প্রথম সংস্করণ, ১৩৫৫। পৃ. [৮] + ১৬৬। মূল্য তিন টাকা।
“…‘তক্ত্ মোবারক’ ঐতিহাসিক কাহিনী। পূর্বে আমি যত ঐতিহাসিক কাহিনী লিখিয়াছি, রোমান্সই ছিল তাহাদের লক্ষ্য, ‘তক্ত্ মোবারক’ গল্পে ইতিহাসের মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান করিয়াছি।
‘ইন্দ্রতূলক’ রচনাটি কেহ গাম্ভীর্যের সহিত গ্রহণ করিবেন এরূপ আশা করি না। উহা ‘হইলে হইতে পারিত’ গোছের পরিকল্পনা। কিন্তু জ্ঞাত ইতিহাসের সহিত তাহার কোথাও বিরোধ নাই। আর্যদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল এই ঐতিহাসিক তর্কের এখনও মীমাংসা হয় নাই। আর্যগণ য়ুরোপের আদিম অধিবাসী ছিলেন ইহা যেমন সাহেবদের আষাঢ়ে গল্প, আমার গল্প হয়তো ততটাই আষাঢ়ে, তাহার বেশী নয়।’— গ্রন্থকারের নিবেদন
দ্বিতীয় সংস্করণ, মাঘ ১৩৬২। পৃ. [৮] + ১৬৬। মূল্য তিন টাকা।
মূল ‘তক্ত্ মোবারক’ গল্পের ‘আলাবর্দি খাঁ’ নামটি বদল করে বর্তমান সংকলনে, শরদিন্দু অম্নিবাস ষষ্ঠ খণ্ডের মতো, আলিবর্দি খাঁ রাখা হয়েছে। এই শব্দটি পাঠকদের কাছে বেশি পরিচিত।
‘আদিম’ গল্পটি ‘এমন দিনে’ গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত।
এমন দিনে। ইণ্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিঃ। প্রথম সংস্করণ, ৭ই ফাল্গুন ১৮৮৩ শকাব্দ [ ১৩৬৯]। পৃ. [৮] + ১৮২। মূল্য তিন টাকা পঁচাত্তর নয়া পয়সা।
শঙ্খ-কঙ্কণ ও রেবা রোধসি গল্প দুটি ‘শঙ্খ-কঙ্কণ’ গ্রন্থে প্রকাশিত।
শঙ্খ-কঙ্কণ। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। প্রথম সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩। পৃ. [৪] + ১১২। মূল্য দুই টাকা পঞ্চাশ নয়া পয়সা।
অন্যভাষায় অনূদিত শরদিন্দুবাবুর কয়েকটি ঐতিহাসিক গল্পের নাম উল্লেখ করা হল—
হিন্দি : চুয়াচন্দন; মারাঠী : প্রাগ্জ্যোতিষ; মলয়ালাম : বিষকন্যা; কন্নড় : রক্ত-সন্ধ্যা, বিষকন্যা; গুজরাতী : রক্ত-সন্ধ্যা; চন্দন-মূর্তি, মরু ও সঙ্ঘ, অমিতাভ; ইংরাজি : চন্দন-মূর্তি (The Divine Image— ‘Green and Gold’, 1975), সেতু (Across— Indian Horizons, Vol. XXXIII, No. 4, 1974); ফরাসি : সেতু (A Traves)।
কালের মন্দিরা। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স। দ্বিতীয় সংস্করণ, আষাঢ় ১৩৬০। পৃ. ২+১৯৫। মূল্য তিন টাকা আট আনা।
প্রথম প্রকাশ— শ্রাবণ ১৩৫৮।
“এই কাহিনীর ঐতিহাসিক পটভূমিকা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙ্গালার ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম ভাগ দ্বিতীয় সংস্করণে এইরূপ পাওয়া যায়—
“মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। স্কন্দগুপ্ত যৌবরাজ্যে পুষ্য মিত্রীয় ও হূণগণকে পরাজিত করিয়া পিতৃরাজ্য রক্ষা করিয়াছিলেন। কথিত আছে, যুবরাজ ভট্টারক স্কন্দগুপ্ত পিতৃকুলের বিচলিত রাজলক্ষ্মী স্থির করিবার জন্য রাত্রি ত্রয় ভূমিশয্যায় অতিবাহিত করিয়াছিলেন। প্রথমবার পরাজিত হইয়া হূণগণ উত্তরাপথ আক্রমণে বিরত হন নাই, প্রাচীন কপিশা ও গান্ধার অধিকার করিয়া হূণগণ একটি নূতন রাজ্য স্থাপন করিয়াছিল। …৪৬৫ খৃষ্টাব্দের পর হূণগণ পুনরায় ভারতবর্ষে প্রত্যাগমন করে ও বারবার গুপ্তসাম্রাজ্য আক্রমণ করে।”
আখ্যায়িকা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, কেবল স্কন্দগুপ্তের চরিত্র ঐতিহাসিক।
এই আখ্যায়িকায় নিছক গল্প বলা ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য যদি থাকে তবে তাহা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ব্যক্ত করা যাইতে পারে—
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন—
শক-হূণ-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হ’ল লীন।
অতীতে যাহা বারবার ঘটিয়াছে ভবিষ্যতেও তাহা ঘটিবে, ইতিহাসের এই আত্মনিষ্ঠায় অবিশ্বাস করিবার কারণ নাই। যাহারা মানুষে মানুষে ভেদবুদ্ধি চিরস্থায়ী করিতে চাহে তাহারা ইতিহাসের অমোঘ ধর্ম লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করে, তাহারা শুধু বিচারমূঢ় নয়— মিথ্যাচারী।
সর্বশেষে এই কাহিনী সম্বন্ধে একটি ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি আছে, তাহা পাঠক-পাঠিকাকে নিবেদন করা প্রয়োজন মনে করি। ১৯৩৮ সালে মুঙ্গেরে থাকা কালে এই কাহিনী লিখিতে আরম্ভ করি। কয়েক পরিচ্ছেদ লেখা হইবার পর সুদূর বোম্বাই হইতে আহ্বান আসিল, জীবনের সমস্ত কর্মসূচী ওলটপালট হইয়া গেল। তারপর দীর্ঘ দশ বৎসর এ কাহিনী আর লিখিতে পারি নাই। শুধু সময়ের অভাবেই নয়, এ আখ্যায়িকা লিখিবার পক্ষে মনের যে ঐকান্তিক অনন্যপরতা প্রয়োজন তাহা সংগ্রহ করিতে পারি নাই। অতঃপর ১৯৪৮ সালে দৃঢ়ব্রত হইয়া আবার আখ্যায়িকার ছিন্নসূত্র তুলিয়া লইয়াছি এবং আরম্ভের ঠিক বারো বৎসর পরে শেষ করিয়াছি।
বারো বৎসরের ব্যবধানে মানুষের মন এক প্রকার থাকে না; চরিত্র দৃষ্টিভঙ্গি রসবোধ সবই বদলাইয়া যাইতে পারে, সৃষ্টিশক্তিরও তারতম্য ঘটা সম্ভব। গল্পের যে স্থানটিতে বারো বছরের ফাঁক পড়িয়াছে পাঠক-পাঠিকা হয়তো সহজেই তাহা ধরিয়া ফেলিতে পরিবেন। যদি না পারেন, বুঝিব আমার অন্তর্লোকে মহাকালের মন্দিরা এখনও একই ছন্দে বাজিতেছে, তাহার তাল কাটে নাই।” — ভূমিকা (মালাড্, ৪-২-১৯৫০)
১৯৩৮ সালের ৮ই মার্চ মুঙ্গেরে এই কাহিনী লেখা আরম্ভ হয়। কয়েক পরিচ্ছেদ লেখার পর কর্মসূত্রে লেখক বোম্বাই-এ চলে আসেন; তখন লেখা বন্ধ থাকে। দীর্ঘ দশ বৎসর পরে ১৯৪৮ সালে তিনি সেই অসমাপ্ত কাহিনীটি আবার লিখতে শুরু করেন। এই প্রসঙ্গে শরদিন্দুবাবু ডায়েরিতে লিখেছেন : ‘…অনেকবার লিখিব মনে করিয়া নাড়াচাড়া করিয়াছি; কিন্তু এ ধরনের উপন্যাস আধখানা মন দিয়া লেখা যায় না। তাই উহা নূতন করিয়া ধরিতে সাহস হয় নাই। ইতিমধ্যে এই এগারো বছরে কাহিনীর অনেক সূত্র মনের মধ্যে হারাইয়া গিয়াছে। শুধু তাই নয়, এগারো বছর আগে আমার মন যেরূপ ছিল এখন যে ঠিক তাহাই আছে এমন কথা জোর করিয়া বলিতে পারি না। ‘আমার সে-মন গেছে বহুক্ষণ আমার এ-মন ফেলে।’— একেবারে না হোক কিছুটা সত্য বটে। তাছাড়া শক্তিরও তারতম্য ঘটিয়া থাকিতে পারে। তখন আমার বয়স ছিল উনচল্লিশ, এখন পঞ্চাশ।
তবু আবার লিখিতে আরম্ভ করিয়াছি। গল্পের কাঠামোটা ভুলি নাই, তাহারই উপর নূতন করিয়া রঙ ফলাইতে আরম্ভ করিয়াছি। জানি না, রোমান্সের রঙ আগের মত ফলিবে কিনা। যদি শেষ করিতে পারি পাঠকেরা হয়তো বুঝিতে পরিবেন, গল্পের কোনখানে এগারো বছরের ব্যবধান।’ (২২ মে ১৯৪৯)
১৯৫০ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি (২২ মাঘ ১৩৫৬ সাল) উপন্যাসটি শেষ করার পর তিনি লিখেছেন : ‘…বারো বৎসর ধরিয়া মাছের কাঁটার মত গল্পটা আমার গলায় বিঁধিয়া ছিল, এতদিনে বাহির হইল। বেশ স্বচ্ছন্দতা অনুভব করিতেছি; আবার কেমন যেন একটু ফাঁক ফাঁক ঠেকিতেছে।
ভাবিতেছি…[মুঙ্গেরে থাকাকালে] একটানা ভাবে লিখিয়া যদি উহা শেষ করিতাম তাহা হইলে কেমন হইত? এখন যেমন দাঁড়াইয়াছে তাহার চেয়ে ভাল হইত কি?
এখন যে কী দাঁড়াইয়াছে তাহা আমি জানি না। হয়তো ভাল হইয়াছে; হয়তো কিছুই হয় নাই। এইটুকু শুধু বলিতে পারি, আমি লিখিয়া আনন্দ পাইয়াছি; রসজ্ঞ সমালোচকদের যদি ভাল নাও লাগে এই আনন্দটুকুই আমার পুরস্কার। এবং ভাবিয়া দেখিতে গেলে এর চেয়ে বড় পুরস্কার লেখকের আর নাই।
আমার মস্তিষ্কের মধ্যে যে পরম ছিদ্রান্বেষী সদা-জাগ্রত সমালোচকটি আছে সে আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিতেছে— ‘সাবাস! ভয় নাই।’
দেখা যাক। কালোহ্যয়ং নিরবধি বিপুলা চ পৃথ্বী। ‘(ডায়েরি, ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০)
গল্পের যে স্থানটিতে বারো বছরের ফাঁক পড়েছে সেদিকে লেখক গ্রন্থের ভূমিকায় পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায় ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের ‘মুদিত চক্ষে চিত্রক নিজ জীবন-কথা চিন্তা করিতেছিল’— এই লাইন পর্যন্ত মুঙ্গেরে লেখা। এরপর ১৯৪৮ সালে লেখা শুরু হয়েছে— ‘চিন্তার সূত্র মাঝে মাঝে ছিন্ন হইয়া যাইতেছিল…।’
গৌড়মল্লার। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স। প্রথম সংস্করণ, জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১। পৃ. ৩+[৩]+২৩৭। মূল্য চার টাকা।
“এই কাহিনী রচনা কালে কয়েকটি পণ্ডিত ব্যক্তির নিকট অনেক সাহায্য পাইয়াছি। প্রথমেই আচার্য শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়কে কৃতজ্ঞ অন্তরে স্মরণ করি। তাঁহার কাছে যে আমি কত ভাবে ঋণী তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। বেতসকুঞ্জ হইতে ধনুর্বেদ পর্যন্ত সমস্তই তাঁহার অফুরন্ত জ্ঞান ভাণ্ডার হইতে আহরণ করিয়াছি। শ্রীনীহাররঞ্জন রায় মহাশয়ের বিরাট গ্রন্থ বাঙালীর ইতিহাসে সংগৃহীত উপাদান আমার কাহিনীর ভিত্তি। শ্রীসুকুমার সেন মহাশয়ের প্রাচীন বাংলা ও বাঙালী নামক পুস্তিকা হইতে সাহায্য পাইয়াছি। শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় কয়েকটি প্রাচীন শব্দের সন্ধান দিয়া আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করিয়াছেন।
গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড়বঙ্গে শতবর্ষ ধরিয়া মাৎস্যন্যায় চলিয়াছিল, চারিদিক হইতে রাজ্যগৃধ্নু রাজারা আসিয়া দেশকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দিয়াছিলেন। একদিক হইতে আসিয়াছিলেন জয়নাগ ভাস্করবর্মা, অন্য দিক হইতে হর্ষবর্ধন। তারপর আরও অনেকে আসিয়াছিলেন, বাংলা দেশ লইয়া কাড়াকড়ি ছেঁড়াছেঁড়ি পড়িয়া গিয়াছিল। শেষে শতবর্ষ পরে পাল বংশের গোপাল আসিয়া শান্তি শৃঙ্খলা ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন।
এই শতাব্দীব্যাপী মাৎস্যন্যায়ের মধ্যে বাংলা দেশে ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটা যুগ শেষ হইয়াছিল। শশাঙ্কের জীবদ্দশা পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম পাশাপাশি শান্তিতে বাস করিতেছিল; দুর্ধর্ষ বীর শশাঙ্ক অবশ্য শান্তিকামী অহিংস বৌদ্ধধর্মের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না, অল্পবিস্তর উৎপীড়নও করিয়াছিলেন। তথাপি জনগণের মনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি নষ্ট হয় নাই। কিন্তু বিপ্লবের শতাব্দী শেষে দেখা গেল বৌদ্ধধর্মের স্বতন্ত্র সত্তা প্রায় লোপ পাইয়াছে; বৌদ্ধ দেবদেবী হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত হইয়া হিন্দুধর্মকে নব কলেবর দান করিয়াছে; স্বয়ং বুদ্ধ হিন্দুর অবতার রূপে পূজা পাইতেছেন। পাল বংশীয় রাজারা অবশ্য বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু নামে মাত্র; দুই ধর্মের মাঝখানে সুচিহ্নিত সীমারেখা লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল।
এই শতবার্ষিক ক্রান্তিকালে বাঙালীর আধ্যাত্মিক বিবর্তন যেরূপই হোক, ঐহিক ব্যাপারে তাহার মারাত্মক অনিষ্ট হইয়াছিল; তাহার সামুদ্রিক বাণিজ্য একেবারেই ধ্বংস হইয়া গিয়াছিল। শুধু অন্তর্বিপ্লবের জন্যই নয়, বাহির হইতেও প্রবল শত্রু দেখা দিয়াছিল। এ পর্যন্ত বাঙালীর জল-বাণিজ্য পূর্বে চীনদেশ হইতে পশ্চিমে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল; এই সময় আরব দেশের মরুভূমিতে তাহার এক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী জন্মগ্রহণ করিল। নূতন ধর্মের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হইয়া আরবগণ দিকে দিকে প্রধাবিত হইল। ভারতসাগরের নৌ-বাণিজ্য তাহারা বাঙালীর হাত হইতে কড়িয়া লইল। বাঙালীর তখন ঘরে আগুন লাগিয়াছে, বাহিরের শত্রুর কাছে সে পরাভূত হইল। বাঙালীর সাগরোদ্ভবা লক্ষ্মী আবার সাগরে নিমজ্জিত হইলেন। বাঙালীর সৌভাগ্যের দিন ফুরাইল। দেশে সোনা-রূপার বদলে কড়ির মুদ্রা প্রচলিত হইল।
ইহার প্রায় সহস্র বৎসর পরে মোগল পাঠানের আমলে বাঙালীর নৌ-বাণিজ্য আর একবার মাথা তুলিয়াছিল। কিন্তু তাহাও অধিক দিন স্থায়ী হয় নাই। মগ ও পোর্তুগীজ জলদস্যু আসিয়া আবার ভরাডুবি করিয়াছিল।
আমার কাহিনী শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে আরম্ভ হইয়া তাহার বিংশ বৎসর পরে শেষ হইয়াছে। এই সময়ে বাঙালীর চরিত্র সংস্কৃতি গ্রাম্য জীবন নাগরিক জীবন কিরূপ ছিল তাহা অঙ্কিত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। পটভূমিকা জানা থাকিলে কাহিনী অনুসরণ করিবার সুবিধা হয় তাই এত কথা লিখিলাম।”— ‘পটভূমিকা’ শীর্ষক ভূমিকা (পুণা, মাঘ ১৩৬০)
লেখকের ডায়েরিতে দেখা যায় ১৩৫৭ সালের ৩রা আষাঢ় (১৭ জুন, ১৯৫০) এই কাহিনী লেখা শুরু হয়, শেষ হয় ১৩৫৯ সালের ৪ঠা আশ্বিন (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫২)। উপন্যাস আরম্ভ করার অল্পদিন পরে শরদিন্দুবাবু লিখেছেন ঃ ‘ভাবিয়ছিলাম কালের মন্দিরার পর বড় আর কিছু লিখিব না, ইহাই বঙ্গ-বাণীর চরণে আমার শেষ অর্ঘ্য। বয়স বাড়িতেছে, জীবন জটিলতর হইয়া উঠিতেছে; অতঃপর দীর্ঘ রচনা আর সম্ভব হইবে না। কিন্তু নীহাররঞ্জনের বাঙালীর ইতিহাস পড়িয়া আবার মাথায় একটি উপন্যাস আসিয়াছে। লিখিতে আরম্ভ করিয়াছি।
প্রাচীন বাংলা দেশ লইয়া গল্প লিখিবার ইচ্ছা অনেকদিন হইতে ছিল; কিন্তু বাংলা দেশের বিশিষ্ট আবহাওয়া সৃষ্টি করিবার মত মালমশলা কোথাও পাই নাই। নীহাররঞ্জনের বইখানি পড়িয়া যে অপূর্ব উপাদান পাইয়াছি তাহাই অবলম্বন করিয়া উপন্যাস আরম্ভ করিয়াছি। শশাঙ্কদেবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বাংলা দেশে যে শতাব্দীব্যাপী মাৎস্যন্যায় আরম্ভ হইয়াছিল তাহারই সূচনা আমার গল্পে আছে। বাঙালীর জীবনে ইহা এক মহা ক্রান্তিকাল। আধুনিক বাঙালীর জন্ম এই সময়।’ (ডায়েরি, ২৭ জুলাই ১৯৫০)
বাংলা দেশের সমাজ ও অন্যান্য বহু বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি তথ্য লেখক আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়ের অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। বিদ্যানিধি মহাশয়ের সঙ্গে তাঁর এ নিয়ে দীর্ঘ পত্র-বিনিময় হয়। লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে সযত্নে রক্ষিত চিঠিপত্রের ফাইলে তার সাক্ষ্য রয়েছে।
প্রথমে এই উপন্যাসটির নাম ছিল ‘মৌরী নদীর তীরে’। কয়েক পরিচ্ছেদ লেখার পর নতুন নাম হয়— গৌড়মল্লার।
তুমি সন্ধ্যার মেঘ। নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। প্রথম প্রকাশ, আশ্বিন ১৩৬৫, সেপ্টেম্বর ১৯৫৮। পৃ. [৬] + ২৪০। মূল্য পাঁচ টাকা পঞ্চাশ নয়া পয়সা।
তৃতীয় সংস্করণ, ভাদ্র ১৩৮৩, আগস্ট ১৯৭৬।
উৎসর্গ ॥ যাঁহার প্ররোচনায় এই কাহিনী লিখিয়াছি/ সেই পরম ভক্তিভাজন পণ্ডিতপ্রবর শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্যরত্ন মহাশয়ের করকমলে ইহা সাদরে অর্পণ করিলাম।
প্রচ্ছদ ॥ আজিত গুপ্ত
“এই কাহিনীতে দীপঙ্কর, রত্নাকর, শান্তি, নয়পাল, বিগ্রহপাল, লক্ষ্মীকর্ণদেব, বীরশ্রী, যৌবনশ্রী, জাতবর্মা, বজ্রবর্মা, যোগদেব ও তিব্বতীয় আচার্য বিনয়ধরের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। দীপঙ্করের শান্তি-প্রচেষ্টা এবং বিগ্রহপালের সহিত যৌবনশ্রীর বিবাহও ঐতিহাসিক ঘটনা।
এই কাহিনীর সংঘটন কাল হইতে শতাধিক বর্ষ পরে কান্যকুব্জের রাজা জয়চাঁদ তাঁহার কন্যা সংযুক্তার স্বয়ংবর সভায় পৃথ্বীরাজকে অপদস্থ করিবার যে ফন্দি করিয়াছিলেন, এই কাহিনীর ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনাবলীর সহিত তাহার কিছু সাদৃশ্য আছে। জয়চাঁদের এই ফন্দি তাঁহার স্বকপোলকল্পিত এরূপ মনে করিবার কোনও কারণ নাই। অনুমান হয়, তৎকালের রাজাদের এই ধরনের নষ্টামি একটা ব্যসন ছিল।
যে লঘুচিত্ততা অপরিণামদর্শিতা স্বজাতিদ্রোহিতা ও অন্তঃকলহের ফলে ভারতের সংস্কৃতি নয়শত বৎসরের জন্য অস্তমিত হইয়াছিল তাহারই চিত্র আমার কাহিনীর পটভূমিকা।” — ভূমিকা (ভাদ্র ১৩৬৫)
লেখকের ডায়েরি থেকে জানা যায় এই গ্রন্থ রচনা আরম্ভ হয় ২৬ অক্টোবর ১৯৫৬, শেষ হয় ১৯ আগস্ট ১৯৫৮।
শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরেই হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁকে চেদীরাজ কর্ণদেব ও বাংলার পাল সম্রাটদের নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার জন্য অনুরোধ করেন। শুধু অনুরোধ জানিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি; লেখার উপকরণ হিসেবে নানা ঐতিহাসিক তথ্য এবং আকর গ্রন্থের কথা জানিয়ে তিনি উপন্যাসটি লেখার জন্য বারম্বার তাগিদ দিতে থাকেন? হরেকৃষ্ণবাবুর লেখা কয়েকটি চিঠির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হল ঃ
‘বাঙ্গালার তথা ভারতের ইতিহাস আমার অন্যতম প্রিয় বস্তু। তুমি যেমন সেই ইতিহাসের উপকরণ লইয়া গল্প-উপন্যাস লেখ, অতীতের সুন্দর বাতাবরণ সৃষ্টি কর। সেকালের সম্রাট, সেনাপতি, সামন্ত, প্রজা— সেই নাম-ধাম। সেকালের উপযোগী কথোপকথন— সে এক অভিনব কল্পলোক। আমি সব চোখের সম্মুখে দেখি— একেবারে সেকালে গিয়া উপস্থিত হই। দুর্গেশনন্দিনীতে, রাজসিংহেও ইতিহাসের ছায়া আছে। কিন্তু কালের মন্দিরা ও গৌড়মল্লারের সঙ্গে তাহার পার্থক্য কত।
তুমি চেদীরাজ কর্ণদেব আর বাঙ্গালার পাল সম্রাটদের লইয়া একখানি উপন্যাস লেখ। কর্ণদেব আপনি কন্যা যৌবনশ্রীকে বিগ্রহপালের হাতে দিয়া সন্ধি করিয়াছিলেন। বাঙ্গালার সে এক গৌরবময় অধ্যায়। রাঢ়ের তখন বিপুল ঐশ্বর্য। …’ (চিঠি, ১৮ শ্রাবণ ১৩৬১)
‘… ৺রাখালদাস বন্দ্যোর বাঙ্গালার ইতিহাস প্রথম খণ্ড ও ৺নগেন্দ্রনাথ প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবের রাজকাণ্ড গ্রন্থে সংক্ষিপ্তভাবে চেদীরাজ কর্ণদেব এবং নয়পাল ও বিগ্রহপালের কথা আছে। বাঙ্গালার মাৎস্যন্যায় প্রশমনের জন্য বাঙ্গালী প্রধানগণ গোপালদেবকে রাজা নির্বাচিত করেন। গোপালের ইতিহাস বিখ্যাত পুত্র ধর্মপাল। ইঁহার ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর নাম গর্গদেব। ইঁহারই মন্ত্রণা কৌশলে ধর্মপাল সমগ্র উত্তরাপথে রাজচক্রবর্তী পদবীতে আরূঢ় হন। এই বংশে নয়পালের উদ্ভব। নর্মদা নদীর তীরবর্তী জব্বলপুরের নিকটস্থিত ত্রিপুরীর অধীশ্বর গাঙ্গেয়দেবের পুত্র চেদী বংশীয় নরনাথ কর্ণদেব জীবনের অধিকাংশ দিন দিগ্বিজয়ে অতিবাহিত করেন। ষাট বৎসর এইরূপে ব্যয়িত হয়। তিনি নয়পালের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া যুবরাজ বিগ্রহপালের করে কন্যা যৌবনশ্রীকে সমর্পণ করেন। কর্ণদেবের জ্যেষ্ঠকন্যা বীরশ্রীকেও একজন রাজকুমার বিবাহ করেন, তাহার নাম জাতবর্মা। তোমার পক্ষে এই কাহিনীই তো যথেষ্ট। গৌড়মল্লারে তুমি ইতিহাস লিখিয়াছ কতটুকু? উপাদান কিই বা পাইয়াছ! তাহা অপেক্ষা এ উপকরণ তো যথেষ্ট বলিতে হয়। কর্ণদেব ও নয়পালের যুদ্ধে অতীশ দীপঙ্কর মধ্যস্থ হইয়াছিলেন। …
তুমি ৺রাখাল বন্দ্যোর ‘ধর্মপাল’ পড়িলে সেকালের বাঙ্গালার অবস্থার আভাস পাইবে। গৌড়মল্লারে বাঙ্গালার দুর্দিনের চিত্র আঁকিয়াছ। অধঃপতিত রাজবংশের এক কামোন্মদিনী রাণীর ছবি দেখাইয়াছে। ইহারই পরবর্তী অধ্যায় লিখিতে অনুরোধ করিতেছি। স্বাধীন বাঙ্গালার শৌর্যে বীর্যে মহিমান্বিত বাঙ্গালী, চাণক্যপ্রতিম ব্রাহ্মণ মন্ত্রী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হইয়াও সর্বধর্মের উৎসাহদাতা বাঙ্গালী সম্রাট। … ডক্টর রাধাগোবিন্দ বসাকের রাম-চরিত অনুবাদ পড়িলে আবার বাঙ্গালীর আর এক রূপের পরিচয় পাইবে। …’ (চিঠি, ১১ কার্তিক ১৩৬১)
‘… ১ম মহীপালের পুত্র নয়পাল। তার পুত্র ৩য় বিগ্রহপাল। জয়পাল নয়, নয়পালই প্রকৃত নাম। ইহাদের রাজধানী ছিল গৌড়ে এবং মগধে। মালদহ এবং পাটনায়। …নয়পাল এবং বিগ্রহপালের সঙ্গে চেদীরাজ কর্ণদেবের যুদ্ধ মগধে আরম্ভ হইয়া রাঢ় পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। রাঢ়দেশের পাইকোড় (প্রাচীকেট) গ্রামে চেদীকর্ণের শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। কর্ণদেবের রাজধানী ছিল জব্বলপুরে নর্মদা তীরে ত্রিপুরী। মর্মর পাহাড়ের সৌন্দর্য ললিতা কর্ণদেবের দুই কন্যা, জ্যেষ্ঠা বীরশ্রী, বঙ্গেশ্বর জাতবর্মা ইহাকে বিবাহ করেন। বঙ্গ বা সমতট ইহাদের রাজধানী। দ্বিতীয়া কন্যা যৌবনশ্রীকে বিবাহ করেন বিগ্রহপাল। বিবাহ বোধহয় রাঢ়দেশেই হইয়াছিল। পাইকোড়ের লিপি হইতে মনে হয় চেদীরাজ সেখানে কোন দেববিগ্রহ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়া কিছুদিন অবস্থান করিয়াছিলেন। খ্রীষ্টীয় একাদশ শতকের মধ্যভাগের ঘটনা।’ (চিঠি, ২১ চৈত্র ১৯৬১)
‘যৌবনশ্রী তো ক্ষত্রিয়ের মেয়ে। সে যদি বাপের কাছে যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়া থাকে এবং পুরুষবেশে যুদ্ধক্ষেত্রে বাপের সহযাত্রী হয়, দোষ হয় নাকি? এই পরিবেশে বিগ্রহপালের সঙ্গে তাহার দেখাটা তুমি পছন্দ কর? ভাই, ‘যৌবনশ্রী’ তুমি আরম্ভ কর…।’ (চিঠি, ৬ শ্রাবণ ১৩৬২)
হরেকৃষ্ণবাবু এমনকি গ্রন্থখানির নামকরণও করেছিলেন— যৌবনশ্রী।
বলা বাহুল্য, উপন্যাসটি লেখক হরেকৃষ্ণবাবুকেই উৎসর্গ করেছেন। এই প্রসঙ্গে হরেকৃষ্ণবাবু লিখেছেন :
‘…জীবনের এই উত্তীর্ণপ্রায় অপরাহ্ণে আসন্ন সন্ধ্যার গোধূলি ধূসর পাণ্ডুর ছায়া যখন আমাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে অপসারিত করিবার সার্থক প্রযত্নে অগ্রসর হইতেছে, আমি যখন প্রসন্ন চিত্তে চির প্রস্থানের প্রতীক্ষায় দিন গণিতেছি, এমনই দিনে তোমার অকপট আন্তরিক শ্রদ্ধাসম্ভার আমি অঞ্জলি পাতিয়াই গ্রহণ করিলাম। …তোমার কল্যাণ হউক। নিরাময় দীর্ঘজীবনে বাঙ্গালার যুবক যুবতীকে বাঙ্গালীর অতীত গৌরবের কাহিনী শুনাইয়া, বাঙ্গালীর দুর্বলতার, তাহার স্খলন ত্রুটির চিত্র আঁকিয়া দেখাইয়া আত্মসচেতন করিবার চেষ্টা কর। বাঙ্গালী আত্মবিস্মৃত জাতি।
সুন্দর পটভূমি, লোভনীয় বাতাবরণ, তৎকালোপযোগী পরিবেশ, সংঘাত সঙ্কুল ঘটনা, সার্থক চরিত্র, মনোহারী সংলাপ, কোনটা রাখিয়া কোনটার কথা বলিব। …
যৌবনশ্রীকে আমার বড় ভাল লাগিয়াছে। ভারী সুন্দর যৌবনশ্রী। রূপে গুণে নারীরত্ন। হাজার কয়েক বছর আগে এক চতুর্দশবর্ষীয়া ক্ষত্রিয় কুমারী রাজাবরোধ হইতে ঠিক এই কথাই লিখিয়া পঠাইয়া ছিলেন দ্বারকার শ্রীকৃষ্ণকে। যৌবনশ্রী মুখে যাহা বলিয়াছেন, পত্রে সেই কথাই লেখা ছিল, তুমি এস, একাকী নয়, চতুরঙ্গ বাহিনীতে সজ্জিত হইয়া এস। প্রকাশ্য দিবালোকে সমাগত রাজন্যমণ্ডলীর সমক্ষে আমাকে রথে তুলিয়া লও। রাক্ষস বিবাহে আমায় গ্রহণ কর। সিংহের ভোগ্য যেন শৃগালে স্পর্শ না করে। ইহার সুস্পষ্ট ব্যঞ্জনা— চোরের মত আসিও না। আমাকে চুরি করিয়া লইয়া যাইও না, ক্ষত্রিয় নন্দিনীর গৌরব বহন করিয়া আমি তোমার সঙ্গিনী হইব। ইনিই ভীষ্মক দুহিতা। দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের পরিহাস বাক্যে মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়াছিলেন। ভারতের ক্ষত্রিয় কুমারীর অন্তর্নিহিত এই কামনা ঐ কুসুমপেলব তন্বী যৌবনশ্রীর আলেখ্যকে মহিমান্বিত করিয়াছে। অম্বিকা দেবী মনে রাখিবার মত।
বাঙ্গালী যুবক বিগ্রহপাল ও জাতবর্মা, তোমার বীরশ্রী ও বান্ধুলি, তোমার লম্বোদর, রন্তিদেব ও অনঙ্গপাল— যথাযথ চিত্র। কিন্তু চেদীরাজ কর্ণদেব কিছুটা অতিরঞ্জিত মনে হয়। …’ (চিঠি, ১৮ আশ্বিন ১৩৬৫)
পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায় প্রথম কয়েকটি পরিচ্ছেদ পর্যন্ত এই উপন্যাসটির নাম ছিল ‘রেবা রোধসি’; পরে নাম বদলে ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’রাখা হয়।
কুমারসম্ভবের কবি। বর্তিক। প্রথম প্রকাশ, রথযাত্রা ১৩৭০। পৃ. ১২০। মূল্য তিন টাকা।
“এই কাহিনী পূর্বে ‘কালিদাস’ নামে চিত্রনাট্যের আকারে প্রচলিত ছিল, এখন ইহা ‘কুমারসম্ভবের কবি’ নামে উপন্যাসের আঙ্গিক পুনর্লিখিত হইয়া প্রচারিত হইল। “কালিদাস” আর ছাপা হইবে না।”— ভূমিকা, (পুণা, বৈশাখ ১৩৭০)
চিত্রনাট্যের প্রারম্ভে লেখক বলেছেন— ‘মহাকবি কালিদাসের কোনও নির্ভরযোগ্য জীবনী নাই— আছে কেবল কতকগুলি রূপকথার মত কিম্বদন্তী। এই কিম্বদন্তীর সহিত অনুরূপ কল্পনা মিশাইয়া এই কাহিনী রচিত হইল; ইহাকে বাস্তব জীবন-চিত্রণ মনে করিলে ভ্রম হইবে। কাহিনীর ঘটনা-কাল অনুমান খৃঃ চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দী।’
তুঙ্গভদ্রার তীরে। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। প্রথম সংস্করণ, ১লা অগ্রহায়ণ ১৩৭২। পৃ. [৪]+২২৪। মূল্য ছয় টাকা।
একবিংশ মুদ্রণ, ফাল্গুন ১৩৯৭। পৃ [৪] + ১১৯। মূল্য ১৫.০০।
উৎসর্গ ॥ বাংলা সাহিত্যের বিক্রমশীল ধর্মপাল/শ্রীপ্রমথনাথ বিশী/সহৃদয়েষু
প্রচ্ছদ ॥ অজিত গুপ্ত
“এই কাহিনীর ঐতিহাসিক পটভূমিকা Robert Sewell-এর A Forgotten Empire এবং কয়েকটি সমসাময়িক পান্থলিপি হইতে সংগৃহীত। Sewell-এর গ্রন্থখানি ৬৫ বছরের পুরাতন। তাই ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের সম্পাদিত সাম্প্রতিক গ্রন্থ The Delhi Sultanate পাঠ করিয়া Sewell-এর তথ্যগুলি শোধন করিয়া লইয়াছি। আমার কাহিনীতে ঐতিহাসিক চরিত্র থাকিলেও কাহিনী মৌলিক; ঘটনাকাল খৃ ১৪৩০-এর আশেপাশে। তখনো বিজয়নগর রাজ্যের অবসান হইতে শতবর্ষ বাকি ছিল।
অনেকের ধারণা পোর্তুগীজদের ভারতে আগমনের (খৃ ১৪৯৮) পূর্বে ভারতবর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচলন ছিল না। ইহা ভ্রান্ত ধারণা। ঐতিহাসিকেরা কেহ কেহ অনুমান করেন, সুলতান ইল্তুৎমিসের সময় ভারতবর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছিল। পরবর্তীকালে স্বয়ং বাবর শাহ তাঁহার আত্মজীবনীতে লিখিয়া গিয়াছেন যে, বাঙ্গালী যোদ্ধারা আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় নিপুণ ছিল। এই কাহিনীতে আগ্নেয়াস্ত্রের অবতারণা অলীক কল্পনা নয়। তবে বাবর শাহের আমলেও ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র ভারতে আবির্ভূত হয় নাই।
দেশ-মান সম্বন্ধে সেকালে নানা মুনির নানা মত দেখা যায়। চাণক্য এক কথা বলেন, অমরসিংহ অন্য কথা। আমি মোটামুটি ৬ ফুটে ১ দণ্ড, ২০ গজে ১ রজ্জু এবং ২ মাইলে ১ ক্রোশ ধরিয়াছি।
পরিশেষে বক্তব্য, আমার কাহিনী Fictionised history নয়, Historical Fiction.”— ভূমিকা
লেখকের ডায়েরিতে দেখা যায় এই গ্রন্থ রচনা আরম্ভ হয় ২১ জুলাই ১৯৬৩, শেষ হয় ১৭ এপ্রিল ১৯৬৫।
তুঙ্গভদ্রার তীরে সম্বন্ধে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্য উদ্ধৃত করা হল—
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় : ‘তোমার লেখার একটা যাদু আছে, তুমি অনায়াসে এমন একটা বাতাবরণ সৃষ্টি কর যে পলকে মনকে সুদূর অতীতে টানিয়া লও। তুঙ্গভদ্রার তীরে তোমার সে সুনাম রক্ষা করিয়াছে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী— দুইই তোমার তুল্যমূল্য। …’ (চিঠি, ৪ আষাঢ় ১৩৭৩)
সুকুমার সেন : ‘অনেকদিন বাংলা বই পড়ে এমন তৃপ্তি পাইনি। আপনি গল্পের মধ্যে অনেক রস প্রবাহিত করেছেন।’ (চিঠি, ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৫)
প্রমথনাথ বিশী : ‘আপনার গল্প পড়তে পড়তে বঙ্কিমবাবুকে মনে এনে দেয়— তিনি ছাড়া আপনার জুড়ি নেই। এর অধিক প্রশংসাবাক্য জানি না।’ (চিঠি, ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৫)
রমেশচন্দ্র মজুমদার : ‘…আপনি বিজয়নগরের অতীত ঐশ্বর্যের স্মৃতি একটি মনোরম কাহিনীর মধ্য দিয়া ফুটাইয়া তুলিয়াছেন— এজন্য আমরা অর্থাৎ ঐতিহাসিকেরা খুবই কৃতজ্ঞ— কারণ লোকে ইতিহাস পড়ে না— কিন্তু আপনার বই পড়িবে। Alexander Dumas যে উদ্দেশ্য নিয়া Three Muskateers প্রভৃতি লিখিয়াছিলেন। আপনার দুইখানি উপন্যাসের মধ্য দিয়া তেমনি শশাঙ্কের পরবর্তী সময়কার বাংলা ও দেবরায়ের বিজয়নগর সম্বন্ধে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে।’ (চিঠি, ২৬ নভেম্বর ১৯৬৫)
তুঙ্গভদ্রার তীরে ১৩৭২ সালে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটির জন্য ১৯৬৭ সালে লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত রবীন্দ্র-পুরস্কার লাভ করেন।
শরদিন্দুবাবুর ঐতিহাসিক গল্প সম্বন্ধে কয়েকজন বিশিষ্ট সমালোচক এবং রসজ্ঞ পাঠকের অভিমতের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হল—
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি : ‘আমি গল্প প্রায় পড়িনা। বড় গল্প একেবারেই না। অবসর পাইনা, আর পড়িতে ভালও লাগে না। কিন্তু কৌতূহলবশে শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত কয়েকখানি গল্পের বই পড়িয়াছি।
জাতিস্মর নামক পুস্তকে তিনটি গল্প আছে। তিনি ‘অমিতাভ’ ও ‘মৃৎপ্রদীপ’ নামক গল্প বৌদ্ধ কালের ছিন্নপত্র সংগ্রহ করিয়া রচনা করিয়াছেন। তাঁহার বিদ্যাবত্তা, রচনা-চাতুর্য ও ভাষার মাধুর্য ও ঔদার্য দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছি। দেশ ও কাল নির্দেশ করিয়া গল্প লিখিতে হইলে নানা বিষয়ে সাবধান হইতে হয়। নচেৎ, অনৌচিত্য ও অসঙ্গতি দোষ আসিয়া পড়ে। তিনি যথাসাধ্য পুরাতন কাল রক্ষা করিয়াছেন, কিন্তু তদ্দ্বারা কাহিনীর অঙ্গহানি হয় নাই। বিষকন্যা নামক পুস্তকে ‘চন্দনমূর্তি’, ‘সেতু’, ‘মরু ও সঙ্ঘ’, ও ‘বিষকন্যা’ এই চারিটি গল্পে ভয়ানক রস প্রকট হইয়াছে। কিন্তু পুরাতন কালের বর্ণনায় প্রাচীনতা অক্ষুন্ন আছে। এই দুইখানি বই লিখিতে লেখক যে কত পুস্তক পড়িয়াছেন ও আয়ত্ত করিয়াছেন, তাহা ভাবিলে তাঁহাকে জল্পক আখ্যা দেওয়া চলিবে না, তাঁহাকে আমি বিদ্বান্ বলিয়া মনে করি। কালিদাস কুমারসম্ভবের কয়টি সর্গ লিখিয়াছিলেন, অষ্টম সর্গ লিখিয়াছিলেন কিনা, এই লইয়া বহুকাল হইতে একটা তর্ক চলিয়া আসিতেছে। সে তর্ক ধরিয়া ‘অষ্টম সর্গ’ গল্প রচিত হইয়াছে। গল্পটি ভাল, তর্কের মীমাংসাও ভাল, কিন্তু পাত্র নির্বাচনের প্রশংসা করিতে পারিলাম না। এই দুইখানি পুস্তকে সংস্কৃত শব্দ পুঞ্জীভূত হইয়াছে, কিন্তু সে সকল শব্দ অজ্ঞাত নয় এবং তদ্দ্বারা বাংলার স্বরূপ উজ্জ্বল হইয়াছে। ‘চুয়াচন্দন’ নামক গল্প সমষ্টি লঘুপাঠ্য। …’ (লেখকের নিকট প্রেরিত অভিমত, তারিখ ১২ পৌষ, ১৩৫৫)
মোহিতলাল মজুমদার; ‘আপনার সাহিত্যিক পাণ্ডিত্য এবং কল্পনা শক্তি দুইই আছে— এই দুয়ের সঙ্গে আপনার মনের যে একধরণের romantic প্রবৃত্তি আছে— ভারতের অতীতকে, হিন্দু ক্লাসিক্যাল বা বৌদ্ধ monastic ভাবরূপকে পুনরুদ্ধার করিবার যে কবিত্বময় স্পৃহা আছে, তার পরিচয় [পাওয়া যায়]। … এপিক যুগের ভারতের চিত্র আমরা পুরাণ-সাহিত্যে কতগুলি পাইয়াছি। কিন্তু এই বৌদ্ধ-হিন্দু ক্লাসিক্যাল যুগের যে পূর্ণতর ভারতীয় সভ্যতা, তাহার জীবন্ত চিত্র কাব্যগত হয় নাই। আপনার গল্পগুলি পড়িলে মনে হয়, আপনি এ যুগের সাহিত্য ও ইতিহাস শিক্ষার্থীর মত অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করিয়াছেন— তাহার উপর আপনার রোমান্স রচনা করিবার শক্তি আছে।’ (‘বিষকন্যা’ গ্রন্থ সম্পর্কে চিঠি, তারিখ ১০-৮-১৯৪০)
“মরু ও সঙ্ঘ’ আপনার একটি উৎকৃষ্ট রচনা। বোধ হয় এ লেখা— অন্যগুলির তুলনায় পরিণততর রচনা। আপনার রচনায় যে ধরণের কবিত্বময় কুশলী কল্পনার অবাধসুন্দর গতি আছে— যৌবনদীপ্ত প্রাণবন্ততার সঙ্গে যে বৈদগ্ধ্য ও রসদৃষ্টি আছে তাহা…বড়ই উপাদেয়।’ (চিঠি, তারিখ ৩০-৮-১৯৪০)
[চুয়াচন্দনের] ‘গল্পগুলির সবগুলিই আনন্দদায়ক— যে আনন্দকে ত্বরিতানন্দও বলিতে পারি, অবশ্য রূঢ় অর্থে নয়। ইংরাজীতে যাহাকে entertaining বলে— আপনার প্রায় সকল গল্পেই তাই। গল্পগুলির অধিকাংশই গল্প এবং সে-গল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য রসসৃষ্টি— অর্থাৎ পাঠকের মনোহরণ। আপনার গল্পগুলিতে কবিমানসের সকল বৃত্তিই অল্পাধিক পরিমাণে আছে— fancy, imagination, invention-এর চপল চটুল ক্রিয়া রহিয়াছে, সেই সঙ্গে সাহিত্যিক শক্তি অর্জনের জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, সেই সাধনার পরিচয় সর্বত্র রহিয়াছে। …
রোমান্সই আপনার কবিত্বের মূল প্রেরণা…। আপনি বাস্তবের বাস্তবতা খুঁড়িয়া দেখিতে চান না, জীবনের কোন ব্যাখ্যা বা philosophy আপনার মনকে চাপিয়া ধরে না— সে পিপাসা আপনার নাই; অর্থাৎ আপনি Keats-এর Nightingle-এর মত ভাগ্যবান— মানবমনের বা প্রকৃতির চিরবসন্তের দেশে পলাইয়া বাঁচিবার কৌশল আয়ত্ত করিয়াছেন। আপনি passion ও emotion গুলিকে পাক করিয়া একটু রস তৈয়ার করিয়া দেন এবং ইহার জন্য situation, incident ও character নিজের মত করিয়া গড়িয়া লন। ..ইহাই আপনার বাহাদুরী। …
আপনার রচনায় যে রসিকতা আছে, তাহা স্বাভাবিক ক্ষুধা তৃষ্ণার মতই মানুষ মাত্রেই তাহার বশ্যতা স্বীকার করিবে। প্রকাশ্যে না করিলেও গোপনে করিবে। …
‘চুয়াচন্দনে’র গল্পগুলির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হইয়াছে। ‘বাঘের বাচ্চা’— একেবারে প্রথম শ্রেণীর। ইহাকেই বলে ‘reconquest of antiquity’। ইহা আপনার ঐতিহাসিক কল্পনার একটি চূড়ান্ত নিদর্শন।’ (চিঠি, তারিখ, ৮-৯-১৯৪০)
চিঠিতে উল্লিখিত অভিমতই সমালোচকের সাহিত্য-বিতান গ্রন্থে ‘বর্তমান বাংলাসাহিত্য’ নামক প্রবন্ধে ব্যক্ত হয়েছে— ‘…অতীতের রোমান্সকে তিনি [‘মরু ও সঙঘ’] গল্পে যে রস-রূপ দান করিয়াছেন, তেমনটি আর কোথাও দেখি নাই। এ গল্পের কল্পনা ও পরিকল্পনায় তিনি যে ভাবুকতা ও দার্শনিক রসদৃষ্টির পরিচয় দিয়াছেন, তাহাতে মানব-জীবনের শাশ্বত সমস্যাই তাঁহার জীবন-দর্শনকে যেমন সুস্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছে, তেমনই তাহাতে যে একটি সুকর্ষিত সুমার্জিত বিদ্বান-সুলভ মনোভঙ্গি প্রকাশ পাইয়াছে, তাহাও অনন্যসুলভ। এই কাহিনীতে রোমান্স-রস বা ইতিহাসের যাদু যেমণ চরমে উঠিয়াছে, তেমণই ইহার ভাববস্তু হইয়াছে— মানুষের সহিত প্রকৃতির দ্বন্দ, ভিতরে ও বাহিরে সেই এক শত্রুর সহিত প্রাণান্তিক সংগ্রাম, এবং পরিণামে সেই চিরন্তন হাহাকার। …’
রাজশেখর বসু : ‘আজকাল শুদ্ধ বাংলা দুর্লভ হয়েছে, খ্যাত লেখকেরাও বিস্তর ভুল করেন। যে অল্প ক’জন শুদ্ধি বজায় রেখেছেন তাঁদের পুরোভাগে আপনার স্থান। সংস্কৃত শব্দ, বিশেষত সেকেলে শব্দ দেখলে আধুনিক পাঠক ভড়কে যায়। আশ্চর্য এই— আপনার লেখায় এ রকম শব্দ প্রচুর থাকলেও পাঠক ভড়কায় না। বোধহয় তার কারণ আপনার প্লটের বা বর্ণনার দুনির্বার আকর্ষণ।’ (চিঠি, তারিখ ২-৩-১৯৫৩)
‘আপনার সকল রচনার মধ্যেই একটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই, যা আর কারও লেখায় নেই— বর্ণনার মাঝে মাঝে আপনার সরস obiter dictum. সেখানে পাঠককে থেমে থেমে উপভোগ করতে হয়, যেমন পোলাও খেতে খেতে পেস্তা বাদাম পেলে।’ (চিঠি, তারিখ ১৩-২-১৯৫৩)
‘জাতিস্মর পূর্বেই পড়েছি। ১০ বছর আগে দিল্লীর নার্সিং হোমে শয্যাশায়ী ছিলাম তখন ওই বইটি পড়ে রোগযন্ত্রণা ভুলতাম।’ (চিঠি, তারিখ ১৯-৭-১৯৫৬)
‘আপনার কাছ থেকে আরও…বিষকন্যা জাতীয় গল্প আশা করি।’ (চিঠি, তারিখ ২৮-৭-১৯৫৬)।
‘প্রাচীন ভারতের জীবিতবৎ চিত্র অঙ্কনে আপনি অদ্বিতীয়। রোমাঞ্চ গল্পেও আপনার স্থান সকলের উপরে আর। একটি কথা— আপনার পরিচ্ছন্ন শুদ্ধ ভাষা।’ (চিঠি, তারিখ ২৯-৩-১৯৫৭)
রমেশচন্দ্র মজুমদার : ‘শঙ্খকঙ্কণের [পুস্তক] মধ্যে ইতিহাসের ছাপ প্রথমটাতে খুবই আছে এবং বিশেষ উপভোগ্য। দ্বিতীয়টিতে [রেবা রোধসি] খুব বেশী না থাকিলেও একটি জাতীয় আদর্শের পটভূমিকায় কাহিনীটি খুবই উপভোগ্য। …
[চুয়াচিন্দন] গল্পটি খুবই উৎকৃষ্ট বলিয়া মনে হইয়াছিল। নবদ্বীপের ও তান্ত্রিকতার পটভূমিতে লেখা— এবং বিস্মৃতপ্রায় বাঙ্গালীর সুদূর দেশে বাণিজ্যযাত্রার কাহিনী— এই উভয়ে মিলিয়া যে একটি সুপরিকল্পিত কাহিনীকে খাড়া করিয়াছেন তাহা বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচায়ক।’ (চিঠি, তারিখ ১৮-১২-১৯৬৫)
প্রমথনাথ বিশী : ‘শরদিন্দুবাবুর প্রধান গুণ ঐতিহাসিক কল্পনা। বহু দূরকালের সামান্য কয়খানা ঘটনার কঙ্কালের মধ্যে তিনি প্রতিভার মন্ত্রবলে প্রাণ সঞ্চার করিতে পারেন। এ শক্তি প্রচুর পরিমাণে বঙ্কিমচন্দ্রের ও কিয়ৎ পরিমাণে রমেশচন্দ্রের ছিল। … প্রাণীতত্ত্ববিদেরা প্রাগৈতিহাসিক যুগের জানোয়ারের এক-আধখানা অস্থির ভগ্নাংশ পাইলে সমগ্র জন্তুটির আকৃতি সংগঠন করিতে পারেন; কিন্তু ঐতিহাসিক কল্পনা তার চেয়েও বিস্ময়কর শক্তি। ইহার বলে ইতিহাসের ঘটনা ও চরিত্রের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করা যায়। শরদিন্দুবাবুর এই শক্তি আছে।
‘বাঘের বাচ্চা’ গল্পে কিশোর শিবাজীর চিত্র পাওয়া যায়। কিশোর শিবাজীকে আমরা কোথাও দেখি নাই। শিবাজীর শরীরের যে বর্ণনা তিনি দিয়াছেন, তাহা আশ্চর্য রকমে বস্তুগত। শিবাজীর দেহের ঊর্ধ্বার্ধ যে নিম্নার্ধের অপেক্ষা সবল ও পুষ্ট ছিল, ইহা শরদিন্দুবাবু কোথাও পড়িয়াছেন কিনা জানি না; কিন্তু শিবাজীর অশ্বারূঢ় চিত্র দেখিলেই এই কথাটি মনে হয়। বোধ হয় ইহা শিবাজীর প্রতিষ্ঠিত মহারাষ্ট্র রাজ্যেরও প্রতীক। শিবাজীর মৃত্যুর এক শতাব্দীর মধ্যেই মহারাষ্ট্র রাষ্ট্র ভাঙ্গিয়া পড়িল; তাহার নিম্নার্ধ বা ভিত্তি অস্পষ্ট ছিল, ইহাই বোধ করি তাহার সবচেয়ে বড় কারণ। এই গল্পে আমরা দেখিতে পাই শিবাজীর human জ্ঞান ছিল। বোধকরি অধিক বয়সেও তিনি এ শক্তি হারান নাই। নতুবা আওরঙ্গজেবের কয়েদ হইতে সন্দেশের ঝুড়ি করিয়া পালাইবার বুদ্ধি তাঁহার মনে আসিত না।
‘রক্ত-সন্ধ্যা’ ও ‘চুয়াচন্দন’ গল্প দুইটি আমাদের সবচেয়ে ভালো লাগিয়াছে। ভাস্কো-ডা-গামার আমলের গোয়া নগর এবং তথাকার লোকজন এমন জীবন্তভাবে লেখক আঁকিয়াছেন যে তাঁহাকে প্রশংসার ভাষা খুঁজিয়া পাই না। হয়তো এ সব তথ্য তিনি ইতিহাস হইতে পাইয়াছেন, কিন্তু এ প্রাণ তো ইতিহাসের গ্রন্থে ছিল না।
কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়ের, গল্পের যে ফ্রেমটির মধ্যে এই গোয়া নগরের কাহিনীকে তিনি আঁটিয়া দিয়াছেন। কলিকাতার এক মাংস বিক্রেতা ও গোয়া নগর হইতে আগত এক পোর্তুগীজ ফিরিঙ্গীর মধ্যে খুনোখুনিকে লেখক অপূর্ব প্রতিভাবলে বহু শতাব্দীর পূর্বেকার ভাস্কো-ডা-গামা ও মির্জা দাউদের সঙ্গে জড়িত করিয়া দিয়াছেন। বুদ্ধি বলে, ইহা অসম্ভব; সংস্কার বলে— সম্ভব হইতেও পারে। বিজ্ঞান বলে, ইহা মিথ্যা; আর্ট বলে, ইহা সত্য। লেখক গল্প লেখায় আর্টের সাহায্যেই ইহা সত্য করিয়া তুলিয়াছেন; পড়িবার সময়ে ইহা বিশ্বাস না করিয়া উপায় নাই।
‘চুয়াচন্দন’ চৈতন্যদেবের আমলের নদীয়ার একটি কাহিনী। যেমন রোমান্টিক তেমনি বাস্তব; কিন্তু ইহার মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগিয়াছে কিশোর চৈতন্যের চিত্রটি, চৈতন্যদেবের যে মুণ্ডিতমস্তক কৌপীন সম্বল মূর্তির সঙ্গে আমরা সচরাচর পরিচিত, এ চিত্র সে চিত্র নয়। এ সেই দুর্দান্ত বিদ্বান, মূর্খ পণ্ডিতদের মূর্তিমান ভয় স্বরূপ, দৈব প্রতিভায় সমুজ্জ্বল, এক ডুবে গঙ্গাগর্ভ-নিমজ্জিত-পণ্ডিতদের টিকি ধরিয়া টানিয়া তোলা, প্রচুর হাস্যে প্রগল্ভ সন্ন্যাস-পূর্ববর্তী চৈতন্যদেবের চিত্র। চৈতন্যদেব যে এমন ছিলেন তাহা কোন কোন বৈষ্ণব লেখকের জীবনী হইতে পাওয়া যায়, কিন্তু স্পষ্টভাবে সে ছবি দেখি নাই। যে চৈতন্য একদিন বিষ্ণুপ্রিয়াকে ত্যাগ করিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই, তিনি আবার একদিন অন্ধকার রাত্রে মাঝগঙ্গায় চন্দনের সহিত চুয়ার রাক্ষস-বিবাহ দিয়াছিলেন এমনতর মিথ্যা-সত্য ইহার আগে পড়ি নাই। যাঁহারা চৈতন্যদেবের গতানুগতিক চিত্র দেখিয়া বিরক্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তাঁহারা এ দৃশ্য দেখিলে চৈতন্যদেবের ভক্ত হইয়া উঠিবেন, আশা করিতেছি।’ (‘চুয়াচন্দন’ পুস্তকের আলোচনা। শনিবারের চিঠি, আষাঢ় ১৩৪৩)
‘শঙ্খকঙ্কণে’র narrative চমৎকার। এমন মধুর প্রাঞ্জল narrative শক্তি বর্তমানে আর কোন লেখকের নাই— কাহারো নাই— এই কাহারোর মধ্যে জীবিত সমস্ত লেখকই পড়েন। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে তুলনীয় ৺প্রভাত মুখোপাধ্যায়। তবে তিনি ইতিহাসে পদক্ষেপ করেন নাই। ইতিহাসকে জীবন্ত করিয়া তুলিতে আপনার জুড়ি নাই।’ (চিঠি, তারিখ ১৯-৩-১৯৬৩)
জিজ্ঞাসু পাঠক এই প্রসঙ্গে জগদীশ ভট্টাচার্যের লেখা ‘শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প’ গ্রন্থের ভূমিকাটি পড়ে দেখতে পারেন।
পরিশেষে নিজের ঐতিহাসিক গল্প সম্পর্কে ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ (তারিখ ২৩-২-১৯৫১) শরদিন্দুবাবুর মন্তব্যটির উদ্ধৃতি বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না :
‘ইতিহাস অবলম্বন করিয়া কাহিনী লেখা বঙ্গভাষায় প্রচলিত নয়। বঙ্কিম ও রমেশচন্দ্র উহার সূত্রপাত করিয়া ছিলেন, কিন্তু সে সূত্র ছিঁড়িয়া গিয়াছে। প্রাক্-মুসলমান যুগের ঐতিহ্য বাঙ্গালী যেন ভুলিয়া গিয়াছে। রাখালদাস স্মরণ করাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি ইতিহাসবিৎ ছিলেন, গল্পলেখক ছিলেন না, তাঁহার চেষ্টা সার্থক হয় নাই। বাঙ্গালী জাতির হৃদয়ে ‘শশাঙ্ক’ ‘ধর্মপাল’ স্থান করিয়া লইতে পারে নাই।
আমি আমার অনেকগুলি গল্পে প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরিবার চেষ্টা করিয়াছি। কেহ কেহ বলেন এইগুলি আমার শ্রেষ্ঠ রচনা। শ্রেষ্ঠ হোক বা না হোক, আমি বাঙ্গালীকে তাহার প্রাচীন tradition-এর সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছি। এ চেষ্টা আর কেহ করেনা কেন? বাঙ্গালী যতদিন না নিজের বংশগরিমার কথা জানিতে পারিবে ততদিন তাহার চরিত্র গঠিত হইবে না; ততদিন তাহার কোনও আশা নাই। যে জাতির ইতিহাস নাই তাহার ভবিষ্যৎ নাই।’
শোভন বসু
১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৭
—
|| সমাপ্ত ||