সুইসাইড
নিজেই ভূত হয়ে গেলে তখন আর ভূতে বিশ্বাস করাটা শক্ত ব্যাপার নয়। এক হঠকারী মুহূর্তে আমি ফাঁসিতে ঝুলেছিলাম, আর কাজটা ভালোভাবে শুরু করার আগেই মনস্তাপও হয়েছিল। চেয়ারটাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ামাত্রই আবার সেটাকে পায়ের নিচে ফিরে পেতে চাইলাম, কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ততক্ষণে কাজ শুরু করে দিয়েছে; চেয়ারটা মেঝেতে যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে রইল। আর আমার তেরো স্টোন এগারো হন্দরের দেহটা ক্রমেই নিচে নামতে লাগল, গলার রশিটা ক্রমেই এঁটে বসতে লাগল।
গলার মাঝখানটায় ভীষণ ব্যথা করতে লাগল; কিন্তু আমার গাল দুটো এমনভাবে ফুলে উঠল যে সেটাই তাজ্জব ব্যাপার বলে মনে হলো। গালের দুটো উঁচু ঢিবির উপর দিয়ে ভালো করে তাকাতেও পারছি না, যদিও তখন আমি প্রাণপণে দরজার দিকে তাকাতে চাইছিলাম যদি তখনো কেউ এসে আমাকে উদ্ধার করে এই আশায়। কিন্তু আমি ভালো করেই জানি যে বাড়িতে আর কেউ নেই, আর থাকলেও দরজাটা তো ভেতর থেকে ভালো করে বন্ধ করেই দিয়েছি। পা দুটো ছোড়ার ফলে আমি অনবরত ঘুরছি; ফলে কখনো দরজার দিকে কখনো জানালাটার দিকে মুখ ঘুরে যাচ্ছে, কাঁপা হাতে রশি ধরে যতই টানাটানি করছি ততই সেটা আরও শক্ত হয়ে মাংসের মধ্যে বসে যাচ্ছে।
আমার নামটি হলো—ছিল-এডোয়ার্ড থর্নবার্ন, ১৮৩৮-১৮৭৭। চল্লিশতম জন্মদিনের ঠিক এক মাস আগে আমি আত্মহত্যা করি। আমি জানি, সে জন্য দায়ী আমার পুরুষত্বহীনতা। আমি যদি সন্তানের পিতা হতে পারতাম তাহলে আমাদের বিবাহবন্ধন শক্ত থাকত, তাহলে এমিলি আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতিনী হতো না, আর আমিও ক্ষণিকের দুর্বলতায় নিজের জীবন নষ্ট করতাম না।
ঘটনাস্থল কানেকটিকাট-এর বার্নস্টেপল-এ আমাদের বাড়ির গেস্ট রুম; সময় সন্ধ্যা সাতটার ঠিক পরে; বছরের এই সময়টাতে তখন গাঢ় গোধূলি নেমে আসে। অফিস থেকে ফিরেছি ছয়টার একটু আগে। আমি বাড়ির দালালি করি; কাজটা কানেকটিকাট শহরে বেশ লাভজনক, যদিও ইদানীং আমার আয়-উপার্জন বেশ কমে এসেছিল। বাড়ি ফিরেই দেখি রান্নাঘরের টেবিলে একখানা চিঠি : ‘গ্রেগের সঙ্গে প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ দেখতে যাচ্ছি। তোমার রাতের খাবার ব্যবস্থাটা নিজেকেই করে নিতে হবে। দুঃখিত। ভালোবাসা, এমিলি।’
এই গ্রেগ লোকটা এমিলির প্রেমিক। নিউইয়র্ক যাবার বড় রাস্তার উপর তার একটা পুরাবস্তুর দোকান আছে; অল্প মাইনের সহকারী হিসেবে এমিলি দিনের বেশির ভাগ সময় সেখানেই কাটায়। মধ্য সপ্তাহের দীর্ঘ অপরাহ্নগুলোতে যখন দোকানে কোনো ভ্রমণকারী থাকে না, তখন তারা দুজন একত্রে দোকানের পেছনে গিয়ে কী করে তাও আমি জানি। তিন বছরের অধিক কাল ধরে ব্যাপারটা আমার জানা থাকলেও তা নিয়ে কী যে করব ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আসলে ব্যাপার হলো, দোষটা তো আমারই, তাই পাছে এই কুৎসিত ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে পড়ে সেই ভয়েই আমি কিছু বলতেও পারিনি।
তাই মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও আমি নিশ্চুপই ছিলাম। অসন্তোষ, দুঃখ, প্রতিবাদ সবই মনের মধ্যেই চেপে রেখেছিলাম।
আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। প্রথমে মোটরগাড়ি নিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসা কোনো ট্রাকের দিকে এগিয়ে গিয়েছি (কিন্তু চতুর্দিকের হর্নের শব্দে শেষ মুহূর্তে নিজের গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিয়েছি); কখনো বা পাহাড়ের উপর থেকে কানেকটিকাট নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছি (একবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে ব্রেকটা টেনেছি এবং আধা ঘণ্টা ঘর্মাক্ত দেহ গাড়িতে কাটিয়ে তবে সুস্থ হয়ে উঠেছি); শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চলের একটা লেভেল ক্রসিং-এ গাড়িটাকে আড়াআড়িভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছি, কিন্তু বিশ মিনিটের মধ্যেও ট্রেন না আসায় মনের বেপরোয়া ভাব কেটে গেছে, আর আমিও গাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছি।
পরে কব্জিটা কেটে ফেলতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনো ধারালো যন্ত্র নিজের শরীরে ঢোকাতে পারিনি। অসম্ভব। পরের কোনো সুযোগের জন্য অপেক্ষা করেছি।
শেষ পর্যন্ত রশির সাহায্য নিলাম; আর তাতেই সফল হলাম। পা দুটো হাওয়ায় ছুড়তে লাগলাম, আঙুল দিয়ে নিজের গলা চেপে ধরলাম, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এল, জিভটা শুকিয়ে গেল, গোটা দেহ লাটিমের মতো ঘুরতে লাগল, তীব্র, তীক্ষ্ণ, অসহ্য যন্ত্রণা।
ক্রমে পা দুটো দুর্বল হয়ে এল, হাত দুটো ঝুলে পড়ল, আঙুলগুলো বৃথাই ট্রাউজারের পা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করল, ফাঁসির দড়ি থেকে মাথাটা কাত হয়ে ঝুলতে লাগল।
দেখতে পেলাম, আমার বিস্ফারিত চোখ দুটি দ্যুতিহীন, সাদা হয়ে উঠেছে, চোখের কোণে এক ফোঁটা জল নেই, পাথরের মতো শুকনো। তবু নিজের চোখ দুটোকে দেখতে পাচ্ছি, আরও ভালো করে তাকিয়ে গোটা শরীরকেই দেখতে পেলাম-ঝুলছে, ঘুরছে কিন্তু এখন আর তাতে কোনোরকম খিঁচুনি নেই। সভয়ে বুঝতে পারলাম আমি মরে গেছি।
কিন্তু আছি। মরে গেছি, তবু আছি; গলায় এখনো ফাঁসের ব্যথা, মাথার মধ্যে কেমন একটা ঠেলে ওঠা চাপ। আছি, কিন্তু সেই মাটির শরীরে নেই, নেই সেই ঝুলন্ত মাংসপিণ্ডের মধ্যে; অদৃশ্য আলোর মতো ছড়িয়ে আছি সারা ঘরে, নিরালম্ব হয়ে ফিরছি সর্বত্র। এবার কী হবে? ভয়, বিস্ময় ও ব্যথা একসঙ্গে আমাকে ভর করল; ঝুলন্ত কুয়াশার মতো পরবর্তী ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিন্তু কিছুই ঘটল না। অপেক্ষা করেই যাচ্ছি : শরীরটা একেবারেই স্থির হয়ে গেছে; দেয়ালের দুটো ছায়া এতটুকু নড়ছে না; বিছানার পাশের বাতিগুলো জ্বলছে; দরজা বন্ধ; জানালার পর্দা নামানো; কিছুই ঘটল না।
এবার? চিৎকার করে প্রশ্ন করতে চাইলাম, পারলাম না। গলাটা ব্যথা করে উঠল, কিন্তু আমার তো তখন কোনো গলা ছিল না। মুখটা যেন জ্বলে গেল, কিন্তু আমার তো মুখও নেই। শরীরের প্রতিটি চেষ্টা ও উদ্যম মনের উপর ছাপ এঁকে দিচ্ছে, কিন্তু আমার তো শরীর নেই, মস্তিষ্ক নেই, আত্মা নেই, কিছুই নেই। কথা বলার মতো ক্ষমতা নেই, নড়াচড়ার শক্তি নেই, এই ঘর ছেড়ে, এই ঝুলন্ত শবদেহ থেকে দূরে যাবার ক্ষমতাও নেই। আমি পারি শুধু এখানে অপেক্ষা করতে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অপেক্ষা করে থাকতে।
বিছানার মুখোমুখি ড্রেসিং টেবিলে একটা ঘড়ি ছিল। সেদিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ৭.২১- সম্ভবত পা দিয়ে চেয়ারটা ঠেলে দেবার পরে বিশ মিনিট পার হয়ে গেছে, আর আমি মরে যাবার পরে পনেরো মিনিট কেটে গেছে। এখনো কি কিছু ঘটবে না? কোনো পরিবর্তন দেখা দেবে না?
ঘড়িতে যখন ৯.১১ তখন বাড়ির পেছনে এমিলির ভক্সওয়াগনের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি কোনো চিরকুট লিখে রাখিনি; লিখবার তো কিছু ছিল না; আমার মৃতদেহটাই তো সবকিছু বলবে। কিন্তু এমিলি যখন আমাকে দেখবে তখনো আমি যে এখানেই থাকব এটা ভাবতে পারিনি। এখন অনুশোচনা হলেও আমি যা করেছি ঠিকই করেছি। আমি জানি আমি ঠিক কাজই করেছি, কিন্তু এমিলি যখন দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকবে তখন তার মুখটা দেখতে আমি চাইনি। সে আমার প্রতি অন্যায় করেছে, সেই তো সবকিছুর কারণ, সেও আমার মতোই সে কথাটা বুঝুক, কিন্তু তার মুখ দেখতে আমি চাইনি। চাইনি।
ব্যথাটা আবার বাড়ল; যা ছিল আমার গলায়, আমার মাথায়, সেখানে ব্যথা। অনেক দূরে একতলায় দরজা বন্ধ করার শব্দ হলো। বাতাসের মতো ঘরের মধ্যেই আমি কেঁপে উঠলাম। কিন্তু ঘর ছেড়ে গেলাম না, যেতে পারলাম না।
‘এড? এড? আমি ডাকছি সোনা!’
আমি জানি তুমি ডাকছ। এখন আমাকে চলে যেতে হবে এখান থেকে, এখানে থাকতে আমি পারি না। ঈশ্বর কি আছো? এই ভ্রাম্যমাণ উপস্থিতিই কি আমার আত্মা? এর চাইতে নরকও ভালো; আমাকে নরকে নিয়ে যাও, যেখানে খুশি নিয়ে যাও, শুধু এখানে ফেলে যেয়ো না।
ডাকতে ডাকতে এমিলি উপরে উঠে এল, গেস্টরুমের বন্ধ দরজার পাশ দিয়ে চলে গেল। আমাদের শোবার ঘরে ঢুকল, আমার নাম ধরে ডাকল; কণ্ঠস্বরে যেন একটা ভয়ের আভাস। সে আবার চলে গেল, হল পেরিয়ে নিচে নেমে এল। সব চুপচাপ
সে কী করছে? হয়তো আমার কোনো চিরকুট, কোনো সংবাদের খোঁজ করছে। জানালা দিয়ে তাকাল; আমার শেভ্রলে গাড়িটা দেখে বুঝল আমি বাড়িতেই আছি। এঘর থেকে ওঘরে গেল। বাড়িটা খুব পুরানো। প্ৰায় দুশো বছর বয়স। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আগেকার মালিক কিছু অদলবদল করেছিলেন। আমি কিনেছি বারো বছর আগে, সেকেলে আসবাবপত্র ও পুরাবস্তু দিয়ে বাড়িটাকে সাজিয়েছে এমিলি ও গ্রেগ। নড়বড়ে আসবাব, ঔপনিবেশিক যুগের জিনিসপত্র, পাইন কাঠের হলদে পুরানো টেবিল। বাড়িটা কিনেছি আমি, কিন্তু কোনোদিন এটাকে ভালোবাসতে পারিনি। কিনেছি এমিলির জন্য, তার জন্যই সব করেছি, কারণ আমি জানি এমিলি যা চায় সেই জিনিসটি কোনোদিন তাকে দিতে পারব না। দিতে পারব না একটি সন্তান।
অবশ্য এ নিয়ে এমিলি কখনো গোলমাল করেনি। এমিলি খুব ভালো। কখনো আমি তাকে দোষ দিইনি, নিজের পরিবর্তে তাকে কখনো দোষী করিনি। বিয়ের প্রথম দিকে সে সাগ্রহে দু-একবার কথাটা তুলেছে, কিন্তু আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে দীর্ঘকাল আর কিছুই বলেনি। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি।
যে কড়িকাঠ থেকে আমি ঝুলেছি, সেটা পুরানো বাড়িরই একটা অংশ- এগারো বর্গ ইঞ্চি হাতে চেরা একখণ্ড পুরানো কাঠ। কড়িকাঠটা বেশ শক্ত। আমি চিরকাল ঝুলে থাকলেও ওটার কিছু হবে না। সকলের চোখে পড়বার পরে তারা যখন আমাকে নামিয়ে নেবে তখনো ওটা আমার ভার সইতে পারবে।
ঘড়িতে ৯.২৩। এমিলি আবার উপরে উঠে এসেছে। কাঠের সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ দ্রুততর হলো। ডাকল, ‘এড?’
দরজার হাতলটা ঘোরাল।
দরজা তালাবন্ধ। চাবিটা ভেতরে। দরজা ভাঙতে হবে। সেজন্য অন্য কাউকে ডাকতে হবে। এমিলি একা পারবে না।
‘এড? তুমি কি ভেতরে আছো?’ এমিলি দরজায় ধাক্কা দিল, হাতলটা খটখট করল, বারকয়েক আমার নাম ধরে ডাকল, তারপর হঠাৎই নিচে নেমে গেল, তার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। টেলিফোনে কাকে যেন ডাকছে।
মনে হলো গ্রেগকে। গলার ব্যথাটা আবার বাড়ল। মন বলল, এবার শেষ হোক। আমি চাই, আমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হোক, জীবন্ত আত্মা ও মৃতদেহটাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হোক। সবকিছুর অবসান ঘটুক
নিচে এমিলি অপেক্ষা করছে গ্রেগের জন্য, আর উপরে আমি অপেক্ষা করছি তাদের দুজনের জন্য। হয়তো সে বুঝতে পেরেছে এসে কী দেখতে পাবে; তাই নিচেই অপেক্ষা করছে।
গ্রেগ এখানে আছে বলে আমার কোনো আপত্তি নেই; আমার আপত্তি এমিলির উপস্থিত থাকায়।
ঘড়িতে যখন ৯.৪৪ তখন বাড়ির পাশের পাথরের নুড়ির উপর গাড়ির চাকার শব্দ শুনতে পেলাম। গ্রেগ বাড়িতে ঢুকল, নিচে তাদের কথাবার্তা শুনলাম; গাঢ় কণ্ঠস্বর, ধীর স্থির আশ্বাসপূর্ণ, আর আবছা নারী-কণ্ঠস্বর দ্রুত ও ভয়ার্ত! দুজনে একসঙ্গে উঠে এল। কারও মুখে কথা নেই। দরজার হাতলটা ঘুরল, খটখট শব্দ হলো, গ্রেগের গলা শোনা গেল, ‘এড?’
খানিক নীরবতার পরে এমিলি বলল, ‘না। না। ও কিছুতেই এ কাজ করতে পারে না।’
‘এ কাজ?’ গ্রেগের গলায় সন্দেহ। ‘তুমি কী বলতে চাইছ? এ কাজ মানে?’
‘ইদানীং ও এত মনমরা হয়ে থাকত-এড?’ দরজা ধরে নাড়া দিল।
‘ওরকম করো না এমিলি। ব্যাপারটাকে সহজভাবে নাও।’
এমিলি বলল, ‘তোমাকে ডাকা আমার ঠিক হয়নি। এড? দোহাই তোমার!
‘কেন ঠিক হয়নি? ঈশ্বরের দোহাই, বলো এমিলি-’
‘এড, দয়া করে বেরিয়ে এসো। এভাবে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়ো না।’
‘কেন আমাকে ডাকা তোমার ঠিক হয়নি, এমিলি?’
‘এড তো বোকা নয় গ্রেগ। সে তো—’
আবার নীরবতা। ওরা ভাবছে, আমি ভেতরে এখনো বেঁচে আছি। ওরা চায় না আমি শুনে ফেলি। এমিলি বলছে, ‘সে তো জানে গ্রেগ, আমাদের সব কথা জানে।’
একটু পরে গ্রেগ বলল, ‘এটা কী রকম ইয়ার্কি হচ্ছে, এড? বেরিয়ে এসো। খোলাখুলি সব কথা হোক।’ আবার দরজায় খটখট শব্দ। ‘আমাদের ঢুকতেই হবে। অন্য কোনো চাবি আছে কি?
‘আমার মনে হয় এ বাড়ির সবগুলো তালাই এক। এক মিনিট দাঁড়াও।’ সত্যি তাই। যেকোনো চাবিতেই এ বাড়ির ভেতরের দরজাগুলো খোলা যায়। কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বুঝলাম, এমিলি আর একটা চাবি আনতে গেছে, এখনই তারা ফিরে আসবে। এমিলি ঘরে ঢুকবে ভেবে আমি এত ভয় পেয়ে গেলাম যে বিকৃত আয়নায় প্রতিবিম্বের মতো ঘরের মধ্যেই আমি যেন ঝিকমিক করে উঠলাম। আহা, আমি যদি কোনোরকমে দেখতে পারাটা বন্ধ করতে পারতাম! যখন বেঁচে ছিলাম তখন আমার চোখ ছিল এবং চোখের পাতাও ছিল, যা অসহ্য তাকে দৃষ্টির আড়ালে রাখতে পারতাম, কিন্তু এখন তো আমি একটা উপস্থিতি মাত্র, আমার চেতনাকে তো আমি থামিয়ে দিতে পারি না।
তালায় চাবি ঘোরানোর খসখস শব্দ যেন আমার গলায় উকোর মতো ঘষা খেতে লাগল। আবার তীব্র যন্ত্রণা। তার মধ্যেই শুনতে পেলাম এমিলি বলছে, হলো কী? আর গ্রেগ জবাব দিল, চাবিটা ভেতরেই রয়েছে, ওপাশ থেকে।
‘হা ঈশ্বর। হায় গ্রেগ, না জানি ও কী করে বসেছে।’
গ্রেগ বলল, ‘দরজার কব্জা খুলে ফেলতে হবে। টনিকে ডাকো। ওর যন্ত্রপাতির বাক্সটা নিয়ে আসুক।’
‘তুমি কি চাবিটা ঢোকাতে পারছ না?’
‘নিশ্চয়ই পারব,’ তবু গ্রেগ গম্ভীর গলায় বলল, ‘যা বলছি তাই করো, এমিলি।’
আর তখনই বুঝলাম যে দরজা খোলার সময় এমিলি থাকুক এটা সে চাইছে না; তাই তাকে সরিয়ে দিল। বেশ, বেশ!
‘ঠিক আছে,’ বলে এমিলি চলে গেল টনিকে ফোন করতে। টনি যুবক, ঘন ভুরু, একরাশ কালো চুল, গায়ের রং অলিভ পাতার মতো, সে গ্রেগের বাড়িতেই থাকে, তার সব কাজকর্ম করে।
তালায় নতুন খসখস শব্দ হতে লাগল। এমিলি ফিরে আসার আগেই গ্রেগ দরজাটা খুলতে চেষ্টা করছে। আমি যেন একটা আরামের স্বাদ অনুভব করলাম, গ্রেগকেও ভালো লাগছে। সে তো লোক মন্দ নয়; আমার স্ত্রীর ব্যাপারে একটা চান্স নিলেও আসলে সে লোক খারাপ নয়। সে কি এখন এমিলিকে বিয়ে করবে? তারা তো এই বাড়িতেই বাস করতে পারবে; এ বাড়ি সাজানো-গোছানোর ব্যাপারে তার অবদান তো আমার চাইতেও বেশি। নাকি এ ঘরটা এমিলির কাছে বড় বেশি দুঃখজনক স্মৃতি হয়ে থাকবে? এমিলি কি এ বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্র বাস করবে? কিন্তু তাকে তো অনেক অল্প দামে বাড়িটা বিক্রি করতে হবে। বাড়ির দালাল হিসেবে আমি তো জানি, যে বাড়িতে কোনো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে সেটা বিক্রি করা কত ঝামেলার ব্যাপার। অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার ভীতি মানুষের মন থেকে যায় না। অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করে বসবে যে বাড়িটা ভূতে পাওয়া।
আর ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম এ ঘরটাও তো ভূতে পাওয়া। এখানে তো আমি রয়েছি! আমি তো ভূত।
কী ভয়ানক কথা! আমি এখানে ভেসে বেড়াচ্ছি, হাড় নেই, মাংস নেই, একটা বেদনাদীর্ণ উপস্থিতি মাত্র; ঠিক যেন একটা এককোষী ছত্রাক; কত লোক যাবে-আসবে আর নিরবধিকাল দিন ও রাত্রি একাকী, দুঃখিত মনে আমি তাদের নীরব দর্শকমাত্র হয়ে থাকব। না, এমিলি বাড়িটা বিক্রি করেই দেবে-তাকে বিক্রি করতেই হবে। আর সেটাই হবে আমার যোগ্য শাস্তি -আত্মহত্যার শাস্তি, যে মানুষ নিজের জীবনকে হনন করে তার নিশ্চিত নির্জন নরকবাস। সবগুলো ইন্দ্রিয় সজাগ থাকবে, অথচ তার বেশি কিছু থাকবে না; মাধ্যাকর্ষণের চাইতেও শক্তিমান কোনো শক্তি আমাকে বেঁধে রাখবে আমারই আত্মহননের ঘটনাস্থলে।
তালার এদিককার চাবির একটা আকস্মিক শব্দে চমকে সেদিকে তাকাতেই দেখি একটা জীবন্ত প্রাণীর মতো এঁকেবেঁকে চাবিটা যেন লাফ দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে ঝনাৎ শব্দে মেঝেতে ছিটকে পড়ল। এক মুহূর্ত পরেই দরজাটা খুলে গ্রেগ আমার রক্তিম মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল, আর পরক্ষণেই বিস্ময়ে ও আতঙ্কে-নাকি ঘৃণায়? পিছিয়ে গিয়ে দরজাটাকে সশব্দে বন্ধ করে দিল। তালার মধ্যে চাবিটা আর একবার ঘুরল; শুনতে পেলাম, দ্রুত পায়ে সে নিচে নেমে গেল।
ঘড়িতে ৯.৫৮ বাজে। এতক্ষণে গ্রেগ সব কথা এমিলিকে বলছে; তাকে শান্ত করতে ড্রিংকস দিচ্ছে। এবার সে পুলিশকে টেলিফোন করছে। এবার এমিলিকে জিজ্ঞাসা করছে, পুলিশকে ব্যাপারটা জানাবে কি না। জানি না, ওরা কী করবে।
‘না-আ আ আ- আ আ আ!’
ঘড়িতে ১০.০৭ বাজে। এত সময় লাগছে কেন? গ্রেগ কি এখনো পুলিশে খবর দেয়নি?
এমিলি সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে আসছে; হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, তবু আবার দৌড়াচ্ছে; চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি ঘরের এক কোণে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দরজার উপর তার ঘুষির শব্দ শুনতে পেলাম। সে ঢুকতে পারছে না। হে ঈশ্বর, ওকে ঢুকতে দিয়ো না। ও যা খুশি করুক; আমার যায় আসে না; শুধু ও যেন আমাকে দেখতে না পায়! ওকে আমাকে দেখতে দিয়ো না!
গ্রেগ এল। এমিলি চেঁচামেচি করল, মিনতি করল, রাগ করল, তর্ক করল, দাবি করল, কিন্তু গ্রেগ শুনল না। ‘চাবিটা দাও। আমাকে চাবিটা দাও।’
গ্রেগ চাবিটা এমিলিকে দিল।
না। এ অসহ্য। এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর। এমিলি ঢুকল, হেঁটে ঘরের মাঝখানে এল, তার পায়ের শব্দ চিরকাল আমার মনে থাকবে। সে কাঁদছে, কিন্তু তা যেন মানুষের কান্না নয়; যেন কোনো জীবের হতাশাভরা কান্না; এতক্ষণে বুঝলাম, হতাশা কাকে বলে।
গ্রেগ তাকে সংযত করতে চেষ্টা করল, ঘাড়ে হাত রেখে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাইল; কিন্তু এমিলি তার হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে এল… না আমার দিকে নয়। যন্ত্রণায় ও বিষাদে আমি তো তখন ঘরের সব জায়গায় আছি। এমিলি এগিয়ে এল আমার শবদেহের দিকে। গভীর মমতায় সেটার দিকে তাকাল, হাত বাড়িয়ে ফুলে ওঠা গালটা স্পর্শ করল, অস্ফুটে বলল, ‘হায় এড!
গ্রেগ এগিয়ে এল। আবার তার কাঁধে হাত রাখল, নাম ধরে ডাকল। এবার এমিলি ডুকরে কেঁদে উঠে মৃতদেহের পা দুটি জড়িয়ে ধরল, কাঁদতে কাঁদতে অত্যন্ত দ্রুত এমন সব কথা বলতে লাগল যে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা গেল না।
আর বোকা গ্রেগটা এমিলিকে ধরে জোর করে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল; দরজাটাকে সশব্দে বন্ধ করে দিল। মৃতদেহটা কিছুক্ষণ দুলতে দুলতে একসময় আবার স্থির হয়ে গেল। সে বড় শোচনীয় অবস্থা। এর চাইতে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না। দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত এখানে এভাবে কাটাতে হবে! কিন্তু এর চাইতেও শোচনীয় পরিস্থিতি তো আছে। এমিলি বেঁচে থাকবে, বাড়িটা বেচে দেবে, ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে। (আমিও তো একসময় ভুলে যাব)-সে গ্রেগকে বিয়ে করবে। তার তো মোটে ছত্রিশ বছর বয়স; সে এখনো মা হতে পারবে।
বাকি রাতটা বাড়ির অন্য কোনো ঘর থেকে তার বিলাপ শুনতে পেলাম। শেষ পর্যন্ত পুলিশ এলো; মর্গ থেকে এলো সাদা কোট পরা দুই লোক। আমাকে-ওটাকে-কেটে নামিয়ে নিতে তারা ঘুরে ঢুকল। একটা ভাঙা খেলনার মতো লাশটাকে পুঁটলির মতো জড়িয়ে স্ট্রেচারে করে বয়ে নিয়ে গেল।
ভেবেছিলাম, আমাকে মৃতদেহের সঙ্গেই থাকতে হবে; ভয় পেয়েছিলাম আমাকেও হয়তো ওটার সঙ্গেই কবর দেওয়া হবে, একটা বাক্সের কালো অন্ধকারের মধ্যে অনন্তকাল কাটাতে হবে। কিন্তু মৃতদেহটা ঘর থেকে চলে গেল, আর আমি থেকেই গেলাম।
ডাক্তার ডাকা হলো। লাশ সরিয়ে নেবার পরে দরজাটা খোলাই ছিল। নিচের কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। ডাক্তার এমিলিকে ঘুমের ওষুধ দিতে চেষ্টা করছে, কিন্তু তার বিলাপ কিছুতেই থামছে না। বারবারই বলছে, ‘আমিই এ কাজ করেছি! সব দোষ আমার!
হ্যাঁ। এই প্রতিক্রিয়াই আমি চেয়েছিলাম, আশা করেছিলাম। জীবনের শেষ মুহূর্তে যা কিছু কামনা করেছিলাম সবই পেয়ে গেলাম, তবু এ যে ভয়াবহ। আমি তো মরতে চাইনি! চাইনি এমিলিকে এত কষ্ট দিতে আর সবচেয়ে বড় কথা, এখানে থেকে এসব দেখতে ও শুনতে আমি চাইনি।
শেষ পর্যন্ত এমিলি চুপ করল। গ্রেগকে সঙ্গে নিয়ে নীল পোশাক পরা একজন পুলিশ ঘরে ঢুকল। গ্রেগ ঘটনার একটা বিবরণ দিল।
পুলিশ শুধাল, ‘আপনি কি ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু?’
‘বলতে পারেন ওর স্ত্রীর সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা বেশি। সে আমার দোকানে কাজ করে। নিউইয়র্কে রোডের ওপর আমার অ্যান্টিকের একটা দোকান আছে।’
পুলিশ বলল, ‘উনি কেন এ কাজ করেছেন বলে আপনার ধারণা?’
‘আমার মনে হয়, উনি সন্দেহ করতেন যে ওর স্ত্রীর সঙ্গে আমার প্রণয়ঘটিত কোনো ব্যাপার আছে।’
পুলিশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি সত্যি এ ব্যাপারে জড়িত ছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘মহিলাটি কি বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য চেষ্টা করছিলেন?’
‘না। সে আমাকে ভালোবাসে না; ভালোবাসে তার স্বামীকে।
‘তাহলে তিনি যেখানে-সেখানে রাত কাটান কেন?’
এ কথায় গ্রেগ অসন্তুষ্ট হলো। বলল, ‘যেখানে-সেখানে তো রাত কাটায় না। মাঝে মাঝে, তাও ঘন ঘন নয়, আমার সঙ্গে রাত কাটায়।’
‘কেন?’
‘একটু স্বস্তির জন্য। এডের সঙ্গে চলাটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। সে বড়ই মেজাজি মানুষ। ইদানীং ক্রমেই অবস্থা খারাপ হয়ে উঠছিল।’
‘জীবনে সুখী লোকেরা আত্মহত্যা করে না।’ পুলিশটি বলল।
‘ঠিক কথা। এড প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকত, মাঝে মাঝেই চাপা ক্রোধে কষ্টও পেত। ফলে তার ব্যবসা খারাপ হচ্ছিল, খদ্দেররা বিগড়ে যাচ্ছিল। এমিলির জীবনও শোচনীয় হয়ে উঠছিল, কিন্তু তবু সে এডকে ছাড়তে রাজি ছিল না, সে স্বামীকে ভালোবাসে। জানি না এখন সে কী করবে।’
‘আপনারা দুজনে বিয়ে করতে পারেন না?’
‘না, না,’ গ্রেগ বিষণ্ণ হাসি হাসল। ‘আচ্ছা, আপনি কি ভাবছেন আমাদের বিয়ে করতে সুবিধা হবে বলেই আমরা ওকে খুন করে আত্মহত্যা বলে চালাতে চেষ্টা করছি?’
‘মোটেই না,’ পুলিশটি বলল। কিন্তু আপনাদের সমস্যাটি কী? আপনি কি বিবাহিত?’
ঠিক তা নয়। তবে কারণ একটা আছে। তা ছাড়া আগেই বলেছি, এমিলি আমাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে তার স্বামীকে।’
‘অথচ—’
গ্রেগ তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘এমিলিকে আমি ভালোবাসি, তার জন্য আমার দুঃখ হয়, এডের সঙ্গে তার জীবনটা খুব সুখের ছিল না। কিন্তু আপনাকে তো আগেই বলেছি তার সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কালেভদ্রে। আর তাতেও সে যে খুব খুশি হয়েছে তাও নয়।’
হায় এমিলি! বেচারি এমিলি!
পুলিশ বলল, ‘ঠিক আছে। বাইরে চলুন।’
ওরা চলে গেল। দরজাটা খোলাই রইল; সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দুজনে কথা বলতে লাগল।
পুলিশটি জিজ্ঞেস করল, ‘রাতে থাকার মতো কেউ আছে কি? মিসেস থর্নবার্নের একলা থাকাটা ঠিক নয়।’
‘গ্রেট বারিংটনে ওর আত্মীয়স্বজনরা আছেন। আগেই তাদের টেলিফোন করেছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কেউ না কেউ এসে পড়বেন।’
‘ততক্ষণ আপনি থাকছেন তো? ডাক্তার বলেছেন, হয়তো উনি ঘুমিয়ে থাকবেন, তবু ধরুন যদি-’
‘বেশ তো। আমি থাকব।’
ওই পর্যন্তই। একটু পরেই নিচের কথাবার্তা থেমে গেল। গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম।
নর-নারীর সম্পর্ক কত জটিল। সাধারণ কাজও কত অর্থহীন। কাউকে কোনোদিন বুঝতে পারিনি, নিজেকে তা মোটেই না।
পুলিশ চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই গ্রেগ আবার ঘরে ঢুকল। তাকে খুব অপরাধী ও অনুতপ্ত লাগছে। চেয়ারটাকে পায়ার উপর দাঁড় করিয়ে তার উপর উঠে দাঁড়াল; অনেক কষ্টে বাকি দড়িটা খুলে ফেলল। সেটাকে পকেটে ভরে চেয়ারটাকে ঘরের এক কোণে রেখে মেঝে থেকে চাবিটা কুড়িয়ে নিল। সেটাকে তালার মধ্যে ঢুকিয়ে বিছানার দুটো বাতিই নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।
এবার আমি অন্ধকারে একা। দরজার ফাঁক দিয়ে ঈষৎ আলো আসছে, আর আছে ঘড়ির জ্বলজ্বলে সংখ্যাগুলোর স্তিমিত আলো। একটা মিনিট কী দীর্ঘ! ওই ঘড়িটাই আমার শত্রু। ওটার টিকটিক করে চলাটাই আমি সহ্য করতে পারছি না। এক ঘণ্টায় ষাটবার টিকটিক; ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সারাটা রাত। একটা রাতই সহ্য করতে পারছি না; তাহলে কেমন করে সহ্য করব অনন্তকাল?
সারাটা রাত আমাকে ভাবতে হবে, এই যন্ত্রণা সইতে হবে, কিসের জন্য অপেক্ষা করছি অথবা কখন এ অপেক্ষার শেষ হবে তা না জেনেই অপেক্ষা করে থাকতে হবে। এমিলির বড় বোন ও ভগ্নিপতির আসার আওয়াজ পেলাম। টনি ও গ্রেগ চলে গেল। তার অল্পক্ষণ পরেই গেস্টরুমের দরজাটা খুলেই বন্ধ হয়ে গেল। কেউ ঘরে ঢুকল না। একটু পরেই হলের আলোও নিভে গেল। এখন ঘড়ির আলোই অন্ধকারের একমাত্র ব্যতিক্রম।
এমিলির সঙ্গে আবার কখন দেখা হবে? সে কি আবার এ ঘরে আসবে?
একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটতে লাগল। বাইরে সূর্যহীন মেঘলা দিন। খুবই অনুজ্জ্বল। ঘড়ির টিকটিক শব্দের সঙ্গে একটা একঘেয়ে দিন এগিয়ে চলল। কখনো পাছে কেউ ঘরে ঢোকে সেই ভয়, আবার কখনো মনে মনে প্রার্থনা জানাই, যেমন করে হোক, এমনকি এমিলির উপস্থিতির দ্বারাও যদিও হয় তবু এই সীমাহীন নির্জনতার শেষ হোক। কিন্তু দিন একইভাবে চলতে লাগল—কোনো ঘটনা নয়, শব্দ নয়, কর্মচাঞ্চল্য নয়। এমিলিকে হয়তো এখনো ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত গোধূলি লগ্নে-ঘড়িতে যখন ৬.৫২ বাজে—দরজাটা আর একবার খুলে গেল। এক লোক ঘরে ঢুকল।
প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। রাগীমতো লোকটা দৃঢ় পদক্ষেপে দ্রুত ঘরে ঢুকল, শয্যাপার্শ্বের দুটো বাতি জ্বালিয়ে দিল, তারপর খামোকাই জোরে ধাক্কা মেরে দরজাটা বন্ধ করে চাবিটা ঘুরিয়ে দিল। সে দরজা থেকে মুখটা ফেরাতেই অবাক হয়ে দেখলাম যে সে তো স্বয়ং আমি। আমি! আমি মরিনি, বেঁচে আছি! কিন্তু তা কেমন করে হয়?
কিন্তু তার হাতে কী? ঘরের কোণ থেকে চেয়ারটা টেনে এনে মাঝখানে রেখে চেয়ারের উপর সে উঠে দাঁড়াল-
না! না!
দড়িটাকে কড়িকাঠের সঙ্গে বাঁধল। অপর দিকে ফাঁসটা বানানোই ছিল, সেটাকে মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে দিতেই গলার উপর চেপে বসল।
হা ঈশ্বর! এ কাজ কোরো না।
লাথি মেরে চেয়ারটা সরিয়ে দিল।
চেয়ারটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দেবার পরমুহূর্তেই সেটার দিকে ফিরে চাইলাম, কিন্তু চেয়ারটা যেখানে ছিটকে পড়েছিল সেখান থেকে ফিরে এল না, আর আমার তেরো স্টোন এগারো হন্দর ওজনের ভারী দেহটাও গলার শক্ত দড়িটা থেকে ক্রমেই নিচের দিকে নামতে লাগল।
গলায় ব্যথা লাগছিল, ভয়ংকর ব্যথা; কিন্তু তার চাইতেও বিস্ময়করভাবে আমার গাল দুটো ফুলে উঠল।। যন্ত্রণাদীর্ণ চোখে বহু কষ্টে দরজার দিকে তাকালাম, মনে আশা এখনো যদি কেউ এসে আমাকে রক্ষা করে। যদিও জানি বাড়িতে কেউ নেই, আর দরজাটা বেশ ভালোভাবেই তালাবন্ধ করা হয়েছে। পা দুটো ছোড়ার ফলে শরীরটা দুলতে দুলতে ঘুরপাক খাচ্ছে; ফলে কখনো দরজার দিকে, কখনো জানালার দিকে আমার মুখটা ঘুরে যাচ্ছে। গলায় এঁটে বসে যাওয়া ফাঁসটা ঢিলে করার জন্য কাঁপা হাতে বৃথাই অনেক চেষ্টা করলাম, কোনো ফল হলো না।
ক্রমে দেহটা স্থির হয়ে এলো। মনে হলো, এবার আমার মৃত্যু হলো। এই তো মৃত্যু।