সীমার মাঝে অসীম তুমি

সীমার মাঝে অসীম তুমি

আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?

এই প্রশ্নটির সামনে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে বারবার পড়তে হয়েছে।

তিনি বারবার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সহজ স্বচ্ছতার সঙ্গে। তাঁর গভীর ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও তাঁর বিজ্ঞান-আলোকিত চেতনা থেকে উঠে এসেছে উত্তর।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নাস্তিক নন। বরং নাস্তিকতার বিরুদ্ধে তিনি খাড়া করেছেন তাঁর বোধদীপ্ত যুক্তি।

কিন্তু নাস্তিক না হলেও, তিনি বিশ্বাসী নন ব্যক্তিগত ঈশ্বরে।

নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আইনস্টাইন বলছেন, ‘The fanatical atheists are like slaves who are still feeling the weight of their chains which they have thrown off after hard struggle. They are creatures who-in their grudge against traditional religions as the ‘opium of masses’-cannot hear the music of the spheres.’

আইনস্টাইনের এই ভাষা হয়তো ঠিক বিজ্ঞানের ভাষা নয়। এ-ভাষা দর্শন ও সাহিত্যের। রোম্যান্টিকতা-প্রাণিত যে ভুবনবোধ প্রকাশ পেয়েছে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের এই বক্তব্যে তার পিছনে আছে মননের স্বাতন্ত্র্য ও হৃদয়ের প্রত্যয়। তিনি বলছেন যারা অন্ধ নাস্তিক, যাদের নাস্তিকতা যুক্তিবিহীন তারা যেন ক্রীতদাসের মতো। অনেক কঠিন লড়াই করে যে শিকলের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিল, তারা কিন্তু আসলে এখনও অনুভব করছে সেই শিকলেরই ভার। এই নাস্তিকের দল ঐতিহ্যবাহী ধর্মকে মনে করে জনসাধারণের নেশার আফিম। হায়রে, ওরা শুনতে পায় না মহাকাশের সংগীত।

তাহলে কি আইনস্টাইন আস্তিক?

না, তাও নয়।

একদিকে অন্ধ নাস্তিকতা। অন্যদিকে ব্যক্তিগত ঈশ্বরে বিশ্বাসী আস্তিকতা।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মৌলিক ঈশ্বরভাবনার স্বাতন্ত্র্যে আলোকিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই দুই মেরুর মধ্যবর্তী প্রত্যয়ভূমিতে।

তিনি ‘agnostic’। তিনি পরিষ্কার বলছেন, যে-ঈশ্বরে বিশ্বাসী তিনি, তার সঠিক প্রকৃতি কী, তা তিনি জানেন না। কিন্তু যাঁরা ব্যক্তিগত ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, যাঁদের বিশ্বাসে মূর্ত হয়ে আছেন ঈশ্বর মানুষী প্রতিমায়, তাঁদের সম্পর্কে আইনস্টাইনের ধারণা কীরকম? তিনি কি কঠোর সমালোচক?

মোটেই তা নয়। তিনি বরং লিখেছেন, such a belief seems to me preferable to the lack of any transcendental outlook.

তা হলে কি আইনস্টাইনকে ধার্মিক-মানুষ বা religious man বলা যায়?

এক গহন দার্শনিক বা রোম্যান্টিক কবির ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এ-যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নিজেই—

A knowledge of the existence of something we cannot penetrate, of the manifestations of the profoundest reason and the most radiant beauty, which are only accessible to our reason in their most elementory forms-it is this knowledge and this emotion that constitute the truly religious attitude; in this sense and in this sense alone, I am a deeply religious man.

এমন এক সত্তার অস্তিত্বের জ্ঞান যাকে আমরা ভেদ করতে পারি না; গভীরতম বোধ ও উজ্জ্বলতম সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে এমন এক সত্তায়— শুধু আমাদের বোধবুদ্ধি যে-সত্তার প্রাথমিক রূপটি ধরতে পারে— এই জ্ঞান এবং এই আবেগই তৈরি করে সত্যিকার ধর্মীয় ভাব। এই অর্থেই এবং শুধুমাত্র এই অর্থেই আমি একজন গভীরভাবে ধর্মীয় মানুষ।

এই ধর্মের কোনও নাম আছে?

সেই নামটির ব্যাখ্যা নিজেই জানিয়েছেন আইনস্টাইন। সেই ধর্ম মহাজাগতিক— যে-ধর্মের প্রকাশ ঘটেছে প্রকৃতির অন্তরবার্তায়। লিখছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন—

I have nothing but awe when I observe the laws of nature. There are not laws without a lawgiver, but how does this lawgiver look? Certainly not like a man magnified.

আমি যখন প্রকৃতির নিয়মকানুন, অন্তরনীতিগুলি অনুধাবন করি, তখন আমার মধ্যে ভয়ংকর বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই জাগে না। যখনই থাকবে কোনও নিয়মকানুন, রীতিনীতি তখনই থাকবে তাদের স্রষ্টাও। কিন্তু কেমন দেখতে এই বিশ্বপ্রকৃতির স্রষ্টাকে? নিশ্চয় সেই স্রষ্টা নয় কোনও বিপুল আকৃতির মানব।

আমাদের তুলনায় সেই স্রষ্টার ক্ষমতা ও শ্রেয়তা সীমাহীন।

আমার একান্ত নিজস্ব ধর্ম হল, সেই অন্তহীন সত্তার কাছে শ্রদ্ধায় অবনত হওয়া।

আইনস্টাইনের এই বক্তব্য, ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর এই ধারণা আমাকে মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের গানে এমনই এক সত্তার অনিবর্চনীয় উদ্ভাসের কাছে কবির প্রণতি—

তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী

আমি অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি।

ভবিষ্যতের মানবজাতির জন্যে এক মহাজাগতিক ধর্মের কথা ভেবেছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

এই ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন আইনস্টাইন এই ভাষায়—

It should transcend personal God and avoid dogma and theology. Covering both the natural and the spiritual, it should be based on a religious sense arising from the experience of all things natural and spiritual as a meaningful unity.

অর্থাৎ, এই মহাজাগতিক ধর্ম পেরিয়ে যাবে ব্যক্তিগত ঈশ্বরকে। এই ধর্ম ঈশ্বর-কেন্দ্রিক হবে না। এই ধর্মে থাকবে না কোনও সংস্কার-আচ্ছন্ন সংকীর্ণতা, কোনও শাস্ত্রীয় অনুশাসন। এই ধর্ম একই সঙ্গে গ্রহণ করবে প্রাকৃতিক এবং পারমার্থিককে। এই ধর্মের ভিত হবে এমন এক আধ্যাত্মিক চেতনা যার উত্স আমাদের যূথবদ্ধ সামগ্রিক অভিজ্ঞতা। যে-অভিজ্ঞতার অন্তরে যা কিছু প্রাকৃতিক এবং যা কিছু আধ্যাত্মিক সব একসঙ্গে নিহিত থাকবে অর্থবহ বন্ধনে।

আমাদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আইনস্টাইনের ঈশ্বর ও ধর্ম সম্পর্কে এই চেতনার উত্সটি কোথায়? এই ভাবনার সূত্র ধরে পিছন ফিরে তাকালে কোথায় পৌঁছব আমরা?

পৌঁছব দার্শনিক স্পিনোজার ঈশ্বর-ভাবনায়। আইনস্টাইন নিজেই আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ঈশ্বরচেতনার উৎসে—

I believe in Spinoza’s God, who reveals himself in the harmony of all that exists, not in a God who concerns himself with the fate and the doings of mankind.

তাঁর স্বচ্ছ, যুক্তিগ্রাহ্য প্রত্যয়ের ভূমিতে দাঁড়িয়ে এখানে ঈশ্বর সম্পর্কে দ্বিধাহীন উচ্চারণে কথা বলেছেন আইনস্টাইন। বলেছেন তিনি বিশ্বাস করেন স্পিনোজার ঈশ্বরে।

কেমন এই ঈশ্বর? আইনস্টাইন কুণ্ঠাহীন স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, সেই ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করছেন সমস্ত অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত ছন্দবদ্ধতার মধ্যে।

তারপর একই স্পষ্টতার সঙ্গে বলছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না সেই ঈশ্বরে যিনি শুধু মানবজাতির কাজকর্ম আর ভাগ্যের ব্যাপারে সর্বদা চিন্তিত।

দার্শনিক হিসেবে আইনস্টাইন কেন স্পিনোজার ভক্ত? স্পিনোজার দর্শনভাবনার কোন দিকটি তাঁকে সবচেয়ে মুগ্ধ করে? আইনস্টাইনের কাছেই শোনা যাক এই প্রশ্নের উত্তর—

I am fascinated by Spinoza’s pantheism, but admire even more his contribution to modern thought because he is the first philosopher to deal with the soul and body as one, and not two separate things.

স্পিনোজাই প্রথম দার্শনিক যিনি আত্মা ও শরীরকে এক করে ভাবতে পেরেছিলেন। তাদের মধ্যে তফাৎ করেননি। এই কারণেই আইনস্টাইনের স্পিনোজামুগ্ধতা! বোঝাই যাচ্ছে বিজ্ঞানী শ্রোডিঙ্গারের মতো আইনস্টাইন আমাদের বৈদিক দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি। স্পিনোজার ভাবনা বৈদিক দর্শনের কত কাছের!

অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ঈশ্বরদর্শনের গভীরে পৌঁছনো সহজ কাজ নয়। বিজ্ঞান-দর্শন এবং রোম্যান্টিক ভুবনচেতনা একাকার হয়ে মিশে গেছে আইনস্টাইনের ঈশ্বরভাবনায়। তিনি এ-যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হয়েও ঈশ্বর-বিষয়ে কখনও কথা বলেন দার্শনিকের ভাষায়, কখনও কবির ভাষায়। কিন্তু যেভাবেই কথা বলুন তিনি, বলেন বড় সুন্দরভাবে। তাঁর ভাবের মধ্যে ফুটে ওঠে যুক্তিনির্ভর বোধদীপ্ত পরম আধ্যাত্মিকতা। শোনা যাক আইনস্টাইনের মুখের কথা। কথাগুলি উঠে এসেছে তাঁর নিজস্ব মনন ও মগ্নতা থেকে—

Try and penetrate with our limited means the secrets of nature and you will find that, behind all the discernible laws and connections, there remains something subtle, intangible and inexplicable. Veneration for this force beyond anything that we comprehend is my religion. To that extent I am, in fact, religious.

একটি পার্টিতে পানভোজন গল্পগুজব চলছে। সেই পার্টিতে উপস্থিত স্বয়ং আইনস্টাইন। হঠাৎ উঠল ধর্ম এবং ঈশ্বরের প্রসঙ্গ। আইনস্টাইন শুনছেন, একটি কথাও বলছেন না। পার্টিতে উপস্থিত এক অতিথি বললেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস হল কুসংস্কার।

গৃহকর্তা এই তর্ক থামাতে বললেন, তা কেন? স্বয়ং আইনস্টাইনের মধ্যেও ধর্মীয় বিশ্বাস আছে।

পাশেই দাঁড়িয়ে আইনস্টাইন। তখনও একটিও কথা বলেননি ঈশ্বর সম্পর্কে। যে-ভদ্রলোক ঈশ্বরকে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি কিছুটা অবাক হয়েই আইনস্টাইনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, সত্যি! আপনিও ধর্মে বিশ্বাস করেন? সবাই এবার তাকিয়ে আইনস্টাইনের দিকে।

কী উত্তর দেবেন ভুবনবিখ্যাত এই বিজ্ঞানী?

বলেছিলেন, আপনাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে প্রকৃতির গহন রহস্যকে একবার ভেদ করার চেষ্টা করুন। দেখবেন প্রকৃতির সমস্ত দৃশ্য, পরিচিত নিয়মকানুন আর সংযোগগুলির পিছনে এমন একটা কিছু আছে যা সূক্ষ্ম, অদৃশ্য এবং ব্যাখ্যার অতীত। আমরা যা কিছু ভাবতে ও বুঝতে পারি এই ফোর্স তার অতীত। এবং এই ফোর্সের প্রতি শ্রদ্ধাই আমার ধর্ম। এইভাবে দেখলে আমাকে ধর্মে বিশ্বাসীও বলা যায়।

একটি কথা এখানে জানিয়ে রাখি। শৈশবে আইনস্টাইন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। সেটা ছিল আইনস্টাইনের জীবনে বেশ সোচ্চার ধর্মভাবের অধ্যায়।

তারপর তিনি হঠাৎ ঈশ্বরে স্পষ্টতই অবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। প্রায় জীবনের চল্লিশটা বছর কাটালেন ঈশ্বর সম্পর্কে কোনওরকম আগ্রহ না দেখিয়ে। ক্রমে তাঁর বয়েস পঞ্চাশ হল। এবং পরিবর্তিত হল ঈশ্বর সম্পর্কে তার ভাবনাচিন্তা। তিনি ঈশ্বর সম্বর্কে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। লিখলেন ঈশ্বর সম্পর্কে। সাক্ষাৎকার দিলেন ঈশ্বর বিষয়ে। ঈশ্বর বিষয়ে আলোচনায় সময় কাটালেন। চিঠিতেও এল ঈশ্বরের প্রসঙ্গ। তিনি বিশ্বাস করেন ঈশ্বরে, এ-কথা যেমন বোঝা গেল, সেই ঈশ্বর যে কোনও সাকার ব্যক্তিগত ঈশ্বর নন, সেকথা বুঝতেও অসুবিধে হল না।

গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ডের ইকুয়েশনগুলিতে যখন তিনি মোহিত হচ্ছেন, বলছেন তাদের সৌন্দর্যের কথা, কিংবা যখন কোয়ানটাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তার সমালোচনা করছেন তখনও অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বিশ্বজগতের অন্তর্নিহিত পারিপাট্যের প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশ করছেন বারবার। মহাবিশ্বের এই যে সুসংবদ্ধতা, এই যে অন্তহীন সৌন্দর্য, তার প্রতি এই শ্রদ্ধাই আইনস্টাইনের বিজ্ঞানচেতনা ও ধর্মবোধের উত্স।

এই কথাটাই আইনস্টাইন বললেন তাঁর অনবদ্য ভাষায়, প্রকাশ করলেন মহাবিশ্ব সম্পর্কে তাঁর মৌলিক মনন—

The highest satisfaction of a scientific person is “that God himself could not have arranged these connections any other way than that which does exist,…”

একজন বিজ্ঞানীর সবচেয়ে বড় তৃপ্তি কী? সেই তৃপ্তি হল, এইটুকু বুঝতে পারা যে স্বয়ং ঈশ্বরও মহাবিশ্বকে অন্যভাবে সৃষ্টি করতে পারতেন না, যেভাবে আছে সেইভাবেই সৃষ্টি করতে হত। মহাবিশ্বের মধ্যে নিহিত ‘কানেকশন’-গুলিকে অন্যভাবে সাজানো যেত না।

সবে কেটেছে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পঞ্চাশতম জন্মদিন। তাঁকে সরাসরি আবার প্রশ্ন করা হল, আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?

এই প্রশ্নের অসামান্য উত্তর দিলেন আইনস্টাইন—

I am not an atheist. The problem involved is too vast for our limited minds. We are in the position of a little child entering a huge library filled with books in many languages. The child knows someone must have written those books. It does not know how. It does not understand the languages in which they are written. The child dimly suspects a mysterious order in the arrangement of the books but doesn’t know what it is. That, it seems to me, is the attitude of even the most intelligent human being toward God. We see the universe marvelously arranged and obeying certain laws but only dimly understand these laws.

এরচেয়ে সহজ করে ঈশ্বরের মতো জটিল ও গূঢ় বিষয়টি নিয়ে বোধহয় আলোচনা করা যায় না। প্রথমেই আইনস্টাইন বলছেন, তিনি নাস্তিক নন। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তরে তিনি দ্বিধাহীনভাবে জানালেন, তিনি নাস্তিক নন— আইনস্টাইনের এই উক্তি বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। তারপরেই যে-কথাটি তিনি বললেন, সেটির গুরুত্ব আরও বেশি— ঈশ্বর আছে কি নেই সেটি নির্ধারণ করতে আমরা যে-সমস্যার মধ্যে পড়ি সেটি আমাদের সীমিত বোধবুদ্ধির পক্ষে এক বিশাল সমস্যা।

আমাদের অবস্থাটা তখন কেমন? ধরা যাক, একটা বিশাল লাইব্রেরিতে সাজানো রয়েছে নানা ভাষায় লেখা বিচিত্র বই। এবং সেই লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েছে একটি শিশু। শিশুটি জানে কেউ একজন এইসব বই লিখেছে। কিন্তু শিশুটি জানে না, কেমন করে লিখেছে। বইগুলি যেসব ভাষায় লেখা তা শিশুটি বুঝতে পারে না। কিন্তু সে অস্পষ্টভাবে আন্দাজ করে যে, বইগুলি যেভাবে গোছানো হয়েছে তার মধ্যে একটা রহস্যময় পদ্ধতি আছে। কিন্তু এই পদ্ধতিটা কেমন, তা সে জানে না।

এবার আইনস্টাইন এমন একটি উক্তি করেছেন যা তাঁর ঈশ্বরদর্শনের একেবারে মূল কথা— তিনি বলছেন, একটি বিশাল লাইব্রেরিতে অজানা ভাষায় লেখা বইগুলি দেখে শিশুর মনে যে-ভাবটি উদয় হল, সেইটেই আমাদের মধ্যে খুব বুদ্ধিমান মানুষের মনোভাব ঈশ্বরের প্রতি। লাইব্রেরিতে সাজানো বইগুলি দেখে যেমন শিশুটির মনে হতে পারে, সেই সাজানোর পিছনে এক রহস্যময় পদ্ধতি কাজ করেছে, ঠিক তেমনি মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়েও আমাদের মনে হয়, কী বিস্ময়করভাবে সাজানো এই মহাবিশ্ব রহস্যময় কিছু নিয়ম মেনে চলেছে! কিন্তু সেই রহস্যময় সব নিয়ম আমরা শুধু আবছাভাবে বুঝতে পারি!

চমৎকার এই তুলনা।

যখনই আইনস্টাইন আলোচনা করেছেন ঈশ্বর-প্রসঙ্গে, যখনই তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি করেন না, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করেছেন, তখনই আইনস্টাইন সরে গেছেন বিজ্ঞানের ভাষা থেকে। তখন যেন তিনি কবি কিংবা দার্শনিক— কিন্তু এমন এক কবি বা দার্শনিক যিনি কথা বলেন গভীর বিজ্ঞানচেতনা থেকে। যেমন, The most beautiful emotion we can experience is the mysterious. রহস্যময়তার অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি— বললেন আইনস্টাইন। শিল্প এবং বিজ্ঞান উভয়েরই জন্ম রহস্যময়তার অনুভূতি থেকে। আইনস্টাইনের ভাষায়, It is the fundamental emotion that stands at the cradle of all true art and science. এই মহাবিশ্বের নিহিত রহস্যের প্রতি যে মানুষের কোনও আবেগ নেই তাকে মৃত বলেই ধরা যায়— সে যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়া বাতি। He to whom this emotion is a stranger, who can no longer wonder and stand rapt in awe, is as good as dead, a snuffed-out candle.

কাকে বলে ধার্মিকতা? ভিন্ন ভাষায় ব্যাখ্যা দিলেন আইনস্টাইন। বিশ্বের অন্তর্নিহিত রহস্যময়তার সূত্র ধরেই তিনি বললেন, যা কিছু আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারি, ধরতে পারি, তার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা আমাদের মন কিছুতেই বুঝতে পারে না, যা থেকে যায় আমাদের নাগালের বাইরে, যার সৌন্দর্য এবং মহত্ত্ব আমাদের কাছে পৌঁছয় তির্যকভাবে— এই অনুভবই হল ধার্মিকতা। To sense that behind anything that cannot be experienced there is something that our minds cannot grasp, whose beauty and sublimity reaches us only indirectly: this is religiousness. হ্যাঁ, আমি এই অর্থে অত্যন্ত গূঢ়ভাবে একজন ধার্মিক মানুষ, বলেছেন আইনস্টাইন।

আমি ‘ভগবান’ বলতে কী বুঝি জানতে চান? বেশ, তা হলে খুব সংক্ষেপে বলছি, শুনুন—

My religiosity consists of a humble admiration of the infinitely superior spirit that reveals itself in the little that we can comprehend about the knowable world. That deeply emotional conviction of the presence of a superior reasoning power, which is revealed in the comprehensible universe, forms my idea of God.

এই বিশ্বভুবনের কতটুকুই বা বুঝি! যতটুকু বুঝতে পারি, তার মধ্যে প্রকাশিত দেখি এক মহত্তর সত্তা। তার প্রতি বিনত শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতাকেই আমি মনে করি ধর্মানুভব। এই বোধগম্য মহাবিশ্বের মধ্যে বিরাজ করছে এক উচ্চতর, শ্রেয়তর বুদ্ধিমত্তা— এই গভীর ভাবানুবেগ প্রাণিত প্রত্যয়ই আমাকে দিয়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের অনুভব।

এইখানেই থেমে থাকেননি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। আরও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, যে-ফোর্স শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জগতে সবকিছু ঘটাচ্ছে, তার ওপর আমাদের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই। ক্ষুদ্রতম পোকামাকড় থেকে বৃহত্তম তারকা— সবাই এই ফোর্সের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষ উদ্ভিদ, শাকসবজি কিংবা সুদূর মহাজাগতিক ধুলো, আমরা সবাই নাচছি এক রহস্যময় সংগীতের সুরে। সেই সুর বাজাচ্ছে এক সুদূর অদৃশ্য সুরশিল্পী।

I am a determinist. Everything is determined, the beginning as well as the end, by forces over which we have no control. It is determined for the insect as well as for the star. Human beings, vegetables or cosmic dust, we all dance to the mysterious tune, intoned in the distance by an invisible player.

আকাশভরা সূর্যতারার দিকে তাকিয়ে বিনম্র বিস্ময়ে জেগে ওঠা চেতনা— এই হল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের চোখে ‘রিলিজিওসিটি’, ধর্মোপলব্ধি। এই অনন্ত সৃষ্টির বুননে মিশে থাকা এক পরম শক্তিমান নিরাকার সত্তা— এই হল আইনস্টাইনের ঈশ্বর। আইনস্টাইনের এই ভাবনা থেকে প্রাচীন ভারতের ঋষির ধ্যানোপলব্ধ প্রত্যয় খুব দূরের পথ নয়। উপনিষদে ‘ব্রহ্ম’ শব্দটির অর্থ ‘বৃহত্তম’। মহাবিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন রূপে এই ‘বৃহত্তম’ সত্তা প্রতিভাত হচ্ছে। এই সত্তা পরিবর্তনের অতীত। উপনিষদও একই কথা বলছে— ব্রহ্ম কখনও ব্যক্ত, কখনও অব্যক্ত, কখনও গোচর, কখনও অগোচর। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্যমান জগতে আমরা ব্রহ্মেরই প্রকাশ দেখি। উপনিষদের ভাষায়— পূর্ণাৎ পূর্ণম উদচ্যতে, এই প্রকাশমান স্থূল জগতের উত্স এক অদৃশ্য, অব্যক্ত সত্তা। যেমন বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয় চারাগাছ। আমরা বীজটিকে দেখতে পাই না। কিন্তু বীজের অস্তিত্ব সন্দেহের অতীত। সে না থাকলে গাছটি কোথা থেকে এল? এক এবং অদ্বিতীয় সেই সত্তা সৃষ্টির প্রতিটি ক্ষেত্রে উপস্থিত। এই অদৃশ্য, অগোচর পরম সত্তার উদ্দেশেই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ—

এই তো তোমার আলোকধেনু সূর্য তারা দলে দলে—

কোথায় বসে বাজাও বেণু, চরাও মহাগগনতলে ॥

আইনস্টাইনও শুনতে পেয়েছিলেন এই মহাজাগতিক রহস্যময় বেণু, ‘the mysterious tune, intoned in the distance by an invisible player.’

একজন বিজ্ঞানী। অন্যজন কবি। তবু ওঁদের ভুবনবীক্ষণ, ওঁদের ঈশ্বর-অনুভব কোথায় যেন এক স্রোতে মিশেছিল! তা সত্ত্বেও ওঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির কোনও স্বাতন্ত্র্য ছিল কি? জানা যাবে তাঁদের মুখোমুখি ঐতিহাসিক সংলাপে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *