সীমান্ত প্রদেশ
দরজার আড়াল থেকে হীরেন দেখতে পেল, ওর স্ত্রী ললিতাকে ওর বন্ধু হেমকান্তি চুমু খাচ্ছে। হীরেন একটু হাসল।
হীরেন চিঠি ফেলতে গিয়েছিল, কাল বিকেলবেলা বেড়াতে গিয়ে ওরা যে দোকান থেকে ঢাকাই পরোটা খেয়েছে, তার পাশেই অশ্বত্থগাছের সঙ্গে লাগানো ডাকবাক্স, হেমকান্তির কাছে ডিরেকশন শুনে নিয়ে হীরেন সেটা ঠিকই চিনতে পারত এবং তাহলে চিঠিটা ফেলে আসতে হীরেনের সময় লাগতো বারো মিনিট, মেরে কেটে দশ মিনিট তো বটেই। তা বলে হীরেন যে অন্য সময় অনুপস্থিত থাকে না তা নয়, বা কালকে বিকেলেই তো বেড়াবার সময়, একটা লোকের হাতে বেতের তৈরি ব্যাগ দেখে হীরেন এমন মোহিত হয়ে যায় যে, সেই লোকটির সঙ্গে বেত-শিল্প বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা জুড়ে দেয়, বিরক্ত হয়ে সেই মন্থর অবসন্ন সন্ধ্যায় ললিতা ও হেমকান্তি আলাদা হাঁটতে থাকে মাঠের মধ্যে, অনেক দূর চলে গেলে হেমকান্তি চেঁচিয়ে বলেছিল, এই হীরেন, আমরা খালের ধারে গিয়ে বসছি! তুই আয়—এ কথা বলারও অনেকক্ষণ পর হীরেন এসেছিল।
সুতরাং, এখন এই চিঠি ফেলতে যাবার দশ মিনিটের কোনো আলাদা মূল্য নেই, শুধু, হীরেন যদি সত্যি সত্যি দশ মিনিট ব্যয় করত, তাহলে এই দৃশ্যটা তাকে দেখতে হত না। কারণ, ললিতা ও হেমকান্তি এ বিষয়ে মুখে কিছু আলোচনা না করে নিলেও দুজনেই মনে মনে নিশ্চিন্ত ছিল, এখন সময় আছে দশ মিনিট এবং ললিতা ঝটকা মেরে হেমকান্তিকে ঠেলে দেবার সময় বলেছিল, কী করছেন কী! আপনি পাগল, এক্ষুনি ও এসে পড়বে! হেমকান্তি বলেছিল, না, আসবে না, একবার, একবার।
কিন্তু হীরেন দশ মিনিট খরচ করেনি। সেটা ঠিক তার দোষও নয়। হীরেনের হাতে ঘড়ি নেই, কিন্তু বোধহয় ও সাড়ে তিন কি চার মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসেছে। এই অসময়ে ফিরে আসার জন্য পরোক্ষে হেমকান্তিই দায়ী। পিসিমাকে বলে এসেছিল পৌঁছে সংবাদ দেবে, কিন্তু যেদিন হীরেনরা হেমকান্তির কাছে এসে পৌঁছোয় সেদিন শনিবার বিকেল, পরদিন রবিবার ডাক বন্ধ, আজ সোমবার সকালে চা-পর্ব শেষ করার পর, হীরেনেরই মনে পড়ে চিঠি লেখার কথা, ওর সুটকেসেই পোস্টকার্ড ছিল, হীরেন একপিঠে লেখার পর অন্যদিকে ললিতার পিসতুতো বোন বুলুকেও কয়েক লাইন লিখে দেয়, হেমকান্তি তখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে দাড়ি কামাচ্ছে, ললিতা মুরগির মাংসের গা থেকে পালক ছাড়াচ্ছে। সে সময় হীরেনের ঠিক কিছুই করার নেই ভেবে সে নিজেই চিঠিটা ফেলে আসার কথা ভাবল, চাকর এই মাত্র বাজার থেকে এসেছে, তাকে আবার এখুনি পাঠানো ঠিক নয়।
পরনে সিল্কের লুঙ্গি ছিল, তার ওপর পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে নিয়ে হীরেন যখন বেরুবে, তখন হেমকান্তি চেঁচিয়ে বলেছিল, সিগারেট নেই, দুপ্যাকেট সিগারেটও আনিস তো! হীরেন আচ্ছা বলে বেরিয়ে যায়, ভুজিয়াওয়ালার দোকান পর্যন্ত পৌঁছেই ওর মনে পড়ায় পকেটে হাত দিয়ে দেখে যে পকেট ফাঁকা। কাল রাত্তিরে, হেমকান্তি বলেছিল এখানে বড়ো চোরের উপদ্রব, তাই হীরেন পকেট থেকে টাকাকড়ি ও খুচরো পয়সা পর্যন্ত সবই সুটকেসের মধ্যে রেখেছিল। তাহলে সিগারেট কেনার পয়সা আনার জন্যই তাকে ফিরতে হয়।
হীরেন ভেবেছিল বাড়িতে আর না ঢুকে জানলা দিয়েই পয়সা নেবে। কিন্তু তখন মনে পড়ে, উঠোনের রোদে বসে হেমকান্তিকে ও দাড়ি কামাতে দেখে এসেছে, ললিতাও রান্নাঘরের সামনে বারান্দায়, সুতরাং ওরা কেউ শুনতে পাবে না। হীরেন তাই বাড়ির মধ্যে ঢুকে বৈঠকখানা পেরিয়ে, হেমকান্তির ঘর পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় হেমকান্তির ঘরের একপাল্লা ভেজানো দরজা দিয়ে একেবারে ওপাশের দেয়ালের কাছে সেই চুম্বনের দৃশ্য দেখতে পায়।
ঠিক ওদের না দেখলেও, হয়তো আলমারি-জোড়া আয়নায় ওদের ছায়া দেখেছিল, মোট কথা হীরেন দেখেছিল মাত্র এক ঝলক, ললিতার চুলের মধ্যে হেমকান্তির হাত ও মুখের কাছে মুখ। আর হীরেন কয়েকটা কথাও শুনতে পেয়েছিল, সে কথাগুলো ছবির মতন, সব দেখতে পাওয়া যায়। উঠোনে হেমকান্তির দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম ছড়িয়ে আছে, রান্নাঘরের বারান্দায় রাখা আছে আনাজ ও মাংস, চাকর বাথানি বাইরের কুয়ো থেকে জল তুলছে। হীরেন একটু হাসল।
অন্তত দশ মিনিট হীরেনের বাইরে থাকার কথা ছিল, তার মধ্যে মাত্র সাড়ে তিন কি চার মিনিটে ফিরে এসেছে। না এলেই ভালো হতো। এই দশ মিনিটের দাম বড়ো কম নয়, হয়তো সারাজীবন। দশ মিনিট বাদে এলে ওরা নিশ্চয়ই সাবধান হয়ে যেত, ওরা দুজনের কেউই তো কাণ্ডজ্ঞানহীন নয়।
হীরেন এক মিনিট কী দেড় মিনিট ওখানে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপরই মনে পড়ল, হঠাৎ ওরা ওকে এখন দেখতে পেলে ব্যাপারটা বিশ্রী লজ্জাজনক হয়ে পড়বে। ওরা দুজন হয়তো ভাববে, হীরেন আগে থেকেই ওদের সন্দেহ করেছিল বলেই গোপনে ফিরে এসে চোরের মতন দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে হীরেনের এই কথায় মনে হয়, সে মোটেই এমন খুঁতখুঁতে ও অনুদার নয় যে বন্ধুকে সন্দেহ করবে। বন্ধুর সঙ্গে নিজের স্ত্রীকে একা রেখে সন্দেহবশে আড়ি পেতেছে। ওরা যদি তাকে দেখে এখন সেই কথা ভাবে, সেটা খুবই অন্যায় হবে। হীরেন ঘুণাক্ষরেও এ সব কিছু ভাবেনি, সেইটা প্রমাণ করার জন্যই যেন তার সেখান থেকে তখুনি চলে যাওয়া দরকার।
তা ছাড়া, দ্বিতীয় কারণটি এই, এখুনি যদি তারা দুজনে তাকে দেখে ফেলে তা হলেই ব্যাপারটা সারা জীবনের মতো, স্থায়ী হয়ে গেল, হেমকান্তির সঙ্গে সে ঝগড়া করতে বাধ্য হবে। ঘটনাটা দুজনের কাছেই জানাজানি হয়ে গেলে তারপর আর শান্তভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, ললিতার সঙ্গেও তার সম্পর্ক কী দাঁড়াবে কে জানে—শেষ পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা আত্মহত্যা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকতে পারে। অথচ সামান্য একটা চুমুর জন্য, দেখে ফেলার জন্য।
এখানেই হীরেন একবার হাসল। ভাবতে ভাবতেই আরও তিন-চার মিনিট কেটে যায়, চুম্বন শেষ করে ললিতা ও হেমকান্তি একটু দূরে সরে গিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। এই অবসরে হীরেন খুব সাবধানে আবার উঠোন পেরিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে। নিজের বাড়ি থেকে তাকে সন্তর্পণে লুকিয়ে বেরুতে হচ্ছে, এটাও একটা হাসির ব্যাপার।
এখন আর সিগারেট খাবার কোনো উপায় নেই জেনে সামান্য অস্বস্তি হল, শরীরটার মধ্যেও খানিকটা চিনচিন করছে, কাছে সিগারেট না থাকলে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছেটা কী সাংঘাতিক প্রবল হয়, বস্তুত হীরেন শরীরে এক ধরনের অবসাদ বোধ করতে থাকে, ললিতার চুলের গুচ্ছে হেমকান্তির একটা হাত মুঠো করা—হেমকান্তি মুখখানা আস্তে আস্তে এগিয়ে আনছে—এই দৃশ্যটাই শুধু তার চোখে ভাসছে। হীরেন লক্ষ করল, ওর কপালের কাছে ও নাকের ডগাটা একটু গরম গরম লাগছে, অর্থাৎ ও উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। অথচ ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, হীরেন ভাবল , কিছুই এতে আসে যায় না, সামান্য একটি চুমু, সে নিজেও কি আগে একাধিক মেয়েকে চুমু খায়নি? সে কি তাদের জন্য বিরলে দুঃখ বোধ করে? মোটেই না তারা কোথায় হারিয়ে গেছে, বিশেষ বিশেষ সেই সব চুমু খাবার মুহূর্তে খানিকটা আকর্ষণ বোধ করেছিল—এই পর্যন্ত। একমাত্র অরুণা, মাঝে মাঝে অরুণার ব্যাপারটা একটু খটকা লাগে, কিন্তু সে ঘটনাই তো অন্য রকম। অরুণাকে তার মাঝে মাঝে মনে পড়ে, মনে পড়লেই একটু খারাপ লাগে , কিন্তু অরুণা তাকে ভুলে গেছে নিশ্চয়ই, ভুলে যাওয়াই ভালো। ললিতাও হেমকান্তিকে ভুলে যাবে—এবার হেমকান্তির জন্য একটা ভালো পাত্রী দেখে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে দেখছি।
লাল ডাকবাক্সটার গায় এমন একটা মরচে ধরা তালা লাগানো যে দেখলে সন্দেহ হয়—কোনোদিন এটা খোলা হয় কি না! হীরেন একটু ইতস্তত করল। এ সব মফস্বল শহরের ডাক ব্যবস্থায় ঠিক বিশ্বাস নেই, সে মিষ্টির দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতে গেল। দোকানে কাঠের বেঞ্চিতে চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে কয়েকজন যুবক আড্ডা দিচ্ছে , চায়ের দোকানে আড্ডা মারার স্বভাব কলকাতা থেকে পুরুলিয়ার মতন শহরেও পৌঁছে গেছে। হীরেনের খুবই লোভ হল ওই দোকানে বসে একটু চা খায়, আরও খানিকটা সময় কাটিয়ে ফিরতে চায়, কিন্তু উপায় নেই, পকেটে একটা পয়সা পর্যন্ত নেই। সিগারেটের তৃষ্ণাও তাকে আকুল করে তোলে। এখানে একা বসে চায়ের সঙ্গে সিগারেট খেতে পারলে তার মুখখানা স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারত, তখন সে ওদের দুজনের মনে সামান্যতম সন্দেহ না জাগিয়ে বাড়ি ফিরতে পারত।
স্বাভাবিক তাকে হতেই হবে, হীরেন খুব মনের জোর দিয়ে কথাটা ভাবল, একটা চুমুর জন্য কিছু আসে যায় না। হেমকান্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব সে নষ্ট করতে পারবে না। আর, ললিতার ভালোবাসা হারালে পৃথিবীতে সে আর কোথায় আশ্রয় পাবে? হীরেন তখন একটু আগে দেখা সেই দৃশ্য ও গুণের দুজনের যা সামান্য কথা সে শুনতে পেয়েছে তাই মনে করার চেষ্টা করল।
হীরেন যখন দরজার কাছাকাছি এসেছিল, তখন ললিতার কাঁধে হেমকান্তির হাত। তা দেখে হীরেনের একটুও খটকা লাগেনি, এমনকি একথাও ভাবেনি, মাত্র সাড়ে তিন মিনিট আগে ওরা দুজন ছিল উঠোনে ও রান্নাঘরে এরই মধ্যে দুজনে দুজনের কাজ ফেলে ঘরের মধ্যে চলে এল কী করে? তবে কি আগে থেকেই ওদের ঠিক করা ছিল, হীরেন বেরিয়ে যাবার পরই চোখোচোখিতে কথা ঠিক হয়ে যায়? হীরেন তখনও একথা ভাবেনি, ভেবেছিল পরে, তার আগে সে অন্যমনস্কভাবে দরজা পেরিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় শুনতে পেল, কী করছেন। কী? আপনি পাগল! এক্ষুনি ও এসে পড়বে। আর, তারপরই হেমকান্তির ব্যাকুল মিনতিপূর্ণ গলা, না আসবে না, একবার, একবার! হীরেন তখন দাঁড়িয়ে পড়েছিল, যেন নিজের স্ত্রী ভেবে নয়, কোথাও কোনো যুবতীকে কোনো যুবক চুমু খাচ্ছে—এই দৃশ্য দেখে ফেললে যেমন আড়াল থেকে আরও দেখতে ইচ্ছে হয়—অনেকটা সেই রকম। ললিতা বলেছিল, না, একবারও না , ছিঃ।
হেমকান্তি বলেছিল, এসো, একবার, শুধু একবার!
না! না!
হ্যাঁ! এসো!
না! কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন।
আমি কত কষ্ট পাচ্ছি, তুমি জানো না।
এরপর হেমকান্তি একহাত ললিতার কোঁকড়ানো চুলের গুচ্ছে ডুবিয়ে অন্য হাতে ললিতার চিবুক ধরে, এবং ললিতার সকালবেলার ফোলা ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন করে। একবার মাত্র। চুম্বনের পর দুজনই কয়েক সেকেন্ড একেবারে নিঃশব্দ। তারপর ললিতা খানিকটা কাতর গলায় বলেছে, কেন এ রকম করলেন?
হেমকান্তি চাপা গলায় স্বীকার করে, আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি আর পারছিলাম না, তুমি এত সুন্দর!
ও কথা আর বলবেন না।
ওকথা বারবার বলব। কিন্তু এইমাত্র যা করলুম, তার জন্য আমার অনুতাপ হচ্ছে, হীরেনকে আমি দুঃখ দিতে চাই না।
সত্যি এরকম আর কখনও করবেন না বলুন? ও আপনার কতদিনের বন্ধু।
আমার ওপর রাগ করো না, আমাকে ক্ষমা করো, আর কখনও না।
এই সময় হীরেন চলে এসেছিল।
চিঠি ফেলার পর হীরেন স্টেশনের দিকে বেড়াতে যায়। মাত্র একটা ট্রেন ছেড়ে গেল। এই ট্রেনে খবরের কাগজ এসেছে, কিন্তু তার তো কাগজ কেনারও উপায় নেই। সে উঁকি মেরে প্রথম পাতার খবরগুলো দেখে নেবার চেষ্টা করে। চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ ও সিগারেট খাওয়া—কলকাতার এই বাঁধা অভ্যেস আজ কিছুতেই রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু এখানকার রোদ্দুরটা এত ভালো কলকাতার সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না, বেশ গাঢ় ধরনের শীতের সকালে এমন সাদা রোদ্দুর, সারা শরীরটাকে বেশ মোলায়েম করে তুলেছে। এই রোদ্দুরে বুড়ি ভিখারির মুখও সুন্দর মনে হয়।
স্টেশনের বাইরে পুরোনো ডাকবাংলো, সাহেব-মেম বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে রোদ্দুরে আরাম করছে। ওদিকে বোকারোর কাজ শুরু হয়েছে বলে, এ পথ দিয়ে আবার অনেক খাঁটি সাহেব-মেমের যাতায়াত শুরু হয়েছে। টুকটুকে লালরঙের সোয়েটার পরা ফুটফুটে বাচ্চা বল নিয়ে খেলা করছে মাঠের মধ্যে, একটি অষ্টাদশী মেম-তরুণী কি-যেন খেলার নিয়ম বোঝাচ্ছে ওদের। নীল-রঙা গাউন, মাথায় হলদে স্কার্ফ বাঁধা, কি স্বচ্ছন্দ স্বাস্থ্য মেয়েটির, মসৃণ চামড়া, ঝকঝকে সাদা দাঁত, নরম রক্তিম ঠোঁট। হীরেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ খেলা দেখতে লাগল। ওদের তো ওসবে কিছুই আসে যায় না। অনেক সময় স্বামীর সামনেও বউকে চুমু খেলে সেটা হয় ঠাট্টা। কি যেন একটা রুমাল-চোর ধরনের খেলা আছে ওদের? যে জিতবে, সেই পাশের মেয়েটিকে একবার চুমু খাবে।
দরজা খোলা ছিল কেন? ওরা দরজাটা বন্ধ করে নিলেই পারত। কিন্তু সকালবেলা ঘরের দরজা বন্ধ করা দৃষ্টিকটু। সাড়ে তিন কি চার মিনিটেই ওরা ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলল কী করে? আসলে যা মনে হয়, ওরা কিছুই আগে ঠিক করেনি, রান্নাঘরের বারান্দায় ছিল ললিতা, উঠোনে বসে হেমকান্তি দাড়ি কামাতে কামাতে দুএকটা ফষ্টিনষ্টি করছিল। কিছু একটা দরকারে ললিতা এসেছিল ঘরের মধ্যে, সেই সময় হেমকান্তিও টপ করে উঠে এসে ঝোঁকের মাথায় ওকে জড়িয়ে ধরে! একটা অন্ধ আবেগের ব্যাপার। ছবিটা ভেবে নিয়ে নিজের যুক্তিবাদী কল্পনা শক্তিতে হীরেন বেশ খুশি হয়ে ওঠে। অন্ধ আবেগের ব্যাপার, হঠাৎ করে ফেলে দুজনেই এখন অনুতপ্ত, তা তো ওদের কথা শুনেই বোঝা গেল। ললিতা তো রাজি হয়ইনি, হেমকান্তিটা বরাবরই একগুঁয়ে, যখন যা মনে হয়, না করে ছাড়ে না, কিন্তু পরে অনুতাপ করে।
হেমকান্তির অন্যায় আবদারে ললিতা যে চেঁচিয়ে ওঠেনি, কান্নাকাটি করে নাটক বাধায়নি, এতে ললিতার প্রতি হীরেনের কৃতজ্ঞতাই বোধ হয়, নাটকীয় ব্যাপার সে একেবারেই পছন্দ করে না।…ওদের যে-কটা কথা শুনেছে, তাতে হীরেন স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে যে, ললিতা আগাগোড়াই হেমকান্তিকে বাধা দিয়েছে, হেমকান্তির ছেলেমানুষি দৌরাত্ম্যির কাছে একবারের মতো আত্মসমর্পণ করলেও মন থেকে সায় দেয়নি কিছুতেই। ললিতার কথার সুরে একথাও ফুটে উঠেছে যে, হেমকান্তির অন্যায় আবদারের জন্য—হীরেনকে বলে দিয়ে সে কোনো শাস্তি আদায় করতেও পারবে না।
হেমকান্তি হীরেনের প্রায় জন্ম থেকে বন্ধু, গোটা ইস্কুল আর কলেজ জীবন একসঙ্গে কাটিয়েছে, হীরেনের বিয়ের সাতপাকের সময় হেমকান্তি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল পর্যন্ত। সেই হেমকান্তির সঙ্গে হীরেনের বিচ্ছেদ কল্পনাও করা যায় না, ললিতাও তা জানে! তার বদলে, সামান্য একবার।
‘কেন আমায় কষ্ট দিচ্ছেন?’ ললিতা একথা বলেছিল কেন? হীরেন আবার একটু হাসলো। পরপুরুষের মুখে রূপের স্তুতি শুনে একটু অন্তত বিচলিত বোধ করবে না এমন মেয়ে আবার হয় না কি? ওটা তো স্বাভাবিক, যেমন স্বাভাবিক, যত প্রিয় বন্ধুই হোক, তার সুন্দরী স্ত্রীকে আড়ালে পেলে যে কোনো পুরুষের পক্ষেই একটু ফষ্টিনষ্টি করার লোভ জাগে। দুজনের মধ্যে কেউ যদি একটু বদ হত, তাহলেই ব্যাপারটা অনেক দূরে গড়াত। কিন্তু হীরেন হেমকান্তিকে জানে ওর চরিত্রে হঠকারিতা থাকলেও মলিনতা নেই এক ছিটে। আর—ললিতা, সাড়ে চার বছর বিয়ে হয়ে গেছে, তবু হীরেন জানে—ললিতাকে ছাড়া তার জীবনটা শূন্য হয়ে যাবে, ললিতা ছাড়া তার আর কোনো অবলম্বন নেই। স্ত্রীর কাছ থেকে শুধু ভালোবাসা পাওয়াই যথেষ্ট নয়, ললিতার স্বভাবের মধ্যে একটা গভীর সমবেদনা আছে।
ললিতার প্রথম কথাটাতেও একটু খটকা লাগতে পারে। ‘কী করছেন কী? এক্ষুনি ও এসে পড়বে!’ হীরেনের এসে পড়াতেই একমাত্র আপত্তি। একমাত্র না হোক হীরেন ভাবল সত্যিই তো এইটাই প্রধান। দেখে ফেলাটাই তো সবচেয়ে ভয়ংকর! অন্য কেউ দেখে না ফেললে, আর সব কিছু মিটিয়ে ফেলা যায়, ভুলে যাওয়া, দূরে যেতে পাওয়া যায়, কিন্তু একবার কেউ দেখলেই তা শাশ্বত হয়ে গেল! ভাগ্যিস, হীরেন যে দেখে ফেলেছে, তা ওরা দেখেনি।
অজান্তেই হীরেন মনে মনে হিসেব করে, সাত না আট? আটজন এ পর্যন্ত ললিতা ছাড়া আরও আটটি মেয়েকে চুমু খেয়েছে হীরেন, সেজো মামিমাকে ধরেই বিয়ের পরই তো দুজনকে, একবারও কেউ দেখেনি, কেউ সন্দেহও করেনি, তাই কোথাও কোনো গণ্ডগোল নেই! দীপ্তির সঙ্গে এখনও দেখা হয়, ললিতার সঙ্গে একদিন সিনেমা দেখতে গিয়েও তো দীপ্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, কত স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা হল, মুখের একটি রেখাও বদলায় নি। কল্যাণী বিয়ের পর বোম্বাইতে আছে, তিনটি ছেলেমেয়ে হয়েছে না কি। নীলি, মানে নীলিমা—হীরেনের পিসতুতো বোন, তাকে তো চুমু ছাড়াও আরও কত কি সে তো এক আই এ এস-কে বিয়ে করে এখন খুব সমাজসেবিকা হয়েছে—সুবাদে সেজোমামিমা এখনও নিরালায় দেখলেই চোখের ইঙ্গিত জানায়—এসব তো আর কেউ দেখেনি, তাই কোথাও অশান্তি নেই। দেখাটাই তো একমাত্র দোষের, তা ছাড়া কোথায় কী ঘটেছে—কে জানে! ওদের কারুর জন্য হীরেনের পিছুটানও নেই, শুধু একমাত্র অরুণা, অরুণার কথা ভাবলেই হীরেনের বুক শিরশির করে। না অরুণাকে চুমু খাবার সময়েও কেউ দেখেনি কিন্তু একমাত্র অরুণাকেই ও চুমু খেয়েছিল জোর করে।
তখন হীরেনরা থাকত কোন্নগরে ওদের পাশের বাড়ির পরিবারটা ছিল ছন্নছাড়া। অরুণার বাবা গগনবাবু ছিলেন রেসের বুকি, লোকের কাছ থেকে পাঁচ আনা দশ আনা পয়সা নিয়ে রেসের বাজি ধরতেন, প্রত্যেক শনিবার ওদের বাড়ির সামনে চেঁচামেচি হই-হল্লা লেগেই থাকত। গগনবাবুকে দেখলেই মনে হত লোকটা ভালো নয়, মানুষ ঠকানোই ওঁর কাজ। তা ছাড়া, স্টেশনের পাশে রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে বসে গগনবাবুকে দিশি মদ খেতে হীরেন নিজের চোখে দেখেছে। অরুণার দাদা সাধনটা তো ছিল এক নম্বরের গুন্ডা, শুধু পাড়ায় বখামিই নয়, রাত্তিরবেলা ছিনতাই, জোচ্চুরির কাজেও ছিল, দু-তিনবার পুলিশেও ধরা পড়েছিল, পাড়ার এক রাজনৈতিক নেতা বারবার ওকে ছাড়িয়ে এনেছে। অরুণার ছোটো ভাইবোনেরা বস্তির ছেলেদের সঙ্গে মিশে রাস্তায় ছিপি খেলত, কী কুৎসিত গালাগালি শিখেছিল দশ-বারো বছরেই—অরুণার মা বালিশের ওয়াড় আর ফ্রক-পায়জামা সেলাই করে বিক্রি করতেন। সেই বাড়ির মেয়ে অরুণা, অরুণা কলেজে পড়ত। অসম্ভব তেজ ছিল তার। পাড়ার কারুর সঙ্গে, বাড়ির কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলত না, নিরেট মুখ করে সোজা হয়ে হেঁটে যেত রাস্তা দিয়ে। পাড়ার ছেলেরা, অনেক সময় সাধনের বন্ধুরাও অরুণাকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল মন্তব্য করেছে, সিটি দিয়েছে, অরুণা কোনোদিন ঘাড় তুলে তাকায়নি। সন্ধেবেলা দুটো টিউশনি করত, তাই দিয়ে পড়ার খরচ চালিয়েছে। হীরেন চেয়েছিল অরুণার কাছাকাছি আসতে। গোড়ার দিকে অরুণাকে শ্রদ্ধা করত সে, ক্রমে এক ধরনের মায়া ও শারীরিক আকর্ষণ জাগে। বছর সাতেক আগের কথা, হীরেন তখন সদ্য পোর্ট কমিশনার্স অফিসে চাকরি পেয়েছে, হীরেন চেয়েছিল অরুণাকে বিয়ে করে তাকে ওই পরিবেশ থেকে উদ্ধার করবে।
কিন্তু অরুণা হীরেনকে গ্রাহ্য করেনি, কিছু যেন একটা ব্রত ছিল তার। অরুণা একমাত্র কিছুটা কথাবার্তা বলত হীরেনের দিদির সঙ্গে। হীরেনের দিদি তখন উইমেন্স কলেজে পড়ান, অরুণা মাঝে মাঝে দিদির কাছে আসত পড়াশুনো দেখে নিতে। হীরেন চেষ্টা করেছিল অরুণার সঙ্গে ভাব করতে, অরুণা ঠান্ডা গলায় কাটাকাটা উত্তর দিয়েছে শুধু, অরুণার চোখ দুটো অসম্ভব জ্বলজ্বলে, সবসময় চোয়াল শক্ত, ভেতরে ভেতরে যেন সর্বক্ষণ একটা তীব্র ক্রোধ জ্বলছে। হীরেন একদিন বলেছিল, বাগবাজারে একটা মেয়েদের স্কুলে একটা চাকরি খালি আছে—আমার এক বন্ধু বলছিল, তুমি করবে নাকি? আমার বন্ধুর কাকা সেই স্কুলের সেক্রেটারি। অরুণা শুধু সংক্ষেপে জানিয়েছিল আমি কারুর চেনাশোনার জোরে কোনো চাকরি নিতে চাই না!
হেমকান্তির মতন হীরেন অমন হঠকারী নয়, কিন্তু অরুণার ব্যাপারে হীরেন কিছুদিনের জন্য ক্ষেপে উঠেছিল। সে যে সৎ এবং ভালো উদ্দেশ্যেই অরুণার সঙ্গে মিশতে চায়—অরুণা এটুকুও বুঝতে চায়নি বলেই যেন হীরেন ক্রমশ বেশি ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। একদিন দিদির ঘরে অরুণাকে একা পেয়ে, দিদি তখন নীচে বাথরুমে গেছে, হীরেন অকস্মাৎ এসে অরুণার হাত ধরে আবেগবিহ্বল গলায় বলেছিল অরুণা, শোনো! অরুণা এক ঝটকায় সরে গিয়ে তিক্ত গলায় বলেছিল হাত ধরেছেন কেন? হীরেন তক্ষুনি কাঁচুমাচুভাবে বলেছিল, অরুণা, তুমি আমাকে ভুল বুঝ না, আমি তোমার বন্ধুত্ব চাই! অরুণা ওর দিকে না তাকিয়েই বলে, আমি কারুর বন্ধুত্ব চাই না। হীরেন আহতভাবে জিজ্ঞেস করল, কেন? সত্যি, বিশ্বাস করো। অরুণা অস্থির হয়ে জ্বলে ওঠে, আপনি কি চান, আমি এখান থেকে চলে যাই?
আরও দু-তিনটি কথা বলার পর অরুণার তিক্ততা আরও বাড়তে দেখে হীরেন উন্মত্তের মতন হয়ে যায়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে অরুণাকে জড়িয়ে ধরেছিল, অরুণা সমগ্র শক্তিতে বাধা দিয়ে হীরেনের চুল ধরে টানতে থাকে, এক হাতে সরিয়ে দিতে চায় হীরেনের মুখ তবু হীরেন জোর করে অরুণার ঠোঁট কামড়ে ধরে, একহাত নেমে আসে অরুণার বুকের কাছে তখনও কাতরভাবে বলতে থাকে অরুণা আমায় বিশ্বাস করো—কোনোক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে অরুণা বলে আপনারা সবাই আমার সঙ্গে শত্রুতা করবেন? আপনারা সবাই—অরুণা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে এবং তক্ষুনি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সে ঘটনাও কেউ দেখেনি দিদি জানতে পারেনি, কেউই জানেনি, কিন্তু অরুণা আর কখনও ওদের বাড়িতে আসেনি এবং মাসখানেকের মধ্যেই বাঁকুড়া না কোথায় ইস্কুলের কাজ নিয়ে চলে যায়। যাবার আগে অরুণা ওর বাড়ির লোকের সঙ্গে বিষম ঝগড়া করেছিল।
রোদের তাপ বেশ চড়া হতে হীরেনের খেয়াল হয় অনেকক্ষণ আগেই তার ফেরা উচিত ছিল। এতক্ষণ না ওরা আবার তার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এবং ডাক বাংলোর কাছ থেকে সরে এসে কখন যে সে চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে—তাও খেয়াল করেনি। একটু দ্রুত বাড়ি ফেরার পথ ধরতেই কিছুটা দূরে গিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির সামনে হেমকান্তির সঙ্গে তার দেখা হয়। হেমকান্তির স্নান করা চেহারা, পুরোদস্তুর স্যুট-টাই ও পালিশ-করা জুতো। হেমকান্তি এখানকার আদালতের হাকিম। হীরেনকে দেখে সে জিজ্ঞেস করল কীরে, ঘুরে-ফিরে শহরটা দেখছিলাম ছোটো হলেও মন্দ না শহরটা, বেশ ছিমছাম।
তোকে সিগারেট কিনতে বলেছিলুম, ললিতা বলল, তুই পয়সা নিয়ে বেরোসনি!
হীরেন সহসা উত্তর দিল, এই পর্যন্ত এসে পকেটে হাত দিয়ে দেখি যে খালি! দে সিগারেট দে!
হেমকান্তির কাছ থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে হীরেন জিজ্ঞেস করল, তোর ছুটি পাওনা নেই?
আজ সোমবার তো, আজ অ্যাটেন্ডেন্স দিয়ে তারপর টানা চারদিন ছুটি নিয়ে নেব। কাল অযোধ্যা পাহাড়ে যাবি?
সেটা কতদূরে? পুরুলিয়ায় আবার পাহাড় আছে নাকি?
পাহাড় মানে ঢিবি আর কি। বেশি দূরে না, তবে জায়গাটা সুন্দর, একটা চমৎকার বাংলো আছে। দেখি লাহিড়িকে বলে একটা স্টেশন ওয়াগন জোগাড় করতে পারি কি না! না হলে, কোনো ট্যাক্সির সঙ্গে কথা বলে রাখব—
তুই খেয়েছিস?
না, লতিকা মাংস চাপিয়েছে। দুপুরে এসে খাবো এখন।
হেমকান্তির হনহন করে হেঁটে যাওয়া চেহারার দিকে হীরেন খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পাতলার ওপর চেহারা, হেমকে দেখলে এখনও তিরিশের নীচে বয়েস মনে হয়।
বারান্দাতেই তোলা উনুন এনে লতিকা মাংস চাপিয়েছে। এর মধ্যে স্নান সারা হয়ে গেছে তার, একরাশ কোঁকড়া চুল পিঠময় ছড়ানো, রোদ্দুরে এখন আর অমন ধবধবে সাদা নেই, এখন একটু হলদেটে, তবু এই মফস্বল রোদ্দুরে ললিতার সুন্দর মুখ আরও সুন্দর মনে হয়। উনুনের আঁচে খানিকটা লালচে ছায়াও পড়েছে।
হীরেনের দিকে চোখ তুলে ললিতা জিজ্ঞেস করে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
হীরেন বলল, ঘুরে ফিরে দেখে এলাম। এখানে বেতের জিনিস বেশ সস্তা। ভাবছি যাবার সময় এখান থেকে কয়েকটা বেতের চেয়ার নিয়ে যাব।
হ্যাঁ। অ্যাদ্দুর থেকে আর বেতের চেয়ার নিতে হবে না। তা ছাড়া বেতের চেয়ার বেশিদিন টেঁকে নাকি?
বরং কয়েকটা বেড কভার নিয়ে যাব। ঠাকুরপো বলল, এখানকার বেড কভারও নাকি ভালো।
কথা বলতে বলতে হীরেন এসে রান্নাঘরের বারান্দাতেই বসে পড়ে। বাথানি এক কোণে বসে শিল-নোড়ায় পেঁয়াজ বাটছে আর গামছা দিয়ে চোখের জল মুছছে। বড়ো সাইজের দুতিনটে দাঁড়কাক কীজন্য চিৎকার করছে কে জানে? হীরেন জিজ্ঞেস করল, তোমার রান্নার কত দেরি?
ললিতা মুখ টিপে বলল, তোমার এর মধ্যেই খিদে পেয়েছে নাকি?
তা মন্দ পায়নি! এখানকার জলে বেশ খিদে হয়!
কলকাতার জলেও তো তোমার খিদে কম দেখি না।
তা বলে তুমি মোটেই আমাকে পেটুক বলতে পারো না। কতক্ষণ চাপিয়েছ, দাও একটু চেখে দেখি।
বেশিক্ষণ চাপেনি, এখনও কাঁচা। তুমি বরং ততক্ষণ স্নান করে নাও না। আর একটা উনুনে ভাত বসিয়ে দিয়েছি।
দাঁড়াও, এখুনি কি চান করব? খবরের কাগজ দেয়নি, না?
উঁহু!
হেমটা বোধহয় কাগজের পয়সা বাঁচায়। কোর্টে গিয়ে কাগজ পড়ে!
তোমার বন্ধু বোধহয় একটু কৃপণ আছে না?
কৃপণ? হেম? মোটেই না—
চারজন খাব দুবেলা, মোটে একটা মুরগি আনতে দিয়েছে কেন? তুমি কিন্তু কাল সকালে নিজে বাজার করবে? সবকটা দিন বন্ধুর ঘাড়ে চালিও না।
হেম মোটেই কৃপণ নয়। ও খাওয়া-টাওয়া বেশি পছন্দ করে না, কিন্তু অন্য অনেকরকম শৌখিনতা আছে। দেখছ না, ঘরে কত রকম স্নো-পাউডার সেন্টের শিশি। ব্যাচেলার মানুষ, বেশ আছে!
তোমার বুঝি লোভ হচ্ছে? তুমি খুব খারাপ আছো, না?
আমার মতন ওর তো কোনো বন্ধন নেই!
আমি তোমার বন্ধন?
বন্ধনই তো—
এ কথা বলে হাসতে হাসতে অভ্যাসবশে হীরেন ললিতার দিকে হাত বাড়ায়। ললিতা ত্রস্তে সরে গিয়ে চাকরকে ইশারায় দেখিয়ে ভ্রূভঙ্গি করে বলে, কী হচ্ছে কি? যত দিন যাচ্ছে তত তোমার লোভ বাড়ছে।
কথা শেষ করে ললিতা ছোট্ট করে মধুরভাবে হাসে। দাঁড়িয়ে উঠে হীরেন বলে, ভাগ্যিস ও বেচারা একবর্ণ বাংলা বোঝে না।
বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে এসে হীরেন আবার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ভারী মনোরম এই ছুটি, এই সকাল, দূরে ট্রেনের হুইশল বেজে উঠল, বাইরে একটা ছাগলের বাচ্চা তখন থেকে একটানা ডাকছে—কোথাও কোনো গরমিল নেই। হঠাৎ হীরেনের মনে হল, সকালে ওই দৃশ্যটা ওকি সত্যিই দেখেছিল, নাকি তার দিবাস্বপ্ন? রাস্তায় দেখা হল হেমকান্তির সঙ্গে, ওই তো ললিতা বসে পিঠে চুল মেলে, কোথাও কোনো আড়ষ্টতা নেই, জড়তা সেই, সবই স্বচ্ছন্দ, সারা পৃথিবী কি তার সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছে নাকি আজ সকালে? নাঃ, ও রকম কিছু সত্যিই ঘটেনি, সবটাই হীরেনের কল্পনা? দিবাস্বপ্নকে কে গুরুত্ব দেয়?
আস্তে আস্তে হীরেন এসে হেমকান্তির ঘরে ঢুকল। খুব সন্তর্পণে দরজাটা তখন যেমন ছিল, সেইরকম আধখোলা রাখল। বন্ধ জানলাটার কাছে আলমারি, এখানে ললিতা দাঁড়িয়েছিল, আলমারির দুটো পাল্লাজোড়া আয়না, আয়নায় ছায়া পড়ছিল। হয়তো আলমারি থেকে মাখনের টিন নিতেই ললিতা তখন ঘরে ঢুকেছিল। ওইখানে দাঁড়িয়েছিল হেমকান্তি, হীরেন নিজে এসে ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়াল না, এখান থেকে দরজা দেখা যায় না। হীরেন ফিসফিস করে বলল, একবার! একবার! এ কথা কি বাইরে থেকে শোনা যায়? শুনতে পাবারই তো কথা!
হঠাৎ হীরেনের মনে হল, হেমকান্তি আর ললিতা যেন দুজনেই তাকে উকিল হিসেবে নিয়োগ করেছে, সে যেন প্রাণপণে ওদের দুজনের পক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করছে। আর ওদিকে আদালতে বসে হেমকান্তি এতক্ষণে অন্য লোকদের শাস্তি দিচ্ছে।
এই সময় ললিতা এসে ঘরে ঢুকল। ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখটা হালকা করে হীরেন বলল, তোমায় আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে লতু।
ললিতা ওর কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে, বুকে শরীরটা হেলান দিয়ে একটু আদুরে গলায় বলে, মাঝে মাঝে বাইরে বেড়াতে এলে, বেশ হয়, না? এবার থেকে আমরা বছরে একবার করে আসব।
খরচ কম নয়—
এমন কিছু খরচ নয়। সারা বছর চেষ্টা করলে ঠিকই হয়।
হীরেন দুহাত দিয়ে ললিতাকে বেষ্টন করে। ললিতার বুকের ওপর ওর হাতের চাপ পড়লেও ললিতা বিশেষ আপত্তি করে না, শুধু বলে, চাকরটা যদি এদিকে আসে আবার।
হীরেন নিজের মুখটা ললিতার কাছে এগিয়ে এনেও ভাবে, আচ্ছা, এখন থাক, অন্তত একটা দিন থাক না। সে তার গালটা রাখে ললিতার গালে, আঃ কি ঠান্ডা, কি শান্তি, গরিবের ঘরের বউ হয়েও ললিতা স্বাস্থ্যটা ভালো রেখেছে। গালে গাল রেখেই হীরেন ললিতার শরীরটা দোলাতে থাকে, এবং ইয়ার্কি করার মতন লঘু গলায় বলে, হেম আবার তোমার সঙ্গে প্রেম-ট্রেম করার চেষ্টা করেনি তো?
ললিতা বলল কেন, ভয় আছে নাকি তোমার? আমার মাথা ঘুরে যেতে পারে? হীরেন বলল, তা নয়, হেমটা আবার একটু কবি-কবি স্বভাবের আছে। ও যদি কখনও একটু বেশি গদগদ হয়ে ওঠে, তুমি আবার সেটা খুব সিরিয়াসলি নিও না।
কলহাস্য করে উঠে ললিতা বলে, বত্রিশ বছর বয়েস হয়ে গেল, এখন আর এ চেহারা দেখে কারুর কবিত্ব জাগবে না—তোমার ছাড়া!
গাল সরিয়ে এনে, উদাসীনভাবে হীরেন বলে, বাথরুমে জল দিয়েছ?
হ্যাঁ, জল আছে। আমি দেখি, মাংসটা ধরে গেল নাকি! ছাড়ো—
হেমকান্তির বাথরুমও খুব শৌখিনভাবে সাজানো। সিঙ্ক, বেসিনগুলো পরিষ্কার ঝকঝকে। এরকম মফস্বল শহরের বাড়িতেও এরকম আধুনিক কায়দার বাথরুম আশা করা যায় না। তাকে সারি সারি সাজানো সাবান, শেভিং ক্রিম, পেস্ট-শ্যাম্পু। র্যাকে দু-তিনটে তোয়ালে। হীরেন নিজের তোয়ালে নিয়ে এসেছিল, একটু বাদে ও খেয়াল করল, তোয়ালে কাঁধে নিয়ে ও বাথরুমের মধ্যে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কেন দাঁড়িয়ে আছে, নিজেই প্রশ্ন করল। পরক্ষণেই বুঝতে পারল, এরকমভাবে তো সে কোনোদিনই স্নান করে না। একে শীতকাল তার ওপর কুয়ো থেকে তোলা কনকনে ঠান্ডা জল, এরকম জলে হীরেন কখনও স্নান করতে পারে না। তার বিষম ঠান্ডার ধাত, বারো মাস সে গরম জলে স্নান করে, শীতকালে তো কথাই নেই। সে পুকুরে কিংবা নদীতে পর্যন্ত সাঁতার দিয়ে স্নান করতে পারে না।
ললিতা আজ তাকে গরম জল দিতে ভুলে গেছে। কালও গরম জলে স্নান করার ব্যাপারে হেমকান্তি তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গরম জল না করিয়ে হীরেন কিছুতেই স্নান করেনি। আজ, ললিতার গরম জলের কথা মনেই পড়েনি। হীরেন একবার ভাবল চেঁচিয়ে ললিতাকে গরম জলের কথা বলে, কিন্তু মনে পড়ল, দুটো উনুনেই রান্না চাপানো—এখন জল গরম করা অনেক ঝঞ্ঝাট! যেন ললিতার সঙ্গে ঠাট্টা করার লোভেই হীরেন আজ বহুকাল বাদে ঠান্ডা জলেই স্নান করবে ঠিক করে ফেলল। ব্রাশে পেস্ট নিয়ে মুখ ঘষতে লাগল সে।
সেই দারুণ ঠান্ডা জল বালতির পর বালতি মাথায় ঢেলে অল্পক্ষণে স্নান সেরে ফেলে হীরেন, সমস্ত শরীরটা যেন অবশ হয়ে গেছে, দাঁত ঠকঠক করছে তার। তাড়াতাড়ি গা মুছে দরজার সামনে আসে, পা-টা তখনও ভিজে বলে তোয়ালে দিয়ে পা মুছতে থাকে বার বার। তারপর, বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দরজা না খুলে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায় একটু। বাথরুমের মধ্যে এইমাত্র কি যেন একটা ঘটে গেল! কী ঘটল? হীরেন ভাববার চেষ্টা করে এবং একটু বাদেই সেটা বুঝতে পেরে অপরাধীর মতন লাজুকভাবে হাসে। হেমকান্তির ওপর সত্যিই তার রাগ হয়েছে তাহলে। কেননা, হীরেন বুঝতে পারলে, অন্যমনস্কভাবে সে হেমকান্তির পেস্ট থেকে দাঁত মাজতে গিয়ে, টিউবের প্রায় অর্ধেকটা টিপে অনেকখানি পেস্ট মাটিতে ফেলে নষ্ট করেছে। হেমকান্তির দামি চন্দন সাবানখানা গায়ে মাখার পর সে সাবানটা মাটিতেই ফেলে রেখেছে—জলের মধ্যে সাবানটা ক্ষয়ে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এবং ততক্ষণে সে নিজের তোয়ালের বদলে হেমকান্তির দামি তোয়ালেটা দিয়েই পায়ের তলা মুছছিল। সাবানটা তুলে রেখে, তোয়ালেটা ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে হীরেন আপন মনে সস্নেহে বলল, না, হেম, আমি তোর ওপর রাগ করিনি। ওসব কিছু না, মুহূর্তের ভুল। ওতে কিছু যায় আসে না। সেজোমামাও তো বউয়ের একেবারে আঁচল ধরা, আমার সঙ্গে সেজোমামির ব্যাপারটা কখনও জানতে পারেননি বলেই তো।
দুপুরে হেমকান্তি এসে চলে যাবার পর, ললিতা চাকরটাকে পাঠিয়েছে পান আনতে এবং গরম কাপড়ের ব্লাউজটা হীরেনের সামনেই খুলতে আরম্ভ করে। শুধু ব্রেসিয়ার পরা বুকে ললিতা যখন মাটিতে উবু হয়ে বসে সুটকেস খোলে—তখন হীরেন খানিকটা অস্থির বোধ করে। দিন কয়েক ধরে ওদের দাম্পত্য ব্যাপারটা হয়নি। শনিবার ট্রেন জার্নি করে এসে খুব ক্লান্ত ছিল, এসেই মড়ার মতন ঘুমিয়েছে। কালকেও বেড়িয়ে ফেরার পর, তিনজনে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছে ঘরে বসে, শেষের দিকে ললিতারই চোখ ঘুমে ঢুলে আসছিল। সুতরাং আজ দুপুরবেলা, এখনই তো ঠিক সময়, কিন্তু হীরেন চঞ্চল হয়ে ভাবে—একটা দিন থাক না। হীরেন উঠে জামা গায়ে দিতে দিতে বলে, এখানে আমার এক পিসেমশাই থাকেন, একটু খোঁজ নিয়ে আসি বুঝলে? তুমি দরজা-টরজা বন্ধ করে শুয়ো।
ললিতা অবাক হয়ে বলল, এখন এই দুপুরবেলা যাবার দরকারটা কী?
যদি শোনেন, দুদিন ধরে এখানে এসেছি অথচ খোঁজ করিনি, আমি চট করে ঘুরে আসছি। তুমি দরজা বন্ধ করে থেকো।
হীরেনের ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে হয়ে যায়। ললিতা ও হেমকান্তি তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, হীরেনের চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে দুজনেই। হীরেনের চোখ দুটো টকটকে লাল, সারা শরীরটা কাঁপছে। বারান্দার মেঝের ওপরই বসে পড়ে হীরেন আস্তে আস্তে বলে, দ্যাখো তো, আমার বোধহয় খুব জ্বর এসেছে! কথা বলতে বলতেই হীরেন সেখানে শুয়ে পড়ে। ললিতা ছুটে এসে হীরেনের মাথাটা কোলে তুলে নেয়, সত্যি জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। হেমকান্তি ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করে, এতক্ষণ তুই কোথায় ছিলি?
হীরেন চোখ দুটো বন্ধ করে অস্পষ্টভাবে বলে, একটু ওইদিকে গিয়েছিলাম। আজ ঠান্ডা জলে চান করেছি তো, তাই বোধহয় জ্বর এসে গেল।
দেখতে দেখতে হীরেনের জ্বর বাড়তে থাকে, জ্বরের ঘোরে ছটফট করে। ওর খুবই কষ্ট মনে হয়। একটা তীব্র যন্ত্রণা পাওয়া চাপা গলায় শুধু বলে, আঃ, আঃ!
কপালের জলপট্টি বারবার ভিজিয়ে দিতে দিতে ললিতা কাঠ হয়ে বসে থাকে ওর শিয়রের কাছে। হেমকান্তি ডাক্তার ডাকতে চলে যায়। হীরেন বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত ছটফট করে, খালি সেই যন্ত্রণাসিক্ত গলায় বলে, আঃ আঃ!
ললিতা বিপন্ন-আকুলভাবে ওর বুকে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, তোমার ব্যথা করছে? কোথায়? পেটে না বুকে? হীরেন কোনো উত্তর দিতে পারে না।
ডাক্তার এসে ভালো করে পরীক্ষা করলেন। বললেন, আর তো কোনো খারাপ লক্ষণ দেখছি না, কিন্তু একশো পাঁচ জ্বর উঠে গেল হঠাৎ! ওই ঠান্ডা জলের জন্যই—নিউমোনিয়া না হয়ে যায়! জ্বর আজ কমে গেলে আর ভয় নেই।
জ্বরের ঘোরে হীরেনের সারা শরীর দুমড়ে-মুচড়ে উঠতে থাকে, আর ওর দুপাশে হেমকান্তি আর ললিতা বসে থাকে নিঃশব্দে। ললিতা একসময় বলল কোনোদিন ওর ভুল হয় না, অথচ আজ যে কেন ঠান্ডা জলে চান করল। হেমকান্তি বলল একদিন ঠান্ডা জলে চান করলেই ওরকম জ্বর হবে তার কোনো মানে নেই। অসুখ কেন হয়, তা কেউ জানে না! ফুড পয়জন হয়নি তো?
তাহলে তো তিনজনেরই হতে পারত। একই খাবার—
তা ঠিক। অনেক সময় হঠাৎ একজনেরও হয়।
ঠাকুরপো, তুমি তো ওঁকে অনেকদিন জানো, এরকম হঠাৎ জ্বর ওঁর আগে কখনো হয়েছে?
এরকম তো কখনো দেখিনি। অবশ্য এটাও এমন কিছু না, ডাক্তার তো বললই দু-একদিনে সেরে যাবে।
তবু কেন যে এরকম হল—
ঘন্টা চারেক ছটফট করার পর হীরেন খানিকটা আচ্ছন্নের মতন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ওর মুখখানা ভারী করুণ আর অসহায় দেখায়। ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে ওর মুখখানা কুঁচকে আসছে। এতক্ষণ টানা উৎকণ্ঠার মধ্যে থেকে ললিতা আর হেমকান্তির মুখও শুকিয়ে এসেছে। ললিতার আর খাওয়া-দাওয়া করার কোনো ইচ্ছেই নেই, হীরেনের শিয়র ছেড়ে সে আর উঠলোই না। খানিকক্ষণ বাদে হেমকান্তিও নিজের ঘরে চলে গেল।
হীরেনের ঘুম ভাঙলো মাঝ রাত্তিরের দিকে। তখনও গায়ে বেশ জ্বর, বুকে ব্যথা! ঘুম ভাঙতেই ধড়মড় করে হাত বাড়িয়ে হীরেন ডাকল—লতু! লতু! মশারি গুঁজে এতক্ষণ বসেই ছিল ললিতা, কোন এক সময় ঘুমের মধ্যে এক পাশে লুটিয়ে পড়েছে। ডাক শুনে তাড়াতাড়ি জেগে উঠল, হীরেনের মুখের কাছে মুখ এনে বলল—এখন কেমন আছো? ভালো লাগছে একটু? ইস জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে এখনো।
হীরেন ক্লিষ্ট স্বরে বলল—লতু, আমার বড়ো কষ্ট হচ্ছে।
ললিতা জিজ্ঞেস করল কোথায়?
তা ঠিক জানি না, দম আটকে আসছে যেন মনে হচ্ছে।
ডাক্তার এসেছিলেন, বলেছেন ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একটু ঘুমোও।
হীরেন একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর কী ভেবে আবার ছটফট করে উঠে বলে লতু! লতু! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আর পারছি না, যদি মরে যাই।
ওকি অলুক্ষুণে কথা! চুপ! না-না-কিছু হয়নি তোমার।
ললিতা প্রায় হাহাকার করে। জোর করে একহাতে হীরেনের মুখ চাপা দেয়। অন্য এক হাতে হীরেনের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। হীরেন একটু শান্ত হয়ে মুখ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আঃ, এখন আরাম লাগছে। আগে হাত বুলিয়ে দাওনি কেন?
দিচ্ছি তো, অনেকক্ষণ থেকে। এখন কম লাগছে?
অনেক কম লাগছে। হঠাৎ আমার এমন অসুখ হল কেন বলো তো?
কী জানি!
হীরেন একটা অনেক বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ ওর চোখটা ভিজে এল। পাশ ফিরে ললিতার জানু দুটো চেপে ধরে বলল না, মরব কেন? এমনি বলছিলাম, যদি হঠাৎ মরে যাই।
আবার ওই কথা? তুমি চুপ করে ঘুমোও বলছি।
লতু, তোমায় আমি কতটা যে সত্যি ভালোবাসি, তুমি জানো?
জানি।
তোমায় যদি একটা কথা বলি, তাহলে তুমি আমাকে ভালোবাসবে?
কী কথা?
লতু, কথা দাও আগে, সেকথা শুনেও আমায় তুমি ভালোবাসবে?
ললিতা সমস্ত শরীর নিয়ে হীরেনের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে। ভয় পাওয়া গলায় বলে, ওকি, তুমি ওরকম করছ কেন? তোমার ঠোঁট কাঁপছে। আজ আর কিছু বলতে হবে না। কাল বলো—
না, কথা দাও, সেকথা শুনেও—
কথা দিচ্ছি। তুমি তো জানোই, তোমায় আমি চিরদিনই ভালোবাসবো।
না, আজ সকাল থেকে একটা কথা মনে পড়ে এমন মন খারাপ লাগছে। আমি একবার খুব অন্যায় করেছিলুম, ওঃ! জানো লতু, অরুণা বলে একটা মেয়েকে আমি একবার জোর করে চুমু খেয়েছিলাম। তার একটুও ইচ্ছে ছিল না, সে আমায় পছন্দ করত না, তবু আমি গায়ের জোরে, জন্তুর মতন, ওঃ আমার জন্যই মেয়েটা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। একথা শুনেও তুমি আমাকে ভালোবাসবে বলো? বলো? হঠাৎ দুহাতে মুখ চাপা দিয়ে হীরেন শিশুর মতন কাঁদতে শুরু করে!