ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

সীমান্তের বিভীষিকা

সীমান্তের বিভীষিকা (ছোট গল্প)

রাজ্য সরকার চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

চিন্তার কথা তো বটেই। কিছুদিন ধরে সীমান্তের সেনানিবাসে চিঠিপত্র বা খাদ্যবস্তু কিছুই এসে পৌঁছোয় না–ডাকপিয়ন নিরুদ্দেশ!

দক্ষিণ আমেরিকার যে বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমির বুকে পেরু এবং ইক্যয়াডর নামক দুই রাজ্যের সীমানা এসে মিলিত হয়েছে, সেইখানে ইক্যয়াডার রাজ্যের নিজস্ব সীমান্তে একটি ছোটো সেনানিবাস আছে।

সেনানিবাসের খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েই ইক্যয়াডরের রাজ্য সরকার খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

চিন্তার কারণ আগেই বলেছি- শহর থেকে চিঠিপত্র ও খাদ্যবস্তু নিয়ে ডাকবাহক আর সেনানিবাসে পদার্পণ করে না। চিঠিপত্র তবু না হলেও চলে, কিন্তু খাদ্যের অভাবে সীমান্তরক্ষীদের অবস্থা শোচনীয়।

শুরু হল অনুসন্ধান-পর্ব। অবশেষে জানা গেল যে, হতভাগ্য ডাকপিয়নের অনুপস্থিতির কারণ হচ্ছে একটি অতিকায় সর্প।

এক জন নয়, পর পর দুজন ডাকহরকরা সাপের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। আপার আমাজন নামক অরণ্যময় অঞ্চলের ভিতর দিয়ে নদীপথে নৌকো চালিয়ে আসার সময় সর্পদানব নৌকোর উপর হানা দিয়ে ডাকবাহকদের হত্যা করেছে এবং নৌকোসমেত যাবতীয় খাদ্যবস্তুর হয়েছে সলিল-সমাধি।

মহা মুশকিল! সাপের উৎপাতে কি সীমান্তরক্ষী সৈন্যরা উপবাস করবে?

বিমানযোগে প্যারাশুটের সাহায্যে কিছু কিছু খাদ্যদ্রব্য সৈন্যদের প্রেরণ করা হয় বটে, কিন্তু কয়েকটি বিশেষ প্রয়োজনীয় খাদ্য ওইভাবে পাঠানো সম্ভব নয়। তাই জলপথে নৌকো চালিয়ে চিঠির সঙ্গে খাদ্যসম্ভারও নিয়ে আসে ডাকবাহক পিয়ন।

পান্তাজা, টাইগার ও কুরারে নামক তিনটি নদীর উপর দিয়ে ক্যানো জাতীয় নৌকোর সাহয্যে ডাকবিভাগের কাজকর্ম চালানো হয়। ইক্যয়াডর রাজ্যের ডাকবহনকারী পিয়নরা সভ্য জগতের সঙ্গে অরণ্যবাসী সৈনিকদের আদান-প্রদান অক্ষুণ্ণ রাখে। অতএব তাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।

পর পর তিনটি নৌকো এবং দু-দুটি পিয়ন যখন সর্পের আক্রমণে সলিল সমাধি লাভ করল, তখন রাজ্য সরকার উদবিগ্ন হয়ে পড়লেন। সাপটাকে হত্যা করার জন্য নিযুক্ত হল একটি শিকারি দল।

সীমান্তরক্ষী কয়েক জন শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও অরণ্যবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের নিয়ে এই ছোটো দলটি গঠিত হল। দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন সার্জেন্ট পাবলো।

গ্রামবাসীদের মধ্যে অনুসন্ধান করে ইতিমধ্যে জানা গেছে, সর্পদানব শুধু ডাকহকরাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়, তার ভয়াবহ ক্ষুধা তৃপ্ত করতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে কয়েকটি শিশু এবং তিনটি যুবক।

নদীর জলে সাঁতার কাটার সময়ে যুবক তিনটি সর্পদানবের আক্রমণে মারা পড়েছে। হত্যাকাণ্ডগুলি সংঘটিত হয়েছে বহু মানুষের চোখের সামনে।

নদীর জলে রেড-ইন্ডিয়ান মেয়েরা ময়লা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে। কোনো অসতর্ক জননী যদি শিশু-সন্তানকে তীরভূমির উপর রেখে কাপড় কাঁচতে বসে, তাহলেই হয় বিপদ। আচম্বিতে জলের ভিতর থেকে একটা সুদীর্ঘ লাঙ্গুল ছিটকে বেরিয়ে আসে, পরক্ষণে ডাঙার উপর অবস্থিত হতভাগ্য শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে জলের মধ্যে!

শিকারের দেহ জলের উপর এসে পড়লেই ভয়াল দানব তাকে কামড়ে ধরে। অভাগিনী মা দেখতে পায়, তার কোলের সন্তান ছটফট করছে সাপের মুখে। পরক্ষণেই নদীর জলে মিলিয়ে যায় সেই ভয়াবহ দৃশ্য।

শুধু দ্বিপদ মনুষ্য নয়, গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছে মহাসর্পের লুব্ধ দৃষ্টি। গ্রামবাসীদের বহু কুকুর, ছাগল ও শূকর স্থান লাভ করছে সর্পের উদর-গহ্বরে।

এতগুলো হত্যাকাণ্ডের নায়ক হচ্ছে একটি আনাকোন্ডা।

সর্পরাজ আনাকোন্ডা– যেমন ভয়ঙ্কর তার চেহারা, তেমনি তার আকৃতি-প্রকৃতি! অজগর সমাজে আনাকোন্ডা হচ্ছে বৃহত্তম জীব। এরা দৈর্ঘ্যে আঠারো থেকে পঁচিশ ফিট পর্যন্ত হয়। পঁয়ত্রিশ ফিট লম্বা আনাকোন্ডাও দেখা গিয়েছে।

অজগর-গোষ্ঠীর অন্যান্য সাপের মতোই আনাকোন্ডা নির্বিষ। অবশ্য তাতে কিছু যায়-আসে না। শিকারকে অতর্কিতে জড়িয়ে ধরে চাপ দিতে থাকে আনাকোন্ডা এবং সেই প্রচণ্ড পেষণে অস্থি-পঞ্জর চূর্ণ হয়ে অথবা শ্বাসরোধ ঘটার ফলে হতভাগ্য জীবটি যখন প্রাণত্যাগ করে, তখন সর্পরাজ শিকারের মৃতদেহ আস্ত গিলে ফেলে। এক বার শিকার ধরলে বেশ কয়েক দিন তার আর আহারের প্রয়োজন হয় না। এই সময় নির্জীব হয়ে শুয়ে থাকে সে। শিকারের দেহের মাংস হজম হয়ে গেলেই আবার শিকারের সন্ধানে বের হয়।

আনাকোন্ডা জল ভালোবাসে। অধিকাংশ সময়েই সে জলে থাকে, তবে ক্ষুধার্ত হলে ডাঙায় উঠে এসেও শিকারকে আক্রমণ করে। অর্থাৎ এই সর্পদানবের জাত উভচর জলে স্থলে সর্বত্রই তার অবাধ গতি। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন জলাভূমি ও নদীর নিকটবর্তী অরণ্যে এই ভয়ঙ্কর জীবদের দেখা যায়।

এমনি এই সর্পদানবের আতঙ্কে পেরু ও ইক্যয়াডরের সীমান্তভুমির দম বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে। আর তাই সাপটাকে হত্যা করার জন্য রাজ্য সরকারের তরফ থেকে নিযুক্ত হয়েছে একদল শিকারি।

শ্বেতাঙ্গ ও স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে মিলিত এই দলটির নেতা পাবলো আগুরা নামক জনৈক সার্জেন্ট। পাবলো ও তার শ্বেতাঙ্গ সঙ্গীদের নিয়ে যে শিকারির দলটি গঠিত হয়েছে তারা সকলেই সীমান্তের রক্ষীবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। আর জিভারো এবং ইয়াম্বো নামক রেড-ইন্ডিয়ান জাতির দুই দল মানুষ স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছে এই শিকার-অভিযানে।

পাবলোর নেতৃত্বে শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও রেড-ইন্ডিয়ানদের মিলিত বাহিনী সমগ্র অঞ্চলটা খুঁজল তন্ন-তন্ন করে। কিন্তু সর্পদানবের সন্ধান মিলল না।

পাবলো তখন সাপের জন্যে ফাঁদ পাতল। এই ফাঁদের টোপ হল কয়েকটা ছাগল। নদীর ধারে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা ছাগলকে বেঁধে রাখা হল। এই জীবন্ত টোপগুলির আশেপাশে সর্পরাজকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা করার জন্য লুকিয়ে রইল একদল সশস্ত্র শিকারি। দ্বিপদ ও চতুষ্পদ যাবতীয় জীবন্ত খাদ্যের মধ্যে ছাগলই হচ্ছে আনাকোন্ডার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। অতএব শিকারিরা আশা করে, ছাগ-মাংসের লোভে দানব নিশ্চয় আত্মপ্রকাশ করবে…

পর পর তিনটি দিন চলে গেল, কিন্তু আনাকোন্ডার পাত্তা নেই! হয়তো সর্পরাজ শিকারিদের অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে, অথবা তখনো পর্যন্ত হয়তো পূর্ববর্তী শিকারের মাংসে উদর পূর্ণ থাকায় সরীসৃপ নতুন শিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি।

অবশেষে চতুর্থ দিন ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় হঠাৎ প্রভাতের নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল একটা ছাগল কণ্ঠের কাতর আর্তনাদ!

আরাবেলা নামক একটি ছোট জলধার যেখানে কুরারে নদীর বিপুল জলস্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তার নীকটবর্তী তীরভূমির উপর থেকেই শব্দটা ভেসে আসছে। ওই অঞ্চল পাহারা দেওয়ার ভার নিয়েছে তিন জন ইয়াম্বো-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ান এবং একজন শ্বেতাঙ্গ সৈনিক। তারা শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল।

আকুস্থলে সর্বপ্রথম যে রেড-ইন্ডিয়ানটি পদার্পণ করল, তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়ংকর দৃশ্য আনাকোন্ডার প্রচণ্ড আলিঙ্গনের মধ্যে নিশ্চল হয়ে আছে হতভাগ্য ছাগলের প্রাণহীন দেহ! আক্রান্ত হয়ে একবারই আর্তনাদ করার সময় পেয়েছিল জীবটি পর মুহূর্তে নাগপাশের নিষ্ঠুর বন্ধন তার কণ্ঠকে নীরব করে দিয়েছে। মৃত্যু এসেছে মুহূর্তের মধ্যে!

ইয়াম্বো শিকারিটি অকুস্থলে এসে পৌঁছোনোর আগে সাপটা নিশ্চয়ই তার শিকার নিয়ে জলের ভিতর আত্মগোপন করত। কিন্তু জলস্রোতের নিকটবর্তী তীরভূমির উপর অবস্থিত একটা গাছের সঙ্গে শক্ত দড়ি দিয়ে ছাগলটা বাঁধা ছিল বলেই সর্পরাজের উদ্দেশ্য সফল হয় নি। ইয়াম্বো রেড-ইন্ডিয়ানটি দেখল আনাকোন্ডা দড়ি ছিঁড়ে শিকার নিয়ে নদীর বুকে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে রেড-ইন্ডিয়ানটি তার হাতের বর্শা নিক্ষেপ করল। সাপের মোটা চামড়া ভেদ করে বসে গেল বর্শার শাণিত ফলক। ইতিমধ্যেই লোকটির চিৎকার শুনে তার সঙ্গীরা যথাস্থানে এসে পড়েছে এবং আনাকোন্ডাও বুঝতে পেরেছে, এই জায়গাটা আর তার পক্ষে নিরাপদ নয়।

ছাগমাংসের মায়া ছেড়ে সে তখুনি দ্রুতবেগে এগিয়ে গেল জলের দিকে।

একজন শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের রাইফেল উপরি-উপরি দুবার গর্জে উঠল। দুজন রেড়-ইন্ডিয়ান শিকারির হাতের বর্শা ছুটে গেল আনাকোন্ডার দেহ লক্ষ্য করে গুলি লাগল কিনা বোঝা গেল না, কারণ সর্পদানবের গতি রুদ্ধ হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। আর বর্শা দুটিও হল লক্ষ্যভ্রষ্ট…

ঘটনাটা যেখানে ঘটছে, সেই জায়গা থেকে সিকি মাইল দূরে ছিল সার্জেন্ট পাবলোর আস্তানা। রাইফেলের গর্জন শুনেই সে বুঝল, কিছু একটা হয়েছে। তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে উপযুক্ত পোশাক চড়িয়ে সে যখন অকুস্থলে উপস্থিত হল, তখন আনাকোন্ডা জলের তলায় আত্মগোপন করেছে।

যে সৈন্যটি গুলি চালিয়েছিল, সে পাবলোকে জানাল যে, এত লম্বা আর এত মোটা সাপ দেখে সে হয়ে পড়েছিল হতভম্ব। তার উপর দু-দুটো গুলিতেও যখন সাপটার কিছু হল না, তখন তার এমন বুদ্ধিভ্রংশ ঘটল যে, তৃতীয়বার গুলি ছোঁড়ার কথা মনেই হয়নি। একটু পরেই অবশ্য তার সম্বিৎ ফিরে আসে। এবং তার সহযোগী রেড-ইন্ডিয়ানদের ডেকে সে একটা ক্যানো-জাতীয় নৌকো আনতে বলে

পাবলোর সহকারী রেড-ইন্ডিয়ান শিকারিরা যখন অকুস্থলে এসে উপস্থিত হল, তখন পূর্বোক্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের সঙ্গীরা নৌকো নিয়ে এসেছে। দুজন সুদক্ষ সৈনিকের সঙ্গে নৌকোর উপর উঠে বসল সার্জেন্ট পাবলো। নৌকো চালানোর ভার নিল দুজন ইয়াম্বো-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ান। জিভায়রা-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ানরা ডাঙার উপর পা চালিয়ে নৌকোটাকে অনুসরণ করল এবং পাবলোর আদেশে তার অধীনস্থ সৈনিকরা আর একটি নৌকো আনতে ছুটল।

সকাল ছটা বেজে গেছে। নদীর মধ্যস্থল এখন দিবালোকের স্পর্শে উজ্জ্বল, অবশ্য তীরের কাছে ঘন উদ্ভিদের ছায়ায় ঢাকা অন্ধকারের নীড় ভাঙতে তখনও আধঘণ্টা দেরি…

প্রায় পঁচিশ গজ যাওয়ার পরে নৌকোর উপর উপবিষ্ট এক জন ইয়াঘো মাঝি তার হাতের দাঁড় তুলে বাঁ দিকে উঁচিয়ে ধরল। সেদিকে লক্ষ্য করে পাবলো দেখল, জলের উপর দুলছে একটা বর্শাদণ্ড!

আর একটু দূরেই নদীর জলে ভাসছে একটা কুৎসিত ও ভয়ংকর মুখ– আনাকোন্ডা।

নৌকো আর সপর্দানেবের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল আন্দাজ ৩৫ গজ। তিন-তিনটি রাইফেল নৌকোর উপর থেকে সাপের দেহ লক্ষ্য করে অগ্নি-উদ্গার করল। দোদুল্যমান নৌকোর উপর থেকে নিশানা স্থির করা খুব কঠিন। তা ছাড়া সাপটাও স্থির হয়ে নেই, সাঁতার কাটছে। তাই রাইফেলের সব কটা বুলেট লক্ষ্যভেদ করল কিনা বলা মুশকিল।

 তবে অন্তত একটা গুলি নিশ্চয়ই সর্পের দেহে বিদ্ধ হয়েছিল, কারণ আগ্নেয়াস্ত্রের আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহাসর্প নদীর জলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে ছটফট করতে লাগল। আনাকোন্ডার দেহে কামড় বসিয়ে বর্শার ফলাটা এতক্ষণ দুলে দুলে উঠছিল, জলের ধাক্কায় সেই অস্ত্রটা এবার তার শরীর থেকে খসে নদীর জলে হারিয়ে গেল। পরক্ষণেই জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল মূর্তিমান আতঙ্ক! এতক্ষণ পর্যন্ত ভাসমান বর্শান্ত দেখেই শিকারিরা নদীর উপর আনাকোন্ডার অস্তিত্ব নির্ণয় করতে পেরেছে, কিন্তু বর্শাটা এখন খুলে পড়ায় জলরাশির মধ্যে তাকে আবিষ্কার করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ল।

জলের উপর কিছুটা রক্ত ভেসে উঠেছিল কিন্তু সরীসৃপ জাতীয় জীবের দেহে খুব গভীর ক্ষত হলেও ক্ষতস্থান থেকে স্তন্যপায়ী জীবের মতো প্রচুর রক্তপাত হয় না। তাই সামান্য রক্তের চিহ্ন ধরে আহত সাপটাকে অনুসরণ করা সম্ভব হল না। তীব্র স্রোতের টানে সেই রক্তের ধারাও সত্বর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

কিন্তু শিকারিরা হতাশ হল না। তারা নদীর বুকে এদিক-ওদিক নৌকো চালিয়ে অনুসন্ধান করতে লাগল…।

আচম্বিতে নৌকোর তলায় এক দারুণ ধাক্কা! ধাক্কা মেরেছে আনাকোন্ডা। পরক্ষণেই আত্মপ্রকাশ করল সে! সঙ্গেসঙ্গে নৌকো উল্টে গেল এবং সার্জেন্ট পাবলো তার দলবল নিয়ে ছিটকে পড়ল নদীর জলে!

সবাই মিলে নৌকোটাকে আবার সোজা করে উঠে পড়ল বটে, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রগুলি তখন নদীর জলে অদৃশ্য হয়ে গেছে!

সুখের বিষয়, আনাকোন্ডা এই সুযোগে শিকারিদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেনি নৌকো উলটে দিয়ে আবার জলের তলায় গা-ঢাকা দিয়েছে।

ইতিমধ্যে অকুস্থলে আবির্ভূত হয়েছে দুই নম্বর ক্যানো। এই নৌকোটা আরও বড় এবং তার ছয় জন আরোহীর মধ্যে চার জনের হাতেই রাইফেল।

দুনম্বর নৌকো থেকে পাবলো এবং তার এক জন সঙ্গীকে একটি একটি করে দুটি রাইফেল দেওয়া হল। পাবলোর নির্দেশে দুটি ক্যানো পাশাপাশি চলতে লাগল। তাদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় কুড়ি ফিট।

আনাকোন্ডা যে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করবে না, এমন কথা জোর করে বলা যায় না। তাই ক্যানো দুটিকে কাছাকাছি রাখার ব্যবস্থা করা হল।

বলা যায় না, মুহূর্তের অসতর্কতায় শিকারি পরিণত হতে পারে শিকারে!…।

সমস্ত সকাল ধরে চলল অনুসন্ধান। নদীর দুই দিকের তীরবর্তী অগভীর জলে বার বার খুঁজে দেখল শিকারিরা। পাবলোর বিশ্বাস, সাপটা আহত অবস্থায় গভীর জলে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারবে না, খুব সম্ভব নদীর ধারে কোনো গোপন গুহা বা গর্তের ভিতর সে লুকিয়ে আছে। পরবর্তী ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া গেল যে, পাবলোর ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নির্ভুল।

প্রভাত অতিবাহিত হল ব্যর্থ প্রচেষ্টায়… পলাতক আনাকোন্ডার সন্ধান মিলল না কোথাও।

 তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্ন ভোজোনের পালা সাঙ্গ করে পাবলো এবং তার দল আবার অনুসন্ধান শুরু করল। জিভরো রেড-ইন্ডিয়ানরা এতক্ষণে নদীর এপারে সাপটার সন্ধান করছে। এইবার তারা নৌকোযোগে নদীর অপর পারে উঠে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। আর অন্যান্যেরা দুটো ক্যানো জলে ভাসিয়ে টহল দিতে শুরু করল। তাদের লক্ষ্য নদীর অগভীর জলের দিকে..

বেলা পড়ে এসেছে। অপরাহ্ন ৪টা। হঠাৎ নদীর উত্তর দিকের তীরভূমি থেকে ভেসে এল উত্তেজিত জিভারোদের উল্লাসধ্বনি?

ক্ষিপ্রহস্তে বৈঠা চালিয়ে মাঝিরা নৌকো দুটিকে যথাস্থানে নিয়ে এল। আর পরক্ষণে শিকারিদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য!

জিরো শিকারিরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে একটা গর্ত বা গুহার মতো জায়গায় বর্শা দিয়ে খোঁচা মারছে। পলাতক দানব জিরো শিকারিদের তীক্ষ্ণদৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে নি।

নদীর ধারে যেখানে নিমজ্জিত শিকড় ও উদ্ভিদের অরণ্যে আত্মগোপন করেছে সর্পদানব আনাকোন্ডা, সেখানে জলের গভীরতা খুব কম— চার-পাঁচ ফিটের বেশি নয়। তীরের জমিটা জলের উপর খানিকটা এগিয়ে এসে পলাতক সর্পের দেহের উপর একটা আচ্ছাদনের সৃষ্টি করেছে এবং ঘরের ছাদের মতো ওই জমির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কয়েক জন জিরো তাদের সুদীর্ঘ বর্শা দিয়ে নীচের অন্ধকার গুহার মতো জায়গাটায় সজোরে খোঁচা মেরে চলেছে অবিরাম।

আরও কয়েকজন জলের কিনারে উচ্চভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে উদ্যত বর্শা হাতে, এবং আর একদল অতি-দুঃসাহসী জিভারো শিকারি জলে নেমে ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্ভিদের বেড়াজাল ভেঙে নদীর দিক থেকে সাপটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে,

হঠাৎ নদীর তীরবর্তী ছাদের মতো জমিটা ভেঙে পড়ল সশব্দে! আর–

যেখানে ঘন উদ্ভিদের জাল ও অগভীর জলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে আনাকোন্ডা, ঠিক সেই জায়গায় অন্ধকার মাখা গুহাটার ভিতর ছিটকে পড়ল দুজন জিভারো!

এক জন চটপট তীরে উঠে পড়ল। তার সঙ্গীটিও সেই চেষ্টা করল বটে, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না।

বিদ্যুৎবেগে আনাকোন্ডা লোকটির পা কামড়ে ধরল। পরক্ষণেই ফঁসের দড়ির মতো দুটো মারাত্মক কুণ্ডলীর বন্ধনে বন্দি হল হতভাগ্যের দেহ… একটা কাতর আর্তনাদ শুধু… তারপর সব শেষ….

নৌকোর উপর বসে গুলি চালাতে নিষেধ করে সার্জেন্ট পাবলো। কারণ সাপটাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে নাগপাশে আবদ্ধ জিরোর গায়েও গুলি লাগার সম্ভাবনা। কিন্তু যখন দেখা গেল, হতভাগ্যের মৃত্যু হয়েছে, পাবলো তখন গুলি চালানোর আদেশ দিল। শ্বেতাঙ্গ সৈনিকদের চার-চারটে রাইফেল অগ্নি উর করে গর্জে উঠল। ইয়াম্বো মাঝিবা বৈঠা ফেলে তুলে নিল বর্শা…

রাইফেলের গুলিতে জর্জরিত সর্পদানবের দেহে বিধে যায় দুদুটো বর্শা… বিকট হাঁ করে শিকারিদের আক্রমণ করার উপক্রম করল আনাকোন্ডা। সঙ্গে সঙ্গে আবার গর্জে উঠল সব কটা রাইফেল… এইবার মর্মস্থানে আঘাত পড়েছে বোঝা গেল। দারুণ যাতনায় পাক খায় আনাকোন্ডা। নদীর বুকে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল নিষ্ফল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে বারংবার…

ধীরে ধীরে থেমে গেল দানবের অন্তিম আস্ফালন। জিভারোরা তাদের সঙ্গীর মৃতদেহটা উদ্ধার করল সৎকারের জন্যে। আনাকোন্ডার মারাত্মক আলিঙ্গনের কঠিন পেষণে হতভাগ্যের অস্থি-পঞ্জর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।

নিহত সাপটার মাথার একটু পিছনে একটা শক্ত দড়ি বেঁধে নৌকোর পাশে সেটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। এক নম্বর ক্যানো নৌকোটা পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল আর তার পিছনে চলল দুই নম্বর নৌকো। দ্বিতীয় নৌকোটা দৈর্ঘ্যে আঠারো ফিট। আনাকোন্ডার মাথাটা বাঁধা হয়েছে এই নৌকোর সামনে, আর পিছনে নৌকো ছাড়িয়ে আর প্রায় ছয় ফিট আন্দাজ ভাসছে তার লেজের দিকটা!

সত্যিকারের এক সর্পদানব!

 দুঃখের বিষয়, সাপটার শারীরিক স্থূলত্বের ও দৈর্ঘ্যের সঠিক মাপ নেওয়া শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

কারণ কী?

কারণ হচ্ছে- পিরানহা!

দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন নদীতে ঘুরে বেড়ায় এই পিরানহা নামক মাছের ঝাঁক।

অনেক পর্যটক ও শিকারি শরীরে ক্ষত থাকলে পিরানহার ভয়ে জলে নামতে সাহস করেন না। কারণ রক্তের ধারা জলে পড়লেই পিরানহা মাছ দল বেঁধে সেখানে ছুটে আসে এবং খুরের মতো ধারালো দাঁতের আঘাতে শিকারের দেহ ছিন্নভিন্ন করে বীভৎস ভোজসভা বসিয়ে দেয়।

অবশ্য শরীরে ক্ষত না থাকলে অধিকাংশ সময়ে নিরাপদে নদী পার হওয়া যায়, কিন্তু জলে রক্ত পড়লেই মুশকিল। বর্শা ও রাইফেলের গুলি আনাকোন্ডার দেহে অনেকগুলো রক্তাক্ত ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। সেই রক্তের নিশানা ধরে ছুটে এল এক ঝাক পিরানহা মাছ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আনাকোন্ডার প্রকাণ্ড শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল খুদে রাক্ষসের দল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *