1 of 2

সীমান্তবাসী

সীমান্তবাসী

চাঢ্ঢাসাহেব বহুদিন হলই বলছেন, একবার তাঁর কারখানায় বেড়িয়ে আসতে। দিল খুশ হয়ে যাবে।

কোনো কারখানায়ই কেউ বেড়াতে যায় না। কিন্তু এ-কারখানার বিশেষত্ব আছে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসী এলাকাতে ‘শেল্যাক’-এর কারখানা। বন-বনান্তর থেকে আদিবাসীরা পলাশ ফুল আর কুসুম গাছ থেকে কেটে নিয়ে আসে স্টিক-ল্যাক। তা থেকেই এই কারখানাতে তৈরি হয় সিড-ল্যাক। আর শেল্যাক। চাঢ্ঢাসাহেব বহুবারই বলেছেন, খুবই শান্তির জায়গা, একবার ঘুরে আসুন সেনসাহেব।

টিনার পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা শেষ হল এই সেদিন। দুর্যোগের মধ্যে কোনোরকমে দিল পরীক্ষা। এবারে ব্যাপার যে কী তা বোঝা যাচ্ছে না। শ্রাবণের প্রথমে আকাশের দিকে চেয়ে যখনই দেখছি বৃষ্টি আসছে না এবং আকাশ নির্মেঘ, মনে হচ্ছে আশ্বিনই এসে গেছে বুঝি। কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি।

টিনার পরীক্ষা হতেই রিনা আর টিনা বম্বে চলে গেছে। সেনসাহেবের বড়ো সম্বন্ধী বম্বেতে আছেন। মার্কেনটাইল ফার্মের নাম্বার ওয়ান। বিরাট ফ্ল্যাট, নেপিয়ান সি রোডে। সাদা-রঙা এয়ার-কণ্ডিশানড-ভলভো গাড়ি। পার্টি, নাচ, গান; নেমন্তন্ন। বম্বে যেতে পারলে রিনা এবং মেয়ে টিনা আর কিছুই চায় না। অতএব, তাদের ‘গীতাঞ্জলি’তে তুলে দিয়েছেন সেনসাহেব।

ভেবেছিলেন, ফাঁকা বাড়িতে স্ত্রী-বর্জিত কষ্টলব্ধ স্বাধীনতা সেলিব্রেট করবেন, পুরোনো বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে বাড়িতে হই হই করে। রিনা বাড়িতে ড্রিঙ্ক-টিঙ্ক করা একেবারেই পছন্দ করে না। এই-ই সুযোগ। যত মোদো-মাতাল কিন্তু তালে-ঠিক বন্ধু-বান্ধব আছে, তাদের এই বেলা একটা গুড-ট্রিট দেবেন ভাবলেন। ইতিমধ্যেই একটা শুক্রবার বনধ-এর কারণে উটকো ছুটিও পাওয়া গেল। কলকাতায় আবার বনধ কী? প্রতিদিনই তো কিছু না কিছু বন্ধ থাকে। মিটিমিটি আধবোজা এখানে জীবনযাত্রা। কাজ ছাড়া এখানে আর সব কিছুই হয়।

বনধটি ঘোষিত হবার পরই হঠাৎ মনে হল চাঢ্ঢাসাহেবের কথা। সেনসাহেব ফোন করলেন একটা।

নো প্রবলেম। আই অ্যাম অনার্ড স্যার। কতদিন থেকে বলছি একবার যাবার কথা।

হ্যাঁ, কোন ট্রেনের টিকিট কাটব? ট্রেন কখন?

আপনার কিছুই ভাবতে হবে না স্যার। টিকিট আমি পৌঁছে দেব। মেমসাহেবের আর মেয়ের নামটা বলুন। আর বয়েস। আজকাল তো আবার বয়েস লাগে রিজার্ভেশন করতে।

ওরা কেউই যাবেন না। ইনফ্যাক্ট কেউই নেই এখানে। সবাই বম্বেতে। আমি একাই যাব।

একা? ওই জঙ্গুলে জায়গাতে বোর হয়ে যাবেন স্যার।

আমার একা থাকতেই ভালো লাগে।

আমি কি যাব আপনার সঙ্গে স্যার? টু কিপ ইউ কোম্পানি? তাস খেলব, বিয়ার খাব। যদিও আমার এ সপ্তাহে একটু চায়না, মানে বেজিং-এ যাবার কথা ছিল।

সেনসাহেব মনে মনে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে। চাঢ্ঢা সঙ্গে গেলে তো হয়েই গেল। এই লোকটি শুধু টাকাই বোঝে। টাকা, সাফল্য, চিৎকার, শোরগোল। ওর জীবনে কোনো একটিও মুহূর্ত নেই, যা শূন্য। মানে, এমন একটিও মুহূর্তও নেই যা কোনো পূর্ণতার প্রত্যাশাতেই শূন্য থাকে অন্তত কিছুক্ষণ। পৃথিবীর সব পাওয়াই তার পাওয়া হয়ে গেছে। জীবনের সব চাওয়া তার হিপ-পকেটে রাখা ফোলা কোলাব্যাঙের মতো মোটা পার্স-এর মধ্যে বন্দি আছে। পার্সটা শুধু খুললেই হল।

কী হল? যাব নাকি? আমি? স্যার?

চাঢ্ঢা আবার বলল, তার হাসকি, সেক্সি গলায়, ফোনে।

না, না।

সেনসাহেব বললেন, আমি একটু একাই থাকতে চাই।

ও কে ফাইন। পরশু পৌনে ন-টায় তৈরি হয়ে থাকবেন রাতে, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আপনাকে তুলে নিয়ে আমার একজন লোক গাড়িতে তুলে দিয়ে আসবে।

কেন? আমি কি শিশু নাকি? না ইনভ্যালিড?

না স্যার; আপনি ভি আই পি। আপনারা শিশুর চেয়েও বেশি যত্ন পেয়ে থাকেন তো। আমারই বা নম্বর কাটা যায় কেন? আমার নিজেরই স্বার্থেই সবসময় আপনার দেখভাল করি আমি। পৃথিবীতে স্বার্থ ছাড়া একটা মাছিও ওড়ে না স্যার।

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন সেনসাহেব। সিএমডি-এর কাজ হচ্ছে মোড়ে। মাত্র দুজন কুলি গাঁইতি হাতে কাজ করছে। একটু কাজ করেই বসে বিড়ি খাচ্ছে। ততোধিক কুঁড়ে একজন সুপারভাইজার মাঝে মাঝে এসে তাদের কাজের তদারকি করে যাচ্ছে। ওই মোড়টুকুতে রাস্তার সারফেস-এর কাজ শেষ হয়নি বলে প্রতিমুহূর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং হাজার হাজার যানবাহনের কী অশেষ দুর্গতি! কলকাতায় বাস করেন এবং নিজে বাঙালি বলেই বড়ো লজ্জাবোধ করেন আজকাল সেনসাহেব। এই রাজ্য কীভাবে চলছে তা জানতে সরকারি বিজ্ঞাপন বা বিরোধীদের প্রতিবাদ পড়ার দরকার হয় না সেনসাহেবের। চোখ খুলে চাইলেই তা বোঝা যায়। এই অবস্থা সত্ত্বেও নির্লজ্জ নেতাদের কদর্য আস্ফালনে বমি পেয়ে যায়। সবাই কি ঘুমোয় কলকাতায়?

তাঁর বন্ধু শ্যামল তাঁকে বলছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা শহরটুকু নিয়েই নয়। হয়তো তা নয়। কিন্তু সারারাজ্যের মস্তিষ্ক, নার্ভ-সেন্টার তো এই কলকাতাই! তা ছাড়া, গ্রামেও তো সেনসাহেবকে মাঝে মাঝে যেতে হয়। গ্রামবাংলার অবস্থাও তাঁর নিজচোখেই দেখা!

একটা সিগারেট ধরালেন। চ্যাটার্জি দিয়ে গিয়েছিল একপ্যাকেট ভালো বিলিতি সিগারেট। যখন ওর কাছে আসে, তখনই ইচ্ছে করেই নতুন একটা প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট নিজে নিয়ে, প্যাকেটটা যেন ভুল করেই রেখে যায় রোজ টেবিলে। এগুলোকে ঘুস বলে মনে করেন না সেনসাহেব। তিনি ঘুস খান না। খেলে, তাঁর অনেক কলিগ-এরই মতো তাঁরও বাড়ি গাড়ি থাকত। তবে এইসব ছোটোখাটো ব্যাপারে ‘না’ করেন না। অতিসতীপনা নেই তাঁর। বিবেকের দিক থেকে পরিষ্কার উনি। সরকারকে ঠকিয়ে কাউকে কোনো ফেভার দেন না। কাউকেই হ্যারাসও করেন না বলেই সকলে তাঁকে ভালোবাসে। সৎ বলেই টাকা অফার করার সাহস না পেয়ে এমনি করে গুড-হিউমারে রাখতে চায় সকলেই তাঁকে। বোঝেন। যা বোঝার! এই সব ছোটোখাটো ফেভারে তাই ‘না’ করেন না।

অনেক দিন পর রাঁচি এলেন সেনসাহেব। গাড়ি পৌঁছোবার কথা আটটা পঁচিশে। আরও চল্লিশ মিনিট লেট ছিল।

চাঢ্ঢার লোক হাওড়াতে এসে এয়ারকণ্ডিশানড কোচ-এ তুলে দিয়ে গিয়েছিল এয়ারকণ্ডিশানড কন্টেসা গাড়ি করে। রাঁচিতেও চাঢ্ঢার লোক এসেছিল। সেনসাহেব ট্রেন থেকে নামার আগেই কোচ অ্যাটেন্ড্যান্ট-এর কাছে নাম জিজ্ঞেস করে কোচ-এউঠে, রিসিভ করে নিয়ে গিয়েছিল গাড়িতে, একজন অল্পবয়েসি ছেলে। তার পর বি এন আর-এ গিয়ে চান সেরে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে; গাড়িতে উঠে পেছনে বাঁ-দিকে আরাম করে বসেছিলেন।

গাড়ি ছুটে চলল ফাঁকা পথ দিয়ে, শহর পেরুবার পরই। দু-পাশে চাপ-চাপ সবুজ। চাঁইবাসার পথ এটা। অঝোরধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সঙ্গে ঝোড়ো, দমকা হাওয়া। খুঁটি, মুরহু, টেবো ঘাট হয়ে চক্রধরপুর চলে গেছে এই রাস্তা। সেখান থেকে চাঁইবাসাও। বীরসা মুন্ডার উলগুলানের পটভূমির ওপর দিয়ে চলে গেছে পথ।

ঘণ্টা দুয়েক চলার পর চাঢ্ঢাসাহেবের বাংলোতে এসে পৌঁছোলেন। কারখানার লাগোয়া বাংলো। ছোট্ট, কিন্তু সুন্দর। সঙ্গের ছেলেটি ডাকল, হনসো।

একটি মুণ্ডা মেয়ে এসে দাঁড়াল। বয়েস বাইশ-তেইশ হবে বেশি হলে। যেমন সুন্দর ফিগার তেমনই চোখের ও মুখের ভাব।

হনসো বলল, বাবু!

সাহাবকা দেখভাল করে গা।

এই মেয়েটিই বাংলোর কেয়ারটেকার স্যার। আমরা কারখানা থেকে মাঝে মাঝেই এসে খোঁজ নিয়ে যাব। চৌকিদারও আসবে মাঝে মাঝে। লোডশেডিং এদিকে খুব। কলকাতার চেয়ে আমরা এ বাবদ পেছিয়ে নেই। তবে আমাদের চারটি জেনারেটর আছে। সঙ্গে সঙ্গে টেকওভার করে নেয়। হ্যাভ আ নাইস স্টে স্যার।

ছেলেটি চলে গেল। বেডরুমের পাশে বাগান। ড্রয়িং রুমের সামনেও তাই। নানারকম শৌখিন গাছ লাগানো। ড্রয়িং রুমের লাগোয়া একটি বারান্দা। তার সামনে মস্ত একটি কাঠটগরের গাছ। পাতাবাহার; লালপাতিয়া, পেছনে করবীর বেড়া, সোনাঝুরি, পেয়ারা, আম, লিচু সব দাঁড়িয়ে আছে সারে সারে আর পাগলা হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে, হাত পা নাড়াচ্ছে পাগলের মতো। দু-হাত তুলে জংলির মতো চুমু-খাওয়া বৃষ্টিকে বলছে, এই না, না; আর নয়। অসভ্য। থামো এবার!

সাহাব!

কে?

চমকে উঠলেন সেনসাহেব।

হনসো।

পিনেকা পানি। বলে, বেডসাইড টেবিলের ওপর ঝকঝকে স্টেইনলেস স্টিলের জাগ এবং গ্লাস রেখে গেল হনসো, স্টেইনলেস স্টিলের ট্রের ওপর।

এয়ারকণ্ডিশানার ছিল। সেটা বোধ হয় ভোল্টেজে গন্ডগোলের কারণে খুলে নেওয়া হয়েছে। প্রেসমেশিনে গোলগোল করে কাটা একটা লোহার জাল দিয়ে সিমেন্ট গেঁথে দেওয়া হয়েছে সেই শূন্যে। জল, হাওয়া, আলো, চাঁদ সবই আসে।

সেনসাহেবের খুবই ভালো লাগতে লাগল। অনেকদিন এমন ভালো লাগেনি। এই পরিবেশ, শান্তি, নির্জনতা, এই আবহাওয়া।

কাঠটগরের গাছে বড়ো বড়ো সাদা ফুল ধরেছে। বৃষ্টিতে আর হাওয়াতে ফুলগুলোকেকাগজের ফুল বলে মনে হচ্ছে। একটি মুণ্ডা মেয়ে এরইমধ্যে কলসি কাঁখে চলে যাচ্ছে ঘন গাছগাছালির মাঝে মাঝের সুঁড়িপথে। তাকেও আবছা দেখাচ্ছে, নরম, গলে-যাওয়া কালচে—লাল লাক্ষারই মতো। কাগজের নারী।

কিছুই করবেন না এখানে সেনসাহেব। শুধু খাবেন, ঘুমোবেন, আর চুপ করে এই নির্জন প্রকৃতির রস নিজের কোষে কোষে ভরে নেবেন। দু-একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করলেও করতে পারেন। আত্মরতি এবং কবিতা এই দুটি বদভ্যাসই বহুদিন হল পেছনে ফেলে এসেছেন। মাঝে মাঝে বদ হওয়া ভালো। ভাবলেন সেনসাহেব। তাতে ভালোত্বটা ওয়াটার-প্রুফিং পুডিংয়ের প্রলেপের মতো সুরক্ষিত হয়।

সাহাব!

কে?

আবার চমকে উঠলেন সেনসাহেব।

হনসো!

হনসো তাঁর শরীরের একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে। মুখে সরল, নিষ্পাপ, স্নিগ্ধ হাসি।

হনসো বলল, সাব, দোপহরমে খানা ক্যা বনে গা?

সেনসাহেব, হনসোর ওই নৈকট্য সহ্য করতে পারছিলেন না। বৃষ্টি-ভেজা কাঠটগর গাছের মতো টাটকা সতেজ যৌবন। তার উদ্ধত অথচ স্বাভাবিক শান্ত বুক, তার দীর্ঘ মরালী গ্রীবা, তার কালো চোখের নির্লোভ চাউনি। এই পরিবেশে, এমন বাদলা, মেঘলা দিনে, এমন নিরিবিলিতে সাহেবের বয়েসটাকে দামাল গ্রীষ্ম-দুপুরে খসে-যাওয়া সোনাঝুরি পাতার মতো এক-ফুৎকারে উড়িয়ে নিয়ে গেল যেন। সেনসাহেবের কষ্ট হতে লাগল। যেসব কষ্টবোধ কলেজে-পড়া মেয়ের বাবা, স্ত্রীর প্রৌঢ় স্বামী এবং ভারিক্কি সরকারি অফিসারের দামি মোড়কে এতদিন ঢাকা ছিল, যেসব কষ্ট আদৌ এখনও আছে বলেও জানা যায়নি, সেইসব কষ্টগুলোই একইসঙ্গে নকশাল ছেলেদের অসংখ্য ছোরার মতো তাঁর বুকে-পেটে-চোখে-মাথায় আঘাত করল। হুঁশ হারিয়ে ফেলার মতো হল তাঁর। সোফায় বসে পড়ে বললেন, তুমি যা বানাবে তাই-ই!

তার পরেই হুঁশ ফিরে পেয়ে বললেন, তুমি কোথায় থাকো?

গ্রামে।

গ্রামে?

ও! হ্যাঁ। তা তো হবেই। গ্রামীণ মানুষ তো গ্রামেই থাকবে।

প্রশ্নটাই বোকার মতো হল। ভাবলেন সেনসাহেব।

কোন গ্রামে?

হাসসা।

তোমার কে কে আছে?

সবাই। বাবা, মা, ভাই, বোন।

বর?

হনসো হেসে বলল, না:।

সে কী? তোমার বর নেই? বিয়ে হয়নি এখনও?

না:।

এই বাংলোয় কে থাকে আর? রাতে?

আমি।

তুমি একা?

হ্যাঁ। তবে মেহমান থাকলে। কেউ না থাকলে, গ্রামে চলে যাই।

ও। তা বেশ। তুমি যখন বিয়ে করোনি তখন…। তুমি বিয়ে করবে তো?

হাসল হনসো। বলল, কে জানে?

তোমাদের বিয়েতে বরের কী দিতে হয়? গোরু? দুটো গোরু?

না:। টাকা, শাড়ি গয়না।

তা বেশ!

হেসে বললেন, সেনসাহেব।

সেনসাহেব হেসেই বললেন তাকে, আমিই তবে বিয়ে করব তোমাকে।

হনসো মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসল।

তুমি রাতে থাকবে এইখানে! বেশ! তাহলে তো ভালোই!

কী ভালো এবং কেন ভালো তা আর বললেন না।

হনসোও কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেল।

আবার জোর বৃষ্টি নামল। কী জোরে বৃষ্টি হচ্ছে! এবারে সত্যিই ডিল্যুজ হবে। ঘোর কলি তো! ন্যুহ সাহেবের নৌকো ভাসাবার সময় হল আবার। এত পাপ, এত অবিচার পৃথিবীর আর বোধ হয় সইছে না।

পাপ! পাপ কাকে বলে? হনসোকে এই হঠাৎ চাওয়া কি পাপ? তাঁর কৃপাপ্রার্থী চাঢ্ঢার অতিথি হয়ে আসা কি অন্যায়? বোগাস। সব ব্যাপারই রিলেটিভ। এই চাঢ্ঢা ইচ্ছে করে সেনসাহেবকে ফাঁসাবার জন্যে হনসোর কাছে এই ফাঁকা বাংলোতে ভিড়িয়ে দিয়েছে কি তাঁকে? হতেও পারে। সেনসাহেব ভাবলেন। নতুন রিলে স্টেশান হবে অনেকগুলো। কয়েক কোটি টাকার কাজ। টেণ্ডার পড়লেও, টেণ্ডার কমিটি বসলেও, আসল ক্ষমতা সেনসাহেবেরই। বোর্ডও জানে সেনসাহেব ঘুসখোর নন। সেনসাহেবের ‘ভেটো পাওয়ারই’ এ ব্যাপারে শেষকথা। মেজরিটি উল্টো দিকে গেলেও তাঁর ডিসিশানই বহাল থাকবে।

রিলে স্টেশান, চাঢ্ঢা, হনসো, নির্জন জঙ্গলের মধ্যে বাংলো! সেনসাহেব এই বৃত্তর মধ্যে পড়ে কি ফেঁসে যাবেন? চাঢ্ঢা আর কী চায়? এমনিতেই তো সব কাজই তাঁকে দেন উনি। কাজ দেন, কারণ চাঢ্ঢার অনেক লোকজন আছে। পয়সার জোর আছে। টার্গেট ডেটের অনেক আগেই কাজ কমপ্লিট করে দেয়। তবু, তাঁকে এই পরীক্ষাতে ফেলার দরকার কী ছিল তার? এই পরীক্ষায় পাস কি তিনি করবেন আজ?

ভয় হচ্ছে সেনসাহেবের।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুম লাগালেন একটা। ট্রেনে ভালো ঘুম হয় না, সে যে ক্লাসেই ট্রাভেল করা যাক না কেন!

বিকেলে উঠে ড্রইং রুমে বসলেন। আবহাওয়ার কোনোই উন্নতি হয়নি। ‘শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথ যামিনীরে! কুঞ্জপথে সখী কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে’!

কোন দিক দিয়ে আসবে হনসো? বেডরুমের সঙ্গে একটা দরজা আছে, যেটা বাইরের বারান্দাতে খোলে। রাতের অতিথি সেই পথ দিয়ে আসতে পারে। খাওয়া-দাওয়ার পর খাওয়ার ঘর দিয়েও আসতে পারে। একথা ভাবতেই সোফায় বসে দুটি হাঁটুই থরথর করে কাঁপতে লাগল সেনসাহেবের।

বলবেন কী করে? কী বলবেন?

ভাবলেন, একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে বলবেন, তুমি কাপড় কিনে নিয়ো। বলবেন কি? ফিসফিস করে? রাতে এসো।

যদি চেঁচামেচি করে। চাঢ্ঢা একবার বলেছিল যে, মুণ্ডারা তাদের মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া দূরে থাক, একবার খারাপ চোখে তাকালেও তির ছুঁড়ে দেয় পিরিং করে। তাকানো শেষ। বিষের তির। প্রাণ এবং ইজ্জত সঙ্গে সঙ্গে খালাস।

তবে?

বলতে হবে না কিছু। চাঢ্ঢা কি আর এমন নির্জনে একলা মেয়েকে চৌকিদার এমনিই রেখেছে? অতিথিদের খাতির-টাতিরই করতে। এইসব নইলে নাকি আজকাল বড়ো ব্যাবসা চালানোই যায় না। তা ছাড়া মেয়েটার ন্যাকা ন্যাকা ভাবই তার প্রমাণ। ন্যাকা মেয়েগুলো সাধারণত হারামজাদিই হয়।

ভেবেছিলেন, বিকেলে হাঁটবেন একটু। বৃষ্টি ধরল না। সেনসাহেব রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে নার্ভাস বোধ করতে লাগলেন। সমস্ত শরীরে যেমন রোমাঞ্চ হতে লাগল তেমনই ভয়ে আবার তাঁর শিরদাঁড়া সরু হয়ে গিরগিটির শিরদাঁড়া হয়ে যেতে লাগল। এমন করা কি উচিত হবে সেনসাহেবের? তাঁর মেয়ে টিনা জানতে পেলে? রিনা জানতে পেলে? ছি: ছি:।

এমন সময় কে যেন ভেতর থেকে বলে উঠল, হিন্দু বিধবার মতো সবটাতেই ছি: ছি: ছি: ছি: কোরো না ইডিয়ট। চুরিবিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড়ো ধরা। একটাই জীবন ইডিয়ট। একটু মজা করো, লাইফ এনজয় করো, থোর-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোর না খেয়ে, মাঝেমধ্যে একটু দু-পেয়ে মুরগি-টুরগি খাও ইয়ার। আফটার অল, ইউ ওনলি হ্যাভ ওয়ান লাইফ টু লিভ। বুয়েচো!

কে বলল?

অ্যান্টি-বিবেক?

কী জ্বালা!

রাতের খাওয়ার সময় সেনসাহেব মুখ তুলে তাকাতেই পারলেন না হনসোর মুখের দিকে। মস্ত বড়ো জোড়া বিছানাতে দুটি বালিশ ছিল। বিছানা করতে এসে হনসো দুটি বালিশ দু-পাশে দিল, দুজনের শোবার জন্যে, বিছানাতে চাঁপা ফুল ছড়িয়ে দিয়ে গেল। প্রকান্ড মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেল। দুই বালিশের মধ্যে লাল কোলবালিশ। রমণীরমণ ব্যাপার স্যাপার।

সেনসাহেব লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছেন না। যেন নিজেরই নববধূ! তাঁর মাথার মধ্যে তাঁর স্কুলের বকা সহপাঠী ফড়িং, চেঁচিয়ে উঠল, মা—ন্তু!

খাওয়া শেষ হতে হতে হঠাৎই ঝড় উঠল একটা। এবং আকাশের সব মেঘ উড়ে গেল যেন মন্ত্রবলে। নিষ্কলঙ্ক ঝকমকে কালো আকাশে তারা ফুটল। জ্বল জ্বল করে। আঃ।

হনসোর গলার স্বরের সঙ্গে আরও দু-একজনের গলার স্বর শুনলেন সেনসাহেব। তবে কি বিপদ অনুমান করে হনসো অন্য লোকদের ডেকে নিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে? পাঁজরে একটি বিষের তির। উঃ। লাগুক লাগুক। তবু। এসে অবধি কামনার অসংখ্য তিরে তিনি বিদ্ধ। রক্তাক্ত। শুধু পুরুষই জানে পুরুষের কষ্টর কথা; তার অসহায়তার কথা। এটা ভালো খারাপের প্রশ্ন নয়। আদৌ নয়। পুরুষমাত্রই হতভাগা। বিধাতা তাকে বড়ো দুর্বল করে গড়েছেন। বড়োই দুর্বল! নইলে, সেনসাহেবের মতো অক্সফোর্ডের এম এ, এতবড়ো সরকারি কর্মচারী; রাশভারী মানুষ হনসো নাম্নী এক অশিক্ষিতা প্রলেতারিয়েতের তিরে এমন করে ভূলুন্ঠিত হন! ছো:! ছো:!

খাওয়া-দাওয়ার পর হনসো বলল, দরওয়াজা অন্দরসে বনধ কর দিজিয়েগা সাহাব!

ছেনালি! দরজা, অন্দরবাসী কে আর কবে বাইরে থেকে বন্ধ করেছে রে শালি!

পা কাঁপতে লাগল আবার।

দরজা বন্ধ করলেন সেনসাহেব। ভাবলেন, সঙ্গের লোকজনকে বিদায় করেই আসবে হনসো। শরীরের মধ্যে একদল টাকা-কেন্নো লাল-লাল, লক্ষ-লক্ষ পা-ওয়ালা; হেঁটে বেড়াচ্ছে। দরজাটা বন্ধ করলেন শব্দ করেই। ভাবলেন, এই হঠাৎ শব্দে তাঁর ভেতরের হঠাৎ-আসা কাম-পোকাটা যদি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়! বিছানাতে শুয়ে ওই ঠাণ্ডাতেও গরম লাগল তাঁর। অথচ এমনই ঠাণ্ডা এখন এখানে যে, কম্বল দিয়েছে হনসো পায়ের কাছে। রসিকতা! যুবতীশরীর থাকতে কে আর কবে কম্বলে মুড়েছে নিজেকে?

ঘুম এল না। উঠে পড়লেন। দরজা খুলে, ভেতরের উঠোনে রান্নাঘরের সামনে পায়চারি করতে লাগলেন।

হনসো এবং আরও দুটি মেয়ে কাজ করছে। এরা আবার কারা? এল কোত্থেকে? ওয়ান ভার্সাস থ্রি? যা:! উনি কি পারবেন?

একজন পুরুষের গলা। একটি শিশুর। খাচ্ছে বোধ হয়। খেয়ে খেয়েই ভারতবর্ষ গেল। সময় নেই, অসময় নেই; কেবল গেলা। গব-গব।

কিছুক্ষণ পর সেনসাহেব আবার বন্ধ করলেন দরজা। ফিরে এসে। জোরে শব্দ করে। ভাবখানা এমন, যেন হনসোকে বলতে চাইছেন; পরে পস্তিয়ো না। বন্ধ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে হনসোকে ডাকলেন। অন্যদের চেহারা দেখাতে চান না।

হনসো দরজার কাছে এলে, সবাইকে শুনিয়ে জোরে বললেন, দরওয়াজা বনধ কর দেতা।

বলেই, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে হনসোকে বললেন, উধারসে আও।

হনসোর কাছে থেকে কোনোই উত্তর পাওয়া গেল না।

সেনসাহেব ভাবলেন, ইডিয়ট। এসব কথার কি উত্তর হয়? অন্যরা শুনতে পাবে না! ঠিকই আসবে।

ঘরে গিয়ে, মশারির মধ্যে ঢুকে ভূতের মতো বসে রইলেন কান খাড়া করে। পঁচিশ বছর আগে কৃষ্ণনগরের নেদেরপাড়ার এক বিয়েবাড়িতে মশা ভন ভন বাসরঘরে মশারির মধ্যে যেমন করে নববধূর অপেক্ষাতে ছিলেন; তেমন করে। এই দ্বিতীয়বার। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, আধঘণ্টা, একঘণ্টা। ওদের খেজুরে আলাপ শেষই হয় না। কারখানার পেটাঘড়িতে এগারোটা বাজল। এবার লোকজন চলে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। আপদেরা বিদেয় হল। ওদের ভাষায় কী যেন বলে, হনসো উঠোনের দরজা বন্ধ করল ভেতর থেকে।

এখন ওপরে তারা-ভরা আকাশ, বৃষ্টিভেজা। হাসনুহানা, মাধবীলতা আর জুঁইলতা ঘেরা মার্বেলের সাদা উঠোন আর হনসো। আর সেনসাহেব। আঃ!

সেনসাহেব তাড়াতাড়ি এসে দরজা খুললেন ভেতর থেকে।

উঠোনে কেউই নেই। থামে-জড়ানো লতাগুলো দুলছে উথাল-পাথাল হাওয়ায়। তাদের ছায়া নড়ছে। উঠোনের লাগোয়া একটা বটগাছ। দামাল ঠাণ্ডা ভেজা হাওয়াটা তাদের পাতাদের হাতে হাতে ধরে হাততালি বাজাতে বাধ্য করছে। কীসের এই হাততালি? অভিনন্দন, না কৌতুক? নির্জন বাদলা রাতে, উদলা আকাশের নীচে সেই হাততালিকে কেমন ভূতুড়ে বলে মনে হচ্ছিল।

হনসো! সে কোথায়?

সেনসাহেব দেখলেন, ফ্রস্টেড কাচে ঘেরা একটি ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে। মধ্যে একটি নারীমূর্তি। স্পষ্ট তো আর দেখা যায় না। ফিগার দেখে বুঝলেন যে, হনসো। শাড়ি ছাড়ছে। সারাদিন পর কাজের শাড়ি, বার বার বৃষ্টিতে-ভেজা শাড়ি ছেড়ে, এবার বোধ হয় আদর-খাওয়ার শাড়ি পরে আসবে। খোলবার জন্যেই তো পরা। হে:! হে:!

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন ওখানে সেনসাহেব। ফ্রস্টেড কাচের মধ্যে দিয়ে হনসোকে দেখতে দেখতে শিহরন বোধ করছিলেন তিনি। সারাশরীরে। প্রায় অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যে এখনও এমন ফার্স্টক্লাস রয়েছে একথা ভেবে নিজেই চমৎকৃত বোধ করলেন। ফিরে এলেন। এসে দরজাটা ভেজিয়ে রাখলেন। বন্ধ করলেন না। শোবার ঘরের বাইরের দিকের দরজাও ওইরকম করে ভেজিয়ে রাখলেন।

চোরের বা ভূতের ভয় নেই সেনসাহেবের। ভাবলেন, আহা হনসোরও তো প্রস্তুতিতে সময় লাগবে একটু। এত খাটা-খাটনি গেছে সারাদিন। আফটার অল, সেক্স ইজ নাইন্টি পার্সেন্ট সাইকোলজিকাল, টেন পার্সেন্ট ফিজিক্যাল!

মশারির মধ্যে একটি রাজহাঁসের মতো হিসহিস করতে লাগলেন সেনসাহেব নিখাদ কামে। এই কামে কোনো ভেজাল নেই। একটুও প্রেম নেই। দয়া নেই; করুণা নেই, ক্ষোভ নেই, লোভ নেই, ঘৃণা নেই, রাগ নেই; অনুশোচনা নেই। এ একেবারে শতকরা এক-শো ভাগ কাম। একপার্সেন্ট ভয় হয়তো আছে। সেটা নেসেসারি ইভিল। পরকীয়া প্রেমে থাকেই।

হাঁস হিসহিস করতে লাগল অথচ অন্য হনসো বা হাঁসির দেখা নেই।

রাত গভীর হতে লাগল। পেটাঘড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেজে যেতে লাগল।

ঘন অন্ধকার রাতে অন্ধকারতর কালো চকচকে পেশির মুণ্ডা যুবকেরা সেনসাহেবকে মাটিতে ফেলে তাঁর শরীরের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁকে ঘেন্নার তির মারতে লাগল। অন্ধকার ভিজে হাওয়াটা দমকে দমকে উড়ে এসে তাঁর ঘাড়ে গলায় থাপ্পড় মারতে লাগল। মশারির মধ্যে বারংবার পাশ ফেরার কারণে লাল মখমলের কোলবালিশ নিপীড়িত হল, চাঁপাফুলের সোনা গলে গেল বিছানার সাদা চাদরে। বড়ো কষ্ট। বড়ো দ্বিধা। গিয়ে কি হনসোর দরজায় ধাক্কা দেবেন? যদি চেঁচায়? মি. বি এন সেন। ছি:। ছি:। যদি জানাজানি হয়ে যায়?

ইশশ।

রাত চলে যায় রাতের মনে।

কারও কাম চরিতার্থ হয়। কারো হয় না। কারো পরীক্ষায় প্রশ্ন কমোন আসে, কারো আসে না। রাত বড়ো টেঁটিয়া; নির্দয়। তার মন বোঝা দায়। প্রোষিতভর্তিৃকাকে কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখেও রাতের করুণা হয় না। সেনসাহেবকে লাল কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখেও হল না।

রাত চলে যায়, রাতের মনে।

সে রাতও গেল। হাড়ে কালি মাখিয়ে দিয়ে গেল সেনসাহেবের।

কে যেন ডাকছিল সেনসাহেবকে।

সেনসাহেবের মৃত মা কি? না, রিনা? সেনসাহেবের স্ত্রী? না কি টিনা? সেনসাহেবের মেয়ে?

কে যেন ডাকছে দূর থেকে। মাথার মধ্যে কাঁপন তুলছে সেই ডাক।

সাহাব! চায়ে লায়া, সাহাব!

সেনসাহেব ধড়মড় করে উঠে বসলেন।

পায়জামার দড়িটা খোলা ছিল। রাতের অন্ধকারে এই দড়িই খোলার জন্যে অধীর উৎকট আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। আলোয়-ভরা সকালে সেই দড়ি বাঁধার জন্যেই ছটফট করতে লাগলেন। মশারি থেকে বেরিয়ে দেখলেন, হনসো দাঁড়িয়ে আছে চা নিয়ে। মুখে, সেই নিষ্পাপ সরল হাসি। চোখে, কোনো পাপ নেই, আবিলতা নেই। শুধু বনহরিণীর মতো সরল বিশ্বাস আছে।

মনে পড়ল, কাল রাতে দরজাটা ভেজিয়ে রেখেছিলেন। বন্ধ করেননি।

চা-টা হাতে নিয়ে বসবার ঘরে এসে বসলেন সেনসাহেব।

চা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল। সেনসাহেব বসেই রইলেন।

বড়ো লজ্জা হল! কিন্তু পরমুহূর্তেই ঝকঝকে রোদে ঝলমলে টগর গাছটার দিকে চেয়ে এক দারুণ ভালোলাগায় ভরে উঠল তাঁর মন। কী লজ্জা। কী বিপদ। কী অপমানের হাত থেকে বেঁচে গেছেন তিনি গতরাতে। একথা ভেবে মা বগলামুখীকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন। বর্ষার রাত বড়ো খারাপ। অন্ধকার খারাপ। মানুষের ভেতরের অন্ধকার দিকগুলোবড়ো প্রশ্রয় পায় সেই সময়ে। কাল যা ঘটলে খুবই খুশি হতেন বলে ভেবেছিলেন, তা সত্যিই ঘটলে আজ কি হনসোর চোখে তিনি তাকাতে পারতেন? না, হনসোই পারত তাঁর চোখে চাইতে?

জীবনে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধ হয় কিছু কিছু চাওয়া থাকে, যা পাওয়ায় পর্যবসিত না হলেই এক গভীর আনন্দ বেঁচে থাকে বুকে। যে আনন্দ, মানুষ হওয়ার আনন্দ। অমানুষ হয়ে যেতে যেতেও মানুষ হয়ে থেকে যাওয়ার আনন্দ।

সেনসাহেব, গলা ছেড়ে, নি:সংকোচে ডাকলেন, হনসো।

হনসো উত্তর দিল মিষ্টি করে, হানজী!

ঔর এককাপ চায়ে লাও। বেগর চিনি। জাদা দুধ।

লা রহা হ্যায় সাহাব!

উঠোনে এসে দাঁড়ালেন সেনসাহেব। বটগাছের পাতায় পাতায় রোদ ঝিলমিল করছে। কী পরিষ্কার আকাশ! কী নিটোল সবুজ পরিবেশ! তাঁর মনের মধ্যেও এক সুস্থ পরিচ্ছন্নতা গভীরভাবে অনুভব করতে লাগলেন তিনি। তিনি যে শিক্ষিত, ভদ্রলোক, এই জানাটা জেনে খুশি হলেন নতুন করে।

বটগাছের পাতাদের দিকে চেয়ে নিরুচ্চারে বললেন, খারাপ-ভালোর কোনো সুচিন্তিত সীমারেখা বোধ হয় নেই। প্রত্যেক মানুষেরই প্রান্তসীমাতেই বসবাস। কেউ না জেনে গন্ডি পেরোয়। কেউ ইচ্ছে করে পেরোতে চেয়েও অপারগ হয়।

ঘটনা, এটাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *