সীমান্ত
দাওয়ায় বসে চিন্তিত মুখে হুকো টানছিল ফজলে রব্বি। না, আর দেরি করা উচিত নয়। এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা বিয়েশাদির ব্যবস্থা করে ফেলতে হচ্ছে মেয়েটার।
এদিক থেকে তাদের নিয়মকানুন বরং অনেকটা ভালো। নিতান্ত চাষাভুসোর ঘরেও ন বছর হতে-না-হতে পর্দা হয়ে যায় মেয়েদের, অনেকখানি আড়াল থাকে শকুনগুলোর চোখ থেকে। কিন্তু হিন্দুর ঘরের বেটি, নটখট করে সব জায়গায় বেরুনো চাই। গাঁয়ের যে বখা বাঁদরগুলো আগে তটস্থ হয়ে থাকত ভয়ে, ইদানীং যেন সাপের পাঁচখানা করে পা দেখেছে। তারা। কিছুদিন থেকেই এ রাস্তায় তাদের আসা-যাওয়া অকারণে বেড়ে উঠেছে। কবে রাতারাতি কী হয়ে বসবে ঠিক নেই। তার চাইতে…
ছেলে তাহের একখানা গোরুর গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছিল। ফজলে রব্বি তাকে ডাকল।
হ্যাঁ রে, কোন দিকে চললি?
সাপাহার হাটে যাব বা-জান। ধান আনতে হবে আজ।
ভালোই হল। যাওয়ার সময় কান্তরামকে ডেকে দিবি এক বার।
কান্তরাম? তাহের এক বার চোখ মিটমিট করল, সে তো শুনছি হিন্দুস্থানে পালাবার ফিকির খুঁজছে। তাকে কেন?
ফজলে রব্বি চটে উঠল, সব কথার জবাবদিহি করতে হবে নাকি তোকে? যা বললাম তাই করবি।
আচ্ছা। মুখ গোঁজ করে তাহের গাড়িতে গিয়ে উঠল। চাপা ক্রোধে একটা নির্দোষ গোরুর ওপরেই সবেগে চালিয়ে দিলে শাঁটাটা। একরাশ ধুলো উড়িয়ে মেহেদি-বেড়ার আড়ালে গাড়িটা অদৃশ্য হল।
বিরক্ত হয়ে হুঁকো নামাল ফজলে রব্বি। সত্যি সত্যিই মেয়েটা তার গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। নিজে বুড়ো হয়ে পড়েছে, তার ওপরে একটা পা তার খোঁড়া। এমনিতেই অশক্ত মানুষ, সবসময়ে আগলে আগলে রাখা সম্ভব নয় তার পক্ষে। তা ছাড়া পট করে একদিন যদি মরে যায়, তাহলে যে মেয়েটা অথই জলে পড়বে এ সে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে। হাঙর কুমির চারদিকে মুখিয়ে তো আছেই, তার নিজের ছেলে তাহেরের মতিগতিও খুব সুবিধে বলে মনে হচ্ছে না। তাই বেঁচে থাকতে থাকতে কোনো বেইমানি ঘটবার আগেই মেয়েটার একটা সুরাহা সে করে দিয়ে যাবে।
বন্ধু!
কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সুতোয় টান পড়ল একটা; আর সেই টানে পুতুলবাজির মতো কতগুলো পেছনের দিন সামনে এসে দাঁড়াল। পাশাপাশি বাড়িতে থাকত, পাশাপাশি জমিতে চাষ করত দুজন, তার হাত থেকে হুঁকো নিয়ে তাতে একটা নল বসিয়ে টান লাগাত দয়াল মন্ডল। বন্ধু বই কী! অমন বন্ধু কারও হয় না, কারও কোনোদিন হয়নি।
তারপর ঝড়ের রাত এল! সে-ঝড় আকাশ ভেঙে ঝরে পড়ল না, মাটি খুঁড়ে উঠে এল। সমস্ত রাত ধরে লালমাটির মাঠজুড়ে ডুম ডুম করে মেঘের ডাকের মতো বাজতে লাগল। সাঁওতালের নাগারা-টিকারা। বাঘের জিভের মতো সড়কি-বল্লম-টাঙ্গির ফলা।
আগস্ট আন্দোলন। নামটা ভোলবার কথা নয়, কলিজার ভেতর গাঁথা হয়ে আছে আগুনের হরফে। সেদিনের লড়াইয়ের ডাকে দয়াল মন্ডল ঝাঁপ দিয়ে পড়ল, ফজলে রব্বিও পেছনে পড়ে থাকল না। প্রথম দুটো দিন কাটল অবিচ্ছিন্ন জয়ের গৌরবে। শহর দখল হয়ে গেল। থানার বাবুরা, মহকুমা হাকিম, কে যে কোন দিকে পালিয়ে বাঁচল তার হদিশ পর্যন্ত পাওয়া গেল না। মনে হল ইংরেজ সরকার ফৌত হয়ে গেছে, কায়েম হয়েছে গরিবের মালিকানা, দেশের মানুষ তার দেশের মাটি ফিরে পেয়েছে।
কিন্তু তিন দিনের দিন এল ফৌজ। একটা টিলার দু-ধারে জমায়েত হল দু-দল। এপার থেকে যখন সড়কি-বল্লম নিয়ে হাজার মানুষ ঝাঁপ দিয়ে পড়ল, ওপার থেকে তখন তার জবাব দিলে কয়েকশো বন্দুক। সে-বন্দুকের সামনে টাঙ্গি-বল্লম শুকনো পাতার মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়ল, সেইসঙ্গে বুক চেপে পড়ে গেল দয়াল মন্ডল।
হাঁটুতে গুলি খেয়ে তার পাশেই বসে পড়েছিল ফজলে রব্বি। মরবার আগে দয়াল মন্ডল তার হাত ধরল।
আমার বেটিটাকে দেখো দোস্ত। ওর আর কেউ নেই। ওর ভার তোমার হাতেই দিয়ে গেলাম।
সেই থেকেই ফুলমণির দায় ফজলে রব্বির ওপরে এসে পড়েছে। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেল কাঞ্চন নদীর ওপর দিয়ে। যে-আজাদির জন্যে অতগুলো মানুষ অমন করে প্রাণ দিলে, যার জন্যে অতগুলো মানুষকে অমন করে চাবুক মারা হল, জ্বালিয়ে দেওয়া হল গ্রামের পর গ্রাম, কেরোসিন তেল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল ধানের গোলা, সেই আজাদি একদিন না-চাইতেই দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। বাও নেই, বাতাস নেই, অথচ ভাদ্র মাসের পাকা তাল যেমন টুপ করে পড়ে যায়, তেমনি করে আজাদি এসে পৌঁছাল।
ভারি তাজ্জব লেগেছিল গোড়াতে। পাকিস্তানের কথা শোনা আছে অনেক বার, ইউনিয়ন বোর্ডের ব্যাপারে ভোটও দিয়েছে লিগের লোককে, কিন্তু পাকিস্তান যে এমন বিনা নোটিশে মুঠোর মধ্যে চলে আসবে, কে ভেবেছিল সেকথা।
এসেছে ভালোই হয়েছে। মুসলমানের মাটি, মুসলমানের তমদুন! কোথাও কোথাও এ নিয়ে খুব দাঙ্গাফ্যাসাদও হয়েছে হিন্দু-মুসলমানে, সেকথাও অজানা নেই ফজলে রব্বির। কিন্তু ওসব দাঙ্গার আঁচ কখনো এসব তল্লাটে লাগেনি। কখনো-সখনো মৌলবিরা গরম গরম বক্তৃতা শুনিয়ে গেছে বটে, কিন্তু লোকে ঝিমুতে ঝিমুতে সেসব কথা শুনেছে, কখনো কান পাতেনি। কিন্তু সত্যি সত্যিই পাকিস্তান হয়ে গেল। নদীর ওপার থেকে ঝাঁকবেঁধে আসতে লাগল মুসলমান, এপার থেকে দলবেঁধে পালাতে লাগল হিন্দু। বোঝা গেল রাতারাতি পালটে গেছে দুনিয়ার হালচাল। কিন্তু মনে মনে কিছুতেই একটা জিনিসের ফয়সালা করতে পারল না ফজলে রব্বি। আজাদির জন্যে যে-মাটিতে দয়াল মন্ডল তার বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে দিলে—সেই মাটিই তার রইল না, সে হল ভিন দেশের বাসিন্দা।
চিরকালের চেনা মানুষগুলো যখন এক-এক করে পর হয়ে গেল, বুকের ভেতরে তখন মোচড় দিয়ে উঠেছিল বই কী। তবু মনে হয়েছিল একদিক দিয়ে এ ভালোই হয়েছে। কাগজের পাতায় আর লোকের মুখে উড়ো উড়ো ভাবে যখন কলকাতার খবর আসত, খবর আসত কাফেররা কীভাবে সাবাড় করে দিচ্ছে মুসলমানের ধন-প্রাণ-ইজ্জত, তখন খাঁটি মুসলমান ফজলে রব্বিও কি রক্তের মধ্যে একটা চঞ্চলতা অনুভব করত না? আগুন-ঝরানো ভাষায় মসজেদে মোক্তবে মৌলবিসাহেবরা যখন ওয়াজ করে যেতেন, তখন সে-আগুনের তাপ কি তাকেও এসে স্পর্শ করত না? তার চাইতে এই-ই ভালো হয়েছে। ওরা থাক হিন্দুস্থান নিয়ে, পাকিস্তান নিয়ে খুশি থাক মুসলমান। কারও গায়ে কেউ এসে পড়বে না, যার যত ইচ্ছে বাজনা বাজাক আর যত খুশি কোরবানি করুক। কোনো ঝামেলা নেই।
তবু ঝামেলা বেঁধেছে ফুলমণিকে নিয়ে।
দয়াল মারা যাওয়ার পরে তার জমিজিরেত ফজলে রব্বিই তদারক করত। মেয়েটাকে দেখবার জন্যে ভিন-গাঁ থেকে এসেছিল তার এক বিধবা মাসি। মোটের ওপর নিশ্চিন্তেই কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু আট বছরের ফুলমণি যখন সতেরো বছরে পড়ল, তখন একদিন ওলাবিবির নেকনজরে পড়ে চোখ বুজল মাসি। আর সেই থেকে মুখের প্রতিটি গ্রাস তেতো হয়ে উঠল ফজলে রব্বির। একা ঘরে থাকে মেয়েটা, একা ঘাটে জল ভরে। তারই সুযোগ নিয়ে শুরু হয়েছে ভূতের উৎপাত। দিনদুপুরে বাড়ির সামনে কে গান গেয়ে ওঠে, পুকুরপাড়ের ভাঁট ঝোঁপের আড়াল থেকে চড়া গলায় শিস টানে রাতবিরেতে, টর্চের আলো পিছলে পড়ে উঠোনে দাওয়ায়।
এই তো কাল সকালে ফুলমণি এসে বললে, চাচা, আর তো ঘাটে যেতে ভরসা পাই না।
কেন, কী হয়েছে? নড়েচড়ে বসল ফজলে রব্বি।
পানু মোল্লার বড়োছেলে জিকরিয়া আজ দু-দিন থেকে ছিপ নিয়ে ঘাটে বসছে। আর যা তা বলছে আমাকে।
জিকরিয়া! অসহ্য ক্রোধে ফজলে রব্বির সারা গা জ্বলে উঠল। এক নম্বরের বদমায়েশ, একটা মেয়েচুরির হাঙ্গামায় কিছুদিন আগেও দু-বছর হাজত খেটে এসেছে। এতদিন চোরের মতো লুকিয়ে বেড়াত, হালে আবার বড় বাড় বেড়েছে ওর। নাঃ, এক বার দেখতে হচ্ছে।
খোঁড়া পা-খানাকে টেনে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল ফজলে রব্বি, আয় আমার সঙ্গে। ঘাটে তখনও ছিপ ফেলে বসে ছিল জিকরিয়া ওরফে জ্যাকেরিয়া। ওদের আসতে দেখে ভ্রূক্ষেপমাত্র করল না, তাকিয়ে রইল ফাতনার দিকে।
বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল ফজলে রব্বি। ভেবেছিল তাকে দেখে উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে পথ পাবে না জিকরিয়া। কিন্তু আশ্চর্য দুঃসাহস, অবিশ্বাস্য স্পর্ধা ছোকরাটার!
নিজেকে সামলে নিয়ে ফজলে রব্বি বললে, জিকরিয়া!
মাথা না তুলে জিকরিয়া সাড়া দিলে, কী বলছ?
ছিপ নিয়ে বসেছিস কেন মন্ডলের পুকুরে?
মাছ ধরব। শান্ত নিস্পৃহ স্বর জিকরিয়ার।
কিন্তু পরের পুকুরে মাছ ধরতে কে হুকুম দিয়েছে তোকে?
পাকিস্তানে হিন্দুর কোনো সম্পত্তি নেই, সব মুসলমানের।
ফজলে রব্বি এইবার ফেটে পড়ল।
চুপ কর হারামজাদা বদমায়েশ! তোদের মতো শয়তানের জন্যেই পাকিস্তানের এত বদনাম। উঠে যা বলছি এক্ষুনি, উঠে যা।
আকস্মিক বিস্ফোরণে বিভ্রান্ত হয়ে ছিপ গুটিয়ে উঠে দাঁড়াল জিকরিয়া। কিন্তু তার দু-চোখে আগুন ঝিলমিল করতে লাগল।
অত চোখ দেখিয়ে না মিয়া, এ তোমায় বলে দিচ্ছি।
কী করবি, কী করবি তুই? হতভাগা শয়তান! খোঁড়া পা নিয়েই হিংস্র ক্রোধে জিকরিয়ার দিকে এগোতে লাগল ফজলে রব্বি, ফের এদিকে এগোবি তো মাথা গুঁড়িয়ে দেব।
জিকরিয়া পিছু হটতে লাগল। তার সমস্ত মুখ যেমন কুটিল তেমনি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। কাফেরের পক্ষ নিয়ে তুমিও বড়ো বেশি মাথা ঘামাচ্ছ মিয়া। কিন্তু অত বাড়াবাড়ি ভালো নয়। আমার মাথা গুঁড়োবার ভয় দেখাচ্ছ, কিন্তু অমন করে চোখ রাঙালে তোমার ভালো হবে না।
এরপরে একমাত্র হাতের লাঠিটা তুলেই ছুড়ে মারতে পারত ফজলে রব্বি। করতে যাচ্ছিলও তাই, কিন্তু তার আগেই বুদ্ধিমানের মতো উধাও হয়েছে জিকরিয়া। অদৃশ্য হয়েছে। যথাসম্ভব দ্রুতবেগে।
হারামজাদা! নিরুপায় ক্রোধে ফজলে রাব্বি দাঁত কিড়মিড় করল এক বার, বিষাক্ত চোখে তাকাল ফুলমণির দিকে, কাল থেকে ঘাটে আসবার সময় আমায় ডাকবি তুই।
কিন্তু এমন করে কতদিন আগলে রাখা যাবে? শয়তানের মওকা পড়েছে চারদিকে। মানুষের আরজ আর খোদার দরবারে গিয়ে পৌঁছোয় না। সাচ্চা লোকের জান-মান কিছুই আর থাকবে না বলে সন্দেহ হয়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে পাপ, মজ্জায় মজ্জায় বাস্তু বেঁধেছে বেইমানি। খোঁড়া পা দিয়ে বুড়ো ফজলে রব্বি কতদিন লড়তে পারবে? লড়তে পারবে ক জনের সঙ্গে?
নইলে তাহের—তার নিজের ছেলে তাহের! সেই কিনা বলতে পারল কথাটা।
ফুলমণির শাদি নিয়ে এত ভাবনা কেন আব্বাজান? দিয়ে দাও-না আমাদের মকবুলের সঙ্গে। কথাটা শুনতে পায়নি, এমনই বিহ্বল ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল ফজলে রাব্বি। তাহের আবার শুরু করল, কালই কলমা পড়িয়ে, উকিল ডেকে…।
কথাটা শেষ হতে পারল না। তার আগেই ফজলে রব্বির ডান পায়ের চটিটা বাজের মতো গিয়ে উড়ে পড়ল তাহেরের গালে। একটা টাল খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলে তাহের।
কমবখত, উল্লুক! ফের যদি এসব তোর মুখে শুনতে পাই তাহলে পঁচিশ পয়জার লাগিয়ে বাড়ি থেকে দূর করে দেব।
তাহের চলে গেল। কিন্তু যে-দৃষ্টিতে তাকিয়ে গেল, সে-দৃষ্টি জিকরিয়ার চোখের। ঠিক কথা, তামাম দুনিয়াজুড়ে শয়তানের দেওয়ানি কায়েম হয়েছে। কেউ বাদ নেই, কোথাও বাদ নেই। বাইরের খ্যাপা কুত্তাগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়া চলে, কিন্তু ঘরের দাওয়াতে যখন গোমা সাপে গর্ত করে বসে আছে, তখন যত তাড়াতাড়ি দায় চুকিয়ে দেওয়া যায় ততই ভালো।
হ্যাঁ, কান্তরাম। ভালোই হবে। দয়ালেরই স্বজাতি। দেখতে-শুনতেও মন্দ নয় ছোকরা, সুখীই হবে ফুলমণি। হিন্দুস্থানে পালাতে চাইছে কান্তরাম—তা পালাক। একেবারে চোখের আড়াল হয়ে যাবে মেয়েটা, একথা ভাবতে গেলেও মোচড় দিয়ে ওঠে বুকের ভেতরে। কিন্তু নিজের চেনা, নিজের জানা মানুষগুলোর মধ্যে গিয়েই নিশ্চিন্ত হোক মেয়েটা, দু-দন্ড স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচুক। ফুলমণি তার নিজের মেয়ে হলেও এর চাইতে বেশি কী আর দোয়া সে চাইতে পারত আল্লা রহমানের কাছে?
না, কান্তরামের সঙ্গেই বিয়ের ব্যবস্থাটা করে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে আজকালের মধ্যেই। নইলে চট করে কোন দিন হিন্দুস্থানে সরে পড়বে তার ঠিকঠিকানা নেই কিছু।
নেবা কোটায় একটা টান দিয়ে নামিয়ে রাখল ফজলে রাব্বি। পোড়া টিকে আর তামাকের ছাই ঝাড়তে লাগল দাওয়ার নীচে।
ডেকেছেন বুড়ো মিয়া?
কান্তরাম ভয়ার্ত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়িয়েছে দাওয়ার নীচে। একটু এদিক-ওদিক দেখলেই হাত কচলাতে শুরু করবে যেন। দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পর সব হিন্দুর চোখেই ওইরকম একটা উদভ্রান্ত বিহ্বলতা লক্ষ করেছে ফজলে রব্বি। যেন কোথা থেকে কেউ মস্ত একটা ডাণ্ডার ঘা দিয়ে খুঁড়িয়ে দিয়েছে ওদের শিরদাঁড়াগুলো, ওদের কলিজার রক্তটুকু শুষে খেয়ে নিয়েছে কেউ। দিনেদুপুরে আচমকা বেরিয়ে-পড়া শেয়াল যেমন পালাবার জন্য ঝোপঝাড় সন্ধান করে বেড়ায়, ওরাও ঠিক সেইরকম সবসময় একটা লুকোবার জায়গা খুঁজে ফিরছে।
বিশ্রী লাগে, কেমন সহজভাবে কথা বলতে পারা যায় না ওদের সঙ্গে। মিষ্টি করে বললে সন্দেহ করে, চোখ রাঙালে আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সত্যিই ওদের ঘৃণা করা যেন আর অন্যায় নয় এখন।
ফজলে রব্বি জাকুটি করল।
দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো।
জড়োসড়ো ভঙ্গিতে একটা চৌপাই টেনে নিলে কান্তরাম।
চলে যাচ্ছ বুঝি ঘরবাড়ি ছেড়ে?
কান্তরাম মাথা নীচু করে রইল, জবাব দিলে না।
তা যাও। সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে মরতে যাও যেখানে খুশি! ফজলে রব্বি আর এক বার কুটি করল, কিন্তু এই বুড়োর একটি আর্জি আছে তোমার কাছে।
আর্জি! হকচকিয়ে উঠল কান্তরাম, আর্জি কি বুড়ো মিয়া! হুকুম করুন।
থামো! পাকামি কোরো না। ফজলে রব্বি একটা ধমক দিলে। দয়াল মন্ডলের মেয়ে ফুলমণিকে দেখেছ তো?
দেখেছি। সবিস্ময়ে মাথা নাড়ল কান্তরাম।
কেমন মেয়ে?
তা, তা মন্দ কী! কান্তরাম গোটা দুই ঢোঁক গিলল। প্রশ্নটার কোনো অর্থবোধ করতে না পেরে তাকিয়ে রইল বোকা বোকা শঙ্কিত দৃষ্টিতে।
ফুলমণিকে তোমার বিয়ে করতে হবে।
কী বললেন? কান্তরাম ভয়ানকভাবে চমকে গেল এবারে।
অমন হাঁ করছ কেন! আমি কি রসগোল্লা গিলতে বলছি নাকি? খাসা মেয়ে ফুলমণি, আমার নিজের বেটির মতোই দেখি ওকে। ঘরে নিলে বর্তে যাবে। তোমাদের যা পাওনা থোওনা সব আমিই দেব, সেজন্যে কিছু আটকাবে না তোমার।
আজ্ঞে তা বটে, তা বটে। কান্তরাম মাথা নাড়তে লাগল, কিন্তু…
কিন্তু আবার কী? হিন্দু, তোমার সজাতি, কিন্তু কোথায় এল এর ভেতরে?
দৃষ্টি তীক্ষ্ণকরে ফজলে রব্বি জানতে চাইলে।
আমি বলছিলাম… কান্তরাম ঢোঁক গিলল, ওদের নীচু ঘর, আমাদের সঙ্গে ঠিক…
চোপরাও! জিকরিয়া আর তাহেরের ওপরে সঞ্চিত ফজলে রব্বির যা কিছু ক্রোধ দ্বিগুণ বেগে ফেটে পড়ল কান্তরামের ওপর। নীচু ঘর! জাতের বড়াই হচ্ছে। ওই করেই মরতে বসেছ তোমরা! খেয়াল থাকে যেন এটা পাকিস্তান। এখন যদি মাটিতে চিত করে ফেলে। খানিক গোস্ত ঠেলে দিই, জাতের গরমাই কোথায় থাকবে তখন?
আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে গেল কান্তরাম। পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল চৌপাইটার ওপরে।
জাত জাত! অসহ্য জ্বালায় দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগল ফজলে রব্বি। আজ যদি গুণ্ডারা এসে মেয়েটাকে লোপাট করে নিয়ে যায়, জাতের মান বাড়বে তোমার? যদি জোর করে মুসলমানদের সঙ্গে ওর বিয়ে দিই, হিদুর মুখ উজ্জল হবে? ডরপোক জানোয়ারের দল। একটা মেয়ের ইজ্জত বাঁচাবার সাহস নেই, জাতের বড়াই। সাধে কি তোমাদের ঠেঙিয়ে দূর করে দিতে চায় পাকিস্তান থেকে!
নিষ্প্রাণ কান্তরাম নড়ে উঠল এবার। থরথর করে কাঁপতে লাগল বাঁশপাতার মতো। তার হাত দুটোকে জড়ো করে আনল কোনোক্রমে। প্রায় নিঃশব্দ আবছা গলায় বললে, মাপ করুন। আপনি যা বললেন, তাই করব।
পুরো একটা বছর হয়ে গেছে তারপর।
আর একটু বুড়ো হয়ে গেছে ফজলে রব্বি, খোঁড়া পা-খানাকে টেনে চলতে আরও বেশি কষ্ট হয় আজকাল। তাহেরের হাতে তুলে দিয়েছে ঘরসংসার খেতখামারের ভার। শূন্য দাওয়ায় বসে বসে ঝিমোনো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আজকাল। এক-এক বার ইচ্ছে করে এই শেষ বয়সে হজটা এক বার ঘুরে আসে, কিন্তু উৎসাহ হয় না, ভরসা জাগে না দুর্বল অশক্ত দেহটার ওপরে।
ঝিমঝিমে স্তব্ধ দুপুরে নেশা-জড়ানো চোখে চুপ করে বসে থাকে দাওয়াটার ওপরে। কানে আসে শালিকের কচকচি, ঝিরঝিরে হাওয়ায় সামনের নিম গাছ থেকে ঝুরজুরিয়ে পাতা ঝড়তে থাকে; আর ওই ঝরা পাতাগুলোর মতোই বোধ হয় জীবনকে—তার দিনগুলো যে কখন অমন করে ঝরে গেছে, ভালো করে যেন মনেও পড়ে না সেসব।
নিম গাছটার পেছনেই দয়ালের ভিটের দাওয়াটা শুধু চোখে পড়ে এখান থেকে। এই এক বছরেই চালের খড় ঝরে ঝরে মাটিতে মিশে গেছে ওর, হলুদের গুঁড়োর মতো রেণু রেণু হয়ে লয় পেয়েছে ঘুণে-খাওয়া বাঁশের খুঁটিগুলো। দরজা-জানালা যা ছিল যে যা পেয়েছে রাতারাতি হাতিয়েছে সব। পোড়া দাওয়ার ওপরে উঠেছে হাঁটুসমান বিছুটি, কচু আর তেলাকুচোর লতা। ওখানে কোনোদিন মানুষ ছিল, ছিল সংসার একথা যেন আজ বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না।
ওদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বেশি করে মনে পড়ে বন্ধুর কথা, মনে পড়ে ফুলমণির কথা। এই দেশের জন্যে লড়াই করে যে নিজের জান কোরবানি করে দিয়েছিল, দেশের মাটিতে তার চিহ্ন মাত্র রইল না। ভারি তাজ্জব লাগে, কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়। আর মেয়েটার জন্যে থেকে থেকে একটা তীক্ষ্ণ উৎকণ্ঠা আর বেদনা তাকে পীড়ন করতে থাকে। যাওয়ার দিনে গোরুর গাড়িতে ওঠার আগে যখন অশ্রুভরা চোখে ফুলমণি তার পায়ে লুটিয়ে প্রণাম করল, সেদিন তাকে বাধা দিতে পারেনি ফজলে রব্বি, একটা কথাও বলতে পারেনি। শুধু চলন্ত গাড়িটার ধুলোর মেঘের দিকে চোখ মেলে দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ।
আজ এক বছরের মধ্যে কোনো খবর পায়নি ফুলমণির। কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে। হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান। মাঝখানে শুধু একটা নদীর খেয়াঘাট পার হয়েই মানুষ কেমন করে এত দূরে সরে যায় কে বলবে।
বুড়ো মিয়া?
কে? একটু দূরের মানুষ আর ভালো করে ঠাহর হয় না আজকাল। ভুরুর ওপর হাতখানা তুলে ধরে ফজলে রব্বি বলল, কে ওখানে?
আমি মকবুল।
কী খবর রে।
ওপারে গিয়াছিলাম। তোমার ফুলমণির সঙ্গে দেখা হল।
ফুলমণি! ফজলে রব্বি চমকে উঠল, কোথায় আছে তারা! ভালো আছে তো সব?
শহরেই বাসা বেঁধেছে, কিন্তু ভালো নেই চাচা। সেই খবরটাই তোমায় দিতে বললে।
ভালো নেই! বুকের ভেতরে ধক করে উঠল ফজলে রব্বির, কী হয়েছে?
কী-একটা হাঙ্গামায় মানুষ খুন করে উধাও হয়েছে কান্তরাম। খাওয়া জুটছে না তোমার ফুলমণির। ওপারে ষাট টাকা চালের মন আজকাল।
ফজলে রব্বি বিমূঢ়ের মতো বসে রইল। খুন করে উধাও হয়েছে কান্তরাম, উপোস করছে। ফুলমণি। দুটোই এত অসম্ভব, এমন অবিশ্বাস্য যে একটা অস্ফুট শব্দ পর্যন্ত বেরুল না ফজলে রব্বির মুখ দিয়ে। সেই ভীরু দুর্বল কান্তরাম মানুষ খুন করেছে আজ। মুমূর্য দোস্তের কাছে কসম খেয়ে যার দায় সে মাথা পেতে নিয়েছিল, আজ না খেয়ে উপোস করছে সেই মেয়ে।
এই দিনদুপুরেও ফজলে রব্বির কানের কাছে ঝিঝি ডাকতে লাগল, আরও ঝাপসা হয়ে এল ঝাপসা চোখের দৃষ্টি। তাহের তাহেরই ঠিক বলেছিল। কলমা পড়িয়ে ওই মকবুলের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়া উচিত ছিল ফুলমণির। হিন্দুস্থানির সঙ্গে মেয়েটাকে অমন করে বলি দেওয়ার চাইতে তাকে সুখী করলেই বন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞার মর্যাদা বজায় থাকত তার। ভালো ছেলে মকবুল, চরিত্রবান, জমিজিরেত সব আছে, শুধু জাতের জন্য মেয়েটাকে নিজের হাতে জবাই করেছে সে—ভালো করতে গিয়ে ঠেলে দিয়েছে সর্বনাশের মুখে উঠে দাঁড়াতে চাইল ফজলে রব্বি, ইচ্ছে করতে লাগল ছুটে গিয়ে গলাটা চেপে ধরে কান্তরামের।
আমি চলি বুড়ো মিয়া। মকবুল বিদায় নিয়ে গেল।
একটা অসহ্য জ্বালায় ফজলে রব্বি জ্বলতে লাগল। উপায় করতে হবে যে করে হোক, বাঁচাতে হবে ফুলমণিকে। দরকার হলে আবার তাকে ফিরিয়ে আনবে পাকিস্তানে। এবার তার নিজের মেয়েকে সে তার জাতের হাতে তুলে দেবে, যাতে তার ভালো হয় তা-ই সে করবে।
সে কলমা পড়িয়েই হোক আর যে উপায়েই হোক।
বিকেল বেলায় তাহরেকে সে ডাকল।
আমন চাল পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।
আমন চাল! কোথায়?
ওপারে, শহরে। ফুলমণিকে দিয়ে আসবি।
শুনে বার কয়েক খাবি খেল তাহের।
তুমি কি খেপে গেলে আব্বাজান?
খেপব কেন? ফজলে রব্বি চটে উঠল, যা বলছি তাই করবি। দিয়ে আসবি চাল।
তাহের করুণার হাসি হাসল, কী পাগলামি করছ? চাল নিতে দেবে কেন ওপারে?
বোকা ভুললাচ্ছিস আমাকে? এত তোক নিয়ে যাচ্ছে—চোরাকারবার করছে চালের, আর তুই পারবি না? নাহয় আট গন্ডা পয়সা গুঁজে দিবি হাতে।
তাহের আবার সহিষ্ণু করুণার হাসি হাসল, দিনরাত তো ঘরেই বসে আছ আব্বাজান, দুনিয়ার হালচালের কোনো খবর রাখ না। আনসার আর ফৌজের ঘাঁটি বসেছে খেয়াঘাটের ধারে। এক দানা ধান-চাল নিতে দেবে না ওপারে।
ফৌজের ঘাঁটি! ফজলে রব্বি ম্লান হয়ে রইল কিছুক্ষণ। বেশ তো, তা হলে রাতের অন্ধকারে…
আস্তে, আস্তে আব্বা! কারুর কানে গেলে ফাটকে যেতে হবে। তাহের সভয়ে বললে, রাতের অন্ধকারে? কিছু বোঝ না তাই বলছ এসব কথা। ও-চেষ্টা করতে গেলে ফৌজের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যাবে। আইন হয়ে গেছে—সাঁঝের পরে খেয়া পেরুনো একদম বারণ।
আইন থাকলে বেআইনও আছে। তর্ক করিসনি আমার সঙ্গে। নিরুপায় ক্রোধে ফজলে রব্বি প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, আমি বলছি তোকে নিয়ে যেতে হবে।
অসম্ভব কথা বোলো না আব্বাজান। আধমন চালের জন্যে আমি জান দিতে পারব না। তাহের আর কথা বাড়াল, সংক্ষেপে নিজের বক্তব্য পেশ করে দিয়ে সরে গেল সামনে থেকে।
ফজলে রব্বির মুখের রেখাগুলো কঠিন হয়ে আসতে লাগল আস্তে আস্তে।
কিন্তু ফজলে রব্বিও পারল না।
পরের দিন রাত প্রায় দুটোর সময় যখন কাঁধে আধমন চালের বোঝা নিয়ে খোঁড়া বুড়ো ফজলে রব্বি খেয়াঘাট থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে আঘাটায় নেমেছে নদী পার হওয়ার জন্যে, তখন তার মুখের ওপর এসে পড়ল কড়া টর্চের আলো। হাঁটুসমান কালো জলের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।
শালা বদমাস!
গর্জন করে উঠল একজন। আর একজনের হাতের লাঠিটা প্রবল বেগে এসে আছড়ে
পড়ল তার মাথায়।
ঝুপ করে জলের মধ্যে খসে পড়ল চালের বস্তাটা, পড়ে গেল ফজলে রব্বিও। নদীর কালো জলের চাইতেও আরও কালো আরও প্রখর অন্ধকার স্রোতের মধ্যে ভেসে গেল তার চেতনা।
শুধু ফজলে রব্বি একটা জিনিস জানতে পারল না। জানতে পারল না লাঠি যে মেরেছে সে মাত্র আট মাস আগে পাকিস্তানে পালিয়ে এসে মুসলমান হয়েছে। আগে তার নাম ছিল কান্তরাম, এখন সে ইয়ার মহম্মদ।