সীতা – সায়ন্তনী পূততুণ্ড

সীতা – সায়ন্তনী পূততুণ্ড

এক

অবশেষে বনোয়ারিলাল শ্রীঘরে গেল!

সংবাদটা শুনে আদৌ বিস্মিত হইনি ৷ বরং এতদিন কেন যে ও জেলে যায়নি, সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার! গত কয়েক বছর ধরেই হাজতবাসের ফাঁড়াটা ওর মাথার ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছিল ৷ কিন্তু কোনোবারই জেলের ভাত খেতে হয়নি ওকে ৷ এই প্রথমবার ব্যতিক্রম ঘটল!

 খবরটা পেলাম সুখিয়ার কাছে ৷ সুখিয়া বনোয়ারিলালের দাদা বংশীলালের বউ ৷ ওরা দুই ভাই-ই কয়লাখনির অস্থায়ী শ্রমিক ৷ বলাই বাহুল্য, সকালে বেরোলে বিকেলে ফিরে আসবে কিনা, সে গ্যারান্টি ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না ৷ তার ওপর একা রামে রক্ষা নেই, দোসর লক্ষ্মণ! ওই বিপজ্জনক কাজের ফাঁকেই দুই ভাই মিলে আবার সুযোগ পেলেই কয়লা চুরি করে ৷ তাতে সংসারে দুটো পয়সা বেশি আসে ঠিকই, কিন্তু কয়লা চুরি করায় প্রাণের ঝুঁকি আছে ৷ যে কোনো সময় মারা পড়তে পারে ৷ উপরন্তু ধরা পড়লে জেলের ভাত খেতেও হতে পারে ৷

.

 বনোয়ারিলালের শ্রীঘরে গমনের স্বপক্ষে কয়লাচুরি ও বে-আইনিভাবে বিক্রি করার কারণই যথেষ্ট ছিল ৷ কিন্তু শুধু এটুকুতেই তার কার্যকলাপ থেমে থাকেনি ৷ জেলে যাওয়ার রাস্তাটা সে আরও বেশি প্রশস্ত করেছিল নিজের বউ রামদুলারিকে নিয়মিত ঠেঙিয়ে! যার শহুরে ও পোশাকি নাম— ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স! কিন্তু রামদুলারি বা সুখিয়ারা জানে না ফোর নাইন্টি এইট কাকে বলে ৷ বরং তাদের ধারণা, মরদ যখন, তখন তো পেটাবেই! খেতে, পরতে দেয়, আর ‘লুগাইকে’ একটু পেটাবে না?

একটি নামকরা এনজি ও-’র পক্ষ থেকে যখন আমি বিহারের এই প্রত্যন্ত প্রদেশে এসে পৌঁছই তখন প্রথমদিকে জায়গাটাকে শান্তিপ্রিয় বলেই মনে হয়েছিল ৷ এখানকার বেশির ভাগ লোকই কয়লাখনিতে দিন-মজুর হিসাবে খাটে ৷ আবার কেউ বা অন্যের জমিতে মাটি কোপানো, লাঙল চালানোর কাজ করে ৷ যখন কাজ থাকে, দিনান্তে পয়সা পায়, তখন বাড়িতে দুবেলা হাঁড়ি চড়ে ৷ অন্যথায় পেটে কিল মেরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই ৷ বিনোদন বলতে বিড়ি, বা গাঁজার ছিলিমে সুখটান ৷ সঙ্গে উৎকট গন্ধওয়ালা দেশি মদ! কখনও কখনও মুরগি লড়াই, কিংবা ছোটখাটো ‘ নৌটঙ্কি’ বা কুস্তির ‘দঙ্গল’ ৷ এর বেশি ফুর্তি করার সামর্থ্য ওদের নেই ৷ ইলেকট্রিসিটি থাকলেও সারি সারি ঝুপড়িগুলোয় তার চোখ ধাঁধানো আলোর অনুপ্রবেশ এখনও হয়নি ৷ বরং সন্ধে হলেই তেলের কুপি জ্বলে ওঠে ৷ আমার আজন্ম শহুরে চোখ সেই শান্ত আলোয় বড় আরাম পায় ৷ মনে হয়, একমুঠো জোনাকির স্নিগ্ধ আলো কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে চতুর্দিকে ৷ ঝুপড়িগুলোয় যেন নেমে এসেছে এক অদ্ভুত ঠান্ডা দীপ্তি! প্রায় রাতেই এনজি-ও’র সবেধন নীলমণি গেস্টহাউসের বারান্দায় বসে তাকিয়ে থাকতাম ওই বিন্দু বিন্দু আলোর দিকে ৷ বড় ভালো লাগত ৷

 কিন্তু সপ্তাহখানেক ঘুরতে না ঘুরতেই বুঝলাম অশিক্ষা আর কুসংস্কারের আড়তের মধ্যে এসে পড়েছি ৷ আমাদের এনজিও এই গ্রামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রাণপণ খাটছিল ৷ কিন্তু আখেরে কোনো লাভ হয়নি ৷ স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, রোগী নেই ৷ থাকবে কী করে? এখানে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারের কাছে যায় না, বরং দৌড়য় জনৈক জংলিবাবার কাছে ৷ ডাক্তারবাবু একদিন আফসোস করে বলছিলেন—‘ কেন যে মরতে এখানে এলেন! কখনও কখনও আমারও সেই জোকটার মতো মনে হয় যে, নরক থেকে এখানে ফোন করলে নির্ঘাৎ লোক্যাল কলই হবে! আমি এখানে ট্রিটমেন্ট করার জন্য বসে আছি, কম্পাউন্ডার আছে, ওষুধ আছে, টেবিল- চেয়ার—সব আছে ৷ কিন্তু পেশেন্ট নেই’ ৷

 ‘কেন? পেশেন্ট থাকবে না কেন?’ অবাক হয়ে বলি— ‘ট্রিটমেন্ট তো ফ্রি-তে দেওয়া হচ্ছে! এমনকী ওষুধও ফ্রি! এক পয়সাও লাগবে না ৷ তাবে?’ ডাক্তারবাবু হাসলেন—‘ওই খানেই মার খা গিয়া ইন্ডিয়া! আমি শুধু ওষুধই দিতে পারি ৷ জংলিবাবার মতো হাত ঘুরিয়ে ‘‘নিম্বু’’ বা শূন্য থেকে ‘‘বিভূতি’’, আই মিন ছাই, তো আমদানি করতে পারি না!’

 তাই তো! কঠিন সমস্যা! ডাক্তারবাবু ওষুধ দিতে পারেন, লেবু বা ছাই আমদানি করবেন কী করে! অতএব স্বাস্থ্যকেন্দ্র ফাঁকাই পড়ে থাকে ৷ কম্পাউন্ডার ও ডাক্তার সম্মিলিতভাবে মশা ও মাছি তাড়ান!

 ডাক্তারবাবু আপনমনেই বিড়বিড় করে বলেন—‘এই তো! কিছুদিন আগেই একটা বাচ্চা মেয়ের জ্বর হয়েছিল! পুরো হলুদ হয়ে গিয়েছিল ৷ ক্লিয়ার কেস অব জন্ডিস! কিন্তু তাকে ডাক্তারখানায় আনা তো দূর, সবাই মিলে জংলিবাবার কাছে নিয়ে গেল! জংলিবাবা পরীক্ষা করে বললেন—‘‘ভূত ধরেছে’’ ৷ তারপর তিনদিন ঝাঁটাপেটা, লোহার ছ্যাঁকা দেওয়ার পর ভূত তো গেলই, মেয়েটার প্রাণও গেল! আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম…শুধু দেখলাম…!’

 ওঁর হাহাকারের সান্ত্বনা আমার কাছে ছিল না! শুধু বুঝলাম, স্বাস্থ্যের এই হাল! আর শিক্ষার কথা বলতে গেলে কান্না পেয়ে যায় ৷ আমি নিজেই এখানে শিক্ষকতা করতে এসেছি ৷ আমাদের এনজিও আপাতত একটা মেটে বাড়িতে শ্রমিক-সন্তানদের জন্য অস্থায়ী স্কুল গড়ে তুলেছে ৷ সেখানে পড়ানোর জন্য একজন হেডস্যার ও আমাকে নিয়ে সর্বসাকুল্যে দুজন শিক্ষক উপস্থিত ৷ অফিস থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এই মেটে বাড়িটা পাকা হবে কি না তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে ছাত্রসংখ্যার ওপরে! টার্গেট টাইম—দু বছর ৷ কিন্তু আমি এখনই হলফ করে বলতে পারি—জীবনেও হবে না! দশমাস আগে ছাত্রসংখ্যা ছিল শূন্য! এখনও তাই! তাও ভালো, জনগণনা মাইনাসে রান করে না! তাই বৎসরান্তে রিপোর্ট করার সময় ‘উন্নতি হয়নি’ বলতে পারব ৷ কিন্তু ‘অবনতি হয়েছে’ তা আমার অতিবড় শত্তুরও প্রমাণ করতে পারবে না!

 ‘আগের জন তিনমাসেই পালিয়েছিল’ ৷ হেডস্যার আবার লখনৌ-র মানুষ ৷ প্রথম সাক্ষাতেই চোস্ত হিন্দিতে বললেন—‘আপনি কবে পালাচ্ছেন, জনাব?’

 প্রথম সম্ভাষণেই হকচকিয়ে গেলাম ৷ আমার বিস্ময় দেখে ভদ্রলোক হেসে ফেলেন—‘আপনি ‘‘কলকত্তার’’ লোক ৷ এখানকার হালচাল দেখলে দুদিনেই ‘‘পালাই পালাই’’ করবেন ৷ এদের পড়ানোর সাধ্যি স্বয়ং দেবী সরস্বতীরও নেই, তো আমরা কোথাকার খাঞ্জা খাঁ?’

 স্কুলের হেডস্যার যদি প্রথমেই এমন একখানা আছোলা বাঁশ দিয়ে দেন, তবে শিক্ষক বেচারি যায় কোথায়? তবু ভাবলাম, এত সহজে ছাড়ব না ৷

 ‘প্রথম প্রথম অনেক চেষ্টা করেছি’ ৷ হেডস্যার নির্লিপ্ত মুখে জানালেন—‘কিন্তু বাচ্চাগুলো পড়বে কী! ওরাও তো বাপ-মায়ের সঙ্গে কাজে বেরোয় ৷ কেউ কয়লাখনিতে যায় ৷ কেউ জমিতে খাটার কাজ করে’ ৷

 ‘কিন্তু শিশুশ্রম তো বে-আইনি!’

 ‘আইন!’ এবার সজোরে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক—‘এখানে আইন কোথায়? ‘‘পুলিশ-ঠানে’’ একটা আছে ঠিকই, কিন্তু আইন নেই!’

 বুঝলাম, ‘পুলিশ-ঠানে’ আসলে শালগ্রাম শিলারই নামান্তর! তবু হাল ছাড়িনি ৷ এই এনজিও-তে এটাই প্রথম আমার ‘বিগ ভেঞ্চার’ ৷ এতদিন বয়েস নিতান্তই কম বলে ছোটখাটো কাজই করতে হচ্ছিল ৷ নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ এই প্রথম ৷ মনে মনে ভাবলাম, এত সহজে ছাড়ব! চ্যালেঞ্জ নিয়েই দেখি না কী হয়! আমিও নজরুল, নেতাজি, ক্ষুদিরামের দেশের লোক ৷ ‘আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হব শান্ত…!’

 অনেক উত্তপ্ত কবিতা মনে মনে আবৃত্তি করে অবশেষে মাঠে নেমেই পড়লাম ৷ মনে মনে বিদ্রোহী কবিতা আওড়ালেও বাহ্যিক ভাবটা একদম বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো! যেন দোরে দোরে গিয়ে ঝুলি পেতে বলছি—‘ভিক্ষাং দেহি’! কুড়িয়ে বাড়িয়ে যদি একটি ছাত্র বা ছাত্রী মিলে যায় তবেই একেবারে আগ্রা ফোর্ট জয় করে ফেলব! কিন্তু ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’ ৷ প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতেই চা, গুড়, মুড়ি পেলাম, সসম্মানে ‘মাস্টারজি’ অভিধাও জুটল, হাত পাখার মিঠে বাতাসও পেলাম—কিন্তু ছাত্রছাত্রী পাওয়া গেল না! ঘরে ঘরে শুধু বাটিটা পাততে বাকি রেখেছি ৷ কিন্তু ভবি ভোলবার নয় ৷ ঘরের শিশুদের ধানখেতে, কয়লা খনিতে, কিংবা কোনো লালার চাল-কলে, তেল-কলে খাটতে দিতে রাজি ওরা ৷ কিন্তু স্কুলে পড়তে পাঠালেই ‘সত্যনাশ’ ৷ বেশ কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টাও করলাম ৷ সবার মুখেই এক কথা—‘আমার একার রোজগারে ‘‘গেরস্থী’’ চলে কী করে মাস্টারজি? একেই কাজের ঠিক নেই ৷ আজ আছে, কাল নেই ৷ বাঁচতে হলে তো সবাইকেই ‘‘মেহনত’’ করতে হবে ৷ আর আমাদের মতো মজুরদের ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে কোন ‘‘জজ-কালেক্টর’’ হবে! ওসব আপনাদের মতো বড় লোকদের ব্যাপার! মজদুরি খাটলে পয়সা আসবে, ‘‘সকুল’’ এ পড়ে কি দু বেলার ‘‘দাল-রোটি’’ জোগাড় করতে পারবে বাচ্চা?’

 এই ‘ঘর-ঘর’ ক্যাম্পেনিং-এর সময়ই দেখা হল বনোয়ারিলালের সঙ্গে! ওর দাদা বংশীলাল এবং বনোয়ারির বাড়িতেও গিয়েছিলাম ছাত্র-ছাত্রীর খোঁজে ৷ কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তাতে চক্ষু চড়কগাছ! বনোয়ারি তখন ওর বউ রামদুলারিকে পেটাতে ব্যস্ত ছিল ৷ উঠোনে পা দিয়েই বুঝলাম—টাইমিঙে ভুল হয়েছে! সামনে এক ক্ষীণদেহী, বিবর্ণ-শুকনো-ক্ষয়াটে চেহারার নারী ঘুঁষি-লাথি খেয়ে কঁকিয়ে যাচ্ছে, আর এক পুরুষ তাকে মেরে মেরে পাট পাট করছে ৷ গালি দিচ্ছে—‘কালমুহি, করমজলি! আজ তোকে মেরেই না ফেলেছি!’…

.

 ‘মাস্টারজি…!’

.

 মুহূর্তের মধ্যে চিন্তাসূত্রটা ছিঁড়ে গেল ৷ কিন্তু সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে! সামনেই ক্লান্ত ধ্বস্ত চেহারার সুখিয়া দাঁড়িয়েছিল ৷ ক্লান্ত হওয়াই স্বাভাবিক ৷ তিনদিন আগেই সে একটি সন্তান প্রসব করেছে ৷ এ গ্রামের সকলেই জেনে গিয়েছে আমি ‘ছাত্রবিহীন মাস্টারজি’— অর্থাৎ ‘মিনিস্টার উইদ আউট পোর্টফোলিও’! কিন্তু পড়াশোনা জানি বলে গাঁয়ের অনেকেই আমার কাছে সমস্যা সমাধানের আর্জি নিয়ে আসে ৷ আজ বনোয়ারিলালের হাজতবাসের খবর নিয়ে এসেছে ভগ্নদূত নিরুপায় সুখিয়া!

 মনে মনে ভাবছিলাম— ‘পুলিশ-ঠানে’ নামক শালগ্রাম শিলাটি হঠাৎ নড়ে চড়ে বসল কেন? এতদিনে কি তবে কয়লা চুরির অপরাধ ধরা পড়ল? না আচম্বিতে রামদুলারির মাথায় কোনো দিব্য শক্তি ভর করে ফোর নাইন্টি এইটের পাঠ পড়িয়েছে! রামদুলারিও তো গর্ভবতী! নাকি গর্ভবতী বউটা মার খেতে খেতে মরেই গেল বলে খুনের অভিযোগে ধরেছে পুলিশ? যদি তাই হয়ে থাকে, তবে বেশ হয়েছে ৷ অনেক আগেই ওর শাস্তি হওয়া উচিত ছিল!

 নির্বিকারভাবে জানতে চাই— ‘পুলিশ ধরেছে কেন? কয়লা চুরি করেছে? না বউটাকে খুন করেছে?’

 সুখিয়া ছলছল চোখে বলল— ‘না মাস্টারজি ৷ বনোয়ারি রামদুলারিকে পেটায়নি’ ৷ একটু থেমে সজল চোখে জানায় সে— ‘ও বংশী…মানে আমার মরদটাকে পিটিয়েছে! পিটিয়ে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে ৷ ও ‘‘ঠানে’’ তে বনোয়ারির নামে ‘‘রপট’’ লিখিয়েছে হুজুর! এদিকে রামদুলারিরও পেট হয়েছে ৷ সকাল থেকে কিছু খায়নি সে ৷ খালি কাঁদছে ৷ এখন আপনি কিছু করুন ৷ নয়তো পুলিশ বনোয়ারিকে ছাড়বে না! রামদুলারি কেঁদে কেঁদে জান দিয়ে দেবে ৷’

 যাঃ কলা! এ তো উলটপুরাণ! মাথায় আস্ত আকাশ ভেঙে পড়লেও বোধহয় এত আশ্চর্য হতাম না! শেষ পর্যন্ত বনোয়ারি রামদুলারিকে নয়, বংশীলালকে পেটানোর অপরাধে জেলে গেল! ভাবা যায় না! কবিগুরু এই পরিস্থিতিতে থাকলে নির্ঘাত একটা আপ্তবাক্য লিখে ফেলতেন—

 ‘বউ ঠ্যাঙাইলে নিস্তার আছে, ভাই ঠ্যাঙাইলে নাই!’

দুই

‘আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন, মাস্টারজি?’ একমুখ জর্দা পানের পিক ফেলে বললেন দারোগা—‘এ তো ওদের ‘‘নিজি’’ মামলা ৷ এক ভাই আরেক ভাইকে পিটিয়েছে ৷ পুলিশে ‘‘রপট’’ লিখিয়েছে ৷ এরপর দেখবেন একটু পরেই দুই ভাই গলা জড়াজড়ি করে কান্নাকাটি করবে ৷ ‘‘মাফি’’ চাইবে ৷ তারপর নালিশ তুলে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বাড়ি চলে যাবে ৷ বংশী আর বনোয়ারি— দুটোই সমান ‘‘নৌটঙ্কিবাজ’’!’

 ‘নিজি’ মামলা আর পারিবারিক ‘নৌটঙ্কি’র মধ্যে পুলিশ কেন মাথা ঘামাচ্ছে তা বুঝতে অবশ্য বাকি ছিল না ৷ বংশীলাল চোরাই কয়লার দামের ‘হিস্যা’ দারোগা সাহেবকে দেয় ৷ অতএব সেই কড়ক নোটের সুগন্ধ শালগ্রাম শিলাতেও প্রাণসঞ্চার করেছে ৷ আমি একঝলক বনোয়ারিলালের দিকে দেখলাম ৷ লোহার গরাদের পিছনে সে বিস্রস্ত, অবিন্যস্ত হয়ে বসে আছে ৷ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে ৷ চুল উসকোখুসকো ৷

 গরাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি— ‘বংশীকে পেটালি কেন?’

 সে বলল— ‘বংশী ভাবিকে পেটাচ্ছিল ৷ তাই আমিও দিয়েছি কয়েক ঘা!’

 এবার আর আকাশ নয়, গোটা ব্রহ্মাণ্ডটাই বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল মাথায়! এ কী কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে! যে নিজেই বউপেটানোয় ওস্তাদ, সে কি না বউদির গায়ে হাত তুলেছে বলে নিজের দাদাকেই পিটিয়েছে! এ চৈতন্য হল কবে ওর?

 আমার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে বনোয়ারি যেন অনুচ্চারিত প্রশ্নটা বুঝে নিল ৷ আস্তে আস্তে বলল— ‘ভাবি আবার লড়কি পয়দা করেছে ৷ তাই দাদা পেটাচ্ছিল! ম্যায়নে ভি দিয়া রখকে!’ সে ভাসাভাসা চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে—‘আপনিই তো বলেছিলেন মাস্টারজি, যে লড়কি লছমীজির অংশ হয়! সীতার জাত লড়কি! তবে সীতা-মাইয়ার অপমান কী করে হতে দিই?

 এ কী! এ যে পুরো সীতাভক্ত হনুমান! এই ভাবান্তর হল কী করে? কবেই বা হল! বনোয়ারি ভিতরে ভিতরে এতটা পাল্টেছে, টেরই পাইনি! এ কী আদৌ সেই বনোয়ারিলাল…!

.

 …সেদিন বনোয়ারি একটা আস্ত বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি পেটাচ্ছিল বউটাকে! অসহায় রামদুলারি মাটিতে পড়ে প্রাণপণ চেঁচাচ্ছিল আর কাঁদছিল! বংশী আর সুখিয়া নীরব দর্শক! দৃশ্যটা দেখে আর বৌদ্ধ ভিক্ষুর ইমেজ বজায় রাখতে পারলাম না ৷ বাঁশটা ফের বিপজ্জনকভাবে তুলেছিল বনোয়ারি ৷ আমি লাফ মেরে এগিয়ে গিয়ে খপ করে তার হাত চেপে ধরি ৷

 বনোয়ারি রক্তচক্ষু তুলে আমার দিকে তাকায় ৷ একটু অনুতাপও নেই ওর মুখে ৷ বরং পারলে যেন বাঁশটা রামদুলারির মাথায় না বসিয়ে আমার মাথাতেই বসায়! কিন্তু অত সহজ নয় ৷ আমার হাত খেটে খাওয়া মজুরের না হলেও কলেজ লেভেলে চ্যাম্পিয়ান বক্সারের কড়া হাত ৷ বনোয়ারি সেটা বুঝতে পেরেছিল ৷ প্রথমে রাগ, পরে বিস্ময় ছাপ ফেলল ওর মুখে ৷ রাগে গর গর করে বলল— ‘কে আপনি? আমাদের ঘরের ব্যাপারে দখলদারি করছেন কেন?’

 রামদুলারির দিকে তাকালাম ৷ ওর চোখে জল ৷ দু হাত জোড় করে অসহায় মিনতিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ দেখেই বুঝলাম, মেয়েটি এই প্রথম মার খাচ্ছে না ৷ আগের মারের দাগগুলো এখনও তার মুখ থেকে অবলুপ্ত হয়নি ৷

 আমার মাথার ভেতরটা দপ করে জ্বলে উঠল ৷ বললাম— ‘লজ্জা করে না! নিজের বউকে এমন অমানুষের মতো পেটাচ্ছ! তোমাকে আমি পুলিশে দেব ৷’

 ‘পুলিশ!’ বনোয়ারি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে— ‘কী অপরাধ করেছি আমি?’

 ‘স্ত্রীকে পেটানো আইনত অপরাধ ৷’ দাঁতে দাঁত পিষে বললাম— ‘এই অপরাধে তোমার জেলযাত্রা কেউ আটকাতে পারবে না! এটা ভারতীয় কানুন ৷’

 ‘ছ্যাঃ’ বনোয়ারি হাতের বাঁশটা ফেলে দিয়ে বলল— ‘আপনিও দেখছি আগের ‘‘নাকচড়ি’’ মাস্টারনিটার মতো কথা বলছেন! আমি পাপ করেছি? ওই শালিকে জিজ্ঞাসা করুন— ও কী করেছে? তিন বছর ধরে আমার ঘরে ‘‘লড়কি’’ পয়দা করছে!’

 ‘লড়কি পয়দা করেছে তো কী? মেয়েরা মানুষ নয়?’

 ‘ওসব আমি জানি না ৷’ তেড়িয়া ভঙ্গিতে জানায় সে— ‘জংলিবাবা বলেছে আমার ঘরে ‘‘রামললা’’র অবতার আসবে ৷ রামললা জংলিবাবার স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি আমার ঘরে আসবেন! আমার কিসমত চমকাবে ৷ তার জন্য ঘরে যা ছিল সব বেচেবুচে প্রতিবছর ছেলের জন্য যজ্ঞ করাচ্ছি জংলিবাবাকে দিয়ে! আর এই ‘‘করমজলি’’ খালি লড়কির পর লড়কিই পয়দা করেছে ৷ এটা পাপ নয়?’

 বলতে বলতেই সে ফের তেড়ে গেল মেয়েটির দিকে— ‘শালি, মেরেই ফেলব আজ তোকে!’

 রামদুলারি ভয়ে চিৎকার করে ওঠে ৷ আমার মাথাতেও খুন চেপে গেল! এতদিন ধরে কুসংস্কারের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল ৷ অন্ধত্বেরও একটা সীমা আছে ৷ সপাটে এক ঘুঁষি বসিয়ে দিলাম ওর মুখে ৷ বক্সারের ঘুঁষি! সামলাতে না পেরে পড়ে গেল বনোয়ারি!

‘তোর জংলিবাবার এইসি কি তেইসি! যজ্ঞ করলে ঘরে রাম আসবে?’ রাগে অন্ধ হয়ে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিল ৷ কী বলছি, কী করছি খেয়াল ছিল না ৷ আঙুল তুলে বললাম—‘জীবনেও আসবে না! কারণ রাম নারায়ণের অংশ! আর নারায়ণ লক্ষ্মীকে ছাড়া কখনও একা আসেন না! লক্ষ্মীর অংশ হলেন রাধা, সীতা ৷ মেয়ে নন ওঁরা? তোরা যখন রামনাম করিস, তখন কার নাম আগে বলিস? যখন ডাকাডাকি করিস তখন সীতা-রাম, রাধে-শাম বলিস, আর এটাও বুঝিস না রাম বলার আগে সীতার নাম আসে? শামের আগে রাধা? কাউকে আজ পর্যন্ত রাম-সীতা বলতে শুনেছিস, রাঘব-জানকী বলতে শুনেছিস? সবসময় সীতা রামের আগে থাকে, জানকী-রাঘব বলা হয় ৷ শামের আগে রাধা, নারায়ণের আগে লক্ষ্মী! আর ‘‘লড়কি’’ লক্ষ্মীর অংশ হয় শুয়োরের বাচ্চা! যেখানে লক্ষ্মীর এমন হেলাফেলা, যেখানে সীতার জাতের ‘‘মোল’’, ‘‘ইজ্জত’’ নেই— সেখানে রাম কোনোদিন আসে না! আসবেও না! আর রইল তোর জংলিবাবা? তাকেও দেখে নেব আমি!’

 কথাগুলো ছুড়ে দিয়েই হনহন করে চলে এসেছিলাম ৷ এরকম নাটকীয় ভাষণ আগে কখনও দিইনি ৷ রক্তারক্তি কাণ্ডও হয়ে যেতে পারত! কিন্তু আসার আগে দেখেছিলাম বনোয়ারি কেমন যেন হতবাক হয়ে বসে আছে ৷ পালটা মার দেওয়া তো দূর, সে যেন একেবারে শক্তিহীন হয়ে মূঢ়ের মতো এলিয়ে পড়েছে উঠোনে!

 এই ঘটনা রাষ্ট্র হতে বেশি সময় নেয়নি ৷ দাবানলের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে ৷ হেডমাস্টারমশাই এবং ডাক্তারবাবু আশঙ্কা প্রকাশ করলেন ৷ বললেন— ‘সর্বনাশ! সত্যিই কি আপনি জংলিবাবার বিরুদ্ধে স্টেপ নেবেন?’

 আমার গরম রক্ত তখন টগবগিয়ে ফুটছে—‘নিশ্চয়ই ৷ ওই ভণ্ডবাবাই হল সব নষ্টের গোড়া! ওকে তো আমি…’ ৷

 হেডমাস্টারমশাই সভয়ে বললেন—‘ওসব করার কথা মনেও আনবেন না ৷ ওই জংলিবাবা ডেঞ্জারাস লোক ৷ আপনার আগে যে দুজন টিচার এসেছিল, তারাও ওই লোকটার এগেনস্টে স্টেপ নিতে চেয়েছিল ৷ অমনি গ্রামবাসীদের জংলিবাবা বোঝালেন যে ওরা নাকি শয়তানের দূত! ওদের পুড়িয়ে মারলে স্বর্গের দরজা খুলে যাবে ৷ অনেক পুণ্য হবে ৷ ব্যস, গ্রামবাসীরা একদিন রাতে এসে ওদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল!’

 শুনতে শুনতে রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল ৷ শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলি—‘তারপর?’

 ভদ্রলোক হাসলেন—‘দুজনেরই বরাত ভালো ছিল ৷ কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে আসতে পেরেছিলেন ৷ তারপরই কালক্ষেপ না করে সিধা চম্পট! আপনাদের কলকাতা অফিস এই ঘটনা জানে ৷ সেইজন্যই প্রথম দিন জানতে চাইছিলাম—কবে পালাচ্ছেন?’

 এবার পুরো ছবিটা পরিষ্কার হল ৷ সম্ভবত আমার অন্য কোলিগরা এই ঘটনা জানে বলেই কেউ আসতে রাজি হয়নি ৷ যেহেতু আমি তখন নতুন জয়েন করেছি, কিছু জানতাম না, তাই বাড় খেয়ে শহিদ হওয়ার জন্য আমাকেই এখানে পাঠিয়েছে অফিস ৷ আমি যোগ্যতর বলে নয়!

 ডাক্তারবাবু জানান—‘পৃথিবী উলটে যাক, কিন্তু জংলিবাবার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবেন না ৷ একটু সাবধানেও থাকবেন ৷ এ ব্যাটারা দল বেঁধে মারপিট করতে এক্সপার্ট ৷’

 আমি হেসে জানাই—‘অত সহজ নয় ৷ দল বেঁধে মারতে এলে আগে কয়েকটাকে মেরেই মরব ৷ সে ক্ষমতা আছে’ ৷

 ডাক্তারবাবু বিড়বিড় করেন— ‘তবু হাতের কাছে একটা লাঠি রাখবেন ৷ বলা যায় না…!’

 ডাক্তারবাবুর সামনে ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দিলেও মনে কিন্তু একটা ভয় থেকেই গেল ৷ এরপর সচরাচর রাতে বাইরে বোরোতাম না ৷ একটা প্রমাণ সাইজের লাঠি ঘরে মজুত রাখলাম ৷ রাত্রে ঘুম হত না! কী জানি! যদি বনোয়ারিলাল দলবল নিয়ে এসে হাজির হয়…! যদি জংলিবাবার নির্দেশে ‘গৃহদাহ’ কেস করে দেয়…!

 বনোয়ারি অবশ্য এল ৷ কিন্তু দলবল নিয়ে নয় ৷ একদিন ভোররাতে দরজায় জোরালো নকের আওয়াজ শুনে লাফিয়ে উঠলাম ৷ পোক্ত লাঠিটা বিছানার পাশেই ছিল ৷ শক্ত করে চেপে ধরে বলি— ‘কে?’

 উলটো দিক থেকে ভেজা ভেজা গলার স্বর ভেসে এল—‘মাস্টারজি, আমি বনোয়ারি!’

 নামটা শুনেই আমার হাতের মুঠো আরও শক্ত করে লাঠিটাকে চেপে ধরল—‘কী চাও’?

 ‘থোড়া বাতচিৎ করতে চাই মাস্টারজি’ ৷

 কথা বলার সুরটা অবশ্য যথেষ্টই নরম ছিল ৷ তবু সন্দিগ্ধ স্বরে বলি—‘বাতচিৎ করতে এসেছ, না দলবল নিয়ে মারপিট করতে?’

 অন্যপ্রান্ত থেকে বনোয়ারির বিব্রত কণ্ঠস্বর শোনা গেল—‘রামললা’-র কীরে বাবু ৷ স্রেফ কয়েকটা কথা বলতে এসেছি ৷ আমি একা ৷ আর কেউ নেই!’

 কথা শুনে মনে হল সত্যি কথাই বলছে ৷ তবু সাবধানের মার নেই ৷ একহাতে লাঠি বাগিয়ে ধরে অন্যহাতে হুড়কো খুলে দিলাম!

 তারপর যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য! বনোয়ারি কথা নেই বার্তা নেই, হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠে আমার দু-পা জড়িয়ে ধরল! কান্নাবিকৃত স্বরে বলল—‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন হুজুর! আমি পাপী! না বুঝে অনেক পাপ করেছি ৷ সিয়া-মা’র জাতকে দূরছাই করেছি! তাই রামলালা আমার কাছে আসছেন না! জংলিবাবাও বলল—আগে সিয়া, পরে রাম! সীতা না এলে রাম আসে না! যেখানে সীতা-মাইয়া নেই, সেখানে রামজি থাকবেন কী ভাবে?’

 মনে হল বোধহয় সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’ গল্পের মতো আমারও নাম কেউ ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ রেখে দিয়েছে, অথবা ও ফরাসি ভাষায় কথা বলছে! ঘটনা যে এমন ট্র্যাপিজের খেলের মতো ডিগবাজি খাবে স্বপ্নেও ভাবিনি ৷ কোনমতে প্রাণপণে পা ছাড়িয়ে নিয়ে বলি—‘আরে ঠিক আছে……ঠিক আছে ৷’

 ‘না মাস্টারজি!’ সে নাছোড়বান্দা ৷ ফের পা জড়িয়ে ধরেছে— ‘ওই লাঠিটা আপনি আমার পিঠে ভাঙুন! আমি পাপী৷ মহাপাপী! আমি সীতা-মা কে অবহেলা করেছি ৷ রামললাও তাই গুসসা করে আমার ঘরে আসছেন না! মারুন মাস্টারজি!’

.

 শুরু হয়েছিল মারপিট দিয়ে ৷ কিন্তু কিছুদিন গড়াতে না গড়াতেই বন্ধুত্ব জমে গেল ৷ বনোয়ারিলাল নিয়ম করে বিকেলবেলায় নানারকম ‘ভাজি-পুরী’ নিয়ে এসে হাজির হত ৷ অনেক বারণ করেছিলাম ৷ ও শোনেনি ৷ রোজ এসে ঘণ্টা- দেড় ঘণ্টা ধরে গল্প করত, সুখ-দুঃখের কথা বলত ৷ ওর বৃদ্ধ-বাপ মা এখনও বেঁচে আছেন ৷ কিন্তু বংশী বা বনোয়ারি, কেউই ওদের দেখে না ৷ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এই গ্রামেই ওর বোন আর বেহনোই-এর সঙ্গে থাকেন ৷ বংশী আর বনোয়ারির একটাই দুঃখ ৷ মা ষষ্ঠীর কৃপায় বংশীর চার সন্তান ৷ আর বনোয়ারির তিন ৷ কিন্তু কারোরই পুত্রসন্তান নেই ৷ সবই কন্যাসন্তান ৷

 ‘মাস্টারজি, বেটা না থাকলে যে নরকেও ঠাঁই হবে না!’ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে জানিয়েছিল বনোয়ারি—‘ছেলের হাতের জল না পেলে যে আত্মার শান্তিও হবে না! লড়কি তো সুখের পায়রা ৷ আজ এখানে বকম বকম করছে, অন্য বাড়িতে দানাপানি পেলে সেখানেই উড়ে চলে যাবে ৷ বুড়ো বয়েসে তবে দেখবে কে?’

 ভয়ংকর হাসি পেল ৷ কোনোমতে হাসি চেপে বললাম—‘তাই? তা তোর বাপ-মায়ের তো দু-দুটো বেটা! বুড়ো বয়েসে ওদের কে দেখছে? বেটা না বেটি?’

 বনোয়ারি একটু থমকাল ৷ কী বুঝল কে জানে! কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে তারপর বলল—‘কিন্তু বেটার হাতের জল না পেলে যে স্বর্গ নসিব হয় না! পরজন্মে মানবজন্মও মেলে না!’

 মৃদু হেসে জানাই—‘ভাই, আমি শুধু এইটুকু জানি যে এ জন্মে যদি বেঁচে থাকতে ভাত-জল, সন্তানের আদর-যত্ন না পাই, তো মরার পরে ওই মশা মারার ধূপ আর পিণ্ড দিয়ে আমার কাঁচকলা হবে! না খেতে পেয়েই যদি মরি, তবে যম শিং নিয়ে তাড়া করুক, কি মেনকা সামনে এসে ধেইধেই করে নৃত্যই করুক—কী আসে যায়! তোদের রামললাও তো শুধু বাপের এক কথায় বনবাসে চলে গিয়েছিলেন ৷ বাপ-মাকে কতটা ভক্তি করলে এমন করা যায় ভাব তো!’

 সে চুপ করে আমার কথা শুনছিল ৷ বুঝলাম ওষুধ ধরছে! ওরা যে ভাষা, যে জাতীয় যুক্তি বোঝে— সেই যুক্তি দিয়েই গজচক্র করতে হবে ব্যাটাকে! বললাম — ‘তাছাড়া রামললা আসবেই বা কেন? তোরা সব নিরক্ষর! রামজির বাপ-মা কত শিক্ষিত ছিলেন জানিস? ভগবান রামজি নিজেও কত শিক্ষিত ছিলেন ৷ সব বিদ্যা জানতেন! তোদের ঘরে এলে তো বেচারিকে ক অক্ষর গোমাংস হয়েই থাকতে হবে! হয় কারোর খেতে কাজ করতে হবে, নয়তো কয়লাচুরি করতে পাঠাবি ৷ কোনো দেব-দেবী এসব করে?’

 বনোয়ারি কী বুঝল কে জানে! কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের আস্তে আস্তে বলল — ‘সও টাকা কি বাত, মাস্টারজি ৷ কথা দিচ্ছি বেটা ঘরে এলে তাকে আমাদের মতো ‘আনপড়, গওঁয়ার’ বানাব না! আপনার সকুলেই পড়াব ছেলেকে! অনেকগুলো পাশ দেওয়াব…!’

 এরপরও ও অনেকবার আমার কাছে এসেছে ৷ দেখলাম, রামকে ছেড়ে ও এখন সীতাকে নিয়ে পড়েছে ৷ সীতা-মাইয়াকে নিয়ে ওর অপরিসীম কৌতূহল ৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সীতার জন্মবৃত্তান্ত জানল ৷ তারপর কী যেন ভেবে বলল—‘আচ্ছা মাস্টারজি, সীতা মাইয়া তো তবে ধরতী মায়ের পুত্রী ৷ মিট্টিতে জন্ম ৷ তবে তিনি কোনো ঔরতের পেট থেকে আসবেন কী করে?’

 ওর প্রশ্নটা শুনে চমৎকৃত হয়েছিলাম ৷ একটা অশিক্ষিত, মজুর মানুষের মাথায়ও এমন প্রশ্ন আসে! সীতার জন্ম যে মনুষ্য-যোনি থেকে হয়নি, হতে পারে না, তা একদম ঠিকঠাক বুঝে গিয়েছে ৷ আমি মৃদু হেসে বলি—‘এটা কলিকাল বনোয়ারি ৷ এখন আর সীতা মাটি ভেদ করে আসেন না! আগে যজ্ঞ করে রাজরাজড়ারা ছেলে-মেয়ে পেতেন ৷ এখন হয়? তুইও তো তিন-তিনবার ঘর বাঁধা দিয়ে, রামদুলারির গয়না বেচে জংলিবাবাকে দিয়ে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করালি ৷ হল?’

 বনোয়ারি সেদিন অসন্তুষ্ট মুখে চলে গিয়েছিল ৷ সম্ভবত উত্তরটা ওর পছন্দ হয়নি ৷ কিন্তু পিতৃ-মাতৃভক্তির ওষুধটা সত্যিই ধরেছিল ৷ একদিন খবর পেলাম বনোয়ারি বাপ-মাকে নিজের ঘরে এনে তুলেছে ৷ তাদের জোরদার সেবাও করছে!

 সেদিন ভেবেছিলাম পরিবর্তনটা সাময়িক ৷ কিন্তু আজ বংশীলালকে মেরে বনোয়ারি প্রমাণ করে দিল—সত্যিই সে বদলে গিয়েছে!

তিন

‘আপনি তো মিরাকল করে দিলেন মশাই!’

 ডাক্তারবাবু প্রশংসাসূচক দৃষ্টিতে তাকালেন—‘ওদের অস্ত্রে ওদেরই ঘায়েল করেছেন! রামদুলারিকে বনোয়ারি আর পেটায় না ৷ বংশীও ভাইয়ের ভয়ে সুখিয়ার গায়ে হাতটুকুও তোলে না! অতবড় একটা ট্র্যাজিক ঘটনা হয়ে যাওয়ার পরও সুখিয়াকে বেশি দোষারোপও করেনি! করলেন কীভাবে!’

 ঘটনাটা সত্যিই ট্র্যাজিক! বংশীলালের সদ্যোজাত শিশুকন্যাটি দেখতে বড় চমৎকার হয়েছিল ৷ ওদের ঘরে অমন সুন্দর রাজকন্যার মতো মেয়ে জন্মায় না! বংশী আর বনোয়ারির ঝামেলা চুকেবুকে গিয়েছিল সেদিনই ৷ বনোয়ারি ছাড়া পেয়েই আমাকে ওর নতুন ভাইঝির ‘মুখ-দিখাই’ এর জন্য ‘নেওতা’ দিয়ে বসল ৷ প্রথামাফিক দেখতেও গিয়েছিলাম ৷ একজোড়া ছোট ছোট রুপোর বালা দিয়ে শিশুটিকে দেখেওছিলাম ৷ ভারী মায়াবী ৷ সবচেয়ে মায়াবী তার হাসি! বংশী গর্বিত কাকার মতো বলেছিল—‘এই হল আমাদের সীতা মাইয়া—নয়, মাস্টারজি?’

 আমি হেসে মাথা নেড়েছিলাম ৷ বনোয়ারি তার সুন্দরী ভাইঝির গর্বে একেবারে কয়েক ইঞ্চি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল! এমনকী কাজ থেকেও তাড়াতাড়ি ফিরত শিশুকন্যাটির জন্য ৷ সবসময়ই হয় তাকে কোলে নিয়ে আদর করছে, নয়তো খেলছে!

 কিন্তু একদিন ও বাড়িতে ফের কান্নার রোল উঠল! তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দেখি, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে! বনোয়ারির অমন সুন্দরী শিশু সীতামাইয়াকে ভামে কিংবা শেয়ালে টেনে নিয়ে গিয়েছে ৷ এ ঘটনা অবশ্য নতুন নয়! ওদের চিরকালীন অভ্যাস গরমকালে বাড়ির বাইরে দাওয়ায় শোওয়া! এর আগেও বহু নবজাতক ভাম বা শিয়ালের হিংস্র লোলুপ দাঁতের শিকার হয়েছে ৷ হতভাগিনী ক্লান্ত মা শিশুকন্যাকে কোলের কাছে রেখে নিশ্ছিদ্র ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল ৷ কখন যে তার সন্তানকে বুক থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছে সুযোগসন্ধানী জানোয়ারগুলো, টেরই পায়নি ৷

 ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি সে এক সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! বংশী সুখিয়াকে যা নয় তাই বলে দোষারোপ করছে ৷ তার অবস্থা দেখে মনে হয় শোকের চেয়েও রাগ বেশি! তেলে পড়বে কি জলে পড়বে বুঝতে পারছে না!

 আমি পৌঁছতেই গালিগালাজগুলোকে গিলে নিল বংশী ৷ সুখিয়া বেচারি শুধু কেঁদেই চলেছে ৷ ওর অবস্থা দেখে রাগ হল ৷ বললাম— ‘ওর কী দোষ? তুমিও তো বাপু পাশে ছিলে! তুমি টের পেয়েছ? না, মেয়ের দায়িত্ব একা মায়েরই?’

 চুপ করে ভর্ৎসনাটা হজম করল ও ৷ মাথা হেঁট করে আমার কথাই মেনে নিল ৷ জোরালো গলায় বললাম—‘খালি কান্নাকাটি-গালিগালাজ করলেই চলবে? মেয়েটার খোঁজ করবে না? হয়তো এখনও জন্তুটা বেশি দূর যেতে পারেনি ৷ হয়তো এখনও আশা আছে…!’

 আশা ছিল না! অনেক খোঁজাখুঁজির পর শুধু মেয়েটির পরনের ছোট্ট জামাটা মিলল ৷ তা ও ছেঁড়াখোঁড়া! সুখিয়া তিনদিন শুধু বুক ভাসিয়ে কাঁদল ৷ বনোয়ারি গুম হয়ে বসে রইল ৷ বংশী কয়েকদিন কাজে গেল না ৷ আসন্নপ্রসবা রামদুলারি ভারী শরীরটা নিয়ে শুকনো মুখে গোটা ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে রইল ৷ তার অনাগত সন্তানের অমঙ্গল আশঙ্কায় হয়তো কাঁদতেও পারল না!

 তারপর আবার সব স্বাভাবিক! গরিবের ঘরে শোক বেশিদিন থাকে না ৷ বিশেষ করে যখন একটির মৃত্যুর শোক ভোলাবার জন্য ঘরে আরও তিনটি মজুত রয়েছে তখন দুঃখের ঠাঁই বেশিক্ষণ হয় না ৷ সুখিয়া চোখের জল মুছে কাজে লাগল ৷ বংশীও ফের কয়লাচুরির কাজে নেমে পড়ল ৷ ধাক্কাটা শুধু সামলাতে পারেনি বনোয়ারি ৷ তার হাবভাব এরপর থেকেই কেমন অস্বাভাবিক হয়ে গেল! বেশি কথা বলে না ৷ চুপচাপ বসে থাকে ৷ সারাদিন ধরে কী যে ভাবে ভগবানই জানে! জিজ্ঞাসা করলে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে!

 ‘যে ভাবে এগোচ্ছেন, তাতে আপনার স্কুল হয়তো শীগগিরই ছাত্র-ছাত্রীতে ভরে উঠবে’ ৷ ডাক্তারবাবু বললেন—‘আপনাকে ওরা সবাই খুব মান্য করে ৷ পারলে আপনিই পারবেন ৷ অন্তত একটা লোককে তো কুসংস্কারের কবল থেকে টেনে বের করেছেন! আজ একজন বেরিয়েছে, কাল আরও দুজন বেরোবে ৷ এইভাবেই তো হয়…!’

 বুকের কয়েক ইঞ্চি ফুলে উঠল ৷ অনেক সময় মানুষের ধারণা হয়, সে আসলে সাধারণ মানুষ নয়—যুগন্ধর! আমারও হঠাৎ তাই মনে হয়েছিল ৷ মনে হয়েছিল, এটা আসলে নিয়তি! আমি ওদের অন্ধত্ব দূরীকরণের জন্যই আসলে এসেছি! রামমোহন, বিদ্যাসাগর না হলেও আমি ছোটখাটো এক সমাজ সংস্কারক!

 আত্মশ্লাঘা কখনওই স্বাস্থ্যকর জিনিস নয় ৷ কিন্তু তা সত্বেও একটু গর্বিত বোধ না করে পারলাম না ৷ অন্তত বনোয়ারিকে তো আলোয় টেনে আনতে পেরেছি ৷ যদিও পুরোপুরি নয় ৷ কারণ তিনবারের পরও তার শিক্ষা হয়নি ৷ রামদুলারির এখন-তখন অবস্থা ৷ যে-কোনো সময়ই চলে আসতে পারে নবজাতক ৷ এই পরিস্থিতিতে সে আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে জংলিবাবাকে দিয়ে ফের যজ্ঞ করাচ্ছে! আমি আপত্তি করেছিলাম ৷ সে শোনেনি ৷ বলেছে— ‘এইবার শেষ! এবার রামললা আসবেই!’

 ‘যদি না আসে?’

 সে একটু চুপ করে থেকে বলল—‘তবে আর কোশিশই করব না!’

 আমি চুপ করে ওদের ঝুপড়ির দিকেই তাকিয়েছিলাম! কালো ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশের দিকে উড়ছে! ওই জংলীবাবা কীসব পোড়াচ্ছে কে জানে! যত্তসব ভড়ং! যজ্ঞ, তুকতাকের নামে কত লোকের শেষ সম্বলটুকুও গিলেছে শয়তানটা! আমার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ৷ ওটাকেও দেখে নেব একদিন ৷ যেদিন আমার সময় আসবে, সেদিন…!

 আর কিছু ভাবার আগেই আচমকা মনে হল মাথাটা ঘুরছে! এ কী! … চতুর্দিকটা এভাবে পাক খাচ্ছে কেন? টের পেলাম পায়ের নীচে মাটিটাও আন্দোলন শুরু করেছে! যেন রামদুলারির মতোই প্রসব বেদনা উঠেছে তারও! … চোখের সামনে দেখতে পেলাম গাছগুলো কাঁপছে … কেউ যেন ধরে ঝাঁকাচ্ছে … ঝুপঝাপ করে ঝুপড়িগুলো খসে পড়ছে! … কী সর্বনাশ! ভূমিকম্প!

 পড়িমরি করে দৌড়লাম শ্রমিকদের ঝুপড়ি লক্ষ্য করে ৷ পায়ের নীচে মাটি কাঁপছে… মনে হচ্ছে টাল খেয়ে পড়ে যাব … তবু দৌড়লাম … ওদের এখনই সাবধান করে দিতে হবে … বাইরে বেরিয়ে আসতে বলতে হবে! আর রামদুলারি! তার কী অবস্থা কে জানে …! ঝুপড়ির নীচে চাপা পড়েনি তো…!

 টলতে টলতে কোনো মতে হাজির হয়েছি বনোয়ারিদের বাড়ির সামনে! বংশী আর সুখিয়া ততক্ষণে কোনোমতে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এসেছে যন্ত্রণাকাতর রামদুলারিকে ৷ মেয়েরা মিলে কোনোমতে পরনের শাড়ি, গামছা দিয়ে আড়াল করেছে তাকে ৷ ধাই-মা উপস্থিত! যজ্ঞ লন্ডভন্ড! ঝুপড়িগুলো মৃত সৈনিকের মতো মাটিতে এলিয়ে পড়েছে!…

 ‘আ গয়ি! আ গ … য়ি!’

 এই অবস্থায় একটা উচ্ছ্বসিত, আনন্দ-উদ্বেলিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি! কী আশ্চর্য! বনোয়ারিলাল অমন উন্মত্তের মতো দু-হাত তুলে নাচছে কেন? ও কি পাগল হয়ে গেল! শোকে দুঃখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে?

 ‘সীতামাইয়া আ গয়ি মাস্টারজি!’ সে আমাকে আনন্দের চোটে জড়িয়ে ধরেছে—‘কলিকালেও সীতা মাইয়া মাটির বুক চিরে প্রকট হয়েছেন! ওই দেখুন!’

 তার অঙ্গুলিনির্দেশ লক্ষ করে যা দেখলাম তাতে মনে হল আদৌ ভূমিকম্পটা মাটিতে হচ্ছে না! আমার শরীরে হচ্ছে! প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম … মনে হল, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না … শুনতে পাচ্ছি না … ! … বংশী আর সুখিয়া স্তম্ভিত, বিহ্বলের মতো সেদিকেই দেখছে … আর আমি …!

 ভূমিকম্পের তীব্রতায় উঠোনের মাটি কোথাও ধসে পড়েছে! কোথাও লম্বালম্বি বিরাট চিড় ধরেছে ৷ সেই চিড়ের ফাঁক দিয়েই উদ্ধত প্রশ্নের মতো একটা শিশুহাতের কঙ্কাল উঁকি মারছে! হাতে এখনও আমার দেওয়া রুপোর বালা! শিশুহাতটার তর্জনি নিবদ্ধ বনোয়ারিলালের দিকেই! কী যেন ইঙ্গিত করছে…! তার মানে … ওকে কোনো ভাম বা শেয়াল নেয়নি …!

 আমি কোনোমতে বললাম—‘বনোয়ারি! এ—কী!’

 বনোয়ারি নাচতে নাচতেই বলল—‘সিয়া মা! ধরতি ফুঁড়ে উঠে এসেছে! আমি জানতাম! আমি জানতাম কলিকাল হলেও আমার সিয়া মা পুনর্জন্ম নিয়ে ধরতীর বুক থেকে ঠিক আসবেনই! এবার তো রামলালা আমার ঘরে আসবেই! সবাই জয়-জয়কার করো ৷ শাঁখ বাজাও! সীতা মাইয়া এসেছেন! রামও আসছেন! জয় সিয়ারাম, জয় জানকি রাঘব, জয় সিয়ারাম…!’

 হে রা—ম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *