ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
গঙ্গারামের মুক্তির আজ্ঞা প্রচার করিয়া, জয়ন্তীর আজ্ঞা মত দ্বার মুক্ত রাখিবার অনুমতি প্রচার করিয়া, রাজা শয্যাগৃহে আসিয়া পর্যঙ্কে শয়ন করিলেন। নন্দা তখনই আসিয়া পদসেবায় নিযুক্ত হইল। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “রমা কেমন আছে?”
রমার পীড়া। সে কথা পরে বলিব। নন্দা উত্তর করিল, “কই-কিছু বিশেষ হইতে ত দেখিলাম না |”
রাজা। আমি এত রাত্রিতে তাহাকে দেখিতে যাইতে পারিতেছি না, বড় ক্লান্ত আছি; তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হইয়া যাও–তাহাকে আমি যেমন যত্ন করিতাম, তেমনি যত্ন করিও; আর আমি যে জন্য যাইতে পারিলাম না, তাহাও বলিও।
কথাটা শুনিয়া পাঠক সীতারামকে ধিক্কার দিবেন। কিন্তু সে সীতারাম আর নাই। যে সীতারাম হিন্দুসাম্রাজ্য সংস্থাপন জন্য সর্বস্ব পণ করিয়াছিলেন, সে সীতারাম রাজ্যপালন ত্যাগ করিয়া কেবল শ্রীকে খুঁজিয়া বেড়াইল। যে সীতারাম আপনার প্রাণ দিয়া শরণাগত বলিয়া গঙ্গারামের প্রাণরক্ষা করিতে গিয়াছিলেন-সেই সীতারাম রাজা হইয়া, রাজদণ্ডপ্রণেতা হইয়া, শ্রীর লোভে গঙ্গারামকে ছাড়িয়া দিল। যে লোকবৎসল ছিল, সে এখন আত্মবৎসল হইতেছে।
নন্দা বুঝিল, প্রভু আজ একা থাকিতে ইচ্ছুক হইয়াছেন। নন্দা আর কথা না কহিয়া চলিয়া গেল। সীতারাম তখন পর্যঙ্কে শয়ন করিয়া শ্রীর প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
সীতারাম সমস্ত দিন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর পর্যন্ত পরিশ্রম করিয়া ক্লান্ত ছিলেন। অন্য দিন হইলে পড়িতেন আর নিদ্রায় অভিভূত হইতেন। কিন্তু আজ স্বতন্ত্র কথা–যাহার জন্য রাজ্যসুখ বা রাজ্যভার ত্যাগ করিয়া এত কাল ধরিয়া দেশে দেশে নগরে নগরে ভ্রমণ করিয়াছেন, যাহার চিন্তা অগ্নিস্বরূপ দিবারাত্র হৃদয় দাহ করিতেছিল, তাহার সাক্ষাৎলাভ হইবে। সীতারাম জাগিয়া রহিলেন।
কিন্তু নিদ্রাদেবীও ভুবন-বিজয়িনী। যে যতই বিপদাপন্ন হউক না কেন, এক সময়ে না এক সময়ে তাহারও নিদ্রা আসে। সীতারাম বিপদাপন্ন নহেন, সুখের আশায় নিমগ্ন, সীতারামের একবার তন্দ্রা আসিল। কিন্তু মনের ততটা চাঞ্চল্য থাকিলে তন্দ্রাও বেশীক্ষণ থাকে না। ক্ষণকাল মধ্যেই সীতারামের নিদ্রা ভঙ্গ হইল–চাহিয়া দেখিলেন, সম্মুখে গৈরিকবস্ত্র–রুদ্রাক্ষভূষিতা মুক্ত–কুন্তলা কমনীয়া মূর্তি!
সীতারাম প্রথমে জয়ন্তী মনে করিয়া অতি ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কই? শ্রী কই?” কিন্তু তখনই দেখিলেন, জয়ন্তী নহে, শ্রী।
তখন চিনিয়া, “শ্রী! শ্রী! ও শ্রী! আমার শ্রী!” বলিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিতে রাজা গাত্রোত্থান করিয়া বাহু প্রসারণ করিলেন। কিন্তু কেমন মাথা ঘুরিয়া গেল–চক্ষু বুজিয়া রাজা আবার শুইয়া পড়িলেন। মুহূর্ত্ত মধ্যে আপনিই মূর্ছা ভঙ্গ হইল।
তখন সীতারাম, ঊর্ধ্বমুখে, স্পন্দিততারলোচনে, অতৃপ্তদৃষ্টিতে শ্রীর পানে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। কোন কথা নাই-যেন বা নয়নের তৃপ্তি না হইলে কথার স্ফূর্ত্তি সম্ভাবিত হইতেছে না। দেখিতে দেখিতে, দেখিতে দেখিতে–যেন তাঁহার আনন্দ–প্রফুল্ল মুখমণ্ডল আর তত প্রফুল্ল রহিল না-একটা নিশ্বাস পড়িল। রাজা, আমার শ্রী বলিয়া ডাকিয়াছিলেন, বুঝি দেখিলেন, আমার শ্রী নহে। বুঝি দেখিলেন যে, স্থিরমূর্তি, অবিচলিতধৈর্য্যসম্পন্না, অশ্রুবিন্দুমাত্রশূন্যা, উদ্ভাসিতরূপরশ্মি- –
মণ্ডলমধ্যবর্ত্তিনী, মহামহিমাময়ী, এ যে দেবীপ্রতিমা! বুঝি এ শ্রী নহে!
হায়! মূঢ় সীতারাম মহিষী খুঁজিতেছিল-দেবী লইয়া কি করিবে!
সপ্তম পরিচ্ছেদ
রাজার কথা শ্রী সব শুনিল, শ্রীর কথা রাজা সব শুনিলেন। যেমন করিয়া, সর্বত্যাগী হইয়া সীতারাম শ্রীর জন্য পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন, সীতারাম তাহা বলিলেন। শ্রী আপনার কথাও কতক কতক বলিল, সকল বলিল না।
তার পর শ্রী জিজ্ঞাসা করিল, “এখন আমাকে কি করিতে হইবে?”
প্রশ্ন শুনিয়া সীতারামের নয়নে জল আসিল। চিরজীবনের পর স্বামীকে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল কি না, “এখন আমাকে কি করিতে হইবে?” সীতারামের মনে হইল, উত্তর করেন, “কড়িকাঠে দড়ি দিয়া ঝুলাইয়া দিবে, আমি গলায় দিব |”
তাহা না বলিয়া সীতারাম বলিলেন, “আমি আজ পাঁচ বৎসর ধরিয়া আমার মহিষী খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। এখন তুমি আমার মহিষী হইয়া রাজপুরী আলো করিবে |”
শ্রী। মহারাজ! নন্দার প্রশংসা বিস্তর শুনিয়াছি। তোমার সৌভাগ্য যে, তুমি তেমন মহিষী পাইয়াছ। অন্য মহিষীর কামনা করিও না।
সীতা। তুমি জ্যেষ্ঠা। নন্দা যেমন হোক, তোমার পদ তুমি গ্রহণ করিবে না কেন?
শ্রী। যে দিন তোমার মহিষী হইতে পারিলে আমি বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীও হইতে চাহিতাম না, আমার সে দিন গিয়াছে।
সীতারাম। সে কি? কেন গিয়াছে? কিসে গিয়াছে?
শ্রী। আমি সন্ন্যাসিনী; সর্ব কর্ম ত্যাগ করিয়াছি।
সীতারাম। পতিযুক্তার সন্ন্যাসে অধিকার নাই। পতিসেবাই তোমার ধর্ম।
শ্রী। যে সব কর্ম ত্যাগ করিয়াছে, তাহার পতিসেবাও ধর্ম নহে; দেবসেবাও তাহার ধর্ম নহে। সী। সর্ব কর্ম কেহ ত্যাগ করিতে পারে না; তুমিও পার নাই। গঙ্গারামের জীবন রক্ষা করিয়া তুমি কর্ম করিলে না? আমাকে দেখা দিয়া তুমি কি কর্ম করিলে না?
শ্রী। করিয়াছি, কিন্তু তাহাতে আমার সন্ন্যাসধর্ম ভ্রষ্ট হইয়াছে, একবার ধর্মভ্রষ্ট হইয়াছি বলিয়া এখন চিরকাল ধর্মভ্রষ্ট হইতে বল?
সী। স্বামিসহবাস স্ত্রীজাতির পক্ষে ধর্মভ্রংশ, এমন কুশিক্ষা তোমায় কে দিল? যেই দিক, ইহার উপায় আমার হাতে আছে। আমি তোমার স্বামী, তোমার উপর আমার অধিকার আছে। সেই অধিকার বলে, আমি তোমাকে আর যাইতে দিব না।
শ্রী। তুমি স্বামী, আর তুমি রাজা। তা ছাড়া তুমি উপকারী, আমি উপকৃত। অতএব তুমি যাইতে না দিলে আমি যাইতে পারিব না।
সী। আমি স্বামী, আমি রাজা, আর আমি উপকারী, তাই আমি যাইতে না দিলে তুমি যাইতে পারিবে না। বলিতেছ না কেন, আমি তোমায় ভালবাসি, তাই আমি ছাড়িয়া না দিলে তুমি যাইতে পারিবে না? স্নেহের সোণার শিকল কাটিবে কি প্রকারে?
শ্রী। মহারাজ! সে ভ্রমটা এখন গিয়াছে। এখন বুঝিয়াছি, সে ভালবাসে, ভালবাসায় তাহার ধর্ম এবং সুখ আছে। কিন্তু যে ভালবাসা পায়, তাহার তাতে কি? তুমি মাটির ঠাকুর গড়িয়া তাহাতে পুষ্পচন্দন দাও, তাহাতে তোমার ধর্ম আছে, সুখও আছে, কিন্তু তাহাতে মাটির পুতুলের কি?
সী। কি ভয়ানক কথা!
শ্রী। ভয়ানক নহে–অমৃতময় কথা। ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। ঈশ্বরে প্রীতিই জীবের সুখ বা ধর্ম। তাই সর্বভূতকে ভালবাসিবে। কিন্তু ঈশ্বর নির্বিকার, তাঁর সুখ-দুঃখ নাই। তবে যে, কেহ ভালবাসিলে আমরা সুখী হই, সে কেবল মায়ার বিক্ষেপ।
সী। শ্রী! দেখিতেছি কোন ভণ্ড সন্ন্যাসীর হাতে পড়িয়া তুমি স্ত্রীবুদ্ধিবশত: কতকগুলা বাজে কথা কণ্ঠস্থ করিয়াছ। ও সকল স্ত্রীলোকের পক্ষ ভাল নহে। ভাল যা, তা বলিতেছি, শুন। আমি তোমার স্বামী আমার সহবাসই তোমার ধর্ম; তোমার ধর্মান্তর নাই। আমি রাজা, সকলেরই ধর্মরক্ষা আমার কর্ম; এবং স্বামীরও কর্তব্য কর্ম যে, স্ত্রীকে ধর্মানুবর্তিনী করে। অতএব তোমার ধর্মে আমি তোমাকে প্রবৃত্ত করিব। তোমাকে যাইতে দিব না।
শ্রী। তা বলিয়াছি, তুমি স্বামী, তুমি রাজা, তুমি উপকারী। তোমার আজ্ঞা শিরোধার্য্য, কেবল আমার এইটুকু বলিয়া রাখা যে, আমা হইতে তুমি সুখী হইবে না।
সীতা। তোমাকে দেখিলেই আমি সুখী হইব।
শ্রী। আর এক ভিক্ষা এই, যদি আমাকে গৃহে থাকিতে হইল, তবে আমাকে এই রাজপুরীমধ্যে স্থান না দিয়া, আমাকে একটু পৃথক কুটীর তৈয়ার করিয়া দিবেন। আমি সন্ন্যাসিনী, রাজপুরীর ভিতর আমিও সুখী হইব না, লোকেও আপনাকে উপহাস করিবে।
সী। আর কুটীরে রাজমহিষীকে রাখিলে লোকে উপহাস করিবে না কি?
শ্রী। রাজমহিষী বলিয়া কেহ নাই জানিল।
সীতা। আমার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হইবে না কি?
শ্রী। সে আপনার অভিরুচি।
সী। তোমার সঙ্গে আমি দেখাশুনা করিব, অথচ তুমি রাজমহিষী নও; লোকে তোমাকে কি বলিবে জান?
শ্রী। জানি বৈ কি! লোকে তোমাকে রাজার উপপত্নী বিবেচনা করিবে। মহারাজ! আমি সন্ন্যাসিনী–আমার মান অপমান কিছুই নাই। বলে বলুক না। আমার মান অপমান আপনারই হাতে।
সী। সে কি রকম?
শ্রী। আমি তোমার সহধর্মিণী–আমার সঙ্গে ধর্মাচরণ ভিন্ন অধর্মাচরণ করিও না। ধর্মার্থে ভিন্ন যে ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তি, তাহা অধর্ম। ইন্দ্রিয়তৃপ্তি পশুবৃত্তি। পশুবৃত্তির জন্য বিবাহের ব্যবস্থা দেবতা করেন নাই। পশুদিগের বিবাহ নাই। কেবল ধর্মার্থেই বিবাহ। রাজর্ষিগণ কখনও বিশুদ্ধচিত্ত না হইয়া সহধর্মিণীসহবাস করিতেন না। ইন্দ্রিয়বশ্যতা মাত্রই পাপ। আপনি যখন নিষ্পাপ হইয়া, শুদ্ধচিত্তে আমার সঙ্গে আলাপ করিতে পারিবেন, তখন আমি এই গৈরিক বস্ত্র ছাড়িব। যত দিন আমি এ গেরুয়া না ছাড়িব, ততদিন মহারাজ! তোমাকে পৃথক্ আসনে বসিতে হইবে।
সী। আমি তোমার প্রভু, আমার কথাই চলিবে।
শ্রী। একবার চলিতে পার, কেন না, তুমি বলবান। কিন্তু আমারও এক বল আছে। আমি বনবাসিনী, বনে আমরা অনেক প্রকার বিপদে পড়ি। এমন বিপদ ঘটিতে পারে যে, তাহা হইতে উদ্ধার নাই। সে সময়ে আপনার রক্ষার জন্য আমরা সঙ্গে একটু বিষ রাখি। আমার নিকট বিষ আছে–আবশ্যক হইলে খাইব।
হায়! এ শ্রী ত সীতারামের শ্রী নয়।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
সীতারাম তাহা বুঝিয়াও বুঝিলেন না। মন কিছুতেই বুঝিল না। যাহার ভালবাসার জিনিস মরিয়া যায়, সেও মৃতদেহের কাছে বসিয়া থাকে, কিছুক্ষণ বিশ্বাস করে না যে, আর নিশ্বাস নাই। পাগল লিয়রের মত দর্পণ খুঁজিয়া বেড়ায়, দর্পণে নিশ্বাসের দাগ ধরে কি না। সীতারাম এত বৎসর ধরিয়া, মনোমধ্যে একটা শ্রীমূর্তি গড়িয়া তাহার আরাধনা করিয়াছিল। বাহিরে শ্রী যাই হৌক, ভিতরের শ্রী তেমনই আছে। বাহিরের শ্রীকেই ত সীতারাম হৃদয়ে বসাইয়া রাখিয়াছিলেন, সেই বাহিরের শ্রী ত বাহিরেই আছে, তবে সে হৃদয়ের শ্রী হইতে ভিন্ন কিসে? ভিন্ন বলিয়া সীতারাম বারেক মাত্রও ভাবিতে পারিলেন না। লোকের বিশ্বাস আর সব বুঝি না। এক দেহেই কত বার যে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে, তাহা মনেও করি না। সীতারাম বুঝিল না যে, সে শ্রী মরিয়াছে, আর একটা শ্রী সেই দেহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। মনে করিল যে, আমার শ্রী আমার শ্রীই আছে। তাই শ্রীর চড়া চড়া কথাগুলা কাণে তুলিল না। তুলিবারও বড় শক্তি ছিল না। শ্রীকে ছাড়িলে সব ছাড়িতে হয়।
তা, শ্রী কিছুতেই রাজপুরীমধ্যে থাকিতে রাজি হইল না। তখন সীতারাম “চিত্তবিশ্রাম” নামে ক্ষুদ্র অথচ মনোরম প্রমোদভবন শ্রীর নিবাসার্থ নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন। শ্রী তাহাতে বাঘছাল পাতিয়া বসিল। রাজা প্রত্যহ তাহার সাক্ষাৎ জন্য যাইতেন। পৃথক আসনে বসিয়া তাহার সঙ্গে আলাপ করিয়া ফিরিয়া আসিতেন। ইহাতে রাজার পক্ষে বড় বিষময় ফল ফলিল।
আলাপটা কি রকম হইল মনে কর? রাজা বলিতেন ভালবাসার কথা, শ্রীর জন্য তিনি এত দিন যে দুঃখ পাইয়াছেন তাহার কথা, শ্রী ভিন্ন জীবনে তাঁহার আর কিছুই নাই, সেই কথা। কত দেশে কত লোক পাঠাইয়াছেন, কত দেশে নিজে কত খুঁজিয়াছেন, সেই কথা। শ্রী বলিত, কত পর্বতের কথা, কত অরণ্যের কথা, কত বন্য পশুপক্ষী ফলমূলের কথা, কত যতি পরমহংস ব্রহ্মচারীর কথা, কত ধর্ম অধর্ম, কর্ম অকর্ম্মের কথা, কত পৌরাণিক উপন্যাসের কথা, কত দেশবিদেশী রাজার কথা, কত দেশাচার লোকাচারের কথা।
শুনিতে শুনিতে, সেই পৃথক আসনে বসিয়াও রাজার বড় বিপদ হইল! কথাগুলি বড় মনোমোহিনী। যে বলে, সে আরও মনোমোহিনী। আগুন ত জ্বলিয়াই ছিল, এবার ঘর পুড়িল। শ্রী ত চিরকালই মনোমোহিনী। যে শ্রী বৃক্ষবিটপে দাঁড়াইয়া আঁচল হেলাইয়া রণজয় করিয়াছিল, রূপে এ শ্রী তাহার অপেক্ষা অনেক গুণে রূপসী। শরীরের স্বাস্থ্য এবং মনের বিশুদ্ধি হইতেই রূপের বৃদ্ধি জন্মে;-শ্রীর শরীরের স্বাস্থ্য, এবং মনের বিশুদ্ধি শতগুণে বাড়িয়াছিল; তাই রূপও শতগুণে বাড়িয়াছিল। সদ্যঃপ্রস্ফুটিত প্রাতঃপুষ্পের যেমন পূর্ণ স্বাস্থ্য-কোথাও অপুষ্ট নয়, কোথাও অঙ্গহীন নয়, কোথাও বিবর্ণ নয়, কোথাও বিশুষ্ক নয়–সর্বত্র মসৃণ, সম্পূর্ণ, শীতল, সুবর্ণ,-শ্রীর তেমনই স্বাস্থ্য;-শরীর সম্পূর্ণ, সেই জন্য শ্রী প্রকৃতির মূর্তিমতী শোভা। তার পর চিত্ত প্রশান্ত, ইন্দ্রিয়ক্ষোভশূন্য, চিন্তাশূন্য, বাসনাশূন্য, ভক্তিময়, প্রীতিময়, দয়াময়,-কাজেই সেই সৌন্দর্য্যের বিকার নাই, কোথাও একটা দুঃখের রেখা নাই, একটু মাত্র ইন্দ্রিয়ভোগের ছায়া নাই, কোথাও চিন্তার চিহ্ন নাই, সর্বত্র সুমধুর সহাস্য, সুখময়-এ ভুবনেশ্বরী মূর্তির কাছে সে সিংহবাহিনী মূর্তি কোথায় দাঁড়ায়! তাহার পর সেই মনোমোহিনী কথা-নানা দেশের, নানা বিষয়ের, নানাবিধ অশ্রুতপূর্ব কথা, কখনও কৌতূহলের উদ্দীপক, কখনও মনোরঞ্জন, কখনও জ্ঞানগর্ভ-এই দুই মোহ একত্রে মিশিলে কোন্ অসিদ্ধ ব্যক্তির রক্ষা আছে? সীতারামের অনেক দিন ত আগুন জ্বলিয়াছিল, এখন ঘর পুড়িতে লাগিল। শ্রী হইতে সীতারামের সর্বনাশ হইল।
প্রথমে সীতারাম প্রত্যহ সায়াহ্নকালে চিত্তবিশ্রামে আসিতেন, প্রহরেক কথাবার্তা কহিয়া চলিয়া যাইতেন। তার পর ক্রমশঃ রাত্রি বেশী হইতে লাগিল। পৃথক আসন হউক, রাজা ক্ষুধা ও নিদ্রায় পীড়িত না হইলে সেখান হইতে ফিরিতেন না। ইহাতে কিছু কষ্ট বোধ হইতে লাগিল। সুতরাং সীতারাম, চিত্তবিশ্রামেই নিজের সায়াহ্ন আহার, এবং রাত্রিতে শয়নের ব্যবস্থা করিলেন। সে আহার বা শয়ন পৃথক্ গৃহে; শ্রীর বাঘছালের নিকটে ঘেঁষিতে পারিতেন না। ইহাতেও সাধ মিটিল না। প্রাতে রাজবাড়ী ফিরিয়া যাইতে দিন দিন বেলা হইতে লাগিল। শ্রীর সঙ্গে ক্ষণেক প্রাতেও কথাবার্তা না কহিয়া যাইতে পারিতেন না। যখন বড় বেলা হইতে লাগিল, তখন আবার মধ্যাহ্নিক আহারটাও চিত্তবিশ্রামেই হইতে লাগিল। রাজা আহারান্তে একটু নিদ্রা দিয়া, বৈকালে একবার রাজকার্যের জন্য রাজবাড়ী যাইতেন। তার পর কোন দিন যাইতেন, কোন দিন বা কথায় কথায় যাওয়া উচিত উঠিত না। শেষ এমন হইয়া উঠিল যে, যখন যাইতেন, কোন দিন বা কথায় কথায় যাওয়া ঘটিয়া উঠিত না। শেষ এমন হইয়া উঠিল যে, যখন যাইতেন, তখনই একটু ঘুরিয়া ফিরিয়া চলিয়া আসিতেন, চিত্তবিশ্রাম ছাড়িয়া তিষ্ঠিতেন না। চিত্তবিশ্রামেই রাজা বাস করিতে লাগিলেন, কখন কখন রাজভবনে বেড়াইতে যাইতেন।
এ দিকে চিত্তবিশ্রামে কাহারও কোন কার্যের জন্য আসিবার হুকুম ছিল না। চিত্তবিশ্রামের অন্তঃপুরে কীটপতঙ্গও প্রবেশ করিতে পারিত না। কাজেই রাজকার্যের সঙ্গে রাজার সম্বন্ধ প্রায় ঘুচিয়া উঠিল।
নবম পরিচ্ছেদ
রামচাঁদ ও শ্যামচাঁদ দুই জন নিরীহ গৃহস্থ লোক মহম্মদপুরে বাস করে। রামচাঁদের চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া, প্রদোষকালে, নিভৃতে তামাকুর সাহায্যে দুই জন কথোপকথন করিতেছিল। কিয়দংশ পাঠককে শুনিতে হইবে।
রা। ভাল ভায়া, বলিতে পার চিত্তবিশ্রামের আসল ব্যাপারটা কি?
শ্যা। কি জান, দাদা, ও সব রাজা–রাজড়ার হয়েই থাকে। আমাদের গৃহস্থ ঘরে কারই বা ছাড়া-তার আর রাজা-রাজড়ার কথায় কাজ কি? তবে আমাদের মহারাজকে ভাল বলতে হবে–মাত্রায় বড় কম। মোটে এই এ একটি।
রা। হাঁ, তা ত বটেই। তবে কি জান, আমাদের মহারাজা না কি সে রকম নয়, পরম ধার্মিক, তাই কথাটা জিজ্ঞাসা করি। বলি, এত কাল ত এ সব ছিল না।
শ্যা। রাজাও আর সে রকম নাই, লোকে ত বলে। কি জান, মানুষ চিরকাল এক রকম থাকে না। ঐশ্বর্য সম্পদ বাড়িলে, মনটাও কিছু এদিক ওদিক হয়! আগে আমরা রামরাজ্যে বাস করিতাম-ভূষণা দখল হ’য়ে অবধি কি আর তাই আছে?
রা। তা বটে। তা আমার যেন বোধ হয় যে, চিত্তবিশ্রামের কাণ্ডটা হ’য়ে অবধিই যেন বাড়াবাড়ি ঘটেছে। তা মহারাজকে এমন বশ করাও সহজ ব্যাপার নয়। মাগীও ত সামান্য নয়-কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসিল?
শ্যা। শুনেছি, সেটা না কি একটা ভৈরবী। কেউ কেউ বলে, সেটা ডাকিনী। ডাকিনীরা নানা মায়া জানে, মায়াতে ভৈরবী বেশ ধ’রে বেড়ায়। আবার কেউ বলে, তার একটা জোড়া আছে, সেটা উড়ে উড়ে বেড়ায়, তাকে বড় কেউ দেখিতে পায় না।
রাম। তবে ত বড় সর্বনাশ! রাজ্য পড়িল ডাকিনীর হাতে। এ রাজ্যের কি আর মঙ্গল আছে?
শ্যাম। গতিকে ত বোধ হয় না। রাজা ত আর রাজ-কর্ম দেখেন না। যা করেন তর্কালঙ্কার ঠাকুর। তা তিনি লড়াই ঝগড়ার কি জানেন? এ দিকে না কি নবাবি ফৌজ শীঘ্র আসিবে।
রাম। আসে, মৃণ্ময় আছে।
শ্যা। তুমিও যেমন দাদা! পরের কি কাজ! যার কর্ম তার সাজে, অন্য লোকের লাঠি বাজে। এই ত দেখলে, গঙ্গারাম দাস কি করলে!? আবার কে জানে, মৃণ্ময় বা কি করবে? সে যদি মুসমলানের সঙ্গে মিশে যায়, তবে আমরা দাঁড়াই কোথা? গোষ্ঠী শুদ্ধ জবাই হব দেখতে পাচ্চি।
রা। তা বটে। তাই একে একে সব সরিতে আরম্ভ করেছে বটে! সে দিন তিলক ঘোষেরা উঠে যশোর গেল, তখন বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম যে, কেন যাও? বলে, এখানে জিনিসপত্র মাগ্যি। এখনই ত আরও কয় ঘর আমাদের পাড়া হইতে উঠিয়া গিয়াছে।
শ্যাম। তা দাদা, তোমার কাছে বলচি, প্রকাশ করিও না, আমিও শিগগির সরবো।
রা। বটে! তা আমিই পড়ে জবাই হই কেন? তবে কি জান, এই সব বাড়ী-ঘর-দ্বার খরচপত্র করে করা গেছে, এখন ফেলে ঝেলে যাওয়া গরিব মানুষর বড় দায়।
শ্যা। তা কি করবে, প্রাণটা আগে, না বাড়ী–ঘর আগে? ভাল, রাজ্য বজায় থাকে, আবার আসা যাবে। ঘর–দ্বার ত পালাবে না।
দশম পরিচ্ছেদ
শ্রী। মহারাজ! তুমি ত সর্বদাই চিত্তবিশ্রামে। রাজ্য করে কে?
সী। তুমিই আমার রাজ্য। তোমাতে যত সুখ, রাজ্যে কি তত সুখ!
শ্রী। ছি! ছি! মহারাজ! এইজন্য কি হিন্দুসাম্রাজ্য স্থাপিত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলে? আমার কাছে হিন্দুসাম্রাজ্য খাটো হইয়া গেল, ধর্ম গেল, আমিই সব হইলাম! এই কি রাজা সীতারাম রায়?
সী। রাজ্য ত সংস্থাপিত হইয়াছে।
শ্রী। টিকিবে কি?
সী। ভাঙ্গে কার সাধ্য?
শ্রী। তুমিই ভাঙ্গিতেছ। রাজার রাজ্য, আর বিধবার ব্রহ্মচর্য সমান। যত্নে রক্ষা না করিলে থাকে না।
সী। কৈ, অরক্ষাও ত হইতেছে না।
শ্রী। তুমি কি রাজ্য রক্ষা কর? তোমাকে ত আমার কাছেই দেখি।
সী। আমি রাজকর্মে না দেখি, তা নয়। প্রায় প্রত্যহই রাজপুরীতে গিয়া থাকি। আমি এক দণ্ড দেখিলে যা হইবে, অন্যের সমস্ত দিনে তত হইবে না। তা ছাড়া, তর্কালঙ্কার ঠাকুর আছেন, মৃণ্ময় আছে, তাঁহারা সকলে কর্মে পটু। তাঁহারা থাকিতে কিছু না দেখিলেও চলে।
শ্রী। একবার ত তাঁহারা থাকিতে রাজ্য যাইতেছিল। দৈবাৎ তুমি সে রাত্রে না পৌঁছিলে, রাজ্য থাকিত না। আবার কেন তাঁহাদের উপর নির্ভর করিতেছ?
সী। আমি ত আছি। কোথাও যাই নাই। আবার বিপদ পড়ে, রক্ষা করিব।
শ্রী। যতক্ষণ এই বিশ্বাস থাকিবে, ততক্ষণ তুমি কোন যত্নই করিবে না। যত্ন ভিন্ন কোন কাজই সফল হয় না।
সী। যত্নের ত্রুটি কি দেখিলে?
শ্রী। আমি স্ত্রীজাতি, সন্ন্যাসী আমি রাজকার্য কি বুঝি যে, সে কথার উত্তর দিতে পারি! তবে একটা বিষয়ে মনে বড় শঙ্কা হয়। মুরশিদাবাদের সংবাদ পাইতেছেন কি? তোরাব খাঁ গেল, ভূষণা গেল, বারো ভুঁইঞা গেল, নবাব কি চুপ করিয়া আছে?
সী। সে ভাবনা করিও না। মুরশিদ কুলি যতক্ষণ মাল খাজনা ঠিক কিস্তি কিস্তি পাইবে, ততক্ষণ কিছু বলিবে না।
শ্রী। পাইতেছে কি?
সী। হাঁ, পাঠাইবার বন্দোবস্ত আছে বটে— তবে এবার দেওয়া যায় নাই, অনেক খরচপত্র হইয়াছে।
শ্রী। তবে সে চুপ করিয়া আছে কি?
সীতারাম মাথা হেঁট করিয়া কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। পরে বলিলেন, “সে কি করিবে, কি করিতেছে, তাহার কিছু সংবাদ পাই নাই |”
শ্রী। মহারাজ! চিত্তবিশ্রামে থাক বলিয়া সংবাদ লইতে ভুলিয়া গিয়াছ?
সীতারাম চিন্তামগ্ন হইয়া বলিলেন, “বোধ হয় তাই। শ্রী! তোমার মুখ দেখিলে আমি সব ভুলিয়া যাই |”
শ্রী। তবে আমার এক ভিক্ষা আছে। এ পোড়ার মুখ আবার লুকাইতে হইবে। নহিলে সীতারাম রায়ের নামে কলঙ্ক হইবে; ধর্মরাজ্য ছারেখারে যাইবে। আমায় হুকুম দাও, আমি বনে যাই।
সী। যা হয় হোক, আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি। হয় তোমায় ছাড়িতে হইবে, নয় রাজ্য ছাড়িতে হইবে। আমি রাজ্য ছাড়িব, তোমায় ছাড়িব না।
শ্রী। তবে তাহাই করুন। রাজ্য কোন উপযুক্ত লোকের হাতে দিন। তার পর সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া আমার সঙ্গে বনে চলুন।
সীতারাম চিন্তামগ্ন হইয়া রহিলেন। রাজার তখন ভোগলালসা অত্যন্ত প্রবলা। আগে হইলে সীতারাম রাজ্য ত্যাগ করিতে পারিতেন। এখন সে সীতারাম নাই; রাজ্যভোগে সীতারামের চিত্ত সমল হইয়াছে। সীতারাম রাজ্য ত্যাগ করিতে পারিলেন না।