একাদশ পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যার পর গুপ্তচর আসিয়া চন্দ্রচূড়কে সংবাদ দিল যে, ফৌজদারী সৈন্য দক্ষিণ পথে মহম্মদপুর আক্রমণে আসিতেছে।
চন্দ্রচূড় তখন মৃণ্ময় ও গঙ্গারামকে ডাকাইয়া পরামর্শ করিতে লাগিলেন। পরামর্শ এই স্থির হইল যে, মৃণ্ময় সৈন্য লইয়া সেই রাত্রিতে দক্ষিণ পথে যাত্রা করিবেন—যাহাতে যবনসেনা নদী পার হইতে না পারে, এমন ব্যবস্থা করিবেন।
এ দিকে রণসজ্জার ধুম পড়িয়া গেল। মৃণ্ময় পূর্ব হইতেই প্রস্তুত ছিলেন, তিনি সৈন্য লইয়া রাত্রিতেই দক্ষিণ পথে যাত্রা করিলেন। গড় রক্ষার্থ অল্প মাত্র সিপাহী রাখিয়া গেলেন। তাহারা গঙ্গারামের আজ্ঞাধীনে রহিল।
এই সকল গোলমালের সময়ে পাঠকের কি গরিব রমাকে মনে পড়ে? সকলের কাছে মুসলমানের সৈন্যগমনবার্তা যেমন পৌঁছিল, রমার কাছেও সেইরূপ পৌঁছিল। মুরলা বলিল, “মহারাণী, এখন বাপের বাড়ী যাওয়ার উদ্যোগ কর |”
রমা বলিল, “মরিতে হয় এইখানেই মরিব। কলঙ্কের পথে যাইব না। কিন্তু তুমি একবার গঙ্গারামের কাছে যাও। আমি মরি, এইখানেই মরিব, কিন্তু আমার ছেলেকে রক্ষা করিতে তিনি স্বীকৃত আছেন, তাহা স্মরণ করিয়া দিও। সময়ে আসিয়া যেন রক্ষা করেন। আমার সঙ্গে কিছুতেই আর সাক্ষাৎ হইবে না, তাহাও বলিও |”
রমা মনস্থির করিবার জন্য নন্দার কাছে গিয়া বসিয়া রহিল। পুরীমধ্যে কেহই সে রাত্রিতে ঘুমাইল না।
মুরলা আজ্ঞা পাইয়া গঙ্গারামের কাছে চলিল। গঙ্গারাম নিশীথকালে গৃহমধ্যে একাকী গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। রত্ন আশায় সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে তিনি প্রবৃত্ত—সাঁতার দিয়া আবার কূল পাইবেন কি? গঙ্গারাম সাহসে ভর করিয়াও এ কথার কিছু মীমাংসা করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। যে ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছু স্থির করিতে না পারে, তাহার শেষ ভরসা জগদীশ্বর। সে বলে, “জগদীশ্বর যা করেন |” কিন্তু গঙ্গারাম তাহাও বলিতে পারিতেছিলেন না-যে পাপকর্মে প্রবৃত্ত, সে জানে যে, জগদীশ্বর তার বিরুদ্ধ-জগতের বন্ধু তাহার শত্রু। অতএব গঙ্গারাম বড় বিষণ্ণ হইয়া চিন্তামগ্ন ছিলেন।
এমন সময়ে মুরলা আসিয়া দেখা দিল। রমার প্রেরিত সংবাদ তাঁহাকে বলিল।
গঙ্গারাম বলিল, “বলেন ত এখন গিয়া ছেলে নিয়া আসি |”
মু। তাহা হইবে না। যখন মুসলমান পুরীতে প্রবেশ করিবে, আপনি তখন গিয়া রক্ষা করিবেন, ইহাই রাণীর অভিপ্রায়।
গ। তখন কি হইবে, কে বলিতে পারে? যদি রক্ষার অভিপ্রায় থাকে তবে এই বেলা বালকটিকে আমাকে দিন।
মু। আমি তাহাকে লইয়া আসিব?
গ। না। আমার অনেক কথা আছে।
মু। আচ্ছা—পৌষ মাসে।
এই বলিয়া মুরলা হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। কিন্তু গঙ্গারামের গৃহ হইতে বাহির হইয়া রাজপথে উঠিতে না উঠিতে মুরলার সে হাসি হঠাৎ নিবিয়া গেল-ভয়ে মুখ কালি হইয়া উঠিল। দেখিল, সম্মুখে রাজপথে, প্রভাতশুক্রতারাবৎ সমুজ্জ্বলা ত্রিশূলধারিণী যুগলভৈরবীমূর্তি! মুরলা তাহাদিগকে শঙ্করীর অনুচারিণী ভাবিয়া ভূমিতে পড়িয়া প্রণাম করিয়া, জোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল।
একজন ভৈরবী বলিল, “তুই কে?”
মুরলা কাতরস্বরে বলিল, “আমি মুরলা |”
ভৈ। মুরলা কে?
মু। আমি ছোট রাণীর দাসী।
ভৈ। নগরপালের ঘরে এত রাত্রিতে কি করিতে আসিয়াছিলি?
মু। মহারাণী পাঠাইয়াছিলেন।
ভৈ। সম্মুখে এই দেবমন্দির দেখিতেছিস্?
মু। আজ্ঞা হাঁ।
ভৈ। আমাদের সঙ্গে উহার উপরে আয়।
মু। যে আজ্ঞা।
তখন দুই জন, মুরলাকে ত্রিশূলাগ্রমধ্যবর্ত্তিনী করিয়া মন্দিরমধ্যে লইয়া গেলেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কারের সে রাত্রিতে নিদ্রা নাই। কিন্তু সমস্ত রাত্রি নগর পরিভ্রমণ করিয়া দেখিয়াছেন যে, নগর রক্ষার কোন উদ্যোগই নাই। গঙ্গারামকে সে কথা বলায়, গঙ্গারাম তাঁহাকে কড়া কড়া বলিয়া হাঁকাইয়া দিয়াছিল। তখন তিনি অতিশয় অনুতপ্তচিত্তে কুশাসনে বসিয়া সর্বরক্ষাকর্তা বিপত্তিভঞ্জন মধুসূদনকে চিন্তা করিতেছিলেন। এমন সময়ে চাঁদশাহ ফকির আসিয়া গঙ্গারামের ভূষণাগমন বৃত্তান্ত তাঁহাকে জানাইল। শুনিয়া চন্দ্রচূড় শিহরিয়া উঠিলেন। একবার মনে করিতেছিলেন যে, জনকত সিপাহী লইয়া গঙ্গারামকে ধরিয়া আবদ্ধ করিয়া, নগর রক্ষার ভার অন্য লোককে দিবেন, কিন্তু ইহাও ভাবিলেন যে, সিপাহীরা তাঁহার বাধ্য নহে, গঙ্গারামের বাধ্য। অতএব সে সকল উদ্যম সফল হইবে না। মৃণ্ময় থাকিলে কোন গোল উপস্থিত হইত না, সিপাহীরা মৃণ্ময়ের আজ্ঞাকারী। মৃণ্ময়কে বাহিরে পাঠাইয়া তিনি এই সর্বনাশ উপস্থিত করিয়াছেন। ইহা বুঝিতে পারিয়াই তিনি এত অনুতাপপীড়িত হইয়া নিশ্চেষ্টবৎ কেবল অসুরনিসূদন হরির চিন্তা করিতেছিলেন। তখন সহসা সম্মুখে প্রফুল্লকান্তি ত্রিশূলধারিণী ভৈরবীকে দেখিলেন।
সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, তুমি কে?”
ভৈরবী বলিল, “বাবা! শত্রু, নিকটে এ পুরীর রক্ষার কোন উদ্যোগ নাই কেন? তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি |”
মুরলার সঙ্গে কথা কহিয়াছিল ও চন্দ্রচূড়ের সঙ্গে কথা কহিতেছে, জয়ন্তী।
প্রশ্ন শুনিয়া চন্দ্রচূড় বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, তুমি কি এই নগরের রাজলক্ষ্মী?”
জ। আমি যে হই, আমার কথার উত্তর দাও। নহিলে মঙ্গল হইবে না।
চ। মা! আমার সাধ্য আর কিছু নাই। রাজা নগররক্ষকের উপর নগর রক্ষার ভার দিয়াছিলেন, নগররক্ষক নগর রক্ষা করিতেছে না। সৈন্য আমার বশ নহে। আমি কি করিব, আজ্ঞা করুন।
জ। নগররক্ষকের সংবাদ আপনি কিছু জানেন? কোন প্রকার অবিশ্বাসিতা শুনেন নাই?
চ। শুনিয়াছি। তিনি তোরাব খাঁর নিকট গিয়াছিলেন। বোধ হয় তাঁহাকে নগর সমর্পণ করিবেন। আমার দুর্বুদ্ধিবশতঃ আমি তাহার কোন উপায় করি নাই। মা! বোধ করিতেছি, আপনি এই নগরীর রাজলক্ষ্মী। দয়া করিয়া এ দাসকে ভৈরবীবেশে দর্শন দিয়াছেন। মা! আপনি অপরিম্লানতেজস্বিনী হইয়া আপনার পুরী রক্ষা করুন।
এই বলিয়া চন্দ্রচূড় কৃতাঞ্জলিপুটে ভক্তিভাবে জয়ন্তীকে প্রণাম করিলেন।
“তবে আমিই এই পুরী রক্ষা করিব |” এই বলিয়া জয়ন্তী প্রস্থান করিল। চন্দ্রচূড়ের মনে ভরসা হইল।
জয়ন্তীও আশার অতিরিক্ত ফললাভ হইয়াছিল। শ্রী বাহিরে ছিল। তাহাকে সঙ্গে লইয়া জয়ন্তী গঙ্গারামের গৃহাভিমুখে চলিল।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
মুরলা চলিয়া গেলে, গঙ্গারাম চারিদিকে আরও অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। যাহার জন্য তিনি বিপদ সাগরে ঝাঁপ দিতেছেন, সে ত তাঁহার অনুরাগিণী নয়। তিনি চক্ষু বুজিয়া সমুদ্রমধ্যে ঝাঁপ দিতেছেন, সমুদ্রতলে রত্ন মিলিবে কি? না, ডুবিয়া মরাই সার হইবে? আঁধার! চারিদিকে আঁধার! এখন কে তাঁকে উদ্ধার করিবে?
সহসা গঙ্গারামের শরীর রোমাঞ্চিত হইল। দেখিলেন, দ্বারদেশে প্রভাতনক্ষত্রোজ্জ্বলরূপিণী ত্রিশূলধারিণী ভৈরবীমূর্তি। অঙ্গপ্রভায় গৃহস্থিত প্রদীপের জ্যোতি ম্লান হইয়া গেল। সাক্ষাৎ ভবানী ভূতলে অবতীর্ণা মনে করিয়া, গঙ্গারামও মুরলার ন্যায় প্রণত হইয়া জোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল। বলিল, “মা, দাসের প্রতি কি আজ্ঞা?”
জয়ন্তী বলিল, “বাছা! তোমার কাছে কিছু ভিক্ষার জন্য আসিয়াছি |”
ভৈরবীর কথা শুনিয়া গঙ্গারাম বলিল, “মা! আপনি যাহা চাহিবেন, তাহাই দিব। আজ্ঞা করুন |”
জ। আমাকে এক গাড়ি গোলা-বারুদ দাও। আর একজন ভাল গোলন্দাজ দাও।
গঙ্গারাম ইতস্ততঃ করিতে লাগিল—কে এ? জিজ্ঞাসা করিল, “মা! আপনি গোলা-বারুদ লইয়া কি করিবেন?”
জ। দেবতার কাজ।
গঙ্গারামের মনে সন্দেহ হইল। এ যদি কোন দেবী হইবে, তবে গোলা-বারুদ ইহার প্রয়োজন হইবে কেন? যদি মানুষী হয়, তবে ইহাকে গোলা-গুলি দিব কেন? কাহার চর তা কি জানি? এই ভাবিয়া গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিল, “মা! তুমি কে?”
জ। আমি যে হই, রমা ও মুরলা ঘটিত সংবাদ আমি সব জানি। তা ছাড়া তোমার ভূষণাগমন-সংবাদ ও সেখানকার কথাবার্তার সংবাদ আমি জানি। আমি যাহা চাহিতেছি, তাহা এই মুহূর্তে আমাকে দাও, নচেৎ এই ত্রিশূলাঘাতে তোমাকে বধ করিব।
এই বলিয়া সেই তেজস্বিনী ভৈরবী উজ্জ্বল ত্রিশূল উত্থিত করিয়া আন্দোলিত করিল।
গঙ্গারাম একেবারে নিবিয়া গেল। “আসুন দিতেছি |” বলিয়া ভৈরবীকে সঙ্গে করিয়া অস্ত্রাগারে গেল। জয়ন্তী যাহা যাহা চাহিল, সকলই দিল, এবং পিয়ারীলাল নামে একজন গোলন্দাজকে সঙ্গে দিল। জয়ন্তীকে বিদায় দিয়া গঙ্গারাম দুর্গদ্বার বন্ধ রাখিতে আজ্ঞা দিলেন। যেন তাঁহার বিনানুমতিতে কেহ যাইতে আসিতে না পারে।
জয়ন্তী ও শ্রী গোলা—বারুদ লইয়া, গড়ের বাহির হইয়া যেখানে রাজবাড়ীর ঘাট সেইখানে উপস্থিত হইল। দেখিল, এক উন্নতবপু সুন্দরকান্তি পুরুষ তথা বসিয়া আছেন।
দুই জন ভৈরবীর মধ্য একজন ভৈরবী বারুদ, গোলার গাড়ি ও গোন্দাজকে সঙ্গে লইয়া কিছু দূরে গিয়া দাঁড়াইল, আর একজন সেই কান্তিমান পুরুষের নিকট গিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”
সে বলিল, “আমি যে হই না। তুমি কে?”
জয়ন্তী বলিল, “যদি তুমি বীরপুরুষ হও, এই গোলাগুলি আনিয়া দিতেছি—এই পুরী রক্ষা কর |”
সে পুরুষ বিস্মিত হইল, দেবতাক্রমে জয়ন্তীকে প্রণাম করিল। কিছুক্ষণ ভাবিয়া, দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। বলিল, “তাতেই বা কি?”
জ। তুমি কি চাও?
পুরুষ। যা চাই, পুরী রক্ষা করিলে তা পাইব?
জ। পাইবে।
এই বলিয়া জয়ন্তী সহসা অদৃশ্য হইল।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
বলিয়াছি, চন্দ্রচূড় ঠাকুরের সে রাত্রিতে ঘুম হইল না। অতি প্রত্যূষে তিনি রাজপ্রাসাদের উচ্চ চূড়ে উঠিয়া চারি দিক নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। দেখিলেন, নদীর অপর পারে, ঠিক তাঁহার সম্মুখে, বহুসংখ্যক নৌকা একত্র হইয়াছে। তীরে অনেক লোকও আছে বোধ হইতেছে, কিন্তু তখনও তেমন ফরসাি হয় নাই, বোঝা গেল না যে, তাহারা কি প্রকারের লোক। তখন তিনি গঙ্গারামকে ডাকিতে পাঠাইলেন।
গঙ্গারাম আসিয়া সেই অট্টালিকাশিখরদেশে উপস্থিত হইল। চন্দ্রচূড় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও পারে অত নৌকা কেন?”
গঙ্গারাম নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “কি জানি?”
চ। দেখ, তীরে বিস্তর লোক। এত নৌকা, এত লোক কেন?
গ। বলিতে ত পারি না।
কথা কহিতে কহিতে বেশ আলো হইল। তখন বোধ হইল, ঐ লোক সৈনিক। চন্দ্রচূড় বলিলেন, “গঙ্গারাম! সর্বনাশ হইয়াছে। আমাদের চর আমাদের প্রতারণা করিয়াছে। অথবা সেই প্রতারিত হইয়াছে। আমরা দক্ষিণ পথে সৈন্য পাঠাইলাম, কিন্তু ফৌজদারের সেনা এই পথে আসিয়াছে। সর্বনাশ হইল। এখন রক্ষা করে কে?”
গ। কেন, আমি আছি কি করিতে?
চ। তুমি এই কয় জন মাত্র দুর্গরক্ষক লইয়া এই অসংখ্য সেনার কি করিবে? আর তুমিও দুর্গরক্ষার কোন উদ্যোগ করিতেছ না। কাল বলিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে কড়া কড়া শুনাইয়াছিলে। এখন কে দায় ভার ঘাড়ে করে?
গঙ্গা। অত ভয় পাইবেন না। ও পারে যে ফৌজ দেখিতেছেন, তাহা অসংখ্য নয়। এই কয়খানা নৌকায় কয় জন সিপাহী পার হইতে পারে? আমি তীরে গিয়া ফৌজ লইয়া দাঁড়াইতেছি। উহারা যেমন তীরে আসিবে, অমনি উহাদিগকে টিপিয়া মারিব।
গঙ্গারামের অভিপ্রায়, সেনা লইয়া বাহির হইবেন, কিন্তু এখন নয়, আগে ফৌজদারের সেনা নির্বিঘ্নে পার হউক। তার পর তিনি সেনা লইয়া দুর্গদ্বার খুলিয়া বাহির হইবেন, মুক্ত দ্বার পাইয়া মুসলমানেরা নির্বিঘ্নে গড়ের ভিতর প্রবেশ করিবে। তিনি কোন আপত্তি করিবেন না। কাল যে মূর্তিটা দেখিয়াছিলেন, সেটা কি বিভীষিকা! কৈ, তার আর কিছু প্রকাশ নাই।
চন্দ্রচূড় সব বুঝিলেন। তথাপি বলিলেন, “তবে শীঘ্র যাও। সেনা লইয়া বাহির হও। বিলম্ব করিও না। নৌকা সকল সিপাহী বোঝাই লইয়া ছাড়িতেছে |”
গঙ্গারাম তখন তাড়াতাড়ি ছাদের উপর হইতে নামিল। চন্দ্রচূড় সভয়ে দেখিতে লাগিলেন যে, প্রায় পঞ্চাশখানা নৌকায় পাঁচ ছয় শত মুসলমান সিপাহী এক শ্রেণীবদ্ধ হইয়া যাত্রা করিল। তিনি অতিশয় অস্থির হইয়া দেখিতে লাগিলেন, কতক্ষণে গঙ্গারাম সিপাহী লইয়া বাহির হয়। সিপাহী সকল সাজিতেছে, ফিরিতেছে, ঘুরিতেছে, সারি দিতেছে-কিন্তু বাহির হইতেছে না। চন্দ্রচূড় তখন ভাবিলেন, “হায়! হায়! কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি-কেন গঙ্গারামকে বিশ্বাস করিয়াছিলাম! এখন সর্বনাশ হইল। কৈ, সেই জ্যোতির্ম্ময়ী রাজলক্ষ্মীই বা কৈ? তিনিও কি ছলনা করিলেন?” চন্দ্রচূড় গঙ্গারামের সন্ধানে আসিবার অভিপ্রায়ে সৌধ হইতে অবতরণ করিবার উপক্রম করিতেছিলেন, এমন সময়ে গুড়ুম্ করিয়া এক কামানের আওয়াজ হইল। মুসলমানের নৌকাশ্রেণী হইতে আওয়াজ হইল, এমন বোধ হইল না। তাহাদের সঙ্গে কামান আছে, বোধ হইতেছিল না। চন্দ্রচূড় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন, মুসলমানের কোন নৌকায় কামানের ধূঁয়া দেখা যায় না। চন্দ্রচূড় সবিস্ময়ে দেখিলেন, যেমন কামানের শব্দ হইল, অমনি মুসলমানদিগের একখানি নৌকা জলমগ্ন হইল; আরোহী সিপাহীরা সন্তরণ করিয়া অন্য নৌকায় উঠিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
“তবে কি এ আমাদের তোপ!”
এই ভাবিয়া চন্দ্রচূড় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, একটি সিপাহীও গড় হইতে বাহির হয় নাই। দুর্গপ্রাকারে, যেখানে তোপ সকল সাজান আছে, সেখানে একটি মনুষ্যও নাই। তবে এ তোপ ছাড়িল কে?
কোনও দিকে ধূম দেখা যায় কি না, ইহা লক্ষ্য করিবার জন্য চন্দ্রচূড় চারি দিকে চাহিতে লাগিলেন,-দেখিলেন, গড়ের সম্মুখে যেখানে রাজবাটীর ঘাট, সেইখান হইতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ধূমরাশি আকাশমার্গে উঠিয়া পবন-পথে চলিয়া যাইতেছে।
তখন চন্দ্রচূড়ের স্মরণ হইল যে, ঘাটের উপরে, গাছের তলায় একটা তোপ আছে। কোন শত্রুর নৌকা আসিয়া ঘাটে না লাগিতে পারে, এ জন্য সীতারাম সেখানে একটা কামান রাখিয়াছিলেন-কেহ এখন সেই কামান ব্যবহার করিতেছে, ইহা নিশ্চিত। কিন্তু সে কে? গঙ্গারামের একটি সিপাহীও বাহির হয় নাই-এখনও ফটক বন্ধ। মৃণ্ময়ের সিপাহীরা অনেক দূর চলিয়া গিয়াছে। মৃণ্ময় যে কোন সিপাহী ঐ কামানের জন্য রাখিয়া যাইবেন, ইহা অসম্ভব; কেন না, দুর্গরক্ষার ভার গঙ্গারামের উপর আছে। কোন বাজে লোক আসিয়া কামান ছাড়িল-ইহাও অসম্ভব; কেন না, বাজে লোকে গোলা-বারুদ কোথা পাইবে? আর এরূপ অব্যর্থ সন্ধান-বাজে লোকের হইতে পারে না-শিক্ষিত গোলন্দাজের। কার এ কাজ? চন্দ্রচূড় এইরূপ ভাবিতেছিলেন, এমন সময়ে আবার সেই কামান বজ্রনাদে চতুর্দিক শব্দিত করিল-আবার ধূমরাশি আকাশে উঠিয়া নদীর উপরিস্থ বায়ুস্তরে গগন বিচরণ করিতে লাগিল-আবার মুসলমান সিপাহীপরিপূর্ণ আর একখানি নৌকা জলমগ্ন হইল।
“ধন্য! ধন্য!” বলিয়া চন্দ্রচূড় করতালি দিতে লাগিলেন। নিশ্চিত এই সেই মহাদেবী! বুঝি কালিকা সদয় হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছেন। জয় লক্ষ্মীনারায়ণজী! জয় কালী! জয় পুররাজলক্ষ্মী! তখন চন্দ্রচূড় সভয়ে দেখিলেন যে, যে সকল নৌকা অগ্রবর্তী হইয়াছিল-অর্থাৎ যে সকল নৌকার সিপাহীদের গুলি তীর পর্যন্ত পৌঁছিবার সম্ভাবনা, তাহারা তীর লক্ষ্য করিয়া বন্দুক চালাইতে লাগিল। ধূমে সহসা নদীবক্ষ অন্ধকার হইয়া উঠিল-শব্দে কান পাতা যায় না। চন্দ্রচূড় ভাবিলেন, “যদি আমাদের রক্ষক দেবতা হয়েন-তবে এ গুলিবৃষ্টি তাঁহার কি করিবে? আর যদি মনুষ্য হয়েন, তবে আমদের জীবন এই পর্যন্ত-এ লোহাবৃষ্টিতে কোন মনুষ্যই টিকিবে না |”
কিন্তু আবার সেই কামান ডাকিল-আবার দশ দিক্ কাঁপিয়া উঠিল-ধূমের চক্রে চক্রে ধূমাকার বাড়িয়া গেল। আবার সসৈন্য নৌকা ছিন্ন ভিন্ন হইয়া ডুবিয়া গেল।
তখন এক দিকে-এক কামান-আর এক দিকে শত শত মুসলমান সেনায় তুমুল সংগ্রাম বাধিয়া গেল। শব্দে আর কান পাতা যায় না। উপর্যুপরি গম্ভীর, তীব্র, ভীষণ, মুহুর্মুহুঃ ইন্দ্রহস্তপরিত্যক্ত বজ্রের মত, সেই কামান ডাকিতে লাগিল,-প্রশস্ত নদীবক্ষ এমন ধূমাচ্ছন্ন হইল যে, চন্দ্রচূড় সেই উচ্চ সৌধ হইতে উত্তালতরঙ্গসংক্ষুব্ধ ধূমসমুদ্র ভিন্ন আর কিছু দেখিতে পাইলেন না। কেবল সেই তীব্রনদী বজ্রনাদে বুঝিতে পারিলেন যে, এখনও হিন্দুধর্মরক্ষিণী দেবী জীবিতা আছেন। চন্দ্রচূড় তীব্রদৃষ্টিতে ধূমসমুদ্রের বিচ্ছেদ অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন-এই আশ্চর্য্য সমরের ফল কি হইল-দেখিবেন।
ক্রমে শব্দ কম পড়িয়া আসিল-একটু বাতাস উঠিয়া ধূঁয়া উড়াইয়া লইয়া গেল-তখন চন্দ্রচূড় সেই জলময় রণক্ষেত্র পরিষ্কার দেখিতে পাইলেন। দেখিলেন যে, ছিন্ন, নিমগ্ন নৌকা সকল স্রোতে উলটি পালটি করিয়া ভাসিয়া চলিয়াছে। মৃত ও জীবিত সিপাহীর দেহে নদীস্রোত ঝটিকাশান্তির পর পল্লবকুসুমাকীর্ণ উদ্যানবৎ দৃষ্ট হইতেছে-কাহারও অস্ত্র, কাহারও বস্ত্র, কাহারও বাদ্য, কাহারও উষ্ণীষ, কাহারও দেহ ভাসিয়া যাইতেছে-কেহ সাঁতার দিয়া পলাইতেছে-কাহাকেও কুম্ভীরে গ্রাস করিতেছে। যে কয়খানা নৌকা ডোবে নাই-সে কয়খানা, নাবিকেরা প্রাণপাত করিয়া বাহিয়া সিপাহী লইয়া অপর পারে পলায়ন করিয়াছে। একমাত্র বজ্রের প্রহারে আহতা আসুরী সেনার ন্যায় মুসলমান সেনা রণে ভঙ্গ দিয়া পলাইল।
দেখিয়া চন্দ্রচূড় হাতজোড় করিয়া ঊর্ধ্বমুখে, গদ্গদকণ্ঠে, সজলনয়নে বলিলেন, “জয় জগদীশ্বর! জয় দৈত্যদমন, ভক্ততারণ, ধর্মরক্ষণ হরি! আজ বড় দয়া করিলে! আজ তুমি স্বয়ং সশরীরে যুদ্ধ করিয়াছ, নহিলে এই পুররাজলক্ষ্মী স্বয়ং যুদ্ধ করিয়াছেন, নহিলে তোমার দাসানুদাস সীতারাম আসিয়াছে। তোমার সেই ভক্ত ভিন্ন এ যুদ্ধ মনুষ্যের সাধ্য নহে |”
তখন চন্দ্রচূড় প্রাসাদশিখর হইতে অবতরণ করিলেন।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কামানের বন্দুকের হুড়মুপড় দুড়মুড়ি শুনিয়া গঙ্গারাম মনে ভাবিল—এ আবার কি? লড়াই কে করে? সেই ডাকিনী নয় ত? তিনি কি দেবতা? গঙ্গারাম এক জন জমাদ্দারকে দেখিতে পাঠাইলেন। জমাদ্দার নিষ্ক্রান্ত হইল। সে দিন, সেই প্রথম ফটক খোলা হইল।
জমাদ্দার ফিরিয়া গিয়া নিবেদন করিল, “মুসলমান লড়াই করিতেছে |”
গঙ্গারাম বিরক্ত হইয়া বলিল, “তা ত জানি। কার সঙ্গে মুসলমান লড়াই করিতেছে?”
জমাদ্দার বলিল, “কারও সঙ্গে নহে |”
গঙ্গারাম হাসিল, “তাও কি হয় মূর্খ! তোপ কার?”
জ। হুজুর, তোপ কারও না।
গঙ্গারাম বড় রাগ করিল। বলিল, “তোপের আওয়াজ শুনিতেছিস না?”
জ। তা শুনিতেছি।
গ। তবে? সে তোপ কে দাগিতেছে?
জ। তাহা দেখিতে পাই নাই।
গ। চোখ কোথা ছিল?
জ। সঙ্গে।
গ। তবে তোপ দেখিতে পাও নাই কেন?
জ। বটে! কে আওয়াজ করিতেছে?
জ। গাছের ডাল।
গ। তুই কি ক্ষেপিয়াছিস? গাছের ডালে তোপ দাগে?
জ। সেখানে আর কাহাকে দেখিতে পাইলাম না-কেবল কতকগুলা গাছের ডাল তোপ ঢাকিয়া নুঙিয়া পড়িয়া আছে দেখিলাম।
গ। তবে কেহ ডাল নোঙাইয়া বাঁধিয়া তাহার আশ্রয়ে তোপ দাগিতেছে। সে বুদ্ধিমান সন্দেহ নাই। সিপাহীরা তাহাকে লক্ষ্য করিতে পারিবে না, কিন্তু সে পাতার আড়াল হইতে তাহাদের লক্ষ্য করিবে। ডালের ভিতর কে আছে, তা দেখে এলি না কেন?
জমা। সেখানে কি যাওয়া যায়?
গ। কেন?
জ। সেখানে বৃষ্টির ধারার মত গুলি পড়িতেছে।
গ। গুলিতে এত ভয় ত এ কাজে এসেছিলি কেন?
তখন গঙ্গারাম অনুচরকে হুকুম দিল যে, জমাদ্দারের পাগড়ি পোষাক কাপড় সব কাড়িয়া লয়। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখিয়া মৃণ্ময় বাছা বাছা জনকত হিন্দুস্থানীকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, এবং দুর্গরক্ষার জন্য তাহাদের রাখিয়া গিয়াছিলেন। গঙ্গারাম তাহাদিগের মধ্যে চারি জনকে আদেশ করিল, “যেখানে ঘাটের উপর তোপ আছে, সেইখানে যাও। যে কামান ছাড়িতেছে, তাহাকে ধরিয়া আন |”
সেই চারি জন সিপাহী যখন তোপের কাছে আসিল, তখন যুদ্ধ শেষ হইয়াছে, হতাবশিষ্ট মুসলমানেরা বাহিয়া পলাইয়া যাইতেছে। সিপাহীরা গাছের ডালের ভিতর গিয়া দেখিল-তোপের কাছে এক জন মানুষ মরিয়া পড়িয়া আছে-আর এক জন জীবিত, পলিতা হাতে করিয়া বসিয়া আছে। সে খুব জোওয়ান, ধুতি মালকোঁচা মারা, মাথায় মুখে গালচাল্লা বাঁধা; সর্বাঙ্গে বারুদে আর ছাইয়ে কালো হইয়া আছে। চারি জন আসিয়া তাহাকে ধরিল। বলিল, “তোম কোন হো রে?”
সে বলিল, “কেন বাপু!”
“তোম্ কাহে হিঁয়া বৈঠ বৈঠকের তোপ ছোড়তে হো?”
“কেন বাপু, তাতে কি দোষ হয়েছে? মুসলমানের সঙ্গে তোমরা মিলেছ?”
“আরে মুসলমান আনেসে হমলোক আভি হাঁকায় দেতে-তোম কাহেকো দিক কিয়ে হো? চল হুজুরমে যানে হোগা |”
“কার কাছে যাব?”
“কোতোয়াল সাহেবকি হুকুমসে তোমকো উনকাল পাশ লে যাঙ্গে |”
“আচ্ছা যাই। আগে নেড়েরা বিদায় হোক। যতক্ষণ ওদের মধ্যে এক জনকে ও পারে দেখা যাইবে, ততক্ষণ তোরা কি, তোদের কোতোয়াল এলে উঠিব না। ততক্ষণ দেখ দেখি, যে মানুষটা মরিয়া আছে, ও কে চিনিতে পারিস কি না?”
সিপাহীরা দেখিয়া বলিল, “হাঁ, হামলোক ত ইস্কো পহচান্ তে হেঁ। য়ে ত হামারা গোলন্দাজ পিয়ারীলাল হৈঁ—য়ে কাঁহাসে আয়া?”
“তবে আগে ওকে গড়ের ভিতর নিয়ে যা-আমি যাচ্ছি |”
সিপাহীরা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল, “য়ে আদমি ত আচ্ছা বোলতা হৈ। যো তোপকাদ পাশ রহেগা, ওসিকো লে যানেগো হুকুম হৈ। এই মুরদার তোপকাআ পাশ হৈ-উসকো আলবৎ লে যানে হোগা |”
কিন্তু মড়া—হিন্দু সিপাহীরা ছুঁইবে না। তখন পরামর্শ করিয়া একজন সিপাহী ডোম ডাকিতে লাগিল-আর তিন জন তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।
এ দিকে কালি বারুদ মাখা পুরুষ, ক্রমে ক্রমে দেখিলেন যে, মুসলমান সিপাহীরা সব তীরে গিয়া উঠিল। তখন তিনি সিপাহীদিগকে বলিলেন, “চল বাবা, তোমাদের কোতোয়াল সাহেবকে সেলাম করি গিয়া চল |” সিপাহীরা সে ব্যক্তিকে ধরিয়া লইয়া চলিল।
সেই সমবেত সজ্জিত দুর্গরক্ষক সৈন্যমণ্ডলীমধ্যে যেখানে ভীত নাগরিকগণ পিপীলিকাশ্রেণীবৎ সারি দিয়া দাঁড়াইয়া আছে-সেইখানে সিপাহীরা সেই কালিমাখা বারুদমাখা পুরুষকে আনিয়া খাড়া করিল।
তখন সহসা জয়ধ্বনিতে আকাশ পুরিয়া উঠিল। সেই সমবেত সৈনিক ও নাগরিকমণ্ডলী, একেবারে সহস্র কণ্ঠে গর্জন করিল, “জয় মহারাজের জয় |”
“জয় মহারাজাধিরাজকি জয় |”
“জয় শ্রীসীতারামরায় রাজা বাহাদুরকি জয় |”
“জয় লক্ষ্মীনারায়ণজীকি জয় |”
চন্দ্রচূড় দ্রুত আসিয়া বারুদমাখা মহাপুরুষকে আলিঙ্গন করিলেন; বারুদমাখা পুরুষও তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন। চন্দ্রচূড় বলিলেন, “সমর দেখিয়া আমি জানিয়াছি, তুমি আসিয়াছ। মনুষ্যলোকে তুমি ভিন্ন এ অব্যর্থ সন্ধান আর কাহারও নাই। এখন অন্য কথার আগে গঙ্গারামকে বাঁধিয়া আনিতে আজ্ঞা দাও |”
সীতারাম সেই আজ্ঞা দিলেন। গঙ্গারাম সীতারামকে দেখিয়া সরিয়া পড়িতেছিল, কিন্তু শীঘ্র ধৃত হইয়া সীতারামের আজ্ঞাক্রমে কারাবদ্ধ হইল।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
সীতারাম, তখন সিপাহীদিগকে দুর্গপ্রাকারস্থিত তোপ সকলের নিকট, এবং অন্যান্য উপযুক্ত স্থানে অবস্থিত করিয়া এবং মৃণ্ময়ের সম্বন্ধে সংবাদ আনিবার জন্য লোক পাঠাইয়া স্বয়ং স্নানাহ্নিকে গমন করিলেন। স্নানাহ্নিকের পর, চন্দ্রচূড় ঠাকুরের সঙ্গে নিভৃতে কথোপকথন করিতে লাগিলেন। চন্দ্রচূড় বলিলেন, “মহারাজ! আপনি কখন আসিয়াছেন, আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই। একাই বা কেন আসিলেন? আপনার অনুচরবর্গই বা কোথায়? পথে কোন বিপদ ঘটে নাই ত?”
সী। সঙ্গীদিগকে পথে রাখিয়া আমি একা আগে আসিয়াছি। আমার অবর্তমানে নগরের কিরূপ অবস্থা, তাহা জানিবার জন্য ছদ্মবেশে একা রাত্রিকালে আসিয়াছিলাম। দেখিলাম, নগর সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত। কেন, তাহা এখন কতক কতক বুঝিয়াছি। পরে দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিতে গিয়া দেখিলাম, ফটক বন্ধ। দুর্গে প্রবেশ না করিয়া, প্রভাত নিকট দেখিয়া নদীতীরে গিয়া দেখিলাম, মুসলমান সেনা নৌকায় পার হইতেছে। দুর্গরক্ষকেরা রক্ষার কোন উদ্যোগই করিতেছে না দেখিয়া, আপনার যাহা সাধ্য, তাহা করিলাম।
চন্দ্র। যাহা করিয়াছেন, তাহা আপনারই সাধ্য, অপরের নহে। এত গোলা বারুদ পাইলেন কোথা?
সী। এক দেবী সহায় হইয়া আমাকে গোলাবারুদ এবং গোলন্দাজ আনিয়া দিয়াছিলেন।
চ। দেবী? আমিও তাঁহার দর্শন পাইয়াছিলাম। তিনি এই পুরীর রাজলক্ষ্মী। তিনি কোথায় গেলেন?
সী। তিনি আমাকে গোলা-বারুদ এবং গোলন্দাজ দিয়া অন্তর্দ্ধান হইয়াছেন।
শেষে বলিলেন, “এক্ষণে এ কয় মাসের সংবাদ আমাকে বলুন।
তখন চন্দ্রচূড় সকল বৃত্তান্ত,ল যতদূর তিনি জানিতেন আনুপূর্বিক বিবৃত করিলেন।
শেষে বলিলেন এখানে যে জন্য দিল্লী গিয়াছিলেন, তাহার সুসিদ্ধির সংবাদ বলুন |”
সী। কার্যসিদ্ধি হইয়াছে। বাদশাহের আমি কোন উপকার করিতে পারিয়াছিলাম। তাহাতে তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট হইয়া দ্বাদশ ভৌমিকের উপর আধিপত্য প্রদান করিয়া মহারাজাধিরাজ নাম দিয়া সনন্দ দিয়াছেন। এক্ষণে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, ফৌজদারের সঙ্গে বিরোধ উপস্থিত হইযাছে। কেন না, ফৌজদার সুবাদারের অধীন, এবং সুবাদার বাদশাহের অধীন। অতএব ফৌজদারের সঙ্গে বিরোধ করিলে, বাদশাহের সঙ্গেই বিরোধ করা হইল। যিনি আমাকে এতদূর অনুগৃহীত করিয়াছেন, তাঁহার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা নিতান্ত কৃতঘ্নের কাজ। আত্মরক্ষা সকলেরই কর্তব্য। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য ভিন্ন ফৌজদারের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার অকর্তব্য। অতএব এ বিরোধ আমার বড় দুরদৃষ্ট বিবেচনা করি।
চ। ইহা আমাদিগের শুভাদৃষ্ট-হিন্দু মাত্রেরই শুভাদৃষ্ট; কেন না, আপনি মুসলমানের প্রতি সম্প্রীত হইলে, মুসলমান হইতে হিন্দুকে রক্ষা করিবে কে? হিন্দুধর্ম আর দাঁড়াইবে কোথায়? ইহা আপনারও শুভাদৃষ্ট; কেন না, যে হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ধার করিবে, সেই মনুষ্যমধ্যে কৃতী ও সৌভাগ্যশালী।
সী। মৃণ্ময়ের সংবাদ না পাইলে, কি কর্তব্য, কিছুই বলা যায় না।
সন্ধ্যার পর মৃণ্ময়ের সংবাদ আসিল। পীর বক্স্ক খাঁ নামে ফৌজদারী সেনাপতি অর্ধেক ফৌজদারী সৈন্য লইয়া আসিতেছিলেন, অর্ধেক পথে মৃণ্ময়ের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ ও যুদ্ধ হয়। মৃণ্ময়ের অসাধারণ সাহস ও কৌশলে তিনি সসৈন্যে পরাজিত ও নিহত হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে শয়ন করেন। বিজয়ী মৃণ্ময় সসৈন্যে ফিরিয়া আসিতেছেন।
শুনিয়া চন্দ্রচূড় সীতারামকে বলিলেন, “মহারাজ! আর দেখেন কি? এই সময়ে বিজয়ী সেনা লইয়া নদী পার হইয়া গিয়া ভূষণা দখল করুন |”
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
জ বলিল, “শ্রী! আর দেখ কি? এক্ষণে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ কর |”
শ্রী। সেই জন্যই কি আসিয়াছি?
জ। যত প্রকার মনুষ্য আছে, রাজর্ষিই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। রাজাকে রাজর্ষি কর না কেন? শ্রী। আমার কি সাধ্য?
জ। আমি বুঝি যে, তোমা হইতেই এই মহৎকার্যসিদ্ধ হইতে পারে। অতএব যাও, শীঘ্র গিয়া রাজা সীতারামকে প্রণাম কর।
শ্রী। জয়ন্তী! সোলা জলে ভাসে বটে, কিন্তু খাটো দড়িতে পাথরে বাঁধিয়া দিলে সোলাও ডুবিয়া যায়। আবার কি ডুবিয়া মরিব?
জয়ন্তী। কৌশল জানিলে মরিতে হয় না। ডুবুরিরা সমুদ্রে ডুব দেয়-কিন্তু মরে না, রত্ন তুলিয়া আনে।
শ্রী। আমার সে সাধ্য আছে, আমার এমন ভরসা হইতেছে না। অতএব এক্ষণে আমি রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিব না। কিছু দিন না হয় এইখানে থাকিয়া আপনার মন বুঝিয়া দেখি, যদি দেখি, আমার চিত্ত এখন অবশ, সাক্ষাৎ না করিয়াই এ দেশ ত্যাগ করিয়া যাইব স্থির করিয়াছি।
অতএব শ্রী, রাজাকে সহসা দর্শন দিল না।
বাঙালী হয়ে সত্যিই কত ভাগ্যবান আমরা, এই সমস্ত অনবদ্য অতুলনীয় গল্পপাঠের সৌভাগ্য হয়েছে। অবাঙালীদের জন্য সত্যি খুব দুঃখ হয়।