সিলেটি সাগা
০১.
অ ডুরা! কুনার সাবরে আরক কটরা ছালন দেও।
অতিশয় বিশুদ্ধ সিলেটি উচ্চারণে বাক্যটি উচ্চারিত হল। আমি অবশ্য তার জন্য প্রস্তুত ছিলুম। যদ্যপিদেশ : লন্ডনের টিলবারি ডক; কাল : ১৯৩১; পাত্র : রেস্তোরাঁর মালিক। সে আমলে খাঁটি বিলিতি হোটেল-রেস্তোরাঁতে যে অখাদ্য নির্মিত হত সেটা হটেনটটীয় পর্যায়ের। কথায় বলে, ওট নামক বস্তুটি স্কটল্যান্ডে খায় মানুষ, ইংলন্ডে খায় ঘোড়া। কিন্তু ওই আমলে লন্ডনের পোশাকি খানাও স্টকল্যান্ডের ঘোড়া পর্যন্ত খেতে রাজি হত না– এই আমার বিশ্বাস। তাই আমি লন্ডনের লাঞ্চকে বলতুম লাঞ্ছনা আর সাপারকে বলতুম Suffer!
রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে এসেছেন শুনে তাকে প্রণাম জানিয়ে যখন রাস্তায় নেমেছি তখন হঠাৎ এক সিলেটি দোস্তের সঙ্গে মোলাকাত। আলিঙ্গন কুশলাদির পর দোস্ত শুধাল, অত রোগা কেন? একে দুর্দান্ত শীত, তদুপরি লন্ডনের গুষ্টির-পিণ্ডি-চটকানো রান্না। সংক্ষেপে বলল, চল। এতদিন পরে সব ঘটনা আর মনে নেই তবে বাসে করে যে অনেকখানি পথ যেতে হয়েছিল সেটা স্পষ্ট মনে আছে। মোকামে পৌঁছে ভালো করে বেয়ারিং পাবার পূর্বেই দেখি, একটি ছোটখাটো রেস্তোরাঁর মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে এবং কানে গেল পূর্বোক্ত অ ডুরা– ইত্যাদি, যার অর্থ, ও ভোরা, কোণের সাহেবকে আরেক বাটি ঝোল দাও।
হালে কাগজে পড়লুম, বিলেতে যেসব পাক-ভারতের রেস্তোরাঁ আছে তার শতকরা ৮০ ভাগ সিলেটিরা চালায়। অবশ্য ওই চল্লিশ বছর পূর্বে বিলেতে অত ঝাঁকে ঝাঁকে পাক ভারতীয় রেস্তোরাঁ ছিল না; তবে সে-রাত্রেই জানতে পাই, যে-কয়টি আছে পনেরো আনা সিলেটিদের। এমনকি লন্ডনের নামকরা হতচ্ছাড়া তালু-পোড়া দামের এক ভারতীয় রেস্তোরাঁর শেফও সিলেটি।
ইতোমধ্যে দোস্ত শশাঙ্কমোহন অটলালার (হোটেলওয়ালার) সঙ্গে বে-এক্তেয়ার গালগল্প জুড়ে দিয়েছেন– আহা, যেন বহু যুগের ওপার হতে লঙ লসট ভ্রাতৃদ্বয়ের পুনর্মিলন। শশাঙ্ক আমাকে অটলালার পাশের একটা টেবিলের কাছে বসবার ইঙ্গিত দিয়ে আবার তার ভ্যাচর ভ্যাচরে ফিরে গেল। একটা দরজা খুলে যেতে দেখি বেরিয়ে এল একটি প্রাপ্তবয়স্কা মেম। হাতের ট্রের উপর রাইস, কারি, ডাল, ভাজাভুজি। আমাদের দিকে নজর যেতেই মৃদুহাস্য করে গুড ইভনিং বলে বয়সের তুলনায় অতি স্মার্ট পদক্ষেপে গটগট করে প্রথম অন্যান্য খদ্দেরদের রাইসকার্যাদি দিয়ে সর্বশেষে কোণের সাহেবের টেবিলের উপর তার ছালনের কট্রা রাখল। ইনিই তা হলে ডোরা।… জনা আষ্টেক খালাসি পরম পরিতৃপ্তি সহকারে সশব্দে, ছুরি-কাটার তোয়াক্কা না করে খেয়ে চলেছে। আরও দু জন গোরা একান্তে বসে ওই খাদ্যই রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে। ডোরা ফিরে আসতে অটলালা তার ক্যাশ ছেড়ে এল। আমরা চারজন এক টেবিলে বসলুম। অটলালা সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমরা তো বেশি পদ রাঁধি না– আমাদের গাহক তো সবই খালাসি, দু একজন গোরা মাঝেমধ্যে। কিন্তু আপনারা অতদূর থেকে মেহেরবানি করে এসেছেন। ভালোমন্দ কিছু করতে হয়। আমাদের আপত্তি না শুনে দুজনা রান্নাঘরে চলে গেল। শশাঙ্ক বলল, আশ্চর্য, কুড়ি বছর হয়ে গেল এই আম্বরউল্লা এ-দেশে আছে, তবু একবর্ণ ইংরেজি শিখতে পারেনি। ওদিকে ওর বউ ভোরা দিব্যি সিলেটি বলতে পারে। খালাসি গোরা সব খদ্দের ও-ই সামলায়। তবে ওর ইংরেজি বোঝাটাও চাট্টিখানি কথা নয়। একদম খাস খানদানি কনি। আমি শুধালুম, বিয়েটা– মানে সিলেটি খালাসি আর লন্ডনি মেমেতে হল কী প্রকারে? কেন হবে না? তুমি কি ভেবেছ ডোরা কোনও অক্সফড ডন-এর মেয়ে এবং কেমব্রিজের রেঙলার? আর হ কথাই যদি কই, তবে বলি, সামাজিক পদমর্যাদায় আম্বর মিয়া তার মাদামের চেয়ে ঢের ঢের সরেস। মিয়া চাষির ছেলে আর ডোরা মুচির মেয়ে। অবশ্য ভোরার মতো লক্ষ্মী মেয়ে শতকে গোটেক। আমাদের যে কী আদর করে, পরে দেখতে পাবে। আর এমন সময় আম্বর মিয়া সহাস্য আস্যে প্রত্যাবর্তন করে বলল, আমাদের সুখদুঃখের কথাতে মাঝে মাঝে বাধা পড়বে, স্যর। ডোরাই খদ্দেরদের কাছ থেকে হিসেবের কড়ি তোলে। এখন রাঁধছে। ওটা আমাকে সামলাতে হবে। আমি ভয় পেয়ে মনে মনে বললুম, মেমের হাতের রান্নায় আবার সেই লাঞ্ছনা আবার সেই সাফার! আমরা তো গাঁটের রোক্কা সিক্কা ঝেড়ে হেথায় পৌঁছলুম, আর ওই হতভাগ্য লন্ডনি লাঞ্ছনা-সাফার কোত্থেকে বাস-ভাড়া জোগাড় করে আমাদের পিছনে ধাওয়া করল? প্রকাশ্যে রোস্টোমোস্টো রাঁধবে নাকি?
হেসে বলল, তা-ও কি কখনও হয়, স্যর। রাঁধবে খাঁটি সিলেটি রান্না।
শিখল কার কাছ থেকে?
আমার কাছ থেকে সামান্যই, কিন্তু আমার গাহক খালাসি-ভাইদের ভিতর প্রায়ই বাঢ়িয়া বাঢ়িয়া বাবুর্চি থাকেন। তাঁদের কাছ থেকে সিলেটের পোশাকি খানা থেকে মামুলি ঝোল-ভাত সবকিছু শিখে নিয়েছে। এমন সময় কোণের গোরা রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে সামান্য গলা চড়িয়ে বলল, ও মিসিস উল্লা আজকের কারিটাতে একদম ঝাল নেই। দুটো গ্রিন চিলি– সরি– সে তো,এই গড ড্যাম দেশে নেই। তা হলে একটু টাবাস্কো চিলি সস্ দাও না। বলে কী ব্যাটা! ডোরা যখন রাইস-কারি নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে-কারির কটকটে লাল রঙ দেখে আঁতকে উঠে আমার মতো খাস সিলটাও মনস্থির করেছিল ওই বস্তু কম মেকদারে খেতে হবে– চাটনির মতো, আ লা চাটনি। আর এ-গোরা হট, হট, ডবল হট মাদ্রাজি আচার দিয়ে তার ঝোলের ঝাল বাড়াল।… একে একে, দুয়ে তিনে সব খদ্দের কড়ি গুনে চলে গেল। আমার চোখে একটুখানি ধাঁধার ভাব দেখে বলল, ঠিক ধরেছেন, স্যর। সক্কলের জেবে কি আর রেস্ত থাকে? ইনশাল্লা, দিয়ে দেবে কোনও এক খেপে। আর নাই বা দিলে।
আমরা খেয়েছিলুম, বেগুন-ভাজা, মুড়িঘন্ট, মটরপোলাও, মাছ ভাজা, মুরগি কারি– বাকি মনে নেই। অসম্ভব সুন্দর রান্না। কিন্তু আর শুধোবেন না। আহারাদির আলোচনা আরম্ভ হলে আমার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। রাতও তখন অনেক। মোকা পেয়ে শশাঙ্ককে কানে। কানে বললুম, বিল?
চোক্কোরো। ও-কথা তুললে আম্মর-উল্লা ভ্যাক করে কেঁদে ফেলবে।
শুধু কি তাই! বিদায় নেবার সময় ডোরা দোস্ত শশাঙ্কের হাতে তুলে দিল একটা বাস্কেট। পথে নেমে সেটাকে প্রিয়ার গণ্ডদেশে হাত বুলোবার মতো আদর করতে করতে বলল, তিন দিনের দু বেলার আহারাদি হে দোস্তো দু জনার তিনজনারও হতে পারে।
.
০২.
ঠিক কোন সময়ে হিন্দুরা সমদ্রযাত্রা বন্ধ করেন ঠিক বলা যায় না। তবে এর ফল যে বিষময় হয়েছিল সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই চট্টগ্রাম এবং সিলেটের (সিলেট সমুদ্রতীরবর্তী নয়, কিন্তু সিলেটে বিরাট বিরাট হাওর থাকায় মাঝিরা অন্ধকারে তারা দেখে নৌকা চালাতে পারে– লিন্ডসে সাহেব গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে কম্পাসের সাহায্যে একাধিক হাওর পেরিয়ে চাল-ভর্তি মহাজনি নৌকা মাদ্রাজ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সি-সিকনেস তাদের হয় না) লক্ষ লক্ষ ব্যবসায়ী মাঝিমাল্লা অন্নহীন হয়ে যায়। এর পর আরব বণিকরা সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে ব্যবসা করতে এলে এরা প্রধানত পেটের দায়ে মুসলমান হয়ে গোড়ার দিকে আরব জাহাজে খালাসির চাকরি নিয়ে পূর্বে ইন্দোনেশিয়া ও পশ্চিমে জেদ্দা, সুয়েজ বন্দর অবধি পাড়ি দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই চট্টগ্রামের সদাগর সম্প্রদায় আপন আপন পালের জাহাজ নির্মাণ করে বর্মা মালয়ের সঙ্গে ব্যবসা চালাতে থাকে এবং এ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত ইংরেজের কলের জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দেয়।
প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির মাঝিমাল্লা চাষাভূষোই গোড়ার দিকে ইউরোপীয় জাহাজে কাজ নেয় এবং এদের খালাসি বলা হত (এ স্থলেই উল্লেখ করি সংখ্যায় প্রায় আশি হাজারের মতো যেসব সিলেটি বর্তমানে ইংলন্ডে কলকারখানায় কাজ করে শুনেছি সিলেটিদের তুলনায় পুব পাকের অন্যান্য জেলার লোকসংখ্যা নগণ্য দেশের সিলেটবাসীরা এদের নাম দিয়েছেন লন্ডনি, যদিও এদের বড় আড্ডা বোধহয় নটিংহামে)। বহু বছর ধরে খালাসিরা ডাঙায় বাসা বেঁধে কলকারখানায় ঢোকেনি। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক সিলেটি কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে কলকারখানায় ঢুকে প্রচুর পয়সা কামিয়ে দেশে ফিরত– ওখানে চিরতরে বাসভূমি নির্মাণ করত না।
খালাসিবৃত্তি থেকে কবে কী করে এরা দক্ষিণ ও মধ্য ইংলন্ডের কলকারখানায় ঢুকে পড়ে লন্ডনি খেতাব পায় তার কোনও লিখিত বিবরণ আমি পড়িনি। তবে আমার মনে হয়, ১৯২৯-৩৩-এর পূর্বে নয়, কারণ এ সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার কারখানাকর্মীদের ভিতর প্রচুরতম বেকারি। এর পরে প্রধানত যুদ্ধের সময় বিস্তর সস্তা লেবারের প্রয়োজন হল। আজ যে আপনি-আমি লন্ডন-নটিংহামের যে কোনও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি রেস্তোরাঁতেও পাটনা রাইস এবং কারি পাচ্ছি তার গোড়াপত্তন হয় ওই সময় (পাটনা রাইস বলে বটে, কিন্তু সেটা দেরাদুন, বাসমতি সবকিছুই হতে পারে। বহু গবেষণা করে সন্ধান পেলুম কোম্পানির আমলে এ-দেশ থেকে যে-চাল বিলেত যেত সেটা প্রধানত সংগ্রহ করা হত পাটনার আড়তে যে-হরেক প্রদেশের চাল জড়ো হয়েছে তার থেকে; তাই এর অমনিবাস নাম হয়ে যায় পাটনা রাইস) সৈন্যদের এবং লন্ডনিদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। আজ এদেশ থেকে প্রতিদিন মণ মণ চাল, ডাল, শুঁটকি, মসলা ইত্যাদি তো যাচ্ছেই, তার ওপর হাজার হাজার বোতল আম, নেবু, জলপাইয়ের আচার। গত বছর সিলেটে এক বিরাট আচার ফ্যাকটরি দেখে আমি স্তম্ভিত। পরে সে কারখানার অমায়িক মালিকের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, যা তৈরি হয় তার প্রায় বেবাক মাল চলে যায় লন্ডনিদের খেদমতে। চাহিদাও বেড়ে চলেছে। আমি পেরে উঠছি না। অবশ্য আমি জানতুম, মালদার ম্যাংগো স্লাইজ এবং মিষ্টি-টক (সুইট-সাওয়ার) আমের আচারের এক বৃহৎ অংশ লন্ডনিদের তরেই যায়। কারণ সিলেটের আম জঘন্য। তার থেকে ভালো আচার হয় না– স্লাইস মাথায় থাকুন। অবশ্য সিলেট থেকে সর্বোকৃষ্ট আনারস-স্লাইস বিলেত যায়। মার্কিন হাইনস ফিফটি সেভনের (বা অন্য সংখ্যাও হতে পারে) মতো সিলেটি আচার কারখানা ৪৭ রকমের আচার, স্লাইস ইত্যাদি তৈরি করে। বুঝুন, যে সিলেটি দেশে ভাত, লাল লঙ্কা পেষা, আর কিস্যুৎ নিতান্তই মেহেরবান হলে একটি কাঁচা প্যাজ খেত– তা-ও দুবেলা নয় এবং সে-ও পেট ভরে নয়– সে কি না আজ সিলেটের জমিদার-ছেলেরও যা জোটে না বিলেতে বসে তাই খায়। এস্তেক পান-তক। পান যায়। প্লেনে। তাই নাকি একটা খিলির দাম সি পেন্স থেকে এক শিলিং
সিলেটিরা বিলেতে চাকরি পায় কেন? কাগজে নিশ্চয়ই পড়েছেন, সাদা আর কালো মজুরে সেখানে নিত্য লড়াই। আমি এ-বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত-তাবাশ করিনি। যা শুনেছি, তাই বলছি : (১) কালোরা– বিশেষ করে সিলেটিরা কম মাইনেতে কাজ করতে রাজি; নিগ্রোরা মদ খায়, জুয়া খেলে বলে তাদের খাই বেশি। (২) দুই শিফটে এবং রবিবারেও কাজ করতে রাজি নিগ্রোরা খ্রিস্টান, রবিবারে সাবাৎ মানে। (৩) ইউনিয়ন এড়িয়ে চলে, স্ট্রাইক করতে চায় না। (৪) রাতভর মদ খেয়ে পরের দিন বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে না বলে কাজকর্মে কামাই দেয় কম।
এই সিলেটিরা অনেকেই মেম বিয়ে করে ওদের একটা দু আঁসলা সমাজ গড়ে তুলেছে এবং ঘটকালি করে এই মেমেরা নবাগত সিলেটিকে তাদের বোন-ভাগ্নী বিয়ে দেবার জন্য। বোন-ভাগ্নীও লন্ডনির বউয়ের কাছ থেকে জেনে গিয়েছে (১) সিলেটি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বউকে ঠ্যাঙায় না, (২) ঘোড়ার রেস, কুকুরের রেস, এমনকি কড়ি খর্চা করে ফুটবল খেলা দেখতে যায় না, মদে পয়সা ওড়ায় না এবং কোনওপ্রকারের জুয়োও খেলে না বলে বউ স্বচ্ছন্দে সংসার চালাবার জন্য স্বামীর মাইনের একটা বড় হিস্যে পায়। বিয়ের পূর্বে বা পরে সে অন্য মেয়ের সঙ্গে পরকীয়া করে না– সে তো ধলা মেম পেয়েই খুশ! এ দুটো সেকুরিটি পৃথিবীর সর্বত্রই রমণীমাত্রই খোঁজে। এবং কেউ কেউ তৃতীয় সেকুরিটিও দিতে পারে– আপন পয়সায় কোনও নিজস্ব কটেজ। আমার পরিচিত এক চৌধুরীর ছেলে তো নটিংহামে তিনখানা চেন, হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক (আজকাল সিলেটি মুসলমানদের উচ্চশ্রেণির লোকও নানা ধান্দায় লন্ডনি হচ্ছেন)। তিনি তো অনায়াসে তৃতীয় সেকুরিটি দিতে পারেন। এছাড়া ছোটখাটো আরও অনেক আরাম-আয়েস আছে। বাচ্চা রাত্রে কেঁদে খাস-সায়েব মজুরের ঘুম ভাঙালে সে ধমক দিয়ে বউকে বাচ্চাসহ রান্নাঘরে খেদায়; লন্ডনি গায়ে পড়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঠাণ্ডা করে। দেশে ছেলেবেলা থেকেই সে কত ভাতিজা ভাতিজি ঠাণ্ডা করেছে।… পাব-এ যায় না বলে প্রায়ই তার ফুরসত থাকে এবং বউকে প্রেম। করে বলে প্র্যাম-এ করে বাচ্চাকে হাওয়াভি খাওয়ায়।
.
০৩.
অ ভাই, জলদি আও, বেটিয়ে ডাকে।
একদম ন সিকে খাঁটি সিলেটি উচ্চারণ। অবশ্য আমি খুব-একটা হকচকিয়ে উঠিনি, কারণ ঢাকার অ্যার-পরুটে হরহামেশাই সিলেটি উচ্চারণ শোনা যায়। কিন্তু যে প্রৌঢ় লোকটি এই মধুর আহ্বান শোনালেন, তার পরনে দেখি উত্তম বিলিতি কাট-এ অত্যুত্তম ১০০% বিলিতি উলের নেভি ব্লু স্যুট। ওদিকে গলকম্বল মানমুনিয়া চাপদাড়ি। যাকে ডাকছিলেন তারও ওই বেশ, তবে বয়সে যুবক। কিন্তু ওই বেটিয়ে ডাকে অর্থাৎ মেয়েছেলে ডাকছে–এর বিগলিতার্থটা কী? তখন অ্যার-পরূটের প্রধান লাউজে ঢুকে দেখি একপাল লোক; প্রায় সক্কলেরই পরনে একই ধরনের নেভি ব্লু স্যুট। বুঝে গেলুম এরা লনডনি। বাড়িতে এসে দাদাকে তাবৎ হালত বয়ান করলুম। দাদা বলল, লনডনিরা ঈদের পরবে প্লেন চার্টার করে দেশে যায়। সে ঢাউস প্লেন সিলেটে নামতে পারে না বলে ঢাকা অবধি এসে থেমে যায়। তার পর সাধারণ সারভিসে আপন আপন মোকামে যায়। শ্রীমঙ্গল, শমসের নগরের মতো ছোট ছোট জায়গায়ও প্রধানত এদেরই জন্য অ্যার স্ট্রিপ করা হয়েছে। আর ওই যে চাপদাড়ি-ওলা লোকটাকে দেখলি সে খুব সম্ভব লনডনিদের বিলেতের মসজিদের ইমাম। এ-ই এদের বিলেত থেকে আপন আপন মোকাম অবধি দেখ-ভাল করে পৌঁছিয়ে দেয়। এদেরই একজন বোধহয় ছিটকে পড়েছিল; ইতোমধ্যে তরুণী এনাউনসার মাইকে বলেছে সিলেটগামী প্লেন এখখুনি ছাড়বে। তাই ইমাম হাঁকছিল, বেটিয়ে ডাকে, জলদি আও। সিলেটি মাত্রই জানেন, সে-ভাষায় বেটি ঠিক দুহিতা বা মেয়েছেলে নয়। বরঞ্চ মেয়েমানুষ এমনকি মাগি অর্থেও ধরে। পশ্চিমবঙ্গে যখন কেউ বলে বেটির কাণ্ড দেখ! তখন যে অর্থ ধরে। এখন পাঠক বুঝুন, সেই খাবসুরৎ তরুণীকে বেটি বললে কোন রস সৃষ্ট হয়।
লনডনিরা প্রতি বছর সিলেটে কত টাকা পাঠায় তার হিসাব কেউ দিতে পারে না। কারণ এরা কালোবাজারে খুব ভালো রেট পায় বলে এদের পাঠানো টাকার খুব বড় একটা হিস্যের কোনও সন্ধানই কেউ জানে না। শুনেছি কোনও এক বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক কালোবাজারে লন্ডনিদের কাছ থেকে পাউন্ড কিনে তাদের নারায়ণগঞ্জস্থ আপন পাট গুদাম জুট মিলকে কোড-এ হুকুম দেয়। অমুক সিলেটিকে অত টাকা পাঠাবে। আরও শুনেছি, তার পর ওই পাউন্ড দিয়ে বিলিতি জিনিস কিনে, কিছুটা আইনত, বেশিরভাগ কালোয় প্রাচ্যে পাচার করে।
কত টাকা লনডনিরা পাঠায় তার হিসাব না জানা থাকলেও সিলেট জেলাতে সে টাকার সুদূরপ্রসারী গভীর প্রভাব সর্ব সিলেটির চোখে যেন ঘুষি মেরে আপন মাহাত্ম অহরহ প্রচার করে। সস্তা সেকেনহ্যানড বিদেশি ট্রানজিসটার, পারকার কলম, ক্যামেরা ইত্যাদির কথা বাদ দিচ্ছি– একমাত্র সিলেট শহরেই নাকি গণ্ডা দুই সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ট্রাভেল এজেন্সি আছে– কল্পনা করতে পারেন এ-জিনিস বর্ধমানে? মহকুমা শহরের কথা বাদ দিন, বড় বড় থানায় বিশেষত যেসব পকেটে লনডনিদের আদি নিবাস পর্যন্ত বড় বড় ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ আপিস খোলা হয়েছে। আর ডাকঘরের তো কথাই নেই। যে-ডাকঘরে দিনে তিনখানা চিঠিও আসে কি না, সেখানে আসে পাঁচশো-হাজার টাকার মনিঅরডার। কিন্তু এহ বাহ্য। যে সিলেট শহরের বন্দর-বাজারে মাছের কখনও অভাব হয়নি সেই বাজারে দর আগুন এবং শৌখিন মাছ বিরল। আমার এক মুরুব্বি বললেন, আসবে কোত্থেকে? লন্ডনির পাঠানো টাকাতে এখন গাঁয়ের লোক মাছ খায়। জেলে তকলিফ বরদাস্ত করে শহরে আসবে কেন। বললে প্রত্যয় যাবে কি, পাঁচখানা গাঁয়ের মাঝখানে যে-হাট, সেটা এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বসত সপ্তাহে একদিন একবেলা। এখন বসে রোজ, প্রতিদিন, দু বেলা।
এটা আবার কনফারম করল আমার এক বোন। গাঁয়ের জমিদারবাড়িতে তার বিয়ে হয়েছে এবং লন্ডনিরা যখন দেশে আসে তখন প্রায়ই ব্যাঙ্কের চিঠিপত্রাদি পড়াবার জন্য জমিদারবাড়িতে আসে। বোন বলল, এক লন্ডনি দেশে এসেছে ঈদ করতে। মাছ কিনতে গেছে ভিন গাঁয়ের হাটে। একটা ভালো মাছ দেখে দাম শুধাল। জেলে বলল ওটা বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সেটা কিনেছে ওই গাঁয়েরই এক লন্ডনি, এবং দুই গাঁয়ে দারুণ আড়াআড়ি। ভিন গায়ের লন্ডনির এক দোস্ত প্রথম লন্ডনিকে খোঁচা দিয়ে যা বলল তার অর্থ তোমাদের গায়ে এ-মাছ খাবার মতো রেস্ত আছে কার? প্রথম লন্ডনি বড় নিরীহ, কোনও উত্তর দিল না। কিন্তু তার গায়ের সঙ্গী-সাথীরা চটে গিয়ে তাকে বলল, আল্লার কসম, এই, এই মাছটাই তোকে কিনতে হবে। তখন মাছ চড়ল নিলামে। দশ, বিশ, শ, দু শো চড়চড় করে চড়ে গেল। কবিগুরুর ভাষা একটু বদলালে দাঁড়ায়,
দশ মাষা দিব আমি
কহিলা লনডন-ধামী,
বিশ মাষা অন্য জনে কয়।
দোঁহে কহে দেহো দেহো,
হার নাহি মানে কেহ–
মূল্য বেড়ে ওঠে ক্রমাগত।
আমার বোনটি অতিরঞ্জনে অভ্যস্ত নয়। শেষটায় বলল, আখেরে মাছটা বিক্রি হল এক হাজার এক টাকা মূল্যে। কিনল প্রথম লন্ডনি। এবং আশ্চর্য নগদ টাকা তার ওয়াকিটের পকেট থেকেই বের করল। তার পর বিজয়ী মাছটাকে নিয়ে প্রসেশন করে গ্রামে এসে আপন গাঁ প্রদক্ষিণ করল। বিস্তর জিন্দাবাদ জিগিরের পর মাছটাকে ব্লেড দিয়ে প্রায় ডাকটিকিটের সাইজে টুকরো টুকরো করে গায়ের সব্বাইকে বিলোলো। এখন এরা হাটে গিয়ে দেমাক করে, আজার টেকি (হাজার টাকা দামের) মাছ খাই আমরা।
কিন্তু এহ বাহ্য। সমাজবিদের কান খাড়া হবে শেষ তত্ত্ব এবং তথ্যটি শুনে। লন্ডনি যত টাকা নিয়েই গ্রামে ফিরুক না কেন, জমিদার মিরাশদারের (যদ্যপি এখন আর জমিদারি নেই) বৈঠকখানায় শব্দার্থে এখনও তারা কলকে পায় না। অথচ তারা জাতে উঠতে চায়। তাই তারা হন্যে হয়ে উঠেছে সদরে, মহকুমা টাউনে বাড়ি কিনতে। সেখানে কে কার খোঁজ নেয়? এক বা দু পুরুষে সবাই ভুলে যাবে তাদের উৎপত্তি, পেশা, জন্মস্থল। ফলে সিলেট শহরে যে-বাড়ির দাম পাঁচ বছর আগে ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা, এখন লন্ডনি দেড় লাখ হাঁকছে। একাধিক পেনশনার ভাবছেন সিলেটের বাড়ি বিক্রি করে ওই টাকা দিয়ে ঢাকাতে ওইরকম বাড়িই যখন পাব (সিলেট জেলার বাইরে লন্ডনি বাড়ি চায় না) তখন ছেলে-নাতির পড়াশুনোর সুবিধের জন্য ক্যাপিটালে বাস করার আরও সুবিধে সেখানেই যাই না কেন? যিনি আমাকে এ-ব্যাপারটির কথা বললেন, তিনি প্রাগুক্ত ওই মছলী-কহানীও জানতেন। শেষ করলেন এই বলে– আগে প্রবাদ ছিল মাছ খাবি তো ইলিশ, লাং ধরবি তো পুলিশ, এখন হয়েছে মাছ খাবি ন মণী, লাং ধরবি লন্ডনি। কিন্তু এটা চালু হবে না। লন্ডনিরা সচ্চরিত্র।
.
০৪.
এই পর্যায়ের কীর্তনকাহিনী (সাগা)-র কালি ভালো করে শুকোবার পূর্বেই দেখি হঠাৎ আমি সিলেটিদের মাঝখানে। তবে খাস সিলেটে নয়, লন্ডনে। এবং বিরাট লন্ডনের সব কটা সিলেটি রেস্তোরাঁ চষতে হলে পুরো পাক্কা ছটি মাস লাগার কথা।
প্রথম যেটিতে গেলুম, সেটা নিতান্তই যোগাযোগের ফলে। লন্ডনে যে অ্যারপর্টে নাবলুম সেখান থেকে খাস লন্ডন নিদেন ত্রিশ মাইল দূরে। তিনজন পরিচিতের ঠিকানা নোটবুকে টোকা ছিল। এক সহৃদয় ইংরেজকে সে-তিনটে দেখিয়ে শুধালুম, সবচেয়ে কাছে পড়ে কোনটা। এক ঝলক দৃষ্টি হেনেই বলল, গঙ্গা রেস্তোরাঁ। তাই সই। গেল বছরে যখন ওর মালিক পঁচিশ বছর লন্ডনে কাটিয়ে বাপ-মাকে দেখতে দেশে আসে তখন আমাকে জোর নিমন্ত্রণ জানিয়ে বলে, তার রেস্তোরাঁ আছে, ফ্ল্যাট আছে; আমি যদি দয়া করে পদধূলি– হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ।
কোথায় কী? আমি ভেবেছিলুম, সেই যে চল্লিশ বছর পূর্বেকার টিলবারি ডকের সিলেটি রেস্তোরাঁ- যার কাহিনী আপনাদের শুনিয়েছি সেই ধরনের গরিবগুরবোর অটলই (হোটেলের সিলেটি উচ্চারণ; তবে সিলেটিতে এ্যাকসেন্ট আছে বলে সেটা পড়বে অ-র ওপর) হবে। তবে কি না, নিতান্ত মহারানির আপন নগরের মধ্যিখানে থানা গেড়েছে যখন, তবে হয়তো দেয়াল ছাদে দু এক পলস্তরা পাউডার-রুজ মাখিয়ে নিয়েছে।
কোথায় কী? পরিপাটি ছিমছাম পশ, শিক্। বাদবাকি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার পূর্বেই দূর থেকে মালিক (অটলালা = হোটেলওয়ালা) আমাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসেছে। আউকা, আউকা; বউকা বউকা (আসুন, আসুন; বসুন, বসুন)। তার পর দিল ছুট রেস্তোরাঁর গর্ভগৃহের দিকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য বউকে নিয়ে আসতে।
টেবিল-ক্লথ, ন্যাপকিন মুরমুরে পয়লা নম্বরি আইরিশ লিনেনের, ফুলদানিতে যেন বাগান থেকে সদ্য তোলা, শিশির-ভেজা গোলাপ, ছুরি কাঁটা তথা যাবতীয় কাটলারি যেন মোগল আমলের খাঁটি রুপোর, আর গেলাস-বৌল এমনই স্বচ্ছ যে ভয় হল যে দুর্যোধনের মতো স্ফটিককে জল ভেবে, আমিও এগুলোর দু একটা দেখতে না পেয়ে ভেঙে ফেলি!
ডানদিকে কাচে ঘেরা একটি চৌকো কুঠরি। ভিতরে সারি সারি শেলফে সাজানো দুনিয়ার খাসা খাসা মদ্যাদি। বোতলের আকার-প্রকার রঙ-লেবেল দেখেই বোঝা যায়। কুঠরির। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটি খাপসুরৎ জোয়ান ছোকরা ন্যাপকিন দিয়ে ওয়াইন শ্যামপেন; বিয়ার-মাগ সাফসুতরো করছিল এবং মাঝে মাঝে আমার দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছিল। ছোকরার মুখের আদল, দেহের গঠন সিলেটির মতো। কিন্তু রঙটা? গোরাদের মতো ফর্সা নয়, আবার সিলেটির মতো শ্যাম-হলদেও নয়। সমাধান কিন্তু সহজ। গলা বাড়িয়ে সিলেটিতে শুধোলুম, ভাই সাহেব, আপনার দেশ কোথায়?
গোটা কয়েক গেলাস ভেঙে ফেলেছিল আর কি! গলার আওয়াজ হোঁচট খেতে খেতে, খাবি খেয়ে খেয়ে, পড়িমরি হয়ে বলল, জি, জি, জি; আমি সিলেটের ফেচুগঞ্জের।… এখানে যারা কাজ-কাম করে সবাই সিলেটি। (আমরা মারওয়াড়িদের দোষ দিই; তারা শুধু দেশের ভাইয়াদেরই চাকরি দেয়। সমস্যাটার সমাধান এখনও করতে পারিনি।)
ইতোমধ্যে মালিক এসে গেছেন। তাঁর গৃহিণীর– মেমসাহেবার প্রথম কথা কটি শুনেই আমার মনে সন্দেহ হল, যদিও এর ইংরেজি উচ্চারণ উত্তম– অন্তত আমার চেয়ে ভালো– তবু ইনি বোধহয় কন্টিনেনটাল। ভারি মিষ্টি স্বভাবের, লাজুক, স্বল্পভাষী রমণী। মালিকের মাথায় হঠাৎ কী যেন আচমকা ভাবোদয় হল। বলল, আপনি তো একদা জর্মনিতে পড়াশুনো করেছিলেন; এখনও নাকি ওই দেশের ভাষা বলতে পারেন। ইনি (বউয়ের দিকে তাকিয়ে) খাঁটি জর্মন।।
এ্যাতক্ষ্যাণ ব্যাললেই হত। মেমও সঙ্গে সঙ্গে জর্মন বলতে আরম্ভ করল। ওর উচ্চারণ থেকে মনে হল সে ভুরুটেবের্গ প্রদেশের মেয়ে।
সোমদেবের চরম কৃপাই বলতে হবে! যে প্লেনে জরমনি থেকে লন্ডন এসেছিলুম সেটাতে ওই ভরটেমূবের্গ প্রদেশের মোলায়েম ওয়াইন সস্তায় বিক্রি হচ্ছিল। লন্ডনে পৌঁছে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ডেরা পাব তা তো জানিনে। যদি-স্যাৎ কাজে লেগে যায়। তাই এক বোতল কিনে নিয়েছিলুম। আর যাবে কোথা! এক কোণে উঁই করে রাখা লাগেজ থেকে বোতলটি বের করে ম্যাডামের সামনে রেখে বললুম, এই নিন। সুম ভোল জাইন, আ ভত্র সতেহিয়ার ইজ টু ইউ –এসব তান্ত্রিক মন্ত্রের অর্থ আমি এখনও সঠিক জানিনে। তবে মোটামুটি দাঁড়ায় ইটি পান করে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হোক, আপনার সর্বমঙ্গল হোক ইত্যাদি। উভয় পক্ষ উভয়ের একই মঙ্গল কামনা করেন। মদ্যপান করে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় কি না জানিনে গত যুদ্ধে ফ্রানস হেরে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পেতা যখন প্রথম বক্তৃতা দেন, তখন তিনি বলেন, অত্যধিক মদ্যপান হেতু ফরাসি সেপাই ঠিকমতো লড়তে পারেনি– কিন্তু এটাই রেওয়াজ এবং ম্যাডামের চোখ ছল ছল করে উঠল। কোথাকার কোন ইন্ডিয়ান– তার দেশের জিনিস, এ স্থলে প্রতীক বলতে হবে, এনেছে। এটা কি কম কথা! ভাবুন, আপনি নিউজিল্যান্ড বা ওসলোতে। সেখানে কেউ নিয়ে এল আপনার জন্য পাটিসাপটা ক্ষীরের মালপো দেদো সন্দেশ! তদুপরি সে বাঙালি নয়।
ইতোমধ্যে দুটি একটি করে খদ্দের আসতে আরম্ভ করেছে। তার থেকে বুঝলুম, রাত হয়ে আসছে। আমার কাছে আশ্চর্য বোধ হয় যে আমরা সূর্যচন্দ্র দেখে সময়টা কী এবং তার চেয়েও বড় কথা মানুষের আচরণ তার কাজ-কারবার স্থির করি। যেমন সূর্য অস্ত যাচ্ছেন; অতএব এখন রাস্তার ভিড় কমতির দিকে। আর বিলেতে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। নিশ্চয়ই লাঞ্চের সময়, অতএব দুপুর।
ক্রমে ক্রমে রেস্তোরাঁ ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য! সব গোরার পাল। একটি মাত্র ইন্ডিয়ান নেই। চল্লিশ বছর পূর্বে টিলবারির রেস্তোরাঁয় দেখেছিলুম বেশিরভাগ সিলেটি খদ্দের; মাত্র দু একটি গোরা। এখানে দেখি স লাল হো গিয়া।
মালিক ওয়ারলডু এটুলাসের মতো বিরাট একখানা মেনু এগিয়ে দিয়ে বলল, কী খাবেন, হুকুম দিন। আমি বললুম, প্লেনে বিস্তর ঝাঁকুনি খেয়েছি আর কী খাব, কও। বমি করেছে বেশ কয়েকজন। তুমি-আমি নিতান্ত সিলেটের লোক। জন্ম থেকে হাওর-বিলে নৌকা ভিতরে-বাইরে নাগরদোলার দোল খেয়ে শিলঙ যাবার সময় আচমকা পাহাড়ি মোড়, হেয়ার পিন টার্ন হজম করে করে সি সিক অ্যার সিক, ল্যান্ড সিক হইনে। কিন্তু এবারে আমো কাবু। গা গুলোচ্ছে, বমি না করলেই রক্ষে। প্লেনে ওঠার আগে যা-সব খেয়েছিলুম সেগুলো যেন রিটার্ন টিকিট নিয়ে গিয়েছিল; এখন ফিরি ফিরি করছে। উপস্থিত থাক। বরঞ্চ খাটের পাশে দু খানা স্যানউইচ রেখে দিয়ো। ক্ষিদে পেলে খেয়ে নেব।
মেনুটার ওপর চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলুম, খেয়াল না করে, মালিককে ভদ্রতা দেখাবার জন্য, আলতো আলতো ভাবে। বিরিয়ানি, কোর্মা, কালিয়া, কাবাব, কোফতা, চিকেনকারি গয়রহ গয়রহ। এ তো ডালভাত কিন্তু শব্দার্থে বলছি না। আই মিন, এগুলো তো এরকম ফ্যাশনেবল রেস্তোরাঁতে থাকবেই। ইংরেজিতে যাকে বলে মাসুটস। কিন্তু কী একটা মামুলি আইটেমের দাম দেখতে গিয়ে আমি যেন আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না। বলে কী? দশ শিলিং! মানে? দশ টাকা। তখন মেনুর ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, সব মালেরই প্রায় ওই দাম। অর্থাৎ, দু পদী আহারাদির জন্য আপনার খসে যাবে পৌন্ড খানিক। পনরো, বিশ, পঁচিশ টাকা! ও! তাই ইন্ডিয়ানরা আসেনি। ওদের বেশিরভাগই তো ছাত্রসম্প্রদায়। ওদের জেবে অত রেস্ত কোথায়?… মনে পড়ল, চল্লিশ বছর পূর্বে ছ পেনিতে (পাঁচ আনাতে)। রাইসকারি পাওয়া যেত টিলবারি ডক্-এ।
পরে খবর নিয়ে শুনলুম, গঙ্গার ভাও মোটেই আক্রা নয়। এটাই নর্মাল। এমনকি, ওই পাড়ার চীনা, হাঙ্গেরিয়ান, স্প্যানিশ রেস্তোরাঁতে আহারাদি আরও আক্রা। আর এর পর খাস বিলিতি ডাঙর ডাঙর রেস্তোরাঁতে কী ভাও, সেটা শুধোবার মতো হিম্মত আমার জিগর কলিজায় ছিল না, সেটা আমার হাফ-সিঙ্গল-চা, দুটো-ফলস্ পিনেওলা বেরাদর পাঠক নিশ্চয়ই দিব্য-দৃষ্টিতে দেখে ফেলেছেন।
কিন্তু এহ বাহ্য। কোন দেশে কোন বস্তুর কী দর, বিভিন্ন দেশের রেস্তোরাঁর তুলনাত্মক দরদাম সম্বন্ধে ডকটেরেট থিসিস লিখে ধৈর্যশীল পাঠককে, এ-অধম নিপীড়িত করতে সাতিশয় অনিচ্ছুক! তবে কেন?
সেটা পরে হবে।