সিলি সিলিকোন

সিলি সিলিকোন

এই দ্যাখো না, কী মুশকিল, আমাকে না লিখতে বলেছে। তাও আবার গল্প। আমি কবিতা লিখেছি কয়েকটা, কিন্তু গল্প লিখিনি। আমাকে ওরা বলল তোমার জীবনে কী কম গল্প আছে, ওসবই লেখো।

আছে তো, আমার জীবনে তো সেই ছেলেবেলা থেকেই, সরি, মেয়েবেলা থেকেই গল্প। কাউকে হয়তো গল্প করতে পারি তা নিয়ে, কিন্তু গল্প লেখা যায় না। সব গুলিয়ে যায়। একটার ঘাড়ে আর একটা উঠে – ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের ছবি হয়ে যায়।

চার-পাঁচ বছর আগেকার একটা কথা বলি, অ্যা? রবীন্দ্রসদনে গেছি, পঁচিশে বৈশাখে প্রতিবারই যাই। ওখানে ওই গরমের মধ্যে আলোকাদি ভীষণ সেজেগুজে এসেছে। শাড়ি পরেছে, মাথার খোঁপায় বেলফুলের মালা, আইল্যাশ, কাজল, লিপস্টিক–সব। ওই গরমে ঘামছে। আরে ঘামবেই তো। খোঁপাটা তো ফল্স। টাইট করে শাড়ি পরেছে, বুকটা উঁচিয়ে রয়েছে। আমি আলোকাদির সঙ্গে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে গল্প করছি, এমন সময় ওখানে তাপসদা এলেন। তাপসদা কলকাতা দূরদর্শনে আছেন। আলোকাদির সঙ্গে ভালোই পরিচয়-টরিচয় আছে। তাপসদা আলোকাদিকে দেখে বলল–আরে আলোক, কী করে দিয়েছ, অ্যা? চেনাই যাচ্ছে না…।

আলোকাদি তপসদাকে বলল–শুনুন তাপসদা, আমাকে আর আলোক বলে ডাকবেন না। আমি আলোকা। ভালো লাগছে আমাকে? তাপসদা বলল, দারুণ লাগছে। তখন মনে আছে রবীন্দ্রসংগীত শোনা যাচ্ছিল–এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ…। আলোকাদি বলল–সেক্সি লাগছে?

হেবি।

এমন সময় একটা পাখি গাছ থেকে পটি করে দিল, আর আমার কাঁধে-টাধে ওসব পড়ল। তাপসদা তখন ওর পকেট থেকে কাগজ বার করে আমার কাঁধ থেকে পরিষ্কার করে দিল। আমি সালোয়ার-কামিজ পরেছিলাম। তাপসদা ওরকম করছিল বলে আমার লজ্জা করছিল। সবাই ড্যাবড্যাব করে দেখছিল। একটুখানি আমার বুকেও লেগেছিল। তাপসদা খুব ভদ্রলোক, নিশ্চয়ই বুকে হাত দিত না, তবু আমি সরে গেলাম। ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে তাপসদাকে একটু আড়াল করে বুক থেকে মুছে নিলাম। আলোকাদি কী অসভ্য। ও বলল, তোর লিলকি নিয়ে এত ফুন্টির কী আছে রে? কাকও তেমন, তোর গায়েই হাগে। তাপসদার হাত চেপে ধরে আলোকাদি। হাতটা সোজা ওর বুকে টেনে নেয়। বলে; দেখুন কেমন, একদম অরিজিনালের মতো নয়? দেখলে হবে? খরচা আছে। তারপর মুহূর্তেই তাপসদার হাতটা টেনে নিয়ে আমার বুকে লাগিয়ে দেয় আলোকাদি, বলে–ন্যাকড়া, ন্যাকড়া।একটা থার্টিফোর ব্রা-এর ভিতরে ঢোকানো ছেঁড়া ন্যাকড়া…।

কী অপমান লাগল আমার।আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। মাথা নিচু করে চলে গেলান রবীন্দ্রসদন চত্বর ছেড়ে। রূপে তোমায় ভোলাব না ভালোবাসায় ভোলাব ছেড়ে।

আলোকাদি ইংলিশে এম.এ। একটা এন.জি.ও-তে চাকরি করে। বড় চাকরি। ভালো মাইনে। ও বম্বে গিয়ে বুকে সিলিকোন করিয়েছে। অনেক সিনেমা আর্টিস্ট এসব করায়। আলোকাদি বড় বড় ডাক্তারের কাছে গিয়ে হরমোন থেরাপি করেছে। কিছুদিন আগে ভালো প্লাস্টিক সার্জেনকে দিয়ে ছিবড়ে নিয়েছে। ওর ওপর রাগ আছে বলে ‘ছিবড়ে’ বললাম, লিকম্ কেটেছে। ক্যাসট্রেশন। আমি ওসব করতে পারিনি, তাই বলে কি আমি মেয়ে নই। আমার শরীরটা ব্যাটাছেলের হতে পারে, কিন্তু আমি তো মেয়ে। এতগুলো লোকের সামনে রবীন্দ্রসদনের মতো জায়গায় তুমি একটা ছেলের হাত আমার বুকে ঠেকালে। ঠিক করেছিলে এটা? তোমার টাকা ছিল বলে এটা করেছিলে। টাকার অহঙ্কারে। তুমি যদি মেয়ে হতে, এরকম করতে পারতে না। মেয়ে শুধু লিল্‌কি-চিপটিতে হয় না। মনের ভিতরে থাকে নারীত্ব। সেই দিন থেকে তোমায় আমি ইয়ে করি আলোকাদি। তুমি তো আলোক ছিলে। তুমি তোমার নামের পর একটা লিকম্-এর মতো আকার বসিয়ে মেয়ে হয়ে গেছ। আমি এত সহজে হইনি। আমার স্কুলের নাম সনাতন। আমি সনাতনী হতে পারতাম, সান্ত্বনাও হতে পারতাম, কাছাকাছি হত। কিন্তু আমি প্রীতি। প্রীতি শব্দটাই ভালো লাগে খুব। যেন জলের ঝাপটা, যেন জুঁইয়ের পাপড়ি, যেন বাচ্চা ফোটাবে বলে ডিমের ওপর হাঁসমায়ের বসে থাকা। প্রীতি থেকেই তো পিরিতি কথাটা এসেছে। প্রেম-পিরিতি। কিছুদিন আগে মার্গারিটা নামে একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। গে আর লেসবিয়ানদের নিয়ে একটা ছবি করেছে। ও আমাকে ডাকছিল প্রিটি। প্রিটি শব্দটাও খুব সুন্দর।

নামটার জন্য কম ঝামেলা? সেদিন তো হাজার টাকা লস। তাপসদা টিভিতে একটা কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে ডেকেছিলেন। আমি কবিতা লিখি প্রীতি মিত্র নামে। চেকও তৈরি হল প্রীতি মিত্র নামে। আমি কী করব ওই চেক? তপসদাকে আগেই বলে রাখতে পারতাম, আমার আসল নাম সনাতন দাস, ওই নামেই যেন চেকটা হয়। বলিনি। আমি প্রীতি মিত্র। আসল নাম, নকল নাম বুঝি না। সনাতন দাস আমার সার্টিফিকেটের নাম। একটা সাটিফিকেট সব নয়। ওই চেক আমি ভাঙাতে পারিনি। কারণ ব্যাংকে আমি সনাতন দাস। ভোটার হিসেবে আমি সনাতন দাস কিন্তু কবি হিসেবে আরি প্রীতি মিত্র। ওই চেক আমার কবিতার স্বীকৃতি। ওই চেক আমি যত্নে রেখে দিয়েছি। আমি বই করব। কবিতার বই। প্রীতি মিত্র নামে। ওই তো আমি সেদিন হাসপাতালে গেলাম। কার্ড করলাম। নাম বললাম প্রীতি মিত্র। সেক্স-এর ঘরে লোকটা নিজে থেকেই লিখেছিল এফ। আমার খুব বমি বমি পাচ্ছিল। ডাক্তারকে বললাম। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিল। বাচ্চা ডাক্তার। ইউরিন টেস্ট করাতে বলল। প্রেগন্যান্ট ভাবল? খুব আনন্দ হল আমার। পরে দেখি বিলিরুবিন টেস্ট করতে লিখেছে। আমার না, মাইরি বলছি, গাইনি সেকশনে দেখাতে ইচ্ছে করে, খুব ইচ্ছে করে…। ও ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু, আমার খুব বেশি পিরিয়ড হচ্ছে।

ওইসব পিরিয়ড-টিরিয়ড আমি খুব ছোট বয়েস থেকেই জানি। আমি ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের সঙ্গে মিশতাম। ওদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলতাম। ছন্দা আর মায়ার সঙ্গে পুতুল খেলতাম। পুতুলের বিয়ে দিতাম। পুতুলকে দুদু খাওয়াতাম। মেয়েদের মতোই বসে হিসি করতাম। আমার নুঙ্কুটাকে আমি দু’চোখে দেখতে পারতাম না, কিন্তু অন্য ছেলেদের নুঙ্কু দেখতে ভালো লাগত। ছন্দা আর মায়ারা ওদের সব কিছু আমায় বলত। পাড়ার ছেলেরা আমাকে লেডিজ বলত। বাবা, মা দু’জনেই আমাকে বকেছে, মেরেছে। আমাকে বলত–এক্কাদোক্কা নয়, বল খেলগে যা। ঘুড়ি ওড়াগে যা। আমি যেতাম না। বাবা আমাকে ‘একটা মেয়ে কোথাকার’ বলে মেরেছে। মেয়ে একটা খিস্তি। শুয়ার-খচ্চর-গাণ্ডুর মতো একটা খিস্তি। অথচ আমার আগে নাকি একটা বোন হয়েছিল আমার। ও আন্ত্রিকে মারা যায়।ওর জন্য মা-বাবার আফশোশ শুনতাম। কিন্তু আমাকে ওরা মেয়ে ভাবতে পারল না। কী করে ভাববে। আমি নুঙ্কুধারী যে। ওই একটা অঙ্গ দিয়েই তো বিচার করা হয়। আমি মায়ের আলতা ঠোটে লাগাতাম বলে মার খেয়েছি, তবু সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মায়ের শাড়ি পরেছি, বউ হয়েছি, গভীর রাতে বাবার কোলবালিশটাকে চিমটি কেটেছি। কোলবালিশ তো নয়, ওটা আমার বর।

ছন্দা মায়া, ওদের পিরিয়ড হল। ওরা মেয়ে হয়ে গেল। আমি বেশ বুঝলাম ওরা আমাকে অ্যাভয়েড করছে।

স্কুলে ছেলেরা আমায় চাঁটি মারত, স্যারদের মধ্যে কেউ কেউ হিজড়ে বলত। তখনও ইিজড়ে ব্যাপারটা বুঝতাম না ভালো। আর ভূগোল স্যর আমাকে ম্যাপ পয়েন্টিং শেখাতেন ছুটির পর। গরমের ছুটিতে বাড়িতে যেতে বলতেন।

মাধ্যমিকটা পাস করেছিলাম। টায়-টায় সেকেণ্ড ডিভিশন হয়েছিল। ইলেভেনে ভর্তি হলাম, কো-এডুকেশন ছিল। ওখানে মেয়েরাও আমাকে হ্যাটা করত। কেউ কেউ আমায় দেখে হাততালি দিত। আমি ওদের বলতাম আমি তোমাদেরই লোক। আমার লালি মাসি হয় না বটে, কিন্তু আমি তো…। আমার মা, কলেজে দু’টো বয়ফ্রেণ্ড হয়ে গেল। অশোক আর বিকাশ। ওদের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসি ঠিক বুঝতে পারতাম না। কিন্তু আমায় নিয়ে ওদের কোনও প্রবলেম ছিল না। পরে জানলাম অশোক ডাবলডেকার। মানে উভকামী। তখন বিকাশকেই নিজের ভাবতাম। বিকাশ পড়াশোনায় ভালো ছিল; আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতাম বিকাশ যেন ডাক্তার হয়, মস্ত বড় ডাক্তার হয়ে ও আমাকে অপারেশন করে মেয়ে করে দেবে। আমি আর ও সংসার করব। মাইরি, আপন গড, আমি এসব ভাবতাম। একদিন বিকাশের কাকা আমাকে খুব প্যাদাল। ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। বিকাশ আমার সঙ্গে আড়ি করে দিল। ব্যাপারটা রটে গেল। স্কুলে আমার নাম হয়ে গেল পি.এম। মানেটা নিশ্চয়ই বিতাং করে বলে দিতে হবে না।

গেল আমার কুল। মানে স্কুল। পড়াশুনোয় ফুলস্টপ। বাবা ভীষণ খচে গেল। আমার সঙ্গে কথাবার্তা পুরো বন্ধ। মায়ের সঙ্গেও বেশি কথা হত না। আমি নাচের স্কুলে ভর্তি হলাম। মাইনে নিজেই জোগাড় করতাম। আমার নিজস্ব ইনকামের রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ধুরানি হয়ে গিয়েছিলাম কিনা। পি.এম স্ট্যাম্পটা পড়ে গিয়েছিল আমার সত্তায়।

 বাবার ক্যানসারের কথাটা অত ডিটেলে বলতে ইচ্ছে করে না। কাশি। তারপর কাশির সঙ্গে রক্ত। বুকে জল। জল বার করার দৃশ্যটা মনে আছে খুব। বাবার অফিসের লোকরা ঠাকুরপুকুরে ব্যবস্থা করল। ওখানে একমাস। তারপর বলল বাড়ি নিয়ে যান। কিছু করার নেই। আবার বাড়ি। বাড়িতে একটা আয়া রাখা হল। সেই আয়াটা ওর একটা মাস ছয়েকের বাচ্চাকে নিয়ে আসত। ওর নাম ছিল বাসবী। বাসবী মাঝে মাঝে এসে বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াত, তখন আমাকে ওই ঘর ছেড়ে চলে যেতে হত। কিন্তু অনেকটা সময় আমি বাচ্চাটার গায়ে আলো হয়ে পড়ে থাকতাম। বাচ্চাটির গায়ের গন্ধ নিতাম। বাচ্চাটা হিসি করলে আমি কাথা পালটে দিতাম। বাসবী এসে দেখত কাথা পালটানো হয়ে গেছে ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসত। ওই হাসিতে একটু কৃতজ্ঞতাও মেশানো থাকত। একদিন আমি একটা কাজ করে ফেললাম। বাজে কাজ। আমার গেঞ্জির ভিতরে ইলু ইলু পুরলাম। মানে জল ভরা মোটা পর্দার বেলুন। বাচ্চাটাকে আমার বুকের ওপর চেপে ধরলাম। বাচ্চাটা কেঁদে উঠল। বাসবী ছুটে চলে এল। ছুটে এসে আমাদের ওই অবস্থায় দেখল আর খুব জোরে চিৎকার করে উঠল। ওর চিৎকার শুনে মা ও বাবা ওপর থেকে বলতে লাগল কী হল? আমি ইচ্ছে করেই আমার গেঞ্জির ভিতর থেকে ইলু ইলু সরাইনি। মা আমার হাত ধরে বাবার ঘরে নিয়ে এল। বাবা আমার দিকে অপলক চেয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, অমন করে না মা…। বাবার কাছ থেকে পাওয়া ওটাই আমার লাস্ট প্রাইজ। ওটাই আমার সারপ্রাইজ। কিন্তু মা তখন রাগে কাঁপছে। মেয়ে হয়ে একটা মেয়েকে বুঝতে পারছে না। বাবার ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে আমার ফোলা বুকে খোঁচা দিয়ে বলল, ঢং হচ্ছে, ঢং।

ঝরনাধারার মতো বেলুন থেকে দুখী জল বেরিয়ে গেল মাটিতে। বাবা পরদিনই মারা যান। তখন আমার একুশ বছর বয়েস।

আজ আমি সাতাশ। তখনকার সনাতন দাসের সঙ্গে আজকের এই প্রীতি মিত্রর অনেক তফাত। আমার জীবনে টার্নিং পয়েন্ট রবীন্দ্রসদনের ওই ঘটনাটা, যেটা আগেই বলেছিলাম। সেদিন আলোকাদির মুখ থেকে ছুটে আসা ন্যাকড়া ন্যাকড়া আমাকে পালটে দিয়েছিল। ঠিক করেছিলাম আমিও দেখে নেব। ততদিনে তো আমার বাবা মারা গেছেন। বাবার মৃত্যুর পর মা কেমন চিপসে গেল। বাবার এল আই সি, পি.এফ. গ্র্যাচুইটি–এসব থেকে অনেক টাকা পাওয়া গেল, তার ওপর পেনশন। তার ওপর আমার নিজস্ব রোজগার। নাচে তেমন পয়সা না পেলেও একটা ইউনিসেক্স বিউটি পার্লার থেকে রোজগার ছিল। ওখানে খোমর করতাম, ভালো ইনকাম। ঠিক করলাম, আমিও হরমোন করাব, সিলিকন করাব, প্লাস্টিক সার্জারি করাব। বাবার মৃত্যু আমাকে ওই সুবিধাটা করে দিল। অনেকেই ছি ছি করে উঠছেন, না? তা আমি কী করব? বাবা মারা গেলে আমি কী করব? কিন্তু শ্মশানে বাবার বন্ধুদের কথাবার্তা কানে আসছিল। বাবার নাকি আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা ছিল। বাবার মৃত্যুর জন্য নাকি আমিই চেষ্টা করলে কমপ্যাশনেট গ্রাউণ্ডে আমার চাকরির জন্য নাকি চেষ্টাও করা যায়, কিন্তু আমার মতো মৌগার জন্য ইউনিয়ন চেষ্টা করবে না…।

হাতে টাকা হলেই সাহস বেড়ে যায়। আগে আমি পুরুষ পোশাক ছাড়তে পারিনি। এবার পারলাম। এবার পারিক নিয়ে ঘুরতে লজ্জা নেই আর। ছমকাতে লাগলাম, আমার পৃথিবীটায় যেন বসন্ত এল। মাইরি, যেন অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে। আমার কবিতা পেতে লাগল। প্রেমের কবিতা নয়, সংগ্রামের, সংগ্রামের। নিজেকে পূর্ণ করতে লাগলাম, আমার অন্তর আর বাহিরকে যে মেলাতে লাগলাম–সেটা কি সংগ্রাম নয়?

আমি যুদ্ধ করলাম। সে অনেক কথা। কথা ও কাহিনি। লিখতে পারলে উপন্যাস হয়ে যাবে। সন্না দিয়ে গোঁফ-দাড়ি তুলতাম আগে, হরমোন করার পর ওসব বন্ধ হয়ে গেল। গলার স্বরও পালটে গেল। আমারও চেষ্টা ছিল। সরু গলায় কথা বলা প্রাকটিস করতাম। কেউ শেখায়নি, নিজে নিজে করতাম। ওটাই এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। বুকটা করে ফেলেছি। ডাক্তার দাশগুপ্ত আমাকে একটা কী সুন্দর শ্রী-অঙ্গ করে দিয়েছে। আর আমার জন্ম থেকে পাওয়া লিকম্‌টা–তুলো-রক্ত-গজ ব্যাণ্ডেজের সঙ্গে কোন ডাস্টবিনে। ওখানে মাছি উড়ুক। আমার একজন প্রেমিকও জুটে গেল। আমার বাড়িতেই থাকে। ঘর জামাই। মা ওকে মেনে নিল। আমার কবিতা পেতে লাগল। পৃথিবীতে কত কবিতা। কবিতা তো ফেমিনিন জেণ্ডার। কবিতা স্ত্রীলিঙ্গ কেন? আর একটু বলব। আমার সুখের কথা। আমার প্রেমিকটা খুব ভালো। আমাকে খুব আদর করে। আমি বলেছি আমি তো তোমায় বাচ্চা দিতে পারব না…ও বলেছে সব মেয়ের কি বাচ্চা হয়?

আমার মায়ের স্ট্রোক হল। হাসপাতাল থেকে ফিরে বাড়িতে। বিছানায় সব কিছু। প্যারালিসিস হয়ে গেল। আয়া রাখতে হল। আবার আয়া। এর নাম সুমিত্রা। এই আয়াটারও একটা দুধের বাচ্চা। বাচ্চাটিকে বুকের দুধ খাওয়ায় সুমিত্রা দেখে আমার হিংসে হত। হিংসে হওয়া উচিত নয়, আমি জানি। ভগবান ওকে দুধে ভরা স্তন দিয়েছে। ও বাংলার বধূ বুকে তার মধু। আর আমার নয়নে নীরব ভাষা। আমার ওই ভাষার ট্রান্সলেশন হয়? আমার বুকে যদিও সিলিকোন, তবু আরও ভিতরে, ওই সব সিলিকোন-টিলিকনের আরও গভীরে, গোপনে, একটা রূপকথার কৌটোয় হীরের টুকরোর মতো ভালোবাসা লুকোনো আছে, ডাক্তাররা জানে না। ওই সব ম্যামারি গ্ল্যাণ্ড-ট্যামারি গ্ল্যাণ্ডকে বিলা করে বুকের ভিতর থেকে কীরকম যেন একটা আহ্বান–দুদু খাবি সোনা?

মাঝে নাঝে আমি আয়নার সামনে সব খুলে-টুলে দাঁড়াই। নিজেকে দেখি। আজি এ নিরালা যজ্ঞে আমার অঙ্গ মাঝে, বরণের ডালা সেজেছে আলোকমালার সাজে। জানি এই সবই ইস্ট্রোজেন প্রজেস্টেরনের খেলা, জানি ডাক্তার দাশগুপ্তর হাতযশ। তবু তো কবিতা…

নব বসন্তে লতায় পাতায় ফুলে

বাণী হিল্লোলে উঠে প্রভাতের স্বর্ণকূলে

আমার দেহের বাণীতে সে গান উঠিছে দুলে…।

আমার দেহের বাণীতে–কেন যে, দুদু খাবি সোনা…।দুদু খাবি সোনা…।

বাচ্চা দত্তক নেবার কথা ভেবেছিলাম। হল না। আইন নেই। বললাম দুধের বাচ্চা নেব না, একটু বড় বাচ্চাই নেব।ওরা বলল না, হয় না। আইন নেই। তোমার নারীত্ব বৈধ নয়। তা হলে? আমি যদি পাসপোর্ট করি, কী লেখা হবে? মেল না ফিমেল? মরে গেলে ডেথ সার্টিফিকেটে?

মায়ের আয়া সুমিত্রা জানে আমি অপারেশন করে মেয়ে হয়েছি। সুমিত্রা আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করে। বলেছি। সুমিত্রাও ওর নিজের মেয়েলি কথা বলে। একদিন দেখতেও চেয়েছিল। দেখিয়েছি। সুমিত্রা অবাক হয়েছিল। বলেছিল বাব্বা, একদম সেম সেম। আমি বললাম ওরা সব করতে পারে, কিন্তু লালি মাসিটা দিতে পারে না। বাচ্চা ধরার থলিটা বানাতে পারে না। সুমিত্রা বলে, একদিন হয়তো সেটাও হবে। আমি বললাম, ততদিনে আমরা মরে যাব।

সুমিত্রার সামনে একদিন বুক খুলে দিলাম, বললাম, তোমার বাচ্চাটাকে একটু দেবে? এখানে ওর মুখ ছোঁয়াব…। ফুল ছোঁয়াব। সুমিত্রা আমার খুব ভালো বান্ধবী। ও দিল। আমার নিপ্‌ল-এ ওর নিষ্পাপ ঠোঁট রাখল। উঃ। কী আনন্দ।

মাঝে মাঝেই এরকম করতাম। বাচ্চাটা দুধ পেত না বলে ওর কচি হাতে তোলপাড় করত আমার শরীর। আমার সর্ব অঙ্গে বাঁশি বাজত। ওকে দোলাতাম, আমিও দুলতাম তাই। আমার মায়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। শূন্য দৃষ্টি। আমি কেবল বলতাম, মা তুমি থাকো। তুমি যতদিন থাকবে, ততদিন বসন্ত।

মা মারা গেল। মা চলে গেল বলে সুমিত্রাও চলে গেল। সুমিত্রার বাচ্চাটাকে শেষবারের মতো…। বাচ্চাটা অস্ফুটে যেন বলল মা… মা…। আমাকে? ওর কি কথা ফুটছে? মুখ থেকে বেরিয়ে আসা প্রথম শব্দ, আদি শব্দ…। আমাকে?…

ওরা চলে গেল। সিলিকোন পড়ে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *