উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

সিরাজের বিজয় অভিযান

সিরাজের বিজয় অভিযান

এক

এই অঞ্চলেই আগে ছিল প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ। তারপর তার নাম হয় মাকসুসাবাদ, তারপর মুর্শিদাবাদ।

মহানগরী মুর্শিদাবাদ।

স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী। বিস্ময়-বিমুগ্ধ ক্লাইভ যাকে দেখে লন্ডনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

আজ সেখানে গেলে দেখা যায়, ধুলায় ধূসর হয়েছে তার গর্বোদ্ধত শির। যে ধুলার বিছানায় পড়ে আছে কঙ্কালসার মুর্শিদাবাদের জরাজীর্ণ মৃতদেহ, সেই ধুলার সঙ্গে কিন্তু মিশে আছে সুদূর এবং নিকট অতীতের কত মানুষের স্মৃতি!

হিন্দুদের হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক, মহীপাল, রানি ভবানী ও মোহনলাল এবং মুসলমানদের হোসেন শা, মুরশিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, মিরমদন—

এবং সিরাজউদ্দৌলা।

মিরজাফর ও মিরকাসিম বাংলায় নকল নবাবির অভিনয় করেছিলেন মাত্র। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হচ্ছেন সিরাজউদ্দৌলা।

কয়দিনই বা তিনি সিংহাসনে বসবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র আঠারো বৎসর বয়সে। কিন্তু এর মধ্যেই তাঁর নাম করেছে অমরত্ব অর্জন। কারণ? তিনি ছিলেন স্বাধীনতা-যজ্ঞের পুরোহিত।

বালক সিরাজের ছিল যথেষ্ট বালকতা, প্রচুর দুর্বলতা। সেজন্যে তাঁর নামে শোনা যায় অনেক কুৎসা। কিন্তু সেই নিন্দার খোলস থেকে মুক্ত করে নিলে আমরা যে সিরাজের দেখা পাই, তিনি হচ্ছেন সোনার বাংলার খাঁটি ছেলে। দেশমাতৃকার পায়ে পরাবার জন্যে যখন ফিরিঙ্গি দস্যুরা শৃঙ্খল প্রস্তুত করছিল এবং যখন সেই অপকর্মে তাদের সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে এসেছিল হিন্দু ও মুসলমান দেশদ্রোহীর দল, সিরাজ তখন তাদের বাধা দিয়েছিলেন প্রাণপণে। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি পণরক্ষা করতে পারলেন না, তাঁকে দিতে হল প্রাণ।

এই প্রাণদান, এই আত্মদানের জন্যেই সিরাজের নাম আজ মহনীয়, বরণীয় এবং স্মরণীয়। স্বদেশের জন্যে সিরাজ দিয়েছিলেন বুকের শেষ রক্তবিন্দু।

এই জন্যেই সিরাজের সব দোষ ভুলে লোকে আজও তাঁর জন্যে চোখের জল ফেলে পরমাত্মীয়ের মতো এবং এইজন্যেই সিরাজের মৃতদেহ আজও যেখানে ধুলার সঙ্গে ধুলা হয়ে মিশিয়ে আছে, একদিন আমি সেখানে ছুটে গিয়েছিলুম তীর্থযাত্রীর মতো।

সেখানে গিয়ে কানে শ্রবণ করলুম অতীতের গৌরববাহিনী বাণী, প্রাণে অনুভব করলুম স্মৃতির চিতাগ্নিজ্বালা, মানসচোখে দর্শন করলুম পলাশির রক্তাক্ত দুঃস্বপ্ন।

আগে সেই কথা বলব।

দুই

পনেরো বৎসর আগেকার কথা।

এক সাহিত্যিক বন্ধুর আমন্ত্রণে প্রথমে জিয়াগঞ্জে গিয়ে উঠলুম। জিয়াগঞ্জকে মুর্শিদাবাদের শহরতলি বলা যায়।

তারপর সেখান থেকে গঙ্গাজলে নৌকো ভাসিয়ে চললুম খোসবাগের দিকে, সেখানেই আছে সিরাজউদ্দৌলার সমাধি। আমার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন যুবক।

নৌকো ভাসছে গঙ্গানদীতে, না কোনও ছোট খালের জলে? স্থানে স্থানে শিশুরাও পায়ে হেঁটে গঙ্গা পার হয়ে যায়, এ আমি স্বচক্ষে দেখলুম। স্রোতের নামগন্ধও নেই। এ-গঙ্গার একটিমাত্র গুণ, কলকাতার মতো জল এখানে পঙ্কিল নয়। সমুদ্রনীল স্বচ্ছ জল, তলা পর্যন্ত দেখা যায়। স্পঞ্জের মতো দেখতে পুঞ্জ পুঞ্জ শেওলা ভাসে। গঙ্গার তলদেশে বার বার দৃষ্টিচালনা করেও কোনও ছোট-বড় জলচর জীব আবিষ্কার করতে পারলুম না। শুনলুম কেবল বর্ষাকালেই এখানকার গঙ্গা আবার হয়ে ওঠে বেগবতী স্রোতস্বতী।

গঙ্গাতীরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ। কেবল তীরে নয়, নদীগর্ভেও ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় যেখানে-সেখানে? বোঝা গেল, যেখান দিয়ে আমাদের নৌকো বয়ে যাচ্ছে, আগে সেখানেও ছিল মানুষের বসতি।

সঙ্গীরা দেখিয়ে দিলেন—ওই জগৎ শেঠের ভিটে!

জগৎ শেঠ? সারা ভারতে অদ্বিতীয় ধনকুবের বলে খ্যাতি যাঁর ছড়িয়ে পড়েছিল, টাকার দরকার হলে যাঁর কাছে হাত পাততেন নবাব-বাদশারাও, যাঁর প্রকাণ্ড প্রাসাদ ছিল মুর্শিদাবাদের অন্যতম প্রধান গৌরব—সেই মহীয়ান জগৎ শেঠের বাস্তু-ভিটা?

কিন্তু কোনও প্রাসাদই চোখে পড়ল না। কেবল গঙ্গাতীরে এবং গঙ্গানীরে দেখা গেল একটা ভাঙা স্তূপের খানিক খানিক অংশ। এখানে একটা গরু, ওখানে একটা কুকুর এবং এক জায়গায় চুপ করে বসে আছে কী একটা পাখি।

দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সময়ে হিন্দুদের মধ্যে প্রধান চক্রী ছিলেন এই জগৎ শেঠ! তিনি বার বার চক্রান্ত করেছিলেন বাংলার তিন নবাবের বিরুদ্ধে—সরফরাজ, সিরাজউদ্দৌলা এবং মিরকাসিম। অবশেষে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ তাঁকে মুঙ্গেরের গঙ্গায় ডুবিয়ে মারা হয়—সেটা হচ্ছে মানুষের প্রতিশোধ। তারপর এখানে তাঁর প্রাসাদও গঙ্গাগর্ভে লাভ করেছে সলিলসমাধি—এটা হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ। জগৎ শেঠের নিঃস্ব বংশধররা আজ উদরান্নের জন্যে পরমুখাপেক্ষী, তাঁর বিপুল বিত্তের এক কপর্দকও আর বিদ্যমান নেই, কিন্তু ইতিহাসে অমর হয়ে আছে তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার ঘৃণ্য কাহিনি।

আবার শুনলুম—ওই নবাব আলিবর্দির টাঁকশাল। ইতিহাসে লেখে, নবাবের টাঁকশালের অস্তিত্ব ছিল জগৎ শেঠের প্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যেই। সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে দু-তিনটে জীর্ণ দেওয়াল—তাদের উপরে নেই ছাদের আবরণ।

আবার শোনা গেল—ওই সিরাজউদ্দৌলার প্রমোদশালা! সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বৃদ্ধ আলিবর্দির নয়নের মণি। দাদুর কাছে আবদার ধরে রাশি রাশি টাকা ফেলে তিনি ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে যে রম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, হিরাঝিলের স্বচ্ছ জলে সে দেখত তার নিজের প্রতিচ্ছবি। সিরাজের পতনের পরে ক্লাইভের সঙ্গে মিরজাফর এসে এই প্রাসাদের মধ্যেই বাংলার মসনদে আরোহণ করেছিলেন।

কিন্তু আজ বুঁজে গিয়েছে সে হিরাঝিল। বাংলার শূন্য মসনদ স্থানান্তরিত। প্রমোদশালার বদলে দেখলুম পুঞ্জীভূত ‘রাবিশ’।

যদুপতির সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে মথুরাপুরী এবং শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে অযোধ্যাধাম। এখানেও হয়েছে সেই মহাকাল নাটকের পুনরাভিনয়।

তিন

নৌকা ভিড়ল কূলে। সূর্য তখন অস্তগত। শেষবেলার আলো করছে পালাই-পালাই।

অন্তরের মধ্যে আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণতাকে অনুভব করতে করতে অগ্রসর হলুম খোসবাগের সমাধিমন্দিরের দিকে।

নদীর বালুকাশয্যার পরেই বনজঙ্গল। তার মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে এলোমেলো এবড়োখেবড়ো ধুলোয় ধুলোয় ধূলিময় সংকীর্ণ পথ। চারিদিক নির্জন—জনপ্রাণীর সাড়া নেই। সেদিন চতুর্দশী—এখনও চাঁদের উঁকি মারবার সময় হয়নি।

ভরসন্ধ্যাবেলায় বিজন আলো-আঁধারিতে মনের মধ্যে জমে উঠল কেমন এক আনন্দহীনতা। ভারাক্রান্ত প্রাণে উপস্থিত হলুম বাংলার শেষ নৃপতির শেষ শয্যাগৃহের সামনে।

ছোট একখানা বিশেষত্বহীন বাড়ি, নেই কোনও ঐশ্বর্যের জাঁকজমক। আগ্রায়, লক্ষ্ণৌয়ে এবং অন্যান্য স্থানে নবাব-বাদশা—এমনকি উজির ও রাজকর্মচারীদেরও সমাধিমন্দিরের সমৃদ্ধির তুলনায় এ-বাড়িখানিকে নগণ্য বলেই মনে হয়। এখানে যেন আড়ষ্ট হয়ে আছে একটা করুণ থমথমে ভাব। সিরাজের রক্তাক্ত অন্তিম মুহূর্তের কথা স্মরণ হয়, থেকে থেকে শিউরে ওঠে মন।

চারিদিকে মৃত্যুর স্তব্ধতা। পাখিরাও নীড়ে ফিরে বোবা হয়ে আছে অন্ধকারের ভয়ে। সন্ধ্যার কালিমা ঘন হয়ে উঠলে কোনও পথিকও বোধ করি এই শবস্থানের ত্রিসীমানায় পদার্পণ করে না। এমনকী বারবার ডাকাডাকি করেও এখানকার প্রহরীরও সাড়া পাওয়া গেল না। সেও রাত হওয়ার আগে এখান থেকে সরে পড়ে নাকি। এখান থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় পৃথিবীর জীবনের স্পন্দন! কেবল চিরন্তন ঝিল্লির ঝিমঝিম শব্দে ধ্বনিত হয়ে ওঠে অষ্টাদশ শতাব্দীর একটি শোকার্ত দিনের ভগ্ন কণ্ঠস্বর!

ফটকে ধাক্কা মারতেই নিস্তব্ধতাকে সহসা মুখর করে তুলে খুলে গেল দরজাটা এবং আমরা প্রবেশ করলুম সেই অরক্ষিত সমাধিমন্দিরের ভিতরে।

এধারে-ওধারে ফুলগাছদের ভিড়, তারই মাঝখান দিয়ে পথ। অত্যন্ত সুলভ ও সাধারণ সব ফুলগাছ, আভিজাত্য নেই বলে যারা ধনীদের বাগানে ঠাঁই পায় না। হোক তারা সুলভ ও সাধারণ, তবু আমি তাদের অভিনন্দন দিই। কারণ এখনও তারাই এখানে জাগিয়ে রেখেছে বিগত নবাবি বর্ণবাহারের রঙ্গিলা স্মৃতিটুকু। এই বিশ্বাসঘাতকতার দেশে অমূল্য তাদের কর্তব্যপরায়ণতা।

নবাববংশীয় অন্যান্য ব্যক্তিদেরও দেহ এখানে শায়িত আছে ধরাশয্যায়। তাঁদের সমাধি দেখলুম মুক্ত আকাশের তলায়।

বাইরে তখন ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার ঘনচ্ছায়া। প্রধান সমাধিগৃহের মধ্যে প্রবেশ করে দেখলুম নীরন্ধ্র অন্ধকার।

এতটা আশা করিনি। শুনেছি সিরাজের সাধ্বী সহধর্মিণী লুতফউন্নিসা যতদিন বেঁচেছিলেন, প্রতিদিন নিজে এসে স্বামীর সমাধিকক্ষে স্বহস্তে জ্বেলে দিয়ে যেতেন সোনার সন্ধ্যাপ্রদীপ। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের বিপুল জনতার মধ্যে একমাত্র তাঁরই আত্মা সিরাজকে স্মরণ করত একান্ত শ্রদ্ধাভরে।

লুতফউন্নিসার পরলোকগমনের পরেও বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমাধি যাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে না থাকে, সেইজন্যে পরম করুণাময় ইংরেজ সরকার প্রভূত দাক্ষিণ্য প্রকাশ করেছিলেন।

রাত্রে আলো জ্বালবার জন্যে বরাদ্দ হয়েছিল মাসিক চারি আনা তাম্রখণ্ড!

আমরা কিন্তু সেটুকু উদারতারও প্রমাণ পেলুম না। সমাধিঘরের মধ্যে নেই একটিমাত্র মাটির পিদিমেরও টিমটিমে আলোর শিখা! ঘুটঘুটে আঁধার রাতে এই অশরীরী আত্মার স্মৃতিসৌধে একলা এসে দাঁড়ালে আমার মন হয়তো হত আতঙ্কগ্রস্ত, হয়তো সাহস সঞ্চয় করে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতেই পারতুম না, হয়তো বাইর থেকেই সিরাজের উদ্দেশে কুর্নিশ জানিয়ে এখান থেকে সরে পড়তুম তাড়াতাড়ি।

কিন্তু দলে আমরা হালকা ছিলুম না। এবং আমাদের কারুর কারুর পকেটে ছিল দিয়াশলাইয়ের বাক্স। কাঠির পর কাঠি জ্বেলে অন্ধকারকে আংশিকভাবে তাড়িয়ে যতটা সম্ভব চারিদিক দেখে নিলুম।

একদিকে কতকটা উচ্চস্থানে রয়েছে দৌহিত্রপ্রেমিক মাতামহ নবাব আলিবর্দির অপেক্ষাকৃত মর্যাদাজনক ও মর্মরখচিত সমাধিবেদি।

তারই তলায় প্রায় সমতল জায়গায় দেখা গেল, বিলাতি মাটি দিয়ে বাঁধানো একটি দীন সমাধি—যা যে-কোনও গরিব মুসলমানের যোগ্য হতে পারে। তার একদিক উর্দু ভাষায় কার পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বুঝতে পারলুম না, কিন্তু শুনলুম সেইটিই হচ্ছে বঙ্গ, বিহার ও ওড়িশার অধীশ্বর সিরাজউদ্দৌলার অনন্ত নিদ্রার স্থান। সমাধিটি এত ছোট যে, তার মধ্যে বোধ করি কোনও প্রমাণ মনুষ্যদেহেরও স্থান সংকুলান হয় না। তারপরই মনে হল, এখানে সমাধিস্থ হয়েছে নিহত সিরাজের খণ্ডবিখণ্ড দেহাবশেষ।

সিরাজের পদতলে পতিব্রতা লুতফউন্নিসার ও পার্শ্বদেশে আছে সিরাজের কনিষ্ঠ সহোদর মির্জা মাদির সমাধি—নিষ্কণ্টক হয়ে রাজ্যভোগ করবার জন্যে পাষণ্ড মিরন সিরাজের সঙ্গে হত্যা করেছিল তাঁর সহোদরকেও।

কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর উদাসীনতা ও স্বেচ্ছাকৃত অবহেলা একদা প্রবল পরাক্রান্ত বঙ্গেশ্বরের শোচনীয় অপমৃত্যুর পরেও বিলুপ্ত হয়নি, প্রায় দুই শতাব্দীর কাছাকাছি এসেও তা সমান জাগ্রত থেকে ধুলা-জঞ্জাল ও অন্ধকারের মধ্যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বস্তুর মতো ফেলে রেখেছে তাঁর পবিত্র সমাধিকেও। যিনি ছিলেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার শেষ প্রতীক, আধুনিক যুগ যেন তাঁকে একেবারে ভুলে যেতে চায়!

আধুনিক মানুষ ভুলতে পারে, কিন্তু প্রকৃতি ভোলে না। আকাশের চাঁদ আধুনিক নয় বলেই হয়তো মনে করে রেখেছে অতীত গরিমার কথা।

সঙ্গীদের একজন সহসা সমাধিগৃহের দরজাটা টেনে ভালো করে খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে যেন হারানিধির সন্ধান পেয়ে ঘরের ভিতরে ছুটে এসে অন্ধকারকে লুপ্ত করে ঠিক সিরাজের সমাধির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল চতুর্দশীর প্রায়-পরিপূর্ণ চন্দ্রকরলেখা! রোমাঞ্চ জেগে উঠল আমার সর্বাঙ্গে। মানুষ ভোলে, প্রকৃতি ভোলে না।

বাইরের বাগান থেকে অঞ্জলি ভরে ফুল তুলে এনেছিলুম। আলোকের আশীর্বাদে সমুজ্জ্বল সিরাজের সমাধির উপরে শ্রদ্ধা ভরে ছড়িয়ে দিলুম সেই ফুলগুলি।

চার

পরদিন পলাশির প্রান্তর দিয়ে রেলগাড়ি যখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে, কামরার জানলার কাছে বসে মানসনেত্রে দেখলুম এক মর্মস্পর্শী দৃশ্য…

ধু-ধু করছে পলাশির প্রান্তর। প্রভাতসূর্য করছে কিরণ বিকিরণ। গঙ্গার তরঙ্গ-ভঙ্গে উচ্ছলিত হয়ে উঠছে স্বর্ণাভ রৌদ্র। আম্রকানন একলক্ষ বৃক্ষে পরিপূর্ণ। তারই সামনে ইংরেজদের সেনাদল। দলে তারা ভারী নয়—সংখ্যায় তিন হাজার দুইশত জন মাত্র।

পলাশি গ্রামের সামনে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। ছাউনির ভিতর থেকে কাতারে কাতারে বাংলার সৈন্য প্রান্তরের উপরে বেরিয়ে আসতে লাগল—সংখ্যায় তারা প্রায় পঞ্চাশ হাজার। প্রান্তরের দুই মাইলব্যাপী স্থান আচ্ছন্ন করে নবাবি সৈন্যরা রচনা করলে অর্ধচন্দ্র ব্যূহ। সেই ব্যূহ অগ্রসর হয়ে ইংরেজদের ফৌজকে ঘিরে ফেলতে পারে অনায়াসেই, তখন গঙ্গাজলে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় থাকবে না। ইংরেজদের পক্ষে বাধা দেওয়া অসম্ভব—পঞ্চাশ হাজারের বিরুদ্ধে তিন হাজার!

ঘোর নির্ঘোষে বেজে উঠল কাড়া-নাকাড়া, সদর্পে উড়তে লাগল বাংলার পতাকা, আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে গেল বাঙালি বীরদের বিজয়হুঙ্কারে।

চোখের সামনে জেগে উঠল দুই নায়কের অশ্বারোহী ও অস্ত্রধারী দৃপ্ত মূর্তি—মিরমদন ও মোহনলাল।

দেখলুম তরুণ সিরাজকে। মিরজাফরকে তিনি মিনতি করছেন এবং বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর তাঁকে দিচ্ছেন শূন্যগর্ভ মৌখিক আশ্বাস।

আম্রকাননের সামনে দেখলুম মসীজীবী অসিধারী জালিয়াত ক্লাইভকেও। নবাবের বৃহতী বাহিনীর রণহুংকার শ্রবণ করে বক্ষ তাঁর কেঁপে কেঁপে উঠছে মুহুর্মুহু। বিপক্ষ সৈন্যসাগরে তাঁর নগণ্য ফৌজ তলিয়ে যাবে ক্ষুদ্র তটিনীর মতো। তাঁর একমাত্র আশা বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের নিশ্চেষ্টতা। মিরজাফর যদি সিরাজকে সাহায্য করেন, তাহলে তাঁর ভবিষ্যৎ অন্ধকার!

বাংলার গোলন্দাজরা কামানের পর কামান দাগতে শুরু করলে—ঘন ঘন বজ্রনাদ, হু-হু করে ছুটে আসে নিরেট অগ্নিপিণ্ড, লুটিয়ে পড়ে মরণাহত ইংরেজ সৈন্য। আধঘণ্টার মধ্যে তিরিশজন ইংরেজ সৈন্য নিহত ও আহত!

ক্লাইভ প্রমাদ গুণে চিৎকার করে হুকুম দিলেন—’আর এ ফর্দা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা নয়! পিছিয়ে পড়ো-সবাই পিছিয়ে পড়ে আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নাও!’

ইংরেজরা বেগে আমবাগানের ভিতরে পালিয়ে গেল—আত্মগোপন করলে বড় বড় গাছের গুঁড়ির আড়ালে।

তারপরেই আচম্বিতে আকাশ ভেঙে বজ্রপাত এবং ধারাপাত। ঘনবর্ষণে পলাশির মাঠ হয়ে উঠল বিশাল জলাভূমির মতো।

সমস্ত বারুদ ভিজে স্যাঁতসেঁতে। নীরব হয়ে গেল সিরাজের অগ্নিহীন কামানগুলো! (অনুরূপ দুর্ঘটনা ঘটেছিল ইউরোপের ওয়াটার্লু যুদ্ধক্ষেত্রে—যেখানে ফরাসি নেপোলিয়ন হারেন, ইংরেজ ওয়েলিংটন জেতেন। ভিকটর হিউগো বলেন—’ফরাসিরা হেরে গিয়েছিল খালি কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যে। হঠাৎ বর্ষা নেমে যদি ফরাসিদের বারুদের গাদা ভিজে না যেত, তবে জার্মান সেনাপতি ব্লুচার নতুন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হবার অনেক আগেই ওয়েলিংটন হেরে ভূত হয়ে যেতেন।’ নেপোলিয়নের প্রচণ্ড আক্রমণে কাবু হয়ে প্রায় হাল ছেড়ে ইংরেজদের মান ও প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। ক্লাইভও পালিয়ে গিয়ে আমবাগানে লুকিয়ে রাত্রি কিংবা মিরজাফরের সাহায্যের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। পলাশিতেও বৃষ্টি এসে সিরাজের বারুদের গাদা ভিজিয়ে না দিলে এবং মিরজাফর বিশ্বাসহস্তা না হলে ইংরেজদের জয়লাভের কোনও আশাই ছিল না।)

নিজেদের কামানগুলো অকর্মণ্য দেখে বীর মিরমদন কিছুমাত্র দমলেন না। তিনি ভাবলেন, বৃষ্টিপাতের ফলে তাঁদের মতো ইংরেজদেরও সমস্ত বারুদ ভিজে গিয়েছে। অতএব তাঁর আদেশে নবাবের অশ্বারোহী সৈন্যদল মহাবিক্রমে ইংরেজদের আক্রমণ করবার জন্যে অগ্রসর হল।

কিন্তু না, ইংরেজদের বারুদ ভিজে যায়নি, তারা বুদ্ধিমানের মতো বারুদের স্তূপ ঢাকা দিয়ে রেখেছিল। তাদের কামানের গোলাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণোদ্যত নবাব সৈন্যদের উপরে গিয়ে পড়তে লাগল। সাংঘাতিক আঘাত পেয়ে সেনানায়ক মিরমদন বীরের মতো প্রাণ দিলেন সম্মুখসমরে।

তখনও ইংরেজরা আমবাগান ছেড়ে বাইরে মুখ বাড়াতে সাহস করলে না, কারণ তখনও ব্যাঘ্র-বিক্রমে যুদ্ধ করছে কাশ্মীরি হিন্দু মোহনলালের অধীনস্থ সৈন্যগণ এবং নবাবের বৈতনিক ফরাসি সৈনিকরা।

কিন্তু অবশেষে বেইমান মিরজাফর ও রায়দুর্লভ প্রমুখ শয়তানরাই করলে বাংলার সর্বনাশ। প্রায় আটত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে এতক্ষণ তারা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল অচল কাঠের পুতুলের মতো। এখন চুপিচুপি দূত পাঠিয়ে ক্লাইভকে আক্রমণ করবার পরামর্শ দিয়ে বিশ্বাসঘাতী মিরজাফর প্রভৃতি সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে লাগলেন।

তারপর?

তারপর আমার মানসনেত্র হল অশ্রুবাষ্পাকুল, আর কিছু দেখতে পেলুম না। তার পরের কথা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়, কিন্তু তা আর এখানে পড়ে শোনাবার দরকার নেই, কারণ আজ আমি বলতে বসেছি সেই বালকবীর বিজেতা সিরাজের কাহিনি, যিনি বিজাতীয় ফিরিঙ্গি বণিকদের স্পর্ধা সহ্য করেননি, তাদের কলকাতা থেকে দূর করে দিয়ে তবে ছেড়েছিলেন।

পাঁচ

যেমন অনেক দাগি অপরাধী পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে বাইরে নিরীহ দোকানি সেজে দোকান চালায়, কিন্তু ভিতরে ভিতরে করে চুরি ও রাহাজানি, এদেশে এসে ইংরেজরাও সেই নীতিই অবলম্বন করেছিল।

বাইরে তারা নির্বিরোধী বণিক ছাড়া যেন আর কিছুই নয়। বাজারে নিজেদের মাল বেচে কিছু লাভের লোভেই সাত সাগরে পাড়ি দিয়ে তারা এদেশে আসে এবং ধরনধারণে জাহির করে, যেন তারা নবাব-বাদশার দাসানুদাস।

কিন্তু তলে তলে তাদের আসল ফন্দি ছিল—’ছুঁচ হয়ে ঢুকব, ফাল হয়ে বেরবো।’

একটি বিখ্যাত গল্প আছে। আরব দেশের মরুভূমিতে তাঁবু খাটিয়ে বাস করত এক বেদুইন।

দুপুরের ঝাঁঝালো রোদে পুড়ে মরুবালু আগুন হয়ে উঠেছে। এমন সময়ে একটা উট ধুঁকতে ধুঁকতে এসে বললে, ‘মহাশয়, রোদের তাপে প্রাণ যায়। আপনার এই তাঁবুর ছায়ায় মাথাটা একটু গলিয়ে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেব কি?’

বেদুইন দয়াপরবশ হয়ে বললে, ‘আচ্ছা।’

অল্পক্ষণ পরে উট বললে, ‘মহাশয়, মাথা তো বাঁচল, কিন্তু বুক যে জ্বলে যায়! তাঁবুর ভিতরে বুক পর্যন্ত রাখতে পারব কি?’

বেদুইন বললে, ‘আচ্ছা!’

খানিক বাদে উট বললে, ‘মহাশয়, মাথা আর বুক তো ঠান্ডা হল, কিন্তু দেহের বাকি অংশ যে ঝলসে যাচ্ছে। ওটুকুকে আর বাইরে রাখি কেন?’

বেদুইন বললে, ‘আচ্ছা, ভিতরে এসো।’

উট নিজের গোটা দেহ নিয়ে তাঁবুর ভিতরে ঢুকল। ছোট্ট তাঁবু, একসঙ্গে উট আর বেদুইনের ঠাঁই হল না। অতএব উটকে ভিতরে রেখে বেদুইনকেই বেরিয়ে যেতে হল তাঁবুর বাইরে।

এদেশে এসে ফিরিঙ্গি বণিকরাও অবলম্বন করেছিল তথাকথিত উষ্ট্র-নীতি।

প্রথমে তারা বিবিধ পণ্য নিয়ে এখানে পদার্পণ করে। কিছু কিছু জমি ইজারা নেয়। মাথা রাখবার জন্যে ঘরবাড়ি বানায়। তারপর নানা অছিলায় দুর্গ প্রভৃতি নির্মাণ করতে থাকে। তারপর ক্রমে ক্রমে ভিন্ন মূর্তি ধারণ করে।

কিন্তু ধূর্ত ফিরিঙ্গি বণিকরা নবাব-বাদশাদের চোখে ধুলো দিতে পারেনি।

পোর্তুগিজরা যখন হুগলিতে অন্যায়রূপে প্রবল হয়ে উঠবার চেষ্টা করছিল, তখন ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাজাহান সৈন্য পাঠিয়ে দেন তাদের উৎখাত করবার জন্যে। মোগল সাম্রাজ্যের সেই পূর্ণগৌরবের যুগেও পোর্তুগিজরা সহজে বাগ মানেনি। জলপথে ও স্থলপথে মোগলদের তারা প্রাণপণে বাধা দেয়। প্রায় তিনমাস ধরে লড়াই করে মোগলদের ঠেকিয়ে রেখে অবশেষে পোর্তুগিজরা পরাজয় স্বীকার করে। তাদের বন্দি করে আগ্রায় শাজাহানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দিদের কেউ কেউ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তি পায়, কিন্তু অধিকাংশই ভোগ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই ব্যাপারের পর থেকে বাংলাদেশে শক্তি হিসাবে পোর্তুগিজদের বিষদাঁত একেবারে ভেঙে যায়।

পোর্তুগিজ পর ইংরেজদের পালা। কিন্তু অনেক আগেও ইংজেরা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির অনুসরণ করতে ছাড়েনি। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দেও শায়েস্তা খাঁর আমলে ইংরেজরা একবার হিজলি নামক স্থানে মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। তারপর ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে নানা গোলযোগের সুযোগে তারা কলকাতায় পুরাতন ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ নির্মাণ করে। তারপর নবাব মুরশিদকুলি খাঁ ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের আর কোনও নতুন দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করে দেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ইংরেজরা বাংলাদেশে প্রধান হয়ে ওঠবার চেষ্টা করে। মোগল বাদশাহের রাজশক্তি তখন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে দেখে ইংরেজরা সাহস পেয়ে বাংলাদেশে আবার কেল্লা তৈরি ও ফৌজ গঠন করতে চায়।

কিন্তু নবাব আলিবর্দিও নির্বোধ নন। কারণ ইতিমধ্যেই তিনি দেখেছিলেন, ফরাসি ফিরিঙ্গি দুপ্লে ঠিক ওই উপায়েই দাক্ষিণাত্যের মুসলমান শাসকদেরও চেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। ইংরেজদের ডেকে তিনি বলেন, ‘তোমরা হচ্ছ সওদাগর, তোমাদের আবার কেল্লার দরকার কী? আমিই যখন তোমাদের রক্ষা করবার ভার নিয়েছি, তখন আর কোনও শত্রুকেই তোমাদের ভয় করবার দরকার নেই।’

আলিবর্দির জীবদ্দশাতেই সিরাজ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। অল্পবয়সেই তিনি রাজ্যচালনার কূটকৌশল কিছু কিছু আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন এবং মাতামহের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন একাধিক রণক্ষেত্রে। রীতিমতো বালকবয়সেই সিরাজ পেয়েছিলেন সেনাচালনার ভার। মুতাক্ষেরীন পাঠে বোঝা যায়, রণক্ষেত্রে শত্রুর সামনে নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে সিরাজ যাতে সৈন্যচালনায় দক্ষ হতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যেই আলিবর্দি তাঁর উত্তরাধিকারী দৌহিত্রকে দিয়েছিলেন উপযোগী শিক্ষালাভের সুযোগ।

হলওয়েল বলেন, আলিবর্দি তাঁর মৃত্যুশয্যায় নাকি সিরাজকে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করতে। আধুনিক ঐতিহাসিক বলেন, এ উক্তির কোনও প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাক আর না থাক, আলিবর্দি যে ইংরেজদের সুনজরে দেখতেন না, এটা সিরাজের অবিদিত থাকবার কথা নয়। তার উপরে বাল্যকাল থেকেই ফিরিঙ্গিরা ছিল তাঁর চোখের বালি। তিনি বলতেন, ‘ফিরিঙ্গিদের শাসন করবার জন্যে দরকার কেবল একজোড়া চটিজুতো।’

এই সিরাজ সিংহাসনের অধিকারী হয়েছেন বলে কলকাতার ইংরেজরা দস্তুরমতো তটস্থ হয়ে উঠল।

ছয়

সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের ঝগড়া বাধল কেন? এর উত্তরে দেখানো যায় একাধিক কারণ।

রাজা রাজবল্লভ ছিলেন ঢাকার একজন পদস্থ রাজকর্মচারী। তহবিল তছরুপাতের অভিযোগে তিনি কারারুদ্ধ হন। সেই খবর পেয়ে তাঁর পুত্র কৃষ্ণবল্লভ পিতার সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে গোপনে কলকাতায় পালিয়ে যান এবং ইংরেজরাও তাঁকে আশ্রয় দিয়ে করে অন্যায়কে সমর্থন।

এই বেআইনি কার্যের প্রতিবাদ করে সিরাজ কলকাতায় ইংরেজদের কাছে দূত প্রেরণ করেন। উদ্ধত ইংরেজরা দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।

দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে অতিশয় গুরুতর। আলিবর্দির নির্দেশ ছিল, ইংরেজরা আর কোনও নতুন কেল্লা তৈরি করতে পারবে না এবং ইংরেজরাও মেনে নিয়েছিল এই নির্দেশ।

কিন্তু গুপ্তচরের মুখে সিরাজ খবর পেলেন, ইংরেজরা কেবল কলকাতার পুরাতন দুর্গেরই সংস্কার করছে না, বাগবাজারের খালের ধারে একটি নতুন উপদুর্গও নির্মাণ করেছে। শর্ত অনুযায়ী ইংরেজরা এ কাজ করতে পারে না এবং এটা হচ্ছে নবাবের তাঁবেদার হয়েও তাঁর প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা। কোনও স্বাধীন নৃপতিই এমন অপমান সহ্য করতে পারেন না।

সে সময়ে সিরাজের হাত ছিল জোড়া। তাঁর আত্মীয় পূর্ণিয়ার নবাব সওকত জং তখন বিদ্রোহী হয়েছেন, নিজেকে বঙ্গ-বিহার-ওড়িশার অধীশ্বর বলে ঘোষণা করেছেন। আগে এই বিদ্রোহ দমন করা দরকার। অতএব শর্তভঙ্গ করার জন্যে প্রতিবাদ করে ইংরেজদের কাছে এক দূত পাঠিয়ে সিরাজ মুর্শিদাবাদ থেকে সসৈন্যে বেরিয়ে পড়লেন সওকতের নবাবির স্বপ্ন পণ্ড করে দেওয়ার জন্যে।

যথাসময়ে কলকাতায় গিয়ে উপস্থিত হল সিরাজের দূত। ড্রেক ছিলেন তখন কলকাতার গভর্নর। নির্বোধের মতো তিনি দেখালেন মেজাজ। নবাবের অধীন হয়েও ব্যবহার করলেন স্বাধীন রাজার মতো। তিনি পিয়নদের হুকুম দিলেন, ‘নবাবের দূতকে কলকাতা থেকে দূর করে দাও।’ তাই হল।

সিরাজ তখন যুদ্ধযাত্রা করে রাজমহলের পথ ধরেছেন। দূত যে কলকাতা থেকে গলাধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে, তাঁর কানে উঠল এ খবর।

সিরাজের ক্রোধের আর সীমা রইল না। সংখ্যায় মুষ্টিমেয় একদল বিদেশি সওদাগর পদে পদে যদি নবাবের আদেশ লঙ্ঘন ও তাঁকে অপমান করতে সাহস পায়, তবে তাঁর মানমর্যাদা থাকে কোথায়?

সওকত জং দেখুক আরও দুদিন নবাবির স্বপ্ন, আগে ফিরিঙ্গিদের দর্পচূর্ণ করে তবে অন্য কাজ।

সিরাজ সেনানীদের হুকুম দিলেন, ‘আপাতত ফৌজের মুখ ফেরাও। কলকাতায় চলো, আগে কলকাতায় চলো!’

কলকাতার পথে পড়ে কাশিমবাজার। সেখানে আছে ইংরেজদের কুঠি ও কেল্লা। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ২৪ জুন তারিখে সেইখানে সিরাজের প্রথম সংঘর্ষ হয় ইংরেজদের সঙ্গে। কিন্তু সে সংঘর্ষ নামমাত্র। নবাবের সৈন্যরা অবলীলাক্রমে কেল্লা দখল করে ফেললে। কুঠি হল লুণ্ঠিত। বেশিরভাগ ইংরেজ হল গ্রেপ্তার। কেউ কেউ দিলে পিঠটান—তাদের মধ্যে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস।

কাশিমবাজারে ছিলেন কান্তবাবু। লোকে তাঁকে ‘কান্তমুদি’ বলেও ডাকত, কারণ তাঁর একখানি মুদির দোকান ছিল। হেস্টিংস চম্পট দিয়ে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করলেন, তিনিও তাঁকে নিজের বাড়ির ভিতরে লুকিয়ে রাখলেন। হেস্টিংস এ উপকার ভোলেননি। পরে তিনি যখন হন এদেশে ইংরেজদের সর্বেসর্বা, কান্তবাবুকে বহু সম্পত্তি দিয়ে রাজ-উপাধিতে ভূষিত করেন। কাশিমবাজারের মহারাজারা কান্তবাবুরই বংশধর।

সিরাজ যে রণনীতিতে অনভিজ্ঞ ছিলেন না, এইবারে তারও পরিচয় পাওয়া গেল।

তিনি বুঝলেন, সংঘর্ষ যখন বেধেছে, তখন শত্রুদের আর হাঁপ ছাড়তে দেওয়া উচিত নয়। কারণ অবসর পেলেই তারা আটঘাট বেঁধে প্রস্তুত হয়ে উঠবে। তখন তাদের দমন করতে গেলে রীতিমতো বেগ পেতে হবে।

কাশিমবাজার দখল করবার পর বারো দিনের ভিতরেই সমস্ত তোড়জোড় ঠিক করে ফেলে সিরাজ দ্রুতবেগে ধাবমান হলেন কলকাতার দিকে।

সেখান থেকে কলকাতা হচ্ছে একশো ষাট মাইল। তখন রেলগাড়িও ছিল না, মোটরও ছিল না। কিন্তু বৃহৎ এক সেনাবাহিনী এবং আনুষঙ্গিক লোকজন ও প্রচুর লটবহর নিয়ে সিরাজ ঠিক এগারো দিনের মধ্যেই সেই একশো ষাট মাইল পথ পার হয়ে উপস্থিত হলেন কলকাতার উপকণ্ঠে।

ইংরেজদের বুক কেঁপে উঠল। সিরাজের এমন সংহার-মূর্তি, এমন ঝড়ের গতি তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি।

কলকাতায় সাজ সাজ রব উঠল।

কিন্তু শিয়রে শত্রু, সাজবার ফুরসত কোথায়?

নবাব বলতে বোঝায় তো মূর্তিমান বিলাসিতা—কাজকর্মে জড়ভরত। নবাব যে এমন দেখবার-বোঝবার আগে চিলের মতো হুস করে কলকাতার উপরে ছোঁ মারবেন, কারুর হিসাবে এটা আসেনি। ইংরেজরা ভেবেছিলেন, চোখ রাঙিয়ে আর বাক্য বীরত্ব দেখিয়েই সিরাজকে একেবারে দমিয়ে দেবেন—কিন্তু এখন এ যে উলটা বুঝিলি রাম!

ইংরেজদের সৈন্যসংখ্যা মোট চারশো তিরিশজন—তার মধ্যে খালি ইংরেজ নয়, পোর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান ও ইউরেশিয়ান বা ট্যাঁস ফিরিঙ্গিরাও আছে। মতান্তরে ইংরেজদের দলে ছিল পাঁচশো পনেরো জন লোক।

ইংরেজদের তখন ‘ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সরদারের’ মতো অবস্থা। পুরাতন দুর্গের প্রাচীর নড়বড়ে, তারই উপরে বসানো আছে কতকগুলো সেকেলে মরচে-ধরা কামান। বারুদ স্যাঁতসেঁতে ও অকেজো।

১৬ জুন তারিখে নবাবসৈন্যরা বাগবাজারে খালের ধারে নতুন উপদুর্গ আক্রমণ করলে, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারলে না, তবে অনেক সেপাই নানা জায়গায় খাল পার হয়ে শহরের ভিতরে এসে পড়ল।

ইংরেজরা স্থির করলে তারা খালি সাহেবপাড়ায় (লালদিঘির পূর্ব ও দক্ষিণ দিক) থেকে নবাবসৈন্যদের বাধা দেবে। তারা আগুন ধরিয়ে দিলে দেশিপাড়ায়, সে আগুন নিবতে লেগেছিল অনেকক্ষণ। ইউরোপীয়ানদের স্ত্রী-পুত্র ও কন্যা প্রভৃতিও দুর্গের ভিতরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলে।

সবচেয়ে কাহিল অবস্থা হল ইউরেশীয়ান বা ট্যাঁস ফিরিঙ্গিদের। ইংরেজরা তাদের আমল দেয় না এবং ভারতীয়দের দলেও তারা ভিড়তে পায় না। কাজেই তাদের হাল হল অনেকটা ত্রিশঙ্কুর মতো।

অবশেষে নবাবি সেপাইদের ভয়ে দলে দলে ইউরেশীয় স্ত্রী-পুরুষ দুর্গদ্বারে গিয়ে ধরনা দিতে বাধ্য হল। ইংরেজরা দুর্গদ্বার খুলে তাদের আশ্রয় দিতে নারাজ। কিন্তু তাদের কাতর ক্রন্দন এমন গগনভেদী হয়ে উঠল যে, অবশেষে তাদের জন্যেও দুর্গদ্বার খুলে দিতে হল।

ইতিমধ্যে সিরাজও কলকাতায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। সিমলা অঞ্চলে ছিল আমিরচাঁদের বাগান, তাঁর আস্তানা হল সেইখানেই।

মেটেবুরুজেও ইংরেজদের থানা ফোর্ট নামে এক দুর্গ ছিল। ইংরেজদের তাড়িয়ে নবাবি ফৌজ সেই দুর্গ কেড়ে নিলে।

১৮ তারিখে কলকাতার উপর প্রধান আক্রমণ শুরু হল। নবাবি ফৌজ এল দুই দিক থেকে—শিয়ালদা ও পূর্ব এসপ্ল্যানেড। তারা ইংরেজদের দ্বারা পরিত্যক্ত বাড়িগুলো দখল করে ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গের উপরে এমন প্রচণ্ড অগ্নিবৃষ্টি শুরু করলে যে, ইংরেজদের কামানগুলো হল নীরব—তারা কামানের মায়া ছেড়ে পাততাড়ি গুটিয়ে একেবারে দুর্গের অন্দরমহলে গিয়ে আশ্রয় নিলে।

সেই রাত্রেই অধিকাংশ নারীকে জাহাজে পাঠিয়ে দেওয়া হল। দুর্গরক্ষীদের অবস্থা শোচনীয়, তাদের দেহ শ্রান্ত ও উপবাসক্লিষ্ট—কারণ পাচকরা পলায়ন করেছে, খাবার রাঁধবার জন্যে কেউ নেই। তার উপরে গোলা-গুলি-বারুদও ফুরিয়ে এসেছে। যে গভর্নর ড্রেকের জন্যে এই বিপদ, তিনি তল্পিতল্পা গুটিয়ে লম্বা দিতে চাইলেন।

পরদিনের (১৯ জুন) অবস্থা আরও সঙ্গিন। আর্মেনিয়ান ও ইউরেশিয়ান সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আর লড়াই করতে চাইলে না। ইউরোপীয় সৈন্যদেরও প্রায় সেই অবস্থা, তারা অস্ত্রধারণ করে রইল অত্যন্ত নাচারভাবেই। অনেকেই দিশেহারা হয়ে কেল্লা ছেড়ে জাহাজে গিয়ে উঠে বসল। গভর্নর ড্রেক ও সেনাধ্যক্ষ মিঞ্চিনও প্রমাদ গুণে ‘য পলায়তি স জীবতি’ ভেবে চটপট চম্পট দিলেন জাহাজের উদ্দেশে।

আর্মেনিয়ান ও ইউরোশিয়ানদের বাদ দিলেও দুর্গের মধ্যে তখনও সক্ষম শ্বেতাঙ্গ যোদ্ধা ছিল একশো সত্তর জন। গভর্নর ও সেনাপতির কাপুরুষতা দেখে তারা খাপ্পা হয়ে উঠল। সকলে মিলে তাঁদের পদচ্যুত করে গভর্নর ও সেনাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করলে হলওয়েলকে।

হলওয়েল শত্রুদের বাধা দেওয়ার শেষ চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সফল হলেন না। নবাবের সেপাইদের অত্যুগ্র অগ্নিবৃষ্টির সামনে দুর্গপ্রাকারে তিষ্ঠানোই অসম্ভব, শ্বেতাঙ্গরা দলে দলে হল পপাতধরণীতলে।

সেই রাত্রে দুর্গের চারিদিককার বাড়িঘর দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। ইংরেজ সৈন্যরাও তখন আর সেনানীদের হুকুম মানতে রাজি হল না, তারা মদের ভাণ্ডার লুটে বেহেড মাতাল হয়ে হই হই করে বেড়াতে লাগল। অনেক ইউরোপীয় সৈন্য দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়ে সিরাজের পক্ষে যোগদান করলে।

পরদিন ২০ জুন রবিবার। হলওয়েলও হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন। গঙ্গার বুকে তখনও জাহাজের উপরে গভর্নর ড্রেক প্রভৃতি পলাতক ইংরেজরা বিরাজ করছিলেন। হলওয়েল সঙ্কেত করে তাঁদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ড্রেক ইচ্ছা করলেই নৌকা পাঠিয়ে হলওয়েল প্রভৃতিকে উদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু তখন তাঁর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছে, আবার এই বিপদজ্জনক স্থানে এসে নবাবি গুলি হজম করবার সাহস তাঁর হল না। তারপর বীরবর বোধকরি ‘চাচা আপন বাঁচা’ প্রবাদেরই কথা স্মরণ করে জাহাজ নিয়ে সরে পড়লেন পলতার বন্দরের দিকে।

বেলা চারটের সময়ে নবাবের সৈন্যরা চারিদিক থেকে পাঁচিল টপকে কেল্লার ভিতরে লাফিয়ে পড়ল। যারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা হল কচুকাটা। হলওয়েল তখন আত্মসমর্পণ করলেন সদলবলে। কলকাতার পতন হল।

কলকাতার ও বাংলার অন্যান্য জায়গায় বিলাতি কুঠি সিরাজের হস্তগত হওয়ার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু কম এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। সাধারণ ব্যক্তিদেরও হারাতে হয়েছিল এক কোটি ষাট লক্ষ টাকা। ওলন্দাজ ও ফরাসি বণিকরাও ভয়ে ভয়ে সিরাজের হাত তুলে দিয়েছিলেন যথাক্রমে সাড়ে চার লক্ষ ও সাড়ে তিন লক্ষ টাকা।

তিনদিন পরে কলকাতা জয় ও ফিরিঙ্গি দলন করে সিরাজ মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে বিজয়োৎসবের আয়োজন করলেন মহাসমারোহে। (আমাদের বক্তব্য বিষয় হচ্ছে—সিরাজের বিজয়-অভিযান। সুতরাং অন্ধকূপ-হত্যার প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। এবং ওই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা না করবার আর একটা কারণ হচ্ছে, ও ব্যাপারটা নিয়ে ঐতিহাসিকরা পরস্পরবিরোধী মত পোষণ করেন। অবরুদ্ধ কলকাতার গভর্নর হলওয়েল বলেন, ঘটনাটা ঘটেছিল—১৪৬ জন ইংরেজ কারারুদ্ধ হয়েছিল অন্ধকূপের মধ্যে। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং আরও কেউ কেউ (যেমন মিঃ লিটল) প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন, অন্ধকূপ-হত্যার কাহিনি একেবারেই অমূলক। এই মত অনুসারেই ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট পর্যন্ত অবশেষে কলকাতার লালদিঘি থেকে অন্ধকূপ হত্যার স্মৃতিস্তম্ভ সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকার এবং আরও কারুর কারুর মতানুসারে, অন্ধকূপ, হত্যা-কাহিনি হয়তো একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু হলওয়েল অত্যুক্তি করেছেন, কারণ অন্ধকূপের ২৬৭ বর্গফুট আয়তনের মধ্যে ১৪৬ জন ইংরেজের স্থান সংকুলান হওয়া অসম্ভব। খুব সম্ভব বন্দি ইংরেজদের সংখ্যা ষাটজনের বেশি ছিল না।

এখানে আর একটা কথা উল্লেখযোগ্য। অন্ধকূপ বা ‘ব্ল্যাক হোল’ হচ্ছে ইংরেজদেরই দ্বারা নির্মিত কারাগার। সিরাজ কখনও তো চোখেও দেখেননি, তার আয়তনের কথাও জানতেন না। বন্দি ইংরেজ সৈনিকরা মাতাল হয়ে রক্ষীদের মারধর করতে থাকে। রক্ষীরা সিরাজের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে। সিরাজ জিজ্ঞাসা করেন, ‘এখানে ফিরিঙ্গিদের কোনও কারাগার আছে?’ তারা অন্ধকূপের নাম করে। সিরাজ হুকুম দেন, মাতাল ফিরিঙ্গিগুলোকে যেন তার ভিতরে আটক করে রাখা হয়। যে ডালে বসেছিল মাতলামি করে সেই ডাল কাটতে গিয়ে দুর্বৃত্ত ইংরেজদের ঝাঁপ দিতে হয়েছিল ‘স্বখাত সলিলে’ই! অন্ধকূপ হত্যা আংশিকভাবে সত্য হলেও সিরাজের উপরে কোনওই দোষারোপ করা যায় না।

সাত

পুত্রহীন আলিবর্দির তিন কন্যার সঙ্গে তাঁর তিন ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহ হয়েছিল। মধ্যম ভ্রাতুষ্পুত্র সৈয়দ আহম্মদ পেয়েছিলেন পূর্ণিয়ায় নবাবি করবার ভার। তিনি পরলোক গমন করবার পর তাঁর ছেলে সওকত জং হলেন পূর্ণিয়ার নবাব (১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে)।

সেই সময়েই সিরাজ করেন মাতামহের সিংহাসনে আরোহণ।

ছোট মাসির ছেলে সিরাজ তাঁর চেয়ে বয়োকনিষ্ঠ হয়েও হবেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার সর্বময় কর্তা, এটা সওকতের মোটেই ভালো লাগল না। তাঁর ধারণা হল আলিবর্দির সিংহাসনের উপরে তাঁরই দাবি সর্বাগ্রে। তার উপর বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর তখন থেকেই সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করেছিলেন। তিনি সওকতকে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করবার জন্যে গোপনে প্ররোচনা দিতে লাগলেন।

সওকতও টোপ গিলতে দেরি করলেন না। তিনি দিল্লির বাদশার উজির ইমাদ-উল-মুল্ককে এক কোটি টাকা উৎকোচ দিয়ে নিজের নামে বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব বলে ফরমান আনিয়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলেন এবং সিরাজকে সোজাসুজি জানিয়ে দিতে কসুর করলেন না যে—’ভালোয় ভালোয় সুড়সুড় করে সিংহাসন থেকে নেমে পড়ো। ঢাকায় গিয়ে আমার তাঁবে থেকে চাকরি করো!’

সওকতের দম্ভ চূর্ণ করবার জন্যেই সিরাজ সসৈন্যে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ইংরেজরা নিজমূর্তি ধারণ করে বলে পিছনে শত্রু রেখে তিনি পূর্ণিয়ায় যেতে পারেননি। জুন মাসে কলকাতার পতন ও ইংরেজ বিতাড়িত হল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল বাদলের ঘনঘটা। তারপর বর্ষাকাল কাটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে সিরাজ আবার বেরিয়ে পড়লেন সদলবলে।

সওকত ছিলেন একেবারেই অপদার্থ জীব। তাঁর হামবড়া ভাবের জন্যে কেউই তাঁকে পছন্দ করত না। সর্বদাই তিনি নেশায় চুর হয়ে ইয়ারদের সঙ্গে নর্তকীদের নাচগান নিয়ে মেতে থাকতেন।

সিরাজের সেনাপতি রাজা মোহনলাল সর্বাগ্রে নিজের ফৌজ নিয়ে পূর্ণিয়ায় প্রবেশ করলেন। মনিহারি নামক স্থানের কাছে সওকতও সসৈন্যে এগিয়ে এলেন সিরাজকে বাধা দেওয়ার জন্যে।

সৈন্যবলে সিরাজ ছিলেন সওকতের চেয়ে অধিকতর বলীয়ান। কিন্তু পূর্ণিয়ার ফৌজের সামনে ছিল এক বিস্তীর্ণ জলাভূমি, যা উত্তীর্ণ হওয়া সহজসাধ্য নয়। কাজেই সিরাজের গোলন্দাজরা জলাভূমির এপারে দাঁড়িয়েই কামান দাগতে লাগল। সওকতের গোলন্দাজদের সেনাপতির নাম শ্যামসুন্দর, জাতে বাঙালি কায়স্থ। তিনিও দাগতে লাগলেন নিজেদের কামান।

দুই পক্ষে কামানযুদ্ধ চলছে, এমন সময়ে সওকত নিজের অশ্বারোহী সেনাদলকে অগ্রসর হওয়ার জন্যে হুকুম দিলেন।

প্রবীণ সেনাপতিরা নারাজ। বললেন, ‘ওই অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে দুর্গম জলাভূমির জল-কাদা পার হওয়ার চেষ্টা করলে আমাদের সকলকেই মারা পড়তে হবে।’

কিন্তু সওকত হচ্ছেন মস্তবড় সবজান্তা—যুদ্ধ না করেও সেরা যোদ্ধা। তিনি মহা খাপ্পা হয়ে সেনাপতিদের যা মুখে আসে তাই বলে গালাগালি দিতে লাগলেন।

সে গালাগালি দীর্ঘকাল ধরে সহ্য করতে না পেরে সেনানীরা রাগের মাথায় অশ্বারোহী ফৌজ নিয়ে জলাভূমির ভিতর দিয়েই বাংলার সৈন্যদের আক্রমণ করতে চললেন।

হাবলা সওকত জানতেন না, কত ধানে হয় কত চাল! তিনি ভাবলেন, আমার ঘোড়সওয়াররা যখন হামলা দিতে ছুটেছে, তখন লড়াই তো ফতে হয়ে গিয়েছেই! আমি আর এখানে দাঁড়িয়ে মিছে মাথা ঘামিয়ে মরি কেন?

নিজের তাঁবুর ভিতরে ঢুকে তিনি বললেন, ‘লে আও ভাং। নাচো, গাও, ফুর্তি করো!’

তাঁবুর ভিতরে চলছে যখন নবাব ফুর্তির হুল্লোড়, জলাভূমির উপরে তখন সিরাজের কামানগুলো ঘন ঘন হুমকি দিয়ে হু-হু করে ছুটিয়ে দিয়েছে অগ্নিময় মৃত্যুঝড়! পূর্ণিয়ার অশ্বারোহীরা দলে দলে হতাহত হয়ে জলাভূমিকে করে তুললে রক্তরাঙা। অবশেষে তারা আর অসম্ভবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলে না, ছত্রভঙ্গ হয়ে দিকে দিকে পলায়ন করতে লাগল।

সেনাপতিরা তখন পলায়মান সৈনিকদের আবার উৎসাহিত করবার জন্যে তাঁবুর ভিতর থেকে সওকতকে বাইরে টেনে আনলেন। কিন্তু নবাব বাহাদুরের তখন শোচনীয় অবস্থা—নেশার চোটে আর দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। সকলে মিলে ধরাধরি করে তাঁকে হাতির উপরে তুলে দিলে। কিন্তু কাকে তিনি উৎসাহিত করবেন? রণক্ষেত্রে তখন উপস্থিত আছে মাত্র পনেরো-ষোলোজন পূর্ণিয়ার সৈনিক।

শত্রুপক্ষের এক গুলিতে সওকত ইহলোক ত্যাগ করলেন সেই বেহুঁস অবস্থাতেই। মাটির উপরে পড়ে গেল নবাবের রত্নখচিত উষ্ণীষ।

মনিহারির যুদ্ধে জয়ী হয়ে সিরাজ ব্যর্থ করে দিলেন মিরজাফরের প্রথম ষড়যন্ত্র।

১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ হচ্ছে বিজয়ী সিরাজের জীবনে সবচেয়ে মহিমময়। ফিরিঙ্গিরা পলাতক, প্রতিদ্বন্দ্বী সওকত পরাজিত ও নিহত, বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের থোঁতা মুখ ভোঁতা—সিরাজউদ্দৌলা হচ্ছেন বঙ্গ-বিহার-ওড়িশার একাধিপতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *