তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

সিরাজু

সিরাজু

কলকাতা ক্রমশই ঠেলে ওপর দিকে উঠছে। পেটফাঁপা রুগির পেটের মতো। সাততলার ফ্ল্যাটের এক চিলতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শান্তনু লাহেড়ি দুদিকে দুটো হাত প্রসারিত করে বললেন, আ, দিস ইজ মাই কিংডাম। পদতলে ডার্টি ভালগার শহর, ঊর্ধ্বে ফানির্শড ফ্ল্যাট। হাজারি মনসবদারদের পালিশকরা খোপ। কবুতরি কায়দা। কপোত-কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষচূড়ে। এ জিনিস কেনাও যায়, ভাড়াও পাওয়া যায়। তবে সংগ্রহের জন্যে প্রচুর ডানা ঝাপটাঝাপটির প্রয়োজন হয়।

শহর ধুঁকছে নীচে। ওপরে প্রেশার কুকুারে নরম হচ্ছে পালক ছাড়ানো পোলট্রি। পালিশকরা মেঝের ওপর দিয়ে চিকুম চিকুম করে ছুটছে ছোট্ট লোমওয়ালা কুকুর। যে কুকুরের মুখ নেই, চোখ নেই, পা নেই—বেগবান ছটফটে লোম। যে কুকুর কোলে বসে গাড়ি চেপে, ন্যাপি পরে লিন্ডসের বাদামি সায়েবি সেলুনে ক্ষৌরী হতে যায় কোয়াটারলি ট্যাকসের মতো। দুটি দশ যার দক্ষিণা। এ জিনিস অতি মিহি কিমা খায়, ভিটামিনের ফোঁটা খায়, মেমসায়েবের গালে হাম খায়, সোফার ওপর হিসি করে সায়েবের সাদা পায়ের লাথি খায়। সায়েব-মেমে ঝগড়া হয়। সায়েব কুকুরের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চায়। সায়েব মেমে ভাব হয়। নীচের নোংরা শহর ভেঙে কোনও ভ্যাগাবন্ড আত্মীয় সায়েবের খোপে উঠে এলে কুকুর মেমসায়েবের গলায় মিহিমিহি ধমক ছাড়ে, ভ্যাকভ্যাক।

লাহেড়ি সায়েবের এই খোপে সব আছে। রুমাল মাপের কার্পেট আছে। পারস্যের নয়, দার্জিলিঙের। ওয়েলেসলির কার্পেন্টারের তৈরি ঝাড়া হাত-পা অষ্টাবক্রমুনির মতো দেখতে বসার আসন আছে। শার্টিনের খাপে পোরা লজেন্সের মতো দেখতে পিঠে ঠেকনা দেওয়ার গোল-গোল বালিস আছে। স্টোর টেবিলে দুরকমের অ্যাশট্রে আছে। পোড়ামাটির মালসা। এয়ারলাইন্সের উপঢৌকন চকচকে ধাতুর। টেবিলের দ্বিতীয় তাকে লাথি লাগার জায়গায় ম্যাগাজিন আছে স্পোর্টস, সিনেমা, সাহিত্য, সংবাদ। বাঁদিকের দেয়াল ঘেঁষে লম্বাটে বুককেস, সেখানে রবিন্স আছেন, চেজ আছেন, সরকারি রবীন্দ্রনাথ আছেন, বিবেকানন্দ আছেন, গড ফাদার আছে, একটা এলিয়ট আছে, একসার কমপ্যাকট এনসাইক্লোপিডিয়া, একটি যোগশিক্ষা, একটি হোমিওপ্যাথিক গৃহচিকিৎসা। বুককেসের মাথার ওপর ফুলদানিতে ক্যানিং স্ট্রিটের গন্ধহীন বর্ণময় মোলায়েম ফুল। গর্ভকোষে পরাগের বদলে মিহি ধুলো মাকড়সার লালা। সে ফুলে অক্ষি ভ্রমর বসলেও মক্ষী ভ্রমর বসে না। বড়দিনের কেকের মতো কারুকাজ করা কিংবা পেটিকোটের ফ্রিল বসানো চিত্রাধারে ফিনকি গোঁফ, ঝাঁকড়া চুল স্বাস্থ্যবান যুবকের পাশে কাঁধের সঙ্গে কাঁধ মিশিয়ে স্বল্প রক্ত স্নায়বিক যুবতী। প্রবাসী পুত্র-পুত্রবধূ। পেডিগ্রি মিলিয়ে সংগ্রহ করা। বংশলতিকার শীর্ষ শাখায় ঝুলছেন, রায়বাহাদুর, কোনও জজসাহেব, ম্যাজিস্ট্রেট, এস পি কিম্বা এফ আর সি এস। কোনও ডাল আরও নামি কোনও পূর্বপুরুষের পাঁচিল টপকে গেছে। বিবাহ-সূত্রে জোড়-কলম। ফলে, বীজ হবে কম, স্বাদ হবে ভালো, বর্ণ হবে সুন্দর, গন্ধ হবে কম। মানুষ-মানুষ গন্ধ কমে ফানুসের মতো হবে। সাত তলার খোপ ছেড়ে সিরাজু আরও উঁচুতে উঠে দুনিয়াদারির ওপর লাট খাবে। ব্যোমবাসী বংশদুলাল ছায়ায়, বেড়ে, ওঠা গাছের মতো সূর্যের খোঁজে আরও, আরও ওপরে ঠেলে উঠবে। মিনেকরা মাংস রঙের দেয়ালে লাহেড়ী ঝুলছেন সোনালি প্ল্যাস্টিক ফ্রেমে। পাশে ঝুলছেন স্ত্রী। আর ঝুলছে যামিনী রায়ের প্রিন্ট, নির্বাচিত হয়েছে তুষারমণ্ডিত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর খচমচ রং ও রেখায় কোনও শিল্পীর নিজস্ব চিত্রভাবনা। যিনি সরতে-সরতে লাহেড়ীর চেয়েও উর্ধ্বে উঠে গেছেন রং আর তুলি হাতে। এয়ারলাইন্সের পাঞ্জাবি ঝুলের ক্যালেন্ডারে পাখার বাতাসে কন্টিনেন্ট কাঁপছে।

মিনি শো কেসে অহঙ্কার ভরা আছে। আমি বিশ্ব-ভ্রমণ করেছি। প্রমাণ চাও? এই দ্যাখো জার্মানির ফুলদানি, ইতালির ্যাস্টার অফ প্যারিসের নগ্ন যুবতী, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের বাচ্চা, জাপানের গেইসা। ওই দ্যাখো আমার দেওয়ালে মজাদার ঘড়ি, যার তলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে কাঠবেড়ালির ল্যাজ, পিড়িক পিড়িক করে তালে তালে দুলছে। আমি ফোক আর্টও বুঝি। পোড়ামাটির কাজ, কানউঁচু গোল গলা, গোল ঠ্যাং ঘোড়া, কিড়ি কিচি ঢোকরা। সাতে থাকলেও দূর গ্রামে আমার মন চলে যায় হাইওয়ে ধরে মোটরে। সার্কিট হাউসে মুরগি সাঁটাতে-সাঁটাতে আমি ফিল করি, অহো বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার আমার দ্যাশ। গ্রামীণ শিল্পের আমি পিঠ চাপড়াই। বারে-বারে বলি, টাগোর, বিশ্বভারতী, শ্রীনিকেতন। কলকাতায় আমার মানোয়ারি ভাসছে, নোঙরটি ফেলে রেখেছি গ্রামীণ সংস্কৃতির পলিতে। একটু কেবল তফাতে থাকি একসঙ্গে অনেকটা দেখব বলে। ভিস্টাভিসান প্যানোরামা। গ্রামে অ্যাটাচড বাথ নেই, শাওয়ার নেই, গিজার নেই, কুলার নেই, পাংখা নেই, ভালো রাস্তা নেই, মনোরমা নেই। ব্রাদার, তবে স্টেপ ব্রাদার। তোমাদের গায়ে বড় ঘামের গন্ধ। তোমাদের বসন বড় মলিন। তোমরা বিড়ি খাও, তাড়ি খাও। ইংলিশেতে বড়ই কাঁচা। তাই তো আমি, এখানে, তাই তো তুমি ওখানে।

আমার ছেলে ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ার, তোমার ছেলে ঘরামি। আমার বউ উইকলি পড়ে, পার্টিতে পা মিলিয়ে নাচতে পারে, চাঁপার কলি আঙুলে মানুষখেকো নখে মুক্তোর মতো রং মাখে। লাল ঠোঁটে মালপো কাটে, শূকর ছেঁড়ে। স্ল্যাকস পরে অমরনাথে তুষারলিঙ্গ দেখতে যায়। তোমার বউ গোবর মাখে, চাষ করে, মূর্তি গড়ে। চুলে শ্যাম্পু দেয় না, শিফন পরে না, দাঁতে ঘষে না পেস্ট। সবুজ চোখের পক্ষে ভালো, মাটির স্পর্শে বিদ্যুৎ খেলে যায়, শরীর চাঙ্গা হয়। সবুজ সবজিতে খাদ্যপ্রাণ। তাহলেও এখানটা এখান, ওখানটা ওখান।

আমি রোঁয়াওঠা সবুজ কার্পেটে চটি খুলে আলতো পা রাকি। শিশিরের স্পর্শ পাই না। শব্দ শুনি জীবনানন্দের কবিতায়। সবুজ পর্দায় আমি ধান খেতের ঢেউ দেখি। ফ্রিজের দরজা খুলে গায়ে মাখি কার্তিকের হিম। আইসট্রের হিমেল ধোঁয়ায় খুঁজি ভোরের নদীর ওপর ঝুঁকে-থাকা ঊষার দিগন্ত। আমি টেপরেকর্ডে কোয়েলের ডাক শুনি, দোয়েলের শিস। অ্যাকোয়ারিয়ামে বাহারি মাছের ঘুরপাক দেখে অনুমান করে নি, জাল আছে, জল আছে, জেলে আছে, শীতের ভোরের উষ্ণ জলে রুপালি মাছ আছে। তোমরা নীচে থেকে নিতেই থাকো, আমি ওপর থেকে নিতেই থাকি। আমার দেওয়ার মধ্যে আছে ইনকাম ট্যাকস, ফ্যান, ফোন, ফ্রিজের বিল, ইনসিওরেনসের প্রিমিয়াম আর ধারের কিস্তি। সময়টা দিয়েছি আমার অফিসকে, প্রেম দিয়েছি কেরিয়ারকে, দেশকে দেওয়ার মতো আমার সঞ্চয়ে আর কি আছে!

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শান্তনু শহর দেখছেন। পেছনে বর্গ সেন্টিমিটারে মাপা তাঁর সুখের সাম্রাজ্য। সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্তই তো তিনি বাইরে। স্ত্রীরও তো খোঁপা দেখা যায় না। তবে কি ছিয়ানব্বুই হাজার টাকা খরচ করলেন পাচক, গৃহভৃত্য আর একটা কুকুরের জন্যে! মানুষ যত ওপরে ওঠে, ততই কি সে নি:সঙ্গ হয়ে যায়! ফ্রিজের দিকে তাকালে তাঁর মর্গের কথা মনে পড়ে যায়। সিটিয়ে থাকা মুরগির, ছিন্ন পেশির মতো হিম-শক্ত মাংস, স্ত্রীর হলুদ ত্বকের মতো সবুজ সবজি, ব্লাডব্যাংকে রাখা রক্তের বোতলের মতো লাল পানীয়। ভীষণ হাই অলটিচ্যুড সিকনেসে ভুগছেন শান্তনু। ওপর থেকে সমস্ত মানুষকে বড় ছোট মনে হয়। জনপদ যেন সাজানো, ছড়ানো দেশলাই আর সিগারেটের বাক্স। সমতলে নেমে এলে ওই বোধটাই থেকে যায়। অচল খুপরি থেকে নেমে এসেই দরজা খুলে সচল খুপরিতে ঢুকে পড়েন। পেছনের আসনে বসে থাকেন উদাস। মাছের মতো জল কেটে-কেটে, পিছলে পিছলে এগিয়ে চলেন। সামনে লোক পড়লে গাড়ি যখন হর্ন দেয়, তাঁর মনও যেন হর্ন দিয়ে ওঠে—তফাত যাও, তফাত যাও!

কে বলেছে শান্তনুর হৃদয় নেই। সে হৃদয় আকৃতিতে কিঞ্চিৎ বড়ই, তলার দিকে লোব দুটি শিথিল হয়ে ঝুলে পড়েছে। হলই বা রোগ, তবু সে বৃহৎ হৃদয়ের মালিক। তার রক্তে উচ্চচাপ। এও তো এক ধরনের আবেগ। শরীরে শর্করা! সে তো মিষ্টিতারই লক্ষণ। দৃষ্টি রক্তাভ। ক্রোধ নয়, ভালোবাসা। নিজের স্বার্থকে ভালোবাসা। বৃহৎ দর্শনে আমি আর তুমিতে তো কোনও পার্থক্য নেই। সো হম বেদান্তের শেষ কথা।

ইদানিং শান্তনুর বড় ভাবনা : মৃত্যুর পর তার মৃতদেহটা কি লিফটে করে নীচে নামবে? চার কোণায় চারটে কাঁধ কে দেবে। সে তো কোনও ব্যাপারে কখনও কাঁধ ঠেকায়নি। এই সপ্তম তলের খুপরিতে কার্পেটের ওপর দিয়ে চিকুম চিকুম করে মৃত্যু যখন এগিয়ে আসবে, তখন কী হবে? ডেকরেটার যেমন ম্যারাপের বাঁশ নামায় সেইভাবেই কি তার দেহটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে দূরে ফিতের মতো ওই রাস্তায়, খাটালের পাশের নরম মখমলের মতো জায়গাটায়। শান্তনু তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। কলকাতা এদিকে ক্রমশই ঠেলে উঠছে ওপরের দিকে বিষাক্ত পুঁজে-ভরা ফোঁড়ার মতো। নীচে তবু সংঘ আছে, সংগঠন আছে। ওপর দিকটা সাবানের ফেনার মতো, ফ্যাঁসা তুলোর মতো। ধরতে গেলে শুধুই বায়ু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *