সিমেন্টে গাঁথা মমি

সিমেন্টে গাঁথা মমি

সাকেতনগরের দোতলা বাড়িটার সামনে সকাল থেকেই গিজগিজ করছে কালো মাথা। আশপাশের ছাদগুলোও বাদ নেই। দোতলা বাড়িটার নাম ‘ইন্দ্রাণী’। বাড়ির পাঁচিল বরাবর ছয়লাপ পুলিশে পুলিশে। ও ভাবে কি কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যায় নাকি?

“আরে ইধার কেয়া হ্যায় ভাই। হটো, হটো,’ বলে ছেলে—ছোকরার দলকে ভাগানোর চেষ্টা করছে বারবার ছত্তিশগড় পুলিশের টিম। পুলিশের ‘ডু নট ক্রস’ ব্যারিকেড করা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু হুমড়ি খেয়ে পড়া ভিড় কি তাতে বাধ মানে? অগত্যা কয়েকজনকে ধাক্কাধাক্কি করেই সরিয়ে দিতে হল। উন্মুখ জনতার কৌতুহলী চোখগুলো বলে দেয়, যেন কোনও টানটান নাটকের যবনিকা পতন হতে চলেছে বাড়িটায়। চারদিকের ফিসফিসানির মধ্যেই পরপর এসে দাঁড়াল পুলিশের তিনটে গাড়ি। ছত্তিশগড় পুলিশের অফিসারদের পাশাপাশি সে দলে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশেরও জনা কয়েক অফিসার রয়েছেন। দু’জন কনস্টেবল গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলেন এক যুবককে। বছর তিরিশেকের মাঝারি উচ্চতা, রোগাটে চেহারার সমীরণ দাসকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না পড়শিদের। জনতার ভিড়ে কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, এ ছেলে তো বরাবর চুপচাপই থাকত। আমরা ওকে কোনওদিন জোর গলায় কথা বলতে শুনিনি। এ ছেলে কি না এমন কাণ্ড করে বসল।’

ছেলেটার মাথার চুল উসকোখুসকো। স্নান হয়নি কয়েকদিন, দেখলেই বোঝা যায়। পরনের জামা—প্যান্টেও মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। চোখমুখে ক্লান্তি। চারদিকে একঝলক দেখে পুলিশের সঙ্গে সটান বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল সমীরণ। পিছু পিছু আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার। সঙ্গে হাতে শাবল গাঁইতি—বেলচা হাতে জনা কয়েক লোক।

বাড়িটার ভিতরের চেহারাও সমীরণের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। ঘরের মেঝেতে ধুলোর পুরু আস্তরন। অসংখ্য আধপোড়া সিগারেটের ফিল্টারের টুকরো ছড়িয়ে ইতিউতি। ঘরের এ কোনও কোনে পড়ে মদের বোতল। সমীরণের দেখিয়ে দেওয়া বাড়ির নীচতলার একটা বেদির মতো জায়গা কর্ডন করে ফেললেন কয়েকজন কনস্টেবল। ছত্তিশগড় পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার শাবল—গাঁইতি হাতে ছেলেগুলোকে বললেন, এই জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করুন। কতক্ষণ লাগবে?’ মাঝবয়সি চটপটে একটা ছেলে জবাব দেয়, ‘স্যর, বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না, কতটা খুঁড়তে হবে। ঘণ্টা কয়েক তো লাগবেই।

খোঁড়ার কাজ শুরু হল। আশপাশের পুলিশকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কথা বললেও সমীরণ একেবারে চুপ। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে বেদিটার দিকে। এক অফিসার জিজ্ঞেস করলেন তাকে, ‘চা খাবেন?’ হাতের ইশারায় সমীরণ বুঝিয়ে দেয়, এই মুহূর্তে চা তার লাগবে না। একজন চেয়ার এগিয়ে দিলেন। তবু সমীরণ ঠায় দাঁড়িয়ে। বেদির উপরের টাইলস তুলে ফেলতে বেশি সময় লাগল না। প্রায় ছ’—সাড়ে ছ’ফুট খুঁড়ে মাটি সরাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা ট্রাঙ্ক। জনা ছয়েক শ্রমিক আর পুলিশের কনস্টেবল হাত লাগিয়ে বের করে আনলেন সেটা। প্রকাণ্ড ট্রাঙ্কটার ওজন তার আয়তন অনুপাতেই। ঢাকনা খুলতে ভিতর থেকে বেরল আরও একটা ছোট ট্রাঙ্ক। মুখ চাওয়াচায়ি করছেন সিনিয়র অফিসাররা। ব্যাপার কী? তখনও সমীরণ নির্বিকার এবং একইরকম নিশ্চুপ। যেন কিছুই হয়নি।

সিনিয়র অফিসাররা নির্দেশ দিলেন ট্রাঙ্ক খুলে ফেলার। ট্রাঙ্কটা সিমেন্ট ঢেলে নিপুণ হাতে সিল করে দেওয়া। সিমেন্টের খোলস ছাড়িয়ে সেটা খুলতে বেশ কসরত করতে হল পুলিশকর্মীদের। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা কঙ্কাল। তার পোশাক, অন্তত তখনও পোশাকের যতটুকু লেগে রয়েছে শরীরে, গলার হার আর হাতের একজোড়া চুড়ি দেখে বোঝা যায় সেটা একটা মহিলার। ছোটবেলায় ইতিহাসের বইয়ের পাতায় মিশরের রাজা রানিদের মমির ছবি দেখেছেন অনেকেই। ট্রাঙ্কের সিমেন্টের মধ্যে গাঁথা এই কঙ্কালটাও প্রায় মমির চেহারা নিয়েছে। চামড়ার কিছু অংশ শুকিয়ে আটকে রয়েছে হাড়ের গায়ে। কঙ্কাল দেখে বোঝা যায়, অন্তত কয়েক মাস আগে মৃত্যু হয়েছে মহিলার। তারপর দু’টো ট্রাঙ্কে ভরে দেহ পুঁতে ফেলা হয়েছে এই বাড়ির পুজোর বেদির নীচে।

‘স্যর, আমার মেয়েকে চোখের দেখাটুকুও দেখিনি ছ’মাস। কিছু একটা করুন স্যর। মেয়েটার নিশ্চয়ই কোনও বিপদ হয়েছে, বাঁকুড়া সদর থানার ডিউটি অফিসারের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না বিজেন্দ্রকুমার শর্মা। আদতে পাটনার বাসিন্দা। একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হিসাবে বাঁকুড়া সদরে পোস্টিং। বিজেন্দ্র—ননীবালার এক ছেলে প্রত্যুষ, এক মেয়ে সুচেতা, পরিবারের সবার আদরের সোনি। রাজস্থানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করে বিদেশে চাকরির স্বপ্ন দেখতেন সুচেতা৷ সেই স্বপ্নই হঠাৎ হাতের মুঠোয় চলে এল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাজের অফারটা এসে যাওয়ায়। ইউনিসেফের চাকরি। ওয়াশিংটনে পোস্টিং। অনলাইনেই পুরো যোগাযোগটা হয়েছিল। যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল সমীরণ দাস ওরফে সমীরণ ফন রিখটহোফেন। ভোপালের বাসিন্দা প্রবাসী বাঙালি পরিবারের ছেলে, কর্মসূত্রে সেও এখন ওয়াশিংটনেই। অনলাইনে আলাপ জমে ওঠে সুচেতার সঙ্গে সমীরণের। ওয়াশিংটন পাড়ি দেবেন বলে বাড়ি ছাড়েন সুচেতা, ২০১৬—এর ২৩ জুন। বাড়িতে বলে যান, ‘আমি এখান থেকে দিল্লি যাচ্ছি। ওখান থেকেই সমীরণের সঙ্গে দু’দিন বাদে চলে যাব আমেরিকা। চিন্তা করো না।’

চোখের জলে বছর আঠাশের মেয়েকে বিদায় দেন বিজেন্দ্র—ননীবালা।

সেটাই যে মেয়েকে শেষ দেখা, ভাবেনি শর্মা পরিবার। ট্রেনে দিল্লি রওনা হয়ে যান সুচেতা। দুশ্চিন্তা ছিল। একা অতদূর মেয়েকে পাঠাবেন বাবা—মা ! ভরসা দিয়েছিলেন সুচেতাই। মেয়ের কাছ থেকে সমীরণের নাম শুনেছিলেন বিজেন্দ্ররা। বাড়িতেও এসেছে তাঁদের ছেলেটিকে দেখে ভালোই লেগেছিল। কদিন বাদে বাড়িতে একবার মেসেজ এসেছিল সুচেতার মোবাইল থেকে, বাবা, আমি আমেরিকা পৌঁছে গিয়েছি। এখানে কাজের খুব চাপ। তাই ফোন করতে পারব না। একটা নতুন নম্বর নেব এখানে তখন তোমরা ফোন করো।’ বিজেন্দ্র জিজ্ঞেস — করেন, তাহলে তোর সঙ্গে যোগাযোগ হবে কীভাবে?’ সুচেতা বলেন, ‘রোজ হোয়াটস অ্যাপ করব বাবা। তোমাকে বা প্রত্যুষকে। ক’দিন তো! নতুন একটা নম্বর নিয়েই জানাব।’

কোথায় পোঁতা রয়েছে বাবা-মার দেহ দেখিয়ে দিচ্ছে অভিযুক্ত
কোথায় পোঁতা রয়েছে বাবা-মার দেহ দেখিয়ে দিচ্ছে অভিযুক্ত

তবু বাবা—মার মন তো? মাঝেমধ্যে মেয়ের খোঁজ নিতে ফোন করতেন পুরোনো নম্বরে। কেটে দেওয়া হতো ফোন, শুধু একটা আধটা ছোট্ট হোয়াটস অ্যাপ মেসেজেই বার্তা আসত, ‘আমি ঠিক আছি। চিন্তার কিছু নেই। মেয়েকে দেখার জন্য মাঝেমধ্যে সেলফি তুলে পাঠাতে বলতেন বিজেন্দ্র—ননীবালা। তাও আসেনি। মেয়ে কাজে ব্যস্ত আছে ধরে নিয়ে মনকে সান্ত্বনা দিতেন প্রৌঢ় দম্পতি। মাঝেমধ্যে হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ আসছিল অবশ্য সমীরণের মোবাইল থেকেও। কখনও ‘আপনার মেয়ে আমার সঙ্গে আছে। কাজকর্ম ভালোই চলছে, কখনও বা আমরা শিগগিরই দেশে ফিরব। তখন একসঙ্গেই আসব বাঁকুড়ায়,’—এই রকম কথা লেখা তাতে। সমীরণের নম্বর থেকে কখনও হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ করেছেন সুচেতাও। মেয়ের দেখা বা তাঁর গলা শুনতে না—পেলেও বাবা—মা ধরে নিয়েছিলেন, মেয়ে সুখেই আছে। ভালো আছে। এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে বিজেন্দ্রর কথা শুনছিলেন বাঁকুড়া থানার অফিসারটি।

রুমালে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করেন বিজেন্দ্র, ‘স্যর, ৫ অক্টোবর হঠাৎ আমাদের বাড়িতে হাজির হয় সমীরণ।’

‘মানে? আমেরিকা থেকে? আর সুচেতা?’ প্রশ্ন করেন পুলিশ অফিসার। ‘না। সমীরণ বলেছিল, ও ক’দিনের জন্য দেশে এসেছে। এখান থেকে আবার দিল্লি ফিরে যাবে। আমার মেয়ে আমেরিকায় আছে। আমরা দিল্লি গেলে ওই আমাদের আমেরিকা যাওয়ার ভিসার ব্যবস্থা করে দেবে বলেছিল,’ জবাব দেন বিজেন্দ্র।

সমীরণের কথামতো কিছুদিন বাদে দিল্লি গেলেন বিজেন্দ্র—ননীবালা—প্রত্যুষ। নয়াদিল্লি স্টেশনে নেমে বারবার ফোনও করলেন সমীরণের নম্বরে। ফোন তুলল না কেউ। শর্মা পরিবারের মনে কু ডাকছিল তখন থেকেই। সত্যিই সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? পরদিনই দিল্লি থেকে বাঁকুড়া ফিরে এলেন বিজেন্দ্ররা। সুচেতা আমেরিকায়। সমীরণকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ের হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে মেসেজ করে পুরো বিষয়টা জানান বিজেন্দ্ররা। ও—প্রান্ত থেকে হোয়াটস অ্যাপেই জবাব আসে ক’দিন বাদে, ‘সমীরণ খুন হয়েছে। আমেরিকায়। আমি ভোপালে ওর মার কাছে যাচ্ছি। সমীরণের ফোন আমার কাছেই আছে।’

এসব শুনে তো আকাশ থেকে পড়লেন বিজেন্দ্ররা। সমীরণের উপর এত ভরসা করে বিলেতে পাঠালেন মেয়েকে, আর সমীরণ খুন হয়ে গেল! কীভাবে? তাঁদের মেয়ে ঠিক আছেন তো? কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না সুচেতার বাবা—মা। মেয়ের কাছ থেকে আর কোনও জবাবও আসে না। আমেরিকা, দিল্লি, বাঁকুড়া, ভোপাল—সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল শর্মা পরিবারের। এরপরও সমীরণের নম্বর থেকে কয়েকটা মেসেজ পেয়েছেন তাঁরা। সুচেতার নাম করেই এসেছিল সেইসব মেসেজ, চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে’ গোছের। নিশ্চয়ই সুচেতাসমীরণ ভয়ঙ্কর কোনও বিপদে পড়েছেন, আঁচ করছিলেন বিজেন্দ্র—ননীবালারা।

এত কাণ্ডের পরও মেয়ে কেন কিছুতেই পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলছে না? এটাই বুঝতে পারছিলেন না বিজেন্দ্ররা। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সুচেতার মোবাইলে মেসেজ করলেন প্রত্যুষ, ‘দিদি, বাবার শরীর খুব খারাপ। তুই কিছু টাকা পাঠাস। ভাবলেন, বাবার অসুস্থতার কথা শুনে নিশ্চয়ই আসবেন সুচেতা, অন্তত একবার ফোনও করবেন। ফোন আসে না। মেসেজও আসে না সঙ্গে সঙ্গে। সুচেতার উত্তর আসে কিছুদিন বাদে, হোয়াটস অ্যাপেই, আমি দিল্লি থেকে কলকাতার ফ্লাইট ধরব। কয়েক ঘণ্টা বাদে আবার একটা ছোট্ট মেসেজ, ‘সরি, দুর্গাপুর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু জরুরি কাজে আজই আবার ফেরত যেতে হচ্ছে। আমেরিকা ফিরছি। বাড়ি যেতে পারছি না।’

এতদিন ধরে মেয়েটার দেখা নেই। গলাও শুনতে পায়নি কেউ। বাবার অসুস্থতার কথা শুনেও শুধু এইটুকু মেসেজ! নাহ, কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। শেষমেশ মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে বিজেন্দ্র বাঁকুড়া সদর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করলেন। সেটা ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬।

তদন্ত চলতে থাকল সুচেতা, সমীরণের মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে। থানায় ডায়েরি করার পর অনেকদিন দু’জনের মোবাইল বন্ধ ছিল। মাস খানেক বাদে মোবাইল কিছুক্ষণের জন্য চালু হলে বাঁকুড়া পুলিশ টাওয়ার লোকেশন থেকে জানতে পারল, সুচেতার মোবাইলের অবস্থান ছত্তিশগড়ের সাকেতনগরে। একরাশ দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা আর শঙ্কা সঙ্গী করে ছত্তিশগড় পাড়ি দিলেন সুচেতার বাবা—ভাই। কিন্তু সাকেতনগরে সমীরণের বাড়ি তো তালাবন্ধ! সেখানে খোঁজখবর নিয়ে বিজেন্দ্ররা জানতে পারলেন, সমীরণ মারা যাননি। তিনি বেঁচেই আছেন। মাঝে এসেওছিলেন বাড়িতে। শুধু সুচেতাকেই অনেকদিন দেখেননি পড়শিরা।

তাহলে তো সবটাই নাটক? কোথায় সমীরণ? তাঁদের মেয়েই বা কোথায়?

তড়িঘড়ি স্থানীয় গোবিন্দপুরা থানায় গেলেন বিজেন্দ্ররা। বললেন আগাগোড়া সবকিছু। কিন্তু সেখানকার পুলিশ গা লাগাল না তেমন।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখব। আপনি লিখে যান গোটা ব্যাপারটা।

—আপনারা একটিবার চলুন। আমার মন বলছে, আমার মেয়ে ওই বাড়িতেই আছে।

—আরে আপনার মেয়ে তো মেসেজ করছে বললেন। তাহলে শুধু শুধু এত উতলা হচ্ছেন কেন? আর বাড়ি তো তালাবন্ধ। আমরা যার তার বাড়িতে তালা ভেঙে ঢুকে পড়তে পারি নাকি? কোর্টের অর্ডার লাগে।

—না, সব ঠিক নেই। আপনাকে বললাম তো মেয়ে ঠিক থাকলে ও একবার হলেও আমাদের সঙ্গে কথা বলত? আর সমীরণ বেঁচে আছে কি নেই, তাও বুঝতে পারছি না। কেন ও আমাদের মিথ্যা কথা বললো?

—ঠিক আছে, ঠিক আছে। লিখে দিয়ে যান সবটা। আমরা দেখছি। বিজেন্দ্ররা বুঝতে পারলেন, পুলিশ গা লাগাতে রাজি নয়। গোবিন্দপুরা থানার অফিসারটি বুঝিয়ে দিলেন, সুচেতা—সমীরণ উভয়ে প্রাপ্তবয়স্ক, দু’জনেই শর্মা পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন—অসুবিধা কোথায়? দু’টো প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সম্পর্কে পুলিশ কী করে বাধা দেবে? বাধ্য হয়ে বাঁকুড়ায় ফিরে আসে শর্মা পরিবার।

ইতিমধ্যে সমীরণ—সুচেতা, দু’জনেরই মোবাইলের কল ডিটেলস হাতে এলো বাঁকুড়া পুলিশের, যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, দুজনের কেউ আমেরিকা যাননি গত ক’মাসে। তাহলে এত নাটক কেন? বাঁকুড়ার পুলিশ সুপারকে সবটা ‘ব্রিফ করলেন বাঁকুড়া সদর থানার ইন্সপেক্টর—ইন—চার্জ, ‘স্যর, একটা কিছু তো নিশ্চয়ই হয়েছে। তা না—হলে এতদিন ধরে দু’জন কেন পরিবারের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন? কেন একবারও ফোনে কথা বলছেন না সুচেতা?’ পুলিশ সুপার নির্দেশ দিলেন, ‘তোমার অফিসারদের নিয়ে একটা টিম ফর্ম করো। সাকেতনগরেই লাস্ট টাওয়ার লোকেশন তো সমীরণের? তোমার টিম নিয়ে ওখানে পৌঁছে যাও। আর হ্যাঁ, যা করার খুব সাবধানে করবে। ডিজি সাহেব নিজে কেসটা নিয়ে খুব উওরিড।’

২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। গোবিন্দপুরা থানার অফিসারদের নিয়ে বাঁকুড়া পুলিশের টিম হানা দিল সাকেতনগরের দোতলা বাড়িতে। দরজা খুলে দিল সমীরণ। চেহারা, জামাকাপড় ময়লা। দরজা খুলতেই তাকে হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে আনল পুলিশ। ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালালো পুলিশের আর একটা দল। ঘরের জানলা—দরজা সব টাইট করে বন্ধ। ঘরের ভিতরে দুর্গন্ধে তো পুলিশেরই মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা! এ বাড়িতে একটা সুস্থ মানুষ থাকতে পারে? কয়েকটা ঘরে তো সামান্য যেটুক ফাঁকফোঁকর, তাও মোটা সেলোটেপ দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও গোটা বাড়িটায় আর কারও টিকিটি পর্যন্ত পাওয়া গেল না।

—সুচেতা কোথায়? ভালো চাস তো বল, নাহলে উত্তর বের করার আরও রাস্তা আছে আমাদের।

—স্যর, আপনি এভাবে একজন রেসপেক্টেড সিটিজেনের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন না। আই উইল ডেফিনিটলি স্যু ইউ ইন কোর্ট, ইফ ইউ ডােন্ট লিভ দিস প্লেস ইমিডিয়েটলি। আপনাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে?

—সুচেতাকে কিডন্যাপিংয়ের অভিযোগে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হতে পারে, জানেন?

—সুচেতা আমেরিকায়। আমি এর বেশি কিছু জানি না। সমীরণকে নিয়ে আবার প্রতি ঘরের প্রতি ইঞ্চি তল্লাশি চালাল পুলিশ। তন্নতন্ন করে যখন সুচেতার খোঁজ চলছে, হঠাই নীচতলায় একটা বেদি দেখে চোখ আটকে গেল এক অফিসারের। ঠাকুরের বেদি, যেমনটা আছে এ বাড়ির অনেক ঘরেই। কিন্তু এটার রং একটু অন্যরকম লাগছে না? সন্দেহ হল ওই অফিসারের, এই গাঁথনির সঙ্গে তো ঘরের বাকি অংশের চেহারার মিল নেই।

‘কী আছে ওখানে,’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বাঁকুড়া থানার অফিসারটি। স্যর, ওটা পুজোর জায়গা। দেখছেন তো ঠাকুরের ছবি, মূর্তি রয়েছে ওখানে। দয়া করে ওই জায়গাটা নষ্ট করবেন না, ঝাঁঝিয়ে উঠে জবাব দেয় সমীরণ। তবে পুলিশ এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। রাতভর একই কথা বলতে বলতে একটা সময় ভেঙে পড়ে সে।

—রাগের মাথায় করে ফেলেছি স্যর। মেরে দিয়েছি ওকে। মাথার ঠিক ছিল না।

—এরকম কথা সবাই বলে।

—না, স্যর। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন।

—বিশ্বাস—অবিশ্বাস পরে। আগে বল, কোথায় রয়েছে বডি?

—পুঁতে দিয়েছি।

—কোথায়?

 —বাড়িতে।

মানে? বলে কি ছেলেটা? বাড়িতে? এই বাড়িতেই?

—ইয়েস, আই হ্যাভ কিলড হার। অ্যান্ড হার বডি ইজ কেপ্ট দেয়ার। আঙুল দিয়ে ওই বেদিটার দিকে দেখিয়ে দেয় সমীরণ। গোবিন্দপুরা থানার সিনিয়র ইন্সপেক্টরটিকে ডেকে বাঁকুড়ার পুলিশ অফিসার বললেন, ‘কাল সকালেই ওই জায়গাটা খুঁড়তে হবে। দেখা যাক, সমীরণ ঠিক বলছে কি না।’

সাকেতনগরের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কঙ্কালের পরনের পোশাক, গলার হার আর চুড়ি দেখে সেটা তাঁর দিদি সুচেতার বলে শনাক্ত করলেন প্রত্যুষ। তবু পুলিশকে তো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। তাই মৃতের পরিচয় জানতে ডিএনএ পরীক্ষার রিকুইজিশন দিল পুলিশ। ময়না তদন্তে পাঠানো হল মৃতদেহ। প্রাথমিক রিপোর্ট পরদিনই পৌঁছাল তদন্তকারীদের হাতে, খুনটা হয়েছে দেহ উদ্ধার হওয়ার অন্তত ছ’ সাতমাস আগে। শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে সুচেতাকে। ভেঙেছে ঘাড়ের হাড়ও। তাছাড়া শরীরে আরও কয়েকটা আঘাতের চিহ্ন, যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে, খুনের আগে রীতিমতো ধস্তাধস্তি হয়েছে আততায়ীর সঙ্গে। প্রতিরোধের শেষ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন প্রাণপণে, বাঁচার আকাঙ্খায়। কিন্তু কেন খুন? কেন তারপরও এত নাটক?

—ভালোবাসতাম স্যর সুচেতাকে।

—তাহলে খুন করলি কেন?

—একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম বলেই দিল্লিতে নিয়ে এলাম ওকে। আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল আমাদের একসঙ্গে। এখানে এসে জানতে পারলাম, ওর সঙ্গে অন্য একজনের সম্পর্ক আছে।

—কে? কার সঙ্গে সম্পর্ক?

মাথা নিচু করে থাকে সমীরণ। জবাব আসে না। আবার প্রশ্ন করলেন বাঁকুড়া থানার অফিসারটি।

—কার সঙ্গে সম্পর্ক?

—জানি না।

—কবে খুন করলি সুচেতাকে? —২০১৬—এর ১৫ জুলাই।

—তোর বাড়িতে আর কে থাকে? তোর বাবা—মা, আত্মীয়স্বজন সবাই কোথায়? ওঁরা জানেন সব? কেউ কিছু বলল না? বল, কোথায় বাড়ির সবাই?

বাড়িতে কে কে আছে, তারও পরিষ্কার জবাব গোড়ায় দিচ্ছিল না সমীরণ। কখনও বাংলায়, কখনও হিন্দি, ইংরেজিতে জানায়, তার বাবা—মা দুজনেই আমেরিকায় থাকেন।

কিন্তু আমেরিকার কোথায়?

তারও জবাব আসে না।

সাকেতনগরে সমীরণের ঘরে খুঁজতে খুঁজতেই আলমারি থেকে বেরোল অমরেন্দ্র দাস—চন্দ্রাণী দাসের পাসপোর্ট—সমীরণের বাবা—মা। এ বার তো তদন্তকারী অফিসারদেরই আকাশ থেকে পড়ার জোগাড়। দু’জনের পাসপোর্ট এখানে। তাহলে তাঁরা কোথায়? লাগাতার জেরার মুখে একটা সময় ভেঙে পড়ল সমীরণ। কাটা কাটা ইংরেজিতেই জবাব দেয়, ‘আই হ্যাভ কিলড বোথ অব দেম। কবে? ‘ইন দ্য ইয়ার, ২০১০।’

জবাব শুনে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকেন তদন্তকারী অফিসার। ইন্টারোগেশন রুমে তখন পিন পড়লেও শোনা যাবে। ঠিক বলছে তো ছেলেটা? নাকি মাথার ঠিক নেই? ততক্ষণে সমীরণ বলতে শুরু করেছে, ‘হ্যাঁ, দু’জনকেই আমি খুন করেছি। ছত্তিশগড়ের রায়পুরে আমাদের পুরোনো বাড়ির বাগানে পোঁতা আছে দু’জনের বডি।’

তদন্তের প্রতিদিনের আপডেট নিচ্ছিলেন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার। সমীরণ তার বাবা—মাকেও খুন করেছে, এটা জেনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেন পুলিশ সুপার, ‘স্যর, উই মাস্ট ইনফর্ম দ্য এপিসোড টু রায়পুর পুলিশ। ওদের নিয়েই রায়পুরের বাড়িতে এ বার সার্চ অপারেশন চালাতে হবে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি আসে দ্রুত। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। এ বার অপারেশন রায়পুর। ততক্ষণে সমীরণ দাসের খবর ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সব খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলে। রায়পুরের বাড়ির সামনেও জনতার ভিড় সামাল দিতে মোতায়েন করা হল বিশাল পুলিশবাহিনী। নীল ব্লেজার, জিনস, স্যু পরা সমীরণের মুখ কাপড়ে ঢেকে কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় আনা হল রায়পুরে। মুখ ঢাকা কাপড়ের ফাঁকে শুধু চোখ—নাকের জায়গাটুকুই দেখা যায়। রায়পুরের সুন্দরনগরের বাগানে সমীরণের দেখিয়ে দেওয়া জায়গাটা প্রথমে আর্থমুভার এনে কিছুটা খোঁড়া হল। তারপর লোক লাগিয়ে বেলচা, কোদাল নিয়ে গর্ত করা শুরু হতেই মিলল দু’টো খুলি, কিছু হাড়গোড়। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হল সেই কঙ্কালগুলিও। সুচেতাকে খুনের অভিযোগে আগে থেকেই মামলা রুজু করেছিল বাঁকুড়া পুলিশ। এ বার নতুন করে মামলা রুজু হল সমীরণের নামে। ছত্তিশগড়ের রায়পুরে। দু’টো তদন্তই চলছিল পাশাপাশি। কারণ দু’টো মামলা আলাদা রাজ্যের হলে কী হবে? দু’টোই যে পরতে পরতে জড়িয়ে।

‘তিন—তিনটে খুন করেও কী করে এতটা নির্বিকার থাকে একটা মানুষ? বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার প্রশ্ন করছিলেন তদন্তকারী অফিসারকে। স্যর, এই কেসটা যে কোনও সাসপেন্স থ্রিলারকে হার মানাবে, জবাব দেন তদন্তকারী অফিসারটি। ২০১০—এ বাবা—মা দু’জনকে, তারপর ২০১৬—তে সুচেতাকে খুন করেছিল সমীরণ। দ্রুত ডিএনএ, ফরেন্সিক, ময়না তদন্তের রিপোর্টের পাশাপাশি সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা করছিল দুই রাজ্যের পুলিশ। পাশাপাশি জেরা চলছিল সমীরণেরও। কোন জটিল অপরাধ—মনস্তত্ত্ব থেকে। এভাবে তিন—তিনজনকে খুন করে, গোটা দুনিয়ার সামনে নির্বিকার হয়ে নাটক করে যেতে পারে একজন, বুঝতে রীতিমতো হিমসিম খেতে হচ্ছিল পুলিশকে। জেরার সময় সাহায্য নেওয়া হল ফরেন্সিক সাইকিয়াট্রিস্টেরও।

সমীরণের বয়ানের পাশাপাশি রায়পুরে তাদের প্রতিবেশী, কয়েকজন আত্মীয়, স্কুল—কলেজের পরিচিত—বন্ধুদের কাছ থেকে পুলিশ যা জানতে পারল, তার সারাংশ অনেকটা এইরকম: সমীরণের বাবা অমরেন্দ্র কুমার দাস ছিলেন ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালসের কর্মী, মা চন্দ্রাণী দাস ছত্তিশগড় সরকারের সংখ্যাতত্ব বিভাগের আধিকারিক রায়পুরের সুন্দরনগরে দাস। পরিবার আসে ২০০১—এ। সমীরণ তখন ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। ছোট থেকে হিন্দি, ইংরেজি, বাংলাতিন ভাষাতেই সড়গড় ছিল সে। কিন্তু রায়পুরে আসার পর থেকে তার পড়াশোনার গ্রাফটানামতে থাকে। রায়পুরের নামী স্কুল থেকে। বোর্ডের পরীক্ষায় সে পাশ করতে পারেনি। পরে ওপেন স্কুল থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় বসার ব্যবস্থা হয় তার। স্কুলের গণ্ডি কোনওক্রমে টপকালে বাবা—মা তাকে ভর্তি করে দিলেন ভিলাইয়ের একটি কলেজে, ইচ্ছে ছিল, ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু সেখানেও সে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেনি। বছর কয়েকের মধ্যেই সমীরণ ফিরে আসে রায়পুরের বাড়িতে। বাড়ির লোকজন সম্ভবত সেটা জানতেন না। বাবা—মা সমীরণকে বারবার চাকরির খোঁজ করতে বলছিলেন। ছেলেকে বাড়িতে বেকার বসে থাকতে দেখে বকাবকিও করেছিলেন অমরেন্দ্র—চন্দ্রাণী, আর পাঁচজন বাবা—মার মতো। বাবা—মায়ের মুখ ঝামটা পছন্দ হচ্ছিল না সমীরণের। তখনই দু’জনকে চিরতরে সরিয়ে ফেলার ছক কষে সে।

মৃতদেহের খোঁজে তোলপাড় করে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি
মৃতদেহের খোঁজে তোলপাড় করে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি

একদিন বাজারে বেরিয়েছিলেন বাবা, বাড়িতে মায়ের সঙ্গে ছিল সমীরণ। ঘরের মধ্যেই সে তার মাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে খুন করে। ঘণ্টা কয়েক বাদে বাবা বাড়ি ফিরে মায়ের খোঁজ করতে এলে সমীরণ বলে, ‘মা মন্দিরে যাবে বলে তৈরি হচ্ছে। আমি তোমার জন্য চা এনে দিচ্ছি। চায়ে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল আগে থেকে। অমরেন্দ্রবাবু এতকিছু জানতেন না। চা খেয়ে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়লে তাঁকেও একইভাবে খুন করে সে। দু’জনের দেহ বস্তায় ভরে লোকচক্ষুর আড়ালে পুঁতে ফেলে বাড়ির বাগানে। তারপর উঠে আসে সাকেতনগরের বাড়িতে। কিন্তু সে তো কোনও চাকরিবাকরি করে না। বাড়ি থাকলেও রোজকার খরচ আসবে কোথা থেকে? তাই মায়ের সই জাল করে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে বেশ কয়েক মাস পেনশনের টাকাও তুলছিল সমীরণ। ব্যাঙ্কে জানিয়েছিল, বাবা—মা দুজনেই বিদেশে। তাই ব্যাঙ্কে এসে ভেরিফিকেশন করানোটা একটু মুশকিল। ব্যাঙ্কের আধিকারিক প্রথমে বিশ্বাস করেও নিয়েছিলেন। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার না—হলেও কম্পিউটার, বিশেষ করে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ছিল সমীরণের অনন্ত আগ্রহ। বিভিন্ন নামে সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল সে, এমনকি তার মৃত বাবা—মার নামেও। আর নিজের বিভিন্ন প্রোফাইলে দিয়ে রেখেছিল তার বিভিন্ন ভুয়ো ডিগ্রির ফিরিস্তি, দামি গাড়ি—বাড়ির ছবি। এমনকী বিভিন্ন দেশের দ্রষ্টব্য স্থানের ছবি, যাতে মনে হয় সে বিদেশেই থাকে। সে সব সত্যি না মিথ্যে, বাইরের লোকজন তা জানবে কী করে?

সোশ্যাল সাইটের মাধ্যমেই সমীরণের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বাঁকুড়ার সুচেতার। সমীরণের প্রোফাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চপদে কাজ করার অভিজ্ঞতা নজরে পড়েছিল তাঁর। সেই সুবাদে আলাপ। সুচেতাও তো আমেরিকায় পাড়ি দিতে চাইতেন। সমীরণ বলেছিলেন, তাঁকে আমেরিকায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। ইউনিসেফে চাকরির ভুয়ো নিয়োগপত্রও তৈরি করে দিয়েছিলেন। সুচেতা এতসব বোঝেননি। সম্ভবত বিদেশে চাকরি আর সমীরণের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। আমেরিকায় যাচ্ছেন বলে সুচেতা পরিবারকে ছেড়ে দিল্লি চলে যান। সেখান থেকেই আমেরিকা উড়ে যাওয়ার কথা ছিল দু’জনের। তার আগে সমীরণ তাঁকে বলেন, আমেরিকায় যাবেন দিন কয়েক বাদে। আগে ক’দিন সাকেতনগরের বাড়িতে একসঙ্গে কাটাতে চান তাঁরা। সরল বিশ্বাসে সমীরণের সঙ্গে ছত্তিশগড় পাড়ি দেন সুচেতা। দিন গড়িয়ে যেতে থাকে। ভাঙতে থাকে সুচেতার ধৈর্য্যের বাঁধ। আমেরিকায় যাওয়া হবে কবে, তার উত্তর স্পষ্ট করছিল না সমীরণ। মনোমালিন্য বাড়ছিল দু’জনের মধ্যে। এরমধ্যেই ঘরের আলমারি থেকে সমীরণের বাবা—মার পাসপোর্ট দেখে সন্দেহ হয় সুচেতার। তিনি বুঝতে পারেন, বিপদে পড়েছেন। সমীরণকে লুকিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য টিকিট কাটেন। তবে সেটা সমীরণ কোনওভাবে জানতে পেরে যায়। বুঝতে পারে, সুচেতা সম্ভবত সব জেনে ফেলেছেন। তাঁকে বেঁচে থাকতে দিলে তো এত বছরের পরিশ্রম সব জলে যাবে। তাই তাঁকেও সরিয়ে ফেলার ছক কষে ঠান্ডা মাথায়। গলা টিপে খুন করে সুচেতার দেহ বস্তায় ভরে পুরে ফেলে ছোট ট্রাঙ্কে। দু’দিন যেতে না যেতেই দেহে পচন ধরে দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। বিস্তর সুগন্ধী, রুম—ফ্রেশনার ব্যবহার করেও পচা লাশের গন্ধ কি আর চাপা দেওয়া যায়? সমীরণ বুঝতে পারে, খুনের কথা জানাজানি হয়ে যাবে। তাই মোটা টাকা দিয়ে বাড়িতে মিস্ত্রি ডেকে আনে। ১৪ বস্তা সিমেন্ট গোলানো হয় মিস্ত্রিকে দিয়ে। ছোট ট্রাঙ্কের ভিতর ঢোকানো সুচেতার দেহের উপর ঢালা হয় কিছুটা সিমেন্ট। সেটা একটা বড় ট্রাঙ্কে ভরে বাকি সিমেন্ট ঢেলে দেয় সেখানে। তারপর রাতের অন্ধকারে সমীরণ ঘরের নীচতলায় বেদি তৈরির জন্য খুঁড়ে রাখা গর্তে ভরে দেয় ট্রাঙ্কটা। সুচেতার বিদেশ যাত্রার জন্য যে টাকা দিয়েছিল শর্মা পরিবার, সেটাও এটিএম থেকে তুলে নেয়। সবটাই চলছিল পরিকল্পনামাফিক। সাকেতনগরে তার প্রতিবেশীদেরও ধারণা ছিল না সমীরণ আসলে কী করে। কেউ ভাবত, সে বোধহয় সেনাবাহিনীর অফিসার, কারও কাছে সে ছিল বড় ব্যবসায়ী। সে বাড়িতেই যে লুকিয়ে রয়েছে সুচেতার কঙ্কাল, কে জানত?

সমীরণকে জেরায় পুলিশ জানতে পারল, বাবা—মা—বান্ধবীকে খুনের প্ল্যান গোটাটাই সে করেছিল মার্কিন টেলিভিশন সিরিজ ‘ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেশন’ আর ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’থেকে। কিন্তু বাস্তবটা যে টেলিভিশন সিরিজের থেকেও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।

ঠিকই। বেশিরভাগ খুনের নেপথ্যে থাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকটা কারণ। প্রেম, যৌন ঈষা, অর্থ বা সম্পত্তির লোভ আর প্রবল রাগ—ঘৃণা—প্রতিশোধ প্রতিহিংসা। সমীরণের জটিল মনস্তত্ত্বে হয়তো সবকটাই মিলেমিশে গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *