সিমলার রামদুলাল দে-র পরিবারবর্গ
বাবু রামদুলাল দে, দুলল সরকার নামেই অধিক পরিচিত। তিনি সেই সব দুর্লভ মানুষদের একজন যাঁরা দরিদ্রতম অবস্থা থেকে ঐশ্বর্য ও খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছেন। জাতিতে এঁরা কায়স্থ। তাঁর বাবা বলরাম সরকার বাস করতেন দমদমের নিকটবর্তী রেকজানি গ্রামে। সেখানে গ্রামের গরীব চাষী বাড়ির ছেলেদের বাংলা লিখতে শিখিয়ে যে সামান্য পারিশ্রমিক পেতেন তাতেই নিজের ও স্ত্রীর দিন গুজরান হত। বর্গীর হাঙ্গামার সময় (১৭৫১–৫২ খ্রী.) তিনি স্ত্রীকে নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেন; এই সময় তাঁর স্ত্রী অন্তঃস্বত্ত্বা ছিলেন; এক নির্জন স্থানে তিনি একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন এই সন্তানই ভবিষ্যতের কোটিপতি রামদুলাল। অতি শৈশবেই রামদুলাল মাতৃপিতৃহীন হন। তাঁকে লালন পালনের ভার নেন তাঁর মাতামহ ও মাতামহী। মাতামহ ছিলেন ভিক্ষাজীবী। বেশ কয়েক বছর তাঁর মাতামহী দুঃখ দারিদ্র্যের ও কায়িক শ্রমের জীবন যাপনের পর, বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী বাবু মদনমোহন দত্তের বাড়িতে রাঁধুনীর কাজ পান; রামদুলালকেও সেখানে থাকতে দেওয়া হয়। মনিব বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে লেখাপড়া করে রামদুলাল কিছু বাংলা আর জাহাজের সাহেব ক্যাপটেন, মেট প্রভৃতির সঙ্গে কথা বলবার মতো মোটামুটি ইংরেজি ভাষা শেখেন। মদনবাবু তাঁকে প্রথমে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে বিল-সরকার হিসাবে নিয়োগ করেন। এই চাকুরিতে তাঁর দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে মদনবাবু তাঁর পদোন্নতি করে মাসিক দশ টাকা বেতনে জাহাজ-সরকারের পদ দেন। এই সময় তিনি মনিবের পক্ষ থেকে মেসার্স টুলোহ্ অ্যান্ড কোম্পানির নিলামে উপস্থিত থাকতেন; কী খেয়ালে ডুবে যাওয়া একটা জাহাজ ১৪,০০০ টাকায় তিনি কিনে ফেললেন। নিলামের আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম সেরে, টাকা দিয়ে তিনি বেরিয়ে আসছেন, এমন সময় একজন ইংরেজ এসে জাহাজটি তাঁর কাছে বিক্রি করবার জন্য রামদুলালের সঙ্গে দর কষাকষি করতে থাকেন; একমাত্র এই ইংরেজ ভদ্রলোকই জাহাজটি ও তার অভ্যন্তরস্থ মালের মূল্য জানতেন; শেষ পর্যন্ত এক লক্ষের সামান্য কিছু কমে জাহাজটি তিনি কিনে নেন। রামদুলাল ভাবেন তাঁর মনিবই পুরো এই অর্থ পাবার অধিকারী, সেই বিবেচনা অনুযায়ী তিনি মনিবকে মবলগ টাকা দিয়ে দেন। রামদুলালের সততা ও বিবেকবুদ্ধি দেখে মদনবাবু এত খুশি হলেন যে, তিনি পুরো টাকা নেবার জন্য রামদুলালকে হুকুম করলেন। এই টাকাই রামদুলালের ভবিষ্যৎ উন্নতির ভিত্তি।
অল্পকালের মধ্যেই রামদুলাল কয়েকটি মার্কিন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে এজেন্ট হিসাবে কাজ শুরু করলেন এবং মেসার্স আশুতোষ দে অ্যান্ড নেফিউ নামে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেন; এটি এখন কলকাতার দয়ালচাঁদ মিত্রের ভাই-রা পরিচালনা করেন।
রামদুলাল মেসার্স ফেয়ারলি ফার্গুসন অ্যান্ড কোম্পানিরও বেনিয়ান হন। এই সময় তিনি উন্নতির চরম শিখরে ওঠেন। তখন বাজারে তাঁর অসীম ইজ্জৎ। শুধু তাঁর নাম করলেই লোকে শ্রদ্ধার সঙ্গে আস্থা স্থাপন করে। তাঁর দান এবং উদারতাও ছিল অতুলনীয়। প্রবাদের মতো হয়ে ওঠে তাঁর দয়া, ধর্ম-প্রাণতা এবং নম্রতা ৷ মাদ্রাজে দুর্ভিক্ষগ্রস্তদের ত্রাণের জন্য কলকাতা টাউন হলে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়; সেখানে, সভাস্থলেই রামদুলাল কাঁচা টাকায় (মুদ্রায়) এক লক্ষ টাকা দান করেন। হিন্দু কলেজ স্থাপনের জন্য তিনি দান করেন ৩০,০০০ টাকা। যে-সব দুঃস্থ ব্যক্তি তাঁর অফিসে এসে সাহায্যপ্রার্থী হত, তাদের দান করবার জন্য তিনি দৈনিক ৭০ টাকা সরিয়ে রাখতেন। মাইনে দিয়ে তিনি তিনজন কবিরাজ রেখেছিলেন, তাঁদের প্রতি নির্দেশ ছিল আতরুণ দরিদ্র মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরা চিকিৎসা করবেন এবং তাঁরই ব্যয়ে ঔষধপত্র দেবেন। বেলগাছিয়ায় তিনি একটি অতিথিশালা স্থাপন করেছিলেন; সেখানে অভাবী ব্যক্তিদের উদারভাবে খাদ্য দেওয়া হত। এই প্রতিষ্ঠানটি এখনও চালু আছে। বারাণসীতে তিনি ১৩টি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাঁর ব্যয় হয় ২,২২,০০০ টাকা। ৬৯ বছর বয়সে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন; (চিকিৎসায়) এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করলেও, তখন থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল ৭৩ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। খুব ধুমধামের সঙ্গে তাঁর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়, এতে ব্যয় হয় প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। তাঁর দুই স্ত্রী– একজন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান, অপর জনের ছিল পাঁচ কন্যা ও দুই পুত্র আশুতোষ ও প্রমথনাথ; এঁরা সাতু (ছাতু) বাবু ও লাটু বাবু নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। এঁরা বাপের সুনাম অনেকাংশেই রক্ষা করেছিলেন। আশুতোষ বাবু (ওরফে সাতু বাবু) পুরী বা জগন্নাথধামে এবং উত্তর পশ্চিম ও পশ্চিম প্রদেশের বহুস্থানে ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন বিশেষ সঙ্গীতপ্রিয়; তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ সেতারীদের তিনি অন্যতম ছিলেন। সারা দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে গুণী সঙ্গীতজ্ঞগণ তাঁর চারদিকে ভিড় লাগিয়েই থাকতেন– তিনিও উদার ভাবে তাঁদের উৎসাহিত করতেন। প্রমথনাথ বা লাটুবাবু তাঁর শারীরিক শক্তি ও পুরোপুরি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। এই দুই ভাই যেমন ছিলেন দানশীল, তেমন, বিলাসী: তাঁদের এই দানশীলতা ও বিলাসিতার জন্য তাঁরা সর্বত্র বাংলার ‘বাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। সেকালে ‘বাবু’ বলতে অত্যন্ত ধনী ও খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝাত। আশুতোষের একমাত্র পুত্র গিরিশচন্দ্র দুটি কন্যাসন্তান রেখে পিতার জীবিতকালেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। আশুতোষও দুই কন্যা রেখে যান : তাঁদের একজন চারুচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের মাতা এবং অপরজন রামবাগানে শ্রদ্ধেয় ও সি দত্তের স্ত্রী। প্রমথনাথের দুই বিধবা : তাঁরা দুজনেই একটি করে দত্তকপুত্র গ্রহণ করেন : মন্মথনাথ ও অন্যধনাথ।
রামদুলাল বিপুল বিত্ত (শোনা যায়, এক কোটি তেইশ লক্ষ টাকা) রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর পুত্রদ্বয় এই সম্পদ আশ মিটিয়ে ভোগ করেন।
পরবর্তী বংশধরগণ ছিলেন অমিতব্যয়ী। তাছাড়া ছিল ব্যবসায়িক ক্ষতি। এই সকল কারণে এই পরিবারের সম্পদ ক্ষীণ হয়ে আসে। তাঁর (রামদুলালের) ভেঙে পড়া বিপুল বিস্তৃত সম্পত্তি থেকে কলকাতার বহু ধনী পরিবার গড়ে উঠেছে।