সিমলার বসু পরিবার
বনেদী এই বসু পরিবারের আদি বাস ছিল হুগলী জেলার পানসিয়ালাতে। এই বংশের রামচন্দ্র বসু পানসিয়ালা ছেড়ে হরিপালে বাস করতে চলে যান। তাঁর ছয় ছেলের মধ্যে সীতারাম ও চুনীলাল ভাগ্যান্বেষণে কলকাতা চলে আসেন, আর বেণীমাধব যান বালেশ্বরে। ভাইদের মধ্যে চুণীরামই ছিলেন বিশিষ্টতম। উন্নত চরিত্র, সততা ও শ্রমশীলতার জন্য তিনি সহজেই যোগ্য স্থান লাভ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া বৈষ্ণব। বৃন্দাবন থেকে এলে নিজের ঠাকুরবাড়িতে বিষ্ণুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন; জাতিগত দিক থেকে অধিকার না থাকলেও, তিনি নিজে ঠাকুরের ভোগ রান্না করতেন। অবৈষ্ণব ব্রাহ্মণকে তিনি প্রণাম পর্যন্ত করতেন না। তিনি চাকরি করতেন প্রখ্যাত রামদুলাল দে’র অধীনে; এই চাকুরি ছিল বিশেষ লাভদায়ক; রামদুলাল একদিন বিনীতভাবে আহারের জন্য অনুরোধ করায়, তিনি চাকরি ছাড়তে উদ্যত হয়েছিলেন; তাঁর আয়ের তুলনায় দান খয়রাত ছিল প্রচুর। প্রতিদিন তাঁর ঠাকুরবাড়িতে কয়েকজন বৈষ্ণবকে খাওয়ান হত। দুটি মহোৎসবে হাজার হাজার বৈষ্ণবকে ভোজন করান হত। এছাড়া প্রতিটি বৈষ্ণব উৎসব তাঁর ঠাকুরবাড়িতে বিশেষ সমারোহের সঙ্গে পালিত হত। ৬০ বছরের ‘পরিণত বয়সেই’ তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র গঙ্গাগোবিন্দ বাণিজ্য করে প্রভূত ধনসম্পদ অর্জন করেন। কিন্তু অসৎ লোকের ওপর ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা ভার দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান; শেষ জীবন তাঁর কাটে দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্যে। ব্যবসায় বাণিজ্যে তাঁর দক্ষিণ হস্ত মেজ ভাই রাধাগোবিন্দ এই অবস্থায় একটি ভাল চাকরি জোগাড় করেন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করে তিনিও ধনী হয়ে ওঠেন; সমৃদ্ধির দিনে তিনি বহু দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের ভরণ-পোষণ করতেন। তিনিও ব্যবসায় পরিচালনার দায়িত্ব দেন এক ভ্রাতুষ্পুত্রের ওপর; এই ভাইপোটি ছিলেন অপদার্থ; ফলে রাধাগোবিন্দের ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়; ভগ্ন-হৃদয়ে চল্লিশ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর দুই পুত্র; পিতার মৃত্যুকালে নবীনকৃষ্ণের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। নবীনের জন্ম হয় ১৮২৮-এর ১৩ জানুয়ারি; জ্যোতিষে পারদর্শী পিতা রাধাগোবিন্দ ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এই শিশুর ভবিষ্যৎ উজ্জল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি তখন ইহলোকে থাকবেন না। অতি শৈশব থেকেই এই শিশুর মধ্যে শিক্ষার প্রতি তীব্র আগ্রহ দেখা যায়; শৈশবে তিনি যা শুনতেন বা দেখতেন, তা কখনও ভুলতেন না। কুড়ি বছর বয়স হবার আগেই তিনি ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শনে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। যত দিন যায়, তাঁর জ্ঞান ও জ্ঞান তৃষ্ণাও তেমনি বেড়ে চলে; কিন্তু বিরাট সংসারের বোঝা কাঁধে থাকায় সেই তরুণ বয়সেই তাঁর অসুবিধারও অন্ত ছিল না। তিনি ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক; তাই তাঁর ধারণা হয়েছিল চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা করলে এবং চিকিৎসা ব্যবসায়ে ব্রতী হতে পারলে, জীবনে স্বাধীনভাবে চলতে পারবেন আর প্রকৃতির পৃষ্ঠাগুলিও তাঁর সামনে খুলে যাবে। কলেজ জীবনে তিনি বই পড়তেন না, গ্রন্থাগার হজম করতেন। দুঃখের বিষয়, তাঁর উজ্জল কলেজ জীবনের পূর্ণ বিবরণ দেবার মতো স্থান আমাদের নেই। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, শেষ পরীক্ষায় তিনি সবকটি পদক লাভ করায়, গভর্নর জেনারেল নিজের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি পদক উপহার দেন। শীঘ্রই তিনি চিকিৎসা ব্যবসায় শুরু করলেন; কিন্তু কতকগুলি গভীর প্রশ্নে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে লাগল; বিভ্রান্ত বোধ করতে লাগলেন– একই ওষুধের ক্ষেত্রে একই প্রকার প্রতিক্রিয়া কেন হয় না; কিছুটা নিশ্চয়তার সঙ্গে কেন কিছুই বলা যায় না– চিকিৎসাশাস্ত্রের এই যখন অবস্থা, তখন তিনি চিকিৎসা করবেন কি ভাবে! সংশয় আর মানসিক দ্বন্দ্ব! চিকিৎসা ব্যবসা তিনি একেবারে বর্জন করলেন।
সংবাদপত্রের সঙ্গে তাঁর সংস্রব অনেক আগে থেকেই ছিল। প্রায় এই সময় হিন্দু পেট্রিয়টের মহান সম্পাদকের মৃত্যু হওয়ায়, পত্রিকাটিরও অপমৃত্যু হবার উপক্রম হল। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সি আই ই এবং রাজা দিগম্বর মিত্র সি এস আই, নবীনকৃষ্ণের উপর পত্রিকাটি সম্পাদনার ভার অর্পণ করেন। তাঁর দক্ষ ও প্রশংসনীয় পরিচালনায় পত্রিকাখানি পুনরায় স্বপ্রতিষ্ঠ হয় এবং তাঁর অধীনে যাঁরা শিক্ষানবীশী শুরু করেন, তাঁরাও প্রভূত উন্নতি করে কালে নিজেরা সম্পাদক হয়ে ওঠেন। এই সময় ডাঃ ডাফের অনুরোধে তিনি মধ্যপ্রদেশের কমিশনারের অধীনে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদ গ্রহণ করেন। ‘প্রজাপতির ঐক্য’ শীর্ষক একটি সুযোগ্য প্রবন্ধে নবীনকৃষ্ণ ডাঃ ডাফকে আক্রমণ করেন; ডাঃ ডাফ লেখককে খুঁজে বের করেন; দুজনের পরিচয় হয়; পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। অল্পদিনের মধ্যে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করে, আর্থিক লোকসান স্বীকার করে বিচার বিভাগে একটি পদ গ্রহণ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে জ্ঞান ও স্বাভাবিক প্রতিভা তাঁকে বিশিষ্টতা দান করে। পনের বছর ব্যাপী তিনি এক্ট্রা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের পদে চাকরি করেন। চাকরি করার তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, পরিণত বয়সে পেনসন পেয়ে নিশ্চিত্ততার সঙ্গে গ্রন্থাগারে বসে অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতে পারবেন। দূর্ভাগ্যবশত তাঁর এ উদ্দেশ্য সফল হয় নি; অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে ব্রেন ফিভারে তাঁর জীবনাবসান হয় মাত্র ৫১ বছর বয়সে ১৮৭৯-র ২০ জানুয়ারি। অনেক কিছু করবার মতো দীর্ঘ আয়ু তিনি লাভ করেন নি; কিন্তু বেথুন সোসাইটির সদস্য হিসাবে উক্ত সমিতির বিভিন্ন সভায় তিনি যে সকল বক্তৃতা করেন সেগুলি পড়লে যে-কোন চিন্তাশীল পাঠক বুঝতে পারবেন কত গভীর জ্ঞানের তিনি অধিকারী ছিলেন। এমন কোন বিষয় ছিল না যা তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট করেনি; তাঁর বক্তৃতা ও প্রবন্ধাবলীতে এ কথায় সুস্পষ্ট ছাপ আছে। তাঁর মৃত্যুতে গুণমুগ্ধ বন্ধু ও উদীয়মান লেখকগণ গভীর শোকে নিমগ্ন হন। উদীয়মান লেখকদের তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক, বন্ধু। তাঁর দুই পুত্র : অমৃতকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রকৃষ্ণ।
বেণীমাধবের একমাত্র পুত্র হরমোহনের দুই পুত্র গিরীশচন্দ্র ও শিবচন্দ্রের মধ্যে দ্বিতীয় জন এখন বাঁকীপুরে টেম্পল মেডিক্যাল স্কুলের ধাত্রীবিদ্যার শিক্ষক ও সফল চিকিৎসক।
গঙ্গাগোবিন্দ ও রাধাগোবিন্দের জ্ঞাতি ভ্রাতা মদনমোহন থেকে এই বংশের অপর শাখার উদ্ভব হয়; তাঁর চার পুত্র : শিবচন্দ্র, হরিশচন্দ্র, দূর্গাচরণ এবং তারিণীচরণ। এঁরা সকলেই বেনিয়ান এবং বেনিয়ানদের পেশায় সাফল্যও লাভ করেছেন। লক্ষপতি তারিণীচরণ এখন এই বংশের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি; তিনি কলকাতার প্রথম শ্রেণির ধনী বেনিয়ান।