সিন্ধু সভ্যতা বনাম বহিরাগত আর্য

সিন্ধু সভ্যতা বনাম বহিরাগত আর্য

রামায়ণ ও মহাভারত ইত্যাদিতে বানর, অসুর, দৈত্য, রাক্ষস, নাগ, যক্ষ, পক্ষী ও দাস ইত্যাদি হিসেবে বর্ণিত এক শ্রেণির লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্ণনানুযায়ী এরা আর্যদের প্রতিপক্ষ ও তাদের ঘৃণার পাত্র। অপরদিকে প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক আলোচনাতেও ‘আর্য ও অনার্য’ এ দুটো পরিচিতির মাধ্যমে জনগোষ্ঠীকে ভাগ করার একটি রীতি পরিলক্ষিত হয়। ‘আর্য-অনার্য’ এই ছকে ভারতের আদি বাসিন্দারা ‘অনার্য’, আর বহিরাগত আক্রমণকারীরা ‘আর্য’ বলে বর্ণিত। পরিষ্কার বোঝা যায় এই ‘অনার্য’ শব্দটি ‘অসভ্য’ অর্থেই ব্যবহার করা হয়। তা নাহলে ব্যবহৃত শব্দটি ‘অনার্য’ না হয়ে ‘অন-আর্য’ হতে পারত। কিন্তু তা নয়। বরং ‘অনার্য’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, ‘আর্যরা’ সভ্য ও ‘অনার্যরা’ অসভ্য। স্থানীয়দের এ পরিচিতিতে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। দেখা যায় যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের (ভূমিপুত্র) উল্লেখ পরে এবং বহিরাগত সংখ্যালঘুর (আর্য) পরিচয় আগে। অর্থাৎ সংখ্যালঘুর নিরিখে আলোচিত হয় সংখ্যাগুরু। এটি নিশ্চিতভাবে একটি উল্টো পদ্ধতি। এই উল্টো পদ্ধতি অনুসরণের কারণ কী? এটি কি লেখকদের একটি মনোজাগতিক রোগ?

উত্থাপিত প্রশ্নের একটা উত্তর পাওয়া যায় সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যে (বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে : জিজ্ঞাসা এজেন্সীজ : কলকাতা, ১৯৮৯)। তাঁর মতে এটি ‘আর্যামি’র ফল। ‘আর্য’ শব্দটি বিলেত থেকে আমদানি। নব্য হিন্দুরা বদহজমের ফলে একে একটি গোঁড়ামিতে পরিণত করেছে। এটি স্বাধীন চিন্তার শত্রু। এটি দূর না করলে ইতিহাস চর্চা, ভাষাতত্ত্ব চর্চা সম্ভব নয়। ‘আর্যামি’ যতদিন বাধা দেবে ততদিন বাঙালির সঠিক স্বরূপ বের করা কঠিন। তাঁর মতে non-Aryan এর বাংলা ‘অনার্য’ করাতেই যত বিপত্তি ঘটেছে। অপরদিকে আজকের দিনে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, আর্য জাতি বলে কোনো জাতি ছিল না। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘আপেল বনাম আপেল শকট’ প্রবন্ধে (সংহতির সংকট : বাণী শিল্প : কলকাতা, ১৯৯৯) বলেছেন : ইদানীং ইউরোপীয় পণ্ডিতরা আর্যজাতির অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন। তাঁর মতে ভাষা আর রক্ত এক জিনিস নয়। ভাষা থেকে জাতি বিচার হয় না। এতদসত্ত্বেও দেখা যায় আজও এক শ্রেণির বৈষম্যকামী লেখক এই ‘আর্য-অনার্য’ ছকেই সকল আলোচনা করার পক্ষপাতী। একেই বলে কু-অভ্যাস!

এ কথা আজ সুবিদিত যে, রামায়ণ-মহাভারতে উল্লেখিত বানর, অসুর, পক্ষী ও দাস অথবা তথাকথিত অনার্যরাই এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী অথবা ভূমিপুত্র। এরাই সিন্ধু ও দ্রাবিড় সভ্যতার লোক। এই ‘অনার্য’ শব্দের অর্থ অসভ্য হলে বিষয়টি দাঁড়ায় এই রকম: সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা ছিল অনুন্নত ও অসভ্য, আর আর্যরা ছিল উন্নত ও সভ্য। কিন্তু বাস্তবে কি অবস্থাটা তাই, না ‘অনার্যরা’ ‘আর্যামির’ শিকার? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সিন্ধু সভ্যতার আলোচনায়।

আমরা জানি বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে মাত্র দুটো সভ্যতা এখনও টিকে আছে। এই দুটো সভ্যতার মধ্যে একটি হচ্ছে ভারতীয় সভ্যতা ও অন্যটি চিনা সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতারই অপর নাম হচ্ছে ভারতীয় সভ্যতা। ‘ভারতীয় সভ্যতা’ এই নামকরণেও একটি বিষয় লক্ষণীয়। সিন্ধু সভ্যতার সিন্ধু নামটি একটি নদের। আর ভারতীয় সভ্যতার ‘ভারত’ নামটি এক রাজার নামানুসারে। তার নাম ভরত। পৌরাণিক কাহিনী মতে রাজা ভরতের জন্ম বৃত্তান্ত মোটেই গৌরবজনক নয়। নদের নাম সিন্ধুর বদলে ‘ভারত’ নামকরণও ‘আর্যামির’ আর একটি উদাহরণ। এই নামকরণে হিন্দুদেরকে সিন্ধু সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি প্রয়াস আছে বলে প্রতীয়মান হয়।

ভারত তথা সিন্ধু সভ্যতার আরও একটি দিক লক্ষণীয়। দেখা যায় ঘটনাক্রমে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নগরীর ধ্বংসাবশেষ পড়েছে বর্তমান পাকিস্তানে। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের এই হচ্ছে পরিণতি। পরিণতিটি হচ্ছে : যে ‘সিন্ধু’ থেকে ‘হিন্দু’ তা পড়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে। অর্থাৎ হিন্দুর দেশ বর্তমান ভারতের ভূগোল থেকে সিন্ধু নির্বাসিত। এটা কি ইতিহাসের শাস্তি, না নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা? মাঝে মাঝে মনে হয় ভরত রাজার নামে রাষ্ট্রের নাম ভারত হওয়ার প্রতিবাদেই সিন্ধু স্বেচ্ছায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়।

মজার বিষয় হচ্ছে, সিন্ধু সভ্যতা যে একটি প্রাচীনতম সভ্যতা এই তথ্যটি পৃথিবীর লোক জানতে পারে বিগত শতাব্দীর বিশের দশকে (১৯২১) যখন হরপ্পা নগরীর ধ্বংসাবশেষ প্রথম আবিষ্কৃত হয়। এত বড় একটি সভ্যতা মাটির নিচে লুক্কায়িত থাকা অবস্থায় পৌরাণিক আমল থেকে ইংরেজ-পূর্ব-কাল পর্যন্ত সময়ে ভারতের তথাকথিত ধর্মবেত্তা, পণ্ডিত ব্যক্তি ও আর্যবাদীরা শুধু যাগযজ্ঞীয় এক অসাম্যের ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা করেছে। ভারত ইতিহাসের এই অধ্যায়টি তাই অত্যন্ত পীড়াদায়ক বলে মনে হয়।

আমরা জানি নদীভিত্তিক সিন্ধু সভ্যতার বড় নিদর্শন হচ্ছে ‘মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা’ নগরী। মহেঞ্জোদারোর অবস্থান বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায়। আর হরপ্পা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সাহিওয়াল জেলায়। এই সিন্ধু সভ্যতা ব্যাপক অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। সিন্ধু, গুজরাট, রাজস্থান, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত। নীলনদ, তাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে যেমন যথাক্রমে মিশরীয়, ব্যাবিলনীয় ও আসিরিয় সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল, তেমনি সমসাময়িককালে সিন্ধুনদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিল সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা। কেউ কেউ মনে করেন এই সভ্যতার নিদর্শন মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা দুটো স্বাধীন রাজ্যের দুটো নগরী ছিল। আবার কেউ কেউ মনে করেন এই দুটো নগরী ছিল একটি বড় রাজ্যের দুটো পৃথক নগরী।

কত পুরোনো ও সমৃদ্ধ সিন্ধু সভ্যতা? সিন্ধু সভ্যতা ব্রোঞ্জ যুগের। এ সভ্যতা কমপক্ষে ৩,৭০০ থেকে ৪,০০০ বছরের পুরোনো। আর্যদের সভ্যতা থেকে এটি যে অনেক সমৃদ্ধ ও উন্নত ছিল এই সম্বন্ধে আজ আর কোনো বিতর্ক নেই। উন্নত সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে ‘মহেঞ্জোদারো’ ও ‘হরপ্পা’ এই দুই নগরীর উদাহরণই যথেষ্ট। অনিল চন্দ্র ব্যানার্জি তাঁর গ্রন্থে (হিস্টরি অব ইণ্ডিয়া : এ্যা মুখার্জি এ্যাণ্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড : ১৯৯৫) এ সভ্যতা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় দেখা যায় মহেঞ্জোদারো নগরীটি গড়ে তুলেছিল দক্ষ প্রকৌশলীরা। সকল নাগরিকের আরাম ও সুবিধার দিক লক্ষ রেখেই এই নগরী গড়ে ওঠে। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম পরিকল্পিত নগরী। এ নগরীতে ছিল প্রশস্ত রাস্তাঘাট ও বাতির ব্যবস্থা। ছিল পোতাশ্রয়, নলকূপ, জলাধার, স্নানাগার, বাড়ী-ঘরে আলোর ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন পদ্ধতি ও নর্দমার ব্যবস্থা। দালান নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ইট। ছোট মাঝারি ও বড় এই তিন ধরনের দালান ছিল এ নগরীতে। নগরীটি ছিল দেয়াল বেষ্টিত। অপরদিকে হরপ্পা ছিল মহেঞ্জোদারো নগরী থেকে বড়। অবশ্য এর বৈশিষ্ট্যগুলোও ছিল মোটামুটি মহেঞ্জোদারো নগরীর বৈশিষ্ট্যের মতই। এ নগরীতে একটি বড় শস্যাগার বা শস্যভাণ্ডার ছিল। শ্রমিকদের বসতবাড়ির ব্যবস্থাও ছিল এ নগরীতে।

ব্যানার্জি বলেছেন: মহেঞ্জোদারো নগরীর সাথে বিশ্বের যোগাযোগ ছিল। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের মিলনভূমি ছিল মহেঞ্জোদারো। নৌযান ব্যবহার এর সাক্ষ্য বহন করে। সীলমোহর ব্যবহারের নজির সিন্ধু সভ্যতার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কৃষি ছিল এ সভ্যতার প্রাণ। উৎপন্ন শস্যের মধ্যে ছিল গম, বার্লি, চাল, দুধ ও ফল ইত্যাদি। মাছ ও মাংস ইত্যাদি নাগরিকদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পশুদের মধ্যে ছিল ষাঁড়, মহিষ, ভেড়া, শূকর, হাতি ও উট ইত্যাদি। পুরুষ ও মেয়েরা নানা রকমের অলঙ্কার পরত। হরিণ ও মৃগের শিং এবং নিম গাছের পাতা ইত্যাদি ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো যা পরবর্তীকালে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের জন্ম দেয়। শিল্পে ছিল বিশেষায়ন। তাঁতি, কুমার, মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, স্বর্ণকার, হস্তীদন্তের মিস্ত্রি ও অন্যান্য দক্ষ কারিগর শ্রেণি ছিল। মহেঞ্জোদারোর নাগরিকরা ছিল চারভাগে বিভক্ত। এই চারটি শ্রেণির মধ্যে ছিল : বিদ্বান শ্রেণি, যোদ্ধা, ব্যবসায়ী ও শিল্পী এবং শ্রমজীবী। এই শ্রেণি বিভাজন বর্তমান সময়ের হিন্দু সমাজের চাতুর্বর্ণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে ব্যানার্জি মনে করেন। কিন্তু উল্লেখযোগ্য এই শ্রেণি বিভাজন আজকের দিনের মত জন্ম বা বংশগত ছিল না।

আলোচনার এই স্তরে সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যসভ্যতার একটি তুলনামূলক চিত্র আমাদের ধারণাকে স্পষ্ট করতে পারে। ড. অতুল সুর তাঁর গ্রন্থে (হিন্দু সভ্যতার বনিয়াদ: বিশ্ববিদ্যা পরিচয়: জিজ্ঞাসা এজেন্সিজ লি: কলকাতা, ১৯৯১) এই দুই সভ্যতার একটি তুলনামূলক চিত্র দিয়েছেন। এই তুলনার সাথে ব্যানার্জি কর্তৃক উলে- খিত তথ্যেরও সামঞ্জস্য আছে। নিচে এই দুই সভ্যতার তুলনামূলক একটি চিত্র দেওয়া হল:

মহেঞ্জোদারো সভ্যতাআর্য সভ্যতা
১. নাগরিক সভ্যতা ও বৈষয়িক সংস্কৃতি। ২. সেচসম্বলিত কৃষি ব্যবস্থা ও পরিকল্পিত নগরী। ৩. বণিকের জাতি। ৪. মাতৃদেবী, কুমারী ও শিব পূজা। ৫. সূর্য, নাগ, অশ্বত্থ, বৃক্ষ, জীব-জন্তু,গ্রাম, নদ-নদী, অরণ্য ও পর্বত ইত্যাদি পূজা। ৬. লিঙ্গ পূজা। ৭. মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। ৮. উন্নত ভাষা ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন। ৯. লিপি, পাটিগণিত, দশমিক গণন, জ্যামিতি ও হিসাবরক্ষণের জ্ঞান। ১০. ঔষধি জ্ঞান। ১১. স্বর্ণ-রৌপ্য ও তামার ব্যবহার। ১২. আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তি ও টোটেমের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস ১৩. নিরামিশাষী।১. যাজকীয় আধ্যাত্মিক। ২. ভাষাবাচক যাযাবর জাতি। ৩. যোদ্ধার জাতি। ৪. পুরুষ প্রধান দেবতামণ্ডলী। ৫. যজ্ঞে বিশ্বাসী ও মাংসাশী। ৬. পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। ৭. মূর্তি পূজায় অবিশ্বাসী। ৮. কৃষি কাজে অজ্ঞ। ৯. অগ্নি,অরুণ, বরুণ, ইন্দ্র, সূর্য মিত্র, সবিতা পূষণ, ঊষা,বিষ্ণু, অশ্বিন, চন্দ্রমা ও সরস্বতী ইত্যাদি দেবতা। ১০. অশ্ববাহিত জঙ্গী ওথ।  

ওপরে প্রদত্ত তুলনামূলক চিত্র থেকে এটি পরিষ্কার যে, সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা ছিল মাতৃপূজারী। পুরুষ দেবতা হিসেবে ছিলেন একমাত্র শিব। প্রকৃতির সৃজন শক্তিকে তারা মাতৃজ্ঞানে পূজা করত। মূর্তিগুলো ছিল মাটির। ‘মহেঞ্জোদারো’র ধ্বংসাবশেষে শিবের যে মূর্তি পাওয়া গিয়েছে তাতে শিব তিন মুখ বিশিষ্ট। তিনি সিংহাসনে আসীন। তাঁর বক্ষ, কন্ঠ ও মস্তক উন্নত। সিংহাসনে বসা অবস্থায় আড়াআড়িভাবে তাঁর পা রাখা। তিনি ধ্যানস্থ ও ঊর্ধ্বলিঙ্গ। হাতি, বাঘ, গণ্ডার ও মহিষ তাঁর পার্শ্বচর। অপরদিকে আর্যরা ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজের লোক এবং তাদের ছিল পুরুষ দেবতা।

বিপরীতমুখী দুই সভ্যতা এক দীর্ঘমেয়াদী সংঘর্ষের জন্ম দেয়। এ সংঘর্ষের পরিচয় বেদের পাতায় পাতায় পাওয়া যায়। দেখা যায় আর্যরা তাদের দেবতা ইন্দ্রের কাছে মহেঞ্জোদারো নগরী ধ্বংস করার জন্য বার বার প্রার্থনা করছে। মহেঞ্জোদারো নগরীর লোকেরা যে প্রচণ্ড শক্তিশালী ছিল তা আর্যদের এই আকুতি থেকেই বোঝা যায়। দেখা যাচ্ছে আর্যরা ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর” বলে আখ্যায়িত করছে। ‘পুরুন্দর’ অর্থ নগরী ধ্বংসকারী। আবার সিন্ধি ভাষায় ‘মহেঞ্জোদারো’ অর্থ ‘মৃতের স্তুপ’। এমতাবস্থায় কি বলা যায় আর্যরা ইন্দ্রের নেতৃত্বে মহেঞ্জোদারো সভ্যতা ধ্বংস করেছিল?

ইন্দ্র মহেঞ্জোদারো নগরী ধ্বংস করেছেন এ দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং ঐতিহাসিকরা এই নগরী ধ্বংসের অন্য কয়েকটি সম্ভাব্য কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, বন্যা, বাণিজ্য ঘাটতি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগই মহেঞ্জোদারো নগরী ধ্বংসের সম্ভাব্য কারণ। কেউ কেউ মনে করেন নানা প্রাকৃতিক কারণে এই নাগরিক সভ্যতা আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে হতে শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়। আবার কারো কারো মতে সভ্যতাটি যখন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল তখনই আর্যদের আগমন। যেটি এমনিতেই বিলুপ্ত হতো, আর্যদের আগমনে তা হয়তো ত্বরান্বিত হয়।

মহেঞ্জোদারো নগরী বিলুপ্তি অথবা সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্তিতে আর্যদের কোনো কৃতিত্ব না থাকা সত্ত্বেও বেদ, রামায়ণ ও মহাভারতে আর্যদেরকে যেভাবে বিজয়ীর জাতি হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা রীতিমত প্রশ্ন সাপেক্ষ। রামায়ণের ‘রাম-রাবণ’ যুদ্ধকে আর্য বনাম ভূমিপুত্রের যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই যুদ্ধে রাম আর্যদের প্রতীক, আর রাবণ প্রতীক ভূমিপুত্রদের অর্থাৎ সিন্ধু-দ্রাবিড় সভ্যতার। রামায়ণের কাহিনী মতে এই যুদ্ধে রাম হচ্ছেন জয়ী এবং রাবণ পরাজিত। কিন্তু প্রকৃত ঘটনাটি কী? যারা যুদ্ধের বিবরণ পড়েছেন তারাই জানেন রাম যতটুকু না যুদ্ধ-কৌশল দ্বারা জিতেছেন তার চেয়ে বেশি জিতেছেন ভূমিপুত্রদের সহায়তায়। রবীন্দ্রনাথের মতও তাই। ভূমিপুত্রদের সহায়তা তো ছিলই, অধিকন্তু যুদ্ধে রাম অনেক নীতিবিরুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেন। তা না হলে মাইকেল মধসূদন দত্ত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনার উৎসাহ পেতেন না। তিনি রামকে বীরের আসনে বসান নি। বসিয়েছেন ভূমিপুত্রদেরকে। এরপরেও কথা আছে। আমরা জানি রামায়ণের কথিত রচয়িতা বাল্মীকি অন্ত্যজ শ্রেণি লোক। আবার বেদ ও মহাভারতের কথিত রচয়িতা ব্যাস দেবের মাতাও ভূমিপুত্র। অধিকন্তু বেদব্যাস স্বহস্তে মহাভারত লেখেন নি। মহাভারত লিখেছেন শিবপুত্র গনেশ। যে সঞ্জয়ের বয়ানিতে গীতা বর্ণিত সেই সঞ্জয়ও কিন্তু শূদ্র সন্তান। এসব ঘটনা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? ভূমিপুত্রদেরকে দিয়ে আর্যদের বিজয় কাহিনী লেখানো হচ্ছে কেন? গীতা লিখতে শূদ্রপুত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে কেন? স্পষ্টতঃই বোঝা যায় কাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিকল্পেই এটি করা হয়েছে। ভূমিপুত্রদের পরাজয় কাহিনী ভূমিপুত্ররা লিখলে তা বিশ্বাসযোগ্য হয় বৈ কি!

উপরোক্ত বিষয়গুলো বাদ দিলে আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে যায়। বিষয় দুটো ভাষা ও ধর্ম সম্পর্কিত। ভাষার প্রশ্নে দেখা যায় আর্যরা তাদের ভাষা সংস্কৃতকে ভূমিপুত্রদের দ্বারা গ্রহণ করাতে পারে নি। ভূমিপুত্ররা এটি গ্রহণ না করায় সংস্কৃত ভাষা আজ একটি মৃত ভাষা। এই ভাষাটি মাত্রাতিরিক্ত হারে শুধু ‘আর্যধর্ম’ চর্চা করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিপরীতে দেখা যায় ‘আর্যামি’ থেকে মুক্ত হয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য মহাবীর বর্ধমান প্রাকৃত ভাষায় ও ভগবান বুদ্ধ পালি ভাষায় তাঁদের স্ব স্ব ধর্ম প্রচার করেন। এতে তাঁদের ধর্ম জনপ্রিয় ধর্মে পরিগণিত হয়।

সবশেষে আসে ধর্মের প্রশ্ন। দেখা যায় ভূমিপুত্ররা আর্যদের দেবতাদেরকে গ্রহণ করে নি। পরিশেষে আর্যদেরকে ‘সর্বভূতে আত্মা স্বীকার করে ভূমিপুত্রদের সাথে আপোষ রফা করতে হয় (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : কালান্তর : বিশ্বভারতী : ১৪০০)। এ প্রেক্ষাপটে শেষ পর্যন্ত টিকে রইলেন সিন্ধু সভ্যতার আদি দেবতা শিব ও তার পরিবারের দেবীগণ। আর্যদের ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতারা হয়েছে বিলুপ্ত। অবশ্য রাম ও কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে হিন্দুদের দ্বারা গ্রহণ করানো হয়েছে। কিন্তু দু’জনকেই ভূমিপুত্রদের চেহারা অর্থাৎ শ্যামল অথবা কালো দেহ ধারণ করতে হয়েছে। কৃষ্ণকে তো রীতিমত বাঁশি হাতে নিয়ে দ্রাবিড় ঐতিহ্যের রাধিকাসহ হাজির হতে হয়েছে। এমতাবস্থায় ভূমিপুত্ররাই যে শেষ পর্যন্ত জয়ী এ ব্যাপারে আর সন্দেহ থাকে না।

অতীতের কথা বাদ দিয়ে বর্তমানের দিকে দৃষ্টিপাত করলে কী চিত্র পাওয়া যায়? আজকের দিনে আর্যদের অবস্থান কি? আমরা জানি আর্যদের মূল আবাসভূমি ‘আর্যাবর্ত’। এই আর্যাবর্তের ভৌগোলিক সীমানা আধুনিক আফগানিস্তান, ইরান, বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ঘটনাক্রমে উত্তর প্রদেশ বাদে এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা আজকের দিনে ইসলাম ধর্মাবলম্বী। দেখা যায় আর্যদের একেশ্বরবাদ আর ইসলামের একেশ্বরবাদ প্রায় একই। আর্যরা আজ থেকে তিন-চার হাজার বছর পূর্বে এ অঞ্চলে এসে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সংঘর্ষকামিতা থেকে তারা আজও কি মুক্ত হতে পেরেছে? আর্যদের বংশধরদের দেশ বর্তমান আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তান ইত্যাদি অঞ্চলের অতীত ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা তা প্রমাণ করে না। অপরদিকে দেখা যাচ্ছে ভারতের যেসব অঞ্চলে আর্যদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি সেসব অঞ্চল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ও অর্থনৈতিকভাবে এখনও সবচেয়ে অনুন্নত। এসব অঞ্চল অশিক্ষা, কুশিক্ষা, সামাজিক ভেদাভেদ ও হিংসায় জর্জরিত। এর বিপরীতে যেসব অঞ্চল সিন্ধু সভ্যতা ও দ্রাবিড় সভ্যতার প্রভাবাধীন সেসব অঞ্চল আজকের দিনে সবচেয়ে উন্নত। সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত এর উদাহরণ। এখানেই সিন্ধু সভ্যতার শক্তি, হিন্দুদের শক্তি। প্রমথ চৌধুরীর মতে এ শক্তি মাটি থেকে উত্থিত, আকাশ থেকে নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *