সিনেমা হল
ঝুপড়ির ভিডিও হলে সারা দেশ ছেয়ে গেছে। গ্রামে-গঞ্জে, শহরতলিতে আনাচে কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ভিডিও-পারলার নামের নরককুণ্ডগুলি।
শহরের সিনেমা হলগুলির অবস্থাও অতিশয় শোচনীয়। হতগৌরব, জরাজীর্ণ, রক্ষণাবেক্ষণহীন পোড়োবাড়ির মতো একেকটা হল। দমবন্ধ, অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পাখা ঘোরে না, ঠান্ডা মেশিন চলে না, ছেঁড়া গদি, ভাঙা চেয়ার, হলের মধ্যে দুঃসাহসী ইঁদুর ও আরশোলাদের রাজত্ব। কাউন্টারে টিকিট নেই, টিকিট দালালের হাতে কালোবাজারি দরে বিক্রি হয়।
অথচ এই তো সেদিনের কথা, সিনেমা হলগুলি ছিল সাধারণ মধ্যবিত্তের বিলাসের জায়গা। নরম গদি, রঙিন আলো, সুগন্ধ উর্দি-পরা সুসজ্জিত দ্বাররক্ষী। পুরনো দিনের মেট্রো বা এলিটে, বীণা বা ভারতীতে সিনেমা ভাল হোক বা খারাপ হোক, সিনেমা দেখার আনন্দই ছিল আলাদা।
এমনকী ছোট ছোট শহরে, সেই আশ্চর্য, স্মৃতিবিধুর নামের সেই প্রেক্ষাগৃহগুলি—ছায়াবাণী, অলকা, চম্পা, নীলা, বাণীচিত্র—তাদের চেহারাই ছিল আলাদা। একেকটা নতুন বই আসত, পুরো শহর উত্তাল হয়ে উঠত। লাল-নীল কাগজে ছাপা হ্যান্ডবিল ঘোড়ার গাড়িতে করে বিলি করা হত পাড়ায় পাড়ায়।
এখন আর সেদিন নেই। সিনেমা হল আর মানুষকে টানে না। কখনও-সখনও দুয়েকটা মারকাটারি বই এল তো ভিড়, হুড়োহুড়ি, আর সেই ভিড়ও ভদ্রজনতা নয়। বাকি সময় টিমটিম করে কোনওরকমে টিকে আছে পুরনো হলগুলি। নতুন হল তো চোখেই পড়ে না।
সেদিন এক ভদ্রলোক রসিকতা করে বললেন, কোন একটা হলে একটা পুরনো দিনের নামকরা বই এসেছে শুনে দেখতে গিয়েছিলেন। হলে লোকজন মোটেই নেই। পুরো ফাঁকা হল। বইও সময়মতো আরম্ভ হচ্ছে না। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে হলের অফিসঘরে গিয়ে ম্যানেজারবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দাদা, সিনেমাটা কখন আরম্ভ করবেন?’ ম্যানেজারবাবু করুণ হেসে বললেন, ‘দেখছেন তো অবস্থা। তা যখন বলবেন তখনই আরম্ভ করব।’
একালের সিনেমা হলের কথা বলে মন খারাপ করে লাভ নেই, পুরনো দিনের গল্পে যাই।
দুই অল্পবয়সি ভাই-বোন সিনেমা দেখতে যাচ্ছিল। হলের সামনে দেখা গেল, ভাইয়ের চোখ রুমাল দিয়ে বাঁধা, কানামাছি খেলায় যেমন হয়। সিনেমা হলের গেটকিপার জিজ্ঞাসা করল, ‘এ ছেলেটির চোখ বাঁধা কেন, ও সিনেমা দেখবে না?’
বোন হেসে বলল, ‘না, তা নয়। হলের মধ্যে গিয়ে ওর চোখের রুমাল খুলে দেব।’ গেটকিপার অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’ বোন বুঝিয়ে বলল, ‘বাইরের রোদুর থেকে হলে ঢুকলে অন্ধকার নামে। সিটে যেতে গিয়ে হোঁচট খাই সেই জন্যে ভাইয়ের চোখ বেঁধে এনেছি, হলে ঢুকে চোখ খুলে দিলেই ও পরিষ্কার দেখতে পাবে। তখন আর অসুবিধে হবে না।’
অনেক দিন আগে বিলিতি জোক বুকে একটা কুকুরের গল্প পড়েছিলাম। কুকুরটা টিকিট কেটে একটা সিনেমা হলে ছবি দেখতে গিয়েছিল। ছবিটা একটা বিখ্যাত উপন্যাসের চিত্ররূপ।
ইন্টারভ্যালের সময় একজন কৌতুহলী দর্শক কুকুরটিকে বলল, ‘কোনও কুকুরকে আমি কোনও দিন কোনও সিনেমা দেখতে আসতে দেখিনি।’ কুকুরটি জবাবে বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আমিও সিনেমা দেখি না। তবে এই বইটা যখন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল, আমার খুব ভাল লেগেছিল। তাই ভাবলাম, যাই দেখে আসি সিনেমাটা কেমন হয়েছে।’
আরেকটা গল্প মনে পড়ছে।
অত্যন্ত স্থূলদেহী এক ভদ্রলোক দুটো টিকিট কেটে হলে ঢুকলেন। গেটকিপার টিকিট দুটো ছিঁড়ে কাউন্টারফয়েল ফেরত দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘আরেকজন কোথায়?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘ভাই, আমার নিজের জন্যই দুটো টিকিট কিনেছি। মোটা মানুষ তো, নিজের জন্যেই দুটো নিয়েছি, একটায় যে কুলোয় না।’ গেটকিপার বলল, ‘তা তো বুঝলাম, কিন্তু একটা টিকিটের নম্বর এম ২৩ আর অন্য টিকিটের নম্বর আই ১৪ এই দুটো সিটে আপনি একসঙ্গে কী করে বসবেন?’
অবশেষে একটা অবাস্তব গল্প দিয়ে এই প্রেক্ষাগৃহ-পরিক্রমা সাঙ্গ করি।
অন্ধকার হলে শো চলছে। এমন সময় দেখা গেল, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক সিটের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে কী যেন খুঁজছেন। যে দর্শকের পায়ের তলায় বৃদ্ধ খোঁজাখুঁজি করছিলেন, তিনি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওখানে কী করছেন?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘একটা জিনিস খুঁজছি।’
দর্শকটি জানতে চাইলেন, ‘কী জিনিস?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘চুইংগাম।’ দর্শকটি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘সামান্য চুইংগামের জন্যে অন্ধকার মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছেন?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘সামান্য নয়। ওই চুইংগামের সঙ্গে আমার বাঁধানো দাঁতজোড়া আটকিয়ে আছে।’