সিধু পালের হিমসাগর

সিধু পালের হিমসাগর

ওপারে হাজিপুরের পাটকলে চিমনির ডগায় এই সাত সকালেই সাদা ধোঁয়া। এপারে পর্তুগিজ গির্জার ঘাটে পা দোলাতে দোলাতে একটা সাদা মতাে বুড়াে গঙ্গার দিকে নজর রাখছিল। এই মাত্র ত্রিবেণীর লঞ্চ কেওটা সাগঞ্জের দিকে ছুটল। তার ভাঙা ঢেউয়ে তখনাে কয়েকটা মেছাে বক ফেউ হয়ে উড়ছে।

ফাগুনের সকালের আলােয় তাপ। কুয়াশা কেটে যেতে বােঝা গেল একখানা বুকখােলা হা হাভাতে নৌকো জল কেটে কেটে এদিকেই যেন আসছে। গির্জা ঘাটের সাদা বুড়ােটা তা দেখেই উসখুস করে উঠল।

বুড়াের গায়ে বুকখােলা নীল শার্ট গঙ্গার বাতাসে বেলুন হয়েই দেখা যাচ্ছিল—বুড়াের চামড়া ফোসকা পড়া যেন। হাঁটু ছাড়াই ছাড়াই ধুতি। মাথাটা পাকা চুলে দুধসাদা। সেই মাথা গির্জার ডগার ছুঁচলাে হয়ে পড়া ছায়ার ভেতর এদিক ওদিক নড়ে উঠল—ও ফকির-আজ আবার এলে কেন? | সেই বুকখােলা নৌকোখানা এবার স্পষ্ট। তাতে খালি গা বসে থাকা একটা পেল্লাই লম্বা লােক দূর থেকে ভেসে আসতে আসতেই বলল, তা হয় না পাল মশায়। রােজ লােক ভাড়া করে—করাত ভাড়া করে ফিরে যেতে পারবনি।

এই বুড়াে সিধু পালের কথার বরখেলাপি হয় না ফকির। কথা দিয়েছি—টাকা আগাম নিলাম—ও গাছ তােমাদেরই ফকির। ওদের কাঠ, শেকড় বাকল—ডাল। পাতা—সবই তােমাদের। আজ আর ফিরছিনে পালমশায়। করাত কুড়ােল, দড়িদড়া নিয়ে এখন ফিরলে ওপারে সবাই হাসবে।—বলতে বলতে ফকিরের নৌকো এসে গির্জা ঘাটে ভিড়ল।

বুক খােলা বজরা। জনা-ছয়েক লােক লাফিয়ে নেমেই গঙ্গার নাবাল গায়ে লােহার নােঙরটা আছড়ে ফেলে গেঁথে দিল। তারপর ভাসন্ত বজরায় বাঁধা। কাছির ডগা টেনে এসে সে নােঙরে আচ্ছা করে বেঁধে দিল। বজরা তখনাে দুলছিল। দুলছিল বজরার বুকে শােয়ানাে প্রমাণ সাইজের করাতখানা।

না। হাসবে না ফকির। গাছেরও তাে একটা জীবন আছে। না কি বল ? আজ তােমরা ফিরে যাও।

টেটিয়া হয়ে দাঁড়াল ফকির। না, আজই করাত বসাব। কুড়ােল চলবে—

আজ গুরুবার ফকির। তিন তিনটে হিমসাগর গাছ ফেলবে গুরুবারে? গেরস্থর অকল্যাণ হবে যে—কাঠ ব্যাপারী হয়ে তােমার হাত দিয়ে আমার অমঙ্গল ঘটাতে চাও।

ফকির ব্যাপারীর চোখে পলক পড়ল। সে একই সঙ্গে দুই মনে বলল, তাহলে আজ গাছের তলাতেই কাটাই। খুটো বসাই। দড়িদড়া তাে বাঁধতে হবে। আর—

আর কী ফকির? | দশ আনা বাগান তাে আপনার বিক্রি হয়ে গেল। মানুষজন বাড়ি বানাচ্ছে। তারা চড়া দর দিয়ে গাছ সুদ্ধ বাগান কিনে নিল তাে এ কবছরে। ঠেকাতে পারলেন!

এখন সবাই দালান চাষ করে ফকির। বাড়ির পর বাড়ি উঠছে। ফলের চাষ আর থাকবে না দুনিয়ায়—

 বাগান সুদ্ধ জায়গা কিনে গাছকে গাছ ফর্দাফাই। ঠেকাতে পেরেছেন?

শান্ত গলায় সিধু পাল বলল, যে বাগানে বাবার হাত ধরে ছেলেবেলায় সরি, পেয়ারাফুলি কুড়িয়ে ফিরেছি ফকির—এখন সেখানে দোতলা বাড়ি—পিচ রাস্তা। ইলেকট্রিক পােস্ট!

তাহলে আর আমাদের কেনা গাছ কাটতে বাদ সাধেন কেন পালমশায় ?

গঙ্গার গা ধরে জবরদখল জায়গায় ধানের চাষ। একেবারে সিঁথি কেটে চারা বসানাে। সেখানে আলে সাবধানে পা ফেলে ফেলে গির্জার মাঠে উঠে এল সিধু পাল। তার পেছনে করাতখানা চ্যাংদোলা করে তিনজন লােক। করাতের জিভটা তাদের চলার চালে লক লক করে দুলছিল। তারও পেছনে ফকির ব্যাপারী আর জনা-তিন কাঠুরে। কুড়ুল কঁাধে।

| সিধু পাল কোনাে জবাব দিল না। বাগান রাখতে হলে জোগানদার, আমপাড়া, বাগানদার রাখতেই হবে। রাখতে গেলে টাকা চাই। নইলে লক্ষ্মীছাড়া হাভাতের দল হনুমান হয়ে যা ফলবে সাবাড় করবে। তখন বাগান রাখা-না-রাখা একই।

তাই খানিক খানিক বাগান বেচে দিয়ে গােটা-চল্লিশেক গাছ বাগান-সমেত বাঁচাতে পেরেছে সিধু পাল। কতদিন আর বাঁচিয়ে রাখতে পারবে—তা সে জানে না। মজুরির যা হালফিলের দর—তাতে ফলফলারির চাষ উঠে যাবে।

তারই বেচা বাগান জুড়ে বলাগড় রােড আর বুনাে মসজিদের গা ধরে নতুন ছিমছাম বসতি গড়ে উঠেছে। লােকে বলে সিধু পালের বাগানে থাকি। তার মানে আমগাছ সাবাড় করে দিয়ে সেখানে ওদের দালান চাষ হয়েছে। এই বিশ বছরে। তারই কোনােটায় থাকে। যেখানে রেডিয়াে বাজে। টিভি চলে। আগে আগে যেখানটায় দাঁড়িয়ে সিধু পাল হিমসাগরের ডালে ওষুধ দিয়েছে। ল্যাংড়ার পাতায় মুকুল আসার পর ওষুধ ছিটিয়েছে। পাছে মধু লাগে।

লােকজন নিয়ে ফকির ব্যাপারী হিমসাগর তলায় পুঁজি বাঁধল। তালপাতা, বাঁশ, বড়াে শালপাতার দুই পাটে কুঁজি। মাঝে বাঁশ। পাশাপাশি তিন তিনটে হিমসাগর গাছ। মােটা গােলাই গুড়ি। শির তােলা বাকল। গাছ তিনটের বয়স হয়েছে। তাদের পায়ের কাছে খুটো, কাছি, কুড়ােল পড়ে থাকল। শুধু করাতখানা কাপড়ে মুড়ে কুঁজির পাশে সাবধানে রাখা হল। এবার ফকির ব্যাপারী পান্তার হাঁড়ি বের করবে। খেয়ে নিয়ে তবে কাজে লাগা।

গাঁয়েই সিধু পালের ভিটে বাড়ি। সে বাড়ির গায়ে গায়ে পুকুর আর বাগান। বাগানে সারি সারি গাছ। গম্ভীর হয়ে দাঁড়ানাে। এখনাে ফাগুনে বাতাস ওঠেনি। সবে মুকুল দেখা দিচ্ছে। গাছেদের হাঁটু অব্দি মরা পাতা ঝরে পড়ে আছে।

নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে সে জানলা দিয়ে দেখতে পেল-ফকির ব্যাপারী কাছেপিঠের কেটে আনা তালের ডেগাে দিয়ে শােবার, থাকার কুঁজি সাজাচ্ছে। ভাড়া করা লােকদের একজন কোদালে ঘাস চেঁছে রান্নাবান্নার জায়গা

পরিষ্কার করছিল। সিধু পালের বুকের ভেতটা গুড়গুড় করে উঠল। তিন তিনটে বয়স্ক হিমসাগর গাছ কেটে সাইজ করা—নৌকোয় সাজিয়ে ওপারে চালান | দেওয়া মানে দিন কুড়ির ধাক্কা। তারই গােড়াকার কাজকম্ম সাজাচ্ছে ফকির ব্যাপারী। সিধুর বুকের ভেতরেই যেন মড়মড় করে পয়লা গাছটা ভেঙে পড়ল।

বাপঠাকুর্দার আমলের বাড়ি। ঘরের পর ঘর। ডানদিকটা ঘুপচি হয়ে ভেঙে পড়েছে। উঠোনে বিচি রাখার সবেধন লাউটি মাচায় একা ঝুলছে। শুকনাে গােবরের ভেতর বাঁজা গাই একা দাঁড়িয়ে। প্রাণে ধরে ওকে দূরের মাঠে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসতে পারেনি সিধু। এই একদিকে গঙ্গা—আরেক দিকে ব্যান্ডেল ছুঁয়ে চলে যাওয়া রেললাইন—তার মাঝের ঘাটে সে প্রায় আশিটা বছর জুড়ে বেঁচে আছে। এই বাতাসে নাক পেতে রেখে সে আশ্বিনা আমের বউলের কটু বাস ধরতে পারে। মধু লাগাবার জন্যে মৌমাছির ঝাক নয়া সরাইয়ের দিক থেকে ঘূর্ণি খেয়ে উঠে আসছে কিনা—এই বাতাসেই কান পেতে সিধু ধরে ফেলতে পারে।

ঠিক এমন সময় সিধুর চার ছেলে-ছয় মেয়ের মা—তরঙ্গিনী পাল এসে বলল, উনত্রিশটা টাকা দাও তাে। মনিঅর্ডার করব।

কোথায় পাঠাবে?

সে খোঁজে তােমার কী দরকার। তিন তিনটে গাছ বেচে তাে সাড়ে আট হাজার টাকা পাচ্ছ। জানি জানি। সব জানি আমি।

জেনেছ তাে ভালাে। টাকা অত শস্তা জিনিস নয়। কোথায় পাঠাবে বলতাে?

তরঙ্গিনী একখানা কাগজ এগিয়ে দিল। এ কাগজ চেনে সিধু পাল। লুধিয়ানার চোরচোট্টারা শস্তায় সেলাইকল, রেডিয়াের লােভানি দিয়ে সারা দেশে এইসব কাগজ ছড়ায়। আর তরঙ্গিনী ওদের একের নম্বরের খদ্দের।

কাগজখানা ফেলে দিয়ে সিধু বলল, না। হবে না। টাকা নষ্ট করার জিনিস নয়।

করলামই না হয় নষ্ট। মােটে উনত্রিশটা টাকা তাে।

আমার একটা টাকাও দামি। নষ্ট করতে হয় ছেলেদের কাছে টাকা চেয়ে নাও।-বলেই সিধুকে উঠতে হয়। গঙ্গার ওপার থেকে এই সময় আঁকে ঝুঁকে পাখি আসে। তারা কচি মুকুল খায়। নষ্ট করে। বউল আসা কমে যায় ফলে। ওদের তাড়াবার জন্যে গাছে গাছে টিনের তঁাডরা বসানাে আছে। নীচে ঝােলানাে দড়ি ধরে টানলেই বিকট আওয়াজ। সেই দড়ি টানতে বাগানে ঢুকে পড়ল সিধু পাল। ঢুকতে ঢুকতেই মনে পড়ল—ছেলেরা তাে তরঙ্গিনীকে একটি টাকাও ছোঁয়াবে না। চকবাজারে গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডারে নিজেদের ভেতর কামড়া-কামড়ি করে ব্যবসা করে। বউমায়েরা সব আলাদা আলাদা। ভাগ্যিস মেয়েগুলাে পার করা সারা। আজ তারা সংসারে থাকলে কী হত। সিধু বছরকার চালডাল ধরে দেয়। বাকিটা ওরাই চালায়। কতদিন আর সে এই ভূতের সংসারে চাল ডাল তেল জোগাতে পারবে তার ঠিক নেই। জায়গা বেচতে বেচতে বাগান ছােটো হয়ে এসেছে। অথচ খরচাদার বাগান বজায় করতে জায়গা না বেচেও উপায় নেই। সে আর ভাবতে পারে না। এক সময়কার তিনশাে গাছের বাগান এখন। তিরিশ-চল্লিশটি গাছে এসে ঠেকেছে। বাগানের গা ধরেই নয়া বসতি। লােকজন। নতুন নতুন সংসারপাতি।

খানিকটা ঢুকে পড়তেই সিধু পালকে তার বাগানের ক্ষীরসাপাতি, ল্যাংড়া, হিমসাগর গাছগুলাে প্রায় গিলে ফেলল।

সত্তর-বাহাত্তর বছর আগে যে শিস দিতে শিখেছিল সিধু–বাবা মতি পালের হাত ধরে—অবিকল সেই শিস দিয়ে দিয়ে সে গম্ভীর আমবাগানের ভেতর ঢুকবার চেষ্টা করতে থাকল—সত্যিই মুকুলখাের পাখির ঝাক এল কি না। ওরা এসে ঝাঁক বেঁধে গাছের মগডালে বসে। কচি মুকুল কুটুর কুটুর করে খায়। সব গাছগুলােই তার চেনা। আশ্বিনা গাছটায় সবচেয়ে আগে টোকো আমের গুটি ধরে। আচারের জন্যে এ গাছ থেকে আম নেয় চৌধুরী কোম্পানি। নৌসরা আমের কলম তার নিজের হাতে ধরানাে। আঁটির আমের চারার সঙ্গে পেয়ারাফুলি গাছের নরম ডালে সে নিজের হাতে মাটি ধরিয়েছিল। তখন তরঙ্গিনী এতটুকু বউ। বাবা মতিলাল কুঁচড়াে বাজারে মেয়েমানুষের জন্যে ঘর নিয়ে উঠে গেছেন। বাবাকেও মাস গেলে আড়াইশাে টাকা পাঠাতে হত। সিধুর—সেই বাজারে। তখন প্রায় তিনশাে গাছের বাগান তাদের। সে ছেলেবেলায় শােনে—মতি পালের বাগান। তারপর দেখতে দেখতে লােকে বলতে লাগল সিধু পালের বাগান।

বাগানের জোগানদারদের জন্যে বালতি পড়ে আছে ল্যাংড়া তলায়। ওষুধ মিশিয়ে মরশুমে চার চারবার সারা গাছ ভিজিয়ে দিতে হয়। একবার গাছ ভেজাও। তারপর ডাল পাতা। তারও পর বউল এলে ভিজিয়ে যাও। শেষ ভেজানি গুটি এলে। তাও রক্ষে নেই। মহল্লার কচিকাঁচারা আম পাড়তে আসে। বাধা দিলে চলে? তাদেরও বলতে হয়—নাও বাবারা নাও। পেড়ে খাও। একবার দেখা গেল—তারা যা পেড়েছে—পেড়েছে। বাকি আম ব্লেড ঘষে দাগি করে রেখে গেছে।

বাগান নাম পেল সিধু পালের। কিন্তু গাছ সমেত জায়গা হাতছাড়া হতে থাকল সিধুর। চার চারটে ছেলে। ছ-ছটা মেয়ে। এদের বিয়ে। এদের হিল্লে। টাকার থলে হাতেও লােক এগিয়ে এল। জায়গা দাও—বাড়ি হাঁকাব। দশ পনেরাে বছরে ময়দানবী কাণ্ড ঘটে গেল। গাছ কেটে—এঁদো ডােবা বুজিয়ে বাড়ির পর বাড়ি উঠতে লাগল। মানুষের মজুরিও বাড়ল—লােভও বাড়ল। ফলে লােভ সবার। মানুষের। ব্যাপারীরও। কচিকাচাদের। পাখি তাে আছেই। আবার মৌমাছিরাও। তারও পরে আছে পােকা। এত দরজা পেরিয়ে তবে সরি, ক্ষীরসাপাতি, ল্যাংড়া, হিমসাগর। এক একটি আম—এক একটি ব্রহ্মাণ্ড। সপ্তকাণ্ড পেরিয়ে তবে সিদুরে রং—আঠা আঠা সুবাস। মুখে দিলে অমৃত।

পুকুরের মৌরল্লা, মাঠের বিউলির ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে সিধু বারান্দাতেই ঘুমােয়। বিচির লাউটা তাকে দেখে। দেখে বাঁজা গাই। আর দেখে বাগানের পেয়ারাফুলি, সরি, নৌরসা, হিমসাগরের মাথা। সেই সেই ডগায় পাতার এক পিঠ কালচে সবুজ। আরেক পিঠ কিছু ফিকে।

 সারা বাড়িতে দুই প্রাণী। অন্যজন তরঙ্গিনী। কখন খায়—কখন শােয়—তা জানে না সিধু পাল। সন্ধে রাতে আগান বাগান সেরে সিধু এসে বারান্দায় বসে। কথা বলে। একা একাই। কোনােদিন তরঙ্গিনী শােনে। কোনােদিন কথার পিঠে কথা দেয়। কোনােদিন বা পড়ে পড়ে ঘুমােয়। গাই দেখা—হেরিকেন ধরানাের মাহিন্দির লােকটিই ওদের দুটিকে ফুটিয়ে খেতে দেয় দুটি-সদর দোর আটকায়—আলাে নেভায়।

আমবাগানের ছায়া মাখানাে জ্যোৎস্নায় বসে এক একদিন সিধু পাল তার বাপেরও বাপ-হারু পালের গল্প বলে একা একা।

কোনওদিন হয়তাে তরঙ্গিনী বলে বসে, সেই হারুকে দেখেছ তুমি?

আমি দেখব কোথেকে! বাবার অল্প বয়সে তিনি যান। রেললাইন বসাবার মাটি কাটতে এসেছিল পুবদেশ থেকে। তারপর এখানেই থেকে যায়। সাহেবরা কিংবা রেলকোম্পানি তাকে এসব জায়গা দেয়।

তরঙ্গিনী ফুট কাটে মাঝে। তারপর হারু একদিন নিজের বসানাে আমবাগানে হারিয়ে গেল।

ভদ্র করে কথা বল। তিনি তােমার দাদাশ্বশুর। ওই হল গিয়ে একরকমের! সিধুর এক-এক সময় সন্দেহ হয় তার বউটার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তাে। আবার মনে হয়—তা কী করে হবে। আমের সময় তাে দিনে দিব্যি বিশ পঁচিশটা খেয়ে বসে থাকে। সিধু নিজে সারাদিনে তেতাল্লিশটা পর্যন্ত আম

খেয়েছে।

বিকেল বিকেল চোখ লাল করে ঘুম থেকে উঠল সিধু। উঠে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল সে। ভাগ্যিস ওপারের মতাে এপারেও এলােপাথাড়ি ইটখােলা গজায়নি। ইটখােলার আগুনের হলকা বাতাসে বাগানের বউল ঝলসে যায়।।

সন্ধে হয় হয়। সরস্বতী পুজোর পর দুটি সপ্তাহ গেছে। হিমসাগর তলায়। ফকির ব্যাপারীর মাটির খোঁড়া উনুনে শুকনাে কাঠে আগুন দিল ফকির। আগুনের বাইরেই অন্ধকারে চাপ ধরে আমবাগান দাঁড়ানাে। বাগান কেটে নয়া বসতির ঘরে ঘরে ইলেকট্রিক আলাে, রেডিয়াের গান—আর টিভি-তে বাজনা, কথা, ছবি। এক একটা আস্ত বাগানের জায়গায় মানুষজন কলকল করছে।

ছেলেরা দোকান করে ফিরতে ফিরতে রাত হয়। বউমায়েরা সবাই দোতলার বাসিন্দা। ওরা এখন আলাদা আলাদা কেটলিতে চা খাবে। বড়াে বউমা ঠক করে এক কাপ চা সিধুর সামনে রেখে যাবে।

ফকির ব্যাপারী ডালে সম্বরা দিয়ে অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়েছিল। সে এখানে এলে কাঠের একটা আন্দাজ পায়। কোনাে কোনাে গাছ এতই পুরনাে—যারা আর আম দেয় না —বাকল ফেটে মােটা গুড়ির গােলাই গা বেরিয়ে পড়েছে—নানান পােকায় অবিরাম কুরে কুরে খেয়ে চলেছে তাদের গাথাবড়া মারলে ঝুর ঝুর করে কাঠের পাউডার পড়তে থাকে সেখান থেকে।

আচমকা সে তাকিয়ে দেখে খােদ পালমশায় তার সামনে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে, চাদ্দিকে নগর বসে গেছে পালমশায়। এ বাগানের যাও বা ধরে আছেন—তা ফসকে যাবেই—দেখবেন আপনি! সব জুড়ে ঘর-গেরস্থি বসে যাবে।

এসব কথা ফকির বলে—আর মনের ওপর বসানাে চোখে সে দেখতে পায়—সারা বাগান তার করাতে কুড়ুলে ঢলে পড়ছে। এক একখানা গাছে। হাজারখানা করে পিড়ি হচ্ছে। হচ্ছে পিলসুজ। আলনা। চৌকি। ফকির ব্যাপারী নিজের বুকের ভেতর পেয়ারাফুলি, হিমসাগরদের ঢলে পড়ার মড়মড় শব্দ টের পায়। বড়াে সুখের শব্দ। সচ্ছল শব্দ। বুকের ভেতর ক্ষীরের পাটালি ভাঙার শব্দ।

তখনাে সিধু পাল মুখ খুলছে না দেখে ফকির বড়াে আশায় আশায় বলল, পালমশায়—আপনার অনেক গাছের মগডাল দেখে দেখে সারাদিনে বুঝলাম

কী বুঝলে ? বয়সের ভারে—তােয়াজের গাফিলতির দরুন ওসব গাছ ফোপরা হয়ে আছে। ফল তাে দেবেই না—

তাতে কী হল! ঝুটমুট বাগানের জায়গা দখল করে আছে এক একটা আলিসান গাছ। গঙ্গায় এখন ভরা জোয়ার। গির্জার মাঠের ঘাটে জল এসে অনবরত তড়পাচ্ছে। সেখান থেকে জল ভাঙার শব্দ বাতাসে এতদূরে চলে আসছিল। শব্দটা যেন সিধুর মনের ওপর ঘুরে কিরে মাছি হয়ে বসতে চাইছে। সিধু পাল কিছুতেই তাড়াতে পারছে না। তার মন অন্য কোথায় বিমনা হয়ে পড়ে আছে। তাই আচমকাই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অন্য কথা। একদম অন্যদিক থেকে।

দ্যাখাে ব্যাপারী। এবারে তােমরা ফিরে যাও।

ফকির উঠে দাঁড়াল। বলেন কী পালমশায়?

হা। ফিরে যাও | আমার বাগানের ফোপরা গাছের স্বপন দেখা ছেড়ে দিয়ে এবার তােমরা ওপারে ফিরে যাও—গাছ দেখলেই মনে মনে করাত শানানাে ছাড়াে। বয়স তাে হল। ওপরে গিয়ে কী জবাবদিহি করবে!

বাঃ! তিন তিনবার নানান ওজরে আমায় ফেরালেন। এবার আমি ফিরছিনে পালমশায়—

টাকা দিয়েছ। গাছও তােমার রইল। সময় হলে কেটে নিয়ে যাবে। এ তিনটে গাছই বাবার নিজের হাতে বসানাে ফকির। এক সময় আমে ঢেকে যেত। আঁটির চারার সঙ্গে কলমের ডালে মাটি ধরাত বাবা। তারপর ধরানাে গাছ মাটিতে বসলে আঁটির চারাটি নিজের হাতে কেটে দিত। তােমার নামে তাে রােকড় খাতায় তােলা রইল গাছ তিনটে। আমি যদি চোখও বুজি ছেলেরা কোনাে আপত্য করতে পারবে না ফকির নাতি-নাতনিরা দোতলার বারান্দায় ধামসাচ্ছে। ঝাঁপুনি, কঁদুনির আওয়াজ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ছিল।

তার ভেতরই ফকির ব্যাপারী বলল, তা হয় না পালমশায়। কাল ভােররাতেই করাত পড়বে।

ফকিরের গলা এমন অমােঘ-—যেন কোনাে মােষ আগড় ঠেলে শিং সমেত বড়াে মাথাটা সিধুর বুকের ভেতর সেঁধিয়ে দিল।

সিধু পাল বলল, তবে শােনাে ফকির—এট্টা গল্প বলি। এ আমার ঠাকুর্দা হারু পালের নিজের জীবনের কথা।

আগের বারও আপনি সাত সতেরাে গল্প করে রাত্তির কাবার করে দিলেন। শেষে বললেন—এবার নয় ফকির-আরবারে এসাে।

আরে শােনােই না গল্পটা। আমিও খুব ছােটোবেলায় শুনতাম-হারু পালের বাগান। তা হারু পাল আমার জন্মের কত আগেই ফৌত! কিন্তু তার বসানাে শ-তিনেক গাছের বাগানে জন্মে ইস্তক ঘুরে বেড়াই—পাখির ডাক শুনি— মৌমাছিদের চাপ ধরে ঘূর্ণি খেতে দেখি। আর আম খাওয়ার কথা যদি বল তাে আমি বলব—আম খাইনি-আমের বাগানে সাঁতার দিতাম। সেই বয়স থেকেই বাগানের জোগানদার, বাগানদার, আমপাড়াদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা। তখন আমার বাপ মতি পালের আমল।

গল্প শােনার ইচ্ছে ছিল না ফকির ব্যাপারীর। কিন্তু সেও দেখল—শুধু সে-ই শুনছে না—তার সঙ্গে গােল হয়ে বসে শুনছে ভাড়া করা লােকজনও। ফকির তবু দাবড়ে উঠল, রাত হচ্ছে—ভাতটা বসিয়ে দে রাখাল—

সিধু পাল দেখল—রাখাল নামের লােকটা খুব সম্ভব কাঠুরেদের কেউ হবে। দিব্যি তাগড়া—হাড় হাড় হাত-পা। সে তার কথায় কান রেখে ভাত বসিয়ে দিল। কাঠের আঁচও উশকে দিল। হাঁড়ির মুখ খানিক ফঁক রেখে সরায় ঢাকল।

 আমি বালক বয়স থেকেই বাগানদার, জোগানদার, আমপাড়াদের সঙ্গে বাগানে বসে বসে গল্প করি। খুনখুনে বুড়াে এক জোগানদার ছিল ঠাকুর্দার আমলের। বােধহয় হারু পালের সঙ্গে রেললাইন বসাবার মাটি কাটতে এসেছিল। সেই বলেছিল—তােমার ঠাকুর্দা কি এত গাছ নিজির হাতে বসিয়েছে? তাই ভাব বুঝি!

অবাক হয়ে জানতে চেয়েছি—তবে কে বসাল ? হুঁ হুঁ। সেই তাে মজা। তােমার ঠাকুর্দা হারু পাল গাছ চালান দিত।

সে কীরকম? ধরাে উঁচড়াে কোর্টে হারু গেছে মামলা করতে। আদালতের হাতায় ভারী সুন্দর একটা ল্যাংড়া গাছ দেখল। কলমের ঝাকালাে গাছ। আর দু-বছরের মাথায় ফল আসবে। হারু পাল রাতারাতি সে গাছ চালান দিয়ে দিল নিজেরই বাগানে। আর উঁচড় কোর্টের হাতায় চালান দিয়ে দিল নিজেরই একটা টোকো আমগাছ। কাছাকাছি চেহারার বলেন কী পালমশায় ?

কাঠুরেদের একজনের চোখ গােল হয়ে গেছে। তার চোখে চোখ রেখে সিধু পাল বলল, আগে তাে গঙ্গার আকাশে সারারাত ধরে আমগাছ চালাচালি হত। হাজিপুরের হিমসাগর যাচ্ছে ক্যাওটা সাহাগঞ্জ। নয়াসরাইয়ের ল্যাংড়া চলল নৈহাটি। এই ভাবেই চালান হত সব সারারাতি। একটা গাছ চালান দিলে তাে সে জায়গায় আরেকটা ফিরতি চালান পাঠাও। বাগান তাে আর খালি থাকতে পারে না।

গল্পে গল্পে ভাত কখন ভুগ-ভুগ করে ফুটে আপনা আপনি থেমে গেছে। গির্জার ঘাটে জলভাঙা কিন্তু থামেনি। তার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এখন অনেক স্পষ্ট। দোতলার ঘরে ঘরে সিধু পালের ছেলেরা ফিরেছে। এখন তারা যে যার আলাদা করে উপহারের প্যাকেট খুলবে। মেয়েকে দেবে। ছেলেকে দেবে। ঘুম থেকে তুলে। কেক, লবেথুস। তালমিছরি। তার মানে যে ছেলে যেমন পেরেছে এজমালি গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার থেকে মাল সরিয়েছে—দোকানের গােড়া কেটে আগায় জল দিচ্ছে।

গাছ চালাচালির কথায় ফকির ব্যাপারীর মুখ ছুঁচলাে—চোখ ছােটো হয়ে এসেছে। সে ভাবছিল, গঙ্গার আকাশে গাছগুলাে হুগলীঘাট, ব্যান্ডেল স্টেশনের লােকাল ট্রেনের মতাে যাতায়াত করছে। একটা পাতা কিংবা ফলও খসে পড়ছে না নীচের জলে! শেকড় বাকল সমেত আস্ত আস্ত গাছ চালান হয়ে যাচ্ছে। এ বাগান থেকে ও-বাগানে। কেননা, একটা চালান দিলে বদলি আরেকটা ফিরতি চালান তাে পাঠাতে হবে। পুরােটা ভাবতে গিয়ে ফকির ব্যাপারীর মাথা ঘুরে যায়। কী আশ্চর্য কাণ্ড! তার ঘিলু টিপটিপ করে।

যা চেয়েছিল সিধু পাল—তাই ঘটতে চলেছে। চুলাের আগুনের লাফালাফি আলাের বাইরেই অন্ধকার বাগান—একটু দূরে ভদ্দরলােকদের সব বাড়ি—সেসব বাড়িতে মানুষজনের কলকল, গির্জার ডগায় লাল আলাের ডুম, নদীর ওপারে সারি সারি ঘরবসতির আলাের চাঁদমালা—আর মাথার ওপর চঁাদের টিপ পরানাে একখানি ফরসা মতাে আকাশ। এর মধ্যিখানে লম্ফ জ্বলা হিমসাগরতলা। সেখানে সারাদিন খাটাখাটুনির পর ফকির ব্যাপারীর জন ছয় ভাড়া করা লােকের ঢুলু ঢুলু চোখ।

সিধু পাল চাইছিল, ওরা আরও বেশি করে ঢুলে পড়ুক। তখনই তার আসল কথা পাড়বে। এবারের মতাে এসাে। আরবার দেখা যাবে। গাছ তিনটে তাে তােমারই ফকির। কিন্তু এখনই কেন?

তার আগে আরও ঘুমপাড়ানি অথচ আরও সম্ভ্রম জাগানাে ঘটনাগুলাের সব ঘনঘটা করে আসা দরকার। সিধু পাল তাই চুলাের পাশেই বসে পড়ল।

একথা আমি প্রথম শুনি আমার পিতা ঈশ্বর মতি পালের মুখে। তিনি শােনেন—তার পিতা ঈশ্বর হারু পালের বয়ানে—

হারু পাল একদিন হাল দিচ্ছিলেন। পাওয়া জমিতে তিনি নিজেও পরিশ্রম করতেন খুব। তাতেই আসলে জমিজায়গা সযুত হয়ে আমবাগানের যােগ্য হয়ে ওঠে একথা এদিককার কে না জানে! | দম নিয়ে সিধু পাল সবার মুখে তাকাল। হা—যেমনটি চাওয়া তেমনটি হয়ে উঠছে মুখগুলাে, ছুঁচলাে। গােলালাে। সম্ভ্রমে একাগ্র—একমুখাে। আর চোখগুলাে ঢুলু ঢুলু।

তা হাল দিতে দিতে খিদে পেয়েছে। দিনের বেলা। মুখ তুলে হারু পাল দেখেন—একটি ল্যাংড়া গাছ চুঁচড়াে-মানকুণ্ডুর দিকে উড়ে যাচ্ছে।

ফকির ব্যাপারী সামান্য অবিশ্বাসের গলায় জানতে চাইল, দিনের বেলাতেই চালাচালি ?

তবে না তাে কী? এ কি হারু পালের চালান !! তবে? শােনােই না সবটা। হারু পাল তাে এক ডাকে উড়ন্ত গাছটি নামাল। ল্যাংড়ায় গাছের পাতা দেখা যায় না। নামানাে গাছ থেকে অপূর্ব সুন্দরী চার পরী নেমে এলেন মাঠের মাঝখানে। রূপে তারা ফেটে পড়ছেন। গনগনে দুপুরে।

এক পরী এগিয়ে এসে বলল, আমাদের নামানাে হল কেন? হারু পাল গলায় গামছা দিয়ে জোড়হাত করে বললেন, অপরাধ নেবেন মা লক্ষ্মীরা। খিদে পেয়েছে—-আমরা তাই চার গণ্ডা আম নিচ্ছি। তারপর আপনারা যেমন উড়ে যাচ্ছিলেন তেমনি উড়ে যাবেন—

আম ক-টা ছিড়ে নেবার পর একটি মুখে দিয়ে তার সােয়াদে মুখ ভরে গেল হারু পালের। তিনি জানতে চাইলেন, কোথেকে আসা হচ্ছে? এ আম কোন বাগানের মা?

পরীদের একজন মিষ্টি মিহিন গলায় বলল, অশােকবন। লঙ্কার— কোথায় যাবে?

অযােধ্যায়। সীতার কাছে। তারই পছন্দের গাছ ছিল কিনা লঙ্কায়। রাবণের বাগানে থাকতে লঙ্কায় এই ল্যাংড়াই মনে ধরে সীতার।

পরী বলে কথা। তাই দিনে দিনেই চালান। হারু পাল বুঝদার মানুষ ছিলেন। জানতে চাইলেন, রাম সীতা তাে সে অনেক আগের যুগের ব্যাপার মা লক্ষ্মী?—এ পর্যন্ত বলে সিধু পাল দেখল, ফকির ব্যাপারীর দুই চোখ ঢুলুঢুলু না হয়ে বরং ঢেলা ঢেলা হয়ে বেরিয়ে পড়ার জোগাড়।

ফকির ব্যাপারী বলল, আপনার ঠাকুর্দা তাে খুব স্যায়না মানুষ ছেলেন। ঠিক খেয়াল হয়েছে। সীতার পছন্দ ল্যাংড়া তাে তাহলে সত্যযুগের ল্যাংড়া হবে

শােনােই না বাকিটা। ঠাকুর্দার কথায় সেই সুন্দরী পরী একটুও ঘাবড়ালেন।

 বললেন—আমরা পাঁচ হাজার বছর লেট হয়ে গেছি হারু। নাও এবার গাছ ছাড়াে। দিনে দিনেই এতটা পথ যাব।

ফকির জানতে চাইল, তখন?

তখন আর কী! পরীর আদেশ। সীতার জন্যে চালান দিয়ে নিয়ে যাওয়া উড়ন্ত ল্যাংড়া গাছ কে আটকায়? কার সাধ্যি? শনশন করে গাছ উড়ে গেল মধ্যি আকাশে। তারপর বাঁই বাঁই। চোখের নিমেষে সব উধাও। সেই ল্যাংড়ার আঁটি থেকে চারা করে আমার ঠাকুর্দা কলম ধরান—কলম বসান—তবেই না এত গাছ ফকির।

 পরী, সীতা, উড়ন্ত ল্যাংড়া, সত্যযুগ, পাঁচ হাজার বছর আগের অশােক বন—সব মিলিয়ে ফকির ব্যাপারী তখন গল্পের রঙিন জালে জড়িয়ে গেছে। ঠিক এই সময়েই ঠিক যখন যুক্তি জাল খাড়া করতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে ফকির—তখনই সিধু পাল তার মােক্ষম কোপটি ঝােপ বুঝে মারবে ঠিক করেছিল।

কেননা, এমন নানা ছবিতে বিছানাে রঙিন জালে ফকির ব্যাপারী ঠিক এই সময়টাতেই একেবারে কুপােকাত হবে—এ তাে সিধু পালের জানা। পাঁচ হাজার বছর পিছিয়ে থাকা পরীদের জন্যে এখন কোতথেকে আসবেন সীতা? কোথায়ই বা থাকবে সেই অযােধ্যা?-—এসব প্রশ্ন ফকির ব্যাপারী কিছুতেই সাজিয়ে তুলতে পারবে না।

আর ঠিক এই সময়েই সিধু পাল বলে বসত—এবারের মতাে ঘুরে এস ফকির। গাছ তাে রইলই। না হয় আরবারে এসেই করাত ধরাবে—

কিন্তু তার এসব বলার আগেই দোতলার জানলা দিয়ে বড়াে বউমা ডাকল, ভাত বেড়েছি বাবা | টং করে সিধু পালের মনে পড়ল, তাহলে তাে মহিন্দর আজ ভাত ফোটায়নি। এজমালি সংসার থেকে বড়াে বউমা খাবার ব্যবস্থা করেছে। এক্ষুনি ছুটে যেতে হয়। নইলে বাড়া ভাত সুষ্ঠু বগি থালাখানা দালানে কোনাে বউমার পেয়ারের বেড়ালের ভােগে চলে যাবে। বড়াে বউমা তাে ভাত বেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার লােক নয়।

ছুট। ছুট। আজ নিশ্চয় ভালােমন্দ রান্না হয়েছে দোতলায়। বড়াে ছেলের ঘরে।

খেয়েদেয়ে আর বেরােনাে হল না সিধু পালের। ঘরেও ওঠা হল না। ফল পাকুড়ের ভেতর বেড়ে ওঠা—গড়ে ওঠা শরীরখানা একতলার বারান্দাতেই ছেড়ে দিল সিধু পাল। লাউডগা দিয়ে হরিণে চিংড়ির ঝােল। গাটি কচুর ডালনা। ঝাল ঝাল। আর মুগডাল। খেয়ে তৃপ্তিতে তার সারা শরীর অবশ হয়ে এল। চোখ ঢুলে পড়ল। ভাতের পাতেই আঁচিয়ে এক ফেরাের সবটা জল খেয়ে সে গা ছেড়ে দিল বারান্দায়।

অনেক পরে-নিশুতি রাতে সিধু পাল টের পেল—কে যেন তাকে ডাকছে। কিন্তু নাম ধরে।

ঘুম চোখে তাতেই কিছু খটকা লাগল। সিধু। ও সিধু।

যাই—বলে ঠেলে উঠল সিধু পাল। ডাকটা সদর দরজার বাইরে। উঠে বসেই সে বলল, কে?

আরে আমরা। আমরা ছাড়া কে ডাকবে তােমায় এমন সিধু সদর দরজা খুলে বাইরে এল।

এসেছ? এসাে। আমরা তিনজনই তােমার বাপ মতি পালের হাতে বসানাে কলম

একথায় খচ করে মুখ তুলে তাকাল সিধু।

গাছ তিনটে রাত ফাটানাে জ্যোৎস্নায় একটু একটু দুলছে। আর কদিন পরেই দোল পূর্ণিমা।

এসাে। এখানে এসাে সিধু। আমরা তিনজনই তােমার চেয়ে বয়সে বড়াে সিধু সিধু পাল বেশ ভয়ে ভয়েই সেই তিন হিমসাগরের তলায় এসে দাঁড়াল।

তােমার জন্মের তিন বছর আগে মতি পাল আমাদের বসায়। নইলে তােমায় নাম ধরে ডাকতে পারি সিধু! আমরা তােমার বড়াে ভাই সিধু

পরিষ্কার লতাপাতা জড়ানাে গলা। সিধুর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার জোগাড়। সে বুঝতে চাইল—সে জেগে আছে? —না, স্বপ্ন দেখছে?

না। সে জেগে আছে। ঘুমােচ্ছে ফকির ব্যাপারী আর তার ভাড়া করা লােকগুলাে। এলােমেলাে হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘুমােচ্ছে। চুলাে নেভানাে। লম্ফটা জ্বলে জ্বলে নিভে গেছে। উঠোনে বাঁধা বাঁজা গাইটার কানের লটর পটর আওয়াজ। কিন্তু গঙ্গায় জলের সে শব্দ এখন অনেক কম। শেষ রাতেই তাে ঊটার শুরু। সামনে চাপ ধরা অন্ধকারে সারি সারি গাছের আমবাগান।

সিধু পাল বুঝল, কাল ভােরে উঠেই ফকির ব্যাপারী করাত ধরাবে। তাকে কেউ আর আটকাতে পারবে না তখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *