সিগারেট
যাদব ঠিক করিল সে আজ একটা সিগারেট খাইবে। বিবাহের আগে মাঝে-মাঝে দু-একটা সিগারেট সে খাইত বটে, কিন্তু তারপর এতগুলি বছর আর চুঁইয়াও দেখে নাই, আজ ঠিক করিয়া ফেলিল, যত দামই হোক, সিগারেট আজ একটা সে খাইবেই।
বড়ো রাস্তার রেলওয়ে ক্রসিং-এর গেটের সঙ্গে লাগোয়া যে ছোটো দোকানটা বসে, সেখানে সবরকম সিগারেটই থাকে। যাদব ধীরে ধীরে সেদিকেই চলিল। গিয়া দেখিল, দোকানের মালিক গোকুল সেখানে নাই, হয়তো খাইতে গিয়াছে, একট ছোঁড়া বসিয়া আছে সেখানে। পান সাজানোর চকচকে থালাটার উপর দুটি পয়সা ঝনাৎ করিয়া ফেলিয়া যাদব বলিল, একটা গিসারেট দে তো?
যুদ্ধের ফলে সব সিগারেটের দামই চড়ে গিয়েছে, ছোঁড়াটা বলিল।
তা হোক, যাদব তবু একটা সিগারেট কিনিয়া ফেলিল, অত্যন্ত সাবধানে সেটা দুই ঠোঁটের মাঝখানে চাপিয়া সে তা ধীরে ধীরে ধরাইয়া জোরে একটা টান দিল, তারপর কিছুদূর হাঁটিয়া দেখিল, রেলওয়ে ক্রসিং-এর ওইদিকে লাইনের পাশেই শীতের রৌদ্রের নীচে খোলা জায়গাটিতে গোল হইয়া বসিয়া মাধু সর্দার, ইয়াসিন, শঙ্কর আর সুকুমার গল্প করিতেছে, তাহাদের আজ দুপুর বেলা কারুরই ডিউটি নাই।
সিগারেট-মুখে যাদবকে দেখিয়া তাহারা সকলেই একসঙ্গে হৈ হৈ করিয়া চেঁচাইয়া উঠিল।
ইয়াসিন বলিল, আরে মস্ত বাবু হয়ে গেলে যে যাদববাবু! শঙ্কর বলিল এসব কী? বুড়ো-বয়সে আবার ফুর্তি জাগল কেন?-বুড়া যদিও যাদব এখনও হয় নাই, তবু তাহাকে এমন একটি কথা শঙ্কর না বলিয়া পারিল না।
সুকুমার রেলওয়ে ইউনিয়নের সেক্রেটারি। সে বলিল, তাই তো বলি যাদববাবু কোথায় গেল? ইউনিয়ন অফিসে একেবারেই পাত্তা নেই কেন? আপনার ওপর কী ভার দেওয়া হয়েছিল, মনে আছে তো?
একসঙ্গে কতকগুলি ধোঁয়া নিয়া যাদব হাসিয়া উঠিল। তাহার হাসির সঙ্গে সঙ্গে রুদ্ধ ধোঁয়াগুলি কুন্ডলী পাকাইয়া বারে বারে তীব্র বেগে বাহির হইয়া আসিতে লাগিল।
আর সকলেই বিড়ি খাইতেছে।
তাহার সিগারেটের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া তারপর সুকুমার বলিল, এই সিগারেট দেখে আমার তিরিশ সালের কথা মনে পড়ছে। সে আরম্ভ করিল, তখন গান্ধী বিলিতি-বর্জনের আন্দোলন আরম্ভ করেছেন। আর কি, সে সময় তো এদেশের ধনীদের পোয়াবারো। তাদের ব্যাবসা দিন দিন কেঁপে উঠল, তার লভ্যাংশ দিয়ে তারা নতুন ব্যাবসা খুলল। এদিকে দিশি কতরকম বিড়ি যে বেরিয়ে গেল তার হিসেব নেই। যারা কোনদিন সিগারেট ছাড়া খান না, তারাও বিড়ি খেতে আরম্ভ করলেন, তখন কাউকে সিগারেট খেতে দেখলে, তার ওপর এমন ঘেন্না হত যে তা বলবার নয়, ইচ্ছে হত, বিলিতি-বর্জনের মতো তাকেও বয়কট করি, বা জ্বালাময়ী ভাষায় খুব কয়েকটি কথা শুনিয়ে দিই!—সুকুমার হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল, প্রাণ ভরিয়া কিছুটা হাসিয়া নিয়া আবার সে বলিল, তখন আমি একটা লোককে জানতাম যার স্বভাবই ছিল, সকলে যা করত তার ঠিক উল্টো করা। সকলে যদি ঠিক করল, হরতাল করবে, সে অমনি বাজার করে আসত। সবাই ঠিক করল, এবার বিলিতি আর পরবে না, অমনি দেখা গেল খাঁটি বিলিতি কাপড়ের জামা পরে দিব্যি সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তেমনি সবাই যদি ঠিক করল সিগারেট আর খাবে না, চেয়ে দ্যাখো সে দারুণ সিগারেট খেয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এবার আর কিছুতেই রেহাই পাবার জো-টি নেই। তাকে সিগারেট খেতে দেখে সবাই তাকে বয়কট করলে, এমনকি, কথা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হল, সত্যি এমন শাস্তি আর দেখিনি! সুকুমার হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল, প্রাণ ভরিয়া হাসিতে লাগিল।
অদূরে গেটম্যান গেট বন্ধ করিয়া দিয়াছে।
এখনই গাড়ি আসিবে বোধ হয়। ইষ্টিশনে প্ল্যাটফর্মে কুলিদের অল্পবিস্তর ব্যস্ততাও চোখে পড়ে। দূরে যাদবদের যে সারি সারি কোয়ার্টার দেখা যায়, একটি। দীর্ঘ খেজুর গাছের নীচে তাহাদের নিতান্তই নিরীহ বলিয়া মনে হয়।
হাসি থামিলে সুকুমার আবার বলিল,
-আবার এমনি আর একটা লোককেও দেখেছিলাম, যাকে একদিন দেখি ছোটো ছোটো ছেলেপিলেরাও ঢিল ছুঁড়ে মারেছে!
—ঢিল ছুঁড়ে মারছে!
–হ্যাঁ!—সুকুমার আবার তেমনি হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল।
এমন সময় এক কান্ড ঘটিল।
শঙ্কর হঠাৎ চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল,
—যাদবদা, সিগারেটটা ফেলে দাও, ফেলে দাও বলছি! সকলে বিস্ময়-ভরা দৃষ্টিতে যাদবের দিকে তাকাইল।
শঙ্কর আবার বলিল, ওটা আর খেয়ো না, খেয়ো না, ফেলে দাও বলছি! শঙ্করের চোখে মুখে আতঙ্ক, স্বর উত্তেজিত।
যাদব হতভম্বের মতো সিগারেটটা নীচে নামাইয়া বলিল, কেন?
শঙ্কর বলিল, দেখছো না, ওটা কেমন হয়ে গেছে, কী যেন বেয়ে পড়ছে।
সকলে দারুণ আতঙ্কে জ্বলন্ত সিগারেটটার দিকে চাহিয়া দেখিল : হ্যাঁ ঠিকই কেমন একটা বিশ্রী কালো পদার্থ সিগারেটটার বাকি অংশটুকুর গা বাহিয়া পড়িয়াছে। যাদবও দেখিল, হাতের আঙুলগুলি তাহার ভয়ে আর উত্তেজনায় কাঁপিতেছে।
শঙ্কর বলিল, ওটা বিষ।
–বিষ!
-হ্যাঁ, বিষ। মুখে গেলে আর বাঁচতে হবে না।
আমি এক সাহেবকে দেখেছি তারও এমনি হয়েছিল, কী যেন পড়ছিল সিগারেটের গা বেয়ে, সে অমনি ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। যাদবদা, ওটা খেয়ে না, ফেলে দাও বলছি— ছুড়ে ফেলে দাও!
যাদব আর দ্বিরুক্তি করিল না। সিগারেটটা দূরে ছুঁড়িয়া মারিল। হাতটা তাহার এখনও কাঁপিতেছে।
কিন্তু সিগারেটটা?
অর্ধেক খাওয়া হয় নাই যে! যাদবের মনটা খারাপ হইয়া গেল, সে চুপ করিয়া রহিল।
লাইনের কিছু দূরে দীর্ঘ ঘাসে-ভরা মাটিতে সিগারেটটা জ্বলিতেছে, আর সেই দীর্ঘ ঘাসের-ভিতর হইতে একটা সাদা মসৃণ ধোয়ার রেখা পাকাইয়া-পাকাইয়া উপরের দিকে উঠিতেছে। মনে হয়, লকলকে ঘাসের ওই তীক্ষ্ণ ডগাগুলিও সিগারেটের ধোঁয়ার বিষে জর্জরিত; তাই কম্পমান।