সিংহ

সিংহ

ঘাড়ের কাছে সুড়সুড় ভাবটা কার্তিক তরফদার প্রথম অনুভব করেন অফিসে। হালকা সুড়সুড়ানি মতো ভাব। পিঁপড়ে গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে যেমন হয়, অনেকটা সেরকম। লাল পিঁপড়ে নয়, কালো সুড়সুড়ি পিঁপড়ে। ঘাড়ে যেখানে চুল শেষ হয়েছে, পিঁপড়েটা সেখান দিয়ে হেঁটে গেল।

হাত দিতে গিয়েও নিজেকে সামলেছিলেন কার্তিকবাবু। অফিসের বড়বাবুর ধমকানির সময় ঘাড় চুলকোনো যায় না। আর যখন ধমকানি ‘গাধা-গোরু টাইপ’ হয়, তখন তো আরও যায় না। ‘গাধা-গোরু টাইপ’ বকুনি হল সেই ধরনের বকুনি যা মানুষকে দেওয়া ঠিক নয়, গাধা-গরুকে দিতে হয়। ওরা মানুষের ভাষা বোঝে না বলে মান অপমানের ব্যাপার নেই।

ঘটনা সোমবারের। টিফিনের মিনিট কুড়ি পর। নবা এসে কিছু বলল না, শুধু বড়বাবুর ঘরের দিকে চোখের ইঙ্গিত করে ঘাড় নাড়ল। নবা অফিসের পিওন। সে তেইশ বছর এখানে কাজ করছে। নিজেকে একজন হর্তাকর্তা বলে মনে করে। তার ইঙ্গিতের অর্থ ‘বড়বাবুর ঘরে ডাক পড়েছে। যাও, গিয়ে ঝাড় খাও।’ ইঙ্গিতের সময় নবার ঠোঁটের ফাঁকে ছিল হাসির ঝলক। থাকাটাই স্বাভাবিক। অফিসে সকলেই জানে, বড়বাবুর ঘরে ‘কার্তিক কলিং’ মানে বড় ধরনের হেনস্থার ব্যাপার আছে। ‘কার্তিক কলিং’ একটা হিন্দি সিনেমার নাম। বড়বাবুর ঘরে কার্তিকবাবুর ডাক পড়লে অফিসে ‘কার্তিক কলিং’ বলে মশকরা করে। এর মানে আজ একটা মজা হবে। অফিসে কার্তিক তরফদার একটা ‘মজার জিনিস’। তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশায় কোনো সমস্যা নেই। তিনি কিছু মনে করেন না। মানুষ বিভিন্ন ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। কার্তিকবাবু ঠাট্টা তামাশায় কিছু মনে না করবার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন।

কিছুই মশকরার উদাহরণ দেওয়া যাক।

‘কী কার্তিকবাবু, চুলে কলপ শুরু করলেন কবে থেকে?’

‘কার্তিকদা, গোঁফটা বাদ দেবেন না। পারলে ইয়েতেও…।’

ঘরের সবাই ‘হো হো’ আওয়াজে হেসে ওঠে।

‘তরফদারবাবু শুনলাম, আজকাল মেয়েদের কলেজের সামনে দিয়ে শর্টকাট করছেন। ঘটনা সত্যি? লজ্জার কিছু নেই। কথায় আছে, নিভে যাওয়ার আগে জ্বলিবে দাউ দাউ আগুন।’

‘সেকি! কার্তিকবাবু, এখনও নেভেননি! আপনি তো পুরো তুষের আগুন। ধিকিধিকি নিয়ে ঘুরে বেড়ান।’

‘কী ভায়া কার্তিক, আজ এমন মুখ শুকনো কেন? বাড়িতে বউয়ের হাতে ঝাড় হল নাকি?’

‘ঝাড় কী গো? বৌদি মাঝেমধ্যে উত্তমমধ্যমও দেয়। খবর আছে। খবর হ্যাজ।’

‘কান ধরে ওঠবোস করায় না তো?’

‘কার্তিকদা, আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরব। তোমার বৌমার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাব। কটা ফাইল রেখে যাচ্ছি টাইপ করে রাখবেন। মন দিয়ে করবেন। ক্লাস সেভেনের ছেলেদের মতো সিলি মিসটেক করে বসবেন না।’

আরও আছে। সেটা ঠাট্টা নয়, হুমকির ঘটনা। সেদিনই হল। অ্যাকাউন্টসের অলক বিশ্বাস বারান্দায় চা অমলেট খাওয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে গেল। এটা একটা পুরোনো কায়দা। সত্তর-বাহাত্তরে চলত। চা অমলেট খাওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া, তারপর পেটে ছুরি বা পাইপ গানের গুলি। বডি ফুটপাথে পড়ে থাকত। পাবলিক ডিঙিয়ে চলে যেত।

অলক বিশ্বাস বলল, ‘কার্তিকদা, সেদিন রায় অ্যাসোসিয়েটসের একজন আপনার সঙ্গে দেখা করেছিল?’

কার্তিক তরফদার মাথা চুলকে বললেন, ‘হ্যাঁ, একটা লোক এসেছিল বটে। টাক মাথা।’

অলক চোখ সরু করে হিসহিসিয়ে বলল, ‘টাক মাথা না চুল মাথা জানতে চাই না। লোকটা আপনাকে একটা খাম দিতে চেয়েছিল?’

কার্তিক তরফদার ঘাড় কাত করে বললেন, ‘তাও বটে। চেয়েছিল।’

অলক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আপনি খামটা ফেরত দিয়েছেন?’

কার্তিক তরফদার ঢোঁক গিলে বলল, কী করব? বলল, নিন, সবাই একটু চা টা খাবেন। কাজটা করে দিয়েছেন। আমি বললাম, আপনার কাজ তো এমনিই হবে। চা টা খাওয়ার পয়সা লাগবে না। এটা প্রাইভেট ফার্ম।

অলক চাপা গলায় বলল, ‘কেন এটা করলেন? ওটা তো আপনার একার খাম নয়, সবার খাম। সবার শেয়ার ছিল। ওইটুকু আমাদের এক্সট্রা কামাই। তুমি শালা আটকাবার কে? তোমাকে আগে কতবার বারণ করেছি। সততা মাড়ানোর অভ্যেস বুড়ো বয়েসেও গেল না? তুমি সাধু আর আমরা চোর? লোকটা ভুল করে তোমার কাছে চলে গেছে। তুমি আমাকে ডাকতে পারতে, মালব্যকে ডাকতে পারতে। তুমি রিফিউজ করলে। দেখো শালা, এবার তোমাকে কেমন হুড়কো দিই। বুড়ো বয়েসে প্যান্ট খুলে দৌড় করাব।’

থ্রেট খাওয়া কার্তিকবাবু সেদিন ভয়ই পেয়েছিল।

কার্তিকবাবু কাগজপত্র সরিয়ে উঠে পড়লেন। বড়বাবুর ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। অফিস-টফিসে এখন আর ‘বড়বাবু’ চলে না। শুনতে খাটো লাগে। এখন চলে ‘বস’। ঘটনা হরে দরে একই, কিন্তু ‘বস’ ডাকে কায়দা আছে। তবে এই অফিসে এখনও ‘বড়বাবু’ রেওয়াজ। পুরোনোদিনের ফার্ম। কোম্পানির হিসেবপত্র তৈরি হয়। ইনকাম ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স, এখন আবার জিএসটি ঢুকেছে। ডালহৌসি পাড়ায় ঘর। বড় নয়, আবার একেবারে ছোটও নয়। ক্লায়েন্টরা বংশপরম্পরায় রয়ে গেছে। এখনও লম্বা কালো সেগুন কাঠের চেয়ার টেবিলে কাজ হয়। কম্পিউটার এসেছে, তবে টাইপরাইটার বাতিল হয়নি। কার্তিক তরফদার নিজেই তো একটা গাবদা টাইপরাইটারে কাজ করেন। খটাস খটাস করে আওয়াজ হয়। বড়বাবুর ঘরে আদ্যিকালের সেলুনের মতো সুইং দরজা। কোমর থেকে কপাল পর্যন্ত। ভিতরে বড় কাঠের দরজা আছে বটে, তবে সেই দরজা লাগানো হয় কদাচিৎ। খুব গোপন কোনো মিটিঙের সময়। সে আর কটাই বা হয়।

‘স্যার, আমাকে ডেকেছেন?’

পুরো বাক্যটা বলার আগেই ঢেঁকুর উঠল। ঢেঁড়শের ঢেঁকুর। টিফিনে রুটি আর ঢেঁড়শ ভাজা খেয়েছেন। সঙ্গে দু-টুকরো শশা। তাও হজম হয় না। রক্তে হালকা সুগার, সামান্য কোলেস্টেরল ধরা পড়ায় মিনতিদেবী শক্ত হাতে লাগাম ধরেছেন। স্বামীর খাওয়া দাওয়ায় হেভি টাইট দিয়েছেন। আগেও কন্ট্রোল ছিল। তবে এতটা ভয়ংকর নয়। কার্তিকবাবু নিজেও সাবধানী। নেমন্তন্ন বাড়িতে দশ-বারো বছর যান না। খাওয়ায় যেটুকু আয়েস ছিল, সে ছিল বাড়িতেই। এখন তাও বাদ পড়েছে। স্ত্রী ও ছেলের জন্য একরকম রান্না, তাঁর জন্য আলাদা। গাঁইগুঁই করলে ধমক জোটে।

‘বয়স, তো কম হল না। সাতান্ন বছরেও এত নোলা কীসের তোমার?’

কার্তিকবাবু মিনমিনে গলায় বলেন, ‘এর মধ্যে নোলা কী দেখলে মিনু? এতো একবারে ঘাসপাতা খাচ্ছি মনে হচ্ছে।’

মিনতিদেবী ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, ‘তোমার তাই খাওয়া উচিত। জীবনটাই তো ঘাসপাতা বানিয়ে ফেলেছ। টেস্ট লেস। আমার জীবনটাও তাই করে দিয়েছ।’

কার্তিকবাবু ঢোঁক গিলে বলেন, ‘আমি কী করলাম!’

মিনতিদেবী চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘কী করোনি? এই বুড়ো বয়েসেও নিজের সঞ্চয়ের দিকে একবার তাকিয়েছ? ক্লার্ক হয়েই চাকরি শেষ করলে, রিটায়ারমেন্টের পর হাতে কটা টাকা থাকবে? কোন পয়সায় কোপ্তা কালিয়া খাবে? ঘাস পাতা খেয়েই থাকতে হবে। এখন থেকে হ্যাভিট কর।’

দুটো কথার উত্তরে মিনতির কাছ থেকে দশটা ঝাঁঝের কথা শোনবার অভ্যেস কার্তিকবাবুর দীর্ঘদিনের। বিয়ের প্রথম পাঁচটা বছর ছিল অন্যরকম। সেসব দিন ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট বাংলার সিনেমার রোমান্টিক সিনের মতো বিদায় নিয়েছে। এখন শুধু ওয়েব সিরিজের ভায়োলেন্স। তাও এক তরফা। মিনতিদেবী বললেন, ‘করো তো কেরানির কাজ, তার মধ্যে গাদাখানেক অসুখ বাধিয়েছ।’

কার্তিকবাবু নিচু গলায় বলেন, ‘কেরানি বলে অসুখ হবে না এমন তো কথা নেই। তাছাড়া অফিসারদেরও অসুখ হয়। এই তো আমাদের বিশ্বনাথ ঘোষ, বিশুবাবু, প্রেসার নিয়ে নাজেহাল। উনি তো চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট।’

মিনতিদেবী আঙুল তুলে বললেন, ‘চুপ কর। একদম তক্ক করবে না। বাবা যে কোন আক্কেলে এরকম একটা বোকার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। গোটা জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল। যাক মন দিয়ে শোনো, ছেলে বিয়ে করতে চাইছে। দোতলায় ঘর তুলবে। ঘরের সঙ্গে বাথরুম পায়খানা। টাকা দেবে।’

কার্তিকবাবু বললেন, ‘টাকা! ঘর বানানোর টাকা কোথা থেকে দেব? এই তো ক’বছর আগে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিয়ে তোমার বোনের মেয়ের বিয়ে দিলাম। সে টাকা তো আজও ফেরত পাইনি।’

মিনতিদেবী মুখ বেঁকিয়ে বলেন, ‘জন্মের কম্ম একবারই তো শ্বশুরবাড়ির জন্য কিছু করেছ, এতবার শোনানোর কী হয়েছে? ও টাকা আমি দিদিকে ফেরত দিতে বারণ করেছি। তুমি মনার দোতলার ঘর দেখ। তার বউ এসে তো এই হতচ্ছেদা একতলায় থাকতে পারবে না।’

কার্তিকবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন? থাকতে পারবে না কেন? তার ঠাকুর্দার বউ থেকেছে, তার বাবার বউ থেকেছে, তার বউ পারবে না কেন?’

মিনতিদেবী বললেন, ‘তোমার মতো বেকুবের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলাই ঝকমারি। হায়রে, বাবা যে হাত পা বেঁধে একটা গাধার মুখে ফেলে দেবে আমি কল্পনাও করতে পারনি।’

শুধু স্ত্রী নয়, পুত্রও তার মায়ের সঙ্গে একমত। তবে সে তো এই ‘দুর্ভাগ্য’ এর জন্য মায়ের মতো কাউকে দায়ী করতে পারে না। মনে মনে বললেও, বাবাকে মুখে ‘গাধা’ বলতে পারে না। তবে হুমকি হামকা দিতে পারে। বাবাকে সে বলেছে, ‘জেনে রাখ কার্তিক তরফদার, ছ’মাসের মধ্যে ছাদের ওপর ঘর আমার চাই। আই ওয়ান্ট এন্ড ওয়ান্ট। শুধু ঘর নয়, উইথ ইংিলশ বাথরুম। না হলে কী করতে হয় আমি কার্তিক তরফদারকে দেখিয়ে দিতে জানি। আই ওয়ান্ট, যেখান থেকে পারও ধার দেনা করে কার্তিক তরফদার ঘর তোলা শুরু করুক।

কার্তিকবাবু চিন্তায় আছেন। ভয়েও আছেন। সব সময়েই থাকেন। কে কখন ধমক দেবে, হুমকি দেবে তার ভয়। এই অবস্থায় বড়বাবুর ডাক।

বড়বাবু পুরোনো আমলের গ্যলিস দেওয়া প্যান্ট পরেন। রেগে গেলে বুকের কাছে দুটো হাত দিয়ে সেই গ্যালিস টানাটানি করেন।

‘তরফদার, এই টাইপ আপনার?’

টেবিলে ফেলে রাখা কাগজ দেখে কার্তিকবাবু বললেন, ‘কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ইয়েস স্যার।’

বড়বাবু চোখ সরু করে বললেন, ‘এত ভুল কেন?’

‘সরি স্যার।’

বড়বাবু নিচু গলায় বললেন, তরফদার, আপনি কি গাধা?’

কার্তিকবাবু চুপ করে মাথা নামিয়ে রইলেন। বড়বাবু দাঁতে দাঁত ঘষে চিৎকার করে বললেন, ‘আমার মনে হয় আপনি আসলে একজন গাধা। গাধা না হলে এক পাতার টাইপে এতো ভুল অসম্ভব।’

ঠিক এই সময়ে ঘাড়ের কাছে সুড়সুড়ানি ভাবটা আসে। যেন, পিঁপড়ে হেঁটে গেল। পিঁপড়ে এল কোথা থেকে?

বড়বাবু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘আজ আপনার পানিশমেন্ট কী জানেন? পানিশমেন্ট হল, কুড়ি পাতা টাইপ করে ছুটি পাবেন। রাত দশটা বাজলে বাজবে, এগারোটা বাজলে বাজবে, বারোটা বাজলে বাজবে। দারোয়ানকে বলে যাব। নিন এই পাতা কারেক্ট করে আনুন।’

কাগজ হাতে নিয়ে বড়বাবুর ঘর থেকে বেরবার সময় কার্তিকবাবু বুঝতে পারলেন, এই টাইপ তার করা নয়। অন্য কেউ ভুল করা পাতা তার ফাইলে ঢুকিয়ে বড়বাবুর ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। কে করেছে? যেই করুক বলার কিছু নেই। ছুটির পর অলক বিশ্বাস টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখ নাচিয়ে বলল, ‘কী সৎবাবু? কেমন লাগছে? রাতে মশা কামড়ালে মশারি টাঙিয়ে টাইপরাইটারটা মশারির ভিতর নিয়ে নেবেন। মোবাইলে একটা সেলফি তুলে রাখবেন।’

রাতে থাকতে হয়নি। সাতটার সময় বড়বাবু এসে বললেন, ‘আজ বাড়ি যান। কাল আবার ছুটির পর দু’ঘণ্টা করবেন। যতদিন না শেষ হয় রোজ চলবে।’

বাড়ি ফিরছিলেন কার্তিকবাবু। বাসে উঠেছিলেন। হেদুয়া মোড়ের কাছে এক থলথলে ভুড়ির মোটা লোক দিল বাঁ পাটা মাড়িয়ে। কঁকিয়ে উঠলেন কার্তিকবাবু। মিনমিন করে বললেন, ‘একটু দেখে পা ফেলতে পারেন না? এভাবে মাড়িয়ে দিলেন!

থলথলে ভুড়ি মুখে পান দলাই-মলাই করতে করতে হিন্দিতে বলল, ‘পা টা বাড়িতে রেখে এলেই পারেন, কেউ মাড়াত না। শালা দুনিয়া শুদ্ধ লোক ইয়ে মেরে চলে যাচ্ছে, আর উনি পা মাড়ানো নিয়ে ভাবছেন। যত্তসব ভেতো!’

কথা শেষ করে ভুঁড়ি বাসের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে থক করে খানিকটা পান পরাগের থুতু ফেলল। রাগে গা রি রি করে উঠল কার্তিকবাবুর। তিনি মুখ ঘুরিয়ে রাগ সামলালেন আর তখনই আবার মনে হল, ঘাড়ের ওপর দিয়ে আবার পিঁপড়ে হাঁটছে। ঘাড়ে হাত দিলেন।

না পিঁপড়ে তো নয়। তবে?

তবে কী বুঝতে পারলেন পরদিন সকালে। ঘুম থেকে ওঠবার পর। মুখ ধুতে গিয়ে কেমন একট অস্বস্তি হত লাগল। ঘাড়ে হাত দিলেন। খরখরে ভাব। বাথরুম থেকে বেরিয়ে চা খেতে খেতে বললেন, ‘মিনতি, দেখ তো ঘাড়ে কিছু হয়েছে নাকি?’

মিনতিদেবী মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘কী হবে?’

কার্তিকবাবু বললেন, ‘এই কোনো র‍্যাশট্যাশ। কেমন একটা করছে…।’

মিনতিদেবী তেঁড়েফুড়ে বললেন, ‘আর জ্বালিও না তো বাপু। অসুখের ডিপো একটা। আজ বাদে কাল ছেলের বিয়ে দেব, আর উনি পড়লেন ঘাড়ের র‍্যাশ নিয়ে।’

কার্তিকবাবুও বুঝলেন, অতি সামান্য বিষয় নিয়ে স্ত্রীকে বিরক্ত করা ঠিক নয়। মিনতিদেবী বললেন, ‘মনা বলছে, তুমি যদি ছাদে ঘর তৈরি না করে দাও, গোটা বাড়িটাই প্রোমোটিং-এ দিয়ে দেবে।’

কার্তিকবাবুর কাপ থেকে চা চলকে পড়ল। বললেন, ‘আমরা থাকব কোথায়?’

মিনতিদেবী বললেন, ‘সে তো মনার ভাবনা নয়। তার বাবা কচি খোকা নয়। নিজেরটা বোঝবার মতো বয়স তার হয়েছে।’

কার্তিকবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ‘এই বাড়ি তো আমার।’

মিনতিদেবী চায়ের কাপে আরামের চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ছেলেকে লিখে দিলেই আর তোমার থাকবে না।’

‘আর না লিখে দিলে?’

মিনতিদেবী হেসে ফেলে বললেন, ‘সে মুরোদ তোমার নেই। মনা জানে, আমি জানি। তুমিও জানো। জানো না?’

কার্তিকবাবু ঘাড়ে হাত দিয়ে বুঝলেন, রোঁয়ার মতো কিছু একটা বেরিয়েছে। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়েই বেরিয়েছে। কী হল রে বাবা! কার্তিকবাবু বাজারে বোরোলেন। ব্যাগ হাতে বাড়ির গেট খুলতেই দেখলেন গলির মোড়ের মিসেস বোসের সাধের ল্যাবরাডর প্রাতঃকৃত্য সারছে। বাথরুম হিসেবে সে এ বাড়ির সামনেটাকেই বেচেছে। মিসেস বোস মোবাইল ফোন কানে গল্প করছেন। পোষ্য কার গেটের সামনে ‘কীর্তি’ করছে সেদিকে তাকাবার ফুসরত নেই। কার্তিকবাবু কয়েকবার জোরে কাশলেন। মিসেস বোস খেয়ালই করলেন না। ল্যাবরাডর একবার তাকিয়ে ‘ফেঁৎ’ ধরনের অবজ্ঞার হাঁচি দিল। কার্তিক তরফদারের দিকে তাকিয়ে ‘ঘেউ’ করবার মতো পরিশ্রমেও সে রাজি নয়। ভাবটা হল, তুমি বাপু ঘেউ-এরও অযোগ্য।’

বাজারেও ঠকলেন কার্তিকবাবু। যেমন রোজই কমবেশি ঠকেন। তার ওপর আজ আবার অনমন্যস্ক। ঘাড়ে কী হল? বাড়ি ফেরবার পথে ভবানীর সেলুনে ঢুঁ মারলেন। ভবানী ঘাড় দেখে ভুরু কোঁচকাল।

‘চেয়ারে বসেন ‘

‘কী হল ভবানী?’

‘ঘাড়ে চাঁছা দিয়েছেন নাকি?’

কার্তিকবাবু বললেন, ‘ঘাড়ে চাঁছা! সে আবার কী জিনিস ভবানী? ভবানী গায়ে কালো কাপড় চাপাতে চাপাতে বলল, ‘ক্ষুর বা ব্লেড দিয়ে ঘসাঘসি করেননি তো?’

কার্তিকবাবু বললেন, ‘তুমি কি খেপেছ ভবানী? খামোকা ঘাড়ে ক্ষুর দেব কেন? ঘাড় কি গাল? যে দাড়ি কামাতে হবে।’

ভবানী ক্ষুর বাগিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘তবে এখানে পশমের মতো এসব কী!’ কার্তিকবাবু আঁতকে ওঠেন, ‘অ্যাঁ, পশম! বল কী ভবানী ঘাড়ে পশম এল কোথা থেকে?’

ভবানী ক্ষুরের ছোঁয়া দিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘তা জানি না। তবে জিনিস ভালো ঠেকে না বাবু। মাথার চুলের মতো নয়।’

‘তবে কীসের মতো?’

ভবানী বলে, ‘তা জানি না। অনেকটা জায়গা নিয়েছে। কেমন যেন সোনালি লাগে।’

কার্তিকবাবু প্রায় হাউমাউ করে উঠলেন, ‘আগে কেটে দাও, সব ফেলে দাও। এ আবার কী অসুখ রে বাবা!’

ভবানী চিন্তিত গলায় বলল, ‘বুঝতে পারছি না। তেত্রিশ বছর মানুষের মাথা ঘাড় নিয়ে কারবার। এমন কখনও তো দেখিনি। মানুষের ঘাড়ে সোনালি পশম!’

সেলুন থেকে বেরিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরলেন কার্তিক তফাদার। আপদ গেছে। তবে বিপদ যায়নি। ঠকানির বাজার করবার জন্য এবং দেরি করবার জন্য স্ত্রীর কাছে বকুনি হল। ঘর বানানো নিয়ে বেকার ছেলে খানিকটা হম্বতম্বি করে গেল। মুখ নিচু করেই শুনলেন। একসময়ে অফিসের জন্যে ছুটলেন স্নান করতে। ভালো করে শ্যাম্পু দিয়ে স্নান সারলেন। না, ঘাড়ে কিছু নেই। নো পিঁপড়ের হন্টন, নো খচখচ। ভবানী নাপিত কাজ জানে।

ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে যেতে যেতে দুলুনিতে চোখে পাতায় হয়ে গিয়েছিল কার্তিক তফাদারের। রোজই হয়। মনে হয়, দীর্ঘজীবনের পথে এইটুকুই যা শান্তি। ব্যর্থতা, গ্লানি, ভয় ভুলে নিজের মধ্যে থাকা। এই সময়টায় সহকর্মীদের মশকরা, বড়বাবুর শাস্তি, অলকের শাসানি নেই। বউয়ের ধমক, ছেলের হুমকি থমকে থাকে। মিসেস বোস আর তার পোষা কুকুরের তাচ্ছিল্য চলবে না। এখন শুধু নিজের মধ্যে নিজের থাকার অবকাশ। আধো তন্দ্রা ও জাগরণে নিজেকে মস্ত বড় ভাবার বিলাসিতা। বড় আর শক্তিশালী। থাবা, নখ দাঁত আর কামড়ের শক্তি।

ট্রাম ডালহৌসিতে পৌছোলে সবাই দেখল, বাস থেকে নামছেন ছাপোষা এক অফিসযাত্রী। হাতে রুটি ঢেঁড়শের টিফিন রাখবার ব্যাগ, বগলে লম্বা হাতলের ছাতা। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতো। রোজ যেমন থাকে। শুধু আজ তার ঘাড় থেকে নেমে এসেছে একরাশ সোনালি কেশর। সিংহের কেশর। বাতাসে ফুরফুর করে উড়ছে সেই কেশর।

অফিসের সামনে কার্তিক তরফদার দু’পাশ দেখতে দেখতে রাস্তা পার হচ্ছেন। তার মুখে গরগর আওয়াজ। সবাই সরে দাঁড়াল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *