সিঁদেল চোর (একটি প্রসিদ্ধ মুসলমান চোরের জীবন কাহিনী)
অবতরণিকা
চুরি, জুয়াচুরি, জাল, হত্যা প্রভৃতির অনেক ঘটনা পাঠকগণকে এ যাবৎ উপহার প্রদান করিয়া আসিতেছি। ভয়ানক ভয়ানক চুরি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিরও অগম্য জাল ও জুয়াচুরি, রোমহর্ষণকারী হত্যাকাণ্ড প্রভৃতির অদ্ভুত বৃত্তান্ত যতদূর পারি, তাহা একে একে পাঠকগণের নিকট উপস্থাপিত করিয়াছি; এবং কি প্রকার কৌশল অবলম্বনে অপরাধীগণ ধৃত হইয়া রাজদ্বারে দণ্ডিত হইয়াছে, তাহাও সাধ্যমত দেখাইতে ত্রুটী করি নাই। কিন্তু এই দপ্তরের ভিতর কেবল একজন জালিয়াতের সম্পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত ভিন্ন এ পর্যন্ত আর কাহারও জীবনচরিত প্রকাশিত হয় নাই বলিয়া, তৃতীয় বৎসরের এই শেষভাগে সেখ মনিরূদ্দিন নামক একজন অতি প্রসিদ্ধ “সিঁদেল চোরের” জীবনচরিত লিখিত হইল। জানি না, পাঠকগণ ইহাতে কতদূর সন্তুষ্ট হইবেন। সন্তুষ্ট হউন, বা না হউন, আমার কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম আমি করিব। মনিরূদ্দিনের প্রকৃত জীবনচরিত আমি আজ তাহার স্বকীয় কথাতেই সকলের হস্তে প্রদান করিব। প্রকৃতকথা লিখিতে হইলে, ভাল মন্দের দিকে দৃষ্টি রাখিলে, চলে কৈ?
ইংরাজী ১৮৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মনিরূদ্দিন সৰ্ব্বশেষ জেল হইতে পলায়ন করে। সেই সময়ে ইহাকে ধরিবার নিমিত্ত যে পুলিস-কৰ্ম্মচারী নিযুক্ত হন, তিনি আমার সাহায্য গ্রহণ করেন; আমিও সাধ্যমত চেষ্ট করিতে ত্রুটী করি নাই। এই কার্য্যোপলক্ষে আমরা কিছুদিবস অত্যন্ত কষ্টভোগ করি, কিন্তু পরিশেষে আমাদিগের সেই কষ্টের লাঘব হয়। মনিরূদ্দিন আমাদিগের হস্তে ধৃত হইয়া পুনরায় জেলের ভিতর প্রেরিত হয়। সেই সময় হইতেই মনিরূদ্দিন আমার নিকট পরিচিত।
ইংরাজী ১৮৯২ সালের মে মাসে মনিরূদ্দিন যখন জেল হইতে মুক্ত হয়, প্রথানুযায়ী সে সেই সময় আমাদিগের অর্থাৎ ডিটেকটিভদিগের নিকট প্রেরিত হয়; এবং সেই সময়ে কলিকাতার ভিতর কোনস্থানে তাহার থাকিবার স্থান না থাকায়, প্রায় দুই তিন সপ্তাহ সে আমাদিগের থানাতেই অবস্থিতি করে। এই সময়ে আহারাদি-সম্বন্ধে আমি তাহার বিশেষ সাহায্য করি, এবং তাহার সহিত একটু মিশামিশি ভাব দেখাইয়া তাহার জীবনচরিত সম্বন্ধে সমস্ত কথা তাহার নিকট হইতে আমি অবগত হই। তাহার জীবন-বৃত্তান্ত সম্বন্ধে সে আমাকে যে সকল কথা বলিয়াছিল, এবং যে সকল কথা আমি পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত ছিলাম, আজ তাহাই মনিরূদ্দিনের “নিজের কথায়” পাঠকগণের সমীপে উপস্থাপিত করিতেছি।
আমাদিগের থানা হইতে প্রস্থান করিবার কিছুদিবস পরেই মনিরূদ্দিন পুনরায় ধৃত হয়, এবং বিচারে তাহার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বাসের আজ্ঞা হয়। এবার মনিরূদ্দিন দ্বীপান্তরে গমন করিবার পূর্ব্বেই তাহার এই জীবনচরিত লিখিয়া আমি শেষ করি; এবং জেলের কর্তৃপক্ষের আদেশ গ্রহণ পূর্ব্বক একদিন জেলের ভিতর গমন করিয়া, আদ্যোপান্ত তাহাকে পড়াইয়া শুনাই। “দুই এক স্থান ভিন্ন প্রায় সমস্তই প্রকৃত লেখা হইয়াছে” এই বলিয়া সেই সেই স্থান কিরূপে লিখিতে হইবে, তাহাও সে আমাকে বলিয়া দেয়। পরিশেষে আমি তাহারই নির্দেশমত সেই সেইস্থানের পরিবর্তন করিয়া লই। তাহার অনুরোধক্রমে তাহার বাসস্থান, এবং আত্মীয়-স্বজন প্রভৃতি কয়েকজনের নামও উঠাইয়া দিতে হয়।
মনিরূদ্দিন এখনও জীবিত, কিন্তু চিরনির্ব্বাসিত। জীবিত লোকের জীবনচরিত লেখার নিয়ম এদেশে নাই, এবং কৰ্ত্তব্যও নহে; কিন্তু মনিরূদ্দিন জীবিত থাকিয়াও মৃত। সে যে আর কখনও স্বাধীনভাবে বিচরণ করিতে পারিবে, সে আশা আর নাই বলিয়াই, তাহার জীবনচরিত আমি প্রকাশ করিলাম। এরূপ অবস্থায় জীবিত লোকের জীবনচরিত প্রকাশে আমার কোনরূপ অপরাধ হইবে কি না, জানি না। কিছুকাল পূর্ব্বে জীবিত “ডাক্তারবাবুর” জীবনচরিত লিখিয়াছি, তাহার নিমিত্ত এ পর্য্যন্ত কাহারও কর্তৃক কোনরূপ প্রতিবাদ দেখি নাই; বরং বিশেষরূপে উৎসাহই প্রাপ্ত হইয়াছি। তাই বলিয়াই পুনরায় আর একজন জীবিত ব্যক্তির জীবনচরিত লিখিতে প্রবৃত্ত হইলাম।
প্রথম পরিচ্ছেদ
আমার নাম সেখ মনিরূদ্দিন, আমার পিতার নাম সেখ তেলামহম্মদ, আমার বাসস্থান যশোহর জেলার মধ্যস্থিত একটি ক্ষুদ্র অথচ ভদ্র মুসলমান পল্লীতে। এখন আমার বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসরের নিকটবর্ত্তী।
আমি আমার পিতার একমাত্র সন্তান। আমি ইংরাজী লেখাপড়া শিখি নাই; কিন্তু দেশের নিয়ম-অনুযায়ী যেমন হউক, একটু বাঙ্গালা এবং পারস্যভাষা শিক্ষা করিয়াছিলাম। কৃষিকার্য্যের উপর নির্ভর করিয়া আমার পিতা দিনযাপন করিতেন। পিতা কৃষিকার্য্য করিতেন সত্য; কিন্তু নিজহস্তে কখন কৃষকের কার্য্য করেন নাই; চাকর প্রভৃতির দ্বারাই সেই সকল কাৰ্য্য সম্পন্ন হইত। তিনি সেই গ্রামের সর্ব্বপ্রধান মণ্ডল ছিলেন—পরের কার্য্যের নিমিত্তই তাঁহাকে অনেক সময় ব্যস্ত থাকিতে হইত। কাহারও বাড়ীতে কোনরূপ ক্রিয়াকৰ্ম্ম বা পৰ্ব্ব-পার্বণ হইলে সৰ্ব্বপ্রথমে তাঁহারই মন্ত্রণার প্রয়োজন হইত, এবং তিনি উপস্থিত না থাকিলে কোন কৰ্ম্মই সম্পাদিত হইত না। কাহারও সহিত বিষয় সম্পত্তি লইয়া কোনরূপ বিবাদ উপস্থিত হইলে, বিচারালয়ে গমন না করিয়া সকলেই তাঁহার নিকট গমন করিত; তিনিই উভয়ের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া দিতেন। এইরূপ সমাজ-সম্বন্ধে, জাতি সম্বন্ধে, ধৰ্ম্ম-সম্বন্ধে, বিবাদ-বিসম্বাদ—সম্বন্ধে, যখন যে কোনরূপ প্রয়োজন হইত, তাঁহাকেই তাহাই সম্পন্ন করিতে হইত।
এইরূপ পরোপকারী এবং সদাশয় পিতার ঔরসে এই হতভাগ্য চোরের জন্ম হয়। আমি ক্রমে বড় হইলে পিতা আমাকে বিবাহ-বন্ধনে বদ্ধ করিয়া দেন; নদীয়া জেলার অন্তর্গত গোয়াড়ীগ্রামের জনৈক মুন্সীর কন্যার সঙ্গে আমার পরিণয় হয়। শ্বশুর মহাশয় গোয়াড়ীর ভিতর একজন মান্যগণ্য লোক ছিলেন বলিয়া, এইস্থানে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইল। ইনি কৃষ্ণনগরের মুন্সেফী কোর্টের নাজির ছিলেন।
আমার বিবাহের অতি অল্পদিবস পরেই আমার পিতা-মাতা পরলোক গমন করেন। আমিও আমার পৈত্রিক বাসস্থান পরিত্যাগ করিয়া শ্বশুরালয়ে গিয়া উপস্থিত হই। পিতামাতা বর্তমান থাকিতে, মধ্যে মধ্যে আমি শ্বশুরবাড়ী গমন করিতাম। এইস্থান নদীয়া জেলার প্রধান নগর। দোকান পসার এবং বিলাস সামগ্রী প্রভৃতি যাহা অনুসন্ধান করিতাম, তাহা অনায়াসেই এইস্থানে প্রাপ্ত হইতাম। পল্লী-গ্রামে যে সুখ পাওয়া যায় না, যে সকল বিলাসের দ্রব্য সেইস্থানে মিলে না, তাহার সমস্তই গোয়াড়িতে অনায়াসেই প্রাপ্ত হইতাম। সুতরাং পিতার মৃত্যুর পর জন্মস্থান পল্লী—গ্রাম আমার আর ভাল লাগিল না; গোয়াড়িতেই বাস করিব, স্থির করিয়া আমি আমার শ্বশুরালয়ে গমন করিলাম। যে সময় আমি গোয়াড়িতে গিয়া অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম, সে সময় আমার বয়ঃক্রম আঠার বা ঊনিশ বৎসরের অধিক ছিল না।
শ্বশুর মহাশয় বহদিবস হইতে নাজিরী করিয়া আসিতে ছিলেন, সুতরাং অনেক বড় বড় লোক এবং সাহেব সুবার সহিত তাঁহার বিশেষ আলাপ-পরিচয় ছিল। তিনি বিশেষ রূপে চেষ্টা করিয়া আদালতের ভিতরেই আমার একটি চাকরি করিয়া দিলেন, প্রথমে আমার বেতন হইল, কেবল ১৫ টাকামাত্র। বাল্যকাল হইতে সৰ্ব্বদা স্বাধীনভাবে দিনযাপন করিয়াছি, যখন যেখানে যাইবার ইচ্ছা হইয়াছে, তখনই সেইস্থানে গমন করিয়াছি। সুতরাং এ পরাধীনতা আমার ভাল লাগিল না; কিন্তু কি করি, শ্বশুরের ভয়ে চাকরিও পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না।
যশোহর হইতে আমি যখন গোয়াড়িতে গমন করি, সেই সময় টাকাকড়ি প্রভৃতি যাহা কিছু লইয়া গিয়াছিলাম তাহার অধিকাংশ শ্বশুরের নিকট ছিল; অবশিষ্ট আমার স্ত্রীর নিকটে রাখিয়াছিলাম। গোয়াড়িতে গমন করিবার কিছুদিবস পরেই এক এক করিয়া, ক্রমে অনেকগুলি সঙ্গী জুটিয়া গেল। তাহাদিগের সহিত সর্ব্বদা নগরের নানা স্থানে অসৎ-কার্য্যের উপলক্ষে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। ইহাতে যাহা কিছু খরচ হইত, তাহার অধিকাংশই আমি বহন করিতাম। জুতা, কাপড় খরিদ প্রভৃতি ন্যায্য খরচের নাম করিয়া কিছু কিছু অর্থ শ্বশুরের নিকট হইতে গ্রহণ করিলেও, তাহাতে আমার কুলাইত না। অবশিষ্ট যাহা আবশ্যক হইত, তাহা জোর জবরদস্তি করিয়া আমার স্ত্রীর নিকট হইতে গ্রহণ করিতাম। ক্রমে আমার প্রদত্ত সমস্ত অর্থ, তৎপরে তাহার পিতামাতা প্রদত্ত যাহা কিছু তাহার নিকট ছিল, ক্রমে ক্রমে সমস্তই আত্মসাৎ করিয়া, নিজের এবং বন্ধুবর্গের নিকৃষ্টবৃত্তি পরিতৃপ্ত করিতে লাগলাম। যখন সমস্ত অর্থ নিঃশেষ হইত, তখন অনন্যোপায় হইয়া স্ত্রীর গহনাগুলির উপর ক্রমে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলাম। ক্রমে তাহাও নিঃশেষ হইয়া গেল; এখন সম্বলের মধ্যে কেবল ১৫ টাকা বেতনের চাকরি রহিল।
ক্রমে আমার গুণের কথা শ্বশুর মহাশয়ের কর্ণে উঠিল। তিনি প্রথম প্রথম আমাকে অনেক বুঝাইলেন, আমার দোষ দেখিয়া মধ্যে মধ্যে গালি-গালাজও আরম্ভ করিলেন। আমি প্রথম প্রথম সহ্য করিলাম, তাঁহার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিলাম না। কিন্তু পরিশেষে তাঁহার কথা আমার আর ভাল লাগিল না, ক্রমে আমি তাঁহার অবাধ্য হইয়া উঠিতে লাগিলাম। আমার অবস্থা দেখিয়া যদিও তিনি আমাকে তাঁহার বাড়ী হইতে তাড়িত করিলেন না, কিন্তু আমার সহিত কথাবার্তা বন্ধ করিলেন; আমি কি করি না করি, কোথায় যাই না যাই, তাহার দিকে আর দৃষ্টি করিলেন না। এখন হইতে আমার ও আমার বন্ধুবর্গের খরচের নিমিত্ত বাড়ী হইতে টাকা পাইবার উপায় একেবারে বন্ধহইল। তিনি নিজে ত কিছুই দিতেন না, কিন্তু আমার স্ত্রীর নিকট হইতে যাহাতে আর কিছু না পাইতে পারি, তাহারও উপায় করিলেন। আমার স্ত্রীর গহনাপত্র টাকা-কড়ি প্রভৃতি যাহা কিছু ছিল, তাহার সমস্তই তিনি নিজে গ্রহণ করিয়া, আপনার লোহার সিন্ধুকের ভিতর বন্ধ করিলেন। পাইবার মধ্যে কেবল দুইবেলা আহার পাইতে লাগিলাম। এখন অনন্যোপায় হইয়া কেবল আমার বেতনের ১৫ টাকা দ্বারাই যতদূর সম্ভব, আমার সখ মিটাইতে লাগিলাম।
এ পর্য্যন্ত যে ব্যক্তি মাসে মাসে শত শত টাকা ব্যয় করিয়া আসিয়াছে, এখন কেবলমাত্র ১৫ টাকায় তাহার কি হইতে পারে? এখন আমি আমার বন্ধুবর্গের নিকট ক্রমে অপদস্থ হইতে লাগিলাম। তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ বা আমাকে নানারূপ পরামর্শ দিতে লাগিল। কেহ কহিল, আমার যে সকল টাকা আমার শ্বশুরের নিকটে গচ্ছিত আছে, তাহা যদি তিনি সহজে না দেন, তাহা হইলে আদালতের সাহায্য অবলম্বনে সেই টাকা তাঁহার নিকট হইতে আদায় করিয়া লওয়া হউক। এ পরামর্শ যদিও আমি সম্পূর্ণরূপ শুনিলাম না, কিন্তু চক্ষু-লজ্জার মাথা খাইয়া একদিবস শ্বশুরের নিকট আমি আমার টাকা চাহিলাম। উত্তরে তিনি কহিলেন, “তোমার টাকা আমার নিকট নাই। যাহা তুমি আমাকে দিয়াছিলে, সে তোমার স্ত্রীর টাকা, আমি সে টাকা তোমার স্ত্রীকে দিয়াছি; পার ত’ তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে গ্রহণ কর।” শ্বশুরের কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে আর কিছু বলিলাম না, বা আদালতের সাহায্যও গ্রহণ করিলাম না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
শ্বশুরের কথা শুনিয়া মৌনভাবে আমি বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। বাড়ীর কিছু দূরে একটি দরজীর দোকান স্থল, সেইস্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম। এই দোকানে আমি সর্ব্বদা গমন করিতাম, এবং মধ্যে মধ্যে আমার পরিধান উপযোগী পা-জামা, চাপকান প্রভৃতি তাহার নিকট হইতে সেলাই করাইয়া লইতাম।
দরজীর দোকানে বসিয়া আছি, এমন সময় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, বলিষ্ঠ একটি যুবক সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া, দরজীকে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন হে! আমার কোটটি তৈয়ার হইয়াছে?” দরজী কহিল, “না মহাশয়! এখনও শেষ হয় নাই। কল্য এই সময় আপনি নিশ্চয়ই পাইবেন।”
দরজীর নিকট এইরূপ উত্তর পাইয়াও সে দোকানের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং আমি যে স্থানে বসিয়াছিলাম, তাহার সন্নিকটেই উপবেশন করিল। পরে আমার সহিত অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত নানাপ্রকারের গল্প করিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। কথা-বাৰ্ত্তায় আমি বুঝিতে পারিলাম, উহার নাম কৃষ্ণলাল, জাতিতে কায়স্থ, বাসস্থান যশোহর জেলার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র গ্রামে; নিজের বিষয়-সম্বন্ধীয় মামলা মোকদ্দমার নিমিত্ত তাহার গোয়াড়িতে আগমন; সে গ’ড়ে নদীর নিকটবর্তী একটি স্ত্রীলোকের বাড়ীতে বাসা লইয়াছে।
পরদিবস কৃষ্ণলাল পুনরায় সেই দরজীর দোকানে আগমন করিল, সে সময়েও আমি সেইস্থানে উপস্থিত ছিলাম। সে আসিবামাত্রই দরজী কহিল, “মহাশয়! আপনার কোট প্রায় প্রস্তুত হইয়াছে, সামান্য বাকি আছে মাত্র। আপনি এইস্থানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনই উহা আপনাকে প্রদান করিতেছি।”
দরজীর কথা শুনিয়া কৃষ্ণলাল আমার নিকট আসিয়া উপবেশন করিল, ও আমার সহিত নানাপ্রকার মিষ্টালাপ করিতে লাগিল। এইরূপে সেইস্থানে উপবেশন করিয়া কৃষ্ণলাল প্রায় দুইঘণ্টা অতিবাহিত করিল। কোট প্রস্তুত হইলে, সে সেইস্থান পরিত্যাগ করিবার সময় আমাকে সঙ্গে লইয়া গেল। তাহার সহিত গমন করিতে আমি অনেক ওজর আপত্তি করিলাম, কিন্তু কিছুতেই সে আমার কথা না শুনিয়া, আমাকে সঙ্গে লইয়া তাহার বাসায় গমন করিল। উহার সহিত গমন করিতে প্রথমে আমি যদিচ অমত করিয়াছিলাম; কিন্তু পরিশেষে তাহার কথায় এরূপ আপ্যায়িত হইলাম যে, আর কোন প্রকারেই তাহার কথার অন্যথাচরণ করিতে পারিলাম না। আমি তাহার বাসায় গমন করিলে, প্রথমতঃ সে আমার জলযোগের উদযোগ করিল। সে হিন্দু, আমি মুসলমান; উভয়ের মধ্যে জাতিগত বিশেষ পার্থক্য থাকিলেও দেখিলাম, তাহার নিকটে হিন্দু মুসলমানের পার্থক্য নাই। আমি যে পর্যন্ত তাহার বাসায় ছিলাম, আমাদিগের পাড়া সম্বন্ধে নানা প্রকার কথা তুলিয়া সে আমাকে নানারূপ জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিল। কাহার কিরূপ অবস্থা, কাহার বাড়ী কোথায়, মূল্যবান দ্রব্যাদি কে কোথায় রাখে, এইরূপ ভাবের অনেক কথা হইল। আমি তাহার অন্তরের অভিসন্ধি কিছুমাত্র বুঝিতে সমর্থ না হইয়া, অকপটে তাহার কথার উত্তর প্রদান করিতে লাগিলাম। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, আমিও আমার নূতন বন্ধুর বাসা পরিত্যাগ করিলাম। আসিবার সময় কৃষ্ণলাল আমাকে বিশেষরূপ অনুরোধ করিয়া বলিয়া দিল, “কলা আসিয়া পুনরায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও।” আমিও সম্মত হইলাম।
পরদিবস সন্ধ্যার সময় পুনরায় কৃষ্ণলালের বাসায় গমন করিলাম। দেখিলাম, সে নিজের বাসাতেই বসিয়া আছে। আমাকে দেখিবামাত্র সে বিশেষ সম্মান এবং যত্ন করিয়া আমাকে বসাইল। আজ অনেক কথার মধ্যে আমার নিজের অবস্থা সম্বন্ধীয় কথাই প্রথমে পড়িল। কৃষ্ণলালের নিকটে আমি কোন কথা গোপন না করিয়া, আমার অবস্থা আদ্যোপান্ত তাহার নিকট বর্ণন করিলাম। আমার বিবাহ, পিতার মৃত্যু, দেশ পরিত্যাগ, শ্বশুরালয়ে আগমন, চাকরি এবং শ্বশুরের ব্যবহার প্রভৃতি কোন কথাই আর আমার নূতন বন্ধুর নিকট গোপন করিলাম না। সহরে বাস করিয়া পাঁচজন বন্ধুর সহবাসে থাকিয়া, আমোদ-প্রমোদের দিকে একটু সখ হইয়াছে; কিন্তু শ্বশুরের অত্যাচারে মনের সখ মিটাইতে পারিতেছি না। কেবলমাত্র ১৫ টাকার কতক্ষণ আমোদ আহ্লাদ চলিতে পারে? এইরূপ সকল কথাই আমি অকপটে কৃষ্ণলালের নিকট কহিলাম।
বুঝিলাম, আমার কথা শুনিয়া কৃষ্ণলালের আন্তরিক যেন কষ্ট হইল। তখন সে আমাকে কহিল, “তুমি পূৰ্ব্বে একথা আমাকে বল নাই কেন? আমাকে বলিলে, আমি তোমাকে বিশেষরূপ সাহায্য করিতাম। বন্ধু যদি বন্ধুর উপকারেই না আসিল, তাহা হইলে সে কিসের বন্ধু? তুমি তোমার মনের কথা আমার নিকটে অকপটে প্রকাশ করিলে বলিয়া, আমিও আমার মনের কথা বলিতেছি! তোমার মত আমিও এদিক ওদিক্ বেড়াইয়া, নিজের মনকে সন্তুষ্ট রাখিতে ভালবাসি। প্রাণের সখ যদি মিটাইতে না পারিলাম, তাহা হইলে সে প্রাণ রাখিয়া আর কি সুখ? তুমি তোমার ইচ্ছামত মনের সখ মিটাও। আমিও তোমার সহিত মিলিত হইব, এবং তোমার যখন যাহা আবশ্যক হইবে, তাহা আমিই প্রদান করিব। আপাততঃ এই দুই শত টাকা লইয়া যাও, যখন ইহা নিঃশেষ হইয়া যাইবে তখন পুনরায় আমার নিকট আগমন করিও।” এই বলিয়া দুইশত টাকার নোট আমার হস্তে প্রদান করিল।
কৃষ্ণলালের কথা শুনিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। এইরূপ ভাবে তাহার নিকট হইতে অর্থগ্রহণ করিতে একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিলাম। আমার এই অবস্থা দেখিয়া কৃষ্ণলাল কহিল, “এই অর্থগ্রহণ করিতে তুমি ইতস্ততঃ করিতেছ কেন? এ অর্থ আমার নয়, তোমারই। কোন কার্য্যের নিমিত্ত তুমি আমাকে যেরূপ সাহায্য করিয়াছ, তজ্জন্য কৃতজ্ঞ হৃদয়ে তোমাকে এই অর্থ প্রদান করিতেছি; তুমি ইহা ইচ্ছামত ব্যয় কর। আবশ্যক হইলে, পুনরায় আমার নিকট আসিও, কিন্তু একথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না। কোথা হইতে এই অর্থ তোমার হস্তগত হইল, একথা যখন তুমি প্রকাশ করিবে, সেই সময় হইতে তোমার সহিত আমার আর সাক্ষাৎ হইবে না; সুতরাং পুনরায় কিছু পাইবার তোমার প্রত্যাশাও রহিবে না।” কৃষ্ণলালের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া সেদিবস আমি তাঁহার বাসা পরিত্যাগ করিলাম। কিন্তু মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম,—ঐ ব্যক্তি হঠাৎ এত টাকা আমাকে কেন দিল?
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সেইদিবস সন্ধ্যার পর ঘুরিয়া ফিরিয়া আমি সেই দরজীর দোকানে গমন করিলাম। সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া পরম্পরায় শুনিতে পাইলাম,—গত রাত্রিতে রামধন মোক্তারের বাসায় সিঁদ দিয়া, চোরে তাহার যথাসর্ব্বস্ব লইয়া গিয়াছে। যে রাত্রিতে রামধনের বাসায় সিঁদ হয়, তাহার পূর্ব্বদিবস লাঠের কিস্তির খাজানা দাখিল করিবার নিমিত্ত মফঃস্বল হইতে পাঁচসহস্র টাকা তাহার বাসায় আইসে। কালেক্টরী বন্ধ হইবার পর টাকা আইসে; সুতরাং সে টাকা দাখিল করা হয় না। সেদিন উহা তাহার বাসায় একটি বড় কাষ্ঠের বাক্সের ভিতর রাখিয়া দেওয়া হয়। রাত্রিতে সেই টাকার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে।
এই কথা শুনিয়া হঠাৎ আমার মনে কেমন একটি সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। রামধনের বাসায় যে টাকা আইসে, তাহা আমি দেখিয়াছিলাম। পরে অন্যান্য কথার মধ্যে একথাও আমি কৃষ্ণলালকে বলিয়াছিলাম। এদিকে সেই রাত্রিতেই চুরি হইল! আর পরদিবসই কৃষ্ণলাল আমাকে একেবারে দুইশত টাকা প্রদান করিল! এই কথাগুলি সমস্ত মনে মনে পর পর যতই ভাবিয়া দেখিতে লাগিলাম, ততই সেই সন্দেহ আমার মনে দৃঢ় হইতে লাগিল। কিন্তু কাহাকেও কিছু না বলিয়া, আমি একেবারে কৃষ্ণলালের বাসায় গমন করিলাম। দেখিলাম, কৃষ্ণলাল বাসাতেই আছে। আমাকে দেখিবামাত্র সে যেন একটু ভীতিব্যঞ্জক ভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হে মনিরূদ্দিন! এত শীঘ্র যে? সংবাদ ভাল?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “মন্দ কিছুই দেখিতেছি না। কিন্তু আমার মনে মনে কেমন একটি সন্দেহ হওয়ায়, সেই সন্দেহ ভঞ্জন করিবার নিমিত্ত, এই অসময়ে পুনরায় তোমার নিকট আসিতে হইল।” এই বলিয়া আমি কৃষ্ণলালের নিকটে গিয়া উপবেশন করিলাম।
আমার কথা শুনিয়া কৃষ্ণলাল কহিল, “যখন তোমাকে বন্ধু বলিয়াছি, তখন কোন কথা তোমার নিকট লুকাইবার নাই। তোমার মনে যে কোন সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে, তাহা আমার নিকট অকপটে প্রকাশ করিতে পার। আমি যতদূর পারি, তোমার সন্দেহভঞ্জন করিয়া দিব।”
কৃষ্ণলালের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “একটু পূর্ব্বে আমি সেই দরজীর দোকানে গমন করিয়াছিলাম। সেই স্থানে শুনিলাম,—গত রাত্রিতে রামধন মোক্তারের বাসায় চুরি করিয়া চোরে তাঁহার পাঁচহাজার টাকা লইয়া গিয়াছে। তাহার বাসায় যে এত টাকা আসিয়াছে, এবং টাকা যে সে একটি কাষ্ঠের বাক্সের ভিতর রাখিয়া দিয়াছিল, একথা আমিই তোমার নিকট যে দিবস বলি, সেই রাত্রিতেই তাহার গৃহে চুরি হয়; আর আজ আপনি আমাকে হঠাৎ দুইশত টাকা প্রদান করিলেন! দিবার সময় আবার আমাকে কহিলেন, আমি আপনাকে যে প্রকার সাহায্য করিয়াছি, তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা-চিহ্নস্বরূপ আপনি সেই টাকা আমাকে প্রদান করিতেছেন। এ সকল বৃত্তান্ত কি, আমি কিছুই বুঝিতে সমর্থ হইতেছি না বলিয়া, পুনরায় আপনার নিকট আগমন করিয়াছি।”
আমার কথা শুনিয়া কৃষ্ণলাল যেন একটু বিস্মিত হইলেন; কিন্তু পরিশেষে কহিলেন, “তুমি যাহা অনুমান করিতেছ, তাহাই সত্য; প্রকাশ করিয়া বলিবার আর কোন প্রয়োজন নাই। তুমি দুইশত টাকা প্রাপ্ত হইয়াছ, অবশিষ্ট কিছু আমার নিকট আছে, ইহাও তোমাকে আবশ্যকমত দিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। এ তোমারই অংশ, তোমার সন্ধান-অনুসারে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে বলিয়া, তোমার অংশ আমি পৃথক্ করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছি। চুরি করা আমাদিগের ধর্ম্ম বটে, কিন্তু সহায়তাকারীকে বঞ্চনা করা আমাদিগের ধর্ম্ম নহে। তোমার অংশের অবশিষ্ট মুদ্রা ও তুমি এখন গ্রহণ করিতে পার।” এই বলিয়া আরও তিনশত টাকার নোট আমার হস্তে প্রদান করিল ও কহিল, “সাবধান! একথা কিন্তু আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না; কারণ ইহা প্রকাশিত হইলে তোমার ও আমার উভয়েরই বিপদ। এই কথা যদি গোপনে রাখিতে পার, যদি প্রকৃতই আমি তোমার উপর আমার বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারি, তাহা হইলে দেখিবে, দেখিতে দেখিতে তোমাকে কিরূপ উপায়ে কত বড়লোক করিয়া দিব? তখন বুঝিবে, ১৫ টাকা বেতনের আশায় পরের দাসত্ব করা ভাল, কি আমার সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিয়া, মনের কথা আমি ও তুমি ব্যতীত অপরের নিকট গুপ্ত রাখা ভাল।”
আমি আর এখন বালক নহি, সংসারের সকল কাৰ্য্যই বুঝিয়াছি। কিসের আমার ইষ্ট, কিসে আমার অনিষ্ট, তাহাও বুঝিতে সমর্থ হইয়াছি। তবে বয়সের দোষে এবং কুহকিনীদিগের কুহকে পড়িয়া আত্মহারা হইয়াছি মাত্র। ইহা যে সৎকাৰ্য্য নহে, তাহাও বেশ বুঝিতে পারিয়াছি; কিন্তু কুহকজাল ছিন্ন করিবার অস্ত্র আমার নাই, ক্ষমতাও নাই। যাহা হউক, কৃষ্ণলালের কথা শুনিয়া আমি সমস্তই বুঝিতে পারিলাম। পরদিবস আসিয়া পুনরায় তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এই বলিয়া সেই তিনশত টাকা সমভিব্যাহারে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
নূতন পাপ সঞ্চয় করিয়া ঘৃণিতকার্যে লিপ্ত হইলাম! কিন্তু ইহার পরিণাম ক্ষণকালের নিমিত্ত না ভাবিয়া, ধীরে ধীরে আমার নিন্দনীয় গন্তব্যস্থানে গমন করিলাম। আমোদ-আহ্লাদে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। পরদিবস নিয়মিতরূপে একবার শ্বশুরবাড়ীতে গমন করিয়া আহারাদি পূর্ব্বক আফিসে গমন করিলাম। আফিসে গমন করিলাম সত্য, কিন্তু জানি না, কেন আফিসের কার্য্যে মনোনিবেশ করিতে পারিলাম না; ভীতিজনক নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া হৃদয়কে আলোড়িত করিতে লাগিল।
আফিস হইতে ফিরিয়া কৃষ্ণলালের বাসায় গেলাম। কিন্তু দেখিলাম, সে সেইস্থানে নাই; সেই বাসা পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে, তাহা কেহই বলিতে পারেন না।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কৃষ্ণলালের নিকট হইতে যে পাঁচশত টাকা আমি প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, বলা বাহুল্য, দুই তিন মাসের মধ্যেই তাহা শেষ হইয়া গেল। এদিকে পুলিস, কিছুদিবস সেই চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়া, পরিশেষে আশা-ভরসা পরিত্যাগ করিলেন। চোরকে ধৃত করা দূরে থাকুক, মূল কথার বিন্দুমাত্রও জানিতে পারিলেন না।
সেই পাঁচশত টাকা যে পর্য্যন্ত নিঃশেষ হইয়া না গেল, সেই পর্যন্ত আমি আর আফিসে পদার্পণ করিলাম না। তিনমাস পরে একদিবস আফিসে গিয়া জানিতে পারিলাম, আমার চাকরি গিয়াছে, এবং আমার কার্য্যে অপর আর একটি লোক নিয়োজিত হইয়াছে।
চাকরিও গেল, হাতের টাকাও শেষ হইয়া গিয়াছে; এখন আমি মহাবিপদে পড়িলাম। যে সর্ব্বনাশীর ঘরে আমায় যাতায়াত ছিল, এখন তাহার খরচের টাকা কম পড়ায়, সে আমাকে তাহার বাড়ীর বাহির করিয়া দিল। অপর আর একটি পরিচিত স্থানে গমন করিলাম। দুই একদিবস সে আমাকে বিশেষ যত্নের সহিত স্থান প্রদান করিল, কিন্তু যখন দেখিল, সেই সময়ে আমার নিকট হইতে টাকাকড়ি পাইবার সম্ভাবনা নাই, তখন সেও আমাকে দূর করিয়া দিল। এইরূপে যে যে স্থানে গমন করিলাম, সেই সেইস্থান হইতে বিতাড়িত হইলাম।
কৃষ্ণলালের সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া গমন করিবার পর, পাঁচমাস পর্য্যন্ত অনেক স্থানে সন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। এইরূপ ছয়মাস গত হইয়া গেলে, হঠাৎ একদিবস কৃষ্ণলালের সহিত পথের উপর আমার সাক্ষাৎ হইল। আমাকে দেখিবামাত্র কৃষ্ণলাল আমার নিকট আগমন করিল, এবং কহিল, “তুমি আমার বাসা হইতে আগমন করিবার পর, হঠাৎ আমি আমার বাড়ী হইতে এক পত্র প্রাপ্ত হইলাম। সেই পত্রে যেরূপ সংবাদ লিখিত ছিল, তাহাতে আমি আর তিলার্দ্ধও এইস্থানে থাকিতে পারিলাম না, বা গমনকালীন তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াও যাইতে পারিলাম না। তৎক্ষণাৎ আমি এইস্থান পরিত্যাগ করিয়া আপনার দেশে প্রস্থান করিলাম। নানারূপ বৈষয়িক ঝঞ্ঝাটে এতদিবস আমাকে বাড়ীতেই থাকিতে হয়, সবেমাত্র অদ্য এইস্থানে আগমন করিয়াছি। তোমার সহিত এখন যদি আমার সাক্ষাৎ না হইত, তাহা হইলে সন্ধান করিয়া অদ্যই আমি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতাম।”
কৃষ্ণলালের পরিষ্কার কথাগুলি আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। কৃষ্ণলালের ভাব দেখিয়া বোধ হইল যে, আমি তাহার কথাগুলি সমস্তই যেন সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া লইয়াছি। কিন্তু উত্তরে আমি কহিলাম, “তুমি যাহা কহিলে, তাহা সত্য হইতে পারে; কিন্তু তুমি এস্থান পরিত্যাগ করিবার পর, আমার মনে অন্যরূপ ভাবের উদয় হইয়াছিল। আমি ভাবিয়াছিলাম, তুমি আমাকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিতে পার নাই। সুতরাং আমি যখন তোমার সমস্ত কথা অবগত হইতে পারিয়াছি, তখন যদি আমি অপর কাহারও নিকট সেই সকল কথা প্রকাশ করি, তাহা হইলে তোমার বিশেষ বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা। এই ভাবিয়া যাহাতে কেহ তোমার অনুসন্ধান না পায়, তাহাই করিয়াছিলে, অর্থাৎ যত শীঘ্র পারিয়াছিলে, আমাদিগের সম্মুখ হইতে স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছিলে। এক্ষণে দেখিলে, ছয়মাস গত হইয়া গেল, তোমার বিপক্ষে আমি কোন কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিলাম না। এইরূপ কারণে এখন বোধ হয়, তুমি আমার উপর কতক পরিমাণে বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছ, এবং সেই নিমিত্তই আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সাহসী হইয়াছ। তুমি স্পষ্ট করিয়া বল, আর নাই বল, ইহাই তোমার মনের ভাব বলিয়া, আমার নিশ্চয় ধারণা।”
আমার কথা শুনিয়া কৃষ্ণলাল যেন একটু স্তম্ভিত হইল। তাহার ভাব দেখিয়া স্পষ্ট অনুমান হইতে লাগিল, আমার কথাগুলি যেন তাহার অন্তরের সহিত মিলিয়া গিয়াছে। যাহা হউক, আমার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া সে অপরাপর নানাকথা উত্থাপিত করিল, এবং পরিশেষে আমাকে সঙ্গে লইয়া, তাহার বাসায় লইয়া গেল। পূর্ব্বে যে স্থানে তাহার বাসা ছিল, এবার সে সেইস্থানে বাসা লয় নাই; এবার হরিনাথ কুঙারের বাটীর সন্নিকটে বাসা লইয়াছিল।
তাহার সহিত আমি তাহার বাসায় গমন করিলাম। সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া উভয়ের মধ্যে অনেক কথার আলোচনা হইতে লাগিল। বলা বাহুল্য, আলোচ্য বিষয়ের অধিকাংশই পূর্ব্বের মত অর্থাৎ জ্ঞাতচরিত্র ব্যক্তিগণের মধ্যে কাহার কিরূপ সম্পত্তি, কে কোথায় থাকে, কাহার সম্পত্তি সে কোথায় রাখিয়া থাকে ইত্যাদি।
প্রায় দুইঘণ্টাকাল সেইস্থানে অতিবাহিত করিয়া আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। সেইদিবস সন্ধ্যার সময় পুনরায় তাহার নিকট গমন করিলাম। এইরূপে পুরাতন বন্ধুর সহিত আমি প্রায় সর্ব্বদাই অতিবাহিত করিতে লাগিলাম। পাঁচ সাত দিবস এইরূপে অতিবাহিত হইয়া গেলে, একদিবস কৃষ্ণলাল আমাকে কহিল, “আজ রাত্রিতে এইস্থান হইতে তোমাকে গমন করিতে দিব না; আহারাদি করিয়া এইস্থানেই তোমাকে থাকিতে হইবে। কোন কার্য্যোপলক্ষে আজ রাত্রিতে আমাকে বাহির হইয়া যাইতে হইবে, আবশ্যক হইলে তুমিও আমার সঙ্গে যাইবে।” কি কাৰ্য্যোপলক্ষে কৃষ্ণলাল রাত্রিকালে বাহিরে গমন করিবে, তাহা আমি বুঝিলাম; বুঝিয়াও সেইস্থানে রাত্রিযাপন করিতে সম্মত হইলাম।
আহারাদি করিয়া রাত্রিতে কৃষ্ণলালের বাসায় শয়ন করিলাম, কৃষ্ণলালও আমার নিকট শয়ন করিল। ক্রমে আমরা উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম। রাত্রি প্রায় দুইটার সময় কৃষ্ণলাল আমার নিদ্রা ভঙ্গ করিল, আমি উঠিলাম। দেখিলাম, কৃষ্ণলাল লালবর্ণের কাপড় পরিধান করিয়া আমার নিকট দণ্ডায়মান রহিয়াছে। আমি উঠিলে সে আমার হস্তে অপর আর একখানি লালবস্ত্র প্রদান করিয়া কহিল, “ইহা পরিধান করিয়া আমার সহিত আগমন কর।” আমি তাহাই করিলাম। যাহার নিকট একবার যথেষ্ট অর্থ পাইয়া ইচ্ছামত আমোদ-প্রমোদ করিয়াছি, অন্তরের সহিত বিশ্বাস করিয়া যাহার সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিয়াছি, তাহার কথার কোনরূপ প্রতিবাদ না করিয়া, সেই রক্তবর্ণ বস্তু পরিধান পূর্ব্বক তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। সেই কৃষ্ণপক্ষের রাত্রিতে বিনা-পাদুকায় ঘোরতিমিরাচ্ছাদিত ও লোকজন-সমাগম-বিরহিত অপ্রশস্ত রাজবর্ণের আশ্রয় লইয়া চলিতে লাগিলাম। প্রায় পনর মিনিট চলিয়া একটি প্রকাণ্ড বাড়ীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
যে বাড়ীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই বাটীসম্বন্ধীয় অনেক কথা আমি পূৰ্ব্বে কৃষ্ণলালকে বলিয়াছিলাম। আমাকে সঙ্গে লইয়া কৃষ্ণলাল সেই বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে গমন করিল, ও একটি প্রাচীরের অন্তরালে আমাকে স্থিরভাবে বসিয়া থাকিতে কহিল। আরও বলিল, কোন ব্যক্তিকে যদি এইদিকে আগমন করিতে দেখিতে পাই, তাহা হইলে সঙ্কেতে কৃষ্ণলালকে তাহা জানাইতে হইবে। আমি তাহাই করিলাম; সেই প্রাচীর-অন্তরালে স্থিরভাবে বসিয়া সেই ঘোর অন্ধকারের ভিতর দিয়া যতদূর সম্ভব, দেখিতে লাগিলাম।
কৃষ্ণলাল তাহার বস্ত্রের মধ্য হইতে লৌহনির্ম্মিত একটি অস্ত্র বাহির করিল। এরূপ অস্ত্র ইতিপূর্ব্বে আর কখনও দেখি নাই; কিন্তু পরে জানিয়াছিলাম, ইহাকে সিঁদকাটি কহে। পরে ইহাই আমার প্রধান অস্ত্ররূপে পরিগণিত হয়।
কৃষ্ণলাল সেই অস্ত্রের সাহায্যে সেই প্রকাণ্ড পাকাবাড়ীর প্রাচীর কাটিতে আরম্ভ করিল। আমার এই জীবনে আমি অনেক উত্তম উত্তম রাজমিস্ত্রির কার্য্য দেখিয়াছি, কিন্তু কৃষ্ণলাল যেরূপ উপায়ে এবং নিতান্ত অল্প সময়ের মধ্যে সেই প্রাচীর কাটিয়া মনুষ্য প্রবেশোপযোগী একটি ছিদ্র প্রস্তুত করিল, সেরূপ কিন্তু আর কোথাও দেখি নাই। প্রাচীর কাটা শেষ হইলে কৃষ্ণলাল সঙ্কেত করিয়া আমাকে তাহার নিকট ডাকিল ও চুপি চুপি কহিল, “গৃহের ভিতর হইতে আমি যে সকল দ্রব্য বাহির করিয়া দিব, তুমি আস্তে আস্তে তাহা লইয়া নিকটবর্ত্তী কোনস্থানে রাখিবে। আমি গৃহ হইতে বাহির হইয়া, পরে যেরূপ করিতে হয়, তাহা তোমাকে কহিব।”
কৃষ্ণলালের কথায় আমি সম্মত হইয়া সেই কার্য্যে যদিও আমি প্রবৃত্ত হইলাম সত্য; কিন্তু সেই সময়ে আমার মনের ভাব যে কিরূপ হইল, তাহা এখন আমি বর্ণন করিতে সমর্থ হইতেছি না। আমার মস্তক ঘুরিতে লাগিল; সেই অন্ধকারের ভিতর এতক্ষণে আমি যাহা কিছু দেখিতে পাইতেছিলাম, তাহাও যেন আর দেখিতে পাইলাম না। আমার হস্তপদ কাঁপিতে লাগিল। নিকটস্থিত বৃক্ষ দেখিয়া বোধ হইতে লাগিল, যেন সেইস্থানে দাঁড়াইয়া আমাকে কেহ দেখিতেছে। বৃক্ষ হইতে পত্রস্খলনের শব্দে ভাবিতে লাগিলাম, যেন আমাকে ধরিবার নিমিত্ত কেহ আস্তে আস্তে আমার নিকট আগমন করিতেছে। দূরস্থিত শৃগাল কুক্কুরের শব্দে মনে হইতে লাগিল, আমাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত কে যেন অপরকে ডাকিতেছে। এইরূপে আমি আমার প্রকৃতজ্ঞান হারাইয়া কৃষ্ণলালের আদিষ্ট কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলাম। যাহা করিতেছি, তাহা ভাল কি মন্দ, তাহা বুঝিতে অক্ষম হইয়া কৃষ্ণলালের সাহায্য করিতে লাগিলাম। ক্ষণপরেই যে স্থান দিয়া কৃষ্ণলাল গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, সেইস্থান দিয়া সে দুই তিনটি বাক্স ভিতর হইতে আমার হস্তে প্রদান করিল। বাহির হইতে আমি উহা গ্রহণ করিয়া নিকটেই রাখিয়া দিলাম। পরিশেষে কৃষ্ণলালও সেইস্থান দিয়া বাহির হইয়া আসিল। প্রাচীর কাটা হইতে আরম্ভ করিয়া বাক্স বাহির করা পর্য্যন্ত সমস্ত কাৰ্য্যই বোধ হয়, অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যে শেষ হইয়া গেল
বাহিরে আসিয়া কৃষ্ণলাল তাহার সেই অস্ত্রের সাহায্যে নিমেষ মধ্যে সেই বাক্সগুলি নিঃশব্দে ভাঙ্গিয়া ফেলিল, তাহার ভিতর যে সমস্ত দ্রব্যাদি ছিল, তাহা লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমাকেও পুনরায় তাহার সঙ্গে লইয়া চলিল। রাত্রি তিনটা বা সাড়ে তিনটার মধ্যেই আমরা কৃষ্ণলালের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে আমাদিগের পরিহিত লালবস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া, আপন আপন বস্ত্র পরিধান করিলাম। লালবস্ত্র দুইখানি, এবং সেই সিঁদকাটিটি প্রথমেই কৃষ্ণলাল তাহার বাক্সের ভিতর বন্ধ করিল। পরিশেষে আনীত দ্রব্যগুলি উত্তমরূপে দেখিল। উহার ভিতর অতি অল্পই নগদ টাকা ছিল; কিন্তু সুবর্ণ ও রৌপ্যের অনেকগুলি অলঙ্কার ছিল। অলঙ্কারগুলি সে তাহার বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিল; কেবল নগদ যে কয়েকটি টাকা ছিল, কেবল তাহাই আমাকে প্রদান করিল ও কহিল, “ইহাতে তোমার দুইদিবসের খরচ চলিবে। ইহার মধ্যে অপর স্থান হইতে অপর অর্থ আনিয়া বা এই অলঙ্কারগুলি বিক্রয় করিয়া, তোমার অংশ তোমাকে প্রদান করিব। কিন্তু সাবধান! একথা তুমি কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না। যদি কোনরূপে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে তোমার ও আমার উভয়েরই সমান বিপদ জানিবে।” আমি তাহার কথায় সম্মত হইয়া রাত্রির অবশিষ্টাংশ সেইস্থানেই অতিবাহিত করিলাম। পরদিবস প্রাতঃকালে সেই নগদ টাকা কয়েকটিমাত্র সঙ্গে লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
দিবাভাগে জানিতে পারিলাম যে, পুলিস সেই সিঁদচুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে লিপ্ত হইয়াছে। দেখিলাম, কত লোককে কত কথা জিজ্ঞাসা করিতেছে। শুনিলাম, দাগিচোর ও বদমায়েসদিগের অনুসন্ধান ও তাহাদিগের খানা—তল্লাসি করিয়াছে। কিন্তু কোনস্থান হইতেই কোনরূপ সন্তোষজনক ফললাভ করিতে পারে নাই।
সেইদিবস সন্ধ্যার পর আমি পুনরায় কৃষ্ণলালের বাসায় গমন করিলাম, কিন্তু সেই সময়ে তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল না। জানিতে পারিলাম, বৈকালেই বাসা হইতে সে কোথায় গমন করিয়াছে। পরদিবস পুনরায় তাহার নিকট গমন করিলাম, সেই সময় তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তখন সে কহিল যে, অপহৃত সমস্ত দ্রব্যই সে বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছে; কিন্তু কোথায় বা কাহার নিকট বিক্রয় করিয়াছে, তাহা আমাকে তখন কহিল না। আমার প্রাপ্য অংশ বলিয়া, আমাকে একেবারে তিনশত টাকা প্রদান করিল ও কহিল, “যতদিবস পুলিসের গোলযোগ না মিটিয়া যায়, ততদিবস খরচপত্র বিশেষ বিবেচনার সহিত করিও। কারণ, তুমি অজস্র টাকা ব্যয় করিতেছ, একথা পুলিসের কর্ণগোচর হইলে, তোমাকে লইয়া টানাটানিতে ফেলিতে পারে।” কৃষ্ণলালের কথা বিশেষ যুক্তিপূর্ণ বিবেচনায় কিছুদিবসের নিমিত্ত অন্যায় খরচ বন্ধ করিয়া যেরূপভাবে চলিয়া আসিতেছিলাম, সেইরূপেই চলিতে লাগিলাম। ক্রমে পলিসের গোলযোগ মিটিয়া গেল। কাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে জানিতে না পারিয়া, ক্রমে পুলিস এই অনুসন্ধান পরিত্যাগ পূর্ব্বক অপর কার্য্যে মনোনিবেশ করিল।
এই ঘটনার পর আমি একদিবস কৃষ্ণলালের সহিত অন্ধকারময় রাত্রিতে চুরি করিতে গমন করিলাম। পূর্ব্বদিবসের ন্যায় সে দিবসও অনেকগুলি অলঙ্কারপত্র চুরি করিয়া আনিলাম। পূর্ব্বে কোটাঘরে সিঁদ দিয়া চুরি করা হইয়াছিল, এবার কিন্তু মাটীরঘরে সিঁদ দেওয়া হইল; উহা গোয়াড়ির একজন বেশ্যার ঘর। বেশ্যার অলঙ্কারপত্র যাহা ছিল, তাহা সমস্তই পূর্ব্বোক্ত উপায়ে অপহরণ করা হইল! পূর্ব্বে আমার মনে যেরূপ আতঙ্কের উদয় হইয়াছিল, এবার দেখিলাম, তাহার অনেক কম হইল। যাহা হউক, কৃষ্ণলাল পূর্ব্বোক্ত উপায়ে কোথা হইতে গহনাগুলি বিক্রয় করিয়া আনিল, ও আমাকে উপযুক্তরূপ অংশ প্রদান করিল। এ সিঁদচুরির অনুসন্ধানও পুলিস করিল; কিন্তু কাহার দ্বারা এ চুরি হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র অনুসন্ধান না পাইয়া, ক্রমে ইহারও অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিল।
এই সময়ে আমি কথায় কথায় একদিবস কৃষ্ণলালকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “অন্ধকার রাত্রি ভিন্ন তুমি কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হও না কেন? এবং লালবস্ত্র পরিধান না করিয়া চুরি করিতে বহির্গত হওই বা না কেন?” উত্তরে কৃষ্ণলাল কহিল, “আমাকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার তোমার কোন প্রয়োজন ছিল না; ইহার কারণ তুমি আপনা হইতেই ক্রমে জানিতে পারিতে। অন্ধকার রাত্রিতেই সিঁদচুরি করিবার উপযুক্ত সময়। জ্যোৎস্নাময় রাত্রিতে লোকে দূর হইতে দেখিতে পায়; কিন্তু অন্ধকার রাত্রিতে সেটি হয় না; কোন ব্যক্তির নিকট চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলেও সহজে সে দেখিতে পায় না। বিশেষতঃ যদি লালরঙ্গের বা কালরঙ্গের কোন বস্ত্র পরিধানে থাকে, তাহা হইলে নিতান্ত নিকটে দাঁড়াইয়া থাকিলেও কেহ দেখিতে পায় না। কিন্তু শ্বেতবস্ত্র পরিধান করিলে এই সুযোগ পাওয়া যায় না। এই কারণেই আমরা লালবস্ত্র ব্যবহার করিয়া থাকি।”
দ্বিতীয় চুরি করিবার কিছুদিবস পরেই পুনরায় তৃতীয় চুরিতে প্রবৃত্ত হইলাম। এবার দেখিলাম, আমার স্বাভাবিক ভয় দূরে পলায়ন করিয়াছে, এবং তাহার পরিবর্তে একটু সাহসও আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। বাগানের সংলগ্ন একটি পাকাবাড়ীতে চুরি করাই এবার সাব্যস্ত হইল। পূর্ব্বরূপ উপায়ে আমরা সেইস্থানে গমন করিলাম। বাগানের ভিতর বসিয়া পাকা প্রাচীরে কৃষ্ণলাল সিঁদকাটিতে আরম্ভ করিল। সামান্য পরিমাণ কাটা হইলে, সেই অস্ত্র আমার হস্তে প্রদান করিল, এবং কি প্রকারে উহা ব্যবহার করিতে হইবে, তাহা আমাকে শিখাইয়া দিল। সেই উপায় অবলম্বন করিয়া আমি অবশিষ্টটুকু কাটিয়া ফেলিলাম। আমার কার্য্য দেখিয়া কৃষ্ণলাল আমার উপর বিশেষ সন্তুষ্ট হইল, ও প্রথমে আমাকে বাহিরে রাখিয়া, নিজে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। গৃহের ভিতর হইতে কয়েকটি বাক্স প্রভৃতি বাহির করিয়া সে বাহিরে আসিল, ও আমাকে গৃহের ভিতর প্রবেশ করাইয়া দিয়া, অপর কয়েকটি দ্রব্য আনিতে কহিল।
ভয়ে ভয়ে আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া ভিতরস্থিত দ্রব্য বাহির করিয়া দিলাম ও পরিশেষে নিজেও বাহিরে আসিলাম।
প্রকৃতপক্ষে আজ আমি নিজহস্তে সিঁদচুরি আরম্ভ করিলাম। অপহৃত বাক্সাদি ভাঙ্গিয়া মূল্যবান যে সকল দ্রব্যাদি পাইলাম, তাহাই গ্রহণপূর্ব্বক কৃষ্ণলালের বাসায় গমন করিলাম। ভগ্ন বাক্স এবং সামান্য মূল্যের দ্রব্যাদি সেইস্থানেই পড়িয়া রহিল। পুলিস ইহারও অনুসন্ধান করিল, কিন্তু ফল কিছুই হইল না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অপহৃত দ্রব্যাদি কৃষ্ণলাল কোথায়, কি প্রকারে, এবং কাহার নিকট বিক্রয় করে, জানিবার নিমিত্ত আমার বিশেষ কৌতূহল জন্মিল। তখন আমার মনের কথা আমার গুরুকে কহিলাম। গুরু আমাকে সঙ্গে লইয়া পরদিবস আমিন বাজারের একজন পোদ্দারের নিকট গমন করিলেন। পোদ্দারের নাম আমি এইস্থানে প্রকাশ করিব না; কারণ, সেইস্থানে তাঁহার আত্মীয়গণ এখন বড়লোক বলিয়া পরিচিত আছেন। যাহা হউক, আমাকে দেখিয়া পোদ্দার কৃষ্ণলালকে জিজ্ঞাসা করিলেন “ইনি কে?” উত্তরে কৃষ্ণলাল কহিল, “ইনি এই কাৰ্য্যে আমার একজন প্রধান সহায়। ইহার নিকট আমার কোন কথা গুপ্ত নাই। কিন্তু আপনার সহিত ইহার পরিচয় না থাকায়, পরিচয় করিয়া দিবার নিমিত্ত আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। আপনি আমাকে যেরূপ বিশ্বাস করেন, ইহাকেও সেইরূপ বিশ্বাস করিতে পারেন।” এই বলিয়া কৃষ্ণলাল তাহার নিকটস্থিত গহনার পুঁটলিটি সেই পোদ্দারের হস্তে প্রদান করিল। পোদ্দার কোন কথা না বলিয়া আপনার দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমরাও সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
কৃষ্ণলাল সকল সময়েই প্রায় ভদ্রবেশে থাকিত। সকলেই জানিত, এ ব্যক্তি একজন মানসম্ভ্রম-বিশিষ্ট ভদ্রলোক, বৈষয়িক ব্যাপার উপলক্ষে সময় সময় ইহাকে এইস্থানে আসিতে হয়। সুতরাং ইহার উপর কি পুলিস, কি অপর ব্যক্তি কাহারই কখনও সন্দেহ হয় নাই।
যাহা হউক, সেই সময় আমরা সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিলাম বটে, কিন্তু সন্ধ্যার পরই পুনরায় কৃষ্ণলালের সহিত সেই পোদ্দারের নিকট গমন করিলাম। তিনি আমাদিগকে দেখিয়া দোকানের বাহিরে আসিলেন, এবং ভদ্রোচিত দুই একটি কথার পর এক বাণ্ডিল নোট কৃষ্ণলালের হস্তে প্রদান করিলেন। কৃষ্ণলাল নোটগুলি আপনার পিরাণের পকেটে রাখিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিল; আমিও তাহার সঙ্গে সঙ্গে রহিলাম। তাহার বাসায় আসিয়া সেই নোটগুলি সে গণিয়া দেখিল। দেখিল, উহা দশ টাকা করিয়া সাতশত টাকার নোট। সে নিজে চারিশত টাকা রাখিয়া, আমার অংশ তিনশত টাকা প্রদান করিল ও কহিল, “অপহৃত দ্রব্যের মূল্য চৌদ্দশত টাকা। যে পোদ্দার উহা গ্রহণ করিল, সে তাহার অংশ সাতশত টাকা বাদে অবশিষ্ট সাতশত টাকা আমাদিগকে প্রদান করিয়াছে। চোরাদ্রব্য বিক্রয়ের নিয়মই এই যে, অর্দ্ধেকমূল্যে উহা বিক্রয় করিতে হয়।”
এই ঘটনার পর আমরা উভয়ে মিলিয়া আর একটি চুরি করিলাম, কিন্তু মাল বিক্রয় করিতে এবার কৃষ্ণলাল নিজে গমন করিল না। চোরামাল লইয়া পোদ্দারের নিকট এবার আমিই গমন করিলাম। পূর্ব্বোক্ত উপায়ে পোদ্দারের নিকট সমস্ত অলঙ্কারগুলি রাখিয়া আসিলাম, এবং পরিশেষে সন্ধ্যার পর গিয়া টাকা আনিলাম। যাহা পাইলাম, উভয়েই নিয়মিতরূপে তাহা অংশ করিয়া লইলাম।
গোয়াড়ির ভিতর অল্পদিবসের মধ্যে এইরূপে চারিটি চুরি হওয়ায়, পুলিস এবং প্রজা সকলেই সবিশেষরূপে সতর্ক হইল। সেই সময় সেইস্থানে পুনর্ব্বার চুরি করিলে, ধৃত হইবার সম্ভাবনা বিবেচনা করিয়া কৃষ্ণলাল সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক, আপনার দেশে গমন করিল; এবং আমাকেও তাহার সহিত গমন করিতে অনুরোধ করিল। আমি মুসলমান হইলেও হিন্দুবন্ধুর প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, তাহার সহিত প্রস্থান করিলাম।
কৃষ্ণলালের বাড়ীতেই আমার বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইল। সেইস্থানেই আমি কিছুদিবস অতিবাহিত করিলাম। সেই স্থানে জানিতে পারিলাম, কৃষ্ণলালের অর্থ-সংস্থান যথেষ্ট থাকিলেও, সমাজের ভিতর সে তত গণমান্য ব্যক্তি ছিল না। যে বংশে তাহার জন্ম, সেই বংশ পাকাচোর কায়স্থ বলিয়া পরিচিত। সেই বংশের প্রায় অধিকাংশ লোকই চুরির উপর নির্ভর করিয়া জীবিকা-নির্ব্বাহ করিয়া থাকে। তাহাদের মধ্যে অনেকে অনেকবার ধৃত হইয়াছে, অনেকে জেলেও গমন করিয়াছে। সেইস্থানের পুলিস উহাদিগের উপর সর্ব্বদা কঠোর দৃষ্টি রাখিয়া থাকেন। কৃষ্ণলাল কিন্তু কখনও ধৃত হয় নাই। সে যেরূপভাবে সেইস্থানে অবস্থিতি করিত, তাহা দেখিয়া তাহাকে চোর বলিয়া কেহই বিশ্বাস করিত না। নিজ যশোহরে তাহার একখানি কাপড়ের দোকান ছিল। কেনাদাম হইতেও অল্পমূল্যে তিনি কাপড় বিক্রয় করিতেন; সুতরাং অধিক বিক্রয় হইত, কারবারও বেশ চলিত। সকলে জানিত, কারবার উপলক্ষেই সে বাড়ী-ঘর ও বিষয়-সম্পত্তি করিয়াছে। তাহার ভিতরকার অবস্থা কেহই জানিত না, সুতরাং তাহার উপর কাহারই অবিশ্বাস ছিল না, এবং পুলিসও তাহার উপর কঠোর দৃষ্টিও রাখিতেন না। কৃষ্ণলাল তাহার জাতীয় কোন লোকের সহিত কখন মিলিত না।
প্রায় মাসাবধি আমি কৃষ্ণলালের বাড়ীতে অবস্থিতি করিয়া, পরিশেষে তাহার সহিত তাহার যশোহরের দোকানে গমন করিলাম। সেইস্থানেও প্রায় পনরদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। এই কয়েক দিবসের মধ্যে কেবলমাত্র একদিবস অন্ধকার রাত্রিতে কৃষ্ণলালের সহিত বাহির হইয়াছিলাম, এবং চারি পাঁচশত টাকা মূল্যের অলঙ্কার প্রভৃতি চুরি করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। কৃষ্ণলালের নিকট হইতে চোরাদ্রব্য খরিদ করিতে পারে, এরূপ কোন ব্যক্তি সেই স্থানে না থাকায়, সেই সকল অপহৃতদ্রব্য সেই সময় বিক্রীত হইল না; পরিশেষে আমিন বাজারের সেই পোদ্দারের নিকট সে সকল বিক্রয় করিতে হইল।
এই ঘটনার কিছুদিবস পরেই আমরা উভয়েই পুনরায় কৃষ্ণনগরে গমন করিলাম। সে যাত্রায় সেইস্থানে কেবলমাত্র একস্থান হইতে কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলাম। তৎপরে কিছুদিবসের মধ্যেই কৃষ্ণলাল অসুস্থ হইয়া পড়িল। সুতরাং বাধ্য হইয়া তাহাকে আপনার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিতে হইল। অসুস্থ অবস্থায় কৃষ্ণলালকে একাকী পাঠাইয়া দিতে আমার সাহস হইল না, আমিও তাহার সহিত গমন করিলাম। বাড়ীতে উপস্থিত হইবার দুই একদিবস পরেই কৃষ্ণলালের রোগ প্রবলবেগ ধারণ করিল, এবং অসময়েই সে কালগ্রাসে পতিত হইল। আমার প্রাণের বন্ধুকে হারাইয়া, আমি আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। কিছু দিন পরেই শুনিতে পাইলাম, কৃষ্ণলালের মৃত্যুর পরই তাহার দোকানের কর্ম্মচারীগণ তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়াছে। যে মহাজনের নিকট হইতে কাপড় আনা হইত, তাঁহার নিকট অনেক টাকা বিক্রয় পড়ায়, তিনি নালিস করিয়া কৃষ্ণলালের যথাসর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া লইয়াছেন। সুতরাং কৃষ্ণলালের স্ত্রী সেই গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া অপর স্থানে প্রস্থান করিয়াছে, এবং ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া আপনার জীবনের অবশিষ্টাংশ অতিবাহিত করিতেছে। কৃষ্ণলালের সংসারে তাহার স্ত্রী ব্যতীত একটি বিংশতি বৎসর বয়স্ক পুত্র এবং চতুর্দ্দশ বৎসর বয়স্কা একটি বিধবা কন্যা ছিল। পুত্রটিকৃষ্ণলালের মৃত্যুর প্রায় চারিমাস পূর্ব্বে ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছিল। কন্যাটি সেইস্থানের জনৈক দুশ্চরিত্রের হস্তে পড়িয়া, আপনার কুল ও ধর্ম্মে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়া কোথায় প্রস্থান করিয়াছিল, তাহার আর অনুসন্ধান হয় নাই। যাহা হউক, কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, যে কৃষ্ণলালের স্ত্রী প্রথম প্রথম অনেক কষ্টে আপনার জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়াছিল। কিন্তু পরিশেষে তাহাকে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিতে হইয়াছিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
কৃষ্ণলালের এইরূপ অবস্থা ঘটিবার পর কিছুদিবস আমি কৃষ্ণনগরে অবস্থিতি করিয়া, অসৎ উপায়ে সঞ্চিত যে সকল অর্থ আমার নিকট ছিল, তাহাই ব্যয় করিয়া নিজের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে লাগিলাম। অল্পদিবসের মধ্যে সমস্ত অর্থ ব্যয়িত হইয়া গেল। এরূপ আমি একাকীই আপনার ব্যবসা চালাইবার চেষ্টা করিলাম। কাহারও সাহায্য ব্যতীত একাৰ্য্য একাকী সম্পন্ন করিতে পারি কি না, প্রথমে একবার তাহাই ভাবিলাম। পরিশেষে স্থির করিলাম, আমার অভীপ্সিত কর্ম্মে কৃতকার্য হইতে পারি বা না পারি, একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া একদিন আমার পরিচিত একটি লোকের গৃহে রাত্রিযোগে সিঁদ দিলাম; তৎপরে সিঁদের ভিতর দিয়া গৃহের ভিতরও প্রবেশ করিলাম। গৃহের ভিতর হইতে একটি বাক্স আনিয়া সিঁদের নিকট রাখিয়া, অপর আর একটি বাক্স আনিবার নিমিত্ত যেমন ভিতরে গেলাম, অমনি গৃহস্বামী জানিতে পারিলেন, তাঁহার গৃহে চোর প্রবেশ করিয়াছে। তিনি অমনি “চোর চোর” করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিলেন। আমি অন্য বাক্স আনিবার আশা পরিত্যাগ করিয়া, সেই গৃহ হইতে প্রস্থানের উপায় দেখিতে লাগিলাম। দ্রুতবেগে কোনদিক দিয়া প্রস্থান করিবার উপায় ছিল না; কারণ গৃহের সমস্ত দ্বারই বন্ধ ছিল। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমি সিঁদের নিকট আসিলাম, কিন্তু শীঘ্র সিঁদের ভিতর দিয়া বাহিরে আসিতে সমর্থ হইলাম না। পূর্ব্বে যে বাক্সটি আনিয়া আমি সিঁদের মুখে রাখিয়াছিলাম, তাহাতেই আমার গতিরোধ করিল। সেই বাক্সটি স্থানান্তরিত করিয়া পথ পরিষ্কার করিতে করিতে আমাকে ধরিবার নিমিত্ত এক ব্যক্তি সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল; কিন্তু হঠাৎ সাহস করিয়া আমার নিকট আসিতে পারিল না। সেই সুযোগে কোন উপায়ে আমি সেই সিঁদের ভিতর দিয়া, বাহিরে আসিয়া পলায়ন পূর্ব্বক আমার প্রাণরক্ষা করিলাম। সেইদিবস হইতে আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম যে, একাকী এরূপকার্য্যে আর কখন প্রবৃত্ত হইব না। বিশেষতঃ সিঁদের ভিতর দিয়া গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমে দ্বার প্রভৃতি খুলিয়া পলায়নের পথ উন্মুক্ত করিয়া রাখিব, ও পরিশেষে চুরি করিতে প্রবৃত্ত হইব।
আমার প্রথম কার্য্যেই এইরূপ বাধাপ্রাপ্ত হইয়া, আমি সেইস্থানে চুরি করিতে আর সাহসী হইলাম না। রাজধানীতে গিয়া আমার কার্য্যের যদি কোনরূপ সুযোগ করিতে পারি, এই ভাবিয়া কৃষ্ণনগর পরিত্যাগ পূর্ব্বক কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। ইহার বহুদিবস পূৰ্ব্ব হইতে আমি আমার শ্বশুরবাড়ীতে গমন করিতাম না। সেখানকার কাহার বা আমার স্ত্রীর কোন প্রকার সংবাদ রাখিতাম না। কিন্তু পরে শুনিয়াছিলাম, আমার শ্বশুরের মৃত্যুর পর আমার স্ত্রী অন্য পতি গ্রহণ করিয়াছে।
ইতিপূৰ্ব্বে আমি কখনও কলিকাতায় আসি নাই, কিন্তু লোক-পরম্পরায় শুনিলাম, কলিকাতার ভিতর মেছুয়া—বাজারে চোরের প্রধান আড্ডা। আমি একেবারেই মেছুয়া বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে থাকিবার স্থান অনুসন্ধান করায়, একটি স্ত্রীলোকের বাড়ীতে একখানি গৃহও পাইলাম। আমি যে গৃহে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম, তাহার নিকট আরও কয়েকখানি গৃহ ছিল। দেখিলাম, উহাও অপর কয়েকজন লোকের দ্বারা অধিকৃত। আমি মুসলমান, তাহারাও। মুসলমান; সুতরাং সহজেই তাহাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় হইয়া গেল। কথায় কথায় আমি একদিবস তাহাদিগকে কহিলাম, তোমরা প্রত্যহই রাত্রিকালে বাহির হইয়া যাও, ও পরদিবস প্রাতঃকালে প্রত্যাগমন কর। যদি তোমাদিগের কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে আমিও তোমাদিগের সহিত যাইতে পারি। আর বোধ হয়, তোমাদিগের কার্য্যের কিয়ৎ পরিমাণে সাহায্য করিতেও সমর্থ হই। এই কয়েকদিবস নিষ্কর্ম্মার ন্যায় বসিযা বসিয়া কেবল আপনার অর্থ নষ্ট করিতেছি! আমাদিগের মত লোকের ইহা কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে।
আমার কথা শুনিয়া উহারা আমার মনের ভাব বুঝিল এবং তাহাদিগের সহিত আমাকে লইয়া যাইতেও সম্মত হইল। সেইদিবসই রাত্রিকালে আমি তাহাদিগের সহিত বহির্গত হইলাম, ও সমস্ত রাত্রি তাহাদিগের সহিত ঘুরিয়া বেড়াইলাম; কিন্তু তাহাদিগের কার্য্য দেখিয়া তাহাদিগের উপর আমার ঘৃণা হইল। দেখিলাম, যাইতে যাইতে সুযোগমতে তাহারা যাহা কিছু পাইতে লাগিল, তাহাই অপহরণ করিতে লাগিল। একটি ঘটা দেখিলে কেহ বা তাহা লইল, একটি মুরগি দেখিলে কেহ বা সেইটিই অপহরণ করিল; এইরূপভাবে নিতান্ত সামান্য সামান্য কয়েকটি দ্রব্য অপহরণ করিয়া, পরদিবস প্রাতঃকালে তাহা বিক্রয় করিয়া ফেলিল। এইরূপ উপায়ে যাহা কিছু উপার্জ্জিত হইল, তাহাই সকলে মিলিয়া ভাগ করিয়া লইল, আমাকেও এক অংশ প্রদান করিল। আমার বোধ হয়, দুই তিন আনার অধিক কেহই পাইল না। যে ব্যক্তি এক একদিবস শত শত টাকা অপহরণ করিয়াছে, তাহার এরূপ চুরি ভাল লাগিবে কেন? সেইদিন হইতেই আমি উহাদিগের সঙ্গ পরিত্যাগ করিলাম ও কহিলাম, “অন্নবিনা মরিতে হয় সেও ভাল; তথাপি জীবন থাকিতে এরূপ নীচকার্য্যে কখনও হস্তক্ষেপ করিব না।”
সেইদিবস হইতে আমি আমার উপযুক্ত সঙ্গীর অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। ক্রমে অনেক চোরের সহিত মিশিতে লাগিলাম। তাহাদিগের নিকট হইতে আবার অপর চোরের সন্ধান পাইতে লাগিলাম, তাহাদিগের সহিত ও সাক্ষাৎ করিতে লাগিলাম। এইরূপে কিছুদিবস অনুসন্ধান করিতে করিতে জানিতে পারিলাম, কালীপ্রসন্ন নামক একজন প্রসিদ্ধ সিঁদেল চোর অতি অল্পদিবসমাত্র হইল, জেল হইতে খালাস হইয়াছে। তখন সন্ধান করিয়া ক্রমে কালীপ্রসন্নের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, ক্রমে তাহার সহিত আমার আলাপ-পরিচয় হইল। ক্রমে উভয়েই উভয়ের বাসায় যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিলাম
পল্লীগ্রামের লোক কলিকাতায় আসিলে, অধিকাংশ লোকেরই যেরূপ দশা উপস্থিত হয়, আমারও ক্রমে সেই দশা উপস্থিত হইল। আমি ওম্দা নাম্নী জনৈক মুসলমানী বারবণিতার প্রণয়ে প্রকৃষ্টরূপে আবদ্ধ হইলাম। বহুদিবস হইতে আমার চরিত্রদোষ উপস্থিত হইয়াছিল; কিন্তু এই মুসলমানীকে আমি যেরূপ অন্তরের সহিত ভালবাসিতে লাগিলাম, সেরূপ ভালবাসা, অপরে পাওয়া দূরে থাকুক, আমার বিবাহিতা স্ত্রীও কখন প্রাপ্ত হয় নাই। রাত্রিদিনের মধ্যে প্রায় অধিকাংশ সময় আমি তাহারই নিকট উপস্থিত থাকিতাম। ক্ষণকালের নিমিত্ত ওম্দা অন্তরালে গমন করিলে, সর্ব্বদিক অন্ধকার দেখিতাম। চোরের হৃদয়ে কেন যে এরূপ ভালবাসার সঞ্চার হইল, এবং রমণীর প্রাণই বা কেন যে চোরের উপর মজিল, তাহা, হে খোদা! তুমি ভিন্ন আর কে বলিতে পারে?
ওম্দার সহিত পরিচয় হওয়ার পর আমি মেছুয়া বাজার পরিত্যাগ করিলাম, এবং যে স্থানে ওম্দা থাকিত, সেইস্থানেই গমন করিয়া দিনযাপন করিতে লাগিলাম। ওমদা বারবণিতা হইলেও, আমার সহিত সহধর্মিণীর ন্যায় ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিল। আমিও সাধ্যমত তাহার সুখস্বচ্ছন্দের দিকে বিশেষরূপে দৃষ্টি রাখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। কৃষ্ণলালের মৃত্যুর অনেক দিবস পরে কালীপ্রসন্নের সহিত মিলিত হইয়া, পুনরায় পূর্ব্বাভ্যস্ত কর্ম্মক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইলাম। কালীপ্রসন্নের সহিত যদিচ আমার পূর্ব্ব হইতে আলাপ-পরিচয় ছিল না; কিন্তু যখন উভয়েই এক-ব্যবসায়ী তখন উভয়ের মধ্যে প্রণয় জন্মিতে অধিক বিলম্ব হইল না। বস্তুতঃ উভয়ে উভয়কেই বিশ্বাস করিলাম।
কালীপ্রসন্নেরও বাসস্থান ছিল, যশোহর জেলার মধ্যস্থিত কোন একখানি ক্ষুদ্রপল্লীতে। কিন্তু বাল্যকাল হইতেই সে কলিকাতায় বসবাস করিত, এবং কলিকাতাতেই আপনার কার্য্য প্রথমে আরম্ভ করিয়াছিল। অন্য লোকের সহিত মিলিত হইয়া সে অনেক চুরি করিয়াছে, এবং অনেকবার ধৃত হইয়া জেলেও গমন করিয়াছে।
যাহা হউক, এক্ষণে উভয় বন্ধু মিলিত হইয়া, কিছু দিবস ধরিয়া সহরের নানাস্থানে রাত্রিদিন পরিভ্রমণ পূর্ব্বক পরিশেষে একটি স্থান স্থির করিলাম। আমাদিগের মধ্যে বন্দোবস্ত স্থির হইয়া গেল যে, এইবার কৃষ্ণপক্ষ আসিলেই আমরা কার্য্য আরম্ভ করিব।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
যে সুযোগের প্রত্যাশায় আমরা অপেক্ষা করিতেছিলাম, ক্রমে সেই সুযোগ আসিয়া উপস্থিত হইল। অমাবস্যার অন্ধকার রাত্রির আশ্রয় লইয়া, আমরা উভয়েই বহির্গত হইলাম। প্রজ্বলিত গ্যাসালোকের কৃপায় সহরের ভিতর অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার রাত্রিতে অধিক তারতম্য নাই; সুতরাং সহরের ভিতর আমরা প্রথমে দৃষ্টি না করিয়া সহরতলিতে গমন করিলাম। বলা বাহুল্য, আমরা পূর্ব্বে যে গৃহ স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম, তাহা সহরতলিতেই। বাগানের সংলগ্ন একটি পাকা বাড়ীতে সিঁদ দিয়া আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম, কালীপ্রসন্ন বাহিরেই রহিল। গৃহের ভিতর বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি যাহা ছিল, তাহার কতক বা সিঁদের ভিতর দিয়া বাহির করিয়া দিলাম, কতক বা গৃহের দ্বার খুলিয়া বাহিরে লইয়া গেলাম। তৎপরে বাগানের ভিতর গিয়া সমস্তই ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। তাহার ভিতর মূল্যবান দ্রব্য যাহা পাইলাম, তাহা লইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। আমরা অনেক দিবস যেমন বিনাকৰ্ম্মে বসিয়াছিলাম, এই চুরিতেই তাহার অনেক পোষাইয়া গেল।
অপহৃত দ্রব্যের মধ্যে স্বর্ণ ও রৌপ্যের যে সকল অলঙ্কার ছিল, কালীপ্রসন্ন পরদিবস তাহার সমস্ত বিক্রয় করিয়া ফেলিল, কিন্তু কোথায় যে বিক্রয় করিল, তাহার কিছুই আমি জানিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করায় কালীপ্রসন্ন কহিল, “এই সহরের ভিতর আমার একটি লোক আছেন, যে সকল দ্রব্য আমি অপহরণ করিয়া আনি, তাহা তাঁহারই নিকট বিক্রয় করিয়া থাকি। সময়মত একদিবস তোমাকে সঙ্গে লইয়া, আমি তাঁহার সহিত তোমার আলাপ-পরিচয় করিয়া দিব।”
কালীপ্রসন্নের সহিত মিলিত হইয়া, সহরতলীর ভিতর একে একে অনেকগুলি চুরি করিলাম। তাহার কতকগুলি দ্রব্য কালীপ্রসন্ন বিক্রয় করিয়া ফেলিল, কতক আমাদিগের নিকট রহিয়া গেল। অনেক চুরি হওয়ায় সহরতলীতে বিশেষ গোলযোগ হইয়া উঠিল, পুলিস বিশেষরূপে সতর্ক হইল; পাহারার নিমিত্ত আরও অনেক পুলিসের বন্দোবস্ত হইল। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমরা রাজধানী পরিত্যাগ পূর্ব্বক পুনরায় কৃষ্ণনগরে গমন করিলাম। সেইস্থানে উপস্থিত হইয়াই পুনরায় সেইস্থানে চুরি আরম্ভ করিলাম। কখন নগরের মধ্যে, কখন পল্লীগ্রামের ভিতর, যখন যেখানে সুযোগ পাইতে লাগিলাম, সেইস্থানেই তখন চুরি করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আমাদিগের অত্যাচারে সহরতলী—বাসীগণ যেমন জ্বালাতন হইয়াছিল, তেমনি নদীয়া, যশোহর, বর্দ্ধমান ও হুগলী জেলার অনেক স্থানের লোকগণ ক্রমে সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়া পড়িতে লাগিল।
আমরা নানাস্থানে নানারূপে চুরি করিতে লাগিলাম সত্য, কিন্তু অপহৃতদ্রব্য সমস্ত বিক্রয় করা ক্রমে অসম্ভব হইয়া পড়িতে লাগিল। কালীপ্রসন্ন যাহার নিকট চোরা দ্রব্য বিক্রয় করিত, সে একজন নিতান্ত সামান্য দোকানদার ছিল। একমাসের মধ্যে পাঁচশত টাকার অধিক দ্রব্য গ্রহণ করিবার তাহার ক্ষমতা ছিল না। সুতরাং আমাদিগের নিকট অলঙ্কার প্রভৃতি অনেক দ্রব্য জমিয়া গেল। তখন অনন্যোপায় হইয়া সেই সকল দ্রব্যাদি লইয়া আমি আমিনবাজারের আমাদিগের সেই পুরাতন পোদ্দারের দোকানে গমন করিলাম। সেইস্থানে আমার পরিচিত সেই পোদ্দারকে দেখিতে পাইলাম না, সেই গৃহে অন্য আর এক ব্যক্তি দোকান করিয়াছে। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, আমাদিগের পরিচিত সেই পোদ্দারের যথাসৰ্ব্বস্ব পুড়িয়া গিয়াছে। সে নিজে অন্ধ হইয়া মুষ্টিভিক্ষার প্রত্যাশী হইয়াছে। কোনদিন এক সন্ধ্যা তাহার আহার জুটে, কোনদিন বা তাহাও জুটে না। এইরূপ অবস্থা শুনিয়া সেই পোদ্দারের সহিত সাক্ষাৎ করা একেবারে অনাবশ্যক বিবেচনা করিয়া, অলঙ্কারপত্র সমভিব্যাহারে পুনরায় কলিকাতায় আগমন করিলাম।
এখন আমাদিগের অন্যায় ব্যয় অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। মাসে চারি পাঁচশত টাকায় আমাদিগের দুইজনের কোন প্রকারেই চলে না। সুতরাং অপহৃতদ্রব্য যাহাতে আর অধিক বিক্রয় করিতে পারি, তাহার উপায় দেখিতে হইল। সুযোগমত যেখানে সেখানে ক্রমে ক্রমে অপহৃত অলঙ্কারাদি বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিলাম।
কালীপ্রসন্ন একজন সৰ্ব্বজন-পরিচিত প্রসিদ্ধ সিঁদেল চোর, কয়েকবার জেলেও গমন করিয়াছে। জেল হইতে কালীপ্রসন্ন মুক্ত হওয়ার কিছুদিবস পর হইতে নানাস্থানে সিঁদচুরি আরম্ভ হইয়াছিল। কাজেই পুলিস কালীপ্রসন্নের উপর সন্দেহ করিয়া, পরিশেষে তাহার পশ্চাৎ গুপ্তচোর নিযুক্ত করিল। আমি সর্ব্বদা কালীপ্রসন্নের নিকট গমন করিতাম। কালীপ্রসন্নও সর্ব্বদা আমার নিকট আগমন করিত। ইহাও পুলিস ক্রমে জানিতে পারিল, এবং গুপ্তচোর নিযুক্ত করিয়া আমার গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল।
একদিবস কালীপ্রসন্ন কয়েকখানি অপহৃত অলঙ্কার বিক্রয় করিবার নিমিত্ত গমন করিতেছিল; পথের মধ্যে পুলিস হঠাৎ তাহাকে ধরিয়া তাহার খানা-তল্লাসি করিল। সন্ধানে অলঙ্কার কয়েকখানি তাহার নিকট হইতে বাহির হইয়া পড়িল; কালীপ্রসন্ন ধৃত হইয়া থানায় প্রেরিত হইল।
সেইদিবস রাত্রিকালে কয়েকজন পুলিস-কর্ম্মচারী আমার বাড়ীতে আসিয়া, আমাকেও ধৃত করিল। আমি ও ওম্দা একই গৃহে থাকিতাম, তাহার সেই গৃহ উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিল; কিন্তু নগদমুদ্রা ভিন্ন অপর কোন অপহৃত দ্রব্য আমার গৃহ হইতে পাইল না।
যে কয়েকজন পুলিস-কর্ম্মচারী আমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একজন আমাকে অন্তরালে লইয়া গেলেন। এই কর্ম্মচারীর বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসরের ন্যূন নহে, জাতিতে মুসলমান। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, ঠগীবিভাগের ইনি একজন উপযুক্ত দারোগা। সেই কর্ম্মচারী আমাকে কহিলেন, “তুমি জান, আমরা হঠাৎ আসিয়া কেন তোমাকে ধৃত করিলাম?”
আমি। না!
কৰ্ম্মচারী। চুরি করিয়া তুমি জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছ, এই নিমিত্তই আমরা তোমাকে ধরিয়াছি।
আমি। তবে কি আপনি বলিতে চাহেন, আমি চোর? ভদ্রলোককে এরূপভাবে চোর বলা আপনার উচিত নহে।
কর্ম্মচারী। আমি তোমাকে চোর বলিতেছি না, তোমার প্রিয় সহচর কালীপ্রসন্নই তোমাকে চোর বলিতেছে।
আমি। কালীপ্রসন্ন আমাকে চোর বলিতেছে? কালীপ্রসন্ন কে?
কর্ম্মচারী। তোমার সঙ্গী।
আমি। আমার সঙ্গী? আমি হইলাম মুসলমান, কালীপ্রসন্ন হিন্দু, সে আমার সঙ্গী হইবে কি প্রকারে?
কর্ম্মচারী। অন্য কোন প্রকারের সঙ্গী না হইতে পারে, কিন্তু চরি করিবার সঙ্গী।
আমি। মহাশয়! আপনি এ প্রকার অন্যায় বলিবেন না।
“কেবল বলিব না, কিছু দেখাইবও।” এই বলিয়া কৰ্ম্মচারী কয়েকখানি অলঙ্কার আপনার নিকট হইতে বাহির করিয়া আমাকে দেখাইলেন ও কহিলেন, “তুমি আর মিথ্যা কথা বলিতেছ কেন? কালীপ্রসন্ন এই গহনাগুলি বিক্রয় করিবার সময় ধৃত হইয়াছে। তুমি যাহাকে বন্ধু বলিয়া বিশ্বাস কর, সে আপনার প্রাণ বাঁচাইবার নিমিত্ত তোমার উপর সমস্ত দোষ নিক্ষেপ করিয়া বলিয়াছে যে, তুমিই এই সকল অলঙ্কার অপহরণ করিয়া, তাহার নিকট বিক্রয় করিবার নিমিত্ত প্রদান করিয়াছ। কালীপ্রসন্ন দাগিচোর, কিন্তু তুমি ভাল মানুষের ছেলে; তুমি যদি প্রকৃতকথা না বল, তাহা হইলে তোমাকে জেলে যাইতে হইবে। তোমার ন্যায় ভদ্রলোককে জেলে দিয়া, আমাদিগের কোন লাভ নাই। অথচ যে ব্যক্তি পুরাতন চোর, এবং বন্ধুর সহিত এরূপভাবে বিশ্বাস-ঘাতকতা করে, তাহাকে জেলে প্রেরণ করা আমাদের কর্তব্য। কোথা হইতে কালীপ্রসন্ন এই সকল দ্রব্য চুরি করিয়া আনিয়াছে, তাহা কালীপ্রসন্ন নিশ্চয়ই তোমাকে বলিয়াছে। আর তাহা যদি তুমি আমাদিগকে বলিয়া দেও, তাহা হইলেই তোমার মঙ্গল। আমি মুসলমান হইয়া এই বৃদ্ধবয়সে শপথ করিয়া বলিতেছি যে, এই সকল দ্রব্য কোথা হইতে সে চুরি করিয়া আনিয়াছে, এই কথা আমাকে বলিয়া দিলে তোমার কোন বিপদ হইবে না; নতুবা তোমাকেই জেলে যাইতে হইবে।”
ইতিপূৰ্ব্বে আমি পুলিসের হস্তে কখনও পড়ি নাই, সুতরাং পুলিস যে কি প্রকারের জীব, তাহাও আমি জানিতাম না। আমি সেই মুসলমানের শপথের উপর বিশ্বাস করিয়া, কোথা হইতে সেই সকল দ্রব্য চুরি করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাকে বলিয়া দিলাম। আমার কথা শুনিয়া বৃদ্ধ কহিলেন “আচ্ছা, তুমি আমার সঙ্গে আইস। যে স্থানের কথা তুমি বলিতেছ, সেইস্থানে গমন করিয়া যদি জানিতে পারি তোমার কথা প্রকৃত, তাহা হইলে তোমাকে অব্যাহতি প্রদান করিব। নতুবা কালীপ্রসন্ন ও তোমার উভয়েরই সমান দশা হইবে।”
এই বলিয়া আমার কথিত স্থানে আমাকে লইয়া গেলেন। সেইস্থানে আমার কথা প্রকৃত বলিয়া প্রমাণিত হইল কিন্তু সে কর্ম্মচারী আমাকে ছাড়িলেন না। যে থানায় কালীপ্রসন্ন ছিল, আমাকেও সেই থানায় লইয়া গেলেন।
জানি না, সেইস্থানে উঁহারা কালীপ্রসন্নকে কিরূপ কহিলেন; কিন্তু দেখিলাম, কালীপ্রসন্ন ভীষণক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া কৰ্ম্মচারীগণ সমভিব্যাহারে আমার নিকট আগমন করিল, এবং কহিল “কাফের! আমি তোরে যেরূপ বিশ্বাস করিয়াছিলাম, তুই সেইরূপ কার্য্যই করিয়াছিস্! আমি এই সকল দ্রব্যাদি চুরি করিয়া আনিয়াছি, আর তুই তাহার কিছুই জানিস্ না। এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এ আমার কোনরূপেই আর নিস্তার নাই; কিন্তু যে বন্ধুর ভান করিয়া এইরূপ অবিশ্বাসের কার্য্য করে, আমি তাহার উপর দয়া করিতে চাহি না।” এই বলিয়া, আমি তাহার সহিত যে যে স্থানে সিঁদ দিয়া চুরি করিয়াছিলাম, এক এক করিয়া সেই চারি পাঁচ স্থানের কথা সে বলিয়া দিল।
কালীপ্রসন্নের কথা শুনিয়া আমার ক্রোধও প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তাহার কথায় আমি নিতান্ত ক্রোধান্ধ হইয়া কলিকাতা, নদীয়া প্রভৃতি স্থানে উভয়ে মিলিয়া যে সকল সিঁদ দিয়াছিলাম, এক এক করিয়া তাহার বত্রিশটির কথা বলিয়া দিলাম।
পুলিস কর্মচারীগণ আমাদিগের উভয়ের কথা লিখিয়া লইয়া অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। আমাদিগের উভয়কেই ভিন্ন ভিন্ন স্থানে রাখিয়া দিলেন। মোকদ্দমার দিন মাজিষ্ট্রেট সাহেবের এজলাস ভিন্ন আমাদিগের উভয়ের মধ্যে আর দেখাশুনা হইল না।
দেখিলাম, আমাদিগের বিরুদ্ধে কলিকাতায় এবং নদীয়াতে প্রায় চল্লিশটি মোকদ্দমা রুজু হইল। প্রথম এক মোকদ্দমার বিচার হইল—কলিকাতায়। ইংরাজী ১৮৭২ সালের ২৪শে এপ্রেল তারিখে এই মোকদ্দমার বিচার শেষ হইল। ইহাতে আমার উভয়েই ছয়মাসের নিমিত্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলাম।
দ্বিতীয় মোকদ্দমার বিচার হইল—নদীয়া জেলায়। উক্ত সেনের ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখে দ্বিতীয় মোকদ্দমার বিচারে আমরা উভয়েই দুই দুই বৎসরের নিমিত্ত কারারুদ্ধ হইলাম।
তৃতীয় এবং অবশিষ্ট কতকগুলি মোকদ্দমার বিচার একত্র সেই নদীয়া জেলাতেই হইল। অনেক সাক্ষীর এজাহার গৃহীত হওয়ার পর, আমরা দোষী সাব্যস্ত হইলাম। সেই সনের ৩০শে সেপ্টেম্বর তারিখে জজসাহেব রায় প্রকাশ করিলেন। উহাতে কঠিন পরিশ্রমের সহিত চতুৰ্দ্দশ বৎসরের নিমিত্ত আমাদিগকে জেলে গমন করিতে হইল। তিন দফায় আমাদিগের কারাবাস হইল—সাড়ে ষোল বৎসর করিয়া।
নবম পরিচ্ছেদ
কঠোর পরিশ্রমের সহিত কারাবাস দণ্ডে দণ্ডিত হইয়া কয়েক দিবসমাত্র আমরা নদীয়ার জেলে উভয়ে একত্র অবস্থিতি করিলাম। সেই সময় জানিতে পারিলাম, পুলিস চক্রান্তে আমাদিগের উভয়ের মধ্যে এইরূপ বিবাদ উপস্থিত হইয়াছিল, এবং সেই বিবাদের ফল এই কারাবাস।
কারাবাসের নিমিত্ত আমার যতদূর কষ্ট না হউক, ওম্দাকে যে আর দেখিতে পাইব না, এই নিমিত্ত মন কাঁদিতে লাগিল। তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া চিরদিবসের নিমিত্ত বিদায় লইবার ইচ্ছা হইল। আমার মনের ভাব জেলের কর্ম্মচারীগণকে কহিলাম। তাঁহারা কেহই আমার দুঃখ বুঝিলেন না, অধিকন্তু আমাকে কৌতূক-বিদ্রূপ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের এই ব্যবহার দেখিয়া আমার মনে আরও কষ্ট হইল; তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম,—যেরূপ পারি, জেল হইতে পলায়ন করিয়া ওম্দার নিকট গমন করিব। আমার পাপকার্য্যের কথা তাহার নিকট সমস্ত বিবৃত করিয়া, তাহার নিকট হইতে চিরদিবসের বিদায় গ্রহণ করিব, মনে মনে এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া জেল হইতে পলায়নের সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। চুরি করিতে করিতে আমার হৃদয় অতুল সাহসে পূর্ণ হইয়াছিল, শরীরেও যথেষ্ট বল ছিল। সুযোগক্রমে একদিবস আমি জেলের প্রাচীরের উপর উঠিলাম, ও সেইস্থান হইতে একলম্ফে বাহিরে পতিত হইলাম; কিন্তু পলায়ন করিতে পারিলাম না। সেইস্থানে একজন কর্ম্মচারী কয়েকজন কয়েদীকে লইয়া কি কার্য্য করিতেছিলেন; প্রাচীরের উপর হইতে আমাকে পতিত হইতে দেখিয়া তিনি আমাকে ধৃত করিলেন। জেল হইতে পলাইবার উদযোগ করা অপরাধে পুনরায় আমি মাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলাম। পূর্ব্বোক্ত ১৮৭২ সালের ৩রা অক্টোবর তারিখে আমার কারাবাস আরও পনর মাস বাড়িয়া গেল।
যাহা হউক, নদীয়ার জেল হইতে আমাকে হরিণ-বাড়ীর জেলে পাঠাইয়া দিল। আর কালীপ্রসন্নকে আলিপুরের জেলে প্রেরণ করিল। যে দিবস হইতে আমরা উভয়ে উভয় জেলে প্রেরিত হইলাম, সেইদিন হইতে আমাদিগের আর দেখা সাক্ষাৎ হইল না। জানি না, কালীপ্রসন্ন এখন কিরূপ অবস্থায় কোথায় আছে?
জেল হইতে আমি একবার পলাইবার চেষ্টা করিয়াছি, এই নিমিত্ত সাদা টুপির পরিবর্তে আমাকে লাল টুপি পরিতে হইল। পাছে আমি পুনরায় পলায়ন করি, এই ভয়ে জেলের ভিতর আমার নিমিত্ত স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত হইল। কিন্তু আমার হৃদয়ে যে প্রবলস্রোত বহিতেছিল, যাহার নিমিত্ত আমার কারাবাস আরও প্রায় দেড়বৎসর বাড়িয়া গেল, সেই স্রোতের প্রবলবেগ কোনরূপেই নিবারণ করিতে পারিলাম না। একে একে জেলের প্রত্যেক কৰ্ম্মচারীগণের নিকট হইতে আমি একদিবসের নিমিত্ত ছুটি চাহিলাম; কিন্তু আমার দুঃখে কেহই কর্ণপাত করিলেন না। বরং আমার হাতে হাতকড়ি ও পায়ে বেড়ি পড়িল, এবং সেলের ভিতর বদ্ধ হইলাম। তখন অনন্যোপায় হইয়া হরিণ-বাড়ীর জেল হইতে পলায়নের সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। একদিবস রাত্রিকালে আমি আমার অতুলনীয় বলের পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, কায়িক শক্তিতে হাতের হাতকড়ি খুলিতে পারি কি না, পায়ের বেড়ী ভাঙ্গিতে পারি কি না? বুঝিলাম, শরীরের কষ্ট সহ্য করিতে পারিলে সমস্তই হয়। বলপূর্ব্বক হাতকড়ি গলাইয়া হাত বাহির করিলাম। হাতকড়ির সাহায্যে পায়ের বেড়ী একটু বাঁকাইয়া ফেলিলাম, এবং শক্তি-প্রয়োগে তাহাও পা হইতে গলাইয়া খুলিয়া ফেলিলাম। বাকি থাকিল কেবল সেলের দ্বার, বেড়ীর সাহায্যে তাহাও ভাঙ্গিলাম। বাহিরে আসিয়া একটি বৃহৎ লৌহ পেরেকের সাহায্যে জেলের সেই পাকা প্রাচীরে একটি সিঁদ কাটিলাম। দিবাভাগেই পেরেকটি সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলাম। সিঁদ কাটিবার সময় ভাবিলাম, জেলের ভিতর আসিয়াও আপন ব্যবসা এখনও ভুলি নাই। সিঁদ কাটাও যেমন শেষে হইল, আমিও তাহার ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া পলায়ন করিলাম।
দ্রুতপদে ময়দান পার হইয়া বড়রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, একখানি ঠিকাগাড়ি ভবানীপুরের দিক্ হইতে আসিতেছে। সেই গাড়ি ভাড়া করিয়া একেবারে ওম্দার বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। অসময়ে ওম্দা আমাকে দেখিয়া একেবারে বিস্মিত হইল। আমার সহিত অপরাপর দুই একটি কথা বলিয়াই পরিশেষে কহিল, “জেল হইতে তোমার পলায়নবার্তা যেমন ঘোষিত হইবে, অমনি এখানে লোক আসিয়া সন্ধান লইবে যে, তুমি এখানে আসিয়াছ কি না। অতএব এই সময়ে তোমার নিমিত্ত যদি কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে না কারি, তাহা হইলে তুমি নিশ্চয়ই ধৃত হইবে।” এই বলিয়া ওম্দা আমাকে তাহার গৃহের ভিতর রাখিয়া, বাহির হইতে তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া কোথায় চলিয়া গেল। আমি একাকীই সেই গৃহের ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। প্রায় একঘণ্টা পরে ওম্দা ফিরিয়া আসিল ও কহিল, “আর বিলম্ব করিও না, আমার সহিত আইস।” আমি কোন কথা না বলিয়া, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। যে বাড়ীতে ওম্দা থাকিত, তাহার কিছুদূর অন্তরে একখানি গৃহের ভিতর আমাকে লইয়া গেল ও কহিল, “আমি তোমার নিমিত্ত এই গৃহ ভাড়া করিয়াছি। এইস্থানে তুমি অনায়াসেই লুকাইয়া থাকিতে পারিবে। কেহই জানিতে পারিবে না, বা কোনরূপ সন্দেহও করিতে পারিবে না। সময় সময় আমি আসিয়া তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এবং যাহা কিছু জানিতে পারি, তাহাও তোমাকে বলিয়া যাইব।”
এইরূপে কিছুদিবস আমি সেই গৃহের ভিতর লুক্কায়িত অবস্থায় রহিলাম। রাত্রিদিনের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই ওম্দা আমার নিকট অতিবাহিত করিতে লাগিল। আহারাদি সে তাহার গৃহেই প্রস্তুত করিত, এবং অবসর বুঝিয়া আমাকে দিয়া যাইত। এইরূপে কিছুদিবস যাপন করিলাম। কিন্তু জানি না, কিরূপে পুলিস আমার সন্ধান পাইল। একদিন রাত্রিকালে তাহারা দলবলে আমার সেই নূতন গৃহে আসিয়া আমাকে ধৃত করিল। জেল হইতে পলায়ন করা অপরাধে পুনরায় আমি বিচারালয়ে প্রেরিত হইলাম। ইংরাজী ১৮৭৩ সালের ১লা জুলাই তারিখে আমার কারাবাস আরও ছয় বৎসর বৃদ্ধি হইল। আমি সেই হরিণ-বাড়ীর জেলের ভিতর পুনরায় নীত হইলাম। এবার আমাকে আরও বিশিষ্ট বন্দোবস্তের সহিত কয়েদ করিয়া রাখিল। আমিও আর কোনরূপ গোলযোগ না করিয়া কয়েক বৎসর কাটাইলাম। পুনরায় ওম্দার নিমিত্ত আমার মন কাঁদিল, পুনরায় তাহাকে দেখিতে ইচ্ছা হইল। পুনরায় আমি আমার মনের কথা জেলের প্রধান প্রধান কর্মচারীগণকে কহিলাম, পূর্ব্বের ন্যায় এবারও তাঁহারা আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। সেই দিবস হইতে আমি পুনরায় পলায়ন করিবার সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।
দুই চারিমাস সুযোগ অনুসন্ধান করিতে করিতে যেমন সুযোগ পাইলাম, অমনি জেলে সিঁদ কাটিয়া পুনরায় পলায়ন করিলাম। পলায়ন করিয়া পুনরায় ওম্দার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। এবারও সতর্কতার সহিত ওমদা আমাকে এক স্থানে লুকাইয়া রাখিল; কিন্তু অধিক দিবস থাকিতে পারিলাম না। আপনি ও আরও কয়েকজন ব্যক্তি মিলিয়া আমাকে ধৃত করিলেন। ধৃত হইয়া পুনরায় আমি বিচারালয়ে প্রেরিত হইলাম। এবার ইং ১৮৭৯ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি দিবসে আমার কারাবাস আরও দুই বৎসর বাড়িয়া গেল।
আমাকে পুনরায় সেই হরিণ বাড়ীর জেলে গমন করিতে হইল। আমাকে দেখিয়া জেলের বড়সাহেব আমাকে কহিলেন, “কি হে মনিরূদ্দিন! তুমি পুনরায় পলায়ন করিবে?”
আমি। যখন ইচ্ছা হইবে, তখনই আমি জেলের বাহির হইয়া যাইব। আপনি কোনরূপেই আমাকে জেলের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিবেন না।
জেলের বড়সাহেব। তোমার হাতে রাত্রিদিন হাতকড়ি লাগাইয়া দিব, পায়ে অনবরত বেড়ী থাকিবে। দেখিব, তুমি কিরূপে পলায়ন কর!
আমি। হাতকড়ি ও বেড়ী আনিয়া এখনই আমাকে পরাইয়া দিউন। দেখুন, উহাতে আমাকে আটক করিয়া রাখিতে পারেন, কি না?
আমার এই কথা শুনিবামাত্র জেলের বড়সাহেব তখনই তাঁহার সমক্ষে আমার হাতে হাতকড়ি ও পায়ে বেড়ী দিতে আদেশ করিলেন। দেখিতে দেখিতে আদেশ কার্যে পরিণত হইল। আমিও পূৰ্ব্বমত হাতকড়ি খুলিয়া ফেলিলাম এবং বেড়ী বাঁকাইয়া পা হইতে খুলিয়া বড়সাহেবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলাম। আমার এই আশ্চৰ্য্য ক্ষমতা দেখিয়া বড়সাহেব একেবারে স্তম্ভিত হইলেন ও কহিলেন, “মনিরূদ্দিন! আমি এখন জানিতে পারিলাম, তোমার ক্ষমতা আছে, তুমি ইচ্ছা করিলেই পলাইতে পারিবে। কিন্তু আমার উপদেশ লও, পলাইয়া আর কারাবাসের সময় বৃদ্ধি করিও না।”
উত্তরে আমি কহিলাম, “আমি একটি স্ত্রীলোককে অন্তরের সহিত ভালবাসি। তাহাকে যখন দেখিতে ইচ্ছা হইবে, তখন যদি আমাকে সেইস্থানে গমন করিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে অনুমতি দেন, তাহা হইলে আমি আর পলায়ন করিব না; নতুবা আমাকে পলাইতেই হইবে।”
আমার কথা শুনিয়া সাহেব একটু হাসিলেন ও কহিলেন, “আচ্ছা, আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম। জেলের কোন কর্মচারীর সহিত দুই মাস অন্তর একদিন ছয়ঘণ্টার জন্য সেইস্থানে যাইও। কিন্তু সুযোগ পাইয়া যদি বাহির হইতে পুনরায় পলায়ন কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পুনরায় ধৃত হইবে; এবং এ সুযোগ আর পাইবে না।”
আমার দুঃখ বুঝিলেন দেখিয়া, সাহেবকে আমি বার বার ধন্যবাদ প্রদান করিলাম। সেইদিবস হইতে আমি চোরের মেট অর্থাৎ সদাররূপে পরিগণিত হইলাম। থাকিবার নিমিত্ত একটি স্বতন্ত্র দ্বিতলগৃহ পাইলাম। এখন হইতে হাতকড়ি ও বেড়ীর যন্ত্রণা আর আমাকে সহ্য করতে হইল না। প্রত্যেক দুইমাস অন্তর একবার করিয়া, ওম্দাকে দেখিয়া আসিতে লাগিলাম। এইরূপ কিছুদিবস গত হইল, একদিন জ্বররোগে ওদা ইহজীবন পরিত্যাগ করিল। আমি জেল হইতে বাহিরে আসা বন্ধ করিলাম।
এইরূপে জেলের ভিতর সর্দ্দারী করিয়া অনেকদিন যাপন করিলাম। এ সময় আমি মনোযোগের সহিত জেলের কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছিলাম; সুতরাং গবর্ণমেণ্ট কারাবাস-সময় কিছু মার্জ্জনা করিয়া, ইংরাজী ১৮৯২ সালের ৮ই এপ্রিল তারিখে আমাকে জেল হইতে ছাড়িয়া দিলেন।
জেল হইতে নিষ্কৃতি পাইবার পর, আমি পুলিসের বড় সাহেবের দরবারে নীত হইলাম। তিনি আমার সমস্ত অবস্থা পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতেন, এবং কয়েদীদিগকে দেখিবার নিমিত্ত যখন জেলে গমন করিতেন, তখনই আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন। আমাকে দেখিবামাত্র তিনি কহিলেন, “মনিরূদ্দিন! তুমি এখন জেল হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছ, আশা করি, কোনরূপ সদ্ব্যবসা অবলম্বন করিয়া জীবনের অবশিষ্টাংশ অতিবাহিত করিবে।” উত্তরে আমি কহিলাম, “আমারও ইচ্ছা তাহাই। কিন্তু সদ্ব্যবসা অবলম্বন করিতে হইলে, প্রথমেই অর্থের প্রয়োজন হইবে, তাহা আমি এখন কোথায় পাইব?”
“অর্থের জন্য তোমার কোন চিন্তা নাই, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিব।” এই বলিয়া বড়কর্তা আমাকে সেদিবস বিদায় দিলেন, কিন্তু পরিশেষে সরকারী টাকা দ্বারা আমাকে একখানি জুতার দোকান করিয়া দিলেন। কিছুদিবস আমি, সেই দোকানে বসিয়া জুতা বিক্রয় আরম্ভ করিলাম। প্রথম প্রথম লাভের টাকা দ্বারা আবশ্যকীয় খরচপত্র চালাইতে লাগিলাম; পরিশেষে মূলধনেও টান পড়িল। সামান্য জুতার দোকানে যে লাভ হইত, তাহাতে আমার বাবুয়ানা খরচের কি প্রকারে সংস্থান হইতে পারে? আমি দোকানের সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, ও আমার জেলের কয়েকজন অনুচরের সহিত মিলিত হইলাম।
ইহার কিছুদিবস পরেই পাকুড় নামক স্থানে কয়েকটি বিষ-খাওয়ান মোকদ্দমায় আমি অপরাপর কয়েকজনের সহিত ধৃত হইলাম। উহার এক মোকদ্দমায় আমার দশবৎসর মেয়াদ, এবং অন্য মোকদ্দমায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হইল। এই দণ্ডে ইংরাজী ১৮৯৩ সালের ১৭ই জুলাই তারিখে পুনরায় আমি জেলের ভিতর গমন করিলাম।
[ চৈত্র, ১৩০১]