সােনালী রেখা

সোনালী রেখা

আত্মীয়-পরিজন সকলেই জানল রুচিরা জিতেছে। আনন্দে ডগমগ হবার মতো হারজিতের খেলা নয় এটা। এই হারজিতের ওপর স্বস্তি নির্ভর করছিল। শান্তি নির্ভর করছিল। তাই আনন্দে আটখানা না হোক, রুচিরা জেতার ফলে সকলে খুশী। সকলে বলতে একান্ত শুভার্থী জনেরা। বাবা-মা। দাদা-দিদি। নইলে খবরটা জানাজানি হবার। পর মুখ মচকাবে এমনও অনেকে আছে। রুচিরা ফিরে আবার গাঙ্গুলী হয়েছে এটুকুই তার জিত।

এতদিন ছিল রুচিরা ব্যানার্জী। মিসেস ব্যানার্জী। এখন এই দুপুরের পর থেকে আর মিস মিসেস কিছুই নয়। শুধু রুচিরা গাঙ্গুলী। সাতাশ মাসের একটা দুঃস্বপ্নের। শেষ। এই সাতাশ মাসের মধ্যে পনেরো মাস হাতে নোয়া বা শাখা ছিল না। কপালে। বা সিঁথিতে সিঁদুরও ছিল না। তবু অক্টোপাসের মতো দুটো ক্রুর লোলুপ হাতের অধিকার যেন ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ছিল।

সেই দুটো হাত পুরুষের। শক্ত সবল পুরুষ তাকে বলবে না রুচিরা। গোড়ায়। সেই রকমই বুঝেছিল। সেই রকমই ভেবেছিল। স্বয়ং ইন্দ্রের মতোই মাথা উঁচু মনে হয়েছিল ইন্দ্র ব্যানার্জীর। তার দর্প দেখে তার দম্ভ দেখে তখন শুধু পুরুষকারের ছটাই বড় হয়ে উঠেছিল রুচিরার চোখে। তার সঙ্গে বিয়ের যখন সব ঠিক তখনো সেই লোকের ছোটখাটো দুই-একটা অপরাধের নজির সামনে এনে বিয়ে বরবাদ করতে চেয়েহে কেউ কেউ। বাবা-মা শুনে চিন্তায় পড়েছিলেন। দাদা-বউদি দিদি-জামাইবাবু থমকে ছিল।

চাঁদে কলঙ্ক নেই, গোলাপে কাটা নেই–এ কি হয়? কোকিল কালো নয়–এ কি হয়? সোনায় কিছু খাদ না মিশলে তা দিয়ে গয়না হয়? ইন্দ্র ব্যানার্জীর চরিত্রের যেটুকু আভাস পেয়ে বাড়ির সকলে ধাক্কা খেয়েছিল, রুচিরার চোখে পুরুষ প্রবৃত্তির একটা বেপরোয়া দিক মাত্র সেটা। লোকটার মধ্যে লুকোচুরির ব্যাপার নেই, পায়ে কোনো ভয়ের বেড়ি নেই। থাকলে সব-কিছু একটা ম্যাড়মেড়ে ব্যাপার হয়ে যেত। তাহলে সুশীতল চক্রবর্তীর সঙ্গে তার কোনো তফাত থাকত না। হায়ার সেকেন্ডারি থেকে এম. এ. পর্যন্ত নামকরা ভাল ছাত্র সুশীতল চক্রবর্তী। বি. এ-তে ফিলসফিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। এম, এ-তেও তাই। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল ছেলে। পান-সিগারেট পর্যন্ত খায় না। চোখে পুরু চশমা। তার ও-ধারের একটু ছোট চোখ দুটো বুদ্ধিতে চিকচিক করে। জোর-জুলুম কাকে বলে জানে না। মিষ্টি মিষ্টি হাসে। সকলে ভেবেছিল, এত ভাল ছেলে আই. এ. এস-এ বসবে। আর বসলে যে পাঁচজনের একজন হবে জানা কথাই।

কিন্তু বসল না। কারণটা রুচিরাকেই কেবল বলেছিল সুশীতল চক্রবর্তী। চোখের যা পাওয়ার তাতে বাতিল হয়ে যাবার সম্ভাবনা ষোলআনা। এই দোষ চাপা দিতে হলে অনেক কারচুপির দরকার। তার মধ্যে সে নেই। তাছাড়া ও-সব লাইন ভালও লাগে না। দু-দুটো ভাল কলেজ থেকে অফার এসেছে। কলেজের মাইনে-পত্র আজকাল খারাপ নয় খুব। একটা নিয়ে নেবে। আরো পড়াশুনা করার ইচ্ছে। সুযোগ হলে ডক্টরেট করে নিয়ে কিছু বই-পত্র লেখার ইচ্ছে।

এই লোক রুচিরার জীবনে সেধে এগিয়ে আসতে চেয়েছিল। বিনয়দার নিজের ছোট মাসতুতো ভাই সুশীতল চক্রবর্তী। বিনয়দা হল দিদির বর। বিলেত-ফেরত এঞ্জিনীয়ার। এক প্রাইভেট এঞ্জিনীয়ারিং ফার্মে মস্ত চাকরি করে বিনয়দা। স্বামীকে নিয়ে দিদির ভিতরে ভিতরে বেশ গর্ব আছে। এই বিনয়দার সুবাদে সুশীতল চক্রবর্তীর এ-বাড়িতে অল্প-স্বল্প আসা-যাওয়া ছিল। রুচিরার থেকে তিন ক্লাস ওপরে পড়ত।

এই বিদ্বান মাসতুতো ভাইটিকে বিনয়দা ভালবাসে খুব। আর দিদি তার থেকেও বেশি। দিদি বয়সে বোধহয় ওর থেকে বছর দেড়েকের বড় হবে। কিন্তু কাছে পেলে রসিকতার ছলে দিদি একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো আদর করত ওকে। একবার তো রুচিরা আর বিনয়দার সামনেই কি কারণে খুশী হয়ে দিদি আচমকা ওর দু-গালে দুটো চুমু খেয়ে বসেছিল। সুশীতল চক্রবর্তীর মুখখানা দেখতে তখন হেসে গড়াবার মতই হয়েছিল।

রুচিরা যখন হায়ার সেকেন্ডারিতে মোটামুটি ভাল রেজাল্ট করে ফিলসফি অনার্সে তিন বছরের কোর্সে বি. এ. পড়তে ঢুকল, সুশীতল চক্রবর্তী তখন এম. এ. ফাস্ট ইয়ার। দর্শনশাস্ত্রের সেতু ধরে তার পর থেকে দুজনের মধ্যে দর্শনের ব্যাপারটা আরো অনেক সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। রুচিরার যেবার বি. এ. পার্ট টু ফাইনাল পরীক্ষা, তার আগের বছর এম. এ. পরীক্ষা দিয়ে সুশীতল চক্রবর্তী সোনার মুখ করে যুনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে। আর সেই অবকাশের অনেকখানি রুচিরাকে সাহায্য করার ব্যাপারে ঢেলে দিয়েছে। মাত্র চারটি নম্বরের জন্য বি. এ-তে ফাস্ট ক্লাস না পেয়ে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল রুচিরা। এও তার কাছে এমন কি বাড়ির সকলের কাছেও আশাতীত। ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়ার খেদ শুধু ওই সুশীতলের।

বেজায় খুশী হয়ে দিদি বলেছিল, এবারে পায়ে হাত দিয়ে তোর মাস্টারকে প্রণাম কর একটা, আর প্রার্থনা কর এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পাস।

আজকালকার কলেজে-পড়া ছেলে-মেয়েদের রীতি অনুযায়ী সুশীতলকে নাম ধরে অর্থাৎ বাড়ির সকলের মত শীতল বলেই ডাকত রুচিরা। দিদি এই জন্যেও কম মন্দ বলত না ওকে। শুনলেই চোখ পাকিয়ে ধমক লাগাত।এই! বড় না তোর থেকে?

দিদি এমন কিছু সেকেলে মেয়ে নয়, মাত্র সাড়ে চার পাঁচ বছরের বড় রুচিরার থেকে। তার সময়েও কলেজের সমবয়সী বা একটু আধটু বয়েসের ফারাকের ছেলেমেয়েদের নাম ধরে ডাকাডাকির রীতি ছিল। কিন্তু নিজের আদরের ওই মাসতুতো দেওরটির বেলায় দিদির গোঁড়ামি।

প্রণাম করার হুকুম শুনে বেশ মজার কাণ্ডই করেছিল রুচিরা। চট করে গম্ভীর হয়ে ভারী গলায় ডেকে বসেছিল, শীতল এদিকে আয়

না, একেবারে আধুনিকাদের মতো তুই কখনো বলেনি। তুমি করে বলত। এই ডাক শুনে তো দিদির চক্ষু কপালে। সে ভাবল হয়তো মাঝের এই তিন বছরে বোনের এই উন্নতি। সুশীতল কিন্তু মিটিমিটি হাসছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন?

–দিদি বলল, শুনলি না? আয় প্রণাম করি

সুশীতল তার পরেও ভালমানুষের মতো এগিয়ে আসতে ধাক্কা মেরে তাকে দিদির। গায়ের ওপর ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। প্রণাম সত্যি করবে দিদি আশা করেনি, কিন্তু ওই তুই-তোকারি শুনে রেগেই গেছল। দিদির মনের তলায় তখনো কি আশা রুচিরা বুঝতে পারেনি।

বি. এ. পরীক্ষার সময় সপ্তাহে কম করে চার পাঁচদিন তাকে পড়াতে আসত। সুশীতল। এম.এ-তে ঢোকার গোড়া থেকেই সেই রকমই আসতে লাগল। মুখে। কোনো দিন এতটুকু আভাস ব্যক্ত না করলেও তারপর থেকে কেন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করছিল রুচিরা। জল হোক ঝড় হোক সে ঠিক আসবে। এসে যে কোনো রকম বাজে কথায়. সময় কাটাত তা নয়। তখন আবার কলেজের নতুন মাস্টার সুশীতল। উৎসাহ বা উদ্দীপনার অভাব নেই। গোড়া থেকেই নিয়ম করে পড়াশোনার তাগিদও দিত। কিন্তু ইদানীং ওর এম. এ-তে ভাল রেজাল্টই লক্ষ্য লোকটার, ভাবা যাচ্ছিল না। যা ভাবছিল, সেই গোছের ব্যাপার অনেক সময় চোখে-মুখে লেখা হয়ে যায়। রুচিরার ধারণা, সে সেটা নির্ভুল পড়ে নিতে পারছিল। একদিন তাই সরাসরি বলে ফেলেছিল, গোড়া থেকেই এত লেখাপড়া। আমার পোষাবে না বাপু, এ বছরটা অন্তত আগের মত সপ্তাহে দুদিনের বেশি পড়ছি না, পরীক্ষা এলে তারপর দেখা যাবে। বেশি পড়লে মাথা ঝিম ঝিম করে।

পুরু লেন্সের ওধারের চোখ দুটো তার মুখের ওপর থমকেছিল একটু।–মাত্র দুদিন?

-হ্যাঁ। দুদিন তোমার কাছে পড়ব, দুদিন আবার গানে লেগে যাব ভাবছি, আর দুদিন নিজে পড়ব–এমনিতেই তো দিদি কথা শোনায় আমার বি. এ-র রেজাল্টের পিছনে সবটাই তোমার বাহাদুরি।

মুখের দিকে তেমনি চেয়ে ছিল সুশীতল। যদি ফিরে জিজ্ঞাসা করত বাহাদুরিটা সে অস্বীকার করে কিনা, রুচিরা তেমন যুৎসই জবাব কিছু দিয়ে উঠতে পারত না। কিন্তু সে-রকম দাবি জাহির করার মানুষ সুশীতল চক্রবর্তী নয়। তাছাড়া সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট হওয়াটা তার কাছে কোনো ভাল রেজাল্টই না।

কথামতো সপ্তাহে দুদিন করেই আসছিল এর পর। কিন্তু মুখে যাই বলুক, একটু ভাল রেজাল্ট করার তাগিদ রুচিরার ভিতরে ভিতরে ছিলই। আর সেটা যে সবটাই, সুশীতল চক্রবর্তীর ওপর নির্ভর, তাও স্বীকার না করে উপায় নেই। ফাইনাল ইয়ারে পা দিয়েই সুশীতলের আসাটা দুদিনের জায়গায় এবার তিন দিন করে দেবে কিনা, আপনা থেকেই ভাবছিল।

এরই মধ্যে যা ভাবেনি, এক সন্ধ্যায় তাই হয়ে গেল। পড়ানোর মতো মুখ করেই সুশীতল বলল, অনেকদিন ধরে একটা কথা তোমাকে বলি-বলি করে বলা হচ্ছিল না। বউদিকে, মানে তোমার দিদিকে বলেছিলাম, উনি আবার আমাকেই ঠেলে দিলেন। কথা আর কিছু নয়, তোমার বাবা মা-কে এবারে যদি আমি একটা বিয়ের প্রস্তাব দিই, তোমার তাতে আপত্তি হবে কি না।

এমন মুখ করে বলল, যেন বাজারের আলু-পটল কেনার মতো সাদামাটা প্রস্তাব একটা। কিন্তু তাই শুনেই রুচিরা বিষম চমকে উঠল। অতর্কিতে আক্রান্ত হবার মতো মুখ।–বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব …ইয়ে, মানে আমাকে বিয়ে?

পুরু লেন্সের ওধারের দুচোখে হাসির ছোঁয়া লাগল।তা না হলে আর তোমার আপত্তি হবে কিনা জিগেস করব কেন?

ভিতরে ভিতরে হাঁসাস দশা রুচিরার।–আমি, মানে, আমি কখনো কিছু এ নিয়ে ভাবিইনি-

–ভাবতে অসুবিধে হচ্ছে?

এমন সঙ্কটে রুচিরা বোধহয় জীবনে আর পড়েনি। ভিতরে ভিতরে নিদির ওপরেই আচ্ছা রাগ হতে থাকল। দিদির মারফত প্রস্তাবটা এলে যা বলার বলে দেওয়া সহজ হত, অন্তত চক্ষুলজ্জার বালাই থাকত না। এবারে জবাব দিতে সময় নিল একটু। তারপর যতটা সম্ভব নরম করে বলল, দেখ, তুমি খুব ভাল, আর তোমাকে আমার ভালও লাগে–কিন্তু এ-রকম চিন্তা আমার কখনো মাথায় আসেনি বা সেভাবে তোমাকে কক্ষনো দেখিনি

রুচিরার দেখার ভুল নয়। চোখের হাসি মিলিয়ে গেছে। না, এই জবাব আশা করেনি। উল্টে বোধহয় ধরেই নিয়েছিল রুচিরার চোখেমুখে সম্মতির খুশীর ছটা দেখবে। তার দিকেই চেয়ে আছে তখনো। বিস্ময়-আশাহত চাউনি। না বুঝে-শুনে দিদি একে কতখানি আশা দিয়ে বসেছিল কে জানে।

বিড়ম্বনা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা মানুষটার। গলার স্বরও এবারে ঠাণ্ডা একটু।–সে ভাবে দেখেছ এমন কেউ এসে গেছে?

প্রাণের দায়ে এবারে সোজাসুজি মাথা নাড়ল রুচিরা। অর্থাৎ তাই। এসে গেছে। খুব সত্যি নয়। আবার একেবারে যে মিথ্যে তাও নয়। ইন্দ্র ব্যানার্জী তখন পর্যন্ত ওর মনের দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়েনি। তবু এর কাছে স্পষ্ট মনোভাবটাই প্রকাশ করল রুচিরা। এসেই গেছে। একেবারে কেউ না এলেও এই মিথ্যের আশ্রয় নিত কিনা জানে না।

সুশীতল চক্রবর্তীর মুখে আবার বিস্ময়ের আঁচড় পড়ছিল।–তোমার দিদিরও এটা জানা নেই নিশ্চয়?

মরীয়া হয়েই জবাব দিল রুচিরা–দিদি কেন, এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। প্লীজ, তুমিও আর দয়া করে জানতে চেও না।

সত্যিই ঠাণ্ডা আর ভদ্র এই মানুষটা। এ নিয়ে আর একটি কথাও বলেনি। আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। খানিকটা আত্মস্থ হয়ে উল্টে বলেছিল, কিছু মনে করো না…আমার জানা থাকলে তোমাকে এভাবে অপ্রস্তুত করতাম না।

রুচিরা সাগ্রহে বলেছে, আমি কিছু মনে করিনি, তুমি কিছু মনে করলে না তো?

 –না।…আজ কি পড়বে?

–আজ থাক।

টেবিলের বই দুটো একবার নাড়াচাড়া করে আবার রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। –চলি তাহলে?

কেন যেন ভয়ানক বিচ্ছিরি লাগছিল রুচিরার। তেমনি অস্বস্তি। বলেই ফেলল, পড়াশুনার ব্যাপারে আর তোমার সাহায্য পাওয়ার আশা করাটা ঠিক হবে না বোধহয়?

-কেন?

–আসবে?

–তুমি না চাইলে আসব না।

ভাবের আবেগে রুচিরা বলেছিল, শীতল, তুমি সত্যি অনেক বড়। আমি কিছু না।

— সুশীতল চলে যাবার পর ওর কান্নাই পাচ্ছিল। কেন এ-রকম হল? কেন এ-রকম হয়? সুশীতল খুব–খুব ভাল এটা সে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু স্বামী হিসেবে তাকে ভাবা যায় না কেন? ও এমন কি মেয়ে? পুরুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে এমন রূপের সম্বল কিছুই নেই। গায়ের রং ঠিক ফর্সা বলা চলে, স্বাস্থ্য মোটামুটি, নাক-মুখ পটে আঁকা নয়। কেবল, ওপরতলার কিছু প্রসাদ আছে ওর চোখ দুটোতে। যে দেখে সে-ই সুন্দর বলে। লুকিয়ে চুরিয়ে রুচিরাও আয়নায় নিজের এই চোখ দুটোকে কম দেখে না। ওর আর যা-কিছু রূপ তার সবটাই বুকের তলায়। কারো কষ্ট দেখলে দুঃখ হয়, কারও আনন্দ দেখলে খুশী হয়। কারো উদারতা দেখলে ভিতরটা ভরে যায়, নিপীড়ন দেখলে নিজের ভিতরেই যন্ত্রণা হতে থাকে। কত সময় ভাবে, সকলেই একটু উদার হলে, একটু দরদী হলে, একটু নিঃস্বার্থ হলে, এই পৃথিবীটা তো কত সুন্দর হতে পারে।…হয় না কেন?

চোখ দুটো ছাড়া ওর ভিতরের এই রূপের খোঁজ পেতে হলে স্বাদ পেতে হলে যে অবকাশ দরকার আর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য দরকার, একমাত্র সুশীতল চক্রবর্তীই সেটা পেয়েছিল। কিন্তু তাকে তো সে সরাসরি বাতিল করে দিল। অথচ তার জন্যও যে কত দুঃখ হচ্ছে রুচিরা সেটা কাকে বলবে?

সুশীতল চলে যাবার পরদিনই দিদি এসেছিল, গম্ভীর। হাব-ভাবে বুঝিয়েই দিল বোনের ওপর রাগ হয়েছে। বহুক্ষণের মধ্যে ওর সঙ্গে কোনো কথাই বলল না। ফলে রুচিরার রাগ দ্বিগুণ। ও ভাল কথায় জল, মেজাজ দেখালে আগুন। মনে মনে ভাবল, দিদির চেহারা-পত্র ওর থেকে একটু ভাল, সেই দেমাকে ভাবে ওর দেওরের থেকে ভাল বর আর পাব কোথায়।

রুচিরাও সেধে একটি কথাও বলতে এল না।

যাবার আগে দিদি ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করল, কাকে সব সমর্পণ করে বসে আছিস?

–তোর বরকে! হল?

যা-ই হোক, বোনকে দিদি ভালই বাসে। হেসে ফেলল।-থাপ্পড় খাবি। কে এমন। লোক এল যে শীতলকে একেবারে বাতিল করে দিলি–শুনিই না?

রুচিরার মেজাজ তখনো ঠাণ্ডা হয়নি। চটপট জবাব দিল, বিনয়দার থেকে ভাল এটুকু জেনে রাখ–জানলে তোর হিংসে হতে পারে।

রাগ দেখিয়ে চলে গেল। না গিয়ে করবে কি? দিদির জেরার মুখে পড়লে কি বলবে? কার নাম করবে?

কিন্তু রুচিরা আর যা-ই হোক, মেয়েটা বোকা নয় একটুও। ওরই দিকে চেয়ে একজন বেপরোয়া মানুষ যে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে এটা সে অনুভব করতে পারে। তার নাম ইন্দ্র ব্যানার্জী। এই অভিজাত দক্ষিণ এলাকায় তাকে চেনে না এমন কেউ নেই। রুচিরা অন্তত ছেলেবেলা থেকেই চিনত। কলেজে পড়তেই পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের মাতব্বর হয়ে বসেছিল। সেই খুনোখুনির রাজনীতির সময় তার সম্পর্কে গা-কাটা দেবার মত অনেক গাল-গল্প কানে এসেছে। মোট কথা, সেই দুর্যোগের সময় এই এলাকা একেবারে ঠাণ্ডা ছিল শুধু তার দাপটে। একবার মাত্র এই পাড়ার ওপর হামলার সূচনা হয়েছিল। সুযোগ পেয়ে বাইশ বছরের একটা ছেলেকে কারা ছোরা। আর রিভলভার দেখিয়ে জীপে তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। ঘটনাটা তক্ষুণি পাড়াময় রটে গেছল। সেই বিধবা বুক চাপড়ে রাস্তায় বেরিয়ে অজ্ঞান। হয়ে গেছল। পাড়ার ছেলেরা তাকে ধরাধরি করে রুচিরাদের বাড়ি নিয়ে এসেছিল। রুচিরার বাবা তার চিকিৎসা করেছিলেন। শুধু এ-এলাকার কেন, কলকাতার মধ্যেই। একজন নামী ডাক্তার রুচিরার বাবা।

কিন্তু দুঘণ্টার মধ্যেই পাড়ায় আবার হৈ-চৈ। বিধবার সেই ছেলে অক্ষত অবস্থায় আবার ঘরে ফিরে এসেছে। পরদিন কাগজে খবর বেরিয়েছে, হত্যার উদ্দেশ্যে অমুক জায়গার একটি ছেলেকে কারা জীপে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল। কোথা থেকে আরো দুটো জিপ হঠাৎ এসে তাদের ওপর চড়াও হয়। অতর্কিতে আক্রান্ত হবার ফলে দুষ্কৃতকারীদের তিনজন গুরুতর আহত হয়, আর বাকি দুজন হত্যার বলি সেই ছেলেটাকে ফেলে পালিয়ে যায়। ছেলেটা নিরাপদে ঘরে ফিরেছে। কিন্তু কে বা কারা তাকে উদ্ধার করেছে জানা যায়নি, কারণ তারাও পুলিস আসার আগে নিজেদের জীপ নিয়ে সরে পড়েছে। ছেলেটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু জানা যায়নি। মনে হয় এটা কোনো রাজনৈতিক দলাদলির ফল। আহতদের অবস্থা আশংকাজনক।

ওই বিধবার ছেলেটা যে রুচিরার বন্ধু সুমিতার পিসতুতো ভাই জানা ছিল না। সে চুপি চুপি রুচিরাকে বলেছিল, এত বুকের পাটা কার জানিস না? ইন্দ্রদার।-খবর কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দুটো জীপ নিয়ে আর দল নিয়ে ওদের ঘাঁটিতে গিয়ে। হানা দিয়েছিল।

শুনে রুচিরা কণ্টকিত।–পুলিস জানে না?

–জানলেই বা কি। ইন্দ্রদার বাবা কংগ্রেসের কত বড় চাই জানিস না?

তা অবশ্য জানে। অনেক এম. এল. এ. ছেড়ে কংগ্রেসী মন্ত্রীরাও কত সময়। ইন্দ্র ব্যানার্জীদের বাড়ি আসে।

ইন্দ্র ব্যানার্জীর বাবা হাই ব্লাডপ্রেসারের রোগী। রুচিরার বাবার পেশেন্ট। বাবা বুদ্ধিমান মানুষ, তার কাছ থেকে ফী নিতেন না। বাবার খবর দেবার জন্য ইন্দ্র ব্যানার্জী কখনো-সখনো তাদের বাড়ি আসত। তখন কখনো কখনো রুচিরার সঙ্গে চোখের দেখা হত শুধু, মনের ব্যাপারের ধারে-কাছেও কেউ নেই। কিন্তু রুচিরার ভিতরে ভিতরে এই বেপরোয়া ছেলেটার প্রতি কৌতূহল ছিল।

রুচিরা যখন বি. এ. পড়ে, তখন সেই বন্ধু সুমিতার কাছেই হঠাৎ একদিন শুনল, ওদের ইন্দ্রদা নাকি রুচিরার চোখ দুটোর খুব প্রশংসা করছিল।

সুমিতা বলছিল আর হাসছিল খুব। রুচিরা অবাক, তোকে কে বলল?

বলেছে সুমিতার সেই পিসতুতো ভাই-যে এখন ওই ইন্দ্রদার অন্ধ ভক্ত।

তার দলের ছেলেরা নাকি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ডাক্তারের ছোট মেয়েটার বড় দেমাক, ঝকঝকে গাড়ি চেপে কলেজে যায়, কলেজ থেকে ফেরে– কোনো দিকে তাকায় না। কত যেন রূপসী, যেন তাকালে ছেলেরা হাঁ করে ওকে গেলার জন্য বসে আছে।

তাই শুনে ইন্দ্র ব্যানার্জী নাকি বলেছে, মেয়েটার চোখ দুটো কি সুন্দর লক্ষ্য করে দেখেছিস তোরা? খবরদার ওর পিছনে লাগবি না!

ছেলেরা নাকি তাদের মুকুটমণি ইন্দ্রদার ওই কথায় মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে চুপ মেরে গেছে।

শুনে রুচিরার কেন যেন হঠাৎ রাগ হয়ে গেছে, আবার ভিতরে ভিতরে একটু খুশীও হয়েছে। রাগ ছেলেগুলোর কথা শুনে হতে পারে, আবার ইন্দ্র ব্যানার্জীর মুরুব্বিয়ানার কথা শুনেও হতে পারে। ওর পিছনে লাগার সাহস যেন কারো আছে! আর খুশীর কারণ হয়তো বা ছেলেটার দেখার মতো নিজের দুটো চোখা আছে ভেবে। হতে পারে।

কিন্তু ইন্দ্র ব্যানার্জীর সমস্ত চেহারার মধ্যে যে বেশ একটা জোরালো পুরুষের ছাপ আছে এটা রুচিরা নিজের মনেও অস্বীকার করতে পারে না। গায়ের রং মোটামুটি ফর্সা, দস্তুরমতো লম্বা। বুদ্ধিমাখা চাউনি, জোড়া ভুরু। মুখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি, কিন্তু ইচ্ছে করলেই চোয়াল দুটো যেন কঠিন হতে পারে। না মোটা না রোগা। মাথার ঝাকড়া চুলে চিরুনির বদলে হাত চালায় বেশি। ওদের বাড়ির পাশ দিয়েই গাড়ি চেপে সে কলেজে যায় আর কলেজ থেকে ফেরে। যাবার সময় প্রায়ই নিজের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সাগরেদদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখে। ভিতরে একটু কৌতূহল ছিল। বলেই হয়তো বাড়ির সামনে চোখ ফিরিয়ে বড় একটা তাকায় না রুচিরা। যেটুকু দেখার দূর থেকেই দেখে নেয়। কলেজ থেকে ফেরার সময় গেটটা ফাঁকাই দেখে। তখন বড় একটা চোখে পড়ে না।

সুমিতার মুখে এ-খবরটা শোনার পর রুচিরার কেমন মনে হয়েছে, কলেজে যাবার সময় প্রায়ই যে ওই ছেলেকে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কারো না কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখে, তার পিছনে ব্যাপার কিছু থাকতেও পারে। ঘরে বসে আড্ডা দেয় না কেন? সুমিতা চলে যেতে সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের এই দুটো চোখের দিকেই অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল রুচিরা। তারপর নিজেই লজ্জা পেয়েছে। জ্ব কুঁচকে আয়নার সামনে থেকে সরে এসেছে। কিন্তু একটু খুশীর ছোঁয়া যে মনে লেগেছিল সেটা অস্বীকার করতে পারে না। সুমিতার কাছ থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটা কথা জেনে নিতে পারলে মন্দ হত না। বীরপুরুষটি লেখাপড়া করছে কিনা, বা কদ্দূর করেছে। নাকি বিদ্যাদিগগজ হয়ে মস্তানি করে বেড়াচ্ছে? আবার ভেবেছে, একেবারে শূন্যকুম্ভ হলে পাড়ার অল্পবয়সী এম. এল. এ. দুজন হামেশাই ও-বাড়ি আসে কেন? বাপের সঙ্গে হোমরা-চোমরাদের খুব দহরম-মহরম হলেও ওই দুজনের তার ছেলের সঙ্গেই খাতির বেশি। তারা লেখাপড়া জানা ছেলে শুনেছে। তাদের বন্ধুর পেটে একেবারেই কিছু থাকবে না? তাছাড়া বেপরোয়া হলেও হাব-ভাব আচরণ শিক্ষিত ছেলের মতই।

খেয়াল হতে রুচিরা নিজেকেই চোখ রাঙিয়েছে আবার। লেখাপড়া জানা থোক বা ক অক্ষর গোমাংস হোক, ওর অত ভাবার দরকার কি?

দরকার থাক বা না থাক, পরদিন কলেজ যাবার সময় চেষ্টা করেও চোখ দুটো। অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। অথচ গাড়িতে ওঠার সময় বার বার নিজের মনে সংকল্প করেছে, কক্ষনো কোনো দিকে তাকাবে না। কিন্তু পরিচিত গেটটা পার হবার আগেই চোখ দুটো ঠিক ওই দিকেই ঘুরেছে।

আর যোগাযোগ এমনি যে, এই দিনে গেটের সামনে একলাই দাঁড়িয়ে সে। সঙ্গী সাথী নেই। রুচিরা ঘাড় ফেরানো মাত্র চোখাচোখি। ওই গেট পার হবার আগেই। আর সঙ্গে সঙ্গে রুচিরার নিজের ওপর রাগ যেমন, ভিতরের গোঁ-ও তেমনি। চেয়ে রইল তো চেয়েই রইল।

সেই ছেলেও।

গেট ছাড়িয়ে গাড়িটা এগিয়ে গেল। রুচিরার তখন নিজের ওপরেই এমনি রাগ যে ইচ্ছে করছিল গাড়িতেই ঘুরে বসে পিছনের কাঁচের ভিতর দিয়ে সেই দিকে চেয়েই থাকে। কারণ চোখাচোখি হতে ইন্দ্র ব্যানার্জীর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি দেখেছে। যেন বলতে চেয়েছে এতদিনে সদয় হলে যা হোক

কিন্তু এরপর এই চোখাচোখি হওয়ার ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটতে লাগল। রুচিরার ঠোঁটের ফাঁকে কখনো হাসির ছোঁয়া লাগে, কখনো বা ভুরুর মাঝে ছদ্ম বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। কথা নেই বার্তা নেই, এ যেন এক মজার খেলা।

দিন-কতক বাদে পর পর কয়েক দিন ওই গেটের সামনে ইন্দ্র ব্যানার্জীকে দেখা গেল না। অসুখ-বিসুখ কিছু করেছে এমন নয়। দুদিন আগে ওর বাবা রুচিরার বাবার কাছে এসে ব্লাডপ্রেসার চেক করিয়ে গেছেন। ওপর থেকে তার গাড়ি দেখে রুচিরা বাবার চেম্বারের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল। বাবাকে ধরে নিয়ে গেলে বোঝা যেত। কারো কিছু অসুখবিসুখ করেছে। তা যখন নয় ঘরে ঢুকে তো আর জিজ্ঞাসা করতে পারে না, আপনার গুণধর ছেলের খবর কি?

অপ্রত্যাশিত খবরটা হঠাৎ কাগজে দেখা গেল। কয়েক দিন ধরেই কাগজে জলপাইগুড়িতে ভয়াল বন্যার খবর বেরুচ্ছিল। কাগজের এ-সব খবর রুচিরা দেখেও দেখে না। কিন্তু সেদিন আর না দেখে বা ঘটনাটার আদ্যোপান্ত না পড়ে পারা গেল না। গোড়াতেই ইন্দ্র ব্যানার্জীর ছবি একখানা। তারপর তার দুঃসাহসের প্রশংসার ফিরিস্তি।

…সর্বগ্রাসী বন্যার খবর পেয়ে কলকাতা থেকে কংগ্রেসের এক তরুণ দল সরকারী সাহায্যের ব্যবস্থা নিয়ে জলপাইগুড়ি চলে গেছল। সেই তরুণ দলের নায়ক ইন্দ্র ব্যানার্জী। সেখানে গিয়ে নায়কের মতই একটি কাজ করেছে। নিজের প্রাণের মায়া। তুচ্ছ করে জলমগ্ন কুটিরের এক বুড়ীকে উদ্ধার করে এনেছে। কাগজে যা লিখেছে তা সত্যি হলে ওই ছেলেও যে মস্ত এক ফাড়া কাটিয়ে উঠেছে, সন্দেহ নেই। বুড়ীকে আগলে পুরো ছত্তিরশটি ঘণ্টা অনাহার আর অনিদ্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি বসে থাকতে হয়েছিল তাকে।

দিন-কতক বাদে আবার তাকে গেটের সামনে দেখতে পেল রুচিরা। আগের দিনই তার আসার খবর কানে এসেছিল। খুব ঘটা করে মালাটালা পরিয়ে পাড়ার ছেলেরা নাকি তাকে স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছে।

গাড়িটা ও-বাড়ির গেট পার হওয়ার সময় এই একটি দিন আবার রুচিরা তাকে যেন দেখতেই পেল না। ইচ্ছে করে রাস্তার উল্টো দিকে মুখ করে বসে রইল। ভেবেছে, অত বাহাদুরির খবর পড়ে রুচিরাও আনন্দে গলে গিয়ে বীরপুরুষকে নতুন চোখে দেখবে। কিন্তু কাগজের ছবি দেখে আর খবর পড়ে রুচিরাও যে দুঃসাহসের প্রশংসা মনে মনে করেনি, এমন নয়।

পরের দিনের ব্যাপারটা অন্যরকম। রুচিরার প্রথমে রাগ যেমন হয়েছে, পরে মজাও তেমনি লেগেছে। ওর কলেজ যাবার সময় ইন্দ্র ব্যানার্জী সেদিনও গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল। সঙ্গে দুজন স্তাবকও ছিল। ও ছেলের সঙ্গী-সাথীদের স্তাবক ছাড়া আর কিছু ভাবে না। দূর থেকে ওদের দেখে এই দিনও রুচিরা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে ছিল।

হঠাৎ গাড়িটা প্রায় থেমেই যেতে ঈষৎ বিস্ময়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাতে গিয়ে। রুচিরার সামনের দিকে চোখ পড়ল। রাস্তার ঠিক মাঝখানে গাড়ির পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্র ব্যানার্জী। গাড়িটা প্রায় থামিয়ে ড্রাইভারও সবিস্ময়ে তাকিয়েছে সেদিকে।

রুচিরার সঙ্গে চোখাচোখি হতে ধীর গম্ভীর মুখে রাস্তা ছেড়ে আবার নিজের বাড়ির গেটের দিকে চলল। রুচিরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সেখানে অন্য ছেলে দুটো ওর দিকে চেয়েই হাসছে ফিক ফিক করে।

রুচিরা সেদিন জ্বলতে জ্বলতে কলেজে চলল। হিন্দুস্থানী ড্রাইভারটা পর্যন্ত কি ভাবল কে জানে! কিন্তু জ্বলুনি থাকল না বেশিক্ষণ। তার ওপর মজার প্রলেপ পড়তে লাগল।

এর পরদিন থেকে কলেজ যাবার সময় আবার চোখ দুটোকে ওবাড়ির গেটের দিকে ফেরাতে হল তাকে। তা না হলে পরদিনই আবার রাস্তা আগলে দাঁড়াবে কিনা কে জানে। লোকটার ঠোঁটের ফাঁকে জ্বালা-ধরানো হাসি। তাকে অবজ্ঞা করলে কি হবে সেটাই যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। রুচিরার এ জুলুম বরদাস্ত করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলে ও করবে কি? আর টের পেয়ে গেলে লোকেই বা ভাববে কি? এর থেকে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকানো স্বস্তির ব্যাপার।

আরো কিছুদিন পরের কথা। রাত তখন সাড়ে নটা। পড়াশুনার পাট শেষ করে রুচিরা খাবার টেবিলের দিকে যাচ্ছিল। দাদা তার উদ্দেশ্যে একটা হাঁক দিয়ে বসে গেছে। রাতে দাদা-বউদির সঙ্গে খায়। দিনের বেলা যে-যার সময় মত খেয়ে নেয়। রাতে বাবার খাওয়া একটু দুধ, একটা সন্দেশ, আর খই। তার খাবারটা মা এর অনেক আগেই ঘরে দিয়ে আসেন।

বাধা পড়ল। পুরনো চাকর মহেশ এসে বলল, একটি বাবু নীচে ডাকছেন।

রাত সাড়ে নটায় নীচে বাবু ডাকছেন শুনে রুচিরা হাঁ। ছেলেদের মধ্যে এ বাড়িতে একমাত্র আসে সুশীতল। তাকে খবর দিয়ে আসতে হয় না। সরাসরি আসে।

-কে বাবু?

–ইন্দরবাবু।

রুচিরা হতচকিত কয়েক মুহূর্ত। কি করবে বা কি বলবে ভেবে পেল না। তারপর। মায়ের চোখের আড়াল হয়ে চুপচাপ নীচে নেমে এল। রাত সাড়ে নটায় বাড়ি এসে চাকর দিয়ে তাকে খবর দেওয়া যে চলবে না এটা প্রথম দিনেই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

বৈঠকখানার দরজা খোলা। ইন্দ্র ব্যানার্জী সেখানে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের ছবি দেখছে। মুখ গম্ভীর, একটু ক্লান্তও যেন।

রুচিরা এসে দাঁড়াতেই কোনো ভূমিকা না করে বলল, আমি ডক্টর গাঙ্গুলীর কাছে এসেছিলাম, কিন্তু এখানকার লোকটা বলল, ডাক্তারবাবুকে এখন আর খবর দেওয়া চলবে না, তাই একটু বিরক্ত করতে হল। ডক্টর গাঙ্গুলীকে একবার খবর দিতে হবে, বিশেষ দরকার।

চোখ-মুখ দেখে রুচিরার মনে হল কারো বাড়াবাড়ি গোছের ব্যাপার কিছু। প্রথমেই তার বাবার কথা মনে হল।

-বসুন, আমি খবর দিচ্ছি।

দৌড়ে ওপরে চলে এল। ডাক্তারের বাড়ি, এ-সব ব্যাপারে ঘড়ির নিয়ম মানা চলে না। বাবা তখন আধ-শোয়া হয়ে একটা ডাক্তারি জার্নাল পড়ছেন। বলল, ইন্দ্র ব্যানার্জীর বাবার বোধহয় বাড়াবাড়ি অসুখ কিছু হবে, সে নীচে তোমাকে ডাকছে, বলল খুব দরকার

শুনে রুচিরার বাবা একেবারে তৈরি হয়ে তাড়াতাড়িই নেমে এলেন। পিছনে রুচিরাও না এসে পারল না। কিন্তু তারপর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে যে-কথা শুনল, তার দু-চক্ষু স্থির। শোনার পর লোকটার ওপর যত রাগ, বাবাকে না বুঝে-শুনে এভাবে ডেকে আনল বলে তেমনি সংকোচ।

বাবা ঘরে ঢুকতেই দুহাত তুলে নমস্কার জানিয়ে ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, আপনাকে এখনই একবার আমার সঙ্গে এক জায়গায় একটু যেতে হবে।

এ-কথা শুনে বাবা অবাক।–কি ব্যাপার?

–চলুন। সঙ্গে গাড়ি আছে। গাড়িতে বসে বলছি।

এবারে বাবা বিরক্ত একটু।–এত রাতে আমি কোথাও যাই না–কোথায় যেতে। হবে?

-পার্ক সার্কাসের দিকে। আমার এক বন্ধু কিছুদিন ধরে ভুগছিল, টাকা-পয়সার অভাবে ভাল ডাক্তার দেখাতে পারেনি। খবর পেয়ে তাকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি অজ্ঞান হয়ে আছে। চার টাকা ফী-এর এক ডাক্তার দেখছিল, সে কিছু বুঝতে পারছে বলেই মনে হল না। আপনি দয়া করে চলুন আমার সঙ্গে, আমি নিজে আবার আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব

বিরক্তি চেপে বাবা বললেন, কিন্তু এত রাতে আবার আমি পার্ক সার্কাস যাব-ওদিককার কাউকে পেলে না?

লোকটার জবাব দস্তুর মত উদ্ধত ঠেকল রুচিরার কানে। সে বলছে, আর দেরি করবেন না, আমি আপনাকেই নিয়ে যাবার জন্য এসেছি, আমি সঙ্গে থাকছি, আপনার কোনো ভয় নেই। আর রাতও খুব একটা বেশি হয়নি।

বাবা তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন একটু। তারপর বললেন, আচ্ছা, তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো, আমি ব্যাগটা নিয়ে আসছি–

ইন্দ্র ব্যানার্জী ও-দিকের দরজা দিয়ে বেরুলো, বাবা এদিকে ফিরলেন। দরজার কাছে রুচিরাকে দেখে বললেন, ব্যাগটা এনে দে–

মেয়ের দ্বিধা দেখেই তিনি বুঝলেন সে না বুঝেই তাকে ওপর থেকে ডেকে এনেছে। গলা খাটো করে বললেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই, ব্যাগটা নিয়ে আয়–না গেলে বরং ঝামেলার ব্যাপার হতে পারে, দিন-কাল ভাল নয়।

রুচিরা তক্ষুণি ওপরে এসে বাবার ডাক্তারি ব্যাগটা এনে দিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার ওই লোকটার ওপর। বাবাকে প্রায় শাসিয়েই এই রাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মনে হতে লাগল তার।

এক ঘণ্টার মধ্যেই বাবা বাড়ি ফিরলেন। রুচিরা দোতলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। নিজেই জীপ ড্রাইভ করে বাবাকে বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে গেল।

কিন্তু দোতলায় উঠতে রুচিরা দেখল বাবার এখন প্রসন্ন মুখ। তার হাত থেকে ব্যাগটা নিতে নিতে রুচিরা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। বাবা বললেন, না রে, ছেলেটার অন্তঃকরণ আছে। গিয়ে দেখি ওর সেই বন্ধু বলতে গেলে এক বস্তি-ঘরের ছেলে। তাকে ঘিরে বিধবা মা আর বোন-টোনগুলো কান্নাকাটি করছে।…হার্ট অ্যাটাক, বেঁচে যেতে পারে হয়তো, কিন্তু ঝামেলা আছে। আমাকে নিয়ে ফেরার আগে ওই বিধবা মায়ের হাতে ব্যানার্জীর ছেলেটা তিনশো টাকা গুঁজে দিয়ে এল দেখলাম, বলল, কান্নাকাটি রেখে এখন ভাল শুশ্রূষার দিকে মন দিন, কিছু ভাবনা নেই, ভাল চিকিৎসাও হবে, সেরেও যাবে।

রুচিরা তবু ফোঁস করেই বলে উঠল, আর তোমার ফী?

বাবা হাসলেন। বললেন, দূর পাগলি, এই দেখেও হাত পেতে আমি ফী নিতে পারি নাকি! চৌষট্টি টাকা ফী দেবার জন্যেই ঝোলাঝুলি করছিল, আমি ধমকে উঠতে আর কিছু বলেনি।

শুনল যা তাতে কারো রাগ হবার কথা নয়। শুনে ওরও ভাল খুবই লেগেছে। কিন্তু ওই দাপট দেখিয়ে বাবাকে টেনে বার করে নিয়ে গেছল যে সেটা কিছুতে ভোলা যাচ্ছিল না।

পরদিন গেটের সামনে ইন্দ্র ব্যানার্জীকে দেখা গেল না। মন বলল, তার সেই অসুস্থ গরীব বন্ধুকেই দেখতে গেছে।

সন্ধ্যের দিকে জীপ হাঁকিয়ে তাকে বাবার চেম্বারে আসতে দেখেছে পর পর কয়েকদিন। আবার একদিন দিনের বেলায় এসে বাবাকে নিয়েও গেছে। রুচিরা সব দোতলা থেকেই লক্ষ্য করেছে। একদিনও নীচে নেমে আসেনি। কিন্তু এখন আর রাগ নেই। ভিতরে ভিতরে উল্টে কেন যেন খুশীই একটু। বন্ধুর কঠিন অসুখে বাবা সাহায্য করছেন বলে কি আর কোনো কারণে, বলা শক্ত।

.

দুজনের সম্পর্কটা বেশ একটু সরস নাটকের দিকে গড়ালো রুচিরার বি. এ. পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুনোর পর। গাড়ি চেপে সেদিন বিকেলের দিকে, দিদির বাড়ি যাচ্ছিল, ওই মূর্তি তখন তার বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে। গাড়িতে ওকে আসতে দেখেই গেট ছেড়ে রাস্তায় এসে একটা হাত তুলে ড্রাইভারকে গাড়িটা থামাতে হুকুম করল। আর হিন্দুস্থানী ড্রাইভারটাও কিছু না বুঝে গাড়িটা থামিয়ে নিল।

মিষ্টি মিষ্টি হেসে পিছনের খোলা কাঁচ নামানো জানলায় দু-হাতে ঠেস দিয়ে বলল, কংগ্রাচুলেশনস!

রুচিরা হাসছে না। গম্ভীর।–কেন?

–শুনলাম বি. এ. পরীক্ষায় তুমি সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছ

তুমি! শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাড়-পিত্তি যেন একসঙ্গে জ্বলে উঠল রুচিরার। আর সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞানও প্রায় খুইয়ে বসল। বলে উঠল, থ্যাংক ইউ। তা তোমার নিজের পড়াশুনার দৌড় কদ্দূর?

এই ঝাপটা খেয়েই ইন্দ্র ব্যানার্জী যেন, সত্যিকারের খুশীতে আটখানা একেবারে। তার যেন কান-মন জুড়িয়ে গেল। এ-যাবৎ মেয়েদের ও স্তব-স্তুতি দেখে অভ্যস্ত। এই এক মেয়ে তার ব্যতিক্রম বটে।

বলল, নিশ্চয় সেটা তোমার জানার অধিকার আছে। তিন বছর আগের কলকাতা য়ুনিভার্সিটির গেজেট খুলে দেখো–কোনরকমে এম. এস-সি-টা পাস করেছিলাম!

এ-খবর অপ্রত্যাশিত বটে। সোজা মুখের দিকে আবার তাকাল রুচিরা, মিথ্যে বলল বলে মনে হল না। কিন্তু এ-ভারে জানলায় ঠেস দিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাখাটাই বা বরদাস্ত করে কি করে? তাছাড়া আবারও তুমি বলল, আর বলল, জানার তোমার অধিকার আছে। রুচিরার তার ওপর অধিকার ফলাবার কি দায় পড়েছে?

তেমনি ঝাঝালো সুরেই আবার বলে উঠল, তবে আর কি, এতবড় পণ্ডিত হবার, পর রাতদিন এখন লোকের ওপর মাতব্বরি করে বেড়ানো ছাড়া আর কি কাজ থাকতে। পারে!

-সে কি কথা! উৎফুল্ল অথচ আহত যেন।-আমার ওপর এই বিচার তোমার,! তুমি কলেজে চলে যাবার পরেই নাকে-মুখে ভাত গুঁজে আমাকে ছুটতে হয় কারখানায়, আমি এখন একখানা কেমিক্যাল ফার্মের অর্ধেক মালিক সে-খবর রাখো?

এ জবাব শুনে রুচিরার মেজাজ আরো গরম হল বই ঠাণ্ডা হল না। বলে উঠল,, আমি তোমার কোনো খবরই রাখি না–বুঝলে? ড্রাইভার!

ড্রাইভারটা কি ভেবে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছিল কে জানে। ডাক শুনে তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরিয়ে সেলফ টানল।

কিন্তু ইন্দ্র ব্যানার্জী হাসছে। আর তক্ষুনি জানলা ছেড়ে সরে দাঁড়াল না। বলল, মেয়েদের এমন খামোখা রাগের কি যে অর্থ কে জানে! আমি আরো খুশী হয়ে এলাম অভিনন্দন জানাতে! যাক, আমার সম্পর্কে খবর রাখে না এ তল্লাটে এমন কেউ আছে জানা ছিল না।…খবর এরপর আমিই দিতে চেষ্টা করব তাহলে।

গাড়ি ছেড়ে সরে দাঁড়াতে ড্রাইভারটাই যেন হাঁপ ফেলে বাঁচল। গাড়ি ছাড়ার পর রুচিরার মেজাজ ঠাণ্ডা হতে বেশি সময় লাগেনি। সত্যি তার রাগ করার কোনো মানে হয় না। পাড়ার মধ্যে নামজাদা মানুষ একটা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওই শুরুতেই তুমি শুনে মেজাজটা বিগড়ে গেছল। জবাবে সেও ছেড়ে কথা বলেনি—তুমি’ই বলেছে। এত হিম্মত এ-তল্লাটের কোনো মেয়ের হত বলে মনে হয় না। যেতে যেতে সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা অজানা রসের মতো পেতে লাগল রুচিরা। …এমন ডাকসাইটে মাতব্বর মানুষ, ওর পাসের খবরটা ঠিক রেখেছে। আবার রুচিরার রাগের জবাবে চান্স পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের এম. এস-সি পাস করার খবর জানিয়ে দিয়েছে। রুচিরা এটা সত্যিই আশা করেনি। এম. এস-সি পাস জেনে এখন যেন একটু ভালই লাগছে। বিদ্বানের দুরন্তপনা একটু অন্য ব্যাপার। সেটা মস্তানির পর্যায়ে পড়ে না। তাছাড়া চাকরি-বাকরির মধ্যে না ঢুকে নিজে কেমিক্যাল কারখানা করেছে এটাও পুরুষোচিত কাজ মনে হয়েছে। গোলামি করা রুচিরা দুচক্ষে দেখতে পারে না। তাছাড়া ওই লোক কোথাও চাকরি করতে গেলে রক্তারক্তি করে বেরুনোও বিচিত্র নয়।

মরুকগে। রুচিরা. এ-সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন? মাথায় ব্যাপারটা তবু ঘুরপাক খেতেই থাকল।…কায়দা করে কারখানার আধখানা মালিকানার কথাও জানিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু এর মধ্যে একটা কথা ঠিকই কানে লেগে আছে রুচিরার। ও গাড়ি চেপে এই গেট ছাড়িয়ে কলেজের দিকে চলে গেলেই ওই লোক নাকে-মুখে ভাত গুঁজে কারখানায় ছোটে। তার মানে, বাড়ির গেটের কাছে ও-সময় তার দাঁড়িয়ে থাকাটা শুধু ওরই জন্যে। কথাবার্তার মধ্যেও কোথাও যদি ছিটেফোঁটা রাখা-ঢাকার ব্যাপার থাকত! নির্লজ্জ আবার কাকে বলে!…এর পর থেকে নিজেই নিজের খবর দেবে বলে দিল। রুচিরার অস্বস্তি। এ-লোক মুখে যা বলে কাজেও অনায়াসে তাই করতে পারে। কি করবে? রোজ রাস্তায় এভাবে গাড়ি আটকাবে, না, বাড়ি এসে হাজির হবে? রুচিরার ভাবনাই ধরে গেল।

সে য়ুনিভার্সিটিতে ঢোকার মুখে এই লোককে নিয়ে ঝামেলার মোড় ঘুরল আর এক ভাবে। ঝামেলা ছাড়া আর কি বলবে রুচিরা? না, গাড়ি আর একদিনও থামায়নি। আর রুচিরার সময়ের হিসেব পায় না বলে রোজ আর গেটেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না তাকে। এম. এ. ক্লাসের রুটিন আর কলেজের রুটিনে তফাত আছে। কোনোদিন এগারোটায় ক্লাস, কোনোদিন বারোটায়, কোনোদিন একটায়। এই রুটিনের কল্যাণেই এদিক থেকে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। এদিকে য়ুনিভার্সিটিতে ঢোকার পর রুচিরার যাতায়াতের ব্যবস্থাও কিছু বদলাতে হয়েছে। বিকালের দিকে বাবা বড়জোর এক ঘণ্টা সোয়া ঘন্টার জন্য গাড়ি ছেড়ে দিতে পারেন। আগে কাছেই কলেজ ছিল, ড্রাইভার এক ফাঁকে গিয়ে তাকে নিয়ে আসত। তাই যাতায়াত দুটোই বাড়ির গাড়িতে চলত। এখন শুধু যাওয়াটা গাড়িতে হয়। আসাটা ট্রামে বা বাসে। কিন্তু রুচিরা এ পর্যন্ত ট্রাম বা এমনি বাসে উঠতেই পারে না। ওই গাদাগাদি ভিড় দেখলেই তার মাথা ঘোরে। দুই একদিন চেষ্টা করে উঠেছিল। কিন্তু ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হওয়ার দাখিল। মেয়ে দেখলে অসভ্য লোকগুলোর চাপাচাপি যেন আরো বাড়ে। সবাই যে অভব্য তাই বলে তা নয়, বেশির ভাগই সভ্য। কিন্তু এমন যাচ্ছেতাই ভিড় হলে লোকে করবেই বা কি।

অতএব ওকে আসতে হয় বেশি পয়সা খরচ করে মিনিবাসে। কিন্তু ওই সময়ে। মিনিবাসও বেশির ভাগ বোঝাই হয়ে আসে। পর পর কয়েকটা ছাড়লে একটাতে যদি জায়গা মেলে। তাও না হয় হল, কিন্তু কোনো মিনিবাসই তো উত্তর থেকে টানা দক্ষিণ কলকাতায় আসে না। এসপ্লানেডে এসে সেই মিনিবাসও আবার চেঞ্জ করতে হয়। আর এটাই সব থেকে অসহ্য ব্যাপার। এক ঘণ্টা দাঁড়িয়েও একটা মিনিবাস ধরতে পারে না এমনও হয়। ফলে রোজই বাড়ি ফিরতে রুচিরার সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়, যার ফলে বাড়ি ফেরার পর থেকে মেজাজটা খিঁচড়েই থাকে। সমস্যাটা মাকে বলেছে। মা বলেছে বাবাকে। বাবা ধকলটা অস্বীকার করেন না, কিন্তু মুখে বলেন, দশজনে। যা করছে তাই একটু-আধটু করতে পারার অভ্যাস থাকা ভাল–তা না হলে রুচির জন্যে তো আবার একটা গাড়ি কিনতে হয়।

আবার একটা মানে দাদার জন্য একটা ছোট গাড়ি আছে এবং সেটা বাবার টাকাতেই কেনা। দাদাও ডাক্তার। কিন্তু তার গাড়ি চাওয়া আর তার একখানা হাত বা পা চেয়ে বসা যেন একই ব্যাপার। দাদার পসার বাবার ষোল আনার এক আনাও না। কিন্তু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার গাড়ি চরকির মতো কলকাতার রাস্তা চষে বেড়াচ্ছে। গাড়ি পেতে হলে বউদিকেই দস্তুরমতো ঝগড়াঝাটি করে আদায় করতে হয়। তাছাড়া দাদার গাড়ি পেলেই বা কি? চালাবে কে? দাদা তার নিজের গাড়ির নিজেই ড্রাইভার।

গাড়ি আরো একখানা বাবা ইচ্ছে করলে কিনতে পারেন বটে, কিন্তু এম. এ. পড়ার জন্য ড্রাইভার সমেত আরো একটা গাড়ি রাখার কথা ভাবতেও রুচিরার লজ্জা।

এই ভাবেই চলেছিল গোড়ার মাস দুই। তারপর হঠাৎ ব্যতিক্রম একদিন। ছুটির পর মিনিবাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। ঘ্যাঁচ করে পাশেই একটা জীপ এসে থামল। তার পরেই চক্ষুস্থির রুচিরার। সেই জীপে শুধু ড্রাইভার বসে। এবং সে স্বয়ং ইন্দ্র ব্যানার্জী। রুচিরা তাকে না দেখতেই চেষ্টা করল। তাড়াতাড়ি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু জীপ থামিয়ে যে দাঁড়িয়ে গেছে সে এটুকু দেখেই চলে যাবার লোক নয়। জীপের ওই বিতিকিচ্ছিরি হর্নটা টিপে ধরে বসে রইল। আর একটানা সেই শব্দে বাসের জন্য আর যারা অপেক্ষা করছিল, চকিত হয়ে তারা ওদের দুজনকেই দেখতে লাগল।

বিপাকে পড়ে রুচিরাকে আবার ওই জীপের দিকেই ঘুরে দাঁড়াতে হল। আর একগাল হেসে তক্ষুণি ওই বেহায়া বেশ চেঁচিয়েই অতিপরিচিতের মতো বলে উঠল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়াশুনার ধ্যান হচ্ছে নাকি? উঠে এস

ঠিক যেমনটি হলে রুচিরার মাথায়ও ঝোঁক চেপে যায়, এও যেন তেমনি। পরিস্থিতি একটি। কোনোদিকে না চেয়ে সোজা জীপে উঠে এল। পাশের সীটে বসল। তারপর গাড়ি তিরিশ গজ এগোতেই ঝাঝাল গলায় জিজ্ঞাসা করল, এ-রকম অসভ্যতার মানে কি?

সামনের দিকে চোখ রেখে হাসিমুখে নির্লিপ্ত গলায় ইন্দ্র ব্যানার্জী ফিরে জিজ্ঞাসা করল, দেখেও না-দেখার ভান করে অন্য দিকে ঘাড় ফিরিয়ে থাকার মানে কি?

-মানে আমার দেখার ইচ্ছে নেই।

–আমারও অসভ্যতার মানে জোর করে দেখানোর ইচ্ছে।

আরো রাগত স্বরে রুচিরা বলল, আমি জীপে না উঠলে কি করতে পারতে?

–না উঠতে পারলে তুমি উঠতে না। আমার ইচ্ছে বাতিল করা খুব সহজ ব্যাপার নয়।

–তাহলে গাড়ি থামাও, আমি নেমে যেতে পারি কিনা দেখো!

থামানোর বদলে হাসতে হাসতে গাড়ির বেগ আরো বাড়িয়ে দিল ইন্দ্র ব্যানার্জী। তারপর আলতো করে বলল, এত রাগের কারণ কি, ট্রামে-বাসে চাপাচাপি করে যেতে খুব ভাল লাগত?

–হ্যাঁ, লাগত। তোমার তাতে কি? সত্যি সত্যি এত রাগ কেন হচ্ছে রুচিরা জানে না।

-হিংসে, স্রেফ হিংসে।…তা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলে, গাড়ি কি হল? রুচিরা এবার চেষ্টা করল ঠাণ্ডা হতে। ও যত রেগে যাচ্ছে, লোকটার যেন তত মজা। জবাব দিল, গাড়ি ঠিকই আছে, কারো হিংসে হলেই এখানে চার বার করে গাড়ি যাতায়াত করবে না।

-তার মানে রোজ ট্রাম-বাসে যাতায়াত?

 –আসি গাড়িতে, যাই মিনিবাসে।

–তার মানে তো আবার একদফা এসপ্লানেডে চেঞ্জ!

–তাতে কার কি?

হাসছে আবার বলল, এই যুগটাই অন্যরকম। কত ধকল বাঁচালাম, উপকার করলাম–তার বদলে পাচ্ছি রাগ। অবশ্য এও আমার ভালই লাগছে।

– আবারও রাগের অনুভূতিটা ঠেলে তরল করল রুচিরা। ঠাণ্ডা মুখে জিজ্ঞাসা করল, ধকল বাঁচানো আর উপকার করার জন্য জীপ নিয়ে ঘুরে বেড়াও?

হাসছে।–কাজ না থাকলে তাও বেড়াই। ধকল বাঁচানো আর উপকার করার। মতো মেয়ে দেখলে তুলেও নিই।

কানের ভিতরটা রি-রি করে উঠল রুচিরার।–আমাকে তুলে নেবার মতো মেয়ে ভেবেছ?

সামনে চলন্ত গাড়ির ভিড়। তার ফাঁকেই মুখ ঘুরিয়ে ওকে একবার ভাল করে দেখে নিল। হেসে উঠল হা-হা করে। জবাব দিল, তুলে নিলাম কিনা দেখলে না?

রুচিরা গুম হয়ে বসে রইল। মনে মনে নিজেরই মুন্ডপাত করতে লাগল সে। কেন সে জীপে উঠতে গেল! এবারে কিছুটা আন্তরিক সুরে ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, সত্যি অনেক দিন তোমাকে না দেখে মেজাজটা এত খারাপ হয়ে গেছল! আজ ভাগ্যিস ঠিক এই সময়ে এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম!

এ-কথা শোনার পর রুচিরার কেন যেন আগের মতো রাগ হল না। দোষ এই লোকেরই। হঠাৎ হঠাৎ মগজের মধ্যে ওলট-পালট কাণ্ড বাধিয়ে দেয়। ইচ্ছে থাকলেও ঠাণ্ডা মাথায় এখন দুটো ভাল কথা বলার উপায় নেই।

এসপ্লানেড ছাড়িয়ে জীপ মাঠের মাঝের ফাঁকা রাস্তা ধরে ছুটল। স্পীড কম করে ষাট মাইল হবে। রুচিরা আড়চোখে দেখছে এক-একবার। লোকটার যেন ধৈর্য বলে কিছু নেই, সবেতে হুড়মাড় ব্যাপার।

বাড়ির সামনের মোড়টার কাছে আসার আগেই রুচিরা বলল, এখানে থামতে হবে।

-কেন?

–আমি নামব।

–কেন?

–কেন আবার কি, আমার খুশি!

কেন এখানে নামতে চায় ইন্দ্র ব্যানার্জীর না-বোঝার কথা না। বাড়ির লোকেরা আর পাড়ার লোকের চোখ এড়াতে চায়। আপত্তি না করে জীপ থামাল। রুচিরা নেমেই হন হন করে সামনে এগোলো। পিছনে বসে লোকটা যে হাসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পরদিনও য়ুনিভার্সিটির শেষ ক্লাস সারা হবার আগে রুচিরার কেমন মনে হল ইন্দ্র ব্যানার্জী আজও জীপ নিয়ে আসবে। প্রোফেসারের লেকচার শোনা হয়ে গেল। আর কিছু কানে ঢুকছে না। ঘণ্টা বাজতে রুচিরা বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবছিল, তাকে ফাঁকি দেবার জন্য উল্টো দিকের কোনো ট্রামে বা বাসে উঠে পড়বে কি না। কিন্তু ভিতর থেকে সায় মিলল না। তাতে কোথায় যেন নিজেরই লোকসান। আসে। যদি, আর কিছু না হোক বাসে ওঠা আর বাস বদলানোর ধকলটা তো বাঁচে।

য়ুনিভার্সিটির গেটের বাইরে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিচিত হর্ন। রুচিরা বিষম চমকে ঘুরে তাকাল। আজ একেবারে য়ুনিভার্সিটির ফুটপাথ ঘেঁষেই জীপ নিয়ে অপেক্ষা করছে। হাসছে।

রুচিরা থমকে দাঁড়াল একটু। চোখে চোখ। হঠাৎ হাসি পেয়ে যাচ্ছিল তারও। কিন্তু হাসল না। এমন মুখ করে জীপে গিয়ে উঠে বসল যেন ওরই জীপে ড্রাইভার গোছের কেউ অপেক্ষা করছে। ভিড়ের মধ্য দিয়ে সুপটু হাতে চালাতে চালাতে হৃষ্টমুখে ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, আজও আসব, ভাবনি তো?

ভেবেছি। তোমার কেমিক্যাল কারখানা কি এদিকে নাকি?

হেসে উঠল।আমার কারখানা উল্টোদিকে, এখান থেকে বারো মাইল দূরে সেই যাদবপুর ছাড়িয়ে গড়িয়ার কাছাকাছি।

-তেলের অভাব নেই বোঝা যাচ্ছে।

ইন্দ্র ব্যানার্জী আরো হাসতে লাগল।–এই দিনে আবার তেলের অভাব! একটু তেল দেবার জন্য গৌরী সেনরা সব বসেই আছে।

-বেশ। এ-রকমটা সপ্তাহের মধ্যে কদিন চলবে?

–এ-রকমটা মানে?

–এই বারো মাইল ঠেঙিয়ে, এসে আমার ট্রাম-বাসের ধকল বাঁচানো?

গম্ভীর মুখেই একটু হিসেব করে নিল।-সপ্তাহে দুতিন দিন আমাকে চৌরঙ্গীর দিকে আসতেই হয়।

ছদ্ম গাম্ভীর্যে একটা নিশ্বাস ফেলল রুচিরা। মাত্র!

ইন্দ্র ব্যানার্জী সকৌতুকে ফিরে তাকাল একবার।-বল তো বাকি কদিন কারখানার ড্রাইভারকে দিয়ে জীপ পাঠিয়ে দিতে পারি।

রুচিরা এবারে উৎসুক যেন একটু। ঘুরে তাকাল।–দুতিন দিনই যথেষ্ট, এই দুতিন দিনও শুধু ড্রাইভারকে পাঠানো যায় না?

ইন্দ্র ব্যানার্জী আবার ঘাড় ফেরালো তার দিকে। রুচিরা হেসেই ফেলল।

.

বলতে গেলে বছরের মধ্যে ছমাসই ছুটি কলেজ-য়ুনিভার্সিটিগুলোর। সব মিলিয়ে বাকি ছমাসের মধ্যে সপ্তাহে দুতিন দিন সত্যিই ইন্দ্র ব্যানার্জীর জীপে চেপে সে বাড়ি ফিরেছে। না, বাড়িতে নয়, সামনের ওই মোড় পর্যন্ত। কিন্তু পাড়ার অনেকের সেটা চোখে পড়েছে। য়ুনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েরা তো কিছু একটা ধরেই নিয়েছে। কিন্তু সত্যিই এই একটা বছরে ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দিন কোনো রকম কথা-বার্তা হয়নি। মানুষটা কত যে বেপরোয়া এই একটা বছরে রুচিরা খুব ভাল বুঝে নিয়েছে। এ-রকম লোককে কথায় কৌতুকে বিদ্রপে নাজেহাল করতে পারার মধ্যে বেশ একটা মাদকতা আছে। মেজাজ দেখালে রুচিরা ডবল মেজাজ দেখায়। ইন্দ্র ব্যানার্জী ওর দিকে চেয়ে হাসে। বলে, তোমার অদৃষ্টে দুঃখ আছে।

রুচিরা জবাব দেয়, অদৃষ্টের হাত তোমার ইচ্ছেয় ঘুরবে না কোনোদিন।

 কিন্তু এর বেশি কথা কখনো হয়নি।

এরপর সুশীতল চক্রবর্তীর ওই প্রস্তাব, আর রুচিরার প্রত্যাখ্যান এবং অস্বস্তি। সুশীতল যা বুঝে গেছে তার অনেকটাই যে সত্যি, রুচিরা সেটা অনুভব করে। কিন্তু সত্যি তো ইন্দ্র ব্যানার্জীর সঙ্গে এ-নিয়ে কোনো রকম ফয়সলায় আসেনি সে।

দুদিন বাদে তার সঙ্গে দেখা। জীপ একটু ফাঁকায় আসতে রুচিরা জিজ্ঞাসা করল, সুশীতল চক্রবর্তীকে চেনো?

-না। সে আবার কে?

–য়ুনিভার্সিটির নামকরা ছাত্র ছিল আগাগোড়া, এখন কলেজের প্রোফেসর। সম্পর্কে দিদির দেওর। বি. এ. পড়ার দুবছর আমাকে বাড়িতে এসে পড়িয়েছে–

মুখে শুঙ্কার ভাব এনে ইন্দ্র ব্যানার্জী জিজ্ঞাসা করল, বিনে পয়সায়?

-তাছাড়া আবার কি? এখনও পড়াচ্ছে।

–কি সর্বনাশ! তারপর?

পরশুর আগের দিন সে এসে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল।

রুচিরা হঠাৎ সত্যি সত্যি গম্ভীর দেখল ইন্দ্র ব্যানার্জীর মুখ। জীপটা রাস্তার ধারে– থামিয়ে দিতে দেখে আরো অবাক।

ইন্দ্র ব্যানার্জী জীপেই ঘুরে বসল তার দিকে।লোকটার ঠিকানা কি?

–তার ঠিকানা দিয়ে কি হবে?

–ধড় থেকে মাথাটা নামিয়ে নিয়ে আসি।

রুচিরা হঠাৎ যেন ধাক্কাই খেল একটা। মানুষটা সত্যি-সত্যি ক্রুদ্ধ না ইয়র্কি করছে তাই বোঝা গেল না। এবারে সেও ঝাঁঝিয়ে উঠল, ইস, মুরোদ কত, তুমি তার গায়ে আঙুল ছুঁইয়ে দেখ দেখি!

এবারে ঠাণ্ডা হল একটু।–তোমার সায় না থাকলে ছোঁয়াব না। তারপর কি দাঁড়াল?

–কি আবার দাঁড়াবে? মাঝখানে তুমি দাঁড়ালে।

 এবারে উৎফুল্ল।–সত্যি?

 রুচিরা হাসিমুখে মাথা নাড়ল। সত্যি।

আনন্দে জীপ হাঁকাল আবার। একটু ভেবে নিয়ে রুচিরা বলেই ফেলল, কিন্তু এ-ভাবে আর কতদিন চলতে পারে? তোমার মতলবখানা কি?

–আমার মতলব অনেকদিন ধরেই খারাপ। এম. এ. পরীক্ষার আগে তোমার যদি আপত্তি না থাকে তো ঝুলে পড়ি এসো!

রুচিরা ধমকে উঠল, কথাবার্তার ছিরি কি! বাবাকে তো বলতে হবে।

–আজই চল। বলে ফেলি।

রুচিরা হেসে ফেলল। ভাল লাগছে। এই মানুষকে ভয়ানক ভাল লাগছে আজ তার। এরকম ভাল লাগার স্বাদ এই যেন প্রথম। মাথা নাড়ল, তোমাকে বলতে হবে না, আমি মাকে বলে রাখব, আমাদের বাড়ি থেকে তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব গেলে তিনি যেন আকাশ থেকে না পড়েন–তাঁকে বলে রেখো। বুঝেছ?

-খুব বুঝেছি। তোমার আমার ব্যাপারের মধ্যে আবার বাবা-মাদের ধরে টানাটানি। ঠিক আছে

জীপ হাওয়ায় ছুটেছে এখন। এক নামকরা অভিজাত হোটেলের সামনে এসে থামল সেটা। রুচিরাকে নামিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। দিনটা সেলিব্রেট না করে আজ আর বাড়ি ফিরতে দিচ্ছে না তাকে, আগেই বলেছে। রুচিরা হাঁ করে দেখল, এখানকার কায়দা-দুরস্ত মানুষগুলো সব এই লোকের সুপরিচিত। কোট প্যান্ট টাই পরা একজন ছুটে এল। কি কথা হল রুচিরা জানে না। লিফটে করে দোতলায় নিয়ে গিয়ে সে তাদের ছোট্ট ফিটফাট গালচে বিছানো ঘরে এনে ছেড়ে দিল। ঘরে বড় বড় শৌখিন সোফা সেটি পাতা।

লোকটা চলে যেতে রুচিরা জিজ্ঞাসা করল, এখানে কি?

 –এখানে খাওয়াদাওয়া আর আনন্দ।

বলেই দরজাটা জোরে ঠেলে দিয়ে মানুষটা আচমকা যে আনন্দে মেতে উঠল তার জন্য রুচিরা একটুও প্রস্তুত ছিল না।

ওর হাড়-পাজরগুলোও যেন খসে খসে পড়বে! ওই বুকের সঙ্গে ওর বুক পিষে ফেলার আগে যেন ছাড়বে না। এমন চুমু খেয়ে চলেছে যে দম বন্ধ হওয়ার দাখিল। গোটা দেহটা অবশ করে ফেলছে। তারপর পিঠের ওপর অকরুণ দুটো হাতও যেন অবাধ্য হয়ে উঠছে।

শেষে প্রাণপণ চেষ্টায় রুচিরা ছাড়িয়ে নিল নিজেকে দূরে সরে গিয়ে হাঁপাতে লাগল। মাথা ঝিম ঝিম করছে তখনো। ইন্দ্র ব্যানার্জী হাসছে তার দিকে চেয়ে।

–আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি-এই অসভ্যতা করার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ?

ইন্দ্র ব্যানার্জীর অবাক মুখ।-এর নাম অসভ্যতা?

আবার এগোচ্ছে ওর দিকে।

–ভাল হবে না বলছি! আমি চলে যাব।

 হাসতে হাসতে ইন্দ্র ব্যানার্জী একটা সোফায় বসে পড়ল।

.

দেড় মাসের মধ্যে বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ে ঠিক হবার পর তাড়া ছেলের তরফেরই বেশি। কারণ, ইন্দ্র ব্যানার্জীর বাবার শরীর হঠাৎ বেশি রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ব্লাডপ্রেসার সর্বদা টঙে উঠে থাকে। কখন কি হয় ঠিক নেই, বিয়ে যখন হবে, আগেই হয়ে যাওয়া ভাল।

এই দেড় মাস সাগ্রহে একটি একটি করে দিন গুনেছে রুচিরাও। এই দেড় মাসের অবাধ মেলামেশায় চিরার বাড়ির দিক থেকেও কোনো আপত্তির প্রশ্ন ওঠেনি। তাই এই সময়টুকুর মধ্যে লোকটার পুরুষকারের ছটা আরও যেন অনেকগুণ বেশি চোখে পড়েছে। তার সঙ্গে তাদের ক্লাবে গেছে, পার্টিতে গেছে, কংগ্রেসের উৎসবে গেছে। ওই লোকের সর্বত্র মাদর। বড় বড় ঘরের মেয়েরা পর্যন্ত তার পিছনে পিছনে। ঘোরে, একটু তোয়াজ তোষামোদ করতে পেলে বর্তে যায়। মদ খাওয়া রুচিরা পছন্দ করে না, দাদা চুপিচুপি মাঝেসাঝে খায় টের পায়। কিন্তু মদ খাওয়ার পর সকলের যে মূর্তি, এর তা নয়। মদ আর জল দুই-ই যেন সমান তার কাছে। চোখ আর মুখ সামান্য লাল হয় শুধু, আর কোনো বিকার নেই, তার পরেও দিব্যি গাড়ি হাঁকিয়ে। বেড়ায় ওকে নিয়ে।

এত সব রূপসী চটকদার মেয়ে থাকতে এই লোক ওর মধ্যে কি দেখল। রুচিরা সময় সময় ভেবে পায় না। দেখে-শুনে মনে হয়েছে, যাকে ডাকত সেই বর্তে যেত।

রুচিরার দিন গোনার আরো একটা কারণ, ভয়। এই মানুষের বেপরোয়া মতিগতির কিছু বিশ্বাস নেই। অভিজাত হোটেলের সেই ঘরে আরো একাধিক দিন ওকে নিয়ে গিয়ে তুলতে চেয়েছে। রুচিরা সরাসরি বেঁকে বসতে অবুঝের মতো রাগও করেছে। সঙ্গে আরো ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা ছিল বলে একদিন নির্ভয়ে গেছল। হোটেলের ওই ঘরটা যেন এরই দখলে। চাইলেই মেলে–ঘণ্টা দেড় দুই খানাপিনা হৈ-হুঁল্লোড়ের পর রুচিরা বেশ বুঝল চালাকি করেই অন্য মেয়ে-পুরুষদের জুটিগুলোকে একে একে বিদায় দেওয়া হচ্ছে। বিয়ের তখন মাত্র আর নদিন বাকি। শেষ জুটি বিদায় নিয়ে বেরোবার আগেই রুচিরা উঠে পড়ল। যাবে। গম্ভীর মুখে ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, বিল নিয়ে আসছে, মিটিয়ে দিয়ে বেরুচ্ছি, বসো।

তারপরেই এগিয়ে গিয়ে চোখের পলকে দরজার লক টেনে দিল।

সেই একদিনের মতোই ব্যাপার শুরু হল তারপর। কিন্তু শেষ কোন দিকে গড়াচ্ছে, মতলবখানা কি রুচিরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। সেটা চোখেমুখে স্পষ্ট লেখা। কিন্তু এ-দিন আর অপ্রস্তুত ছিল না। জোর করে বার বার তাকে ঠেলে সরিয়েছে। শেষে রেগেই গেছে অবুঝ মানুষটা।

-কেন?

 –না।

 –না কেন, বিয়ের তো নদিন মাত্র বাকি আর।

রাগ হয়ে যাচ্ছিল রুচিরারও।–সেই কাণ্ডজ্ঞান যদি থাকে তো ওই নদিন আগে তুমি আমাকে ছোঁবে না পর্যন্ত বলে দিলাম!

–আচ্ছা, অবাধ্যতার ফল টের পাবে! প্রচণ্ড রাগ চেপেই ঘর থেকে বেরিয়েছে। ইন্দ্র ব্যানার্জী।

নটা দিন এরপর ভালয় ভালয় কেটেছে। বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ফুলশয্যার রাতে ভিতরে ভিতরে বেশ একটু ধাক্কাই খেয়েছে রুচিরা। ভিতরে ভিতরে মানুষটা সত্যি নিষ্ঠুর কিনা ভেবে পায়নি। নদিন আগের সেই অবাধ্যতার জবাব দেবারই যেন রাত এটা। সারাক্ষণ শিকারীর মতো সময় আর সুযোগের অপেক্ষায় ছিল যেন। সেটা মিলতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

তারপর এই দেহটা যেন শুধু তারই বেপরোয়া ভোগের সামগ্রী। এর সঙ্গে আর কারো যেন আনন্দের যোগ নেই। ছিঁড়ে-খুঁড়ে একাকার করে দিয়ে মত্ত উল্লাসে বিস্মৃতির অতলে ডুবে যাওয়ার তাড়না। না বলেও পারেনি।

এ রকম করছ কেন? আমি কি ফুরিয়ে যাচ্ছি যে একেবারে খেয়ে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি নেই?

চোখে-মুখে সেই রকমই উল্লাস নিয়ে ইন্দ্র ব্যানার্জী সদর্পে বলেছে, আমার কথা শোননি কেন? আমার অবাধ্য হয়েছিলে কেন?

রুচিরার দিক থেকে প্রথম ফুলশয্যার রাত ব্যর্থ গেছে।

মেজাজ-পত্র তার ঠাণ্ডা হলে কি হত বলা যায় না, মন বুঝে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করলে কি হত তাও বলা যায় না। কিন্তু রুচিরার মনে হত সে-ভাবে চলা মানে একজনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাসী হয়ে থাকা। পরিচয়ের গোড়ায় যে-ভাবে ফোঁস করে। উঠত, এখনো তার সেই মেজাজ। বিয়ের আগে ইন্দ্র ব্যানার্জীর কাছে তার এই মেজাজ একটা বড় আকর্ষণ ছিল। বিয়ের পরে বউয়ের এই মেজাজ নিজের একচ্ছত্র বশে আনার অহংকারে ঘা পড়লে সেও কড়া দাপটের মানুষ।

প্রথম পনেরো বিশটা দিন তৃষ্ণা যেন মাথায় চেপেই থাকল তার। বেপরোয়া সম্ভোগে কোনোরকম বাধা বরদাস্ত করার পাত্র নয়। কিন্তু মদ খেয়ে এলে রুচিরা সাফ বলে দিয়েছে, ও-সব খেয়ে এদিক ঘেঁষবে না। ব্যস, তারপর আরো বেশি খাবে আর জোর করেই আরো বেশি ঘেঁষবে, দখল নেবে। তারও সাফ কথা, দেখো, আমার ইচ্ছেটাই সব, যখন যেমন চেয়েছি তেমনি হয়ে আসছে, আর তেমনি হবে! তুমি এটা মনে রাখলে ভাল, না রাখলে কিছু এসে যায় না, তবে তাতে তোমারই অশান্তি!

আর এক ব্যাপারে রুচিরা গোড়াতেই সাবধান করে দিয়েছিল। এম. এ. ফাইনাল। পরীক্ষার আগে কোনো ছেলেপুলে নয়। তারও সাফ জবাব, ও তোমার ব্যাপার তুমি ভাববে, সাবধান হতে হয় নিজে হবে–এসব আমার কোষ্ঠীতে লেখা নেই।

গোড়া থেকেই বুকের তলায় ঘা পড়ছিল রুচিরার। কিন্তু এখনো সে ভাবতে চায় না জীবনের সব থেকে বড় ব্যাপারে সব থেকে বড় ভুলটাই সে করে বসেছে। কিন্তু সে-রকম কোনো গণ্ডগোল দানা বেঁধে ওঠার আগেই বাড়ির কর্তা অর্থাৎ রুচিরার শ্বশুর হঠাৎ বেশিরকম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন আবার এই ছেলের মতিগতি অন্যরকম দেখল। রুচিরার বাবার তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শ্বশুরের তাতে আপত্তি। ছেলে দুহাতে পয়সা খরচ করে হাসপাতালের সমস্ত সুব্যবস্থা বাড়িতেই করে ফেলল। শাশুড়ী অনেককাল আগেই গত হয়েছিলেন, রুচিরা ভিন্ন বাড়িতে আর দ্বিতীয় মেয়েছেলে নেই। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য দুজন নার্স রাখা হল, আয়া রাখা হল। রোগীর অবস্থা যত ঘোরালো হয়ে উঠছে, ইন্দ্র ব্যানার্জীর মনের অবস্থাও তত খারাপ হচ্ছে। দিন-রাত বাপের কাছে বসে থাকে, কারখানায়ও যায় না। পাগলের মতো সাত বার করে রুচিরার বাবার কাছে ছোটে। বাবাকে সারিয়ে তুলতেই হবে -আর কি করা যায়?

সেদিন তো রুচিরার সামনে ওর বাবাকে ধমকেই উঠল প্রায়, একটুও তো সুবিধের দেখছি না, আরো বড় ডাক্তার কে কোথায় আছে ডাকুন!

এই রোগে রুচিরার বাবাই নামজাদা স্পেশালিস্ট। কিন্তু জামাইয়ের মানসিক অবস্থা দেখে কোনো অভিমান না রেখে ভদ্রলোক আরো দুজন নামকরা ডাক্তার নিয়ে এলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না শেষ পর্যন্ত। ওদের বিয়ের আড়াই মাসের মধ্যে শ্বশুর চোখ বুজলেন।

…এই দাপটের ছেলেকে খুন বাপের বুকের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে দেখেছে। রুচিরা। একেবারে অসহায় বাচ্চা ছেলের মতো কান্না। রুচিরাই তখন সান্ত্বনা দিয়েছে। তাকে। টেনে তুলতে চেষ্টা করেছে। ওই লোক তখন অকারণে রাগ করলে বা বিরক্ত হলেও ওর সহিষ্ণুতায় ফাটল ধরেনি।

কিন্তু মানুষের চরিত্র যাবে কোথায়? আবার দুমাস যেতে-না-যেতে যে-কে সেই। বাবা ঘরে থাকার দরুন ঘরে যেটুকু সংযম ছিল সেটুকুও গেল। আবার খটাখটি বাধতে লাগল। রুচিরা যদি চুপচাপ দেখে যায়, যা বলে প্রতিবাদ না করে শুনে যায়,তাহলে হয়তো কোনো গোল থাকে না।কিন্তু অন্যায় দেখলে বা স্নায়ুতে ঘা খেলে রুচিরাও যুঝতে ছাড়বে না। যা বলার সোজাসুজি বলে দেবে। কিন্তু বাধা পেলেই মানুষটার ভিতরে যেন কি বিষের ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। অন্যায় বা জুলুম বুঝলেও জোর করেই তা করবে। সব কিছুই তখন যেন একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে যায়। উল্টে শাসায়, কারো বাবার ধার ধারি না, ভাল না লাগে চুপ করে থাক, মাস্টারি করতে এসো না।

রুচিরার ধারণা, ও পছন্দ করে না বলেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়িতে বসেই এক-এক সন্ধ্যায় মদ গেলে এখন। রাগ করে রুচিরা বাপের বাড়ি চলে এলে দস্তুরমত শাসায়, এ-ধরনের অবাধ্যতা বরদাস্ত করার ধাত নয় তার। সেই মত্ত অবস্থাতেই এক-এক রাতে জোর করে দখল নিতে আসে। নেয়ও। ও কিছুতে আপত্তি করলেই সেটা আরো বেশি করে করার দুরন্ত ঝোঁক চাপে লোকটার। এমন কাণ্ড করে যে রুচিরার মাথা খারাপ হবার দাখিল এক-একসময়।

তার স্তাবকের সংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে। আড্ডায় বসে গেলে কারখানা কামাই করে। বলতে গেলে ঝাঝালো জবাব দেয়, আমি কারখানায় যাই বা না যাই তোমার তাতে কি?

অবশ্য রুচিরা যখন বলতে যায় তখনো সেটা একেবারে শ্লেষশূন্য হয় না। এদিকে কোথা থেকে তাড়া তাড়া নোট আসছে, রুচিরা ভেবে পায় না। ওড়াচ্ছে, ফুর্তি করছে। কিছু বলতে গেলেই দাবড়ানি। কিন্তু বলার যা রুচিরাও বলবেই। আরো খারাপ লাগে। যখন সাঙ্গোপাঙ্গর মারফত একে-ওকে হুমকি দিয়ে পাঠায়। রুচিরা বলে, এটা কি মগের মুলুক নাকি?

সে হেসে জবাব দেয়, মগের মুলুক কিনা দেখছ না?

রুচিরার ভিতরটা বিষিয়েই যেতে থাকল। মনের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সে বছর আর তার এম. এ. পরীক্ষাই দেওয়া হল না। হেসে হেসে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে ছড়াল ইন্দ্র ব্যানার্জী। বলল, ভালই হল, এই বিদ্যের ঝঝেই অস্থির আছি।

মেয়ে কেমন আছে রুচিরার বাবা-মায়ের কাছেও সেটা গোপন থাকল না। একদিন জামাইকে এ নিয়ে দুকথা বলতে এসে বাবা দস্তুরমতো অপমানিত হয়ে ফিরে গেলেন।

গোঁ ধরে রাতে এক-একদিন বাড়িই ফেরে না ইন্দ্র ব্যানার্জী। রুচিরা একদিন কটুক্তিই করে উঠেছিল। জবাবে সে বলেছে, হোটেলের সেই একটা ঘর তো তুমি চেনো, সে-ঘরে তোমার আগেও মেয়ে এসেছে, এখনো আসে–বুঝলে?

শুনে রুচিরা স্তব্ধ। তখন থেকেই পরিত্রাণের রাস্তার কথা ভাবতে লেগেছে কিনা বলা যায় না। এর কিছু দিনের মধ্যে শেষ ঘনাল সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার নিয়ে।

যে-বাড়িতে থাকে তার ভাড়া মাসে ছশো। এখন এ-বাড়ি ছাড়লে ভাড়া তার ডবল হবে। শ্বশুর থাকতে কখনো বাড়িভাড়া বাকি পড়েনি। কিন্তু এখন চার মাসের ভাড়া বাকি। বার কয়েক লোক পাঠিয়ে বয়স্ক বাড়িঅলা নিজে এসেছেন ভাড়ার তদবির করতে।

তাকে দেখেই ইন্দ্র ব্যানার্জী খাপ্পা-লোক পাঠিয়ে উত্যক্ত করছেন, এখন নিজে এসেছেন ভাড়া আদায় করতে, কেমন? যান, দেব না–হিম্মত থাকে কোর্টে গিয়ে ভাড়া আদায় করুন।

শুকনো পাংশু মুখে ভদ্রলোক চলে যেতেই লজ্জায় অপমানে রুচিরা ঝলসে। উঠল।–এ-সবের মানে কি আমি জানতে চাই! এদিকে টাকা ওড়াচ্ছ, ফুর্তি করছ, আর চার মাস ভাড়া দাওনি লজ্জা করে না? নিজে দোষ করে আবার ছোটলোকের মতো ভদ্রলোকের ওপর হম্বি-তম্বি করছ?

ছোটলোকের মত শুনেই ইন্দ্র ব্যানার্জীর মাথায় রক্ত উঠে গেল। মুখের সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। চোয়াল দুটো এটে বসল।–কি বললে?

–কি বললাম তুমি শোননি?

–শুনেছি। আর একবার বল তো?

–বললে তুমি কি করবে?

–একটা একটা করে ওই দাঁতগুলো খুলে নেব।

 রুচিরা থমকাল। তক্ষুণি মনে হল, পারে। এও পারে।

দুপুরে সে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুচিরা নিজের ট্রাঙ্ক গোছাল। গয়নাপত্র সব বার করে নিল। তারপর একটা ট্যাক্সি ডেকে সোজা বাপের বাড়ি।

তারপর দিন গেছে, মাস গেছে, একে একে দুটো বছর ঘুরেছে। ওই এক মানুষকে নিয়ে এই বাড়িতে, এ-বাড়ির রাস্তায় অনেক ঝড় বয়ে গেছে। হুমকি শাসানি আর শেষ পর্যন্ত বোমাবাজীর ভয় পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।

গোঁ রুচিরার বাবারও কম নয়। নামী ডাক্তার, পাঁচজন হোমরা-চোমরা মানুষ খাতির করেন তাকেও। তাদের সহায়তায় বোমাবাজীর হাত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। বাড়িতে তবু বাড়তি দরোয়ান রাখতে হয়েছে। রুচিরাকেও একলা কোথাও বেরুতে দেওয়া হয়নি।

এদিকে কেস চলেছে। জোর ও-তরফেরও কম নয়। বিচ্ছেদের মামলা আনা হয়েছিল রুচিরা স্বামীর ঘর ছাড়ার পাঁচ মাস বাদে। কোর্টের রায় বেরুতে আরো ন-দশ মাস!

সব মিলিয়ে সাতাশ মাসের একটা অধ্যায় শেষ। এর পরেও হামলা হত কিনা বলা যায় না। কিন্তু দেশের হাওয়া রাতারাতি বদলেছে। দিল্লীর শাসন-ক্ষমতা জনতার হাতে এসেছে গত মার্চের শেষে। এখানকার এতদিনের ডাকসাইটে পাণ্ডাদের মাথায়ও আচমকা বজ্রাঘাত ঘটে গেছে যেন। এপ্রিলের এই গোড়াতেই কোর্টের রায় বেরুল।

.

এক বছর বাদ গেছে, তার পরের বছরেই এম. এ. পাস করে ঘরে বসেছিল। রুচিরা। এতদিন সাহস পায়নি, এখন একটা কাজ-টাজ দেখে নেবার ইচ্ছে। নইলে সময় কাটে কি করে?

কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর কোথা থেকে যে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ঘেঁকে ধরেছে তাকে কে জানে। কিচ্ছু ভাল লাগে না। ওই দাপটের মানুষের এখন আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেউ আর কেয়ার করে না তাকে। শুনেছে, বাড়িঅলাও এবার তার বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দিয়েছে।

দিদির আবার মতলব, সুশীতলের সঙ্গেই এবার তার বিয়েটা হোক। এ-পর্যন্তও সে বিয়ে করেনি। দিদি প্রায়ই বোনের মন বুঝতে আসে। কিন্তু রুচিরা কি বলবে? নিজের মনের হদিস নিজেই ভাল পায় না।

সুশীতল চক্রবর্তী নিজেই এল একদিন। রুচিরার হাঁস-ফাস দশা। কথা উঠলে কি বলবে জানে না।

কিন্তু নরম করে সুশীতল যে-কথা বলল, এ-রকমটা শোনার জন্যও প্রস্তুত ছিল। বলল, দেখ তোমার দিদির একটা মতলব টের পাচ্ছি। সেই জন্যই তোমাকে দুটো কথা বলতে এলাম, নইলে তুমি ভাববে হয়তো আমার ইচ্ছে বুঝেই তিনি এই মতলব করছেন। কিন্তু আমি তোমাকে সত্যি কথা বলছি, আমি এতে রাজী নই…আমার মতো মানুষকে ভালবাসতে পারলে তুমি আগেই বাসতে। তুমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস। করেই একজনকে ভালবেসে তার ঘরে গেছলে। যা হয়ে গেল সেটা দুর্ভাগ্য, সেটা তোমার ভালবাসার দোষ নয়। এই দুর্ভাগ্যের সুযোগ নিয়ে আবার আমি এগিয়ে এসে ভালবাসার দাবী করব–এটা বোধহয় আরো বেশি ভুল হবে। আমি বরং প্রার্থনা করব, যে ধাতের মানুষকে তুমি ভালবাসতে পার সে-রকম একজনকেই যেন পাও।

সুশীতলের কথাগুলো অনেক ভেবেছে রুচিরা। প্রতিটি কথা যে সত্যি সে আর ওর থেকে বেশি কে অনুভব করতে পারে?

ডিভোর্সের দেড় মাসের মধ্যে বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এতবড় ডাক্তার, নিজের কোনো রকম চিকিৎসার সুযোগটুকুও দিলেন না।

রুচিরার আরো বুক ফেটে কান্না এল যখন জানতে পারল বাবা এর আগেই ওর জন্য ভবিষ্যতের কি ব্যবস্থা করে গেছেন। তাঁর উইলে বাড়ির দু ভাগ দাদা আর দিদির, একভাগ রুচিরা আর মায়ের। এ ছাড়া শুধু রুচিরার জন্য ব্যাঙ্কে রেখেছেন নগদ দু লক্ষ টাকা। না, রুচিরাকে খাওয়া-পরার ভাবনা ভবিষ্যতে কোনোদিন ভাবতে হবে না।

কিন্তু দিন-রাতই ভাবছে। বাবার কাজ-কর্ম চুকে যেতে শোকতপ্ত মাকে নিয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়ল সে। কারণ বাবা থাকতে মায়ের মুখের একটা খেদ সে অনেকবার শুনেছে। জীবনে এ-পর্যন্ত এক কলকাতা ছাড়া আর কোনো তীর্থের জায়গা দেখা হল না। তীর্থের টান রুচিরার একফেঁটাও নেই, কিন্তু এখানে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। মা তীর্থ করুক, ওর ঘুরে বেড়ানোটাই লাভ।

কাশী মথুরা বৃন্দাবন সেরে দিল্লী হয়ে হরিদ্বারে এল তারা। ফেরার তাড়া কিছু নেই। প্রায় দুটো মাস কেটে গেছে। হরিদ্বারে দিন পনেরো থাকবে। মাঝে ঋষিকেশ লছমনঝোলা যাবে, দেরাদুন আর মুসৌরিটাও ঘুরে আসবে। রুচিরার এই ভেসে বেড়ানোর মতো ব্যাপারটা ভাল লাগছিল। তীর্থের টান থাক না থাক, প্রকৃতির সঙ্গে বুকের তলায় কোথায় একটা বড় যোগ আছে, সেটা বেশ অনুভব করা যাচ্ছিল।

হরিদ্বারে এসে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ একজনের। লোকটা সাধু-সন্ন্যাসী কিনা। জানে না। পরনে ধপধপে সাদা থান, গায়ে সাদা ফতুয়ার ওপর সাদা চাদর। লম্বা দোহারা চেহারা, গায়ের রং ফর্সা নয়, তামাটে। মাথার চুলে কদমছাট। দাড়ি-গোপ কামানো পরিষ্কার হাসি-হাসি মুখ। বছর বত্রিশ-তেত্রিশের মধ্যে বয়েস।

প্রথম দেখা হর কী পিয়ারীর ঘাটে। জনাকতক আধবয়সী মেয়ে-পুরুষ ঘিরে। দাঁড়িয়েছিল তাকে। হাত নেড়ে হাসিমুখে তিনি সামনের আছাড়ি-পিছাড়ি গঙ্গাকে দেখিয়ে কি বলছিলেন। এর মধ্যে নতুন যারা আসছে তারা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে। তাকে। কে প্রণাম করছে না করছে ভদ্রলোক তাও খেয়াল করছিলেন না।

মায়ের সঙ্গে একটু দূরের উঁচু ধাপে দাঁড়িয়েছিল রুচিরা। কথা বলতে বলতে মানুষটির হঠাৎ এদিকে চোখ পড়ল। দূর থেকেও রুচিরার মনে হল চোখ দুটো ভয়ানক ঝকঝকে। আর তার থেকে যেন একটু হাসির আভাস ছিটকে বেরোয়। রুচিরা অন্য দিকে মুখ ফেরাতে যাচ্ছিল। কিন্তু এবারে মনে হল অপলক চোখে ভদ্রলোক এখন মাকে দেখছেন। তাকে ঘিরে যারা ছিল, এই দেখাটা তাদেরও চোখে পড়েছে। তারাও এ-দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে।

তাদের সরিয়ে মানুষটি হঠাৎ এদিকে আসতে লাগলেন। রুচিরা ভেবে পেল না কি ব্যাপার। কাছে এসে হেসে মাকে বললেন, মাসিমা, চিনতে পারেন?

মা হকচকিয়ে গেলেন। দূর থেকে আগে মা-ও একে দেখেছেন আর মস্ত কোনো সাধু-টাধু ভেবে বসেছিলেন। মাসিমা ডাক শুনে তার হতচকিত হবার কথাই।

উনি হেসে বললেন, চিনতে পারলেন না তো, আপনাদের কলকাতার সেই উমাদিদির ছেলে শঙ্কর–মনে পড়ছে না?

মায়ের সমস্ত মুখে যে বিস্ময়ের আঁচড়গুলো পড়তে থাকল রুচিরা তা ঠিকই লক্ষ্য করছে। মা যেন ঠিক ধরতে-ছুঁতে পেরেও পারছেন না। তারপরেই মনে পড়ল। ব্যগ্র মুখে বললেন, সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী রোডের আমাদের পিছনের বাড়ির উমাদি? উমা চ্যাটার্জী?

হেসে মাথা নাড়লেন।-এবারে চিনেছেন? দেয়াল টপকে আপনাদের বাড়ি গিয়ে কত দৌরাত্ম করেছি, যখন-তখন খেতে চেয়েছি, মনে পড়ে? আমি তো এই বাইশ বছর বাদেও আপনাকে দেখেই চিনে ফেললাম।

মায়ের মুখখানা যেন হঠাৎ ব্যাকুলতায় ভরে গেল একেবারে।-হ্যাঁ বাবা চিনেছি। –কিন্তু তুমি এখানে আছ, উমাদি জানেন? তুমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছ? উমাদি কি এখনো ঈশ্বর গাঙ্গুলী রোডের সেই বাড়িতেই আছেন?

মানুষটি হাসছেন। চোখ দুটো আশ্চর্য ঝকঝকে বটে। একবার রুচিরার দিকে তাকালেন। মনে হল ওই দুটো চোখের,একটা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বুঝি গায়ে এসে লাগল। হঠাৎ কেন যে একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল রুচিরা জানে না।

-মা দুবছর আগেই গত হয়েছেন। আমি তখন বাইরে। আর সব ও-বাড়িতেই। আছেন।

ব্যাকুল মুখে মা বলে উঠলেন, সেই বিশ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে চলে গেছলে, এতকালের মধ্যে তোমার মায়ের সঙ্গে আর দেখাই হল না?

–মা মারা যাবার সময় আমি তার কাছেই ছিলাম।

রুচিরার মনে হল তার মা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। একটা ব্যাপারে একটু অবাকই লাগল। মা বলছেন বিশ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছে, আর ইনি একটু আগে বললেন, বাইশ বছর বাদেও দেখেই মাকে চিনেছেন–মানুষটির বয়েস কি তাহলে বাইশ আর কুড়ি বিয়াল্লিশ এখন? মুখ দেখলে এর কাছাকাছি মনে হয় না।

রুচিরার মা বললেন, যাক, তবু তাহলে মাকে শেষ সময়ে শান্তি দিতে পেরেছ। একটু। বলা নেই কওয়া নেই, বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে আর উমাদি একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেল–দেখে আমাদের চোখে জল আসত। মাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কি যে পুণ্য হয় আমি বুঝি না।

হাসিমুখেই মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। বললেন, পুণ্য হয় না।

তার পরে ঘুরে তাকালেন রুচিরার দিকে। গভীর, একেবারে ভেতর দেখে নেবার মতো চাউনি। এমন যে, রুচিরার মনে হতে লাগল গায়ে যেন যথেষ্ট আবরণ নেই। একটু বাদে মায়ের দিকে ফিরলেন আবার। জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ের বিয়েটা বুঝি সুখের হল না?

শোনার সঙ্গে সঙ্গে রুচিরা চমকেই উঠল। মাও প্রথমে হতভম্ব, তারপরে ব্যাকুল।–তুমি দেখে বুঝলে বাবা? তুমি সেই শঙ্কর–না কোনো মহাপুরুষ তুমি?

হাসছেন।–আমি মহাপুরুষ-টুরুষ কিছু নই মাসিমা।

-না না। ও-সব আমি শুনছি না, তুমি সব জান, সব বুঝতে পার, নইলে তুমি জানলে কি করে? তুমি বল ওর কি হবে? ওর অদৃষ্টে কি আছে? ওর কথা ভাবলে আমার প্রাণটা একেবারে শুকিয়ে যায়।

এর মধ্যে একজন লোক এসে তার কানের কাছে মুখ এনে কি বলতে মাথা নেড়ে তিনি আবার মায়ের দিকে ফিরলেন।–আপনি বিশ্বাস করুন মাসিমা, আমি কিছু জানি না, ও-সব বিদ্যে আমার নেই। আমার ওখানে একদিন এলে খুশী হব। মিশনে লোক এসেছেন, এখন আমি যাই

মিশনের নাম এবং হদিস বলে দিয়ে চলে গেলেন।

মা ব্যাকুল চোখে সেদিকে চেয়ে রইলেন।

.

ধরমশালার তিনতলায় একটা সুইট ভাড়া করে মাকে নিয়ে উঠেছিল রুচিরা। ঘরে ফিরে দু-চার কথায় মায়ের কাছে ব্যাপারটা শুনে নিল। উমাদি বলতে মায়ের সত্যি সম্পর্কের কেউ নয়। শঙ্করের বাবা ছিলেন উকিল, কিন্তু খুব পসার ছিল না। রুচিরার বাবা মা-ও তখন ঈশ্বর গাঙ্গুলী রোডে এক ছোট বাড়িতে থাকতেন। রুচিরার মনে থাকার কথা নয়, কারণ তার তখন মাত্র বছর তিন-চার বয়েস। সেই বাড়ির ঠিক পিছনে ছোট একটা ভাঙা পৈতৃক বাড়িতে উমাদি আর অনেকগুলো মেয়ে আর এই একটা ছেলেকে নিয়ে থাকতেন সেই উকিল ভদ্রলোক। এই ছেলেটা সত্যি খুব দুরন্ত আর খেয়ালী ছিল। রুচিরার মায়ের কাছে যখন-তখন আসত, খেতে চাইত। ওদের বিশেষ করে রুচিরাকে নিয়ে নাকি লোফালুফি খেলত। তাই দেখে রুচিরার বাবা নাকি একদিন খুব বকেও দিয়েছিলেন তাকে। শঙ্কর নিজের মাকে আর রুচিরার মাকেও এক-এক সময় বলত, বেশিদিন সে আর এ সংসারে থাকছে না–তার ভাল লাগে না। কিন্তু তার সে-কথায় কেউ কান দিত না। রুচিরার মা ভাবতেন অভাবের সংসারে ভাল খেতে পরতে পায় না বলেই এ সব কথা বলে।

কিন্তু বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে সত্যিই আর সে ঘরে থাকল না। দু-লাইনের এক চিঠিতে মাকে তার জন্য ভাবতে বারণ করে কোথায় যে চলে গেল কেউ জানে না। ভালমানুষ উমাদির অনেকগুলো মেয়ে আর ওই একটাই ছেলে। সে পাগলের মতো হয়ে গেল। এর বছর দেড়েকের মধ্যে রুচিরার বাবা-মা ও-বাড়ি ছেড়ে অন্য বড় বাড়িতে উঠে আসেন। আরো বছর দুই-তিন যাতায়াত ছিল। কিন্তু তখনো উমাদি ছেলের কোনো খবর পায়নি। এরপর রুচিরার বাবা এখনকার এই বাড়ি করে উঠে আসেন। তারপর থেকে আর যোগাযোগ ছিল না।

রুচিরার মায়ের মনে কি আশা কে জানে। পরদিনই বিকেলে সেই মিশনের উদ্দেশ্যে ছুটলেন। রুচিরার সঙ্গে না গিয়ে উপায় নেই। মাকে একলা ছেড়ে দেওয়া যায় না। দেড় মাইলের মধ্যে সেই মিশন। টাঙ্গাঅলাকে বলতে সে-ই নিয়ে গেল। বিরাট এলাকা, বিশাল ব্যাপার। সেখানে সাধন-ভজন ছাড়াও সেবাব্রত একটা বড় কাজ বোঝা গেল। ভিতরে ডিসপেনসারি, হাসপাতাল। পয়সা দিয়ে পড়তে পারে না এমন। ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা-ব্যবস্থাও আছে।

ঝকঝকে মস্ত একটা হলঘরে বক্তৃতার আসর বসেছিল। শঙ্কর চ্যাটার্জীর খোঁজ করতে ওদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। অনেক বিদেশীর সমাগম ঘটেছে সেদিন। আর বহু গেরুয়া-পরা সাধুও বসে। বিদেশাদের কারণেই হয়তো ইংরেজিতে বক্তৃতা করছেন শঙ্কর চ্যাটার্জী। বিশুদ্ধ উচ্চারণ বলার সাবলীল ভঙ্গি। সকলে একাগ্র মনে শুনছেন। ধর্মীয় দর্শনের কিছু একটা ব্যাখ্যা চলেছে। রুচিরার ভাল লাগছে। কান। পেতে শুনতে এবং বুঝতে চেষ্টা করল সেও।

বক্তৃতার পরে মা সেদিন আর তাকে নিরিবিলিতে পেলেন না। কারণ এর পরেই তার অন্যত্র কোথায় যাবার কথা। তবু হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন একটু। মায়ের সঙ্গে পাঁচ-সাত মিনিট কথা বললেন। রুচিরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। বার কয়েক ওকেও ঘুরে দেখলেন তিনি। কিন্তু রুচিরার সেই আগের দিনের গঙ্গার ঘাটের মতোই অস্বস্তি। তাকালেই ভদ্রলোক যেন বড় বেশি দেখতে পান। পুরুষের এই দেখাটাকে রুচিরা খুব যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারে না।

পরদিন সকালে টাঙ্গা নিয়ে মা একলাই চলে গেলেন সেখানে। রুচিরাকে ডাকতে সে স্পষ্ট বলে দিল তার ভাল লাগছে না। ঘণ্টা দুই বাদে মা ফিরে ওই লোকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সকালেও উনি কোথায় চলে গেছলেন বলে মায়ের ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সেই সময় এক বুড়ো সাধুর সঙ্গে মায়ের অনেক কথা হয়েছে। তাঁর মুখে মা শুনেছেন, শঙ্কর চাটুজ্যে সাধু-টাধু কিছু নন কিন্তু এখানকার সব সাধুরাই তাকে বিশেষ ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। তারা তাকে পরম সমাদরে ওখানে রেখেছেন, কখন হুট করে আবার চলে যান সেই ভাবনা সকলের। ভদ্রলোক টানা ষোল বছর বিদেশে কাটিয়েছেন। পৃথিবীর বহু জায়গায় ঘুরেছেন। এই আশ্রমের সঙ্গে তার যোগ পাঁচ বছরের, তার মধ্যেও দু-বার কাউকে কিছু না জানিয়ে একবার এক বছর আর একবার ন-মাসের জন্য কোথায় চলে গেছলেন। আধ্যাত্ম জগতের শিক্ষিত মানুষেরা এখানে। এলে তার কথা, তার ব্যাখ্যা শোনার জন্য ছুটে আসেন। সেই জন্যেই সপ্তাহে একদিন করে এক একটা বিষয়ের ওপর তার বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। আগের দিন সেই বক্তৃতাই তারা শুনে গেছল। অন্যান্য দিন এখানকার সাধুদের তিনি এক ঘণ্টা দু ঘন্টা করে দেশ-বিদেশের দর্শনশাস্ত্র পড়ান। সাধুরাও তাকে তেমনি ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন।

এর পর শঙ্কর চ্যাটার্জীর সঙ্গে মায়ের দেখা হয়েছে, এক ঘণ্টা ধরে অনেক কথা হয়েছে। তার কথা শুনলে নাকি কান-মন জুড়িয়ে যায়। মায়ের মুখখানা আনন্দে বিহ্বল। ঠিক কোন প্রত্যাশায়, রুচিরা ঠাওর করতে পারল না। মা যে গলগল করে ওই লোকের কাছে মেয়ের সর্ব দুর্ভাগ্যের কথা বলে এসেছেন তাতেও কোনো সন্দেহ। নেই। ওর প্রসঙ্গে উনি নাকি হেসেই মাকে বলেছেন, আপনার মেয়ে আমাকে ঠিক পছন্দ করতে পারছে না তাই আসেনি।

রুচিরা কেন যেন তেতে উঠল হঠাৎ।–কি-রকম পছন্দ করতে হবে তাকে?

মা থতমত খেলেন। তারপর ধমকের সুরে বললেন, মহাপুরুষদের নিয়েও কি ভাবে যে কথা বলিস ঠিক নেই। বিকেলে তোকে নিয়ে যাব বলেছি।

-কেন? মহাপুরুষদের কাছ থেকে কি আশা কর তুমি? কি করবেন?

মা জবাব দিলেন, কেন রাগ করিস বুঝি না। মায়ের ভাবনা জানিস না?…এরা কত কি দেখতে পায়, বোঝে, হয়তো তোর ভাল হবে এমন কিছু বলে দেবে–নইলে এদের কাছে মানুষ ছুটে ছুটে আসে কেন?

রুচিরা আর কিছু বলল না। নিজের জ্বালায় রাগ করে। নইলে ওই লোকটি সম্পর্কে মায়ের মুখে শোনা বৃদ্ধ সাধুর কথাগুলো ভারি ভাল লেগেছে। সেদিনের। বক্তৃতার অংশ মা হয়তো বোঝেনি, কিন্তু যেটুকু শুনেছে তাতেই ওর মনে দাগ পড়েছে। অসাধারণ কিছু আছেই ওই লোকের মধ্যে, নইলে এ-ভাবে কেউ জীবন কাটাতে পারে না। আশ্চর্য, আজ সেখানে যাবার জন্য দুপুর থেকে ও নিজেই কিরকম একটা তাগিদ অনুভব করছে। ওই লোকের চোখ দুটোকে কেমন ভয়-ভয় করে, আবার। টানেও যে খুব সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বিকেলে একটুও আপত্তি না করে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। আশ্রমের। আঙিনায় পা ফেললে মনটা আপনা থেকে খুশী হয়। এখানে-ওখানে পরিচ্ছন্ন বাগান। গাছ-গাছড়া। মালি কাজ করছে, সঙ্গে দু-চার জন সাধুও। অদূরের হাসপাতালের দিকে সাধু আর লোকজনের যাতায়াত বেশি। এই পরিবেশের ভারী একটা আকর্ষণ আছে।

মা শঙ্কর চ্যাটার্জীর ঘর চেনেন। ওকে নিয়ে সোজা সেদিকে চললেন।

ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একমুখ হেসে এগিয়ে এসে সমাদরে ওদের ঘরে নিয়ে এলেন। পরিচ্ছন্ন ঘর। দেয়ালে কোনো দেবদেবীর ছবি নেই। কাঠের চৌকির ওপর পাতলা শয্যা বিছানো। সামনে খান-দুই মোড়া।

মা রুচিরাকে বললেন, প্রণাম কর

রুচিরা বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে গেল। ওই ঝকঝকে চোখে চোখ পড়তে ভদ্রলোক হেসেই বললেন, কেন ওকে ব্যস্ত করছেন মাসিমা-আপনি বরং আশ্রমটা একটু ঘুরে টুরে দেখে আসুন, অনেক দেখার আছে–আমি ততক্ষণ দিদির সঙ্গে একটু গল্প করি।-বোসো দিদি, তুমি বোসো

দিদি শুনেই রুচিরার মনে হল মানুষটি যেন ওর মনের তলার কোনো সংশয়ের জবাব দিলেন। মা কিছু একটা আশা নিয়েই আশ্রম দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।

রুচিরা তাকাল তার দিকে। সেই ঝকঝকে চোখ। হাসছেন। কিন্তু আপনা থেকেই এখন সমস্ত সংকোচ ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে রুচিরার। মানুষটির চোখে মুখে হাসিতে যেন জাদু আছে। অদ্ভুত ভাল লাগছে।

এগিয়ে এসে প্রথমে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল, তারপর মোড়ায় বসল।

চৌকিতে বসে শঙ্কর চ্যাটার্জী বললেন, তোমার মায়ের মুখে সব শুনলাম। বড় দুঃখের কথা। ভাল ভাবে এম. এ. পাস করেছ শুনলাম; কোনো মেয়ে-কলেজে কাজ-টাজ দেখে নাও না।

হঠাৎ একটু আগ্রহ নিয়েই রুচিরা বলল, আপনাদের এই সব জায়গায় আমরা কোনো কাজ-টাজ করতে পারি না?

হেসে বললেন, পার, কিন্তু তাতে অন্যের কাজ পণ্ড হবে।

–কেন? মেয়ে বলে?

 শঙ্কর চ্যাটার্জী হাসিমুখে মাথা নাড়লেন। তাই।

এই সংস্রবে এটুকু সময়ের মধ্যে রুচিরা প্রায় মুখরা হয়ে উঠল কি করে জানে না। বলল, সাধুরা তাহলে কিরকম সাধু?

হাসছেন।–শরীর ধরলে কেউ সবটা সাধু নয়, আবার সবটা অসাধু নয়। যখন যার চাষ হয় সে বাড়ে। খাঁটি দুধও জলে ফেললে মিশে যায়, মাখন তুলে সেটা ফেললে জলে ভাসে। সাধুদের বেশির ভাগ মাখন হতে চাইছেন, হননি এখনো। হলে পরে ভয় থাকে না।

সহজ কথা। কিন্তু নিগূঢ় তাৎপর্য আছে। রুচিরা তবু ফস করেই জিজ্ঞাসা করে। বসল, আপনার কোন অবস্থা?

জোরেই হেসে উঠলেন শঙ্কর চ্যাটার্জী। বললেন, তুমি বড় সাদা মনের ভাল মেয়ে দিদি, তোমার এরকম বরাত হবার কথা নয়। আমি একটা রক্ত-মাংসের মানুষের ঢেলার বেশি কিছু নয়।

-রক্ত-মাংসের মানুষ হলে কেউ মাকে ছেড়ে পালায়?

হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন, এটা একটা নেশা। নেশায় পেয়ে বসলে কে আর বাপ-মা মানছে?

এই মানুষ নিজের প্রসঙ্গে কিছু বলবেন না রুচিরা বুঝে নিল। কিন্তু সত্যি ভাল লাগছে তার, হালকা লাগছে। বলল, মায়ের খুব বিশ্বাস আপনি আমার জন্য কিছু করতে পারেন, কিছু দৈব অনুগ্রহও পাইয়ে দিতে পারেন।

হেসে মাথা নাড়লেন।-না, আমি সে রকম ম্যাজিক কিছু জানি না।

-না জানলে আমার বিয়ে সুখের হল না, গঙ্গার ঘাটে আমাকে দেখেই সে কথা বললেন কি করে?

এবারে অবাক একটু। তার পরেই আবার হাসি।–ও, এই জন্যে তোমরা একটা কিছু ভেবে বসে আছ? বছর তিন সাড়ে তিন আগে মাকে দেখতে যখন কলকাতায় গেছলাম, এক রাস্তায় তোমার দাদা সঞ্জয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা আমার। সে চেনেনি, আমি চিনেছি। তাকে খবর জিগেস করতে সে বলেছিল, তোমাদের দু বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। তা আমার পোশাক-আশাক দেখে সেও আমাকে তোমার মতোই ভণ্ড-টণ্ড কিছু ভেবে সরে গেছল। তেমন পাত্তা দেয়নি।

মানুষটার সরলতা দেখে রুচিরা মুগ্ধ হল, আবার লজ্জাও পেল একটু। সরল না হলে বিয়ে সুখের হল না বলার কৃতিত্বটুকু নিজেই নিত। আর লজ্জা পেল কারণ, গঙ্গার ঘাটে প্রথম দেখে সত্যিই অস্বস্তি বোধ করেছিল। তবু জিজ্ঞাসা করল, দাদার মুখে বিয়ের খবর শুনতে পারেন, কিন্তু সুখের হল না জানলেন কি করে?

-এটা জানা যে সহজ সে এখন তুমি নিজে ভাবলেই বুঝতে পারবে। যাক, তোমাকে আমার বড় ভাল লেগেছে দিদি, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

রুচিরা আবার কেন একটু অস্বস্তি বোধ করছে জানে না। মাথা নাড়ল।

-তোমার মত মেয়েও একটা লোককে ধরে রাখতে পারল না, ফেরাতে পারল না, এটা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কেন পারলে না? চেষ্টা করেছিলে?

রুচিরার ভিতরটা হঠাৎই তেতে উঠল।–তাকে জানলে আপনি এ কথা বলতেন না।

শঙ্কর চ্যাটার্জী চুপ করে রইলেন। কিন্তু মুখ দেখে মনে হল ঠিক অনুমোদন করতে পারলেন না যেন।

-আপনার বিশ্বাস হল না?

–না।

রুচিরা প্রায় তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, কেন? আপনি তার কতটুকু জানেন?

-একটুও জানি না। শান্তমুখেই বললেন, কিন্তু সামনা-সামনি কাউকে দেখলে আমি তার অনেকটা ভেতর দেখতে পাই। তাছাড়া তোমার মায়ের কাছেও অনেক কথা শুনেছি।…তুমি সোনার মেয়ে। সোনা গড়িয়ে গহনা করা যায়, আবার ডাণ্ডা বানিয়ে তা দিয়ে ঘা দিলেও আঘাত লাগে। আমি ভাবছি সে-রকম কোনো ভুল হয়ে গেল কিনা।

কথাগুলি সুন্দর, কিন্তু একটা দুর্বল জায়গায় আবার ঘা পড়ল রুচিরার। বলল, আপনি তাকে জানলে এ-কথা একবারও বলতেন না।

এখন আর হাসছেন না। ঝকঝকে চোখ দুটো ওর মুখের ওপর আটকে আছে। বিয়ের আগে ইন্দ্রর সঙ্গে কতদিন মিশেছিলে?

নামটা মায়ের কাছে শুনে থাকবেন। জবাব দিল, এক বছর।

-এই এক বছরে তার মধ্যে যা দেখে তোমার ভাল লেগেছিল, যা দেখে তাকে তুমি ভালবেসেছিলে–সেটা মিথ্যে হতে পারে না। তোমার চোখে পড়া মনে ধরার মতো তার মধ্যে কিছু ছিলই–সেও মিথ্যে হতে পারে না। একটু আগে তোমাকে বলছিলাম, শরীর ধরলে কেউ সবটা ভাল নয়, আবার সবটা মন্দও নয়, যখন যেটা চাষ হয় সেটা বাড়ে। তুমি ভালটা দেখেছিলে, মন্দটা দেখনি। সেই মন্দের ছায়াটা দূর করতে হলে অহংকার আর অভিমান ছেড়ে তারই ভালর আলোটুকু সব থেকে জোরালো করে তুলতে হয়। আমার ভুল হতে পারে, তোমার অভিমানে ধা পড়েছিল কিনা সে আমার থেকে তুমিই ভাল জান। এর পরেও তুমি তার মন্দটাই যদি একমাত্র সত্যি বলে ভাবো তাহলে তার আরো দুর্ভাগ্য, তোমারও আরো বেশি অশান্তি। কিন্তু ভাল স্বীকার করার আর ভাল বড় করে তোলার এমনি জোর যে সেটা পারলে এখনো তোমার সব শেষ হয়ে গেল আমি ভাবি না। কোনো কিছুরই শেষ বলে কিছু নেই।

রুচিরা আর কিছু বলেনি। কিন্তু ভিতরটা বিষাক্ত লাগছিল তার। অথচ এই লোকের সঙ্গে তর্ক করারও কেন যেন আর সাহস নেই।

.

রুচিরা মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল জুন মাসের মাঝামাঝি। এখানেও কংগ্রেস শাসন উৎখাত হয়ে বামজোটের দল ক্ষমতায় এসেছে। তখন সত্যিকারের আনন্দ হয়েছিল তার। দুমাস বাদে অর্থাৎ আগস্টের মাঝামাঝি কলকাতায় ফিরল। সুস্থির হয়ে দুদিন না কাটতে দাদা-বৌদির মুখে যে সুখবরটা শুনল তাতে রুচিরারও আনন্দে আটখানা হবার কথা। ইন্দ্র ব্যানার্জীর সব দিক থেকেই ভরাডুবি হয়েছে। তার বাড়িঅলা কেসে জিতেছে, কোর্ট-থেকে বকেয়া ভাড়া মিটিয়ে দেবার হুকুম হয়েছে। তার ওপর। বাড়ি ছাড়ার কেস ঝুলছে। এদিকে নতুন সরকার তহবিল তছরুপের অভিযোগে তাকে থানায় টেনে নিয়ে গেছে। আগের সরকারের আমলে চল্লিশ হাজার টাকা সে তার কেমিক্যাল কারখানা সম্প্রসারণের জন্য পেয়েছিল। বলা বাহুল্য, সেটা তখনকার সময়ের। ধরা-করার ব্যাপার। কিন্তু এখন ধরা পড়েছে, সে টাকার এক পয়সাও সেই কারখানায়। যায়নি, কারখানার বাকি অর্ধেকের মালিক সেই টাকাপ্রাপ্তির ব্যাপার স্রেফ অস্বীকার করছে। এবং সেও পার্টনারশিপ বাতিলের ব্যবস্থা পাকা করে এনেছে, কারণ, সেখানেও ইন্দ্র ব্যানার্জীর নামে বহু টাকা ব্যক্তিগত ধার হিসেবে লেখাপড়া করা আছে। তাতে ইন্দ্র ব্যানার্জীর সইও আছে। অনেক তদবির-তদারক করে সে এখন জামিনে খালাস আছে! কিন্তু সুদ-সহ ওই চল্লিশ হাজার টাকা সরকারকে বুঝিয়ে দিতে না পারলে তার জেল অনিবার্য। চল্লিশ হাজার দূরে থাক, চল্লিশ টাকা বার করারও তার মুরোদ নেই এখন।

শুনে সকলে ছেড়ে মা পর্যন্ত খুশী। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। খুশী রুচিরাও হতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা কাটা খচখচ করে বিধছে। শঙ্কর চ্যাটার্জীর সেই হাসি-হাসি মুখ আর ঝকঝকে দুটো চোখ আর তার কথাগুলো চেষ্টা করেও মন থেকে তাড়াতে পারে না। আগেও ওই মুখ ওই চোখ আর ওই সব কথা বার। বার সামনে ভিড় করে এসেছে। কিন্তু রুচিরা আর কিছু ভাবতে চায় না, সে-সব। মন থেকে ঠেলে সরিয়েছে।

এখন আর তাও পারছে না।…শঙ্কর চ্যাটার্জী বলেছিলেন, একটা বছরের মেলামেশার মধ্যে ওর চোখে পড়া মনে ধরার মধ্যে কিছু ছিলই–সেটা মিথ্যে হতে পারে না…বলেছিলেন, তুমি সোনার মেয়ে, সোনা গলিয়ে গয়না করা যায়, আবার ডাণ্ডা বানিয়ে তা দিয়ে ঘা দিলেও আঘাত লাগে, আমি ভাবছি অভিমান-বশে সে-রকম কোনো ভুল হয়ে গেল কিনা।

…তিনি বলতে চেয়েছিলেন, সোনার স্পর্শ দিয়ে তার মন্দটা তুমি দূর করতে পারলে না কেন।

রুচিরা ভাবতে চায় না। কিন্তু ভাবনা আসছেই। আসছেই। তিনি বলেছিলেন, ভালটুকু স্বীকার করার আর ভালটুকু বড় করে তোলার এমনি জোর যে সেটা পারলে এখনো তোমার সবশেষ হয়ে গেল আমি ভাবি না।

…কিন্তু কি শেষ হয়ে গেল ভাবেন না তিনি? রুচিরার তাতে মনের প্রসারতা বাড়বে? আর কিছু না হোক শান্তি আসবে? ওই নির্মম দাম্ভিক লোকের মধ্যে ভাল দেখার মতো কি আছে? কি ছিল?

চকিতে এক অদেখা বিধবা মায়ের মুখ যেন চোখে ভেসে উঠল তার। এর বান্ধবীর সে পিসিমা। যার ছেলেকে হত্যা করার জন্য গাড়িতে তুলে নিয়ে পালিয়েছিল। একটি লোক নিজের প্রাণের ভয়-ডর বিসর্জন দিয়ে বেপরোয়ার মতো সেই দুষ্কৃতকারীদের আড্ডায় হানা দিয়ে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে সেই বিধবা মায়ের ছেলেকে উদ্ধার করেছে …জলপাইগুড়ির বন্যায় ত্রাণের সাহায্য করতে গিয়ে নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে একটি অতি-বৃদ্ধ প্রাণকে জীবনের আলোয় ফিরিয়ে এনেছে। …অসুখে বস্তির এক গরিব বন্ধুর প্রাণের আশংকা দেখা দিতে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসে বাবাকে প্রায় হুমকি দিয়েই ধরে নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য। তারপর সেই অসুস্থ বন্ধুর মায়ের হাতে থেকে টাকা গুঁজে দিয়ে আসতে দেখে ফিরে এসে বাবা পর্যন্ত বলেছিলেন, লোকটার দরাজ অন্তঃকরণ সন্দেহ নেই…নিজের বাপের মৃত্যুতে ওই দাপটের লোককে বাচ্চা ছেলের মতো মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে দেখেছে রুচিরা নিজের চোখে।

..শঙ্কর চ্যাটার্জী এ আপনি আমার কি করে দিলেন? এখন আমি কি করব?

দুদিন পরে। গাড়ি করে দিদির বাড়িতেই যাচ্ছিল রুচিরা। ওই বাড়ির গেটের দিকে চোখ পড়তেই বুকের তলায় একটা অদ্ভুত মোচড় দিয়ে উঠল তার। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। পরনে আধময়লা পা-জামা, গায়ে আধময়লা গেঞ্জি। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। বিবর্ণ মুখ।

রুচিরা দেখল।

সেও দেখছে। ক্রুর খরখরে চাউনি।

 গাড়িটা গেট পেরিয়ে যেতেই রুচিরা ড্রাইভারকে বলল, থামো!

 গাড়ি থামতে নেমে এল। কাছে এল।

ইন্দ্র ব্যানার্জী এ-রকমটা ভাবেনি। চেয়ে আছে। চোয়াল দুটো এঁটে বসছে।

রুচিরা শান্ত মুখে বলল, আমি দুমাসের ওপর এখানে ছিলাম না। তোমার শরীর তো খুব খারাপ হয়ে গেছে দেখছি।

–তোমার আনন্দ হচ্ছে না?

–না।

–বল কি? কেন?

— কারণ, আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম।

হঠাৎ যেন একটু আশার আলো লাগল ইন্দ্র ব্যানার্জীর বিবর্ণ মুখে। তবু। অবিশ্বাসভরে বলল, এখন? অনুকম্পার দরুন গাড়ি থেকে নেমে এলে?

-না, এখনো তোমার ভালই চাই।

—ভাল চাও? সত্যি তুমি ভাল চাও?

মুখের দিকে পরিষ্কার চেয়ে রুচিরা মাথা নাড়ল। চায়।

চোখে-মুখে আগ্রহ উপচে উঠল ইন্দ্র ব্যানার্জীর।–আমার এখনকার অবস্থা সব শুনেছ তুমি? জানো?

-জানি।

–তাহলে একটু ভিতরে আসবে? দুই-একটা কথা বলার ছিল…শুনবে?

রুচিরা চুপচাপ চেয়ে রইল কয়েক নিমেষ। ওই ব্যাকুল মুখের দিকে চেয়ে বুকের তলায় আবার মোচড় পড়ছে।

বলল, আমি শুনে কি করতে পারি জানি না। আমার এখন যাওয়া সম্ভব নয়, তুমি ইচ্ছে করলে আমার ওখানে আসতে পার। শুনব।

–কবে?

–কাল, পরশু-যেদিন তোমার ইচ্ছে।

আবার গিয়ে গাড়িতে বসল। দিদির ওখানে যেতে আর ইচ্ছে করল না। একটু ঘুরে-টুরে আবার বাড়ি ফিরে এল।

সমস্ত রাত ঘুম হল না রুচিরার। ভেবেছে। শুধু ভেবেছে।

…পরশু নয়, ওই লোক কালই আসবে জানে।

এল।

বাড়ির লোক, দাদা বউদি মা সকলেই বিরক্ত! ওকে দেখা করতে নিষেধ করল। রুচিরা বলল, আমি তাকে আসতে বলেছিলাম।

সকলে অবাক।

রুচিরা এল। ইন্দ্র ব্যানার্জী বসেছিল। উঠে দাঁড়াল।

–বসো।

 ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, তুমি বসো।

 রুচিরা বসল।–বল।

সোফাটা একটু কাছে টেনে ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, আমি সত্যি বিশ্বাস করব আমাকে তুমি ভালবেসেছিলে?

–কি বলবে বল?

-সব মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার ভয়ানক দরকার। না পেলে আমার জেল হবেই। আমি জানি এ-টাকাটা তুমি ইচ্ছে করলেই দিতে পার। পার না?

–পারি।

-তুমি আমাকে এবারের মতো বাঁচাও রুচি, আমার আর কোনো পথ খোলা নেই। তুমি অনেক বড়, সব ভুলে এবারের মতো আমাকে রক্ষা কর। তারপর তুমি কি বিচার করবে না করবে জানি না, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, আমি ভাল হতে চেষ্টা করব, সৎ হতে চেষ্টা করব।

আগ্রহের আতিশয্যে সে উঠে দাঁড়াল। রুচিরা চেয়ে আছে। দেখছে।

চেষ্টা করবে? চেষ্টা?

–রুচি, আমি কি বলতে চাই তুমি বুঝেছ। প্লীজ।

টাকা না দিলে তোমার কত দিনের জেল হবে?

 ইন্দ্র ব্যানার্জী থমকাল।–কম করে পাঁচ বছরের। কিন্তু টাকা তুমি দেবে না?

-না। অটল ঠাণ্ডা মুখ রুচিরার।–তুমি যে পুরুষ ছিলে সেই পুরুষ কখনো। দয়া চায় না। দয়া দেখিয়ে কাউকে ফেরানো যায় না। আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম না শুধু, এখনো ভালবাসি। পাঁচটা বছর প্রায়শ্চিত্ত করে যদি এটুকু বুঝতে পার, তাহলে পাঁচটা বছরকে ভয় না করে জঞ্জালমুক্ত হয়ে এস। আমি যাকে ভালবাসি তার ভয় সাজে না। আমার কথায় যদি বিশ্বাস করতে পার, তারপর এস। টাকা পাবে, আমাকেও পাবে।

ইন্দ্র ব্যানার্জী আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নির্বাক হতভম্বের মতো চেয়ে। রইল খানিক। তারপর ঝড়ের বেগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রুচিরা নিষ্পন্দের মতো বসে। স্থির, শান্ত।