সাহিত্য-বিচার

সাহিত্য-বিচার

যাঁহারা সাহিত্যের স্রষ্টা, তাঁহাদের কাজ ঐ সৃষ্টিকার্য্যেই সমাপ্ত হয়, প্রতিভার কোন জবাবদিহি নাই। সকল সৃষ্টির আদিস্রষ্টা—ভগবানেরও—সৃষ্টিই, একমাত্র সাক্ষ্য, তাহার অতিরিক্ত কিছু তিনিও বলিতে বাধ্য নহেন। কিন্তু সেই সৃষ্টির অর্থ, মানুষকে আপনার জ্ঞানে বুঝিয়া লইতে হয়। কবি ও ঋষি, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক, কতরূপে তাহার কত ব্যাখ্যাই করিতেছেন; কিন্তু এই সকলের মধ্যে কবিই শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার, কারণ তিনি সৃষ্টির ব্যাখ্যা আর এক সৃষ্টির দ্বারাই করেন— ভাগবতী প্রেরণাকে অনুসরণ করিয়া সেই সৃষ্টির রসরূপ আমাদের চিত্তগোচর করেন। অতএব কবি ভগবানের পরেই দ্বিতীয় স্রষ্টা। তাঁহার সৃষ্টিরও ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়, তাহারই নাম সাহিত্যসমালোচনা। কারণ, যাহাকে সমালোচনা বলা হয়, তাহা আসলে ব্যাখ্যা মাত্র, কবির সৃষ্টিকে ভাল করিয়া আমাদের চিত্তে ধরাইয়া দেওয়াই তাহার অভিপ্রায়। আমি এ বিষয়ে ইতিপূর্ব্বে নানা প্রসঙ্গে যে সকল আলোচনা করিয়াছি, এই প্রবন্ধে তাহাই একটা সংক্ষিপ্ত অথচ সম্পূর্ণ আকারে উপস্থাপিত করিতে চেষ্টা করিব সাহিত্য-বিচারের কয়েকটি মূল তত্ত্ব যতদূর সম্ভব সুস্পষ্ট ও সুনিরূপিত করাই আমার অভিপ্ৰায়।

প্রথমেই, সাহিত্য কি—অন্তত আমার আলোচনার বিষয়ীভূত যে সাহিত্য, তাহার একটা সংজ্ঞা নির্দ্দেশ করা প্রয়োজন। যদি বলা যায়, মানুষ তাহার ভাষায় যাহা কিছু রচনা করে তাহাই সাহিত্য, তবে সাহিত্য-বস্তুটির কোন বিশেষ ধারণাই হইল না; কারণ, ভাষা মানেই সাহিত্যের ভাষা নয়, এবং রচনা-শব্দটিও অতি ব্যাপক ও সাধারণ অর্থে ব্যবহার হইয়া থাকে। অতএব এই সংজ্ঞাই মানিয়া লইতে হইলে, ভাষা ও রচনা—এই দুইটি শব্দের উপরে জোর দিতে হইবে। রচনা মুখে—মুখেও করা যায়, কিন্তু সাহিত্যের ভাষা যেমন কণ্ঠনিঃসৃত বাক্যাবলীই নয়, তেমনই, তাহার রচনাও কথোপকথন মাত্র—এমন কি, বক্তৃতাও নয়। যে রচনায় কেবল মস্তিজাত বিদ্যার অনুশীলন বা বুদ্ধিপ্রণোদিত তত্ত্বেও বিচারণা আছে, যাহাতে সৃষ্টির বস্তুঘটিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আছে, তাহা খাঁটি সাহিত্য বা কাব্য-সৃষ্টি নহে; তাহা জিজ্ঞাসা, মীমাংসা ও আলোচনা মাত্র। সাহিত্যের রচনা বলিতে একরূপ সৃষ্টিই বুঝায়; বাক্য যদিও এইরূপ সৃষ্টির উপাদান, তথাপি এখানে তাহা কিছুকে নির্দ্দেশ বা জ্ঞাপন করে না; একটা রূপকে প্রকাশ করে—মূর্ত্তি নির্ম্মাণ করে। ভাস্কর ও চিত্রকর ভিন্ন উপাদানে যেমন একটা কিছু গড়িয়া তোলে—আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর করে, সাহিত্যস্রষ্টা কবিও তেমনই এক আশ্চর্য্য উপায়ে, বাক্যেরই সাহায্যে, একটা কিছুকে আমাদের অন্তশ্চক্ষুর গোচর করেন, বাহিরের রূপকে অন্তরে রূপময় করিয়া তোলেন। এই যে বাঙ্ময়ী রচনা—ইহা কোন তথ্য, ভাব বা চিন্তার ব্যাখ্যা, বিবৃতি বা নিৰ্দ্দেশ নয়; ইহাতে বক্তৃতা নাই, তর্ক নাই, যুক্তিপ্রয়োগ নাই; কিন্তু তাই বলিয়া ইহা অনিৰ্ব্বচনীয় কোন অনুভূতির আধারও নহে। আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্রে যাহাকে রস বলে, সেই ‘ব্রহ্মাস্বাদ-সহোদর’ একটি চেতনার উদ্রেকই ইহার সার—মৰ্ম্ম নয়; একটা অতিশয় অপার্থিব, অতীন্দ্রিয় নিরুপাধি কিছুর ইঙ্গিত বা উদ্বোধন সাহিত্যের অভিপ্রায় নয়। ভগবানের সৃষ্টি এই বিশ্ব যেমন বস্তুতেই প্রকাশমান, ভাব যেমন সর্ব্বত্র রূপ পাইয়াছে, এবং এই রূপকেই আমরা সৃষ্টি বলিয়া থাকি, তেমনই সাহিত্যের সৃষ্টিও রূপময়; বাক্যে এই রূপ দেওয়াকেই আমরা রচনা বলিব। বাক্যে রচিত আর যাহা কিছু—তাহাতে রূপ নাই, কেবল কথা আছে, এবং কথারও অর্থ আছে; সেখানে সকলই পরোক্ষ—চিন্তার ব্যবধান থাকায় কিছু রূপে প্রকাশ পায় না। অতএব সাহিত্য বলিতে যদি কেবল ভাষাগত রচনা বুঝিতে হয়, তবে রচনা—কথাটির এই বিশেষ অর্থ করিতে হইবে। আমি এখানে সাহিত্য অর্থে সেই রচনার কথাই বলিতেছি।

কথাটা আর একবার বুঝিয়া লওয়া যাক—সেই সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কে ভাষা কি বস্তু, তাহার ধারণাও স্পষ্ট করিয়া লই। ভগবানের সৃষ্টি—যেমন, কোনও প্রাকৃতিক দৃশ্য—কথা বলে না, রূপে প্রকাশ হয় মাত্র; তাহার ভাষা সেই রূপই; যাঁহার দৃষ্টিশক্তি আছে, তিনি সেই রূপকেই দেখেন, আর কিছুর প্রয়োজন হয় না, আমাদের চিত্তে প্রকাশ হইতে পারাই তাহার সার্থকতা। সাহিত্যও এই প্রকার রূপ-সৃষ্টি; ওখানে যেমন রঙ, রেখা ও আকার প্রভৃতির সাহায্যে একটা কিছু প্ৰকাশ পাইয়া থাকে, এখানেও তেমনই বাক্যই সেই রূপসৃষ্টির নিদান; বাক্য কিছু বলে না, সেই রূপকে আমাদের দৃষ্টিগোচর করে। অতএব, বাক্য এখানে একটা অসাধারণ কার্য্য করিয়া থাকে; ভাব ও অর্থের নির্দেশই যাহার উৎপত্তির মূলে—ব্যাখ্যা, বিবৃতি ও সংবাদ-জ্ঞাপনই যাহার সাধারণ কর্ম্ম, তাহার দ্বারা বস্তুকে একেবারে সাক্ষাৎ দৃষ্টিগোচর করাইতে হয়। একটি সামান্য উদাহরণ দিলেই সাহিত্যসৃষ্টিতে ভাষার এই প্রকৃতি-পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাইবে। সভামধ্যে সহসা কোনও মহিমময় পুরুষমূর্তির আর্বিভাব আমাদের দৃষ্টিগোচর করাইবার জন্য কবি লিখিলেন—”পৰ্ব্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ”; ইহাতে প্রত্যক্ষ-দর্শনের ফল হইল। অবশ্য ঐরূপ পর্ব্বতচূড়া দর্শনের ঘটনা যাঁহার জীবনে ঘটিয়াছে, অথবা যিনি কল্পনায় সেই অবস্থা অনুভব করিতে পারেন, তিনিই এই ভাষাকে দৃশ্যরূপে উপলব্ধি করিবেন। এ ভাষা বিবরণ বা বিজ্ঞাপনমূলক নয়। ইহা প্রদর্শনমূলক। এখানে একটি উপমায় যাহা সাধিত হইয়াছে, তাহাই নানা স্থানে, নানা উপায়ে সাধিত হয়; এবং বাক্যের কি বিচিত্র ও অসীম শক্তি, কবিদিগের ভাষায় তাহার অফুরন্ত নিদর্শন আমরা পাইয়া থাকি।

অতএব এই যে ভাষার সাহায্যে রূপসৃষ্টি—এই তত্ত্ব সাহিত্যপরিচয়ের একটা বড় তত্ত্ব। বাংলা ‘রূপ’ কথাটির প্রচলিত অর্থ যাহা, তাহা হইতে এই অর্থ যে ভিন্ন, তাহাও লক্ষ্য করিতে হইবে। প্রথমত, ভাবের যাহা বিপরীত তাহাই রূপ; ভাব একটা মানস-বস্তু বা মানস-ক্রিয়ার ফল; একটা আইডিয়া, ধারণা বা চিন্তাকেও ভাব বলিব; ইহা মনেই উৎপন্ন হইয়া বাহিরের জগতে আরোপিত,—অথবা বাহিরের জগতের সংস্পর্শে মনের মধ্যে উদ্রিক্ত হয়; ইহার কোন রূপ নাই। আর একজাতীয় ভাব আছে, তাহা মানুষের আর এক প্রকার অন্তঃকরণ-প্রবৃত্তির ফল; সে একটি পৃথক প্রবৃত্তি, তাহাকে রস-প্রবৃত্তি বা আনন্দ-পিপাসা বলা যাইতে পারে। ইহাও দুইমুখী—অন্তর্মুখী, বা নিছক ভাবমার্গী; এবং বহির্মুখী, বা জগৎ ও জীবনের বস্তুগত অস্তিত্বের আশ্রয়কামী। এই শেষোক্ত প্রবৃত্তি কখনও abstract বা সম্পূর্ণ মনোগত বিষয়ে আসক্ত হইতে পারে না, ইহা নিরন্তর বস্তু-রূপের কামনা করে। এই প্রবৃত্তির বশেই মানুষের চিত্তে সৃষ্টি-প্রেরণা জাগে, বাহিরের সৃষ্টিকে —বিধাতার বস্তুময়, ঘটনাময় দৃশ্যময় রচনাকে—তাহারই স্বকীয় ছন্দ, রঙ ও রেখায়, একটা অপূর্ব্ব অর্থ-সমন্বিতরূপে আবিষ্কার করে। এই যে আবিষ্কার, ইহাই গভীরতর অর্থে রূপসৃষ্টি; এখানে রূপকথাটির অর্থ আরও সূক্ষ্ম হইয়া উঠিল। কবি-বিধাতার হস্তলিপি-রচিত যে কাব্য প্রত্যক্ষ দৃশ্যরূপে সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত রহিয়াছে, তাহারই অক্ষরে অক্ষরে দাগ বুলাইয়া, তাহার অন্তনির্হিত ভাবকে— ভাবনা করিয়া নয়, মনুষ্যচেতনার অধিগম্য তাহার যে রূপ, তাহাই দৃষ্টিগোচর করিয়া—বাক্যের পবস্ত্রে তাহাকে দৃশ্যরূপে স্থাপন করাই উৎকৃষ্ট কবিকীৰ্ত্তি; তাহাকেই আমি খাঁটি সাহিত্যসৃষ্টি বলিয়াছি। এই প্রসঙ্গে, ভাব ও রূপের পার্থক্য-বিচারে, আমি উপরে অন্তঃকরণ—প্রবৃত্তির যে ভেদ নিৰ্দ্দেশ করিয়াছি, তাহা মনে রাখিতে হইবে; ইহাও বলিয়া রাখা প্রয়োজন যে, মনোবৃত্তি ও রস-প্রবৃত্তি দুইটি স্বতন্ত্র বৃত্তি হইলেও, সাহিত্যসৃষ্টিতে এই দুই বৃত্তির মিশ্রণ বা বৃত্তিসঙ্কর এমনভাবে হইয়া থাকে—অনেক সময়ে তাহা এত গূঢ় ও প্রচ্ছন্ন থাকে যে, সাহিত্যবিচারে ভ্রম-প্রমাদ প্রায়ই অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠে। তথাপি আশা করি, সাহিত্যের স্বরূপ নির্ণয় করা দুঃসাধ্য হইবে না।

এ পর্য্যন্ত যে আলোচনা করিয়াছি, তাহার পর, খাঁটি সাহিত্যরচনা কি, সে বিষয়ে আর একটু স্পষ্ট ধারণা করিবার সুবিধা হইবে। পূর্ব্বে আমি এক স্থানে বলিয়াছি, সাহিত্যসৃষ্টি চিত্র বা ভাস্কর্য্যের মতই একটা রচনাকার্য্য। গদ্যেই হউক আর পদ্যেই হউক, এইরূপ রচনাকে সাধারণভাবে কাব্য বলা যাইতে পারে; অর্থাৎ নাটক, উপন্যাস, গল্প, কবিতা—সকল সৃষ্টিধর্মী রচনাকেই কাব্যজাতীয় সাহিত্য বলিতে হইবে। যেহেতু এ সকলই এক অর্থে রূপ-সৃষ্টি, অতএব ইহাও অন্যান্য শিল্পকলার মত একটা শিল্পকৰ্ম্ম বলিয়াই সহসা মনে হইবে। কিন্তু খাঁটি সাহিত্যসৃষ্টির লক্ষণ বিচার করিলে দেখা যাইবে, ইহা ঠিক আর্ট বা কলাকীৰ্ত্তি নহে; তাহা হইতে ভিন্ন, অথবা শ্রেষ্ঠ। সঙ্গীতও একটি কলা, সুর রচনার সাহায্যে ভাবোদ্রেক করাই তাহার অভিপ্রায়; কিন্তু সে ভাব যতই গভীর বা মৰ্ম্মান্তস্পর্শী, কিংবা চিদঘন আনন্দের উদ্রেককারী হউক, তাহা রূপাশ্রয়ী নয়; জগৎ ও জীবনের সাক্ষাৎ সংস্পর্শ তাহাতে নাই। চিত্র ও ভাস্কর্য্যও দুই বিভিন্ন কলা; ইহাদেরও আদি-আদর্শ সঙ্গীত; অর্থাৎ ইহার বস্তুর রূপ বা রঙ-রেখা ও আকার প্রভৃতির সাহায্যে অভিব্যক্ত হইলেও, রূপ-কে রূপকে পৌঁছাইতে না পারিলে—বিশেষের সাহায্যে নির্বিশেষের ব্যঞ্জনা, সকল উপাদানের সাহায্যে একটা সঙ্গীত-সঙ্গতির রসাবেশ উদ্রেক করিতে না পরিলে তাহা উচ্চাঙ্গের কর্ম্ম বলিয়া গণ্য হয় না। কিন্তু উৎকৃষ্ট সাহিত্যসৃষ্টিতে এইরূপ ভাবাবস্থা মাত্র উদ্রেক করিবার নৈপুণ্য থাকিলেই চলিবে না, তাহাতে জীবন ও জগৎঘটিত একটা সাক্ষাৎ উপলব্ধি—ভাবে নয়, রূপসমন্বিত হইয়া বিদ্যমান থাকা চাই; অর্থাৎ, জীবন ও জগতের একটা সাক্ষাৎ পরিচয় সেই ভাবাবস্থাতেও আমাদের চৈতন্যগোচর হওয়া চাই। ইহাতে আর্টের নৈপুণ্য যতই থাকুক, বাস্তবসৃষ্টির রহস্যবোধ—প্রত্যক্ষ প্রকাশমান রূপেরই একটা নিবিড় চেতনা—যদি লুপ্ত হয়, তবে তাহা উৎকৃষ্ট সাহিত্য-পদবাচ্য নয়। যে-রচনায় ভাব বহির্মুখী না হইয়া একেবারে অন্তর্মুখী হইতে চায়, যাহাতে জীবন ও জগৎ কোন এক দিক দিয়া খণ্ড-ভাবে একটা বিচিত্র অন্তর-অনুভূতির symbol বা প্রতীক হইয়াছে দেখা যায়, তাহা আর্ট মাত্র বা ছোট আর্ট; সাহিত্য যে আর্ট, তাহা আরও উচ্চ, আরও বড়। সেই সকল অপর আর্ট আত্মসৰ্ব্বস্ব; তাহা ব্যক্তির ব্যক্তিগত ধ্যান-কল্পনাকে প্রকাশ করে, সার্ব্বজনীন চেতনা, বা জীবনের বস্তুগত সমগ্ররূপ তাহার লক্ষ্য নয়। যাহা আর্ট মাত্র, তাহা ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে ইন্দ্রিয়ের বিষয় হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহাকে একটা মানস-সুষমা দান করে; বস্তু বা ইন্দ্রিয়ার্থের সম্পর্কশূন্য হওয়ায় তাহা আর সৃষ্টি-রহস্যে অনুপ্রাণিত হয় না; সাক্ষাৎ দেহ-চেতনা হইতে মুক্ত হয় বলিয়াই তাহা সৃষ্টিকে অস্বীকার করে। একটা ছবি, একটা প্রস্তরমূর্তি, একটা শাল বা কার্পেটের নক্সা—এমন কি, একটা সুরসমষ্টির ঐকতান এই জন্যই আর্ট বা শিল্পরচনা হিসাবে সার্থক হয় যে, তাহাতে জীবনের কোন ব্যাখ্যা বা রূপ-প্রদর্শন নাই, বরং জীবনকে অগ্রাহ্য করিয়া ‘রস’ নামক একটি বস্তুর সাধনাই তাহার লক্ষ্য। কিন্তু সাহিত্য এইরূপ আর্টসাধনা নয়, তাহা খাঁটি সৃষ্টিকৰ্ম্ম। এই সৃষ্টিকাব্যের বিষয় ও প্রেরণা কি, এক্ষণে তাহাই বলিব।

এ পৰ্য্যন্ত ইহাই বলিয়াছি যে, সাহিত্য-রচনার উপাদান যেমন ভাষা-সাহিত্য বাঙ্ময় বিগ্রহ, তেমনই, সেই বিগ্রহ জীবনেরই একটি সুপ্রকাশিত রূপ। এখন এই জীবন কথাটিকে ভাল করিয়া বুঝিয়া লইতে হইবে–সাহিত্যের সম্পর্কে ইহার স্থূল ও সূক্ষ্ম অর্থ নির্ণয় করিতে হইবে। সমস্ত বহির্জগতেরই পরিবেশ—সেই পরিবেশের যতখানি মানুষের চেতনায় বিরাজ করে তাহারই আশ্রয়ে, এবং মানুষের দেহ—মন-প্রাণের সহিত অখন্ডনীয় নিয়তিসূত্রে সংযুক্ত হইয়া, পরিবার, সমাজ ও প্রকৃতির পরিবেষ্টনীতে মানুষকে প্রধান নায়ক করিয়া, যে বিরাট নাট্যলীলার অভিনয় হইতেছে, তাহাই জীবন—তাহাই সাহিত্যের বিষয়। জীবন বলিতে ইহাই বুঝিতে হইবে। তথাপি এই ব্যাপক অর্থ বুঝাইবার জন্য আমি প্রায় সর্ব্বত্র ‘জীবন ও জগৎ’ এই যুক্ত বাক্য প্রয়োগ করিয়াছি। সাহিত্যের বিষয়ীভূত জীবনকে নাট্যলীলা বলিবার কারণ আছে। জীবনের এই বহিঃপ্রকাশ যে আর এক ভঙ্গিতে মানুষের জ্ঞানগোচর হয়, তাহাতে জীবনধারণের সমস্যাই প্রবল; তাহাতে কোন রূপ নাই, অর্থাৎ সমগ্রতার উপলব্ধি নাই। তাহা খন্ড ও বিচ্ছিন্নভাবে, প্রয়োজনের তাড়নাসম্ভূত চিন্তা-সমষ্টিরূপে, আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে। এজন্য তাহা একটা রূপ-পরিণামী আদি-অন্তযুক্ত দৃশ্যপরম্পরার মত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না—কেবল কতকগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও ঘটনাপরম্পরায় প্রতিভাত হয়। তাই জীবনের যে রূপকে আমি সাহিত্যের সাধনা বলিয়াছি, তাহাকে নাট্যলীলার সহিত তুলনা করাই সঙ্গত। জীবনের অপর অভিজ্ঞতাকে বাস্তব নাম দেওয়া হইয়া থাকে, এবং ইহাই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুর্দ্ধর্ষ প্রমাণরাশির বলে একটা তত্ত্বরূপে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। জীবনের এই মূর্ত্তির সঙ্গে সাহিত্যের লেশমাত্র সম্পর্ক নাই—মানুষ যেখানে এই বাস্তবের উপাসনা করে, সেখানে সে সাহিত্য-সৃষ্টি করে না। সাহিত্যের বিষয় যে জীবন, তাহাও বাস্তব—কেবল তাহা জড়বাস্তব নহে, চিন্ময় বাস্তব। মানুষের দেহ অ্যানাটমি বিদ্যার নিকটে যাহা, ভাস্কর বা চিত্রকরের নিকট নিশ্চয় তাহা নহে; সেই দেহের নানা অঙ্গসংস্থান, অস্থি ও স্নায়ুশিরার সংখ্যা, ও তাহাদের বিন্যাসপদ্ধতির জ্ঞানই মনুষ্যমূর্ত্তির পরিচয় নহে। সেই মূর্ত্তির আপাদমস্তক সৰ্ব্ব—অঙ্গের যে ছন্দ, তাহার লীলায়িত গতিভঙ্গি, তাহার স্বাস্থ্যের লাবণ্য, তাহার মুখের হাসি ও চোখের কটাক্ষ যে রূপের সাক্ষ্য দেয়—পেশী মাংস অস্থি ও স্নায়ুশিরার সমষ্টি যে-দেহ, সে-দেহে তাহা থাকিতে পারে না। বিজ্ঞানীর নিকটে দেহ একটা বহু অঙ্গ-বিশিষ্ট যন্ত্রমাত্র, তাহার প্রাণ সেই যন্ত্রের একটা ক্রিয়া; এবং সেই প্রাণ—ক্রিয়া নির্ব্বাহ ছাড়া তাহার কোন অর্থ বা অভিপ্রায় নাই। ইহার পর, এই যন্ত্রের বিকল হওয়ার যত কারণ, এবং তাহা নিবারণ করার যত কৌশল—তাহাই যন্ত্রবিদকে অনন্যমনা করিয়া রাখে। প্রাণধারণের পক্ষে ইহার প্রয়োজন আছে; কিন্তু সৃষ্টির রহস্যবোধের পক্ষে ইহা নিতান্তই খন্ড, বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র। ইহা সেই অন্তশ্চক্ষুর গভীরতর দৃষ্টিকে রোধ করিয়া দাঁড়ায়, যাহা পদক্ষেপ হইতে কটাক্ষপাত পৰ্য্যস্ত সর্ব্ব-অঙ্গের মিলিত সুষমায়—কণ্ঠের আত্তচীৎকার ও কলধ্বনি, দেহের স্বেদ—কম্প-পুলক-শিহরণ—এই সকলের মধ্যে, একটি অখন্ড চিৎ-সত্তার অপরূপ প্রকাশ আবিষ্কার করে। এই যে সৃষ্টি, ইহার মূলে কেবল জড়ের জড়ধর্ম্মের উত্তেজনাই নাই, তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ একটি সম্বোধি জাগ্রত হইয়া থাকে। আমি বিজ্ঞানের জড়বাদ ও সাহিত্যের এই জীবনবাদের পার্থক্য বুঝাইবার জন্য একটি সাধারণ উপমা ব্যবহার করিয়াছি, তাহাতে আমার বক্তব্য কিছু বিশদ করিবার সুবিধা হইয়াছে— উপমা যেমন সাহিত্যের ভাষা, তেমনই সাহিত্য-বিচারেও উপমার উপযোগিতা অল্প নহে।

সাহিত্যে আমরা এই জীবনকেই—আকারে-ইঙ্গিতে, রূপকে প্রতীকে, ভাবে ও ভাবনায়—কখনও সুরের অনির্ব্বচনীয়তায়, কখনও বাক্যের অপরূপ ব্যঞ্জনায়, কখনও বা অর্থে, কখনও অর্থহীনতায়, কখনও স্থিরচিত্রে কখনও ঘটনার গতিচ্ছন্দে, কখনও রূপবিবর্জ্জিত অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে, কখনও মানস কন্ডুয়নজাত নানা মতবাদের ভূমিকায় এবং প্রায় এই সকলের একাধিক ভঙ্গির মিশ্রণে, প্রতিবিম্বিত হইতে দেখি। কিন্তু আসলে জীবনকে সাহিত্যে রূপ দিবার ভঙ্গি এক বই দুই নহে—অন্তত যাহা উৎকৃষ্ট সাহিত্য তাহার লক্ষণ সর্ব্বত্র ও সৰ্ব্বকালে একই। সেই রূপ কি, আর একবার ভাল করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে। কবি ও রূপকার—কিন্তু চিত্রকর ও ভাস্করের মত রূপকার নহেন; সাহিত্যের আর্ট—সঙ্গীত, চিত্র বা তক্ষণকলার আর্ট নহে, ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। কেন, তাহা আবার বলি। সাহিত্যের সৃষ্টিকর্ম হয় বাক্যে—বাণীতে; ইহাতে সেই সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য বুঝিতে পারা যায়। বাক্যে যাহা প্রকাশিত হয়, তাহা অর্থবান্ অথচ অর্থাতীত; তাহা ভাবময় অথচ রূপাশ্রিত; তাহা চিত্র ও মূর্ত্তিকলার অনুকারী, অথচ দেশে ও কালে তাহাদের মত সীমাবদ্ধ নয়; তাহা সঙ্গীতযুক্ত অথচ নির্ব্বিশেষ নয়—সবিশেষ। এই জন্যই বাণী ভিন্ন অপর কিছুতেই এ সৃষ্টি সম্ভব নয়। সৃষ্টিতে যাহা খন্ডরূপে, ব্রহ্মের জড়মূর্তিরূপে আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর হয়, তাহাই কবির অখন্ড অনুভূতিতে—যেন একপ্রকার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়চেতনায়—সমগ্ররূপে চিন্ময় হইয়া উঠে; কোনও একটা ইন্দ্রিয়ানুভূতি প্রধান হইয়া মনকে অধিকার করে না, হৃদয়ের একটা বিশেষ বৃত্তি উত্তেজিত হইয়া সূক্ষ্ম ভাব ও শেষে সূক্ষ্মতর রসাবেশে লয়প্রাপ্ত হয় না। এই সর্ব্বানুভূতির ঐক্যবোধযুক্ত যে রূপ, তাহাকেই সাহিত্যে প্রতিফলিত জীবনের রূপ বলিয়াছি; এবং দেশ ও কালের ভূমিকায় এই রূপ নিরন্তর উদ্বৰ্ত্তিত হইতেছে বলিয়া আমি নাট্যলীলাকেই সাহিত্যের আদর্শ বলিয়াছি; সঙ্গীত যদি অন্যান্য শিল্পের আদর্শ হয়, তবে সাহিত্যকে—তাহার সৃষ্টিনিহিত রূপকে—নাট্যরূপ বলিতে হইবে। যাহা দেশে ও কালে—যুক্ত নয়-খন্ডিত, যাহা ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তের একটা অসংলগ্ন সমষ্টি বলিয়া মনে হয়, তাহাকেই একটা প্রাণবন্ত গতিধারায় আদি মধ্য ও অন্ত যুক্ত করিয়া দেখানোই সাহিত্যের সৃষ্টিকর্ম্ম। সকল শ্রেষ্ঠ কাব্যে—মহাকাব্য, কাহিনী, উপন্যাস, এমন কি, উৎকৃষ্ট খন্ডকবিতায়, জীবনের এই নাট্যলীলাত্মক রূপ আছে। এই জন্যই বোধ হয় জীবনকে প্রতিবিম্বিত করিবার উৎকৃষ্ট বাণী-মুকুর নাটক; আর কোথাও জীবনের রূপ-সমগ্রতা আমাদের চিত্তে এমন অবাধে সংক্রামিত হয় না। যখন কোন রচনার এইরূপ লক্ষণ আমরা বিচার করি, তখন দেখিতে হইবে, তাহার মধ্যে একটা কিছুর সমগ্র প্রকাশ আছে কি না—জীবনকে যেখানে যেদিক দিয়াই দেখি, তাহাতে একটা পূর্ণ পরিধি কেন্দ্ৰযুক্ত হইয়া উঠিয়াছে কি না; কাব্য বৃহৎ হউক, ক্ষুদ্র হউক-রচনার বিষয়বস্তু যেমনই হউক-সিন্ধুর বিশাল বক্ষে যেমন, তেমনই পুষ্করিণী ও গোষ্পদে সেই এক চন্দ্রবিম্ব প্রতিফলিত হইয়াছে কি না। এই যে সমগ্রতার রূপ-সংবেদনা, ইহাতেই জীবনের সকল অনর্থ অর্থবান হইয়া উঠে, সকল দুঃস্বপ্ন দূর হইয়া অন্তর যেন অরুণালোকে উদ্ভাসিত হয়। এখানেও দেহের সেই উপমাটা আর একবার কাজে লাগিবে, জীবনের রূপ বুঝিতে দেহের রূপই ধরা যাক। জড়বাদী দেহকে যে ভাবে দেখে, তাহাতে যেমন রূপ নাই, আছে গ্রন্থিবদ্ধ কয়েকটা খন্ডের সমষ্টি—তেমনই, দেহকে দেখিবার কালে যাহার দৃষ্টি দেহকে অতিক্রম করিয়া তাহার পশ্চাতে একটা ভাবময় সত্তাকে আবিষ্কার করে, অথবা দেহকে সেইরূপ একটা মানস-সংস্কারের প্রতীকরূপেই গ্রহণ করে—সেও এই রূপের কারবারী নহে। একটা উদাহরণ দিব। যে কবি বিশ্বমানবের ধ্যান করেন, তিনি মানুষের দিকে না তাকাইয়া তাহাকে অতিক্রম করিয়া—মানব-নামে একটা পরম সত্তার পূজা করেন; তিনি মানুষের দেহ-দশার সকল দুঃখ, তাহার জীবনযাত্রার নিয়তি-নির্দ্ধারিত পাপ-তাপের মধ্যে, অর্থাৎ তাহার বাস্তব প্রকৃতির মধ্যেই, জীবনের রহস্য সন্ধান করেন না; মানুষকে ভাল না বাসিয়া, মানবতার একটা ভাববিগ্রহ গড়িয়া তাহারই পূজা করেন। তাঁহার রচনায় জীবনেরই রহস্য রূপময় হইয়া উঠে না। আবার, যে-রচনায় দেহের কোন একটি অঙ্গের যেমন ভুলতা, নয়ন-ইন্দীবর, বা ভুজবল্লরীর-রমণীয়তাকেই প্রেক্ষণীয় করিয়া তোলা হয়, সে রচনা উৎকৃষ্ট সাহিত্যেকর্ম্ম নয় এক প্রকার শিল্পকলা মাত্র।

আমি যে রূপসৃষ্টিকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম্ম বলিয়াছি, তাহা ঐ দেহের মতই জীবনের সর্ব্বাঙ্গীণ সুষমার অভিব্যক্তি; সে রূপ-ঐ দেহেরই মত—জীবনেরও যেন কান্তি; তাহাতে জীবনের সকল বিষমতা ও বিরোধ, সকল খন্ডতা ও অসংলগ্নতা, একটি সমগ্ররূপে সমাহিত হইয়া প্রকাশ পায়। দেহের রূপ যেমন কোন একটা অঙ্গবিশেষের রূপ নয়, তাহা সর্ব্বাঙ্গ সঞ্চারিত হইয়া থাকে, এবং অখন্ড হইলেও তাহা দেহময়, এজন্য তাহা একই কালে বিশেষ ও নির্ব্বিশেষ—জীবনের রূপও, তেমনই, সাহিত্যে আমাদের চিত্তগোচর হয়। যেখানে জীবনের এই রূপ আমাদের চেতনায় একটি অপরূপ অর্থসঙ্গতি লাভ না করে-সেখানে সাহিত্যের প্রেরণা বিফল হইয়া থাকে। দেহ ও দেহের কান্তির যে উপমা দিয়াছি, জীবন ও জীবনের রূপ তাহা হইতেই বুঝিয়া লইতে হইবে; কায়া হইতে কান্তি যেমন পৃথক করা যায় না, সাহিত্যেও তেমনই জীবন হইতে জীবনের রূপকে পৃথক করা যায় না। অতএব তত্ত্ববিচারে দেহাত্মবাদ নামে যে একটি সিদ্ধান্ত আছে, সাহিত্যবিচারেও এইরূপ সিদ্ধান্তকে কায়া-কান্তিবাদ নাম দেওয়া যাইতে পারে। পরিশেষে, সাহিত্যসৃষ্টির সম্পর্কে জীবনের যে ব্যাখ্যা আমি করিয়াছি, তাহাতে আর একটি কথা যোগ করিলেই আমার বক্তব্য শেষ হয়। তাহা এই যে, সাহিত্যে জীবন ও জীবনের রূপ বলিতে যাহা এবং যতখানিই বুঝি না কেন, শেষ পর্যন্ত তাহা নর-লীলা ভিন্ন আর কিছুই নহে। জগৎনাট্যলীলার নায়ক মানুষ; জীবনে যাহা কিছু দেখি তাহা মানুষেরই দেহ-নিয়তির সঙ্গে মিলাইয়া দেখি; যেখানে সেই দেখা নাই, সেখানেই সাহিত্যসৃষ্টি হয় নাই। সাহিত্যে আমরা জীবনের যে চিন্ময় প্রকাশ দেখি, তাহা মনুষ্যজীবনের জবানিতেই ঘটিয়া থাকে, ইহার অন্যথা হইতে পারে না; কারণ, তাহা হইলে সে রচনা আর্ট-জাতীয় বস্তু হইবে, খাঁটি সৃষ্টিধর্মী সাহিত্য হইবে না।

এতক্ষণ সাহিত্যের প্রকৃতিবিচার করিয়াছি, এবং সে বিচারে সাহিত্যের একটি প্রধান লক্ষণ—যাহাকে আমি স্বরুপ-লক্ষণ বলি—তাহার কথাই বলিয়াছি। কিন্তু শুধু সেই দিক দিয়াই বিচার করিলে চলিবে না। আরও একদিক আছে, সেই দিক দিয়াও দেখিতে হইবে, নতুবা এ বিচার অসম্পূর্ণ থাকিবে। সাহিত্যের প্রকৃতি—বিচারে তাহার বাহিরের রূপ যেমন একটা বড় কথা, তেমনই সেই রূপসৃষ্টির প্রেরণাও অনুধাবনযোগ্য। এই প্রেরণার জন্ম হয় কবিচিত্তে। অতএব কবিচিত্ত বলিতে কি বুঝি, তাহাই এক্ষণে বলিব।

সাধারণ মানুষের চিত্ত ও কবিচিত্তে প্রভেদ এই যে, সাধারণ মানুষের চেতনায় অনুভূতির ক্ষেত্র অতিশয় সঙ্কীর্ণ—যতই গভীর হউক, তাহার প্রসার অল্প। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব বড়ই সীমাবদ্ধ। অনুভূতির ক্ষেত্র সঙ্কীর্ণ বলিয়াছি এই অর্থে যে, তাহা হইতে অপর ক্ষেত্রে প্রসারিত হইতে পারে না, খন্ডের গন্ডি পার হইয়া সমগ্রের দিকে প্রবাহিত হইতে পারে না। আমরা যাহাকে কবি-কল্পনা বলি—উৎকৃষ্ট অর্থে, তাহা এই প্রসারশীল অনুভূতির ফল; ইহা হইতেই কবিচিত্তে জীবনের রূপদর্শন ঘটে। দ্বিতীয় যে লক্ষণের কথা বলিয়াছি, তাহা আরও গভীর, তাই ভাল করিয়া বুঝিয়া লইবার প্রয়োজন আছে। কবির ব্যক্তিত্ব সাধারণ মানুষের মত সীমাবদ্ধ নয়, অর্থাৎ কবির মধ্যে একজন ব্যক্তিরই কামনা-ভাবনা নাই, তিনি যেন সকল মানুষের প্রতিনিধি। ইংরেজীতে ইহাকে rich ও composite personality বলা যাইতে পারে। জগতের শ্রেষ্ঠ কবি শেকসপীয়ারকে এক মনীষী যে বলিয়াছিলেন— ‘genius of humanity’, ইহা যথার্থ। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে ইংরেজীতে individuality বলে, ইংরেজীতে আর একটি শব্দ আছে—personality; এই দুইটি শব্দের অর্থগত প্রভেদ এখানে কাজে লাগিবে। প্রত্যেক মানুষের বাহির ও অন্তরের গঠনে অপরের সঙ্গে যে বৈলক্ষণ্য আছে—যাহা তাহারই, যাহা দ্বারা আর সকল হইতে তাহাকে পৃথক করিয়া লওয়া যায়, তাহাই তাঁহার individuality। কিন্তু personality বলিতে এই ব্যাক্তিত্ব নয়—সাধারণ মানব—চরিত্রেরই এক ঘনীভূত বা প্রবলতর প্রকাশ বুঝায়। কবির personality ইহা হইতেও বড়; তাহা ঘনীভূত বা প্রবল নয়, তাহাতে কোন বিশেষ পুরুষ-মহিলা নাই, তাই তাহা ব্যক্তিত্বেরই একটা বিশেষণ নয়—ব্যক্তিজীবনেরই একটা পৌরুষময় মূর্তি নয়। সে যেন এক পুরুষচিত্তের আধারে সকল পুরুষচিত্তের সমান স্ফূৰ্ত্তি—ইহাই Genius of Humanity; এবং ইহাই genius, বা কবি-প্রতিভা। ইহারই কারণে কবির অনুভূতি সর্বমানবীয় অনুভূতি হইয়া দাঁড়ায়; তাঁহার সৃষ্টি যতই অপূৰ্ব্ব হউক, তাহা সকলের অনুভূতিগোচর হয়,—কারণ, তাহা ব্যক্তিগত খেয়াল-খুশি বা উদ্ভট কল্পনার সৃষ্টি নহে। অতএব কবিচিত্তের যে আর এক লক্ষণ—যে প্রসারশীল অনুভূতির কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাহাও এই লক্ষণের সহিত যুক্ত হওয়া চাই, তবেই উৎকৃষ্ট প্রতিভার জন্ম হয়। এই প্রসঙ্গে ইহাও লক্ষ্য করিতে হইবে যে, কবিচিত্ত সৰ্ব্বমানব চিত্তের প্রতিনিধি বলিয়াই তাহা অতিশয় normal বা সুস্থ; individu—ality বা ব্যক্তিগত বৈলক্ষণ্যের দিক দিয়া দেখিলে কেহই normal নয়। তাই উৎকৃষ্ট কবিপ্রতিভা এত দুৰ্ল্লভ।

কবিচিত্তের এই লক্ষণ— এই সৰ্ব্বময় personality-র প্রসঙ্গে, আর একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। কবিচিত্তে এই যে বহুমুখিতার লক্ষণ আছে, তাহা সত্ত্বেও সে চিত্ত বহুর নয়—একেরই চিত্ত; অর্থাৎ তাহা খন্ডিত বা অসংলগ্ন নয়, তাহা হইলে কবির সৃষ্টিতে সর্ব্বত্র দৃষ্টির মূলগত ঐক্য থাকিত না। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে একই ব্যক্তির মধ্যে যে multiple personality -র অস্তিত্ব স্বীকৃত হইয়াছে—কবির এই personality বা চিৎ-সত্তা সেইরূপ বহুত্বসম্পন্ন নয়; তেমন প্রকৃতি normal বা সুস্থ প্রকৃতি নয়। কবির চিত্ত বহুল নয়, তাহা বিরাট; সংখ্যাধিক্য নয়—প্রসার ও প্রশস্ততাই সেই সার্ব্বজনীনতার কারণ; সে বহুত্বে গণিতের নিয়ম নাই; এক প্রকার প্রেমেরই যাদুশক্তি আছে। সেখানে একটা ‘আমি’র মধ্যেই সকল ‘আমি’ স্পন্দিত হইতেছে—সৰ্ব্বমানবচিত্ত একমুখী হইয়া একই শক্তির পুরুষসত্তাকে বিরাট—পুরুষ করিয়া তুলিয়াছে। এজন্য কবির মধ্যে ব্যক্তি যিনি, তিনিও নৈর্ব্যক্তিক হইয়া আছেন। কবিচিত্তে ব্যক্তি ও নির্ব্যক্তির এই লুকোচুরি কবিপ্রতিভার আর এক রহস্য, ব্যক্তিত্বই যেন বৰ্দ্ধিত হইয়া তাহাকে নৈর্ব্যক্তিক করিয়াছে। তাই যে-জগৎ তাঁহারই জগৎ—তিনি ভিন্ন আর কেহ যাহা রচনা করিতে পারিতেন না—সেই জগৎ তথাপি একার জগৎ নহে সকলর জগৎ,—উৎকৃষ্ট কাব্যপাঠকালে এই উপলব্ধি আমাদিগকে সমধিক বিস্মিত ও পুলকিত করে। এই জন্যই বলিতে হইবে, কবি নিজচিত্তে সকল চিত্তকে ধারণ করেন—ব্যক্তিই বিরাট হইয়া উঠে।

আধুনিক কালে কবিচিত্তের এই লক্ষণ স্বীকৃত হয় না, এখন এইরূপ personality অপেক্ষা individuality-র উপরেই বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়। কিন্তু individuality বা কবির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই উৎকৃষ্ট কবিকর্ম্মের পরিপন্থী। যে কবির চিত্তে স্বাতন্ত্র্য যত অধিক, তিনিই সেই পরিমাণে জগৎ ও জীবনের সহিত যোগযুক্ত নহেন, তিনি সার্ব্বজনীন মানব চিত্তের অধিকারী নহেন, তাঁহার রচনা আত্ম—ভাবম্পদ্ধী; তিনি নিজেরই idiosyncrasy বা ব্যক্তিগত খেয়ালের বশে নিজের বিচিত্র-গঠন মানসদর্পণে জগতের যে প্রতিবিম্ব রচনা করেন, তাহা যেমন সৃষ্টির সত্যে অনুপ্রাণিত নয়, তেমনই তাহা সৰ্ব্বমানবচিত্তের দৃষ্টিগোচর নহে। যাহাদের সহিত সেইরূপ মানসধর্ম্মের মিল আছে, কেবল তাহারই—অনুরূপ আত্মাভিমান তৃপ্ত হয় বলিয়া—সে রচনার পক্ষপাতী হয়। আধুনিক সাহিত্যসমাজে এই ধরণের রসিকেরাই সম্মান পাইয়া থাকেন; এবং ইংরেজীতে ইঁহারা যে intellectuals নামে অভিহিত হত, তাহা সঙ্গত; কারণ, ইঁহারা সাহিত্যবিচারে প্রকৃতই মনোবিলাসী; ইঁহারাও আত্মভাবপন্থী। সাহিত্যে এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দাবি আধুনিক কালে অত্যধিক বাড়িয়া উঠিয়াছে—ইহাতে সাহিত্যের স্বকীয় আদর্শ নষ্ট হইতেছে, জীবনের দেহচেতনাগত রূপমাধুরী, এবং কায়ার সহিত অভিন্ন যে কান্তি, সাহিত্যে তাহা আর ফুটিতে পারিতেছে না।

কবিচিত্তের যে লক্ষণ নির্দ্দেশ করিয়াছি, তাহাতে, এই ভারতন্ত্রের মতই সাহিত্যের Realism বা বস্তুতন্ত্রের কথাও প্রাসঙ্গিক বটে। ভাবতান্ত্রিক যেমন আত্মভাবের আদর্শে আপনার জগৎ পৃথক গড়িয়া থাকেন, এবং তাহার মূলে আছে স্বাতন্ত্র্যের অভিমান, বস্তুতান্ত্রিকের অবস্থা ঠিক তাহার বিপরীত। এই সকল লেখক যেমন কোন স্বকীয় স্বতন্ত্র অনুভূতি দাবি করেন না, তেমনই, কোনপ্রকার অনুভূতি-কল্পনাও তাঁহাদের নাই। বস্তুতান্ত্রিকের বুদ্ধি জগৎকে বস্তুসমষ্টিরূপেই দেখে— সে যেন কতকগুলা বক্র ভগ্ন অসম্পূর্ণ অর্থহীন রেখার সমাবেশ। ইহার কারণ, পুরুষের যে সম্বিৎ কোন কিছুকেই অসম্পূর্ণ দেখিতে চায় না-হয় কল্পনা, নয় বিশ্বাস, অথবা প্রেমের দ্বারা জগতের সব কিছুর একটা সঙ্গতিরোধ করে—ইহারা তাহাকে প্রশ্রয় দেয় না; ইহাদের প্রেম নাই, ইহারা অবিশ্বাসী, নাস্তিক। আমি পূর্ব্বে যে বৈজ্ঞানিক জড়বাদের কথা বলিয়াছি, ইহারা সাহিত্যেও তাহারই আরাধনা করে। ইহাদের মতে মানুষের দেহও তড়িৎ-তাড়নার মত কতকগুলো সুখদুঃখ অনুভূতির আধার। সেই অনুভূতি যেন মুহূর্ত্তের অনুভূতি মাত্র; যদি তাহার পরম্পরাও থাকে, তবে তাহার কোন পরিণাম নাই। এরূপ রচনায় রূপসৃষ্টি তো পরের কথা, একটা সঙ্গতি-সুষমাও লক্ষিত হয় না, ইহা শিল্পকলারও অর্ন্তভুক্ত নহে; কারণ, সেখানেও অর্থহীন রং রেখা প্রভৃতিকে একটা সুবলয়িত সুষমা দান করার প্রবৃত্তি আছে। কিন্তু রহস্যের কথা এই যে, এই সকল বস্তুতান্ত্রিক সাহিত্যিকেরা বস্তুর নিছক বাস্তবতাকেও আয়ত্ত করিতে পারেন না। ইহার কারণ, বৈজ্ঞানিক চিন্তার ক্ষেত্রে আত্ম-সংস্কার বর্জন করা যতই সম্ভব হউক, যে রচনা আদৌ অনুভূতিমূলক—সাক্ষাৎ ইন্দ্রিয়-পরিচয় উপরেই যাহার নির্ভর, তাহাতে বস্তুর মধ্যে লেখকের আত্ম-প্রবেশ থাকিবেই। সেই আত্মসংস্কারকে দমন করা অসম্ভব বলিয়াই বাস্তব চিত্রের মধ্যেও আত্মভাবেরই একটা অতিশয় বিকৃত ক্ষতবিক্ষত বিকলাঙ্গ রূপ ফুটিয়া উঠে। ইহা হইতে বুঝিতে পারা যাইবে যে, Realism বা বস্তুতন্ত্র সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যের পক্ষে সম্পূর্ণ অর্থহীন।

অতঃপর, সাক্ষাৎ সাহিত্যসৃষ্টিতে কবিচিত্তের প্রেরণা কি, তাহাই বলিব। সাহিত্যসৃষ্টিতে কবির মূল প্রেরণা ভাবও নয়, চিন্তাও নয়—বাহিরের সহিত অন্তরের একাত্মতা; এই জগৎ ও জীবন যেন তাঁহার চেতনাকে অধিকার করিয়া রূপের ভাষায় আপন কথা বলে; অর্থাৎ তাহার কোন অংশই দেশ কাল হইতে বিচ্ছিন্ন না হইয়া—যেমন আছে, হয়, ও ঘটে—তাহারই মূর্তিতে প্রকাশিত হয়। এখানে এই যে রূপের কথা বলিলাম, ইহা ভাবের বিপরীত মাত্র। জীবনের কোন একটা অভিজ্ঞতা হইতে, অথবা আমারই অন্তরের কামনা হইতে, ভাবের উৎপত্তি হইতে পারে; এই ভাব অতিসূক্ষ্ম অনুভূতি-রসে পরিণত হইয়া এক প্রকার কাব্যের প্রেরণা হয়। কিন্তু এই ভাবমূলক রচনার রূপ নাই, ইহার ভাষা ভাবেরই ভাষা—আমারই হৃদয়োখিত এক অশরীরী বিগ্রহ, ইহা আমার সম্মুখে জগতেরই একটা ঘটনা বা দৃশ্যরূপে উদয় হইতেছে না। তাই ইহা জীবন-দর্শন নয়, এক প্রকার আত্মদর্শন মাত্র। আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্রে—জীবনের রূপও নয়, ভাবের রসসৃষ্টিই কাব্যের মূলীভূত অভিপ্রায় বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। ভাব বরং বস্তুমুখী; রস ভাবেরও সূক্ষ্মতর পরিণামে, একেবারে বেদান্তর-স্পর্শশূন্য! কিন্তু আমি যে রূপের কথা বলিয়াছি, তাহা বস্তুর সহিত অভিন্ন; কিন্তু তাই বলিয়া তাহা বস্তুতন্ত্রের বাস্তব নহে। এখানে কায়া ও কান্তির উপমা স্মরণ করিতে হইবে। অতএব কবিত্বের মূল প্রেরণা—বাহিরের সহিত অন্তরের একাত্মতা। ইহাকে যদি আত্মার সহিত দেহের মিলন, জড়ের সহিত চিৎ-এর পরিণয় বলি, তবে কথাটা বড়ই দুৰ্ব্বোধ্য হইয়া উঠিবে। যদি বলি—ইহাই প্রেম, তাহা হইলে কথাটা কতকটা হৃদয়ঙ্গম হইতে পারে। ইহারও পরে, যদি বলি, এই প্রেম আত্মমুখী নয়, বহির্মুখী—ইহা আত্মরতি নয়, জগৎ-রতি, তাহা হইলে বোধ হয় কথাটা আর একটু স্পষ্ট হইয়া উঠিবে। জগৎ‍ ও জীবনের প্রতি এই আসক্তি যখন ভাবের আকারেই সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তাহা উৎকৃষ্ট সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা নয়, সেও নিজেরই সুখদুঃখের গীতময় উচ্ছ্বাস; তাহার যে কবিতা, সেও রূপাত্মক নয় ভাবাত্মক; এ জন্য তাহা উৎকৃষ্ট গান হইলেও উৎকৃষ্ট সৃষ্টি নহে—উৎকৃষ্ট আর্ট হইলেও, উৎকৃষ্ট সাহিত্য নহে। তথাপি সাহিত্যসৃষ্টির মূলে কবির সেই আসক্তি আছে—ইহারই বশে কবিচিত্তে এক আশ্চর্য্য উপায়ে জগতের বিক্ষিপ্ত বস্তুরাশির মধ্যে অনুস্যূত হইয়া নটলীলায় প্রবৃত্ত হয়; তখন কিছুই আর ভাব নয়, ‘ভব’, বা ঘটনায়, দৃশ্যে, আকারে, অবস্থানে—শরীরী হইয়া উঠে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কবি যখন বলেন—

“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই;”

—তখন তাহাতে খাঁটি জগৎ-প্রীতির প্রেরণাই আমরা লক্ষ্য করি বটে, কিন্তু এখানে তাহা ভাবের আকারেই আছে—’ভব’ হইয়া উঠে নাই; অর্থাৎ, একটি ভাবরূপেই তাহা আমাদের চিত্তে সংক্রামিত হয়—জীবনের কাহিনীতে রূপ ধারণ করিয়া চাক্ষুষ হইয়া উঠে না। ভাব ও রূপের এই প্রভেদ অল্প নহে। ভাবের আদিও নাই, অন্তও নাই,—উহা একটা চিত্ত-চমক মাত্র; কিন্তু রূপে, অর্থাৎ জীবনের ঘটনায়, যখন তাহা নাট্যীকৃত হয়, তখন তাহা আদি-অন্ত-যুক্ত হইয়া জীবনের গভীরতম রহস্যকে অপরোক্ষ করিয়া তোলে। উপরি-উদ্ধৃত শ্লোকে যে কামনা ব্যক্ত হইয়াছে, তাহা কামনা মাত্র; তাহাতে রূপসৃষ্টির সম্পূর্ণতা নাই, ভাব হইতে ভাবেই তাহার পরিসমাপ্তি। কিন্তু রূপসৃষ্টিমূলক সাহিত্যে আমাদের অনুভূতি এইরূপ ভাবমূলক অসম্পূর্ণ অনুভূতি হইবে না। সেখানে ভাবিবার কিছুই নাই, সকলই দেখিবার; তাই কামনাও একটা ঘটনার রূপে সম্পূর্ণ হইয়া ওঠে। এখানে কবি যাহা কামনা করিতেছেন, তাহা নিশ্চয় অসম্ভব বলিয়া মনে হয় না; বরং মৃত্যুর নিয়তিকে লঙ্ঘন করার যে সম্ভাবনা, তাহাই এই কামনাকে বৃহৎ ও কবিত্বময় করিয়াছে। কিন্তু এই কামনা যদি রূপে প্রকাশ পাইত, তবে দেখা যাইত ‘আমি’ মরে নাই ‘আমি’ মানুষের মাঝে বাঁচিয়া আছে। আরও একটি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিত, ঐ ‘আমি’টাকে তখন দেখিতে পাওয়া যাইত বলিয়া ‘আমি’ আর ব্যক্তি-আমি থাকিত না, সাধারণ আমি হইয়া যাইত—ভাবে যাহা ব্যক্তি-‘আমি’, রূপে তাহা সকলের ‘আমি’ হইয়া উঠে। এই জন্যই কাব্যসৃষ্টিতে Subjectivity বা মন্ময়তা অপেক্ষা Objectivity বা তন্ময়তাই কবিকল্পনার উৎকর্ষ প্রমাণ করে।

অতএব এই যে রূপসৃষ্টি, ইহার মূলে আছে প্রেম—কারণ এমন করিয়া দেখিতে বা দেখাইতে হইলে সঙ্গে সঙ্গে ‘আমি’টাকে উৎসর্গ করিতে হয়। যিনি এই বিশ্বের আদি স্রষ্টা, তিনিও এই প্রেমের প্রেরণায় আপনাকে উৎসর্গ করিয়াই জগৎ-সৃষ্টি করিয়াছেন—নির্বিকল্প কৈবল্যের অবস্থা ভাল লাগে না বলিয়াই, রসব্রহ্ম জগৎ—ব্রহ্মের রূপ ধারণ করিয়াছেন; এবং “ভাব হইতে রূপে যাওয়া আসা” নয়, নিত্য রূপের মধ্যেই অবস্থিতি করিতেছেন। কবির চিত্তেও সেই প্রেম জাগে—ভাগবতী সৃষ্টির সেই মূলকল্পনাকে মানবীয় সৃষ্টিতে মানবদেহানুভূতির ভাষায় অনুবাদ করিয়া ভোগ করিতে ইচ্ছা হয়; তাই সাহিত্যে জগৎরূপী ব্রহ্মের দর্শন ঘটিয়া থাকে। রূপ-রূপ—রূপ! তত্ত্ব নয়, ভাব নয়, চিন্তা নয়, দেশ ও কালের দ্বিগুণিত সূত্রে বয়ন-করা, সর্ব্বেন্দ্রিয়-মনোহর সেই কাব্য-দেহকে দেহ দিয়া অনুভব করার মতই, প্রত্যক্ষগোচর হইয়া উঠে। সকল রূপ-পিপাসার মূলে এই দেহ-প্রেমই আছে; এই রূপ-পিপাসার দেহ-প্রেমই কবির প্রতিভায় দিব্যদৃষ্টিতে পরিণত হয়; তখন কিছুই আর ক্ষুদ্র, খন্ড, কুৎসিত, অপ্রীতিকর থাকিতে পারে না। ভাবের আত্মপরায়ণতায় যাহা তুরীয়ধর্মী—অর্থাৎ অরূপের অসীমায় যাহা অর্থাতীত ও আদি-অন্তহীন, তাহাই দেহের প্রেম-পিপাসায়—সমগ্র, সুষীম, রূপময় ও অর্থপূর্ণ। কিন্তু কেবলমাত্র রূপ—পিপাসাই এই প্রেম নয়; রূপ-পিপাসায় কিছুই সৃষ্টি হয় না, তাহাতে ইন্দ্রিয়বিলাসের উপকরণ রচনা হয় মাত্র, তাহাকেই আর্ট বলে। তাহাতে জীবনের সমগ্রতাবোধ নাই, কারণ তাহাতে পিপাসাই আছে, প্রেম নাই। সেখানেও দেহের খন্ডরূপেরই আরাধনা হইয়া থাকে। নিম্নোদ্ধৃত পংক্তিগুলিতে এই রূপ-পিপাসার একটি চমৎকার অভিব্যক্তি আছে—

Mamua, when our laughter ends
And hearts and bodies, brown as white,
Are dust about the doors of friends,
Or scent ablowing down the night,
Then, Oh! then, the wise agree
Comes our immortality;
Mamua, there waits a land
Hard for us to understand,
Out of time, beyond the Sun…
There the Eternals are, and there
The Good, the Lovely, and the
True And Types, whose earthly copies were
The foolish broken things we knew…
Never a tear, but only Grief;
Dance, but not the limbs that move;
Instead of lovers, Love shall be,
And there, on the Ideal Reef,
Thunders the Everlasting sea.

—এখানে রূপবিবর্জ্জিত নির্বিশেষে যে অস্তিত্ব, তাহার বিরুদ্ধে বিশেষের অনুরাগী, দেহপিপাসাতুর প্রাণের যে দীর্ঘশ্বাস শুনিতে পাই, তাহা প্রেম নয়—পিপাসারই ভাবোচ্ছ্বাস। কবিচিত্তের প্রেম জগৎ ও জীবনকে “foolish broken things” বলিবে কেন? সকলকেই সুসম্পূর্ণ ও সুসম্বন্ধ দেখিবে, এবং সেই দেখাতেই হৃদয়ে আর কোন আক্ষেপ থাকিবে না—আপন সৃষ্টির মধ্যেই একটা শাশ্বত ও চিরন্তনী সত্তা উপলব্ধি করিবে। সাহিত্যেই আমরা এই অপূর্ব আশ্বাস লাভ করি; আর সকল পথে প্রশ্ন এড়াইয়া চলিতে হয়, অথবা প্রশ্ন বাড়িয়াই চলে, সমাধান আর হয় না। এই জন্য সাহিত্যকেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানযোগ বা প্রকৃষ্ট প্রজ্ঞানপন্থা বলা যাইতে পারে।

8

যাহা শ্রেষ্ট সাহিত্যিক সৃষ্টি, তাহাতে Idealও নাই, Realও নাই, কিন্তু রোমান্স আছে—থাকিবেই। রোমান্স অর্থে অতিচারী কল্পনা নয়, সত্যকার কবিকল্পনা। যে কল্পনা জড়কে চিন্ময় দেখে খন্ড ও বিচ্ছিন্নকে সমগ্র ও অর্থপূর্ণ করিয়া লয়-যাহা ভগ্নকে যুক্ত করে, অসংলগ্নকে সুসম্বন্ধ করিয়া তোলে, তাহাই সাহিত্যকে রোমান্স—গুণযুক্ত করে—অর্থাৎ, জীবনের খণ্ড-রেখায় যে মন্ডলাভাস আছে, তাহার পূর্ণমন্ডল আবিষ্কার করে। এই কল্পনার মূলে আছে প্রেম, ইহাই সুস্থ; কল্পনা যেখানে আত্মপরায়ণ বা আত্মদ্রোহী, সেখানে রূপসৃষ্টির রোমান্স নাই; অবাস্তব ভাববিলাস, অথবা বাস্তবের বস্তু-বিশ্লেষণ আছে। যাহা নাই, তাহার মনোহর মায়ারূপ-রচনা সত্যকার কাব্যসৃষ্টি নয়। যাহারা এই প্রকার রচনাকেই কাব্য বলে, তাহারাই উৎকৃষ্ট উপন্যাসকেও রোমান্স বলিয়া নাসাকুঞ্চিত করে; এবং জীবনের কাহিনীতে কল্পনাহীন বাস্তবের আধিপত্য থাকিলেই তাহাকে আদর্শ উপন্যাস বা সাহিত্যসৃষ্টির এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলিয়া গণ্য করে। এজন্য যে রচনায় প্লট বা সুসম্পূর্ণ কাহিনী নাই—ঘটনা সকলের মধ্যে সাক্ষাৎ কার্যকারণের সম্বন্ধ মাত্র আছে, কিন্তু কোনও একমুখী পরিণামের মিলিত অভিপ্রায় নাই, তাহাই ইহাদের মতে জীবনের উৎকৃষ্ট চিত্র; কারণ তাহা বাস্তব, তাহা রোমান্স নয়। কিন্তু এইরূপ রচনাই সাহিত্য পদবাচ্য নয়, কারণ ইহাতে কবিদৃষ্টির লক্ষণ নাই। কাব্যসৃষ্টিতে কবির দৃষ্টি স্থির, একাগ্র ও পূর্ণতার অভিমুখী; তাহাতে অসম্বন্ধ বাস্তবের বিবৃতি নাই বলিয়াই তাহা অবাস্তব বা মিথ্যা নয়। রোমান্স-বিরোধী যে বাস্তব, তাহাতে যাহা কিছু ‘হয়’, তাহার শেষ সেইখানেই; সেই ‘হওয়া’র কোন পরোক্ষ পরিণতি নাই, তাই সেইরূপ রচনায় কোন কাহিনী বা সুসঙ্গত প্লট থাকে না। কিন্তু উৎকৃষ্ট কবিকল্পনা সকল ‘হওয়া’কেই একটি সম্পূর্ণ ‘হওয়া’র রূপে প্রত্যক্ষ করিতে পারে—‘হওয়া’র এই সম্পূর্ণতাই রোমান্স, ইহাতে বাস্তবই পূর্ণ আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়। যে সকল রচনায় বাস্তবই নাই, অসংলগ্ন স্বপ্নখন্ডকে—রূপে নয়, ভাবে অপরূপ করিয়া তোলা হয়—তাহাকে আমি রোমান্স বলিতেছি না, তাহাকে সাহিত্যিক সৃষ্টি বলিব না; তাহাও আর্টের অন্তর্গত। আবার যেখানে হওয়া উচিত’কেই জবরদস্তি করিয়া ‘হয়’-এর উপরে চাপানো হয়, অর্থাৎ ‘হওয়া’কে তাহার আপন নিয়মেই সম্পূর্ণ ‘হইতে’ দেখার দৃষ্টি নাই—ধৰ্ম্মনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতির আদর্শে জীবনকে কাটিয়া ছাঁটিয়া একটা ছাঁচে ঢালিয়া দেখানো হয়, সেখানেও রোমান্সের চিত্ত চমৎকার নাই, একটা সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তির তৃপ্তিসাধন বা সংস্কারবদ্ধ চিত্তের উল্লাসই আছে

কিন্তু এই প্রসঙ্গে ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, জীবন যাহার বিষয়, সেই সাহিত্য আর্টের মত নীতিহীন হইতে পারে না—যদি তাহা হইত, তবে সাহিত্যে জীবনের রূপসমগ্রতা প্রকাশ পাইত না; কারণ, কোন একটি বৃত্তে সংহত ও মন্ডলায়িত না হইলে রূপের রূপত্ব থাকে না—সেই রূপকে ধারণ করিবার কিছুই থাকে না, তাহার কোন significance বা অর্থই থাকে না। এই গভীরতর নীতি কেমন করিয়া প্রকাশ পায়, তাহাই বলিব। প্রথমত, জীবনের আলেখ্য-রচনায়, সর্বসংস্কারমুক্ত একটা মানবাত্মার কল্পনাই মিথ্যা; কারণ, তাহা আর দেহদশাধীন থাকিবে না বলিয়াই তাহা অবাস্তব। সমাজনীতি বা ধৰ্ম্মনীতির সংস্কার কোন-না—কোনরূপে মানুষের চেতনায় বদ্ধমূল থাকিবেই, কারণ, মূলে উহা প্রকৃতিগত। উহা হইতে মুক্ত হইতে পারিলে জীবনের যে অংশ বাকি থাকে তাহা কবিচিত্তের ধ্যানযোগ্যই নহে—রূপসৃষ্টির উপকরণই শূন্য হইয়া যায়। এই সকল নীতির তাড়নায় এবং তাহাদের সংঘর্ষে, জীবনের গভীরতর নীতি—সৃষ্টির নিয়তি-নিয়মের গূঢ় রহস্য-মানুষের কাহিনীতেই ধরা পড়ে; এবং তাহারই আলোকে কবির সৃষ্টি সমগ্রতার অর্থে অর্থবান হইয়া উঠে। অতএব সমাজনীতি বা ধর্ম্মনীতির আদর্শে যেমন জীবনের সত্যকার রূপসৃষ্টি করা সম্ভব নয়, তেমনই, ঐরূপ সংস্কার-বন্ধনকে একেবারে অস্বীকার করিলে বাস্তব দেহ-মনকেই অস্বীকার করিতে হয়; এবং এই দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়াই যে দ্বন্দ্বাতীত পরমবস্তুর উপলব্ধি হয়, জীবনের সেই রহস্যময় নিয়তির রসরূপকে আর প্রত্যক্ষ করা যায় না। এইজন্য আর্ট যে অর্থে নীতিহীন, সাহিত্য সে অর্থে নীতিহীন নয়। বস্তুতান্ত্রিক সাহিত্যে আর এক নীতির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তাহা নীতিহীনতার নীতি-নীতির পরিবর্তে দুর্নীতিরই একটা প্রবল সংস্কার। বাস্তবতা বা সম্ভাব্যতার দিক দিয়া ইহাই নাকি আরও সত্য। কিন্তু যাহার বিরুদ্ধে এই দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সেই নীতিই ইহার তুলনায় আরও সত্য, আরও বাস্তব। এই দুর্নীতিও মনেরই একটা সংস্কার, এবং ইহা বিকৃত ও অস্বাভাবিক বলিয়া জীবনকে শুধুই ক্ষুদ্র ও অসম্পূর্ণ করিয়া দেখে না, কুৎসিৎ করিয়া দেখে। সম্ভাব্যতা বা probability-র যে অজুহাত ইহারা দেয়, সত্যকার কবিদৃষ্টির পক্ষে সে প্রশ্ন গুরুতর নয়; কারণ কবিচিত্তে এইরূপ কোন সংস্কার না থাকায়, তাহা জীবনের নিম্নতম ও উর্দ্ধতম সীমায় অবাধে যাতায়াত করিতে পারে, এবং সেই পূর্ণদৃষ্টিতে সম্ভব-অসম্ভব-বোধের বাধা আর থাকে না। যাহা এমন করিয়া দেখিতে পাইতেছি, তাহার সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকিবে কেন? সেই দৃষ্টি ইহাদের নাই বলিয়া ইহারা কিছুই সৃষ্টি করিতে পারে না, ইহাদের রচনাও সাহিত্য নয়।

আর একটি কথা বলিয়া আমি কবি-প্রেরণার পরিচয় শেষ করিব। আমরা সাহিত্যে ট্র্যাজেডি-রচনার কথা জানি, এই ট্র্যাজেডিতে জীবনকে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে দেখা হয়—তাহাতে একটা নিদারুণ নিষ্ফলতার চিত্র ফুটিয়া উঠে। কিন্তু ইহাও সত্য যে, কোন উৎকৃষ্ট কাব্যে জীবনকে একটা অভিশাপ রূপে প্রকটিত করা সম্ভব নয়—বৈরাগ্য বিরক্তি বা বিদ্বেষ কবিচিত্তের প্রেরণা হইতে পারে না, জীবনকে সৰ্ব্বাংশে গ্রহণ করাই কবি-কল্পনার সুস্থ প্রবৃত্তি। কোথাও বা, পরম জ্ঞানের যে পরম অনুভূতি, তাহারই এক স্নিগ্ধ করুণ হাস্যজ্যোতি জীবনের উপরে বিকীর্ণ হইতে দেখা যায়; এই humour বা উৎকৃষ্ট হাস্যরস কবিচিত্তের স্বাস্থ্য ও সুস্থিরতার প্রমাণ। কোথাও বা, বাহ্যত কবিচিত্তের এই স্থৈর্য্যলক্ষণ নাই—জীবনে অতল অকূলকে মন্থন করিয়া তাহার তলদেশের চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করা—অথবা সেই ঘূর্ণমান প্রবাহের মধ্যবিন্দুকে ঘূর্ণাসমেত লক্ষ্য করার বাসনাই প্রবল বলিয়া বোধ হয়; কখন কাব্যে জীবনের অপর রস-রূপ-ট্রাজেডির উদ্ভব হয়। কিন্তু উভয়ত্র সেই একই সমান, সুস্থ normal কবিচিত্তের ক্রিয়াই আছে। সাহিত্যে আর এক প্রকার ট্র্যাজেডিও আমরা দেখিয়াছি, তাহাতে জীবনের রস রূপের পরিবর্তে, মৃত্যুর অন্ধকারই ঘনাইয়া উঠে, আমাদের জীবাত্মার আর্ত্ত ক্রন্দনে আর সকল সুর ডুবিয়া যায়—নরনারীর অতিশয় একক পৃথক ব্যক্তিচেতনা অতিমাত্রায় উদ্বুদ্ধ হইয়াই যেন মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়ে। ইহা উৎকৃষ্ট সাহিত্যের ট্র্যাজেডি নয়। এখানে ব্যক্তির ব্যক্তি—স্বতন্ত্র অনুভূতিই জীবনের বাস্তবকে আশ্রয় করিয়াছে—অনুভূতির প্রখরতা আছে, কল্পনার প্রসার নাই; ভাবাতিরেকের বিদ্রোহ আছে, প্রেমের প্রশান্তি নাই। ইহাতে সর্বমানবহৃদয়ের প্রতিনিধিত্ব নাই বলিয়া, বরং ব্যক্তির idiosyncrasy-ই অতিমাত্রায় প্রকট বলিয়া, কাব্য সর্ব্বকালীন ও সার্ব্বজনীন চেতনার অনুমোদন লাভ করিবে না। Sentiment বা ভাবাতিরেক যতই বাস্তবানুগ, এবং কল্পনা যতই সংযত হউক, এ ক্ষেত্রে লেখকের দৃষ্টি একদেশদর্শী বলিয়া জীবনের সমগ্র রূপ তাঁহার আয়ত্ত নহে। মানবজীবনের উৎকৃষ্ট ট্র্যাজেডি রচনা করিয়াছিলেন যে কবি, সেই শেপীয়ার সম্বন্ধে এক মনীষী লেখকের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে বড়ই সত্য—”He was the the most living and least sentimental of authors”.

অতএব জগতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, যাহা আবহমানকাল মানুষের অন্তর তৃপ্ত করিয়াছে—তাহার দিকে চাহিলে সাহিত্যের এই স্বরূপ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিবে না।, হোমার, বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস, শেকসপীয়ার হইতে আমাদের বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, বড় বড় কবির সাহিত্যসৃষ্টিতে এই লক্ষণ যেখানে যতখানি প্ৰকাশ পাইয়াছে, তাহার দ্বারাই ইঁহাদের শ্রেষ্ঠত্ব কার কতখানি, তাহা নিরূপণ করা যাইবে। যাহা শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, তাহাতে মানুষ শুধুই মনোবিলাসের আনন্দ পায় নাই, মানুষের চিত্ত গভীরভাবে আশ্বস্ত হইয়াছে। সেই আশ্বাস উদ্রেকের পন্থা বিভিন্ন হইতে পারে; কিন্তু এইরূপে সাহিত্যে জগৎ ও জীবন এমন সার্ব্বজনীন অভিজ্ঞতার উপকরণে রূপময় হইয়া উঠিয়াছে যে, সৃষ্টির রহস্যভার—বাস্তবের সকল সংশয়—বাস্তবের মধ্যেই সমাহিত হইয়া একটি অপরূপ অর্থের ব্যঞ্জনায় মানুষকে আশ্বস্ত করিয়াছে। এই আশ্বাস ও আনন্দের কারণ, মানুষ এই সাহিত্যের মধ্যে আপনাকেই সমস্ত মানবের সহিত একাত্মভাবে দেখিবার শক্তি লাভ করিয়াছে। দ্বিতীয়ত, এই সকল কাব্যসৃষ্টিতে জীবনের রূপ এমন একটি সমগ্রতায় ফুটিয়া ওঠে, যাহা বুদ্ধির আয়ত্ত নয়, কেবল অনুভবযোগ্য। বুদ্ধির হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া মানুষের গভীরতর চেতনায়, জীবনের এই রূপদর্শনে যে সংশয়মুক্তি ঘটে, তাহাতেই প্রাণ পরিতৃপ্ত হয়, তাই অতিশয় মর্মান্তিক কাহিনীও মধুর হইয়া উঠে; আবার, সত্য ও ন্যায়ের যে আধ্যাত্মিক সংস্কার মানুষের জন্মগত—কিন্তু যাহা জীবনের বাস্তব খন্ড অভিজ্ঞতায় বার বার পীড়িত হয়, তাহা এই সাহিত্যের মধ্যেই চরিতার্থ হইয়া থাকে। এই আশ্বাস যেখানে নাই, দেহ-আত্মার দ্বন্দ্ব যেখানে মিটে নাই, সেখানে কবিকল্পনাই অসম্পূর্ণ—কেবলমাত্র আর্টের দোহাই দিয়া সে রচনা উৎকৃষ্ট হইতে পারে না। সৃষ্টিরও যেমন শেষ নাই, তেমনই কবিচিত্ত ও মানবহৃদয় তাহার সমকালব্যাপী,—এই তিনকে অবলম্বন করিয়াই সাহিত্য। যুগবিশেষের ভাবধারায়, ব্যক্তিত্বের অভিমানে, বা সঙ্কীর্ণ রসিকমন্ডলীর রুচি ও রসবোধের আদর্শে, সাহিত্য সীমাবদ্ধ নয়। অতএব সাহিত্যের প্রকৃত বিচার সর্ব্বকালের সর্ব্বমানবের চিত্তে হইয়া থাকে; সেই বিচারের উপর বুদ্ধিপ্রয়োগ করাই পন্ডিতের কাজ, এবং পন্ডিতের সিদ্ধান্ত যে পরিমাণে সেই বিচারের অনুসরণ করিতে পারে, সেই পরিমাণেই তাহা যথার্থ নতুবা তাহার কোন মূল্য নাই। এখানে কোন মতবাদ, কোন ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত অভিমানের স্থান নাই। কবিচিত্ত যেমন সৰ্ব্বমানবচিত্তের প্রতিনিধি, সাহিত্য-বিচারেও তেমনই সৰ্ব্বমানবচিত্তের প্রতিনিধিত্ব চাই। এজন্য কাল ও নিরন্তর প্রবাহিত মানবচিত্তই সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বিচারালয় হইয়া আছে। এ দিক দিয়া দেখিলে সাহিত্যের এইরূপ পান্ডিত্যপূর্ণ বিচার নিরর্থক বলিয়া মনে হইবে, কারণ, এই সজ্ঞান ধারণার পূর্ব্বেই পাঠকের চিত্তে সে বিচার শেষ হইয়া যায়, জ্ঞানবিচারের পরোক্ষ প্রমাণের জন্য হৃদয়ের অপরোক্ষ অনুভূতি অপেক্ষা করিয়া থাকে না। “আগে দর্শনধারী, তারপর গুণ বিচারি” বাক্য সাহিত্যের পক্ষেও অধিকতর সত্য। দর্শনে, অর্থাৎ সাক্ষাৎ-সংবেদনায়, যাহা মুগ্ধ করে না, তাহার গুণবিচার অনাবশ্যক। এজন্য সাহিত্যের সমালোচনা অনেক স্থলেই “অরসিকেসু রসস্য নিবেদনং”, অথবা অরসিকেরই রসোদগার। তথাপি কাব্যজিজ্ঞাসা ক্রমেই একটা বড় জিজ্ঞাসা হইয়া উঠিয়াছে—কবিকর্ম্মের বৈচিত্র্য ও কবিপ্রেরণার পরিধি যত বাড়িয়াছে, ততই এক দিকে যেমন রুচিভেদ, অপর দিকে তেমনই আদর্শ-নিৰ্ণয় অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠিয়াছে। পরিশেষে সাহিত্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রবল প্রাদুর্ভাবে, এমনই অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছে যে, কাব্যের আদি প্রবৃত্তি ও আদর্শকে সকল অসাহিত্যিক মতবাদ হইতে মুক্ত করিবার জন্য এ কালে সৃষ্টি অপেক্ষা সমালোচনার প্রয়োজন বাড়িয়াছে। কিন্তু এ জিজ্ঞাসার শেষ নাই, যেটুকু নির্দেশ—যোগ্য তাহারই বিচারণা আছে—মীমাংসার সঙ্কেত আছে, সিদ্ধান্ত নাই; তাহা যদি সম্ভব হইত, তাহা হইলে আমি সাহিত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা মিথ্যা হইত। এতকাল ধরিয়া ইহার যে চেষ্টা হইয়াছে এবং তাহাতে যে কয়টি পদ্ধতির উদ্ভব হইয়াছে, আমি এক্ষণে তাহারই সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু বলিয়া এ প্রসঙ্গ শেষ করিব।

সাহিত্যবিচারের জন্য বহুপূর্ব্বে যে শাস্ত্র গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে আমাদের দেশে ও য়ুরোপে, উভয়ত্র—কতকগুলি সূত্র বা বিধির সৃষ্টি হইয়াছিল, এবং সকলের মধ্য দিয়াই একটি তত্ত্ব ক্রমশ পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল। প্রাচীন যুগে, য়ুরোপীয় ও ভারতীয় উভয় কাব্যশাস্ত্রে, কবিকৰ্ম্ম-সম্বন্ধে যে ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, কাব্যের সহিত প্রাকৃত সৃষ্টির—কবিকল্পনার সহিত জীবনের—যেটুকু যোগ স্বীকৃত বা অস্বীকৃত হইয়াছিল, তাহা হইতে আধুনিক কালের ধারণা অনেক পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, কবির রচনা বাস্তবের প্রতিলিপি বা অনুকৃতি হিসাবেই একটি আর্ট, এবং সেই আর্টের সাফল্য নির্ভর করে কতকগুলি সুপরীক্ষিত রচনাপদ্ধতির উপরে—ইহাই যেন অবশেষে য়ুরোপীয় কাব্য-বিচারের প্রধান সূত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, তেমনই আমাদের দেশে কাব্যসাধনাকে জীবনের বা জগতের বাস্তব হইতে অনেক পরিমাণে মুক্তি দিলেও, রচনার বহিরঙ্গ-বিষয়ে আরও সূক্ষ্ম কলাকৌশলবিধির সৃষ্টি হইয়াছিল শব্দার্থের প্রকৃতি ও সম্বন্ধ লইয়া দর্শন ও ব্যাকরণের মীমাংসা; শব্দযোজনা-রীতির দোষগুণ, সুন্দর বচনভঙ্গিমা, বা নানা শব্দালঙ্কারসৃষ্টির নিগূঢ় কৌশল—কাব্যের আত্মা, দেহ, অলঙ্কার প্রভৃতির সূক্ষ্ম ভেদনির্দ্দেশ—এ সকলই কাব্য-বিচারের অঙ্গীভূত হইয়াছিল। ইহার ফলে আমাদের কাব্যশাস্ত্রে কল্পনা বা কবিদৃষ্টি এবং তাহারই বিষয়ীভূত যে জগৎ ও জীবন, তাহা গৌণ হইয়া উঠিল; এবং শেষে কাব্য জীবনেরই রূপসৃষ্টি না হইয়া রসাত্মক বাক্য বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছিল। এই শাস্ত্র অনুসারে সাহিত্য কোন অর্থে জীবনের ব্যাখ্যা বা অনুবাদ নয়—জীবনেরই গভীরতর রূপের প্রতিচ্ছায়া নয়। কাব্যকে বাস্তব জীবনানুভূতির ক্ষেত্র হইতে দূরে সরাইয়া, কতকগুলি conventions বা কৃত্রিম বিধি-বিধানের সংস্কার অনুসারে তাহার রচনা ও সম্ভোগ—একরূপ চিত্তচমৎকারের মানস-উদ্যান সৃষ্টিই হইল কাব্যের আদর্শ। ইহাও সাহিত্যের আর্টবাদ; তাই সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র আর একদিক দিয়া যে গভীর তত্ত্বে উপনীত হইয়াছিল, তাহা সাহিত্য-বিচারের অনুকূল নয়—তাহা নির্বিশেষ রসতত্ত্ব, বা Aesthetics-এরই সগোত্র। এই রসতত্ত্ব যে সময় হইতে সাহিত্যের বিচারাসন অধিকার করিয়াছে, তখন হইতে সাহিত্যেরও অবনতি ঘটিয়াছে; সাহিত্যকে জীবন হইতে কৃত্রিম রসবিলাসের ক্ষেত্রে তুলিয়া ধরায় তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়াছে; কবিচিত্তের তেমন স্ফূর্ত্তি আর নাই। সাহিত্যকে এক অতি অসাহিত্যিক শাসনের অধীন করিয়া তাহার আদর্শ বিচার করিবার চেষ্টা, আমাদের দেশে, এখনও বিংশ শতাব্দীতে বন্ধ হয় নাই; এখনও, যাহারা পন্ডিতমাত্র, অর্থাৎ পুঁথিগত বিদ্যাই যাহাদের একমাত্র সম্বল—যাহাদের কোন প্রতিভাই নাই, তাহারাই শাস্ত্রের চর্বিতচর্ব্বণকে পুনরপি চর্ব্বণ করিয়া, সাহিত্য-বিচারের নামে নিজেদের পান্ডিত্য—অভিমান চরিতার্থ করিতেছে।

কিন্তু আমাদের দেশে সাহিত্য-বিচারের ধারা একই খাতে বহিয়া শেষে রুদ্ধ হইয়া গেলেও, য়ুরোপের জীবন্ত সমাজে তাহা নব নব সৃষ্টির অনুসরণ করিয়া নানা স্রোতে প্রবাহিত হইয়াছে। সেখানে প্রথম হইতেই জীবনের সহিত—বহিঃপ্রকৃতি ও প্রত্যক্ষ বাস্তবের সহিত—সাহিত্যের যোগ স্থাপিত হইয়াছিল; সাহিত্যের সৃষ্টিতেও যেমন, সমালোচনাতেও তেমনই, সাহিত্যের আর্ট রসতত্ত্বের এমন শূন্যবাদে পৌঁছিতে পারে নাই। তারপর, একদা যখন সেই সমাজে জীবন ও জগতের রহস্য আরও বড় হইয়া দেখা দিল, এবং সাহিত্যে সেই রহস্য-বিকাশের অন্ত রহিল না, তখন কিছুকাল সাহিত্য-বিচারের চেষ্টাও স্থগিত ছিল, কোন নব্য পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা হয় নাই। তাহার কারণ বোধ হয় এই যে, সাহিত্য যখন কোন জাতির জীবনে জীবন্ত হইয়া উঠে, তখন পন্ডিতী বিচারের অবকাশ থাকে না; আমি পূৰ্ব্বে বলিয়াছি, সাহিত্যের প্রথম ও প্রকৃত বিচার মানুষের চিত্তেই হইয়া থাকে—কেতাবে পুঁথিতে নয়। মধ্যে আবার এই সৃষ্টি-প্রেরণা মন্দীভূত হইয়া শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ ও যুক্তিবাদের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইহারই প্রতিক্রিয়ার ফলে, কবিকল্পনার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের জয়ঘোষণা হইল, এবং কবির দৃষ্টি অর্ন্তমুখী হইয়া জীবনকে এক নূতন মহিমায় মন্ডিত করিল। এই-কালেই কবিমানসের এই নূতন প্রবৃত্তি যে সকল প্রশ্নের সৃষ্টি করিল, তাহা হইতে নূতন করিয়া কবিপ্রতিভা ও বহিঃসৃষ্টি, অর্থাৎ প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব—ভাবুকের ভাবনা অধিকার করিল; এ বিষয়ে কবিদের সাক্ষ্যও অল্প সহায়তা করিল না। কিন্তু এই সকল আলোচনায় কবিপ্রতিভার মাহাত্ম্য ও কাব্যসৃষ্টির রহস্যই সুগভীর হইয়া উঠিল, এবং কাব্যবিচার—মনস্তত্ত্ব ও অধ্যাত্মদর্শনের সীমান্তবর্ত্তী হইয়া উঠিল। অতঃপর এই শতাব্দীর শেষভাগে সৃষ্টির নিয়তিনিয়মের বাস্তব অভিজ্ঞতা হইতেই এক নূতন দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব হইল, এবং মানব—চেতনার সর্ব্ববিধ ক্রিয়াকে একই তত্ত্বের অধীন করিয়া Aesthetics বা রসতত্ত্বের নূতন ভিত্তি-স্থাপনা হইল। শোপেনহাওয়ার হইতেই এই নূতন রসতত্ত্বের সূচনা হয়, বেনেদেত্তো ক্রোচের মনীষায় ইহা স্ফুটতর ও পূর্ণাঙ্গ হইয়া উঠে। সাহিত্যসৃষ্টির সম্বন্ধেও এই নূতন দার্শনিক চিন্তা এমন এক বিচারপদ্ধতির সন্ধান দিয়াছে—রূপ ও ভাবের এমন অভিন্নতা নির্দ্দেশ করিয়াছে যে, সাহিত্যের আর্টবাদই সৃষ্টিবাদ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই সৃষ্টি ভাগবতী সৃষ্টির মতই বিশেষের সৃষ্টি, প্রত্যেক রচনাই আপন বিশিষ্ট রূপে উজ্জ্বল। কবির অনুভূতি একটা প্রত্যক্ষ প্রকাশ বলিয়াই রূপাত্মক; এবং সকল রূপই বিশেষের রূপ, রূপ কখনও নির্ব্বিশেষ হইতে পারে না, কবির নিজ চিত্তের প্রকৃতি অনুসারে এই বিশেষের বিশেষত্ব ঘটে; তাহাতে কাব্যসৃষ্টির তারতম্য হয় না, কারণ সকলই রূপ, কাব্যে সেই রূপের যথাযথ প্রকাশই নিখুঁত সৃষ্টি। ইহাই সাহিত্য-বিচারের আধুনিক ষ্টাইল-তত্ত্ব। ইহার অনুসরণ সাহিত্যের এই সৃষ্টিধর্ম্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে—এক দিকে যেমন ভাব ও রূপের অভেদ প্রতিষ্ঠা হইয়াছে এবং তাহাতে কবিদৃষ্টির সহিত সাক্ষাৎ জগৎ-চেতনাকে যুক্ত করা হইয়াছে, তেমনই, কবিকল্পনাকে স্বাতন্ত্র্যগৌরবও দেওয়া হইয়াছে। ইহাতে প্রাচীন কাব্যশাস্ত্রের কৃত্রিম বিধিবন্ধন যেমন পরিত্যক্ত হইয়াছে, তেমনই আধুনিক বিজ্ঞানের শ্রেণীবিভাগ-প্রণালীও বৰ্জ্জিত হইয়াছে। কারণ, প্রত্যেক কবিকৰ্ম্মই স্বতন্ত্র বা অনন্যসদৃশ; এজন্য তুলনা দ্বারা, সাধারণ লক্ষণ ধরিয়া খাঁটি সাহিত্যিক সৃষ্টির শ্রেণীবিভাগ চলে না। রচনাবিশেষের প্রেরণা সত্য ও সম্পূর্ণ কি না— রচনাগত রূপের মধ্যে তাহার প্রমাণ আছে; যদি রচনার সর্ব্ব অঙ্গে একটা বিশিষ্ট রূপ—সামঞ্জস্য থাকে, তাহা হইলেই সে রচনার প্রেরণা মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ নয়, রচনা সার্থক হইয়াছে। সাহিত্যসৃষ্টির এই ষ্টাইল-তত্ত্বও সাহিত্যের আর্টকে স্বীকার করে কিন্তু good art-3 great art-এর প্রভেদও স্বীকার করে; যাহা great art-এর পৰ্য্যায়ভুক্ত, সেই সাহিত্যে ষ্টাইলের রহস্য আরও গভীর; কারণ, তাহাতে জীবনের বিরাট ও বিচিত্র রূপ প্রতিফলিত হইয়া থাকে; তাহাতে কেবল অনবদ্য প্রকাশ কৌশল নয়—যাহা প্রকাশিত হইতেছে, তাহারও বিশিষ্ট গৌরব চাই। আমিও সাহিত্যকে সাধারণ অর্থে আর্ট বলিতে কেন কুণ্ঠিত, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি; কোন একটা বিশেষের রূপ-সামঞ্জস্য হইলেই উৎকৃষ্ট সাহিত্যসৃষ্টি হইবে না, জীবনের একটা সমগ্র রূপের ছায়া—অঙ্গবিশেষের নয়, সমগ্র দেহের কান্তির মত তাহাতে ফুটিয়া উঠা চাই; নতুবা তাহা আর্ট মাত্র, উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি নয়। এই সৃষ্টিতত্ত্বকে আমি যে কায়া কান্তিবাদ নাম দিয়াছি, তাহারও এই অর্থ করিতে হইবে।

সৰ্ব্বশেষে সাহিত্য-বিচারের আর এক পদ্ধতির কথা বলিব। এই পদ্ধতি অনুসারে সাহিত্যকে রচনার দিক হইতে বিচার করা হয় না; অর্থাৎ রূপসৃষ্টি হিসাবে তাহা কতখানি সার্থক হইয়াছে—নিখিল কাব্যকলার আদর্শ তাহাতে কতখানি পরিপুষ্ট হইয়াছে, এবং জগৎ ও জীবনের কতখানি সুবলয়িত ও সৰ্ব্বজন-হৃদয়গ্রাহী রূপে চিত্রিত হইয়াছে—সে বিচার করা হয় না; লেখকের দিক হইতে, তাঁহারই ব্যক্তিমানসের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করিয়া, রচনাবলীর মর্ম্ম উদঘাটন করা হয়। ইহাও সাহিত্যের সাহিত্যিক বিচার নয়, কারণ ইহাতে সাহিত্যসৃষ্টি অপেক্ষা কবিমানসকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়,—কাব্যবিচারে জগৎ ও জীবনের রূপ বড় না হইয়া কবির মনোজগৎই বড় হইয়া উঠে। পূর্ব্বে যে ষ্টাইল-তত্ত্বের কথা বলিয়াছি, ইহা তাহারই আতিশয্যঘটিত পরিণাম। একালে এইরূপ পদ্ধতির প্রাদুর্ভাব হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এক্ষণে কবিকল্পনা অতিশয় অন্তর্মুখী ও আত্মনিষ্ঠ হইয়াছে, এজন্য কবিচিত্ত এখন আর সর্ব্বমানব-চিত্তের প্রতিনিধি নহে; অতএব সাৰ্ব্বজনীন জীবনানুভূতিই এখন আর কাব্যের আদর্শ নহে। এই ভাবতান্ত্রিক সাহিত্যের কথা পূর্ব্বেও সবিস্তারে বলিয়াছি।

সাহিত্য-বিচারের কয়েকটি পদ্ধতির কথা বলিলাম। তথাপি বার বার ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, সাহিত্যের প্রকৃত বিচার এইরূপ কোন পদ্ধতিতেই চূড়ান্ত হইতে পারে না। যুগ পার হইয়া যুগান্তরে যে সাহিত্য বাঁচিয়া থাকে, অর্থাৎ যাহা কালের ও চিরন্তন মানবচিত্তের কষ্টিপাথরে যাচাই হইয়া উজ্জ্বল হইয়া উঠে, সকল পদ্ধতি তাহার সাক্ষ্য মান্য করিয়াই আপনার মান রক্ষা করিতে পারে। এই কষ্টিপাথরে কষিত হইয়া কত এককালের উৎকৃষ্ট রচনা দীপ্তি হারাইয়াছে; এবং এত পদ্ধতি সত্ত্বেও একালের পণ্ডিতেরা কোনও আধুনিক শ্রেষ্ঠ কাব্যের অমরতা সম্বন্ধে সুনিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করিতে সক্ষম নহেন। কিন্তু তথাপি সাহিত্যের বিচার কোন কালে বন্ধ হইয়া থাকে না—বিচার চলিতেছে, কষ্টিপাথরে দাগ পড়িতেছে, সেই দাগই স্পষ্ট হইয়া উঠিবে কালান্তরে। আস্তিক্য-বুদ্ধি, জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা, মানব-প্রীতি—ও সেই সঙ্গে ভাষার পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে একটি সহজাত সংস্কার, যে ব্যক্তি বা জাতি বা সমাজের মধ্যে দেখা দেয়, সেখানেই যেমন সাহিত্যসৃষ্টির সম্ভাবনা ঘটে, তেমনই সেই সৃষ্টির স্বাদ বুঝিবার মত লোকেরও অভাব হয় না। বিচার করিবার পূর্ব্বেই সাহিত্য বুঝিতে পারা চাই; যেখানে বিচার আগে-পরে সাহিত্যের রসাস্বাদন, সেখানে বিচারই নিষ্প্রয়োজন, অথবা তাহা সম্ভব নহে। এইজন্য আমি এইরূপ বিচারপদ্ধতিকে আমার এই আলোচনায় সৰ্ব্বাগ্রে স্থান দিই নাই। আমি, মুখ্যত, সাহিত্যের আদর্শ ও তাহার মূল প্রবৃত্তির কথাই বলিয়াছি; তাহাতে এইটুকুমাত্র ফললাভের আশা করি যে, আজিকার এই আদর্শবিপর্যয়ের দিনে যাঁহাদের সহজ সাহিত্যবোধ আছে, তাঁহাদেরও দৃষ্টি যেন আচ্ছন্ন না হয়।

এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলিবার আছে। আমি সাহিত্যের যে খাঁটি আদর্শ উদ্ধৃত করিয়াছি, সেই আদর্শের উৎকৃষ্ট সাহিত্য এক একটা যুগেও অতি অল্পই সৃষ্টি হইয়া থাকে—শতাব্দীকালেও একাধিক মহাকবির উদয় হয় না। ইহা ভাবিয়া দেখিলে আমাদের সাহিত্যের এই বর্ত্তমান অজস্রতার মূল্য কি, তাহা অনুমান করা দুরূহ হইবে না। সাহিত্যের নামে অক্ষমতার এই উন্মাদ-সুলভ অনাসৃষ্টি জাতির দুর্ব্বলতাই স্মরণ করাইয়া দেয়। আমি প্রকৃত সাহিত্যসৃষ্টির যে লক্ষণ ও কবিচিত্তের যে পরিচয় বিস্তারিতভাবে নির্দ্দেশ করিয়াছি, ততদূর চিন্তা না করিয়া অতি সহজেই এই সকল রচনার ব্যর্থতা প্রমাণ করা যায়। প্রথমত, এইজাতীয় সাহিত্যে জীবনের যে চিত্র ফুটিয়া উঠে, তাহা বাস্তবেও নয়, আদর্শও নয়; তাহার বিরূপতাই সকল সুস্থ চিত্তকে আঘাত করে। এ যেন চিরপরিচিত বস্তুকে আরও পরিচিত না করিয়া অপরিচিত করিয়া তোলা!—একের দুঃস্বপ্ন অপরের মস্তিষ্ক পীড়িত করিয়া তোলে। এই অতিশয় মিথ্যাকেও স্বীকার করিয়া লওয়াইবার জন্য, বিকৃত দৃষ্টিকে প্রতিভার লক্ষণ এবং বিসদৃশকে অনন্যসাধারণ বলিয়া দাবি করা হয়। আসলে, ইহা normal বা সুস্থ নয়, অতএব প্রতিভার প্রধান লক্ষণ ইহাতে নাই। আরও প্রমাণ—এই সকল রচনার ষ্টাইল নাই। অতএব রচনাহিসাবেই এগুলি বিকলাঙ্গ ও অসম্পূর্ণ; ভাষাও যেমন অপরিচ্ছন্ন, ভাব তেমনই অপরিপুষ্ট—কল্পনার কোন কেন্দ্রগত ঐক্য নাই। ইংরেজীতে যাহাকে authentic বলে, ইহাদের অনুভূতি সেইরূপ authentic বা সমূলক নয়। বেশ বুঝিতে পারা যায়, যাহা বর্ণিত হইতেছে, তাহাতে প্রচুর ভান বা ফাঁকি আছে, প্রত্যক্ষ-দর্শনের উপলব্ধি তাহাতে নাই; এজন্য ভাষার সকল প্রসাধনই কৃত্রিম। এই কৃত্রিমতার জন্যই এই সকল রচনার কোন ষ্টাইল নাই। যাহা দেখি নাই, অর্থাৎ যাহার সম্পূর্ণ প্রকাশ অন্তরে হয় নাই, বাহিরেও তাহার প্রকাশ অসম্পূর্ণ হইবেই। দৃষ্টি না হইলে সৃষ্টি হইতে পারে না; আবার সৃষ্টি যে হয় নাই, তাহার প্রমাণ এই ষ্টাইলের অভাব। এজন্য, পূর্ব্বে যে-ষ্টাইল-তত্ত্বের কথা বলিয়াছি, তাহাকে দৃষ্টি-সৃষ্টিবাদ-বলা যাইতে পারে, এবং সাহিত্য-বিচারে এই তত্ত্বের বিশেষ উপযোগিতাও স্বীকার করিতে হয়। এই দৃষ্টিই কবিদৃষ্টি, এই শক্তিই প্রতিভা; যেখানে সেই দৃষ্টি ঘটিয়াছে, সেইখানেই রচনায় সৃষ্টির সকল লক্ষণ প্রকাশ পাইবে।

কিন্তু সবচেয়ে লক্ষ্য করিবার বস্তু—এই সকল রচনার দূষিত ভাষা; অথচ ভাষাই রচনার সৰ্ব্বস্ব। যিনি সাহিত্যসৃষ্টি করেন, তাঁহার সবচেয়ে বড় সাধনা বা তপস্যা ভাষাকে লইয়া; সাহিত্য যদি একটা আর্ট হয়, তবে শুধু এই অর্থেই। তাই ভাষার বিষয়ে সাহিত্যশিল্পীর যত্ন ও ভাবনার অন্ত নাই। কিন্তু আধুনিক লেখকগণের ভাষা সম্বন্ধেই ভাবনা সব চেয়ে কম; তাহার কারণ, যে-দৃষ্টির বলে সৃষ্টির প্রেরণা জাগে, সে দৃষ্টি ইহাদের নাই, এবং সেইজন্য কোন কিছুকে সম্পূর্ণ রূপ দিবার প্রয়োজনই হয় না; যদি সে প্রয়োজন হইত, তাহা হইলে ভাষার দুয়ারে সাধ্য-সাধনা করিতেই হইত। অতএব, সাধারণ পাঠকের পক্ষে সাহিত্য-বিচারের সর্ব্বাপেক্ষা সহজ উপায়—রচনার ভাষাটিকে মাত্র পরীক্ষা করা, এবং সে বিষয়ে ইহাই মনে রাখা যে, mannerism বা কৃত্রিম ভঙ্গিমা—অথবা ব্যাকরণ, অভিধান ও ইডিয়মের বিরুদ্ধাচরণ—ইচ্ছাকৃত হইলেও, স্বতন্ত্র ষ্টাইলের লক্ষণ নয়; তাহা লেখকেরই অক্ষমতা ও অযোগ্যতার নিঃসংশয় প্রমাণ। মনে রাখিতে হইবে যে, যে-রচনাকে আমরা সাহিত্যিক সৃষ্টি বলি, তাহা কোন মত, তথ্য বা তত্ত্বপ্রচারের বাহন নয়, তাহা তর্কবিতর্ক নয়—কাহিনী; তাই পরিস্ফুট, পরিচ্ছন্ন ও সুডৌল ভাষাই তাহার সর্ব্বস্ব। এই ভাষার দোষ থাকিলে বুঝিতে হইবে, লেখকের লেখক-জন্মই সত্য নহে, এবং রচনাও সাহিত্যপদবাচ্য নয়।

তথাপি, এই কালের এই কৃত্রিম রচনারাশির মধ্যে এমন রচনাও বিরল নয়, যাহাতে লেখকের শক্তির নিঃসংশয় প্রমাণ আছে। যদিও ইঁহাদের দৃষ্টি অসম্পূর্ণ, অনুভূতি সংশয়ক্লিষ্ট, ও কল্পনা সঙ্কীর্ণ, তথাপি ইহারাই সাহিত্যসাধনার ধারাটিকে এখনও রক্ষা করিতেছেন। খাঁটি সৃষ্টিশক্তির পরিচয় না দিলেও, ইঁহারা জগৎ ও জীবনের অনেক অনাবিষ্কৃত তীর্থ এবং মানব-মনের অনেক নূতন ও সূক্ষ্ম অনুভূতির সন্ধান দিয়াছেন। আমাদের দেশে এ যুগেও এমন যে দুই চারিজন লেখকের সাক্ষাৎ আমরা পাইয়াছি, তাঁহাদের রচনাতেই কবিচিত্ত ও সাহিত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে আমরা কিয়ৎ পরিমাণে আশ্বস্ত হইয়া থাকি।

সৰ্ব্বশেষে আমি দুইটি উক্তি উদ্ধৃত করিয়া আলোচনা শেষ করিব। আধুনিক সাহিত্যের আদর্শ ও মূল্য সম্বন্ধে এক বিখ্যাত ইংরেজ লেখিকার উক্তি এইরূপ—

“It seems that it would be wise for the writers of the present to renounce the hope of creating masterpieces. Their poems, plays, biographies, novels are not books but note-books, and time like a good schoolmaster, will take them in his hands, point to their blots and scrawls and erasions, and tear them across; but he will not throw them into the waste-paper basket. He will keep them because other students will find them very useful. It is from the note—books of the present that the masterpieces of the future are made.”

অপরটি আমাদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের উক্তি, তিনিও বলেন—“কিন্তু সকল মানুষের বিচারবুদ্ধি বড় নয়, সকল সমাজও বড় নয়, এবং এক একটা সময় আসে, যখন ক্ষণিক ও ক্ষুদ্র মোহে মানুষকে ছোট করিয়া দেয়, তখন সেই দুঃসময়ের বিকৃত দর্পণে ছোট বড় হইয়া দেখা দেয়, এবং তখনকার সাহিত্যে মানুষ আপনার ছোটকেই বড় করিয়া তোলে —আপনার কলঙ্কের উপরেই স্পর্দ্ধার সঙ্গে আলো ফেলে। তখন কলার বদলে কৌশল, গৌরবের জায়গায় গর্ব, এবং টেনিসনের আসনে কিপ্লিঙের আবির্ভাব হয়।

“কিন্তু মহাকাল বসিয়া আছেন। তিনি ত সমস্তই ছাঁকিয়া লইবেন। তাঁহার চালুনির মধ্য দিয়া যাহা ছোট তাহা গলিয়া ধুলায় পড়িয়া ধূলা হইয়া যায়। নানা কাল ও নানা লোকের হাতে সেই সকল জিনিসই ঢেঁকে—যাহার মধ্যে সকল মানুষই আপনাকে দেখিতে পায়। এমনি করিয়া বাছাই হইয়া যাহা থাকিয়া যায়, তাহা মানুষের সর্ব্বদেশের সর্ব্বকালের ধন।

“এমনি করিয়া ভাঙ্গিয়া গড়িয়া সাহিত্যের মধ্যে মানুষের প্রকৃতির, মানুষের প্রকাশের, একটি নিত্যকালীন আদর্শ আপনি সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে, সেই আদর্শই নূতন যুগের সাহিত্যের হাল ধরিয়া থাকে। সেই আদর্শমতই যদি আমরা সাহিত্যের বিচার করি, তবে সমগ্র মানবের বিচারবুদ্ধির সাহায্য লওয়া হয়।”

আষাঢ়, ১৩৪৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *