সাহিত্য ও সাদৃশ্য
‘সাহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’ হয়েছে। এ বিষয়ে কারুর সন্দেহ নেই। কারণ পাণিনির বিধান তর্কাতীত। তর্ক বেধেছে কার সহিত কে মিলেছে তাই নিয়ে। অনেকে বললেন, শব্দের সহিত অর্থ মিলেছে; কেউ বললেন, কবির হৃদয়ের সহিত রসিক পাঠকের হৃদয় মিলেছে। রবীন্দ্ৰনাথ বললেন, মানুষের সহিত মানুষ মিলেছে, তাই সাহিত্যের জন্যই “সাহিত্য’। রবীন্দ্ৰনাথ যে ব্যাখ্যা দিলেন তা শুধু প্রশস্ততমই নয় প্রসন্নতমও বটে। তর্কের কথা বাদ দিলেও কোথাও একটা মিল, একটা নৈকট্য স্থাপন না করলে সাহিত্য তার নামের সার্থকতা লাভ করতে পারে না, একথা বুঝতে বোধ হয় অসুবিধা নেই।
‘চাঁদপান মুখ’ কথাটি যে মানুষ প্রথম আবিষ্কার করেছিল সে বোধ হয় সাহিত্যিক ছিল না। শৈশবের বর্ণপরিচয়ে মা যখন বলতেন চাঁদমুখে ভ, হাঁটুভাঙা দ, তখন মাও সাহিত্যিক ছিলেন না। তবু এই শব্দগুলির ভিতরে সাহিত্যের একটা মৰ্মকথা লুকিয়ে রয়েছে। অলঙ্কারশাস্ত্রীরা তার মর্ম উপলব্ধি করে অনেক বিচার বিশ্লেষণও করেছেন। বেশ কিছুদিন আগে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় চাঁদপান মুখ, বাঁশীর মত নাক ও পটলচেরা চোখের এক কাটুন দেখেছিলাম। কাটুর্নকারের উদ্দেশ্য হয়ত ছিল একটু বিশুদ্ধ হাস্যরস সৃষ্টি করা। কিন্তু এর ভিতর দিয়ে অলঙ্কারশাস্ত্রের একটা গভীর তত্ত্বও হয়ত অজ্ঞাতসারেই বার হয়ে পড়েছে। মনে করুন কারুর মুখ চাদের মত থালাকার গোল, আর চাঁদের মতই সে মুখ থেকে আলো বার হচ্ছে। তাহলে কিন্তু চাঁদপানা মুখ দেখে খুন্সী হওয়া যেত না, সাহিত্যেও সে মুখের কোন ঠাই হত না। আকাশের চাঁদ ও মাটির মানুষের মুখের ভিতর যে মিলটুকু মানুষ গ্রহণ করেছে সে এক মিগ্ধোজ্জল কমনীয় কান্তি যা মানুষের সৌন্দৰ্য্যবোধকে পরিতৃপ্ত করে, প্ৰসন্ন করে। অমিলের ভিতরে এই মিলকে উপলব্ধি করা, দূরের ভিতর এই আত্নীয়তাকে আবিষ্কার করা উপমা অলঙ্কারের মূল কথা। সাহিত্যশাস্ত্রীরা বলেছেন সব অলঙ্কারের মূলে রয়েছে এই উপমা অলঙ্কার; উপমা এক নিপুণা নটিনী, কত বিচিত্ৰ বেশে, কত বিচিত্ৰ অলঙ্কারের সাজে। সে বার বার সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হয়।
এই তত্ত্বটিকেই এক বিখ্যাত আলঙ্কারিক ব্যাখ্যা করে বললেন-উপমা অলঙ্কারের ভিভরে রয়েছে এক বিচিত্র ভেদাভেদ সম্বন্ধ। এখন আবার প্রশ্ন করা হল, চাঁদের কান্তি, আর মুখের কান্তি কি এক, কোথায় এদের মিল। তখন আলঙ্কারিক আবার সুনিপুণ দার্শনিক বিশ্লেষণ সুরু করলেন; শেষ পৰ্য্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন, এই মিলটি আর ভাষা দিয়ে বোঝান যাবে না, হৃদয় দিয়ে এর চমৎকারিত্ব অনুভব করতে হবে। সাহিত্যিক বা দার্শনিক না হয়ে ও কিন্তু সহজ মানুষ সহজ ভাবেই বিভেদের ভিতর এই মিল বা নৈকট্যকে উপলব্ধি করেছিল। সাধারণ মানুষের এই আত্মীয়তার উপলব্ধিকে আরও ব্যাপকতর ও উন্নততর। পৰ্য্যায়ে উন্নীত করতে পারার ভিতরেই সাহিত্যিকের কৃতিত্ব। তখন সে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ।
মানুষ ভাষা পেয়েছিল ভাবকে প্ৰকাশ করার জন্য, গোপন করার জন্য নয়, সহজকে দুৰ্বোধ করার জন্য নয়। একই সমাজে, একই পরিবারে, এই একই সংসারে ভাষা মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলিয়ে দেয়। ভাবকে প্ৰকাশ করার অর্থই হ’ল যা ব্যক্তিগত তাকে ব্যক্তির বাইরে নিয়ে গিয়ে শেষ পৰ্য্যন্ত সমাজগত করে তোলা। মানুষের ভাষা সামাজিক সম্পত্তি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সেজন্যই ভাষা-বাহিত ভাব রাশিকে ব্যক্তির হাত থেকে সমাজের হাতে তুলে দেয়াই তার কাজ। এই ‘depersonalisation’ বা নির্ব্যক্তীকরণ অর্থাৎ সমাজীকরণ মানুষের শৈশব থেকে সুরু হয়েছে। এ না হলে মানুষই বাঁচত না, সাহিত্য সৃষ্টি করা ত দূরের কথা।
আমরা অনেকেই ছাদ পেটানো গান শুনেছি। গানের ভাবার্থের সঙ্গে কাজের মিল নেই। কিন্তু গানের তালের সঙ্গে কাজের তালের মিল রয়েছে। নদী থেকে কাছি বেঁধে বড় বড় গাছের গুড়ি টেনে তুলতে দেখেছি। অনেকে মিলে টানছে আর ছড়া বলছে। সে ছড়াগুলির অর্থ অনেক সময় এতই কুৎসিত যে ভদ্র সমাজে পরিবেশন করা অসম্ভব। কিন্তু ছড়ার তালে একসঙ্গে কাছিতে টান পড়ছে, বিপুলকায় তরুস্কন্ধ ডাঙ্গায় উঠে আসছে। মানুষের দৈহিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে এই যে গানের মিল এ কোন সাহিত্যিক বা দার্শনিক সৃষ্টি করে নি, সাধারণ মানুষ জীবনের তাগিদে এই মিলকে খুঁজে বার করেছে। আদিম মানুষের শিকার নৃত্য এবং তার আনুষঙ্গিক আদিম ভাষার ভিতরে নিতান্ত প্ৰাণধারণের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যে “তত্ত্ব’ জীবনের স্বাভাবিক স্বীকৃতি লাভ করেছে তাকেও বলা যেতে পারে বৈসাদৃশ্যের ভিতরে সাদৃশ্যের অঙ্গীকার। সবাই মিলে বাচা, তাই সবাই মিলে নাচ। আর সে নাচকে সতেজ রাখার জন্য সবাই মিলে ভাষা। এ না হলে প্ৰতিকুল প্রকৃতির কোলে প্ৰথম মানুষ বাচিত না। বাঁচবে বলে মানুষ মিলেছে, মিলবে বলে নাচের সঙ্গে জান্তব্যপ্ৰায় ভাষাকেও মিলিয়ে দিয়েছে।
আমাদের দেশের ভেদাভেদবাদী দার্শনিকরাও ভেদের ভিতরে এই অভেদের উপলব্ধিকে মানুষের মুক্তির উপায় বলে নির্দেশ করেছেন। বহু বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত বস্তুকে একটি শব্দের দ্বারা একসঙ্গে প্ৰকাশ করার কৌশল মানুষ যেদিন প্ৰথম আয়ত্ত করেছিল, তখন তার অগ্রগতির ইতিহাসে একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিল বলতে হবে। পরস্পর-বিচ্ছিন্নরূপে প্ৰতিভাত মূর্ত বস্তুগুলিকে একটি বিমূর্তভাবের আধারে বিন্যস্ত করে ধরে রাখার উপায় আবিস্কৃত না হলে মানুষ মানুষ হত না, জানোয়ারই থেকে যেত। সকল মানুষকে এক “মানুষ’ নামে অভিহিত করা, সকল গাছকে “গাছ” বলে চিনতে পারা ও বলতে পারা, ন্যায়শাস্ত্রে যাকে বলে ‘সামান্য’ বাচক শব্দ, সেই একটি সাধারণ শব্দের দ্বারা বহু অসাধারণকে একত্র করে গেথে রাখা-এ হ’ল মানুষকে মানুষ করে তোলার কাজে এক অপরিহাৰ্য্য অঙ্গ। তারপর, ‘সমাজ” ‘সংসার’, ‘বিশ্ব, প্রভৃতি আরও উন্নত স্তরের বিমূর্ত-ভাবব্যঞ্জক শব্দগুলি আরও বহু বিচিত্র মূর্ত ব্যক্তিগুলিকে মানুষের মনন ও ভাবনার মধ্যে এক জায়গায় এনে একটি ভাবমূর্তিতে দাঁড় করিয়েছে। বিমূতকে পরিহার করে কেবল মুতী ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই আমাদের ধ্যান ধারণা যদি ঘুরপাক খেতে থাকত, তাহলে শুধু “সমাজ’, ‘সংসার’ই মিছে হত না, ‘জীবনের কলরব’ও মুছে যেত।
এক আধুনিক আমেরিকান দার্শনিক বলবার চেষ্টা করেছিলেন যে মানুষের সকল দুঃখের মূল কারণ কতগুলি বিমূর্ত শব্দের অত্যাচার। তার মতে বস্তুজগতে ‘মনুষ্যসাধারণ” বলে কিছুই নেই, আছে কেবল ১নং আদমী, ২নং আদমী…এই ভাবে অনির্দিষ্ট সংখ্যা পর্যন্ত। ‘সমাজ’, ‘সভ্যতা’, ‘সংস্কৃতি’, ‘ফ্যাসিবাদ’, ‘পুজিবাদ’, ‘সাম্যবাদ’–এই সব নিরর্থক শব্দের চাপে নিপীড়িত হয়ে মানুষ নির্বোধের মত হানাহানি করে মরছে। মানুষের জীবনের ব্যাকরণ থেকে common noun, abstract noun প্রভৃতি সবগুলি বিশেষ্য তুলে দিয়ে একমাত্র proper nounকেই ধরে রাখতে জানলে আর কোন গোলমাল নেই। মানুষকে সংখ্যা মাত্রে পরিণত করার লোভ-কলুষ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রবীন্দ্ৰনাথের ‘রক্ত করবী’তে বিদ্রুপ জর্জরিত ধিক্কার উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু এখন মানুষকে আবার সেই সংখ্যা হিসাবে পরিচিত করার কৌশল প্রয়োগ করতে হবে।
‘ব্যক্তি স্বাধীনতার’ এই দুরন্ত দার্শনিক আন্দোলন পশ্চিম জগতে এখনও বেশ জোরদার। আমাদের দেশের প্রাচীন আলিঙ্কারিক বলেছেন-উপাম| অলঙ্কারের ভিতরে ভেদাভেদের একটা চমৎকার ভারসাম্য রয়েছে। অভেদের চেয়ে ভেদটা বড় হয়ে উঠলে উপমা পরিণত হয় ‘ব্যতিরেক’ অলঙ্কারে, এবং ভেদটাকে চাপা দিয়ে কেবল অভেদটাকেই তুলে ধরলে উপমার জায়গা দখল করে ‘রূপক’ অলঙ্কার। মানুষের জীবন-দর্শনে আজ সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা-যে দৃষ্টিভঙ্গী গ্ৰহণ করলে মানুষ তার জীবন-দৃষ্টির স্বচ্ছ প্রশান্তি ফিরে পাবে সে কি উপমা, রূপক, না ব্যতিরেক? এ জিজ্ঞাসা সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক সকলকেই ব্যাকুল করে তুলেছে।
‘ব্যতিরোকি’ দৰ্শন যখন সাহিত্যকে আক্রমণ করে তখন অঘোর-পন্থী তান্ত্রিকের ব্যভিচারে সাহিত্যের আলো বাতাস বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এই বিষেরই সর্বশেষ প্রসব বোধ হয়। বিটনিক-কাব্য। বিটানিকের বামাচার ‘কুলার্ণব তন্ত্রের’ও কুলনাশ করেছে। তাই স্বাধীন সাহিত্যে এদেরও বোধ হয় অবাধ গতিবিধি। কিন্তু এ কাব্য আমাদের আলোচ্য নয়। বস্তুত কোনও গোষ্ঠী-কাব্যই আমাদের আলোচ্য নয়। আমরা আলোচনা করছিলাম জীবনদর্শনের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গীর কথা যা আদিমকাল থেকে বৈচিত্র্যের ভিতরে ঐক্য সাধনে ব্যাপৃত। কোন সচেতন দার্শনিকের দর্শন-সূত্রে নিবদ্ধ হওয়ার বহু আগে থেকেই এই দৃষ্টি মানুষের জীবনের মূলে অজ্ঞাত অঙ্গীকার লাভ করেছে। পৃথিবীতে মানুষ যেদিন প্রথম এসেছে সেদিন থেকেই সে ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করার কাজ সুরু করেছে। বহিঃপ্রকৃতির আলো বাতাস জল সে পান করেছে, তারই কাছ থেকে খাদ্য গ্ৰহণ করেছে, এই ভাবেই তার দেহ মন ও অনুভূতি গঠন করেছে। প্ৰতি মুহূর্তে বহির্জগতকে এই ভাবে ‘আত্মসাৎ’ করতে না পারলে তার ‘ব্যক্তিসত্তাই’ গঠিত হত না। পরকে আপন করা, বাহিরকে ঘর করার এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে মানুষ এখনও বেঁচে আছে, ভবিষ্যতেও এই ভাবেই তাকে বেঁচে থাকতে হবে। প্রতিকূল প্ৰকৃতির সঙ্গে এই অনুকুল একাত্মতা না থাকলে মানুষের বোধশক্তি প্ৰথম দিনেই লোপ পেয়ে যেত, যদিও এই একাত্মতা মানুষের বোধির ভিতরে ধরা পড়তে কয়েক যুগ সময় নিয়েছে। এই একাত্মতার ঐকান্তিক অনুভূতি যখন কবির হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তখন তার প্রকাশভঙ্গীও বিশ্ব-কাব্যকে প্রকাশ করার উপযুক্ত গৌরব অর্জন করে। যিনি বিশ্ব-কাব্যকে প্রকাশ করতে পারেন। তিনিই বিশ্ব-কবি :
‘এক সময় … আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলেম” …… আমার এই যে মনের ভাব, এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূৰ্য্যসন্নাথ আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, সমস্ত শস্যক্ষেত্রে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে। এবং নারিকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থর থর করে কাঁপছে। … …’
‘আমি বেশ মনে করতে পারি, বহু যুগ পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূৰ্য্যকে বন্দনা করছেন তখন আমি পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোস্থাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেম। তখন পৃথিবীতে জীবজন্তু কিছুই ছিল না, বৃহৎ সমুদ্র দিন রাত্রি দুলছে এবং অবোধ মাতালের মতো আপনার নবজাত ক্ষুদ্র ভূমিকে মাঝে মাঝে উন্মত্ত আলিঙ্গনে একেবারে আবৃত করে ফেলছে। তখন আমি এই পৃথিবীতে আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম সূৰ্য্যালোক পান করেছিলেম-নব শিশুর মত একটা অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বর তলে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিলেম, এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড়গুলি দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান। করেছিলেম।’
‘প্রকৃতি তাহার রূপরস বর্ণগন্ধ লইয়া মানুষ তাহার বুদ্ধিমন তাহার স্নেহ প্ৰেম লইয়া আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে—সেই মোহকে আমি অবিশ্বাস করি না। সেই মোহকে আমি নিন্দা করি না। তাহা আমাকে বদ্ধ করিতেছে না, তাহা আমাকেই মুক্তই করিতেছে; তাহা আমাকে আমার বাহিরেই ব্যাপ্ত করিতেছে, নৌকার গুণ নৌকাকে বাধিয়া রাখে নাই; নৌকাকে টানিয়া টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। জগতের সমস্ত আকর্ষণপাশ আমাদিগকে তেমনি অগ্রসর করিতেছে।’ (আত্ম পরিচয়)
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রথম দুইটি অনুচ্ছেদকে আলঙ্কারিক পরিভাষায় ‘উৎপ্রেক্ষা’ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন গভীর উপলব্ধিকে অলঙ্কারের দ্বারা চিহ্নিত করার প্রচেষ্টার ভিতরে ‘আঙ্গিক’-প্রধান দৃষ্টির সংকীর্ণতা বিমুগ্ধ হৃদয়কে পীড়িত করে। উপলব্ধির দিক থেকে এখানে কোন অসম্ভবের সম্ভাবনা নেই। বাংলা ‘যেন’ কথাটি এখানে ইংরেজী ‘as if’ এর ধারণা বহন করে না। নদীর তরঙ্গভঙ্গীকে যখন কোন কবি ক্ৰোধোদ্দীপ্ত ভ্ৰকুট বলে কল্পনা করেন, তখন তার ভিতরে একটা সচেতন ‘অসত্য’ ভাষণের অপরূপ প্রয়াস আমাদিগকে মুগ্ধ করে। অসম্ভবের সম্ভাবনাই কল্পনা ও প্রকাশ ভঙ্গীকে গৌরব দান করে। কিন্তু বিশ্ব-কবির অনুভূতি এখানে অবস্তুকে বস্তুরূপে প্ৰতিভাত করে না, কল্পনার ঐশ্বর্যের দ্বারা ভাবনাকে পীড়িত করে না, কিন্তু এক সুনির্বিড় সত্যভাবনার ভিতরে মানুষ ও পৃথিবীর ইতিহাসের একটা বৃহৎ সত্যকে প্রকাশ করে। এই সাহিত্যিক বিশ্বদৃষ্টির সম্মুখে বিশ্বের সত্যরূপ প্রসারিত ও প্ৰকাশিত।
এখন যদি বলা যায় কবির এই অনুভূতি নিতান্তই তার ব্যক্তিগত, যার গভীরে অবগাহন করার মত ক্ষমতা সাধারণের নেই, তাহলে কবিকে সম্মান দেয়া হল, কি অসম্মান করা হল, এ নিশ্চয়ই ভাববার কথা। শুধু কবির কথাই বলছি কেন। যে কোন মানুষের ভাবনা ও বাসনা এক হিসাবে ব্যক্তিগত, আর এক্ল হিসাবে সমাজগত। আমাদের প্রাচীন আলঙ্কারিক রসগ্ৰাহী পাঠক ও দর্শকের নাম দিয়েছেন ‘সহৃদয়’ ও ‘সামাজিক’। এই পারিভাষিক নামকরণ দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কবির হৃদয়ের সমান হৃদয় রয়েছে পাঠকের, একই ভাবনায় ভাবিত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে—এ ক্ষমতা এই সহৃদয়তা শুধু তার একার নয়। সমাজের মানুষের চিন্তা ও ধারণা ব্যক্তিহৃদয়ের মধ্যে ঠাই পেয়েছে; মানুষে মানুষে যত প্ৰভেদই থাকুক, সমান হৃদয়, সমান ভাবনা, সমান চেতনা না থাকলে মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনদিন কোন সম্পর্ক গড়ে উঠত না, এমন কি কোন শক্রিতার সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারত না। আপনি যাকে গাছ ভাবেন, আমি যদি তাকে মানুষ ভাবতাম, আমি যাকে টেবিল ভাবি, আপনি যদি দেখতে পেতেন। সে চাৱ পা ফেলে দৌড়াচ্ছে, আপনার দুঃখের অশ্রুকে আমি যদি সুখের জলসেক বলে মনে করতাম, তাহলে পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, দাস-ভৃত্য, বন্ধুত্ব আর বৈরিতা— মানুষের সকল সম্পর্কই ঘুচে যেত। প্ৰত্যেকটি মানুষ তার নির্জন দ্বীপে একটি নির্বাসিত রবিনসন ক্রুশো হয়ে থাকত। প্রাচীন আলঙ্কারিক বুঝেছিলেন মানুষ যে সহৃদয়, মানুষ যে সামাজিক, এ তার সাহিত্যানুভূতিরও মূল ভিত্তি, যে ভিত্তিতে সাহিত্যিক অসাহিত্যিক বিদ্বান ও মুর্থ এক জায়গায় মিলেছে। এই সর্বসাধারণ সহৃদয়তা ও সামাজিকতাকেই আরও বেশী সুসংস্কৃত ও পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারলে আমরা সাহিত্যিক সামাজিকতা ও সহৃদয়তায় পৌছাতে পারি।
শৈশব থেকে শিশুর সাধনা চলেছে তার অনুভুতির ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রুম করে সমাজ সত্তায় পৌঁছাবার জন্য। মা শিশুকে আঙ্গুল দিয়ে চাঁদ দেখাবার পর শিশু যেদিন আঙ্গুল দিয়ে মাকেই আবার চাঁদ দেখাতে শিখল, সেদিন এই শিশু নিছক অন্ধ জৈব প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে তার নিস্কৃতির পাল| সুরু করল। শুধু ব্যক্তিগত প্ৰতিক্রিয়া প্ৰকাশ করাই নয়, একটি সমান প্রতীকের ব্যবহার দ্বারা অন্যের ভিতরে ও সমান প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা সম্ভব, এই প্রারম্ভিক সামাজিক সত্য তার কাছে আবিষ্কৃত হল। তারপর অঙ্গুলিনির্দেশের এই স্কুল প্রতীককে অতিক্রম করে যখন সে ভাষাগত প্রতীকে উপনীত হল। তখন শিশুমনের সমাজীকরণ যেন একলাফে অনেকদূর এগিয়ে গেল। প্ৰথম শব্দটি শেখার সঙ্গে বার বার তার উচ্চারণ, আর ঐ উচ্চারিত শব্দের দ্বারা কোন বস্তুর সনাজীকরণ শিশুচেতনার অগ্রগতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শব্দের ব্যবহার শেখার সঙ্গে সঙ্গে মানবশিশু সমাজের মানুষ হতে শিখেছে। অন্যের ভাবনাকে আত্মসাৎ করা ও নিজের ভাবনা দ্বারা অন্যের চেতনাকে অনুবিদ্ধ করা, এই দেনা পাওনার কৌশল সে আয়ত্ত করেছে। বিভিন্ন ব্যক্তিচেতনায় বিধৃত ভাব ও বস্তুকে একটি শব্দপ্রতীকের মাধ্যমে একটি সর্বসাধারণ ভাবনার আকারে বেঁধে রাখা যে সম্ভব, এ আবিষ্কার মনুষ্যত্বের গৌরব।
শ্ৰেষ্ঠ সাহিত্যিক এই গৌরবের শ্রেষ্ঠ অংশীদার। উপরের উদ্ধৃতিটির ভিতরে পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের মৌলিক একাত্মতা শুধু কবির উপলব্ধির ভিতরেই নিঃশেষ হয় নি, পাঠকের চেতনাতেও সঞ্চারিত হয়েছে। এই সঞ্চারপ্রক্রিয়াকে সার্থক করার জন্য কবি যে ভাষা-প্ৰতীক ব্যবহার করেছেন তার ভিতরে আধুনিক কষ্ট-কল্পিত প্রতীক-ধৰ্মিতার উৎকট কসরৎ নেই। কয়েকটি অতিপরিচিত শব্দ ব্যাকরণের পরিচিত গাথুনির ভিতরে সুবিন্যস্ত হয়ে এক অসাধারণ ধারণাকে সাধারণের ধরার সীমানার মধ্যে এনে দিয়েছে। যাদের এ ক্ষমতা থাকে না, অথচ প্ৰকাশের দীনতাকে প্ৰকাশ্যে স্বীকার করতে ও যারা কুষ্ঠিত, তারা কাব্যকে শব্দের ধাধায় পরিণত করতে কুষ্ঠিত নয়। ব্যক্তিমানসকে সমাজমানসে সঞ্চারিত করার যে প্ৰাথমিক দায়িত্ববোধ শিশুমনেও সহজ অঙ্গীকার লাভ করেছে সেই দায়িত্ব থেকে নিস্কৃতি লাভই যেন শিল্পম্বাতন্ত্র্যের পরাকাষ্ঠা।
একদল আধুনিক দার্শনিক মনে করেন—আমাদের বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কতগুলি খণ্ড ছিন্ন ইন্দ্ৰিয়বাহিত অভিজ্ঞতার সমষ্টিমাত্র। যা কিছু অতি-প্ৰাথমিক ইন্দ্ৰিয়ানুভূতির বাইরে, তাই অর্থহীন। এই দর্শনের মতে আমি, আপনি, নদী, পাহাড়, আকাশ, প্ৰান্তর কোন ও কিছুরই মৌলিক অস্তিত্ব নেই। একজন বললেন গতিদিনের রবিনসন ক্রুশো আর আজকের রবিনসন ক্রুশোর মধ্যেও মূলতঃ কোনও ঐক্য নেই। দুই দিনের ‘এক’ ব্যক্তি এক নয়। তাই এই দুই-এর ভিতর যে সম্বন্ধ, তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে ক্রুশোরও ঐ একই সম্বন্ধ। কাজেই সম্বন্ধ থাকা না থাকা একই কথা, ওটা ‘বস্তুজগতের’ ব্যাপার নয়, একটা অর্থহীন অভ্যাস-সঞ্জাত কল্পলোকের ব্যাপারমাত্র। এদের মতে সাধারণ মানুষের ভাষাই মানুষের কাল হয়েছে। এই ভাষা বস্তুহীন জগতকে বস্তুর ভারে ভারাক্রান্ত করেছে। এই সাধারণ মানুষের ভাষার হাত থেকে নিস্কৃতিলাভের উপায় আবিষ্কার করাই দর্শনের প্রধান কাজ। সুতরাং ভাষাকে গাণিতিক সংকেতে পরিণত করতে হবে, নূতন নূতন বদখত চেহারার কতকগুলি সংকেতচিহ্র দ্বারা আমাদের প্রাথমিক ইন্দ্ৰিয়জ্ঞানকে প্ৰকাশ করতে হবে। “আমি একখানা বই দেখছি’ এজাতীয় বাক্য অর্থহীন। আমিও নেই, বইও নেই, আছে শুধু দেখা নামক একটি ইন্দ্রিয়গম্য ঘটনা বা অভিজ্ঞতা। যে দেখেছে। আর যাকে দেখছে–ওসব রহস্যবাদী কথা ভুলে যান। একটি লাল রঙের দেখা, একটি নীল রঙের দেখা, এই পৰ্য্যন্ত। এখন এই বিভিন্ন রক্ত নীল বা পীত দৃষ্টির জন্য বিভিন্ন গাণিতিক সংকেত ব্যবহার • করুন-সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল, দর্শনশাস্ত্ৰে যুগান্তর ঘটে গেল। Hume। Mach-এর দর্শন, অথবা দু’হাজার বছর আগেকার বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দর্শন নূতন নামাবলী গায়ে দিয়ে আসরে নেমেছে। লেনিনের Empirico-Criticism এদের কাছে অপাংক্তেয়। কারণ তার প্রত্যেকটি পংক্তি এদের নিদারুণ আঘাত করে।
এখন শোনা যাচ্ছে এই দর্শনের জ্ঞানাঞ্জন-শলাকায় চক্ষু উল্মীলিত করে নূতন ধরণের কাব্য সাহিত্য সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালান হবে, হয়ত ব| সুরুও হয়ে গেছে। মানুষের ভাষা ও ব্যাকরণকে বর্জন করে ‘বিজ্ঞানধর্মী’ সাহিত্য সৃষ্টি হবে, গণিতের সংকেতের সারি দিয়ে খণ্ডিত অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে সার বাধা হবে। অনেক সময় মনে হয় অনেক আধুনিক বাংলা কবিতাও এই প্ৰচেষ্টারই প্ৰাথমিক পরীক্ষা কিনা। শব্দের অর্থ কোনও রকমে বুঝতে পারলেও বাক্যের অর্থ যখন বুঝি না, একটি বাক্যের সঙ্গে আর একটি বাক্যের অর্থগত কোনও মিল যখন অনেক কষ্ট করেও বুঝতে পারি না, বাক্যগঠনে চিরকাল প্ৰচলিত ‘যোগ্যতা’ ‘আসাত্তি’ ও ‘আকাজক্ষার’ নিয়ম যখন স্বেচ্ছাকৃতভাবেই উপেক্ষিত হয় তখন সত্যিই খটকা লাগে– এটা কোন অতি আধুনিক দর্শনের ছোয়ালাগা প্রগতির প্রকাশ কিনা। এই দর্শনের একটা মূল কথা, একটি লোকের দুইটি ক্ষণের অভিজ্ঞতাও একই লোকের অভিজ্ঞতা নয়। সুতরাং অপরের জ্ঞানের সঙ্গে তার মিলের কথা ত উঠতেই পারে না। ঐ মিলিটা মোটেই পারমার্থিক নয়। নিতান্তই ব্যবহারিক। এর সহজ সিদ্ধান্ত এই হওয়া উচিত-সারা দুনিয়াটাই split-personalityর ভাঁড়ার ঘর, সুতরাং ভাষা এখন আর মানুষের অর্থবোধের অপেক্ষা রাখেন, বিভিন্ন মানুষ যাতে সমানে অংশ গ্ৰহণ করতে পারে এমন কোনও ইতারজনগ্রাহ ভাববস্তুকে প্ৰকাশ করার দায়িত্ব থেকে ভাষা। মুক্তি পেয়েছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সেতু হিসাবে কাজ করার ভূমিকা ভাষার শেষ হয়ে গেছে।
অনেক বন্ধু এ রকমের একটা উদার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন যে আধুনিক জীবনটা এতই জটিল যে তাকে সাহিত্যে প্ৰকাশ করতে হলে স্বভাবতই জটিল আঙ্গিক গ্ৰহণ করতে হয়। একথার দুরকম অর্থ হতে পারে—জীবনের জটিলতা প্রকাশ করার জন্য স্বেচ্ছাকৃতভাবে জটিল আঙ্গিক প্ৰয়োগ করা হচ্ছে। অথবা জীবনের জটিলতা কবি-সাহিত্যিকের মনেও এমন জট সৃষ্টি করেছে যা তার সাহিত্য কর্মের আঙ্গিক ও ভাববস্তু উভয়ত্রই প্ৰতিফলিত হয়েছে। প্ৰথম পক্ষে বলা যেতে পারে, জট দিয়ে জটিলকে প্রকাশ করা যায় না, আরও জট পাকানো যায়। দ্বিতীয় পক্ষে কবি-সাহিত্যিক নিজেই একটা pathological case, সমাজ-চিকিৎসার রোগী, সমাজবিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয়।
‘ব্যতিরোকি’-দর্শন জীবনের অনেক কিছুই অতিরিক্ত বলে বর্জন করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিই বলুন, সাহিত্যিক উপলব্ধিই বলুন, নৈতিক আদর্শই বলুন। — ওগুলি দার্শনিক সত্যাসত্যের বিষয় নয়। তাই এগুলি দার্শনিক বিচারে অর্থহীন। কারণ মূল্যবোধ বা মূল্যবিচার দর্শনের পরিধির বাইরে। যে ভাষা ইন্দ্ৰিয়লব্ধ ক্ষণিক অভিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতি রাখে তাই কেবল অর্থপূর্ণ, বাকী সব অর্থহীন। এই নিরিখে রবীন্দ্রনাথের সত্য উপলব্ধির সঙ্গে দার্শনিক সত্যদৃষ্টির কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং পূর্বের উদ্ধৃত কথাগুলির কোন অর্থ নেই।
আমাদের প্রাচীন রাসবাদী অলঙ্কারিকরা রসের বিচারে এবং রসের লক্ষণ নির্ণয়ে শেষ পৰ্য্যন্ত নির্ভর করেছেন রসিক পাঠকের উপর। কবির অনুভূতিকে রস না বলে, সহৃদয় সামাজিক পাঠকের হৃদয়ে অভিব্যক্তি সাহিত্যিক আনন্দানুভূতিকে রস বলেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গীর বিশেষ গুরুত্ব আছে। কারণ এই রসদর্শন মানুষের ভাষার চিরন্তন উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই দৃষ্টিভঙ্গীকে অতিক্রম করে কোনও সাহিত্যিক বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ যখন বললেন-কবিকৰ্ম মানে পাখীরা আপন মনে গান গাওয়া নয়, বঙ্কিমচন্দ্ৰ যখন বললেন মানুষে না বুঝলে লিখে লাভ কি, তখন তার হাটুরে সাহিত্যের কথা বলেন নি, রসা-শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকেই কথা বলেছেন। ঋষি টলষ্টয় শিল্প-রসের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তার সঙ্গে ভারতীয় রস-শাস্ত্রের বিস্ময়কর মিল রয়েছে“দর্শক বা শ্রোতা যদি শিল্পীর অনুভূতি দ্বারা অনুবিদ্ধ হয়, তবেই তা শিল্প।” টলষ্টয়-প্ৰণীত শিল্প-রসের লক্ষণ বহুজনবিদিত হলেও এখানে তার পূর্ণ উদ্ধৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না :
‘To evoke in oneself a feeling one has once experienced and having evoked it in oneself then by means of movements, lines, colours, sounds, or forms expressed in words, so to transmit that feeling that others experience the same feeling-this is the activity of art.
“Art is a human activity consisting in this, that one man consciously by means of certain external signs hands on to others feelings he has lived through, and that others are infected by these feelings and also experience them.’
এর পর টলষ্টয় টীকা করে বললেন-সবচেয়ে বড় কথা। -‘শিল্প কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আনন্দের খেলা নয়, সমান অনুভূতির ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলিয়ে দেবার উপায় হল শিল্পী। জীবনের জন্য এ অপরিহাৰ্য্য, ব্যক্তিমানুষ ও সমগ্ৰ মানবসমাজের কল্যাণকর অগ্রগতির পথে এ এক অপরিহাৰ্য্য পাথেয়।’
টলষ্টয়ের মূল শিল্পীরস-সংজ্ঞার সঙ্গে অভিনব গুপ্তের সিদ্ধান্ত-লক্ষণের আশ্চৰ্য্য সংগতি বিদগ্ধজনের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। টলষ্টয়ের লক্ষণের যে অপূর্ণতা রয়েছে তা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কান্না শ্রোতার হৃদয়ে সহানুভূতির মাধ্যমে যে সমান অনুভূতির সৃষ্টি করে। তাও কি শিল্পরসে অন্তর্ভুক্ত হবে? তা হলে মায়ের ঐ কান্না যখন সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরিত হয় তখন পাঠক হিসাবে আপন অশ্রুধারার মধ্যেও একটা আনন্দঘন পরিতৃপ্তি আমরা অনুভব করি কেন? এ একটা মৌলিক প্রশ্ন। তাই আমাদের দেশের আলঙ্কারিকরা সাহিত্যের মূল ভিত্তির কথা যখন আলোচনা করেছেন তখন সমান অনুভূতির ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে মিলনের কথা বলেছেন, কিন্তু যখন সাহিত্যের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন তখন “বিগলিত-বেদ্যান্তর” আনন্দময় অনুভূতির কথা বলেছেন। সাহিত্যশিল্প যে কেবল অনুকৃতি নয় এ বিষয়ে অভিনব গুপ্ত প্ৰখর ভাবে সচেতন ছিলেন, মন্তব্য করেছেন যে অনুকৃতি মাত্র হলে সাহিত্য কেবল হাস্যরসের সৃষ্টি করতে পারত।
কিন্তু সাহিত্যের মূল ভিত্তিই যদি নড়ে যায়। তবে আনন্দঘন অনুভূতি একটা নিরালম্ব খেয়ালী খেলায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।
এ সম্পর্কে রবীন্দ্ৰনাথ কতখানি সচেতন ছিলেন তার নজিরের জন্য বেশী দূর যেতে হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার অনুভূতি কত নির্বিড় হতে পারে প্রথম উদ্ধৃতিই তার প্রমাণ। কিন্তু মানুষ হিসাবে এই ঐকাত্ম্যবোধই যে যথেষ্ট নয়। সে কথাও রবীন্দ্ৰনাথের মত এমন করে আর কে বুঝেছে?
‘যখন বয়স অল্প ছিল তখন নানা কারণে লোকালয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না, তখন নিভৃতে শিল্পপ্রকৃতির সঙ্গেই ছিল আমার একান্ত যোগ। এই যোগটি সহজেই শান্তিময়। কারণ এর মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই, বিরোধ নেই, মনের সঙ্গে মনের, ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার সংঘাত নেই। এই অবস্থা ঠিক শিশুকালেরই সত্য অবস্থা…
‘বিশ্ব প্ৰকৃতির সঙ্গে নিজের প্রকৃতির মিলটা অনুভব করা সহজ। কেন না। সে দিক থেকে কোনো চিত্ত আমাদের চিত্তকে কোথাও বাধা দেয় না। কিন্তু এই মিলিটাতেই আমাদের তৃপ্তির সম্পূর্ণতা কখনো ঘটতে পারে না। কেন না আমাদের চিত্ত আছে, সেও আপনার একটি বড় মিল চায়। BB এই মিলটা বিশ্বপ্ৰকৃতির ক্ষেত্রে সম্ভব নয়, বিশ্বমানবের ক্ষেত্রেই সম্ভব।’
প্ৰকৃতি থেকে মানব, বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিশ্বমানব-এই ব্যাপকতম উপলব্ধি মানুষেরই বিশ্বপরিক্রমার ইতিহাস। যে ভাষা, যে প্রতীক ও সংকেত, যে দর্শন ও সাহিত্য কখনও বিকৃত বস্তুবাদের নামে, কখনও স্বার্থন্বেষী দেশহিতৈষণার নামে, কখনও ‘বিজ্ঞান ধমিতার’ নামে মানুষের এই স্বাভাবিক বিশ্বমুখীনতাকে ব্যাহত করে, তা মানুষের গৌরবের সামগ্ৰী নয়। যানুষকে খণ্ডিত করে একরাশ পরমাণুপুঞ্জের মধ্যে বিকীর্ণ করে দেখা “বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নয়। খণ্ডিত মানুষকে মিলিত করাই বিজ্ঞানের দৃষ্টি। এ দৃষ্টি সাহিত্যের, এ দৃষ্টি দর্শনের। কারণ এ সুস্থ মানুষের চিরায়ত স্বভাবসংগত। বিসদৃশের ভিতর সদৃশকে আবিষ্কার করে অসাহিত্যিক প্রথম মানুষ উপমা অলঙ্কার সৃষ্টি করেছিল, সকল মহান সাহিত্যিক এই আবিষ্কারকেই এগিয়ে নিয়েছেন মানুষের পরম কল্যাণের দিকে। মানুষের কল্যাণ ব্ৰতের নাম দেয়া যেতে পারে-সাদৃশ্যের অন্বেষণ।
পৃথিবীর প্রথম সাহিত্য ঋগ্বেদের সর্বশেষ মন্ত্র সকল মানুষের মূলমন্ত্র :
সমানী বা আকুতি: সমান হৃদয়ানি ব:।
সমানমন্তু বো। মনো যথা ব: সুসংহাসতি।
সায়নাচাৰ্য্য ব্যাখ্যা করলেন :
তোমাদের সাহিত্য যাতে শোভন হয় তাই তোমাদের সংকল্প সমান হোক, হৃদয় সমান হোক, মন সমান হোক।