প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সাহিত্য ও সংস্কৃতি 

সাহিত্য ও সংস্কৃতি 

দেশে দেশে যুগে যুগে মানুষের যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, যে ইতিহাস রচিত হচ্ছে সে ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে এ সত্যটাই তুলে ধরে যে, বেঁচে থাকার অর্থ শুধু টিকে থাকা নয়। আমরা এও জানি, সংস্কৃতি সাধনাই এ চেতনাবোধ মানুষের মনে জাগিয়ে তোলে। দেহের উর্ধ্বে মানুষের আরো দাবি আছে–সে দাবি মনের দাবি, আত্মার দাবি, প্রতিভার দাবি। এই দাবি পূরণের দায়িত্বভার কৃষ্টি ও সংস্কৃতি-সেবীদের ওপর। যে জাতি ও যে দেশ এ দাবি যত বেশি পূরণ করতে পেরেছে, সে জাতি বা দেশ তত বেশি মহত্ব অর্জন করেছে; মনুষ্যত্ব সাধনায় তত বেশি এগিয়ে গেছে। এ বিষয়ে। আমাদের দেশের ও জাতির দারিদ্র্য অসঙ্কোচে স্বীকার না করে উপায় নেই। 

মাত্র কয়েকদিন আগে দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্বন্ধে পরিচয় রাখেন এমন একজন উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন : ‘এই কয় বছরে আমার দেশ পূর্ব পাকিস্তানে যা জ্ঞান সাধনা হয়েছে তার সবটুকু কিনে নিতে আমার পঞ্চাশ টাকার বেশি ব্যয় করার দরকার পড়ে না। অন্যান্য দেশের তুলনায় এই তো আমাদের জ্ঞান সাধনার পরিমাণ। কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্য না হতে পারে কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে, এ কথায় আমাদের সংস্কৃতি সাধনার সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার প্রতি যে ইঙ্গিত রয়েছে, তা অত্যন্ত রূঢ় ও নিষ্ঠুর হলেও অনেকখানি সত্য। সাংস্কৃতিক জীবনে আমাদের অবদান ও বাস্তব অবস্থার প্রতি এ যে এক সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

স্বীকার করি, এই শোচনীয় অবস্থার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ অনেকখানি দায়ী। অর্থনেতিক অব্যবস্থায় সংস্কৃতিসেবীরা আজ বিপর্যস্ত। আর্থিক নিরাপত্তার অভাবে সংস্কৃতি-সেবীদের অনেকেই বিভিন্ন কলা ও শিল্পচর্চার অনুকূল পরিবেশ থেকে বঞ্চিত। আমাদের সামাজিক পরিবেশ এখনো মধ্যযুগীয়–সংস্কার বিমুক্ত যে সামাজিক আবহাওয়া ও পরিবেশ শিল্পসাধনা ও শিল্পসৃষ্টির জন্য অপরিহার্য তার ক্ষেত্র এখনো রচিত হয় নি। রাজনীতির ক্ষেত্রে অবস্থা আরো শোচনীয়। প্রাক স্বাধীনতা যুগে সংস্কৃতি-সেবীদের যেটুকু স্বাধীনতা ছিল, বলতে দ্বিধা নেই, এখন সেই স্বাধীনতাটুকুও অনেকখানি সঙ্কুচিত। যে কোনো কর্মের অগ্রদূত–ভাব, চিন্তা, কল্পনা। সেই ভাব, চিন্তা ও কল্পনার ক্ষেত্রে যারা একটু এগিয়ে যেতে চান, সেই প্রগতিশীলদের এখন আখ্যা দেওয়া হয়েছে leftist বা বামপন্থী বলে আর সেই বামপন্থীদের রীতিমত সন্দেহের চোখে দেখা যেন উঁচু নিচু ও মাঝারি সব রকম সরকারি পর্যায়ের একটা নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ উদ্ধত সন্দেহের নিচে দাঁড়িয়ে সার্থক সংস্কৃতি চর্চা কখনো চলতে পারে না। এ কথা মনে রাখা জাতীয় স্বার্থের জন্যই প্রয়োজন–এই বহুনিন্দিত প্রগতিশীলরাই দেশকে, জাতিকে সামনের দিক এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন এবং তাঁরাই নিয়ে যেতে পারবেন। বাংলা ভাষা যে আজ রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করেছে তাও এই প্রগতিশীলদের রক্তের বিনিময়ে, তাদের সক্রিয় ও সুসঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের ফলে। নব নব চিন্তার পথে, ভাবের পথে, কল্পনার পথে–এক কথায় সৃষ্টির পথে এঁরাই পা বাড়াতে সক্ষম। যারা Good old days এর জাবর কাটতে চান, পুরোনো ও মান্ধাতার আমলের ভাবাদর্শকেই চরম ও পরম লক্ষ্য। মনে করে চোখ বাঁধা কলুর বলদের মত শুধু ঘানির অচলায়তন প্রদক্ষিণ করে সংস্কৃতি চর্চার ভান করছেন তারা জাতির মানস-জীবনকে পেছনের দিকে, তার সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে বন্ধ্যাত্বের পথে ঠেলে দিচ্ছেন মাত্র। সংস্কৃতি স্থানু নয়–মানুষের জীবনের মতোই তা প্রগতিশীল। হাজার কি দু হাজার বছর আগে কৃষ্টি বা সংস্কৃতির যে রূপ ছিল মানুষের গতিধারার সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ ও ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে ও হচ্ছে। অতীতে সব কিছুর গতি ছিল মন্থর, আজ নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে সেই গতি হয়েছে দ্রুত। তাই এখন এবং ভবিষ্যতে সংস্কৃতির পরিবর্তন আরো দ্রুততর হতে বাধ্য। সংস্কৃতি সাধনায় এই গতি, প্রগতির ধারা যারা বুঝতে পারেন না, ধরতে পারেন না, উপলব্ধি করতে পারেন না সেই সব স্থবিরদের সংস্কৃতি সাধনা আজকের দিনে ব্যর্থ ও নিষ্ফল হতে বাধ্য। সংস্কৃতি সাধকদের এ কথা মনে রাখা দরকার–ঘড়ির কাঁটা কখনো পেছনের দিকে ফেরানো যাবে না। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক আজ আমরা যে ইতিহাসের অংশ হয়ে পড়েছি, সেই ইতিহাসের নির্দেশ হচ্ছে অগ্রগতি, পেছনের দিকে না ফেলে সামনের দিকে পা ফেলার। পৃষ্ঠপ্রদর্শন মানে সেই ইতিহাসের প্রতি বিশ্বাস-ঘাতকতা। সংস্কৃতি-সেবীদের এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন–ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, সে বড় নিষ্ঠুর ও নির্মম বিচারক। যে কোনো রকম ঐশী শক্তির দোহাই সেখানে অচল ও অকেজো। 

কৃষ্টি বা সংস্কৃতির মূল কাণ্ড সাহিত্য। সাহিত্যকে অবলম্বন করেই সাধারণত সংস্কৃতির নানা শাখা-প্রশাখা দল মেলে–সংগীত বলুন, নাটক অভিনয় বলুন, চিত্র শিল্প বলুন; এমনি সংস্কৃতির আরো যত রকম রূপ আছে সব কিছুর মূল উৎস ও প্রেরণা সাহিত্য। মানুষের চেহারার মত প্রতিটি মানুষের মনের স্বরূপও স্বতন্ত্র। যে। কোনো মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রে প্রতিফলিত হয় মনের গতি-প্রকৃতি। নানা সংস্কৃতি সাধনার মধ্য দিয়েই ঋদ্ধ হয় মানুষের মন ও মনন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র যখন বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তার প্রসার যখন হয় দেশব্যাপী, তখনই তা জাতীয় বা দেশগত রূপ লাভ করে। এইভাবে জাতির চরিত্র ও প্রতিভা ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হয় তার সাহিত্যে, সঙ্গীতে, নাটকে, চিত্র-শিল্পে ও তার নৃত্যকলায়। বলা বাহুল্য, আমাদের জাতীয় চরিত্র ও প্রতিভা এখনো সেভাবে আমাদের সাহিত্য-শিল্পের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় তেমন প্রতিফলিত হয় নি, ফুটে ওঠে নি। তাই আমাদের শিল্পী, সাহিত্যিক ও সব শ্রেণীর সংস্কৃতি-সেবীদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং আরো একনিষ্ঠভাবে কঠোর সাধনায় হতে হবে প্রবৃত্ত। 

জাতীয় চরিত্র ও প্রতিভার সঙ্গে বিশ্বমানবধর্ম তথা মনুষ্যত্বের কোনো বিরোধ নেই। সাহিত্য-শিল্পী ও সংস্কৃতি-সেবী মাত্রেই মনুষ্যত্বের সাধক। মনুষ্যত্বের মহাসমুদ্রে অবগাহনই তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ব্যবধান মাত্র সাঁতরে পার হওয়া যায় এমন একটি খালের–তবুও উভয় দেশের সাহিত্য-শিল্পে ভিন্নতর জাতীয় চরিত্র ও প্রতিভা প্রতিফলিত হয়েছে। আরব, ইরান শুধু পাশাপাশি নয়, এক সময় একই শাসনাধীনেও ছিল, তবুও উভয় দেশের সাহিত্য কত আলাদা। ভাষার বিভিন্নতার কথা আমি বলছি না–মর্মগত অর্থাৎ চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের কথাই বলছি। ইংরেজ আর আমেরিকানে নাকি খুড়োতুতো-মাসতুতো ভাই, উভয় দেশের ভাষাও এক–তা সত্ত্বেও উভয় দেশের সাহিত্যের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য কার না লক্ষগোচর? এমন কি, সাধারণ যে রান্নাবান্না তাতেও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতিতে কতই না পার্থক্য। ইংরেজি রান্না, ফরাসি রান্না, মোগলাই রান্না, পাকিস্তানি রান্না, চীনা রান্না, জাপানি রান্না এমনকি বাঙালি রান্না, ঘটি রান্নাও আছে, চট্টগ্রামি রান্না আর ঢাকাই রান্না তো আছেই। অথচ এত সব রকমারি রান্নার এক ও একমাত্র উদ্দেশ্যে হচ্ছে খাওয়া, খেয়ে দেহের পুষ্টিসাধন। সাহিত্য-শিল্পের যে বিভিন্নতা তাও এ ধরনের বিভিন্নতা। একই ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ জীবনের প্রতি যে একটা স্বতন্ত্র মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করে তা-ই সেখানকার সাহিত্য-শিল্পে এবং সংস্কৃতি সাধনায়ও প্রতিফলিত হয়। এ যেন বিভিন্ন নদী বিভিন্ন পথে প্রবাহিত হয় বটে কিন্তু সবের লক্ষ্য হচ্ছে মহাসমুদ্রে মিলিত হয়ে মুক্তিলাভ। তেমনি বিভিন্ন দেশের সাহিত্য-শিল্পে নানা বর্ণবৈচিত্র্য ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে বটে কিন্তু তারও লক্ষ্য এক–মনুষ্যত্বের সাধনা, মনুষ্যত্বরূপ মহাসমুদ্রে মুক্তিলাভ।

সংস্কৃতিসেবী মাত্রেই জানেন সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে জাতীয় চরিত্র ও জাতীয় বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয় তা কখনো দ্বন্দ্বমূলক নয় বরং মিলনমূলকই। আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় Unity in Diversity। এই Unity-র সাক্ষালাভ কখনো ঘটবে না। বৈচিত্র্যহীন যে ঐক্য তা গোরস্থান বা শ্মশানেরই ঐক্য–তা সমাজেরও নয়, জীবনেরও নয়। বলাই বাহুল্য, জীবনবোধ ছাড়া সবরকম সংস্কৃতি সাধনাই ব্যর্থ। কারণ, সংস্কৃতি সাধকরাও সমাজ-জীবনেরই অঙ্গ। সমাজের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব তাদের সংস্কৃতি সাধনা যেন সেই দায়িত্ব পালন ও তার পরিপূরক হয়। জীবন-বিমুখ অর্থাৎ পলাতক সাহিত্য-শিল্পীর আজ আর কোনো মূল্য নেই। কোনোদিন যে মূল্য ছিল তাও আমার মনে হয় না। এই কথা বলতে গিয়ে আমাকে আবার সেই পুরাতন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে–শিল্পের জন্য শিল্প না জীবনের জন্য শিল্প? আজকের দিনের যে সমস্যা অতীতে হয়ত সেসব সমস্যা আদৌ ছিল না। তখনকার সমস্যার রূপ ছিল। ভিন্নতর এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ যে একটি অনবদ্য শিল্প সৃষ্টি সেই সম্বন্ধে দ্বিমত নেই। কিন্তু যক্ষ, যক্ষপত্নী, মেঘ–ধরতে গেলে এ সবই তো রূপক, এই রূপকের আড়ালে কবি কি মানব মনের চিরন্তন বিরহ বেদনাকেই রূপ দেন নি? মানুষের মনের এই এক চিরন্তন সমস্যাকে তিনি রূপ দিয়েছেন বলেই তো ‘মেঘদূত’ পুরোনো হয়েও পুরোনো নয়। মানবজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন হলে এই কাব্য কি যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে আবেদন করতে পারত? কালিদাসের যুগে অন্নবস্ত্রের কোনো সমস্যা ছিল না, ছিল না রেশন প্রথা বা কালোবাজার–কাজেই ওইসব তার বাক্যে স্থান পাওয়ার কথা নয়। আদি কবি বাল্মীকির প্রথম শ্লোকটাই স্মরণ করুন না, যাকে প্রথম কবি উক্তি বলে অভিহিত করা হয়। সে কি জীবন বিচ্ছিন্ন? এক ব্যাধ নিরপরাধ এক ক্রৌঞ্চকে বধ করে ক্রৌঞ্চ বধূর সমস্ত সুখ হরণ করেছে। সেই নিষ্ঠুরতার প্রতি ধিক্কার ধ্বনিই তো তার মুখনিঃসৃত প্রথম শ্লোক। এও তো এক রূপক। অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাল্মীকির মুখ দিয়ে সমস্ত মানব হৃদয়েরই ধিক্কার ধ্বনি কি উচ্চারিত হয় নি? ইতিহাসের শুরু থেকেই তো চিরকাল ধরে চলেছে এভাবে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। তার বিরুদ্ধেই তো আদি কবির বজ্রকণ্ঠের প্রতিবাদ। এভাবে যুগে যুগে সৎ-শিল্পীরা জীবনবোধের পরিচয় দিয়ে এসেছেন এবং আজকের দিনের শিল্পী সাহিত্যিকরাও সে ঐতিহ্যই বহন করে চলেছেন। 

রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন : 

আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে 
হেনেছে নিঃসহায়ে,
আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে 
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে 
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।

অথবা নজরুল যখন বলেন : 

বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
 যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না–
বিদ্রোহী রণক্লান্ত 
আমি সেইদিন হব শান্ত।

তখন কি আমরা আদি কবির কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই না? যুগের পরিবর্তন হয়েছে, ফলে ভাষারও পরিবর্তন ঘটেছে। ছন্দ ও অলঙ্কার প্রকরণ বদলে গেছে, প্রকাশভঙ্গিও নিয়েছে অন্যরূপ–না হয় এই তিন কবির কণ্ঠে একই সুরই তো ধ্বনিত হয়েছে–এই ত্রয়ীর চরিত্রগত রূপও একই? তাই আমার ধারণা, মহৎ শিল্পীরা কখনো জীবনবিমুখ হতে পারে না। মহৎ কথাটার অর্থ কী? যিনি মহৎ তিনি কখনো নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন–যিনি নিজেকে যত বেশি ব্যাপ্ত করে দিতে পারেন তিনিই তো তত বেশি মহৎ। শিল্পী ও সংস্কৃতি সেবীরা যদি নিজেদের চারপাশে ছড়িয়ে দিতে না পারেন, তাদের চারপাশে যে জীবন, সে জীবনের সঙ্গে যদি নিজেদের মেশাতে না পারেন, সেই সব জীবনের সমস্যাকে যদি নিজেদের মানস কল্পনার ও প্রতিভার উপকরণ করে না নিতে পারেন তা হলে তাদের শিল্প ও সংস্কৃতি সাধনা কখনো সার্থক হবে না। শিল্প ও সংস্কৃতি সেবীদের মনে রাখতে হবে–তাঁরা মানুষ, তাই কোনো মানুষই তাদের অনাত্মীয় নয়, কোনো মানুষের কথাই তাঁদের পক্ষে পর-চর্চা নয়। শুধু পঞ্চ ইন্দ্রিয় নয়, মানুষের আছে অনুভূতি, আছে ভাব ও কল্পনা–এ সবের সাহায্যে মানুষ প্রবেশের ছাড়পত্র পায় শুধু চেনা-অচেনা, জানা-অজানা মানুষের অন্তরে অন্তরে নয়, চেতন ও অচেতন সব কিছুর রহস্যলোক সে আবিষ্কার করতে পারে, ফলে সেই সবও হতে পারে সাহিত্য শিল্পের অঙ্গ, তার সঙ্গীত ও নৃত্যের উপকরণ। চৈত্রমাসের ঝরা পাতা কি বহু কবিতা ও গানের উপকরণ হয় নি? আমার চতুর্দিকের যে জীবন ও প্রকৃতি তা চেতন হোক কি অচেতন হোক তার সঙ্গে আমি নিঃসম্পৰ্কীয় নই–সে সবকে বাদ দিয়ে যে জীবন সে জীবন বাতায়নহীন কবরের জীবন। কালিদাস যে কন্বমুনির আশ্রমের অমন ঘটা করে বর্ণনা দিয়েছেন সে কি তার জীবনবিমুখতা? না, বরং তা জীবনেরই স্বীকৃতি। কারণ আশ্রমবাসীদের জীবন আর সেই আশ্রম-প্রকৃতি প্রায় এক হয়ে গিয়েছিল। আশ্রম-প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে কালিদাস যদি শকুন্তলা-চরিত্র আঁকতে চেষ্টা করতেন তা হলে তা অত্যন্ত অবাস্তব হতো। তাই আমি মনে করি, তাঁর কাব্যে আশ্রমকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি বরং বাস্তবতা ও জীবন বোধেরই পরিচয় দিয়েছেন। 

.

জীবনের প্রতি এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি সাহিত্য-শিল্পীর জন্য অত্যাবশ্যক। আজকের দিনে খাওয়া-পরার সমস্যা যে এক নিদারুণ রূপ নিয়েছে এ কারো অবিদিত নয়। স্বভাবতই তা আজ সাহিত্য-শিল্পেও এক বড় স্থান অধিকার করেছে। আজকের সাহিত্য শিল্পের এও এক উপজীব্য তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুঃসহ দুর্যোগ-দুর্ভাবনার শিকার হয়েও সাহিত্য-শিল্পীদের দিশেহারা হলে চলবে না। কারণ, সাহিত্য-শিল্পীর আদর্শ-জীবনের সামগ্রিক রূপেরই ধারণা–শত অভাব-অভিযোগ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও যে জীবন সুন্দর ও মহৎ। কোনো একদিকের প্রতি, বিশেষ করে জীবনের অভাবাত্মক দিকের প্রতি মাত্রাধিক জোর দিলে সামগ্রিক রূপ-কল্পনা ও ধারণা ব্যাহত হতে বাধ্য। সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতি সাধনার একটি বড় অবদান হল জীবনে মাত্রাজ্ঞান ও পরিমিতি বোধ জাগিয়ে তোলা। স্বয়ং শিল্পীরাই যদি সেই মাত্রাজ্ঞান ও পরিমিতি বোধ হারিয়ে বসেন তা হলে তাঁদের রচনা যে ভারসাম্যহীন ও মাত্রাজ্ঞানহীন হয়ে পড়বে তাতে আর বিচিত্র কী? আমাদের তরুণ সাহিত্য-ব্রতীদের কারো কারো রচনায় এ মাত্রাবোধের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলেই, কিছুটা অবান্তর হলেও কথাটা উল্লেখ করলাম। বলেছি, কোনো মানুষই সাহিত্য-শিল্পীর অনাত্মীয় নয়। এমনকি villainও তার অনাত্মীয় নয়। তিনি যখন villain-এর চরিত্র আঁকেন তখন villain-এর প্রতি ঘৃণা উদ্রেকে তার একটা উদ্দেশ্য থাকে বটে কিন্তু তার চেয়েও বড় উদ্দেশ্য থাকে villainও মানুষ, তার ভেতরও। যে মনুষ্যত্ব আছে তাকে আবিষ্কার করা, তাকে ফুটিয়ে তোলা। শেষোক্ত উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো শিল্প-ক্রিয়াই মহৎ শিল্পের মর্যাদা পেতে পারে না। সাহিত্যের সমৃদ্ধি শুধু লেখকের ওপর নির্ভর করে না–পাঠকের সহযোগিতাও অত্যাবশ্যক। সচেতন পাঠকের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সাহিত্যের প্রসার ও অগ্রগতি অসম্ভব। তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, যা ছাপা হয় তাই সাহিত্য নয়। এমন কি অনেক লেখকও মনে করেন যা লেখা হয় তাই ছাপার উপযুক্ত আর যা ছাপা হয় তাই সাহিত্য। এর মতো ভুল ধারণা আর হতে পারে না। তাই পাঠকের ভূমিকাও বেশ মূল্যবান। পাঠক যদি একটু বাছ-বিচার করেন অর্থাৎ বাছ-বিচার করতে সক্ষম হন, তিনি যদি কোন রচনা সাহিত্য পদবাচ্য তা পরখ করে নিতে শেখেন তা হলে বহু অবাঞ্ছিত রচনা পাঠকের উপেক্ষা ও অবহেলায় যথাস্থানে নির্বাসিত হবে ও সত্যকার সাহিত্য প্রসার লাভ করবে এবং সাহিত্য-সেবীরাও তাহলে নিজেদের রচনা যাতে সাহিত্যের মানে গিয়ে পৌঁছে তার জন্য প্রয়োজনীয় সাধনা ও শ্রম স্বীকার করবেন আর প্রতীক্ষা করতে শিখবেন। বলা বাহুল্য, সব রকম সৃষ্টির জন্য প্রতীক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এমন কি জননীও দশমাস প্রতীক্ষা করে থাকেন সন্তানের মুখ দেখার জন্য। 

[‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে। তখন এর নাম ছিল ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *