সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা
হিন্দু-মুসলমান-সমস্যা ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠেছে। এই সমস্যা সমাধানের যে সব চেষ্টা হচ্ছে তা বিশেষ সফলতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে না। সব চেষ্টাই এমনভাবে বিফল হবার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মনে হয়েছে–এই সংঘর্ষের জন্য বাংলা সাহিত্যও অনেকখানি দায়ী। এর অনেক স্থলে সত্যের অপলাপ ও প্রেমের অভাব দৃষ্ট হয়। অনেকস্থলে অহিন্দু বলেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক কতকগুলি লেখকের দ্বারা মুসলমানের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা হয়তো সত্য নয়, অথবা যদি সত্য হয় তবে তার পার্শ্বে হিন্দুর যে চিত্র দাঁড় করান হয়েছে সেটি হয়তো সত্য নয়। সোজা কথায়, আমাদের সাহিত্যে যেখানে হিন্দু মুসলমান উভয়কে আঁকা হয়েছে সেখানে হিন্দুকে শুধু হিন্দু বলেই বড় করার চেষ্টা হয়েছে। বাঙালী জাতির কল্যাণকে উদ্দেশ্য ক’রে আমাদের সাহিত্য গড়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারটা যদি পুস্তক বিশেষে বা লেখক বিশেষে আবদ্ধ থাকত তা হলে হয়তো বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না। কিন্তু নানা কারণে মুসলমানের মনে হয় যে, ধারাবাহিকভাবেই মুসলমানের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। মুসলমান বলে যে, এটা বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষত্ব।
অনেক সময়ে দেখা যায় যে, সময়ের দোহাই দিয়ে অনেক নৃশংস পাপকে পাপ বলে বিবেচনা করা হয় না। যেমন শিবাজীর দ্বারা আফজল খাঁর হত্যা। নরহত্যা মহাপাপ! যত বড় কারণই থাক না কেন, যা পাপ তা পাপই, আর কিছুই নয়। অসহিষ্ণু মানুষ তার সমস্ত যুক্তি তর্ক দিয়ে নিজকৃত পাপকে ঢাকতে চাইলেই পাপ পুণ্যে পরিণত হবে না। আবার অনেক সময়ে দেখা যায় যে, যে জিনিষটি একজনের বেলায় ধর্ম-সাম্রাজ্য স্থাপন, ঠিক সেই জিনিষটি লোক-বিশেষের বেলায় রাজ্য-বিস্তার লালসা।
জাতি বা সম্প্রদায়গত ঈর্ষা জিনিষটি কারও কারও পক্ষে মুখরোচক হতে পারে, কিন্তু যে-সাহিত্যের দ্বারা কোনরূপ বিরোধ সৃষ্টি হয় সে সাহিত্যের অন্য অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও দেশের কল্যাণ হিসাবে তার মূল্য খুব বেশী নয়। সাহিত্যে ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়গত গাল-মন্দ বা কোনোরূপ অশ্লীলতা রুচি ও বিচারবুদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহই জাগিয়ে দেয়।
সাহিত্যে মুসলমানের প্রতি অবিচার করা হয়েছে– মুসলমানের এইরূপ একটি বদ্ধ সংস্কার জন্মেছে। এই সংস্কারকে উপেক্ষা করা উচিত কিনা এসম্বন্ধে সাহিত্যসেবীদের ভেবে দেখবার সময় এসেছে। শুধু ভাবলেই এর মীমাংসা হবে না, যে ধারাটি চলে এসেছে সেটিকে ফেরাতে হবে। সংসার-নিবদ্ধ-দৃষ্টি রাজনীতিবিশারদ আত্মপরায়ণ হিন্দু বা মুসলমান সাহিত্যিক সে-শক্তি অর্জন করতে পারবেন না; এর জন্য প্রকৃত সত্যসন্ধ উদার মানবপ্রেমিক সাহিত্যিকের আবির্ভাব চাই। আমাদের দেশে দুই একজন বড়দরের কবি ও ঔপন্যাসিক জন্মেছেন; কিন্তু তাঁরা জাতি ধর্ম বাদ দিয়ে সমগ্র দেশের কল্যাণের কথা ভাবতে খুব বেশী চেষ্টা করেননি, স্বদেশ-প্রেমিকতার বড় আদর্শ আঁকতে এখনও পারেননি, হয়তো তাঁরা তা আঁকতেই চাননি, অথবা ওটা অসম্ভব মনে ক’রে পাশ কাটিয়েই চলেছেন।
মুসলমান-চরিত্র অঙ্কনে সব হিন্দু সাহিত্যিকই যে অবিচার করেছেন, তা নয়। অনেক সাহিত্যিকই, এমন কি দুই এক জন মহিলা-সাহিত্যিকও, মুসলমান-চরিত্র অঙ্কনে মাঝে মাঝে যে উদারতা ও প্রীতিপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রেম ও প্রীতির যথেষ্ট অভাব থাকায় উদার সাহিত্যিকের উদারতার কথা সাধারণ মুসলমানের মনক্ষতের উপর প্রলেপের কাজ কর্তে পারেনি; অনেক সময়ে তার মনে হয় যে, তা দয়ার দান মাত্র– প্রেম প্রীতির পরশ নয়। তা ছাড়া তেতো জিনিষটার স্বাদ মুসলমানের জিহ্বাকে এমনই আড়ষ্ট ও বিকৃত ক’রে ফেলেছে যে, মিষ্টের আস্বাদের অনুভূতিই যেন তার লুপ্ত হয়ে গেছে!
কল্পনার সাহায্যে লোক-বিশেষের চরিত্রকে সুন্দর বা বিশ্রী ক’রে দেখালে যে কোনো লাভই হয় না, এমন নয়। সাহিত্যে মুসলমান চরিত্রের বিশ্রী দিকটা দেখান হয়েছে বলে সাধারণ মধ্যবিত্ত মুসলমান অনেকখানি সাবধান হতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো তারা আরও সাবধান হতে সক্ষম হবে। বর্তমানেও মানুষ হিসাবে (man for man) সাধারণ মুসলমান সাধারণ হিন্দু অপেক্ষা অনেক বিষয়েই ভালো। সব মুসলমানই ভালো, এমন কথা নিশ্চয়ই বলা হচ্ছে না। বরং কাণ্ডজ্ঞানহীন মুসলমানের সংখ্যাধিক্য দেখলে দুঃখই হয়। এই কাণ্ডজ্ঞানহীন মুসলমানের দৌরাত্ম্যের জন্য কে দায়ী সে আলোচনা থাক। শুধু এইটুকু বলি–বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের প্রতি অবিচার করা হয়েছে এবং তাতে ক’রে যে প্রেমের অভাবের পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা যে হিন্দু-মুসলিম-বিরোধের জন্য কিয়দংশে দায়ী এ-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
সাহিত্য সাধারণের মনকে চালিত করে। সাহিত্যে যদি প্রেম-প্রীতির অভাব দৃষ্ট হয়, তা হলে জীবনেও সে-অভাবটি সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায় যে, পাত্রের অভাবে তৃষ্ণার্ত মুসলমান হিন্দুর বাড়ি থেকে নিরাশ হৃদয়ে শুষ্ক কণ্ঠে ফিরে আসতে বাধ্য হয়; আবার পাশের বাড়ীর উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত হিন্দু যুবক ভালো একটি চাকুরী পেলে মুসলমান পড়শীর মুখ ঈর্ষায় বিবর্ণ হয়ে যায়।
জাতীয় জীবনে এমনতর ঈর্ষা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সাহিত্যে আবার সেই ঈর্ষাই আঁকা হচ্ছে। তাতে ক’রে চক্রবৃদ্ধি হারে সেই ঈর্ষা বেড়ে চলেছে। দেশের এই দুর্দিনে কল্যাণ-জিজ্ঞাসু কাব্যস্রষ্টা ও সাহিত্যিক দ্রষ্টা এই ঈর্ষা বিদ্বেষের গতিরোধ করবার জন্য চেষ্টা না পেলে দেশের কল্যাণ সাধন কি সুদূরপরাহত হবে না?
সৃষ্টি একেবারে শূন্যের উপর খাড়া করার চেষ্টা অনেক সময়ে একেবারে ব্যর্থ হয়ে যায়। সত্যের উপর নির্ভর ক’রে যে সৃষ্টি সে-সৃষ্টিই স্থায়ী ও বাঞ্ছনীয়।
হিন্দুর উজ্জ্বল ও সুন্দর চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বিরল নয়। এতে লাভ লোকসান কতটুকু হয়েছে তা বিচার্য। হিন্দুর আদর্শ সংযমের দৃষ্টান্ত সাহিত্যে যেমন দেখা যায় জীবনে তেমন দেখা যায় না; এর একমাত্র কারণ, সাহিত্যিকের কল্পনার সহিত বাস্তবের একান্ত দূরত্ব। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার নিকট-সম্বন্ধ যদি না থাকে তবে কল্পনা শুধু কল্পনাতেই পর্যবসিত থাকবে, বাস্তব হস্ত প্রসারিত ক’রে তার নাগাল না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বলতে বাধ্য হবে যে ‘আঙুর ফল টক’; তখন সাহিত্যের কল্পনার গোঁজামিল ধরা পড়বেই এবং জীবনে নিছক কল্পনাকে পাশ কাটিয়ে চলতে কেউ আপত্তি করবে না।
অবশ্য কল্পনা চিরকালই কল্পনা, এবং বাস্তব ও কল্পনায় প্রভেদ চিরকালই থাকবে; কিন্তু কল্পনা যদি এমন হয় যে বাস্তব জীবনে তার উপলব্ধি একেবারে অসম্ভব হয় এবং সেই ধারণা দৃঢ় হয়ে যায়, তা হ’লে সে কল্পনার কোনো মূল্য নাই বলা যেতে পারে। তাই কল্পনা এমনতর হওয়া দরকার যে, মনে যেন হয়, আর একটু অগ্রসর হ’তে পারলেই সেই মানস-সুন্দরীর আলিঙ্গন লাভ অবশ্যম্ভাবী। বাংলা সাহিত্যে কল্পনা ও বাস্তবের দূরত্ব কিছু অস্বাভাবিক রকমে বেশী। অবশ্য যদি এই সব কল্পনা বিদ্বেষ- বিবর্জিত এবং আনন্দদায়িনী কল্পনা হয় তা হলে কল্পনা ও বাস্তবের দূরত্বে আপত্তি থাকতে পারে না। সাহিত্যের কোনো কোনো শাখা, যেমন গীতিকাব্য ইত্যাদি– যেখানকার কল্পনায় আনন্দ-সৃষ্টিই কেবল উদ্দেশ্য, সেসবের বেলায় কল্পনার মূল্য অস্বীকার করতে বলা নিষ্ঠুরতা ভিন্ন আর কিছু নয়। বাংলা সাহিত্যের এই বিভাগ ছাড়া অন্যান্য বিভাগে কল্পনা ও বাস্তবের দূরত্ব বেশী করেই ধরা পড়ে। সে সব বিভাগে আদর্শ-চরিত্রাঙ্কনে বিজাতি বিদ্বেষের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বিদ্বেষ জিনিষটি বিষ, এবং আদর্শ-সুধায় বিদ্বেষ-গরল মিশ্রিত থাকলে আদর্শ অনেকখানি শ্রীহীন হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ বাংলা সাহিত্যে-গৃহীত শিবাজী চরিত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। শিবাজী নিশ্চয়ই একজন বুদ্ধিমান ও অসাধারণ লোক ছিলেন, সেই মুক্তিকামী বীরকে দেবতার আসন দিতে কারও আপত্তি না থাকাই উচিত; কিন্তু আওরঙজেবের মতো বিরাট শক্তিশালী সম্রাটের খর্বতার ভিত্তির উপর সেই দেবত্বের প্রতিষ্ঠা হওয়ায় শিবাজীর দেবত্বও কি খর্ব হয়ে যায়নি? তা ছাড়া শিবাজী-চরিত্র অঙ্কনে যে পক্ষপাতিত্ব দেখান হয়েছে তাই কি তাঁকে ম্লান ক’রে দেয়নি?
হিন্দুর বাস্তব জীবনে সূক্ষ্ম বিচারের এমনি অভাব-হেতু দেখতে পাই, বিদ্যাসাগরের মতো উদার হিন্দুর প্রতিষ্ঠিত কলেজে মুসলমান শিক্ষার্থীর কোনো স্থান নাই। সাহিত্যের পুষ্পোদ্যানে বিদ্যাসাগরের মহত্ত্বের যে সৌরভ পাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজের আশেপাশে তা পাই না।
বিদ্যাসাগর ঠিক কি ধাতুতে গড়া ছিলেন তা প্রত্যক্ষ জানি না, কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই ছিলেন সোনা; কিন্তু তাঁর স্মৃতির সঙ্গে জড়িত একটি প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় বাংলার এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের জন্য এতটুকু স্থান যাঁরা রাখেননি তাঁদের উদারতা কি অনেক খানি খর্ব হয়ে যায়নি?
অবশ্য একথা সত্য যে, বিদ্যাসাগরের মতো লোককে বাদ দিয়ে, বাস্তবিক চরিত্রবান না হয়েও লেখার জোরে চরিত্রবান বলে প্রতিপন্ন হবার আশা আজ হিন্দু- সমাজে বেশ চল হয়ে উঠছে। জয়গর্বে গর্বিত মোহান্ধ হিন্দু তাই আজ অনেকখানি অসাবধান। এই সব মোহান্ধ হিন্দুর যে-জয় সে-জয়ের মূল্য নিরূপণ সময়ের উপর নির্ভর করছে। সত্যকে মিথ্যা বা মিথ্যাকে সত্য সাজিয়ে যে জয়লাভ, কিম্বা বিদ্বেষের ভিত্তির উপর নির্ভর ক’রে যে জয়, তার স্থায়ীত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করা স্বাভাবিক। সত্য বড় কঠোর; সে কারও খাতির রাখে না। দরকারের দিনে সে বজ্রকঠোর নিনাদে নিজেকে ঘোষণা করবে এবং তার সর্ব আভরণহীন তীব্র জ্যোতিতে মিথ্যা অন্তর্হিত হয়ে যাবে।
মানুষ সব সহ্য করতে পারে কিন্তু কথার খোঁচাটা তার বড় বাজে। বাংলা সাহিত্যের আদালতে গর-হাজীর মুসলমান মর্মে মর্মে অনুভব করেছে যে, তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তার সম্বন্ধে সাহিত্যিক-বিচারক যে-রায় দিয়েছেন তা তার পক্ষে বড় তীব্র। তার ঝাঁঝ অনেক সময়ে তাকে আত্মহারা ক’রে ফেলে। সে জানে না কোন্ পথে চললে সে নিরাপদ।
সাহিত্যে অনেক স্থলে দেখা যায় যে, যেখানে মুসলমান ক্ষমা করেছে সেখানে সে হীনবীর্য কাপুরুষ, যেখানে সে নিজের জিদ বজায় রাখতে চেষ্টা করেছে সেখানে সে নিষ্ঠুর অত্যাচারী ম্লেচ্ছ। মুসলমানের বীর্যের নাম দাম্ভিকতা, তার শক্তির নাম গুণ্ডামি, তার দয়ার নাম ভণ্ডামি, তার ক্ষমার নাম কাপুরুষতা, তার প্রেমের নাম কামলিপ্সা, –এ যে তার পক্ষে অতি বড় কঠিন পরীক্ষা!
মুসলমানের বিরুদ্ধে একটি প্রধান অভিযোগ বাংলা সাহিত্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশলাভ করেছে যে, সে হিন্দুর মূর্তি ভেঙেছে। এই মূর্তি ভাঙার ব্যাপারটির বিচার শুধু এক দিক দিয়ে করা হয়েছে। এখানে মুসলমানের দিক দিয়েও বিচার ক’রে দেখা উচিত। যেখানে প্রেম থাকে সেখানে অপরাধীর আচরণের বিচার অপরাধীর দিক দিয়েও করা দরকার। মুসলমান মূর্তি ভেঙে হিন্দুর প্রতি প্রীতির পরিচয় দেয় নাই সত্য; কিন্তু কবেকার সেই ব্যাপার তার জন্য হিন্দু আজও মুসলমানকে ক্ষমা করতে পারে নাই। বৌদ্ধরাও হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ভেঙেছিল সে-কথা হিন্দু জানে, কিন্তু হিন্দু বলবে–এ অপরাধের জন্য মুসলমানকে কেন ক্ষমা করবো? এ ‘কেন’র উত্তর হিন্দু পেত যদি সে বৃহত্তর জাতীয় মঙ্গলের কথা ভাবতে পারত! সে কথা থাক্। মূর্তি ভাঙার অন্য একটি দিকের কথাই বলি।
দীনেশ বাবু তাঁর “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” পুস্তকে লিখেছেন–”দ্বাদশ হইতে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গ ও উড়িষ্যায় এক অতিশয় দুর্গতির দিন উপস্থিত হইয়াছিল।… এই যুগের তাম্রশাসনগুলিতে হরপার্বতীর বন্দনায় তাঁহাদের হাবভাব ও পরস্পরের আলিঙ্গনবদ্ধ প্রেম যে ভাবে বর্ণিত হইয়াছে–তাহা শীলতার অভাব ও রুচিবিকার সূচনা করিতেছে। সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালায় হরপার্বতীর সেই সময়কার একখানি বীভৎস প্রস্তরমূর্তি আছে। পূরী ও কোণার্ক মন্দিরের গাত্রে খোদিত মূর্তি সমূহের দিকে চাহিতে চক্ষু লজ্জায় অবনত হইয়া পড়ে।”
উপরোক্ত বর্ণনা পড়ে মনে হয় যে, মুসলমান মূর্তি ভেঙে হিন্দুর প্রতি প্রেমের পরিচয় দেয় নাই বটে কিন্তু হিন্দুর মহা উপকার করেছে। মূর্তি ভাঙার দরুণ মুসলমান চরিত্র নৃশংস প্রতিপন্ন হয়েছে; কিন্তু মূর্তি ভাঙায় যা কিছু সুফল লাভ হয়েছে তার জন্য কোনো প্রকার কৃতজ্ঞতা হিন্দুরা বাংলা সাহিত্যের মারফৎ আজ পর্যন্ত জ্ঞাপন করেনি।
মুসলমান চরিত্রে কালি লেপে তাকে দীনহীন করার যে চেষ্টা তা হয়তো একদিন মুছে যাবে, কারণ, ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব মাত্রেরই বিঘ্ন বিজয়ের এক অদ্ভুত ক্ষমতা দৃষ্ট হয় যার জন্য সে উন্নততর সফলতা ও উচ্চতর জয়লাভের জন্য প্রস্তুত হতে সক্ষম হয়। বাস্তবিক পক্ষে দুঃখ দৈন্য ভগবানের রাজ্যের এক অপূর্ব সম্পদ! কালস্রোতে কার কখন উন্নতি এবং কার অবনতি সে যিনি কালের দেবতা তিনি ভিন্ন আর কেউ জানেন না। আজ হয়তো মুসলমান অনেক বিষয়েই রুচিবিকারের পরিচয় দিচ্ছে, কাল হয়তো সে শোধরাবে। যদি না শোধরায় তবে তার দুর্ভাগ্য। কিন্তু আজ যাঁদের উপর নেতৃত্বের ভার তাঁরা যদি অনবরতই ভুল করেন তবে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণকারীরাও যে ভুলই করবে এবং তাতে ক’রে দুঃখ যে ক্রমে বেড়েই চলবে!
কোনো তীব্র মন্তব্যের দ্বারা দেশের মঙ্গলের আশা করা বিড়ম্বনা। সাহিত্যিকের পথ নির্দেশ ক’রে দেবার মতো ধৃষ্টতা কারো নাই। সাহিত্যিক তাঁর স্বীয় অনুভূতি, তাঁর ভিতরকার অনুপ্রেরণা দ্বারাই পরিচালিত হবেন। তবে একথা ঠিক যে, বর্তমানকালে সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলমান, এ কথাগুলো বাদ না দিলে সৎসাহিত্য ঠিক মতো গড়ে উঠবে না। সাহিত্যিক এসব সম্বন্ধে আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে কোনো শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি সম্ভব ক’রে তুলতে পারবেন না।
হিন্দু মুসলমানের বিরোধ, পড়শীর প্রতি অবিশ্বাস, অপ্রেম, এত বড় দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তির চেষ্টা করা সবার দরকার। প্রার্থনা–ভগবান যেন এই দুর্ভাগা দেশকে চির লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দিয়ে সত্য ও প্রেম, জ্ঞান ও কল্যাণের দিকে অগ্রসর হবার মতো শক্তি দেন, হিন্দু মুসলমান সবাই যেন পূর্ণ প্রস্ফুটিত মানুষ হতে সক্ষম হয়!