সাহিত্যে আধুনিকতা
এক
সাহিত্যে আধুনিকতা কথাটা হালের উৎপত্তি। হাল মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগ। এর আগে সাহিত্যের আলোচনা ও মূল্যবিচার স্রেফ সাহিত্য হিসেবেই হতো। সাহিত্যের ব্যাপক ও সার্বিক রূপ ছিল তখন একমাত্র মূল্যায়নের বিষয়। রচনার মান নির্ণয় হতো সর্বকালীন ঐতিহ্যের মাপকাঠি দিয়ে। তখন কারুকার্যের চেয়েও বাণীর সৌন্দর্য ও সংবেদনশীলতার মূল্য দেওয়া হতো বেশি–সাময়িকতার চেয়েও চিরন্তনতার।
সাহিত্য তখন কাল-চিহ্নিত ছিল না। ইংরেজি সাহিত্যের কাল বা যুগ বিভাগ অনেকখানি মনগড়া ও বেপরোয়া। কারণ ওটা ওদের মত দেব-দেবী রাজা-রাণীর রাজতুকাল অনুসরণ করেই চিহ্নিত। বলা যায়, ওটা ইংরেজের ক্রাউন প্রীতির অন্যতম স্বাক্ষর। না হয় রাজা রাণীর তিরোধান বা সিংহাসন আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য রাতারাতি খোলস বদলায় না, নেয় না নতুন মোড় বা নবজন্ম। ষষ্ঠ জর্জের আকস্মিক মৃত্যুর পর কন্যা এলিজাবেথ সিংহাসনে বসলেন বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাতে ইংরেজি সাহিত্যে কোনো নবদিগন্তের দুয়ার খুলে গেল না বা বন্ধ হলো না পুরোনো স্রোত। প্রথম এলিজাবেথ ও ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকাল ছিল সুদীর্ঘ–এ সুদীর্ঘকালে বহির্জগতে এমন সব ঘটনা ঘটেছে যার ফলে ইংরেজের মনমানস হয়েছে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ। পণ্য উৎপাদন, বণ্টন, বাজার ও সাম্রাজ্যের অভাবনীয় বিস্তার ইংরেজের জীবনে একদিকে নিয়ে এসেছিল সমৃদ্ধির নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা, অন্যদিকে জীবন সম্বন্ধে নব নব চেতনা ও মূল্যবোধ, তার চর্চা ও প্রকাশের অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা, যা প্রতিফলিত হয়েছে সে যুগের সাহিত্য ও শিল্পে এবং জীবনের বিকাশ ও মননশীলতার আরো বহুতর ক্ষেত্রে। এ সঙ্গে মনে রাখতে হবে ইংল্যান্ডের দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য যার সাক্ষাৎ অনুষঙ্গ লেখা ও লেখকের স্বাধীনতা।
ইংরেজের এসব উত্তরাধিকার বা তার পটভূমি রচনায় সাক্ষাভাবে এলিজাবেথ বা ভিক্টোরিয়ার কোনো হাত ছিল না, এ সবের গৌরবের ভাগী ন্যায়ত তারা নন। এ সব আরোপিত গৌরব। ইতিহাসের ও জন্ম-মৃত্যুর অমোঘ বিধানে তখন তারা ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন শুধু। বাইরের ঘটনা প্রবাহই সেদিন ইংরেজের জীবনে ও মন-মানসে নিয়ে এসেছিল বিপুল আলোড়ন, উৎফুল্ল এক জীবনবোধ, যার ফলে সে যুগের বুদ্ধিজীবী ইংরেজের সমস্ত সত্তা হয়ে পড়েছিল জীবন-জিজ্ঞাসায় উৎসুক, উন্মুখ, প্রকাশ বেদনায় অধীর, অস্থির। জীবন-জোয়ারের সে এক অপূর্ব জলতরঙ্গ। কাজেই কোনো ব্যক্তি বিশেষ নয়, বাইরের ও ভেতরের ঘটনা প্রবাহই যুগবিশেষকে নতুন চেতনা ও নতুনতর জীবন-জিজ্ঞাসায় সজাগ ও উদ্বুদ্ধ করে তোলে। এ নতুন চেতনারই ফলশ্রুতি সাহিত্য ও শিল্পে নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য।
রাজতন্ত্রের যুগে ওই ছিল কাল-বিভাগের রেওয়াজ আর ওটা করেছেন ঐতিহাসিকরা নিজেদের সুবিধার খাতিরে। না হয় আমাদের সাহিত্যের রবীন্দ্র যুগ এমন কি নজরুল যুগ বললে যা বুঝায়, এলিজাবেথ কি ভিক্টোরিয়া যুগ বললে তা বোঝায় না। ওই রকম কোনো অর্থের দ্যোতনা নেই তাতে। ওদের কাল-বিভাগ অনেকখানি প্রস্তর-যুগ, লৌহ যুগের মতো জড় ব্যাপার। রাজা-রাণীকে ব্যবহার করা হয়েছে মাইলস্টোনের খুঁটির মতো। দক্ষ সওয়ারি যেমন অশিক্ষিত ও অবাধ্য সওয়ারকেও অনায়াসে গন্তব্য স্থানে। নিয়ে যায়, তেমনি মহৎ প্রতিভা আর মহাব্যক্তিতুও বিক্ষিপ্ত ঘটনা প্রবাহকে উচ্চতর তথা সুস্থ ও স্বাভাবিক সাহিত্যলোকে নিয়ে যেতে পারেন–তাঁরা নিজেরা ঘটনার ক্রীড়নক না হয়ে ঘটনাকে করেন নিজেদের ক্রীড়নক। তবে এরা রাজা-রাণী নন। রবীন্দ্রনাথের সুদীর্ঘ জীবন পৃথিবীর বিচিত্র ঘটনা প্রবাহে কীভাবে সাড়া দিয়েছে এবং ওই সব তার হাতে কীভাবে সাহিত্যের উপজীব্য হয়েছে রবীন্দ্র-জীবনী তার এক প্রামাণ্য দলিল।
একের পর এক দুই বিশ্বযুদ্ধ সাহিত্যিক শিল্পীদের সামনে যে অভাবনীয় ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এসেছে তা যেমন ব্যাপক তেমনি দুর্বার। এর ধাক্কা থেকে যুদ্ধে সাক্ষাৎভাবে লিপ্ত বা নির্লিপ্ত কোনো দেশ গা বাঁচাতে পারে নি। এ দুই ধাক্কায় শুধু সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রের উত্থান পতন ও ভাঙা-গড়া ঘটে নি, মানুষের মনে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত, লালিত বহু ধারণা, বিশ্বাস, নীতি ও মূল্যবোধও ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। মুহূর্তে ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি ইত্যাদির মানে গেছে বদলে। মানুষের মন হয়েছে সব রকম আদর্শচ্যুত, উদভ্রান্ত হয়েছে অগণিত যুদ্ধ-ফেরত তরুণ আর সারা দুনিয়ার বিক্ষত-হৃদয় বুদ্ধিজীবীরা, যুদ্ধের নির্মমতা যাদের বুদ্ধি ও অনুভূতিকে করে দিয়েছে ছিন্নভিন্ন তারা চোখের সামনে দেখেছেন নির্মম ও অকারণ ধ্বংসের আর অহেতুক হত্যার এক পৈশাচিক রূপ। মনের ভেতর এক বিরাট শূন্যতা নিয়ে যারা যুদ্ধ থেকে ফিরে এল তাদের অনেকেই দেখল কোথাও মাথা রাখার ঠাঁই নেই–মনের ভেতর যেমন সব কিছু ভগ্ন ধ্বংসস্তূপে পরিণত, বাইরেও তাই। এমন ফাঁকা ফাঁকা ও ত্রিশঙ্কুদশী মানুষের মনে জাগিয়ে তুলেছিল নবমানবতাবোধ, মনুষ্যত্বে আর সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আস্থা, নীতি ও সঙ্কর্মে বিশ্বাস, ধর্ম ও প্রেমে স্বস্তি ও আশ্রয়–যুদ্ধ সে সবই ভেঙে তছনছ করে দিলো–মানুষ হলো সর্বতোভাবে দেউলিয়া। সামনে কোনা আশা-ভরসা নেই, নেই কোনো আশ্রয় ও অবলম্বন। মনের সব প্রদীপ গেছে নিবে। মনের এ অবস্থায় ঈশ্বর, স্বর্গ, প্রেম, ধর্ম সবই হয়ে গেল তুচ্ছ ও তাচ্ছিল্যের ব্যাপার। দ্বিধা, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও সংশয়ে সব মন আলোড়িত ও বিপর্যন্ত। এ পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিতে যে সাহিত্যের জন্ম তা-ই নাম পেলো আধুনিক বা অতি আধুনিক। ইংরেজিতে অভিহিত হলো modernist বলে।
একটা সর্বব্যাপী অসন্তোষ, বিদ্রোহ, চলতি কিছুকে না মানার এক বেপরোয়া ঔদ্ধত্য, ইচ্ছে করে সব রকম সংযম ও শৃঙ্খলাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া, দুর্বল বোহেমিয়ানার সাহায্যে রচনায় নবত্ব আনার প্রয়াস–এ সব মনোভঙ্গিই এই সাহিত্যের পটভূমি। ফলে এমন সব বিষয়বস্তুর আমদানি হলো যা আগে কদাচিৎ সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। বলা বাহুল্য, বিষয়বস্তুর ও লেখকের মনোভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিকের পরিবর্তন অপরিহার্য। কারণ, ভাবের বাহন যেমন ভাষা তেমনি বিষয়বস্তুরও। বিশেষ করে লেখক যেখানে সাহিত্যের প্রেরণায় নয়, ইচ্ছে করে ভিন্নতর হওয়ার সচেতন চেষ্টায় লিখছেন সেখানে আঙ্গিকে বৈপরীত্য অনিবার্য। শিল্পীর তন্ময়তা এখন শুধু উপেক্ষিত নয়, রীতিমতো Tarifto I have come to hold sacred, the disorder of my mind.’ (র্যাবোঁ)। আধুনিক সাহিত্যের এ হলো এক নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার অন্যতম মুখপাত্র অচিন্ত্য সেনগুপ্ত লিখেছেন : ‘আধুনিক মানেই প্রগতিপন্থী। প্রগতি মানে প্রচলিত মতানুগত না হওয়া’। অতএব যা কিছু চলতি হতে হবে তার বিপরীত পন্থী। এ হল আধুনিকতার এক বড় লক্ষণ। এ যুগে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-রথী, প্রধানতম সাহিত্য স্রষ্টা–তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে তিনি একাগ্র সাধনায় বাংলা সাহিত্যকে সাফল্যের এক মহৎ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। তবুও কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়াই করতে হবে তার বিরুদ্ধতা, হতে হবে তার বিপরীত, তার থেকে আলাদা। অর্থাৎ হতে হবে নিবারণ চক্রবর্তী। আর তাদের ধারণা—’রবি ঠাকুরের লেখা যতক্ষণ না লোকে একেবারে ভুলে যাবে ততক্ষণ এর (অর্থাৎ নিবারণ চক্রবর্তীর) ভালো লেখা সত্য করে ফুটে উঠবে না।’ (শেষের কবিতা)। আর নিবারণ চক্রবর্তী তথা নিজেদের কবিতা সম্বন্ধে তাদের ধারণা হচ্ছে—’এ শুধু লিরিক নয়, নিষ্ঠুর জীবনতত্ত্ব।’ (ঐ)। আধুনিক সাহিত্যিক শিল্পীরা যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর কাছ থেকেই এ নিষ্ঠুর জীবনতত্ত্বের পাঠ পেয়েছেন ও গ্রহণ। করেছেন। সাহিত্য সাহিত্যিকের মনের ফসল। কাজেই এ সাহিত্য যারা রচনা করছেন। বা করেছেন তাদের মনের অবস্থা বুঝেই এ সাহিত্যের দিকে তাকাতে হবে এবং সে ভাবে করতে হবে তা বিচার। মূল্যায়নের পুরোনো মাপকাঠি এখানে অচল। তা হলেও সাহিত্যের একটা সর্বজনস্বীকৃত মানদণ্ড আছে বৈকি। শেষ কালে প্রাচীন কি আধুনিক সব সাহিত্যকে সেখানে গিয়েই দাঁড়াতে হবে। বলা বাহুল্য, আধুনিক মানে হালের বা সমসাময়িক নয়। বাংলা সাহিত্যের যারা আধুনিক বা অত্যাধুনিক নামে একদিন অভিহিত হয়েছিলেন, তারা কাল বা বয়সের হিসেবে তা হন নি। মনমেজাজ, সুর-ব্যঞ্জনা ও ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই অর্থাৎ সেদিন যা চলতি ছিল তার পরিপন্থী ছিলেন বলেই বিপক্ষ দলের পরিভাষায় তারা আধুনিক, পরে অতি-আধুনিক নামে বিশেষিত হয়েছিলেন। অবশ্য নিন্দা অর্থেই তারা প্রয়োগ করেছিলেন এ বিশেষণ দুটি।
দুই
সাহিত্যে আধুনিকতার পটভূমির কিছুটা পরিচয় পাওয়া গেল। তার লক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিণাম ও পরিণতি কী ও কতটুকু তা বিচার করে দেখা উচিত।
আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আধুনিক কাব্য পরিচয়’ পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন : ‘দেখলুম তার অনেক কবিতাই আমাদের কালের হাট থেকে এসেছে। তার আকৃতি চেনা, তার প্রকৃতিও। তা হলে বলতে হবে আধুনিক কবিতা বহু প্রাচীন কাল থেকেই চলে এসেছে, কবির প্রেয়সী বুড়ি হয় না। এ সংকলন গ্রন্থে অনেক কবিতা দেখলুম যাতে কাল শিল্পী বিকৃতিকে নতুনত্ব বলে স্পর্ধা করেছে। বিকৃতি তার অস্বাভাবিকতা দ্বারা চমক লাগায়–যে জন্যে আপন পোষা জীব-জন্তুর মধ্যে ইচ্ছা করে মানুষ বিরূপের সন্ধান করে। অস্বাভাবিক আকষ্মিক, স্বাভাবিক চিরকালের। বিশেষ করে আধুনিকতার আদি যুগে লেখকরা ইচ্ছে করেই অস্বাভাবিক হতে চেষ্টা করেছেন, স্বাভাবিকতা ছেড়ে বিকৃতির করেছেন সন্ধান, করেছেন সাধনা। নূতন কিছু কররে ভাই নূতন কিছু করো’–এ ছিল একমাত্র মনোভঙ্গি। এখন জিজ্ঞাস্য: এটুকু পুঁজি সম্বল করে সাহিত্যের পথে কতটুকু এগিয়ে যাওয়া সম্ভব? আমাদের সাহিত্যের আধুনিক-চিহ্নিত কালের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এতে সাহিত্যের তেমন কোনো স্থায়ী লাভ হয় নি। রবীন্দ্রনাথ যে স্বাভাবিকতার কথা বলেছেন তা অনুসরণ করে সাহিত্য যেমন একদিকে আধুনিক হতে পারে অন্যদিকে আধুনিক হয়েও হতে পারে ‘চিরকালের’। রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনাতেই রয়েছে তার অজস্র দৃষ্টান্ত। চণ্ডালিকা, তাসের দেশ, রক্তকরবী, শেষের কবিতা, চার অধ্যায়–বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক আধুনিকতা চর্চার যুগেই রচিত, তখনকার সামাজিক, অর্থনৈতিক বহু সমস্যাই এসব রচনার উপকরণ ও প্রেরণা জুগিয়েছে। তা সত্ত্বেও এসব রচনা আধুনিকতার সীমা ডিঙিয়ে চিরকালের সাহিত্য হতে বাধা পায় নি–একবার পড়ে বা অভিনয় দেখে এসবকে বাতিল করে দেওয়া যায় না। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ঢেউ অনুপ্রবেশের বহু আগে রবীন্দ্রনাথের যা কিছু সাহিত্যকর্ম তাতেও সমসাময়িক যুগ-জিজ্ঞাসা প্রতিফলিত হয়েছে–চোখের বালিতেই তো আধুনিক উপন্যাসের ভিতপত্তন। গোরা ও ঘরে বাইরেও সমকালের পটভূমিতেই বিধৃত। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন পৃথিবীর তাবত বড় শিল্পীর রচনায় তাই ঘটেছে, কেউ যুগ বহির্ভূত বা যুগান্ধ ছিলেন না। গ্যেটে, টলস্টয়, শরৎচন্দ্র বা রোমা রোঁলা যার কথাই ধরা যাক না কেন–সবাই যুগপ্রতিনিধি হয়েও যুগাতীত। অর্থাৎ চিরকালের সাহিত্যই তারা রচনা করেছেন–শুধু সমসাময়িক কালের মধ্যে তাঁদের রচনা সীমিত হয়ে নেই। এঁদের সকলের রচনায় আধুনিকতা যে পর্যায় পরিমাণে স্থান পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবুও এদের শুধু আধুনিক বললে ছোট করা হয় না কি? এরা সর্বকালের, কেউই নন বাতিল বা বাসী অথবা পেছন তারিখ। সার্থক শিল্পীদের রচনা আধুনিকতার সীমায় আবদ্ধ নয় বলেই তারা কখনো সংকীর্ণ অর্থে আধুনিক নন। এমন কি যে সব রচনায় সমাজ জীবনের বিকৃত চেহারা ফুটে উঠেছে–যেমন ম্যাডাম বোভারি, লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার, ললিতা এসবও রচনা-গুণে সাহিত্যিক ও শিল্পানুগ ‘স্বাভাবিকতার’ জোরে আধুনিকতার সীমা ডিঙিয়ে চিরকালের সাহিত্য হতে পেরেছে। নিশ্চয় এসবের প্রেরণা ও উদাহরণ সমসাময়িক যুগ-ই যুগিয়েছে। এসব রচনা যা চলতি তারই তো পরিপন্থী।
নিঃসন্দেহে আত্মতৃপ্তি সাহিত্যের ও শিল্পের শত্রু। যে কোনো বড় শিল্পীর দিকে তাকালেই এ কথার তাৎপর্য বুঝতে বেগ পেতে হয় না। যা আছে তাকে নিয়ে কোনো বড় শিল্পীই সন্তুষ্ট থাকেন নি। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল–কেউই যা ছিল তাতেই শুধু ঘুরপাক খান নি; যা চলতি ও প্রচলিত রীতি, ভাবে ও আঙ্গিকে তাকে তারা অনায়াসে ডিঙিয়ে গেছেন। অনেকে ইচ্ছে করে সচেতনভাবে যে নতুন পথে পা বাড়িয়েছেন তা নয়, কালের হাওয়ার তরঙ্গাঘাত মনের তটে যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছে তাতে তার সামনে পা না বাড়িয়ে পারেন নি। আজ দূরত্ব বলে কিছু নেই। পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের ভাব-তরঙ্গও আজ এড়িয়ে যাওয়া কারো সাধ্য নয়। সমসাময়িক যুগের সব জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নের সম্মুখীন, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সব শিল্পীকেই আজ হতে হচ্ছে। শরৎচন্দ্রের শেষ প্রশ্নও তো এমনি এক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান। প্যাস্টারনেকের ডক্টর জিভাগো অন্য আর এক প্রশ্নের উত্থাপক ও তার জবাব-খোঁজা। রচনার জন্য জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন ও তার সমাধান বড় কথা নয়, রচনা সাহিত্য হয়েছে কি-না সেটাই বড় কথা। আধুনিক সাহিত্যকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। বাংলা সাহিত্যের মহৎ শিল্পীরাও প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও সংস্কারের নিগড় ভেঙে সামনে অর্থাৎ নতুন পথে পা বাড়াতে দ্বিধা করেন নি এতটুকু। বলা বাহুল্য, এঁরা সবাই শুধু যে স্বদেশের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তা নয়, বিশ্বের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গেও তাঁদের পরিচয় ছিল গভীর ও ব্যাপক। রবীন্দ্রনাথ তো খাঁটি অর্থেই বিশ্বনাগরিক ছিলেন আর নজরুল তো যুদ্ধ-ফেরত। অনেকের ধারণা, নজরুল সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্য সম্বন্ধে কোনো খবরই রাখতেন না। এ ধারণা ভুল। হয়ত গভীরভাবে কোনো সাহিত্যই তিনি অধ্যয়ন করেন নি, তবুও স্বাভাবিক প্রতিভা ও অদ্ভুত গ্রহণশীলতার ফলে অন্যান্য প্রতিভাবানদের মতো তিনি সামান্য পরিচয়কেও অসামান্য করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার ‘সর্বহারা’ বা ‘সাম্যবাদী’ গুচ্ছের কবিতাগুলিও যে তার মার্কসিজম তথা কমিউনিজম সম্বন্ধে গভীর অধ্যয়নের ফল তা নয়–শোনা বুলি ও ভাসা ভাসা পরিচয়কে তিনি ওই সব রচনায় নিজের আবেগ দিয়ে অসামান্য করে তুলেছেন।
কবিতা হিসেবে তাতে ত্রুটি নিশ্চয় ঘটেছে কিন্তু আবেদন হিসেবে তা যে হৃদয়স্পর্শী ও অতুলনীয় তাতে সন্দেহ নেই। তার ‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ নামক প্রবন্ধে তিনি সংক্ষেপে যেটুকু সাহিত্য পরিক্রমা করেছেন তাতে তার সচেতন মনের পরিচয় রয়েছে। আর সে পরিচয় মোটামুটি নির্ভুল।
তদুপরি নজরুল দেশের সীমিত পরিবেশে যুদ্ধপরবর্তী ঘটনা প্রবাহের যে এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ তাতেও সন্দেহ নেই। ফলে যুদ্ধের (প্রথম) পরপর বাংলা সাহিত্যে যে নতুন সুর, নতুন মন-মেজাজ ও ভঙ্গি দেখা দিল স্বাভাবতই তিনি হলেন তার পুরোধা ও মধ্যমণি। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার এক মনোজ্ঞ ছবি এঁকেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার ‘কল্লোল যুগে’। সে বই পড়লেও দেখতে পাওয়া যায় তার প্রধান সুর হচ্ছে নজরুলের সুর–সে বইয়ের আগাগোড়া ছড়িয়ে আছে নজরুলের ব্যক্তিত্ব, উপস্থিতি ও কণ্ঠস্বর। এমন কি ওই বইতে একক নজরুলের যত কবিতা বা কবিতাংশ উদ্ধৃত হয়েছে আর কারো তা হয় নি। সেদিনের আধুনিকতার ঢেউ শুধু কল্লোল, কালিকলম বা প্রগতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তবে অচিন্ত্যকুমার যে কয়জন লেখকের কথা প্রাধান্য দিয়েছেন তাদের কারো কারো মতো অন্যরা হয়তো পরবর্তী সাহিত্যে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। হয়ত সেদিন দেশের ও বিদেশের ঘটনা প্রবাহের সর্বপ্লাবী গতিবেগ এমনি প্রচণ্ড ও দুর্বার ছিল যে তার প্রভাব কেউই এড়াতে পারেন নি। ফলে কলকাতার ও কলকাতার বাইরের আরো বহু পত্র-পত্রিকার পাতায় সেদিন আধুনিকতার সুর ধ্বনিত হয়েছিল। সে সবের ইতিহাস আজো অনুদঘাটিত। কল্লোল যুগের পরিধি লেখকের নিজের অভিজ্ঞতার সীমায় সীমিত। বলা বাহুল্য, লেখকের জন্য সেটাই যথার্থ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পুরোপুরি ইতিহাস লিখতে হলে সারা প্রদেশের সে যুগের সব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত যে সব লেখায় আধুনিক ভাবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে তারো খবরদারি ও মূল্যায়ন করতে হবে। এদিক থেকে কল্লোল যুগ’ বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার আংশিক ইতিহাস মাত্র। কিন্তু রচনাগুণে ও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির আশ্চর্য প্রসারতায় ‘কল্লোল যুগ’ বাংলা সাহিত্যে যে একটি উল্লেখযোগ্য রচনার যুগ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ভাষা ও আন্তরিকতার এমন উচ্ছ্বসিত প্রকাশ কদাচিৎ দেখা যায়। ফলে পড়তে পড়তে মনে হয়–এ বই যেন মনের সব দরজা জানালা খুলে দিয়ে পাঠকের সঙ্গে কথা বলছে। এমন রচনা যে কোনো লেখকের পক্ষেই গৌরবের।
তিন
বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়ার পর নজরুল সৈনিক জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে এলেন ১৯২০-এ অর্থাৎ কল্লোল বের হওয়ার তিন বছর আগে। মোসলেম ভারতের আবির্ভাব ওই বৎসরের বৈশাখ থেকে (বাংলা ১৩২৭)। তার প্রথম সংখ্যা থেকেই বের হতে লাগল নজরুলের পত্রোপন্যাস বাঁধনহারা। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এ নামটি লক্ষ করার মতো। কারণ, আধুনিকতার এক অর্থ সর্ববন্ধনমুক্তি অর্থাৎ ‘বাঁধনহারা’। পর বৎসর অর্থাৎ ১৩২৮-এর কার্তিক সংখ্যা মোসলেম ভারতে একই সঙ্গে বের হয় নজরুলের ‘বিদ্রোহ’ আর ‘কামাল পাশা’। কল্লোল বেরিয়েছিল ১৩৩০ এর বৈশাখে। কাজেই ‘কল্লোল’ বের হওয়ার প্রায় দেড় বছর আগে বাংলা সাহিত্যে সব কিছু না মানার, সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার যে দমকা হাওয়া তা বইয়ে দিল ‘বিদ্রোহী’। বাঁধনহারায় আধুনিকতার যেটুকু প্রভাতকলি ছিল ‘বিদ্রোহী’তে তাই তূর্য। ধ্বনি হয়ে ফেটে পড়ল। এভাবে নিজের অজান্তেই কল্লোলে বহু আগে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ভিৎপত্তন করলেন নজরুল–পরবর্তীকালে ‘কল্লোল যুগে’র যিনি হলেন প্রধান ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে এও স্মরণীয়, নজরুল সম্পাদিত ধূমকেতুও বেরিয়েছিল কল্লোলের প্রায় আট মাস আগে। বলা বাহুল্য, কালিকলম ও প্রগতি বেরিয়েছিল আরো পরে (ধূমকেতু শ্রাবণ, ১৩২৯; কালিকলম বৈশাখ, ১৩৩৩; প্রগতি আষাঢ় ১৩৩৪)। কল্লোল বের হওয়ার আগে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের ধূমকেতু কীভাবে উন্মাদ করে তুলেছিল তারও পরিচয় আঁকা আছে কল্লোল যুগে। কারণ সে যুগের তরুণ লেখকদের বহু আশা-আকাঙ্ক্ষা বিশেষ করে মন-মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির খোরাক ধূমকেতুই তখন জোগান দিয়েছে। ধূমকেতু সাহিত্য পত্রিকা ছিল না সত্য কিন্তু সেদিনের বেপরোয়া বিদ্রোহ ও উন্মাদ যৌবন জলতরঙ্গের ভাষা আর বাহন ছিল ধূমকেতু। আর তা ছিল খাঁটি ও নির্ভেজাল। এ সত্যের জোরেই ধূমকেতু আকর্ষণ করেছিল রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সানুরাগ সহানুভূতি।
‘বিদ্রোহী’ ও ধূমকেতুতে আধুনিকতার অনেক লক্ষণ ছিল বলেই তা সে যুগের তরুণ লেখকদের মনের পটভূমি রচনায় অনেকখানি সহায়তা করেছিল। পরে এসব লেখকদের অনেকেই সাহিত্যে আধুনিকতার আমদানি ও আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে হয়েছেন আধুনিক’ বলে চিহ্নিত। এমন কি জীবনানন্দ দাশের মতো বিশিষ্ট কবিও নজরুলের প্রভাব এড়াতে পারেন নি। নজরুলের তরঙ্গিত সত্তার স্পর্শ পেয়েছিলেন। কল্লোলের কবি জীবনানন্দ দাশ। তার ঝরা পালক গ্রন্থের একাধিক কবিতায় তিনি নজরুলের অনুকরণস্বাক্ষর রেখেছেন। [সঞ্জয় ভট্টাচার্য : আধুনিক কবিতার ভূমিকা।] আমাদের আধুনিক সাহিত্যের একমাত্র নজরুলই বলতে পারেন–‘I have come to. hold sacred, the disorder of my mind বিশৃঙ্খল মনের এমন পরিচয় আর কে দিয়েছেন, কোথায় মিলবে তার দ্বিতীয় নজির? ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটাইতো এ যুগের এক চলচ্চিত্র। আর এও স্মরণীয়, কল্লোল যখন বেরোয় নজরুল তখন জেলে আর সেখান থেকেই লিখে পাঠালেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। ভাঙা ও গড়ার জন্য যে মুক্তি ও প্রবল আত্মবিশ্বাসের দরকার এক পরমাশ্চর্য উচ্ছ্বসিত ছন্দ ও ভাষায় তারই প্রথম জয় ঘোষণা শোনা গেল এ কবিতায়। যা চলতি তার পরিপন্থী হতে হলে অর্থাৎ হতে হলে বিদ্রোহী, চাই শক্তি ও প্রত্যয়, চাই সাহস; বরং বলা যায় সাহসের চেয়েও চাই বেশি দুঃসাহস। নজরুল এবং তার সমসাময়িক ও পরবর্তী অনেক আধুনিক লেখকদের সত্যি এসব গুণ ছিল। রুগ্ণ মন ও ক্ষীণ বলের পক্ষে বিদ্রোহী হওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব নয় চলতি পথের পরিপন্থী হওয়া। বিদ্রোহের লক্ষণ ও লক্ষ্যের সমর্থনে জার্মান দার্শনিক নিটশে যা বলেছেন তা আমাদের বিদ্রোহী তথা আধুনিক লেখকদের বেলায়ও প্রয়োগ করা যায় :Objection, evasion, j yous distrust and love of irony are signs of health; everything absolute belongs to pathology. (Nietzche).। আমাদের আধুনিকদের রচনায় এসব লক্ষণের অভাব নেই এবং তারা শক্তিহীনও নন। যা আছে, যেমন ভাবে আছে, তাতে অভ্রান্ত মনে করে মেনে নেওয়া মনের সুস্থতার লক্ষণ নয়। এ হয়ত খাঁটি কথা। তবুও আশানুরূপ সাফল্য সাহিত্যে দেখা দিল না কেন? কেন ফলল না সাহিত্যে অদম্য উচ্ছ্বাস, শক্তির বেপরোয়া উল্লাস, সব কিছুর প্রতি অবিশ্বাস, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, নগ্ন সত্যভাষণ, বিদ্রোহ আর যা কিছু চলতি তার পরিপন্থী হওয়ার যে দর্শন–এসব প্রচুর শক্তি ও স্বাস্থ্যের লক্ষণ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সাহিত্য ও শিল্পে সাফল্য কি শুধু এর দ্বারা আয়ত্ত হতে পারে? সাহিত্য এক বিচিত্র ব্যাপার–জীবনের গভীরতর সত্যোপলব্ধি ও তার শিল্পোত্তীর্ণ প্রকাশ ছাড়া সাহিত্যে সাফল্য আশা করা যায় না। শুধু বিরুদ্ধতা, বিদ্রোহ, নবতর দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাষা ও আঙ্গিকে চমক সৃষ্টি করে সাহিত্যে যেটুকু সাফল্য ও খ্যাতি তার আয়ু দীর্ঘ নয়।
এ প্রসঙ্গে অচিন্ত্য সেনগুপ্তের বেদে পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে যা লিখেছিলেন তা স্মরণীয়: ‘রচনার যে বিশিষ্টতা বাহ্যিক তোমার পক্ষে তার প্রয়োজন ছিল না। যারা অল্পশক্তি তারাই রচনায় নতুনত্ব ঘটাতে চায়–চোখ ভোলানোর জন্যে। কিন্তু যখন তোমার প্রতিভা আছে তখন তুমি চোখ ভোলাবে কেন, মন ভোলাবে।’
সাহিত্যে জোর করে আধুনিক হওয়ার তথা ‘চোখ ভোলাবার’ চেষ্টায় আজ অনেক শক্তিমান লেখক যে শক্তি ও সময়ের অকারণ অপচয়ে লিপ্ত তার নজির কিছুমাত্র বিরল নয়। চমক লাগানো ব্যাপারটিই তো আসলে স্বল্পায়ু। কিন্তু সাহিত্য-শিল্প তো একদিনের বাদশা’ নয়। শুধু ভাষা আর আঙ্গিকে চমক সৃষ্টি করে যারা একদিনের বাদশা’ হতে চান তাঁদের সম্বন্ধে Irving Stone-এর বক্তব্য হচ্ছে ‘The man of the day is usually man of a day’.
এঁদের অনেকের রচনা দৈনিকের মতই, একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই ব্যাস। যে জিনিস চিরকালের না হোক অন্তত কিছু কালের, তাকে দৈনিকের বস্তু করে তোলার সার্থকতা কোথায়?
আধুনিকতায় যে সব লক্ষণ ও গুণ তা যে একেবারে ব্যর্থ ও মূল্যহীন সে কথা বলা যায় না। নির্জলা সত্যভাষণের ও জীবনের নগ্ন বাস্তবতার রূপায়ণের দুঃসাহস, সর্ববিষয়ে। কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন ও হতাশা মহৎ সাহিত্যের উপজীবিকা যে হতে পারে না তা। নয়। প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ অনেক সময় নতুনকে গ্রহণ করার পথ সুগম করে দেয়। কল্পনায় ও প্রকাশে দুঃসাহস আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ। তার সঙ্গে গভীর ও আন্তরিক মননশীলতার সংযোগ না ঘটলে শিল্প-সৃষ্টি সার্থক হতে পারে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
সাহিত্যে যত রকমের ধারা ও যত মোড় বদল ঘটেছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল, আর সব ধারা-উপধারাই স্থান পেয়েছে তার বিপুল রচনায়। ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম, মডার্নিজম–সব কিছুরই নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তার অজস্র লেখায়। ফটোগ্রাফি যেমন শিল্প নয় তেমনি নির্ভেজাল অর্থাৎ যে রিয়ালিজমে কল্পনার রঙ মেশে নি তাও সাহিত্য নয়। অতি আধুনিকদের অনেক রিয়ালিজম চর্চা এ কারণেই সাহিত্য হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। সাহিত্য নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর এ সম্বন্ধে এত দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও রবীন্দ্রনাথের মত এ যুগের আর কারো নেই। কাজেই এ সম্পর্কে তাঁর মতামত এক রকম প্রামাণ্য ও অপ্রতিরোধ্য বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। আধুনিক সাহিত্য ও কবিতা সম্বন্ধে তিনি বহুবার মন্তব্য করেছেন। এখানে একটি মাত্র মন্তব্য, উদ্ধৃত হলো :
‘…আমাদের দেশের হাল আমলের কাব্য, যাকে আমরা আধুনিক বলছি যদি দেখি তার দেহরূপটাই অন্য দেহরূপের প্রতিকৃতি, তা হলে তাকে সাহিত্যিক জীবসমাজে নেব কী করে। যে কবিদের কাব্যরূপ অভিব্যক্তির প্রাণিক নিয়ম পথে চলেছে তাদের রচনার স্বভাব আধুনিকও হতে পারে সনাতনীও হতে পারে অথবা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু তার চেহারাটা হবে তাদেরই, সে কখনো এলিয়েটের বা অডেনের বা এজরা পাউন্ডের ছাঁচে ঢালাই করা হতে পারে না। … যে কবির কবিত্ব পরের চেহারা ধার করে বেড়ায় সত্যকার আধুনিক হওয়া কি তার কর্ম?’
আধুনিক কবিরা সত্যকার আধুনিক হচ্ছেন না বলেই আমাদের আপত্তি এবং তাঁদের রচনা সম্বন্ধে তাই আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারছি না। নিঃসন্দেহ হতে না পারার বড় কারণ, তারা কবির চেয়েও বিশেষণটার ওপর জোর দিচ্ছেন বেশি। তারা। যতখানি ‘আধুনিক’ হতে চাচ্ছেন ততখানি ‘কবি’ হতে চাচ্ছেন না। তারা অহঙ্কার করছেন কবিতা নিয়ে নয়, আধুনিকতা নিয়ে। জোর দেওয়া হচ্ছে কে কতখানি আধুনিক তার ওপর।
মানুষ যেমন বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনি তার সাহিত্য বিচ্ছিন্ন নয়। বর্তমানের অতিরিক্ত তার যেমন অতীত ও ভবিষ্যৎ আছে–সাহিত্যেরও তাই আছে। বর্তমানের যোগসূত্রে এ তিন একই মালার ফুলের মতো এক সুতোয় গাঁথা। এ উপলব্ধির ওপরই নির্ভর করছে রচনার সাহিত্যিকতা। সব লেখকই এ অর্থে আধুনিক যে, তাকে রচনার উপকরণ। প্রকরণ সংগ্রহ করতে হয় তার কাল থেকে, তার যুগ থেকে। সব শিল্পীই যুগ-সন্তান। কিন্তু শিল্পী সত্তায় তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে হয় যুগকে।
আধুনিক হওয়ার সংকল্প নিয়ে কলম হাতে লিখতে বসলেই আধুনিক হওয়া যায়। না–মনের ভেতর আধুনিকতার বোধ থাকা চাই অর্থাৎ কালের ধারাবাহিকতার বোধ। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের যে অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র আছে তা কালের দিক থেকে যেমন সত্য তেমনি মানুষের শ্রেয়, সৌন্দর্য ও রসবোধের দিক থেকেও সত্য। তা না হলে প্রাচীন সব সাহিত্যই আজ বাতিল হয়ে যেত। অথচ তা তো হয় নি, বরং বহু আধুনিক লেখাই যথেষ্ট চাকচিক্য সত্ত্বেও ক্ষণ-প্রভার মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেছে। তাই সাহিত্যে আধুনিকতা নিয়ে যাদের বড়াই তাঁদের হাত থেকে আমরা কতটুকু ফসল পেয়েছি পাঠকের পক্ষ থেকে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
চার
ইনজেকশন যেমন হারানো স্বাস্থ্যোদ্ধারের উপায় মাত্র, লক্ষ্য নয়–লক্ষ্য স্বাস্থ্য, তেমনি আধুনিকতার যে সব লক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমরা আলোচনা করলাম তাও সাহিত্যকে গতানুগতিকতার হাত থেকে উদ্ধার করে নবতর রূপায়ণের ইঙ্গিতবহ মাত্র। লক্ষ্য সাহিত্য—প্রাচীন বা আধুনিক বিশেষণ বর্জিত সাহিত্য। বলা বাহুল্য, আধুনিকতার প্রয়োজন যেমন আছে তেমনি তার সীমাও আছে। এ সীমা সম্বন্ধে সচেতন না থাকলে আধুনিকতা ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে বাধ্য। প্রমাণের জন্য দূরে যেতে হবে না, বাংলা সাহিত্যে যারা এককালে ঘটা করে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিলেন ও হয়েছিলেন আধুনিক নামে পরিচিত, তাদের শোচনীয় পরিণতি দেখলেই তা বুঝতে পারা যাবে। যথেষ্ট শক্তি ও প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এঁদের কেউ-ই প্রথম শ্রেণীর লেখক হতে পারেন নি। বড় জোর কেউ কেউ পেতে পারেন দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা। অনেকের ভাগ্যে তাও ঘটবে কি না সন্দেহ। দেখে অবাক লাগে–শেষ পর্যন্ত শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মত প্রতিভারও অবলুপ্তি ঘটেছে সস্তা জীবিকার সিনেমা ও সিনেমা-সাহিত্যে। অচিন্ত্য সেনগুপ্তের পরিণাম আরো শোচনীয়। এ যুগে রত্নাকরের এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি মিলবে কিনা সন্দেহ। এক চরম থেকে আর এক চরমে–বেদে থেকে পরমহংসে এমন অবাধে বিচরণ, আধিভৌতিক থেকে আধিদৈবিকে আরোহণ না অবরোহণ!
‘… বেদে থেকে পরম পুরুষের রহস্য বোঝা যায় একমাত্র এইভাবে যে সাহসিকতায় চিন্ময় সৃজনের দুর্মর অভিলায় সমগ্র কল্লোলী লেখকদের প্রয়াস নিঃশেষিত।’
(বাংলা উপন্যাসের কালান্তর, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়। পৃ২৮২)
বুদ্ধদেবের যা কিছু সাফল্য সে তো গদ্য রচনায়। নিঃসন্দেহে আধুনিক কবিতার সার্থক ভাষ্যকার তিনি। কিন্তু সফল আধুনিক কবি তিনি নন। বরং এঁদের তুলনায় আধুনিকতা সম্বন্ধে কোনো স্পর্ধা না করে মোহিতলাল কি তারাশঙ্কর লেখক হিসেবে যে সফলতা অর্জন করেছেন তার গুণগত মূল্য অনেক বেশি। এমন কি আমাদের জসীম উদ্দীনের সফলতাও এঁদের অনেকের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়।
আমার বিশ্বাস, শেষোক্তদের সাফল্যের বড় কারণ এরা নিজেরা যা তা-ই অর্থাৎ এরা নিজেদের স্বকীয়তা ও নিজস্বতা কখনো বিসর্জন দেন নি–এঁরা ‘ধার করা’ কবি বা লেখক নন, হতে চান নিও। এঁদের মন-মানস যতটুকু যা যেভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে। এরা ততটুকুই। আমাদের সাহিত্যে কবিতার ক্ষেত্রেই আধুনিকতার তোড়জোড় সব, চেয়ে বেশি। অথচ সেই কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতা সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছে অর্থাৎ কোনো সুপরিণতিতে গিয়ে পৌঁছাতে পারে নি এখনো। এ প্রসঙ্গে এ কথাও বিবেচ্য আধুনিকতার ব্যর্থতার বীজ হয়ত আধুনিকতার মধ্যেই রয়েছে সুপ্ত। মোটামুটিভাবে আমরা দেখতে পেয়েছি আধুনিকতা হচ্ছে একটা দৃষ্টিভঙ্গি, একটা attitude মাত্র—’A hostile attitude to society and all its institutions’ ইউরোপের ও আমাদের দেশের আধুনিক নামে পরিচিত রচনার দিকে তাকালেই Spender-এর এ উক্তির তাৎপর্য বুঝতে পারা যাবে।
সমাজের সঙ্গে কবি বা শিল্পী-মনের যে সংঘর্ষ তা যতদিন রচনায় অব্যাহত রাখা। যায়, রচনায় ধারও থাকে ততদিন এবং ততদিন সে রচনা থাকে উপভোগ্য। কিন্তু তা। নিঃশেষ হয়ে গেলে রচনা তার বৈচিত্র্য ও ধার হারিয়ে নিছক একটা ভঙ্গি হয়েই দাঁড়ায়। বলা বাহুল্য, ভঙ্গি সফলতা নয় বরং দুর্বলতা। Stephen Spender আধুনিক কবিতার 677 786 761654, ‘To create an art at once extremely contemporary and with a dreamlike quality.’ এ প্রসঙ্গে তিনি ভ্যান্ গগের ছবির কথা তুলনা করেছেন। ভ্যান গগ তার আশে-পাশের জীবন ও প্রকৃতি থেকেই তার ছবির উপকরণ নিয়েছেন এবং তাতে মাখিয়ে দিয়েছেন স্বপ্নের অঞ্জন। তাই তা আধুনিক হয়েও ছাড়িয়ে গেছে আধুনিকতার সীমা, হয়েছে চিরন্তন শিল্প। এর জন্যে কোন দুঃখকেই তিনি দুঃখ মনে করেন নি। কিন্তু অমন দুর্জয় মনোবল আর নিজেকে নিজের মনের মতো করে প্রকাশ করার অমন দুর্বার ইচ্ছাই বা ক জনের থাকে, ক জনের আছে?
সাফল্যই তো আমাদের এক পরম শত্রু–সাফল্যের সূচনাতেই আমরা ভেঙে পড়ি, হয়ে পড়ি আদর্শচ্যুত; তখন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আর আদর্শের হতে থাকে বদল। জীবিকার দরাজ নিরাপত্তা মন থেকে দূর করে দেয় সব বিক্ষোভ ও বিরুদ্ধতা। এতদিন যা ছিল অসহনীয় এখন তা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সহনীয়।
আধুনিকতারও শত্রু এ সাফল্য–জীবনে সফলতা এলে আধুনিক জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রামের প্রয়োজন আর থাকে না। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তখন আর থাকে না ক্ষোভ। চলতি সমাজে যা কিছু মূল্যবান তাকে মূল্যহীন মনে করার ওপরই নির্ভর করে আধুনিকতা। কিন্তু সে সব যখন শিল্পীর নিজেরই করায়ত্ত হয় তখন তা হয়ে ওঠে মূল্যবান।
ফলে সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ঘটে ভরাডুবি। সিএসপি হওয়ার পর আধুনিকতা করার কোনো মানে হয় কি? তেমনি গাড়ি বাড়ি ও সফল বিয়ের পর শিল্পীর মন থেকে আধুনিকতার সব প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, যেতে দেখা গেছে।
জীবনে সফলতার সঙ্গে সঙ্গে রচনাতেও অধিকতর আধুনিকতার সুর ফুটেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। কাজেই যে কবিতা বা সাহিত্য সফলতার দিনেও সফল নয় তার শেষ পরিণতি আঙ্গিকে ভঙ্গি আর ভাবে পুনরাবৃত্তি। এভাবে আজকের আধুনিকও একদিন চলতি ঐতিহ্য ও সমাজে ফিরে যান, ফিরে যেতে বাধ্য হন। মনের ত্রিসীমানাতেও তখন আর স্থান পায় না বোহেমিয়ানিজম বা বাউণ্ডুলেপনা। বরং এখন থেকে শিল্পী বেশ কষে চর্চা করতে থাকেন নকল বনেদিয়ানা। এর ফলেই একদিন যারা বাংলা সাহিত্যে আধুনিক বলে পরিচিত ছিলেন তারা আজ আর তা নন। স্বভাবতই সামাজিক মর্যাদাই নিয়ে আসে। সমাজের সঙ্গে আপোষের ইচ্ছা। আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা ছাড়া আরো অনেক কারণে আধুনিকতার পতন ঘটতে পারে।
আজ অনেক দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এমন যে সেখানে খাঁটি স্বেচ্ছাচারী তথা আধুনিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সে সব দেশে আধুনিকতা কেতাবি বা academic হয়ে পড়তে বাধ্য।
তার ওপর সারাজীবন সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চরিত্র-শক্তি কয়জুনের থাকে? ফলে আপোস না করে উপায় থাকে না। যখন বয়স, সংসার ও পরিবারের বোঝা একটির পর একটি বাড়তে থাকে তখন তার সঙ্গে একটা আপোস করে চলার গতি আরো তরান্বিত হয়। তখন public বা সাধারণ পাঠক যা চায়, যা দিলে সরকারি বেসরকারি অনুগ্রহের পথ হয় সুগম, শিল্পী তা-ই করতে থাকেন, দিতে থাকেন চাহিদা মতো মাল। যে বিদ্রোহ, নৈরাশ্য, হতাশা, বিক্ষোভ নিয়ে লেখকের লেখক জীবনের শুরু এভাবে তার আগুন দিনে দিনে স্বাভাবিক নিয়মেই ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এসব বহুতর। কারণে আধুনিকতা স্বল্পায়ু হতে বাধ্য।
ফলে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক লেখকদের প্রথম রচনাই তাদের * শ্রেষ্ঠ রচনা এবং সেটি একমাত্র উপভোগ্য। পরেরগুলির কোনো কোনোটায় হয়ত পরিণতির পরিচয় পাওয়া যায় কিন্তু প্রথমটির স্বকীয়তা, নগ্নতা ও কাঁচার যে স্বাদ তা আর ওইসবে যায় না পাওয়া। এ প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা আন্দোলনের নেতা প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথমা, অচিন্ত্য সেনগুপ্তের অমাবস্যা ও বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দনা স্মরণীয়। ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি সম্বন্ধেও কি একথা বলা যায় না? কিন্তু আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথ আধুনিক না হয়েও শেষ পর্যন্ত কিন্তু আধুনিক থেকে গেছেন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন যা চলতি তার পরিপন্থী, প্রচলিত সামাজিক ধ্যান-ধারণার বিরোধী।
কালান্তর, চতুরঙ্গ ইত্যাদি তার প্রায় বৃদ্ধ বয়সের রচনা, তা হলেও তাতে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রচলিত মতামত কিছুই রেহাই পায় নি। চতুরঙ্গের জ্যাঠা মশায় বা জগমোহনের মত অমন পাক্কা নাস্তিকের চরিত্র আমাদের কোনো আধুনিক লেখকই এ পর্যন্ত আঁকতে পারেন নি। তাই মনে হয়, আধুনিকতা বয়সের ওপর নির্ভর করে না–ওটা মনের ধর্ম, মনের ব্যাপার। আমি মনে করি, জীবনের সবগুলো দিককে স্বীকার করে নেওয়ার নামই যথার্থ আধুনিকতা। তবে স্বীকৃতি আর প্রকাশের মাঝখানে যে ‘আসমান-জমিন ব্যবধান রয়েছে তার উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে সাহিত্যে আধুনিকতার সফলতা। যুদ্ধোত্তর যুগে আধুনিকতার যে স্পর্ধিত রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি তার বহু আগে থেকেই ফরাসি সাহিত্যিকেরা জীবনের সব কিছুকেই, সব দিককেই সাহিত্যের উপজীব্য করেছেন। জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো কিছুকেই তারা সাহিত্যে বর্জনীয় বা পরিত্যাজ্য মনে করেন নি। জীবনের বিচিত্র রূপ ফরাসি শিল্পীরা অকপটে এঁকেছেন–এ ব্যাপারে তারা কোনো দ্বিধা সংকোচ বোধ করেন নি। ফলে ফরাসি সাহিত্য একদিন জুগিয়েছিল ইউরোপের তাবত জ্ঞানী, গুণী ও রসিকের মনের খোরাক। লেখক ও শিল্পীদের হয়ে জোলা (১৮৪০-১৯০২) যে ঘোষণাপত্র’ বা Manifesto রচনা করেছিলেন তাতে নিঃসন্দেহে ফরাসি সাহিত্যিক-শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে : First, we think all truth beautiful, no matter how hideous its face may seem. We accept all of nature, without any repudiation. We believe there is more beauty in a harsh truth than in a pretty lie, more poetry in earthness than in all the salons of Paris. We think pain good, because it is the most profound of all human feelings. We think sex beautiful, even when portrayed by a harlot and a pimp. We put character above ugliness, pain above prettiness and hard, crude reality above all the wealth in France. We accept life in its entirety, without making moral judgements. We think the prostitute as good as the Countess, the concierge as good as the general, the peasant as good as the cabinet minister. for they all fit into the pattern of nature and are Woven into the design of life,’ বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী ওরফে বীরবল ফরাসি সাহিত্য সম্বন্ধে পণ্ডিত ও ওয়াকিবহাল ছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য হচ্ছে : ‘একথা সত্য যে, সত্যের অনুসন্ধানে মনোরাজ্যের হেন দেশ নেই যেখানে ফরাসি লেখকরা যেতে রাজি নন, সে দেশ যতই অপ্রীতিকর ও যতই অসুন্দর হোক এবং সত্যের খাতিরে হেন কথা নেই যা তারা বলতে প্রস্তুত নন, সে কথা যতই অপ্রিয় যতই অবক্তব্য হোক।’
কাজেই সাহিত্য ব্যাপারে আধুনিকতা বড় কথা নয়–অকপটে জীবন তথা জীবনের সত্যকে উদ্ঘাটনই বড় কথা। তবে শিল্পের স্বভাব ও ধর্ম হচ্ছে অর্জন ও বর্জন, ত্যাগ ও গ্রহণ, যাচাই ও বাছাই–শিল্পে তিলোত্তমা গড়ে ওঠে এভাবে।
অনেকের সাহিত্যে আধুনিকতা সম্বন্ধে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই কিন্তু আধুনিক হওয়ার ঝোঁক আছে। বিশেষত, যারা তথাকথিত সমাজ-সচেতন শিল্পী তাদের ঝোঁকটাই প্রবলতর। এটা নিন্দার কথা নয়, বরং স্বাস্থ্যের লক্ষণ, সজাগ মনের পরিচায়ক। তবে আধুনিকতারও সীমা আছে, আর আধুনিকতা লক্ষ্য নয়, উপায় মাত্র–এ দুটো কথা স্মরণ রাখার ওপর আমি জোর দিতে চাচ্ছি।
পাঁচ
আধুনিক কবিতা সম্বন্ধে এক সুপরিচিত আপত্তি হচ্ছে আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য। এ আপত্তি সম্বন্ধে আমি অন্যত্র অন্য প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। জীবনের জটিলতা, প্রতাঁকের ব্যাপক ব্যবহার, স্বল্প কথায় বেশি অর্থারোপ যে এ জটিলতার এক বড় কারণ তাতে সন্দেহ নেই। তবুও পাঠকের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো মহৎ কবি কি দুর্বোধ্য? বা অবাধ্য? বিখ্যাত সমালোচক Ivan Brown বলেছেন ‘No great poet at his best is obscure, The artist who does not know his own intentions is a pretender. If he does know them and can not express them he is merely incompetent.
কাজেই কবি বা লেখকের প্রথম ও প্রধান শর্ত নিজের মন জানা, তারপর তাকে প্রকাশ করা। তা হলে আমার বিশ্বাস প্রতীক-ধর্মী লেখাও অবোধ্য মনে হবে না।
এই অনুষঙ্গে এ প্রশ্নটিও প্রায় শোনা যায়, আধুনিক কবিতা দীর্ঘস্থায়ী হবে কি?
আধুনিক মনের সঙ্গে আধুনিক জীবন ও সমাজের বাস্তব অবস্থার সংঘর্ষের ফলেই সাহিত্যে আধুনিকতার আবির্ভাব ঘটেছে। এ কথা আমরা আগেই বলেছি, এ প্রশ্নের উত্তর শুধু এ সংঘর্ষের ওপর নির্ভর করছে না। নির্ভর করছে বিভিন্ন শিল্প-রূপের ভেতর দিয়ে একে শিল্পোত্তীর্ণ করার সামর্থের ওপর। আসল কথা, যদি স্থায়ী হয় তা হলে সাহিত্য কর্মই স্থায়ী তথা দীর্ঘকালীন হবে। শুধু বিষয়গত যে আধুনিকতা তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। কারণ, বিষয়ের পরিবর্তন অপরিহার্য ও অনিবার্য। আজ যা বা যে কেথা আনকোরা টাটকা আধুনিক, কাল তা অতীতের বস্তু। আমরা সাহিত্যে দ্বারস্থ হই মন ও কল্পনার খোরাকের জন্য, শুধু বিষয়-নির্ভর সাহিত্য সে খোরাক কিছুতেই জোগান দিতে পারে না। আধুনিক সাহিত্য এত বেশি বিষয়গত ও এত বেশি চটক নির্ভর যে তাতে সাহিত্য পাঠ ও সাহিত্য উপভোগের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। নিছক বিষয়-নির্ভর সাহিত্য যদি মানুষকে খুশি করতে পারতো তাহলে মানুষের কাছে কাব্যের চেয়ে অঙ্কের, উপন্যাসের চেয়ে ভূগোলের কদর হতো বেশি। সাহিত্য যেমন সংবাদপত্র নয় তেমনি সাহিত্যিকেরাও নন রিপোর্টার। রিপোর্টারের সাফল্য বিষয়-নির্ভরতায়, আর সাহিত্যিকের সাফল্য বিষয়কে ছাড়িয়ে যাওয়ায়।
কাজেই আজ অনেকের মনে সন্দেহ জেগেছে সাহিত্যে আধুনিকতা স্থায়ী তথা দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না?
আজকের দিনে বেপরোয়া ও ব্যাপক আধুনিকতা যে সম্ভব নয় সে ইঙ্গিত আগেই করা হয়েছে। যে পরিবেশ ও পটভূমিতে আধুনিকতার জন্ম ও বিকাশ তা যে আজ নির্মূল হয়েছে তা নয়, কিন্তু অনেক দেশের শাসকরা তা সহ্য করবেন না বলেই সে সব দেশে তা ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ ও নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। হতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আজ সমস্ত আধুনিকতা বা ‘প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা’র বিরুদ্ধতার একমাত্র লক্ষ্য হয়েছে কালোবাজার, মুনাফাখখারি, দুর্নীতি, কন্ট্রাক্টার বা জমিদারিহীন জমিদার। এ হচ্ছে এক প্রকার দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। সত্যিকার আধুনিকতার পরিধি ও পরিসর আরো ব্যাপক ও গভীর। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে যদি বদলাতে হয় এবং তা যদি আধুনিকতার অন্যতম লক্ষ্য হয়, তা হলে মূলেই আঘাত করতে হবে–শুধু পত্রপল্লবে খোঁচা দিয়ে সে উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। আশ্চর্য, যেসব দেশ রাষ্ট্র মনেপ্রাণে কমিউনিজম বিরোধী তারা কমিউনিজম তথা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের যা দোষ তা নিজেরা গ্রহণ করে হাতের অস্ত্রে পরিণত হয়েছেন আর তা নির্বিবাদে প্রয়োগ করেছেন যারা কমিউনিজমের গুণ গ্রহণে উৎসাহী তাদের ওপর। কমিউনিজমে যদি কোন গুণ থাকে তাও উল্লেখ করার কোনো অধিকার স্বাধীন বিশ্বের শিল্পীদের নেই। স্বাধীন বিশ্বের শিল্পীদের সামনে এও আর এক অনতিক্রম্য সীমান্ত! আধুনিকতা মানে জীবনের সব দিক, সব কিছুকে গ্রহণ করা, সব কিছুকে অকপটে যাচাই বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। মানুষের সমাজ-ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজম এক নবতর মতবাদ। এ মতবাদের ভালো-মন্দ, সু-কু যাচাই-বাছাইয়ের অধিকার থেকে ‘স্বাধীন বিশ্বে’র শিল্পীরা বঞ্চিত। ভুল বললাম–মন্দ আর কু বলার অর্থাৎ অ্যান্টি হওয়ার অধিকার আছে বই কি! ‘স্বাধীন বিশ্বে’র অধিকাংশ রাষ্ট্র চায় আপনি anti হউন–রাষ্ট্রের এ দাবি না মানলে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র থেকে যে সব অস্ত্র ধার করা হয়েছে তার হাত থেকে আপনারও রেহাই নেই। কিন্তু খাঁটি শিল্পী তো anti হতে পারে না–anti ব্যাপারটিই শিল্পীর জন্য মারাত্মক। এ প্রসঙ্গে জোলা রচিত শিল্পী-সাহিত্যিকদের ম্যানিফেস্টো স্মরণীয়। শিল্পীর প্রধান ভূমিকা তো ভাবাত্মক, নঞর্থক নয়। অ্যান্টি অকমিউনিস্ট হতে গেলে মানুষের কী দুর্দশা ঘটে তার এক সার্থক চিত্র এঁকেছেন বোরিস পাস্তেরনাক কিন্তু কাট্টা অ্যান্টি কমিউনিস্ট হলে কী দুর্দশা ঘটে তার চিত্র আঁকা হতে এখনও বাকি। স্বাধীন বিশ্বের আধুনিক লেখকদের কেউ কি বিপরীত অর্থে পাস্তেরনাক হতে পারেন না? স্বাধীন বিশ্ব’ কথাটা হেঁয়ালি। কারণ একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারা যাবে ‘অ্যান্টি আর ‘স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী কথা। স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিল্পীকে অ্যান্টি হতে হবে, ‘প্রো’ না হোক, নিরপেক্ষও তিনি থাকতে পারবেন না–এ এক চরম জবরদস্তি নয় কি? এ জবরদস্তির চিত্রই তো ডক্টর জিভাগো। স্বাধীন বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে এর বিপরীত যে জবরদস্তি চলেছে তার চিত্রও এক মহৎ উপন্যাসের বিষয়বস্তু হতে পারে।
ছয়
এ শতাব্দির গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডের কাব্য-সাহিত্যে মন্দা দেখা দিয়েছিল অর্থাৎ কবিতা অনেকখানি কৃত্রিম ও ফাঁকা হয়ে পড়েছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিলাতে। তিনি সহজাত কবি ও তীক্ষ্ণ মনীষার অধিকারী–এ কৃত্রিমতার কারণ ও স্বরূপ তার স্ফটিক-স্বচ্ছ মনে ধরা পড়তে দেরি লাগে নি। এ প্রসঙ্গে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা স্মরণীয় এবং মনে হয়, তা আমাদের আধুনিক কাব্য সম্বন্ধেও সর্বতোভাবে প্রয়োগ করা যায়:
“ইংল্যান্ডের বর্তমান কালের কবিদের কাব্য যখন পড়িয়া দেখি তখন ইঁহাদের অনেককেই আমার মনে হয়, ইহারা বিশ্বজগতের কবি নহেন, ইহারা সাহিত্য জগতের কবি। এ দেশে অনেকদিন হইতে কাব্য সাহিত্যের সৃষ্টি চলিতেছে–হইতে হইতে কাব্যের ভাষা উপমা অলঙ্কার ভঙ্গি বিস্তর জমিয়া উঠিয়াছে। শেষকালে এমন হইয়া উঠিয়াছে যে কবিত্বের বা কাব্যের মূল প্রস্রবণে মানুষের না গেলেও চলে, কবিরা যেন ওস্তাদ হইয়া উঠিয়াছে, অর্থাৎ প্রাণ হইতে গান করিবার প্রয়োজনবোধই তাহাদের, চলিয়া গিয়াছে; এখন কেবল গান হইতে গানের উৎপত্তি চলিতেছে। যখন ব্যথা হইতে কথা আসে না, কথা হইতেই কথা আসে, তখন কথার কারুকার্য ক্রমশ জটিল ও নিপুণতর হইয়া উঠিতে থাকে; আবেগ তখন প্রত্যক্ষ ও গভীরভাবে হৃদয়ের সামগ্রী না হওয়াতে সে সরল হয় না; সে আপনাকে আপনি বিশ্বাস করে না বলিয়াই বলপূর্বক অতিশয়ের দিকে ছুটিতে থাকে; নবীনতা তাহার পক্ষে সহজ নহে বলিয়াই আপনার অপূর্ব প্রমাণের জন্য কেবলি তাহাতে অদ্ভুতের সন্ধানে ফিরিতে হয়। এখনকার কাব্য সাহিত্যের যুগে কবি য়েটস যে বিশেষ সমাদর লাভ করিয়াছেন, তাহার গোড়ার কথাটা ঐ। তাঁহার কবিতা তাঁহার সমসাময়িক কাব্যের প্রতিধ্বনির পন্থায় না গিয়া নিজের হৃদয়কে প্রকাশ করিয়াছেন। …কবি য়েটসের কাব্যে আয়লন্ডের হৃদয় ব্যক্ত হইয়াছে।”
আমাদের দেশেও আধুনিক সাহিত্যে তথা সাহিত্যে আধুনিকতার আয়ু নেহাত কম হলো না। যাকে ত্রিশের সাহিত্যান্দোলন বলা হয় তার আয়ু প্রায় চল্লিশ বৎসর। এর মধ্যে সাহিত্যে আধুনিকতার বিকাশ কতখানি ঘটেছে আর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি কতখানি হয়েছে তা বিচার করে দেখার সময় এসেছে। উল্লেখযোগ্য অর্থে আমি মনে করছি যা পরবর্তী প্রজন্মও পাঠ করবে–পাঠ করার প্রয়োজন ও আবেদন অনুভব করবে।
বলা বাহুল্য, আধুনিকতা বয়স বা কালের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে না বলেই রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সেও আধুনিকতায় পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে। আধুনিকদের অন্যতম পুরোধা বুদ্ধদেব বসুর স্বীকারোক্তি ভুল মনে করার কোনো কারণ নেই। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : ‘আমরা যা কিছু করবার চেষ্টা করছিলাম অথচ ঠিক পারছিলাম না, সে সবই রবীন্দ্রনাথ করেছেন–কী সহজে, কী সম্পূর্ণ করে, কী অনিন্দসুন্দর ভঙ্গিতে। মনে হলো, বইটা যেন আমাদের অর্থাৎ নবীন লেখকদের উদ্দেশ্য করে লেখা, আমাদের শিক্ষা দেবার জন্যে এটি গুরুদেবের তীব্র মধুর ভর্ৎসনা। অবাক হয়ে দেখলুম রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিক মূর্তি’–সে যে আমাদের চেয়েও ঢের আধুনিক।’ আধুনিক ইংরেজ কবিদের কবিতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে মন্তব্য করেছেন আমার মনে হয় তা নতুন করে স্মরণ করার যোগ্য। আমার বিশ্বাস আধুনিক কবিতার দুর্বলতা ও অসাফল্যের বীজ তাতেই সুপ্ত রয়েছে। আমাদের আধুনিক সাহিত্যও জীবনের ফসল নয়–তাই অনেকখানি কৃত্রিম ও ফাঁকা। এও এক সাহিত্য থেকে অন্য সাহিত্যের, এক লেখা থেকে অন্য লেখার উৎপত্তি। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, আধুনিক ইংরেজ তথা য়ুরোপীয় কবিরী না জন্মালে পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক কবিরা জন্মাতেন কি না? জন্মালেও এখন তারা যেভাবে ও যে আঙ্গিকে লিখছেন সেভাবে সে আঙ্গিকে লিখতেন কি? যারা হৃদয়ের উৎস থেকে লেখেন না তাদের লেখারও এ পরিণতি হতে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার চেয়েও ঢের আধুনিক ছিলেন, কিন্তু আধুনিকতা নিয়ে তিনি কোনো বড়াই করেন নি। নজরুলও আধুনিকতার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তবু তাকেও আধুনিকতা নিয়ে কোনো অহঙ্কার করতে দেখি নি। সাহিত্যে আধুনিকতার সপক্ষে তাকে কখনো সাফাই গাইতেও শোনা যায় নি। জসীমউদ্দীন তো কোনো অর্থেই আধুনিক নন–তবুও এঁরা এ যুগে কিছুটা সার্থক সাহিত্য যে সৃষ্টি করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এঁদের সম্বন্ধে এ কথা কিছুতেই বলা যায় না যে, মধুসূদন কি ইংরেজ কবিরা না জন্মালে রবীন্দ্রনাথ জন্মাতেন না, রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে নজরুল ইসলাম জন্মাতেন না। বলা বাহুল্য, এঁরা শুধু বইপড়া কবি নন। এঁদের কবিতার উৎস এদের হৃদয়। রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের মণিকাঞ্চন সংযোগ ঘটেছিল বলে। তার রচনা পেয়েছে সর্বাধিক সার্থকতা, হয়েছে সার্বজনীন। হৃদয়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ না ঘটায় নজরুল ও জসীমের লেখায় কী রকম অবিশ্বাস্য সব ক্রটি ঘটেছে তাও কারো চোখ এড়াবার কথা নয়। তবু হৃদয় ও আবেগের স্পর্শে এঁদের অনেক লেখাই যে সার্থক সাহিত্য হয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। নজরুল ও জসীম উভয়েই হৃদয়ধর্মী লেখক, আবেগ এদের বড় সম্বল। বলা বাহুল্য, সাহিত্যে আবেগের মূল্য অনস্বীকার্য। বিশেষত বাংলাদেশে আবেগের মূল্য কখনো অস্বীকৃত ও উপেক্ষিত হবে না। জাত হিসেবে আমরা আবেগ প্রধান। তাই নজরুল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় কবি আর শরৎচন্দ্র সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। গোরার চেয়েও দেবদাসের পাঠক-সংখ্যা অনেক বেশি। এটি একই সঙ্গে আমাদের সবলতা ও দুর্বলতার লক্ষণ।
জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ বা ‘কবর’কে ভাব-ভাষা-ছন্দ ও আঙ্গিকের দিক থেকে কিছুতেই ‘আধুনিক’ বলা যায় না, ব্যক্তি জসীমউদ্দীনও মন-মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে ‘আধুনিক’ নন। অথচ তার এ দুটি কাব্য রচিত হয়েছে সাহিত্যে আধুনিকতার জয় জয়কারের যুগে। আর ‘কবর’ ছাপা হয়েছে কল্লোলেই সর্বাগ্রে। রচনা হিসেবে কাব্য দুটি যে ত্রুটিহীন নয় তাও ঠিক কথা; তবুও কবি-হৃদয়ের আবেগে আর সে আবেগ কবিতায় সঞ্চারিত করে দেওয়ার কৃতিত্বে তা যে সফল হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ এসব কবিতার ভাষা ও আঙ্গিকে আধুনিকতার কোন লক্ষণ নেই, নেই কোনো চমক–ছন্দও অতি মামুলি। তবুও কবিতা দুটির আকর্ষণ এখনো নিঃশেষ হয়ে যায় নি। মনে হয় না এ কবিতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও মিথ্যে হয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও বুদ্ধির চর্চা যতই বাড়ুক না কেন, মানুষ যে কখনো আবেগ বর্জিত হবে তা ভাবা যায় না। আজো আধুনিক কবিতার পাঠক আধুনিক কবিই–এটা কিছুতেই শুভ লক্ষণ নয়।
আমাদের সাহিত্যে আধুনিকতার যুগে একমাত্র সফল হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ। এ আলোচনায় তার সম্বন্ধে নীরবতার দুটি কারণ–এক, তার সম্বন্ধে আমি অন্যত্র দীর্ঘ আলোচনা করেছি। দ্বিতীয়ত, যে আধুনিকতা নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করলাম, সে রকম অর্থে জীবনানন্দ ‘আধুনিক’ ছিলেন কি না সন্দেহ। যে পরিবেশ ও আবহাওয়ায় আধুনিকতার উৎপত্তি আর আধুনিকতার যে সব লক্ষণ ও গুণাগুণের সবিস্তার আলোচনা এ প্রবন্ধে করা হয়েছে, তার রচনায় সে সবের নিদর্শন দুর্লভ। কোনো বিষয়েই তিনি বিদ্রোহী ছিলেন না, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক অসাম্য সম্বন্ধে তার কোনো দুশ্চিন্তা ছিল বলে মনে হয় না। ঈশ্বর ও প্রেম, দেবতা ও ধর্মের বিরুদ্ধেও তাঁর লেখনী অশনি হয়ে দেখা দেয় নি আর আধুনিক ইউরোপীয় কবিদের কাছে অন্যান্য আধুনিক কবিদের মতো সাগরেদিও করেন নি তিনি। তিনি বা তার রচনা আধুনিক ইংরেজ কবিদের প্রতিধ্বনি ছিল না। তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন কিন্তু রবীন্দ্র-বিরোধী ছিলেন না। তাঁর রচনার একটি বিশিষ্ট গুণ প্রকৃতি-প্রেম–এ বিষয়ে অন্য আধুনিক কবিদের চেয়েও বরং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মিল বেশি। মোটকথা জীবনানন্দ এক স্বতন্ত্র কবি, বিশিষ্ট কবি–রবীন্দ্রনাথ থেকে তিনি যেমন স্বতন্ত্র তেমনি অচিন্ত্য, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব থেকেও স্বতন্ত্র। স্বতন্ত্র হলেই বিরোধী হয় না। য়েটস আর শ’ একই সময়ের ও একই দেশের লেখক হয়েও স্বতন্ত্র ছিলেন, তাই বলে পরস্পরের বিরোধী ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, নজরুল থেকে জসীমউদ্দীন, জসীমউদ্দীন থেকে ফররুখ আহমদ আর বুদ্ধদেব থেকে সুধীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ থেকে সমর সেন, সমর সেন থেকে বিষ্ণু দে স্বতন্ত্র কবি, তাই বলে এরা কেউ কারো বিরোধী নন। অচিন্ত্য-বুদ্ধদেবেরা রবীন্দ্র-বিরোধিতাকেও আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ বলে জোর প্রচার করেছেন। তাই এ কথাগুলি বলতে হলো। না হয়, আমি আগেই বলেছি anti বা বিরোধিতা কোন সৎ লেখকেরই সৎগুণ হতে পারে না। কারণ তা সহজেই শিল্পীর মনে পরিমিতিবোধ নষ্ট করে ভালো রচনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন জাত-শিল্পী, তাই কোনো কিছুর anti হয়ে তিনি কখনো পরিমিতিবোধ হারান নি। মন-মেজাজে তিনি ছিলেন দগ্ধ ও প্রকৃতি-প্রেমিক–যা ছিল তার শিল্পী সত্তার উৎস–তিনি ছিলেন অবচেতন মনের অনুভব ও অনুভূতির কবি। এর বাইরে রাষ্ট্র বা সমাজ, ধর্ম বা দেবতা নিয়ে তিনি মোটেও মাথা ঘামান নি। কাজেই যে আধুনিকতা এ প্রবন্ধের উপজীব্য তার আওতায় তিনি পড়েন না বলেই তার উল্লেখ আমি অনাবশ্যক মনে করছি। না হয়, এটা জানা কথা–আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি সর্বতোভাবে বিশিষ্ট ওঁ স্বতন্ত্র কবি। মন-মেজাজ, দৃষ্টিভঙ্গি ও সুরে তিনি এতই স্বতন্ত্র যে তার সমসাময়িকদের মধ্যে তাঁর কোনো দোসর নেই। সব কবির মতো গঠন কৌশলে তিনিও যে সাগরেদি করেন নি তা নয়, কিন্তু তার নিজস্ব শিল্পীসত্তা খুঁজে পাওয়ার পর থেকে তিনি নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর অনুকারকেরা কেউ এখনো তার বিশিষ্টতা অর্জন করতে পারেন নি।
যাক, এ প্রবন্ধে আমি সাহিত্যে আধুনিকতা সম্বন্ধে যে আলোচনা করলাম তাও আংশিক আলোচনা, হয়তো এক তরফাও। বলা বাহুল্য, আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করেছি, আরো দৃষ্টিকোণ থেকেও এ বিষয়ে ব্যাপকতর আলোচনা হওয়া উচিত। তাহলেই সাহিত্যে আধুনিকতার রূপ ও চেহারা আর তার স্বরূপ স্পষ্টতর হবে এবং নিঃসন্দেহে তা লেখক ও পাঠককে কাছাকাছি আসতে সাহায্য করবে। এখন আধুনিক লেখকদের সঙ্গে আধুনিক পাঠকের অর্থাৎ অধিকাংশ পাঠকের মনের দূরত্ব যে প্রায় সুমেরু-কুমেরু তা বোধ করি সবাই স্বীকার করবেন।
আধুনিক মানুষের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে Wilde-এর বিখ্যাত বক্র উক্তি : ‘It is enough that our fathers have believed. They have exhausted the faithfaculty of the species. Their legacy to us is the scepticism of which they were afraid’ পূর্ব পুরুষদের মতো আজ আর আমরা কোনো বিষয়ে সন্দেহ করতে ভয় পাই না। এ সার্বিক সন্দেহ প্রবণতা আধুনিকতার এক বড় লক্ষণ। আরব মনীষী ইবনে রুশদ বলেছেন: ‘সন্দেহ হচ্ছে সব রকম জ্ঞানের উৎস।’ জ্ঞানের উৎস-দ্বার যদি আমাদের সামনে খুলে যায় আর আন্তরিকতা-নাস্তিকতার জুজুর ভয়ে ভীত না হয়ে আমরা যদি সব কিছুকে সার্থক ভাবে সাহিত্যের উপজীব্য করতে পারি, তাহলে আমার বিশ্বাস, সাহিত্যে আধুনিকতা চর্চা আমাদের ব্যর্থ হবে না। এ প্রসঙ্গে ফ্রয়েডের এ মূল্যবান উক্তিটিও স্মরণীয় : ‘Men are strong only so long as they represent a strong idea.’ ত্রিশের সাহিত্যান্দোলনেরও যেটুকু সফলতা তাও এ কারণেই অর্থাৎ তার পেছনে একটা প্রবল ভাব বা স্বপ্ন সক্রিয় ছিল বলেই। সাহিত্যে আধুনিকতারও ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তেমন। কোনো প্রবল ভাব ও ভাবাদর্শের ওপর। শুধু সাহিত্য কেন সব রকম শিল্পান্দোলনেরই গোড়ার কথা এটি। ত্রিশের যুগের লেখকদের স্বপ্ন ছিল, তাই তাঁদের রচনায় স্বপ্নভঙ্গের বেদনা প্রতিফলিত হয়েছে। আজ আমাদের কোনো স্বপ্ন নেই, তাই স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনাহত কোন দুর্মর রূপ আমাদের আধুনিক লেখকদের রচনায় অনুপস্থিত। উপসংহারে আমারও এ আত্মজিজ্ঞাসা: আজ আমাদের মনে কোনো strong idea আছে কি? আছে কি কোনো মহৎ ভাবের প্রেরণা?
[‘সাহিত্যে আধুনিকতা’ প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ পত্রিকার মাঘ-চৈত্র ১৩৬৮ সংখ্যায়। এটি পরবর্তীকালে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে (১৯৬৫) স্থান পায়।]