আদিত্য। সাহিত্য জিনিসটা বিষয়ের উপর বেশি নির্ভর করে না রচনার উপরে? লক্ষ্যের উপরে না লক্ষণের উপরে?
নগেন্দ্র। তুমি তো এ কথাও জিজ্ঞাসা করিতে পার মানুষ বাম পায়ের উপর বেশি নির্ভর করে না ডান পায়ের উপর?
আদিত্য। মানুষ দুই পায়েরই উপর সমান নির্ভর করে এ যেমন স্পষ্ট অনুভবগোচর, সাহিত্য তার বিষয় এবং রচনাপ্রণালীর উপর সমান নির্ভর করে সেটা তেমন নিশ্চয় বোধগম্য নয় এবং এই কারণেই সাহিত্যে আজকাল কেহ-বা নীতিকে প্রাধান্য দেন, কেহ-বা সৌন্দর্যকে, কেহ-বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব-প্রচারকে। সেইজন্যই আলোচনা উত্থাপন করা গেল।
মন্মথ। বেশ কথা। তা হইলে একটা দৃষ্টান্ত অবলম্বন করিয়া আলোচনা শুরু করা যায়। ভ্রমণকারীদের সুবিধার জন্য যে “গাইড’-বই রচনা করা হয় এবং ভ্রমণবৃত্তান্ত, এ দুইয়ের মধ্যে কোন্টা সাহিত্যলক্ষণাক্রান্ত সে বিষয়ে বোধ করি কারও মতভেদ নাই।
আদিত্য। ভালো, মতভেদ নাই– গাইড-বই সাহিত্য নহে। কিন্তু ওই কথাতেই আমার প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। গাইড-বই এবং ভ্রমণবৃত্তান্তের বিষয় এক, কেবল রচনাপ্রণালীর প্রভেদ।
নগেন্দ্র। আমার মতে দুয়ের বিষয়েরই প্রভেদ। ফিজিক্স এবং কেমিষ্ট্রি যেমন একই বস্তুকে ভিন্ন দিক দিয়া দেখে এবং সেইজন্য উভয়ের বিষয়কে স্বতন্ত্র বলা যায়, তেমনি গাইড-বই এবং ভ্রমণবৃত্তান্ত দেশ-বিশেষকে ভিন্ন তরফ হইতে আলোচনা করে।
মন্মথ। গাইড-বইয়ে কেবলমাত্র তথ্যসংগ্রহ থাকে, ভ্রমণবৃত্তান্তে ভ্রমণকারী লেখকের ব্যক্তিগত প্রভাব বিদ্যমান এবং তাহাতেই সাহিত্যের বিকাশ। ব্যক্তিত্ববর্জিত সমাচারমাত্র বিজ্ঞানে স্থান পাইতে পারে, সাহিত্যে নহে।
আদিত্য। তাহা হইলে দেখিতে হইবে, কিসে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। কেবলমাত্র তথ্য নিতান্ত সাদা ভাষায় বলা যায়, কিন্তু তাহার সহিত হৃদয়ের ভাব ব্যক্ত করিতে গেলেই ভাষা নানাপ্রকার আকার-ইঙ্গিতের সাহায্যে নিজের মতো করিয়া গড়িয়া তুলিতে হয়। তাহাকেই কি ইংরাজিতে ম্যানার এবং বাংলায় রচনাভঙ্গি বলা যায় না?
মন্মথ। কেবল রচনার ভঙ্গি নহে, দেখিবার সামগ্রীটাও বিচার্য। এমন-কি, কেবলমাত্র হৃদয়ের ভাবও নহে, কে কোন্ জিনিসটাকে বিশেষ করিয়া দেখিতেছে তাহার উপরেও তাহার ব্যক্তিত্ববিকাশ নির্ভর করে। কেমন করিয়া দেখিতেছে এবং কী দেখিতেছে এই দুটা লইয়াই সাহিত্য। কেমন করিয়া দেখিতেছে সেটা হইল হৃদয়ের এলাকা এবং কী দেখিতেছে সেটা হইল জ্ঞানের।
আদিত্য। তুমি কি বলিতে চাও, সাহিত্যের উপযোগী কতকগুলি বিশেষ দেখিবার বিষয় আছে? অর্থাৎ, কতকগুলি বিষয় বিশেষরূপে সাহিত্যের এবং কতকগুলি তাহার বহির্ভূত?
মন্মথ। আমি যাহা বলিতে চাই তাহা এই– জ্ঞানস্পৃহা সৌন্দর্যস্পৃহা প্রভৃতি আমাদের অনেকগুলি স্বতন্ত্র মনোবৃত্তি আছে, বিজ্ঞান দর্শন এবং কলাবিদ্যা প্রভৃতিরা সেগুলোকে স্বতন্ত্ররূপে চরিতার্থ করে। বিজ্ঞানে কেবল জিজ্ঞাসাবৃত্তির পরিতৃপ্তি, সংগীত প্রভৃতি কলাবিদ্যায় কেবল সৌন্দর্যবৃত্তির পরিতৃপ্তি, কিন্তু সাহিত্যে সমস্ত বৃত্তির একত্র সামঞ্জস্য। অন্তত সাহিত্যের সেই চরম চেষ্টা, সেই পরম গতি।
নগেন্দ্র। সাহিত্যের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আর-একটু খোলসা করিয়া বলো, শুনা যাক।
মন্মথ। ম্যাথ্যু আর্নল্ড্ বলেন, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মনুষ্যত্ব বিকাশ করা। জ্ঞানস্পৃহা সৌন্দর্যস্পৃহা প্রভৃতি মানুষের যতগুলি উচ্চ প্রবৃত্তি আছে তাহার প্রত্যেকটার পরিপূর্ণ পরিণতির সহায়তা করা। আমার মতে শিক্ষাবিধানকে গৌণ করিয়া আনন্দ-উদ্রেককে মুখ্য করিলে সেই উদ্দেশ্য-সাধন হইতে পারে।
নগেন্দ্র। বেশ কথা। তাহা হইলে শেষে দাঁড়ায় এই যে, হৃদয়ের প্রতিই সাহিত্যের প্রধান অধিকার, মুখ্য প্রভাব। এ স্থলে নীতিবোধকেও আমি হৃদয়বৃত্তির মধ্যে ধরিতেছি। কারণ, সাহিত্যে হৃদয়পথ দিয়াই ধর্মবোধের উদ্দীপন করে, তর্কপথ দিয়া নহে।
মন্মথ। এ সম্বন্ধে বক্তব্য আছে। সত্যকে দুই খণ্ড করিয়া দেখা যায়। প্রথম, চিন্তার বিষয়রূপে; দ্বিতীয়, অনুভবের বিষয়রূপে। কিন্তু সাহিত্য সত্যকে আমাদের কাছে জীবন্ত অখণ্ড সমগ্রভাবে উপনীত করে। প্রাকৃত বিজ্ঞানের নির্দেশ অনুসারে আমরা প্রকৃতিকে কেবলমাত্র বস্তু এবং ক্রিয়ার সমষ্টিরূপে মনে করিতে পারি; কিন্তু প্রকৃতিকে তার সমস্ত বস্তু এবং ক্রিয়া এবং সৌন্দর্য-সহযোগে একটি অখণ্ড সত্তারূপে অনুভব করাইতে পারে যে-একটি একীভূত মানসিক শক্তি, সাহিত্যে সেই শক্তিরই বিকাশ।
নগেন্দ্র। সত্য হৃদয়ের দ্বারা কিরূপে অনুভব করা যায় বুঝিলাম না। প্রকৃতির সৌন্দর্যকেই বা কী হিসাবে সত্য বলা যায় ধারণা হইল না। সৌন্দর্য বিশেষরূপে আমাদের হৃদ্বৃত্তিকে উত্তেজিত করে, এই কারণে তাহা বিশুদ্ধরূপে হৃদয়-সম্পর্কীয়। ইহাকে যদি সত্য নাম দিতে চাও তবে ভাষার জটিলতা বাড়িয়া উঠিবে। নদী-অরণ্য-পর্বতের যে সমষ্টিকে আমরা প্রকৃতি বলি তাহার একটা বিভাগ হৃদয়-সম্পর্ক-বর্জিত, এইজন্য সেই বিভাগটাকে আমরা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিকভাবে আলোচনা করিতে পারি। কিন্তু তাহার যে দিকটা আমাদের হৃদয়ভাবকে উত্তেজিত করে সে দিকে সত্য-মিথ্যা উচিত-অনুচিত নাই। এটা সুন্দর হওয়া উচিত বা উচিত নয় এমনও কোনো কথা নাই। সৌন্দর্য মানুষের মন এবং বহিঃপ্রকৃতির মধ্যগত একটা সম্বন্ধ মাত্র। সে সম্বন্ধে সর্বত্র এবং সর্বকালে সমান নহে, সেইজন্যই সাধারণত তাহাকে বৈজ্ঞানিক কোঠা হইতে দূরে রাখা হয়।
মন্মথ। অনেক কথা আসিয়া পড়িল। আমার মোট কথাটা এই, সাহিত্যের বিষয় সুন্দর, নৈতিক এবং যুক্তিসংগত। ইহার কোনো গুণটা বাদ পড়িলে সাহিত্য অসম্পূর্ণ হয়।
নগেন্দ্র। সাহিত্যের লক্ষ্য হইতেছে সৌন্দর্য। তবে যাহা আমাদের ধর্মবোধকে ক্ষুণ্ন করে তাহা আমাদের সৌন্দর্যবোধকেও আঘাত করে; কতকগুলি যুক্তির নিয়ম আছে তাহাকেও অতিক্রম করিলে সৌন্দর্য পরাভূত হয়। সেইজন্যই বলি, হৃদয়বৃত্তিই সাহিত্যের গম্যস্থান, নীতি ও বুদ্ধি তাহার সহায়মাত্র। অতএব, বিষয়গত সত্য এবং বিষয়গত নীতি অপেক্ষা বিষয়গত সৌন্দর্যই তাহার মুখ্য উপাদান; এবং সেই সৌন্দর্যকে সুন্দর ভাষা সুন্দর আকার-দানই তাহাতে প্রাণসঞ্চার।
আদিত্য। পুঁথির গহনা এবং হীরার গহনা গঠনসৌন্দর্যে সমান হইতে পারে কিন্তু ভালো গহনার উপকরণে পুঁথি দেখিলে আমাদের চিত্তে একটা ক্ষোভ জন্মিতে পারে; তাহাতে করিয়া সৌন্দর্যের পূর্ণফল নষ্ট করে। কবি বলিয়াছেন– “বীর বিনা আহা রমণী রতন আর কারে শোভা পায় রে’, তেমনি পাঠক-হৃদয় সাহিত্য ও সৌন্দর্যের সহিত বীর্যের সম্মিলন প্রত্যাশা করে। যথেষ্ট মূলবান গৌরববান বিষয়ের সহিত সৌন্দর্যের সমাবেশ না দেখিলে সেই অসংগতিতে পীড়া এবং ক্রমে অবজ্ঞা উৎপাদন করিতে পারে।
মন্মথ। ইহার মধ্যে বিপদের সম্ভাবনা এই যে, গঠনের মূল্য অপেক্ষা হীরার মূল্য নির্ণয় করা সহজ, সেইজন্য অধিকাংশ লোক অলংকারের অলংকারত্ব উপেক্ষা করিয়া হীরার ওজনেই ব্যস্ত হয় এবং যে রসজ্ঞ ব্যক্তি মূল্যলাভ অপেক্ষা আনন্দলাভকেই গুরুতর বলিয়া গণ্য করেন, নিক্তির মানদণ্ড-দ্বারা তাঁহাকে অপমান করিয়া থাকে। এই-সকল বৈষয়িক সাংসারিক পাঠক-সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্রোহী হইয়াই এক-এক সময় রসজ্ঞের দল সাহিত্যের বিষয়গৌরবকে অত্যন্ত অবহেলাপূর্বক নিরালম্ব কলাসৌন্দর্য সম্বন্ধে অত্যুক্তি প্রকাশ করিয়া থাকেন।
ভারতী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৫