সাহিত্যের ঐতিহ্য
শিল্পী ছবি আঁকেন সামনে একটা মডেল রেখে। মডেলটা উপলক্ষ্য, লক্ষ্য নয়। লক্ষ হচ্ছে ছবি–যে ছবিতে মডেলকে ছাড়িয়ে শিল্পীর ভাব ও রূপ-কল্পনা কায়া নেয়। কিন্তু মডেল জোগায় ব্যাকগ্রাউন্ড অর্থাৎ শিল্পীর রূপকল্পনায় প্রতিষ্ঠাভূমি একটা অবলম্বন শুধু। তেমনি সাহিত্য-শিল্পীর জন্যও ঐতিহ্য হচ্ছে রচনার ব্যাকগ্রাউন্ড বা প্রতিষ্ঠাভূমি। একটা মডেল মাত্র। কিন্তু এই মডেলের প্রয়োজন শিল্পীর জীবনে একদিন নিঃশেষ হবেই। না হলে তিনি কখনো শিল্পী হতে পারবেন না– থেকে যাবেন সারাজীবন নকলনবিস। Wiertz যে বলেছেন : Nothing is so tiring as a constant close imitation of life, one comes back to inevitably imaginative work : 71 সত্য। শিল্পীকে নিজস্ব রূপ-কল্পনার জগতে ফিরে আসতেই হবে করতে হবে তাকে আবিষ্কার। কিন্তু তার আগে প্রস্তুতি হিসেবে Close imitation of life-এর প্রয়োজন আছে। এটা শিল্পীর শিক্ষানবিসি। প্রস্তুতি বা শিক্ষানবিসি সব শিল্পের ক্ষেত্রেই অপরিহার্য। চিত্র-শিল্প বা ভাস্কর্য থেকে সাহিত্যের দুনিয়াটা আরো বড়, আরো ব্যাপক, তার এলাকা বহুবিস্তৃত এবং তার অন্ধিসন্ধি অনেক বেশি রহস্যঘন। তাই সাহিত্য শিল্পের শিক্ষানবিসিও হতে হবে দীর্ঘায়ত ও কঠোর। ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় এই প্রস্তুতির প্রথম সোপান–শিক্ষানবিসির প্রথম পাঠ। শিল্পী নিজের কল্পনার সাহায্যে যে শিল্প বা সাহিত্য সৃষ্টি করে তার প্রধান ভূমিকা অন্যের কল্পনাকে স্পর্শ করা, তাকে সচেতন করে তোলা। এ ছাড়া যে কোনো শিল্পকার্যই ব্যর্থ। যে শিল্পকার্য এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ বহু যুগ ধরে যা মানুষের মনকে স্পর্শ করে এসেছে, মানুষের হৃদয়ের সলতেটাকে একটুখানি উসকিয়ে দিতে পেরেছে–তেমন শিল্পকার্যকে কোনো সৎ-শিল্পীই উপেক্ষা করতে পারে না।
শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিল্পায়ন গ্রন্থের প্রথম নিবন্ধ শুরু করেছেন নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি দিয়ে : ‘Art is not a pleasure trip, it is a battle’ (Millet) বলা বাহুল্য, এ সংগ্রাম যাবজ্জীবনের সংগ্রাম। সৈনিককে যেমন যুদ্ধে নামার আগে সব হাতিয়ারের সঙ্গে তথা তার ব্যবহার সম্বন্ধে দক্ষ হতে হয়, তেমনি শিল্পীকেও তার জীবন-যুদ্ধের সব প্রকরণের সঙ্গে পরিচয় করে তাকে আয়ত্ত করে নিতে হয় আগে থেকেই। এ পরিচয়ের প্রথম ভিত হলো ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়।
এই প্রসঙ্গে এ যুগের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাদী লেখক টি. এস. এলিয়টের মন্তব্য 2002: Tradition cannot be inherited, and if you want it you must obtain it by great labour.’ কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা ছাড়া কোনো ঐতিহ্যই আয়ত্ত হয় না। এ পরিশ্রম স্বীকার না করে কোনো সাহিত্য-শিল্পীরই রেহাই নেই–অবশ্য যদি তিনি সত্যিকার সাহিত্যিক হন বা হতে চান। Millet-এর যে কথাটা ওপরে উদ্ধৃত হয়েছে অর্থাৎ Art is not a pleasure trip তার বক্তব্য এই একই। ছোট বড় সব শিল্পীকে নিজ নিজ শিল্প-ইমারত গড়ে তুলতে হলে শিল্পের পূর্বাপর সব ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। কোনো শিল্পই ভূঁইফোড় নয়–সাহিত্য তো নয়ই। মানুষের ধারাবাহিক সাধনারই ফসল সাহিত্য ও শিল্প।
আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি–কিছুই আর আগের মতো একই ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ নয়–সাহিত্য-শিল্প তো নয়ই। অধিকন্তু সাহিত্য শিল্প কালের সীমায়ও নয় আবদ্ধ। কালের ক্ষয় ও বিচার পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে যেসব সাহিত্য-শিল্প মানুষের চিরন্তন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, তা যে দেশের যে জাতের, যে ভাষারই হোক না কেন সাহিত্যিকের কাছে তা কিছুতেই উপেক্ষণীয় হতে পারে না। ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নামে অথবা জাতি কি ভাষাগত কারণে সাহিত্য-শিল্পের স্মরণীয় ঐতিহ্য বিশেষকে উপেক্ষা করা মানে নিজের শিল্প সাধনাকে খর্ব করা–ছোটর জন্য বড়কে ত্যাগ করা।
ঐতিহ্যকে মানা মানে অতীতের ও বর্তমানের যা কিছু স্মরণীয় তাকে যথাযথ মূল্য দেওয়া–এই মূল্য দেওয়ার ওপরই নির্ভর করে সাহিত্য-শিল্পের তথী সভ্যতার ধারাবাহিকতা। সাহিত্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভালো লাগা মন্দ লাগার কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলি চন্দ্ৰসূর্যের মতোই। এগুলি পরীক্ষিত, অনস্বীকার্য ও সন্দেহাতীতভাবে প্রামাণ্য। বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক Andre Maurois এই প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘Let us have faith in the choice of past centuries. A man may be wrong; so may a generation, but humanity does not make mistakes.’
.
সাহিত্যের ভাষায় যাকে ক্লাসিকস বলা হয়–এইভাবে মানবজাতির পরীক্ষাশালায় তার চুড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত ও সাম্প্রদায়িক রুচি ও সংস্কারের ফলে সাহিত্যিক বিশেষ বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং অন্যকেও হয়তো সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করতে পারেন। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় যে শিল্পকর্ম টিকে গেছে তার মূল্য তাতে কখনো কমবে না। সত্যনিষ্ঠ সাহিত্যিক-শিল্পীরা চিরকাল ওই দিয়েই নিজেদের মন-মানসের পুষ্টিসাধন করবেই। টলস্টয় শুধু মহামনীষী ছিলেন না, ছিলেন মহাশিল্পীও। তাঁর War and Peace কে অনেকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস মনে করেন, অনেকে মনে করেন তাঁর সৃষ্ট আনা কারেনিনা বিশ্ব সাহিত্যের সেরা নারী-চরিত্র। এমন কি কোনো কোনো ইউরোপীয় সমালোচক এমন মন্তব্যও করেছেন–আনা কারেনিনা ছাড়া রুশ ভাষায় যদি অন্য কোনো বই লেখা নাও হতো তা হলেও রুশ ভাষাকে উপেক্ষা করা যেত না। এহেন টলস্টয় সম্বন্ধে বলা হয়েছে, তাঁর প্রথম জীবনে অর্থাৎ সাহিত্যিক জীবনের প্রস্তুতি ও শিক্ষানবিসির কালে তাঁর প্রথম পাঠ্য ছিল গ্যেটে, ভিকটর হুগো, প্লেটো ও হোমার। বলা বাহুল্য, এরা কেউই টলস্টয়ের স্বজাতি বা রাশিয়ান নন।
আশ্চর্য, আমাদের দেশে এরি মধ্যে নাকি কোথাও কোথাও রব উঠেছে যেহেতু রবীন্দ্র-সাহিত্যের ঐতিহ্য বিদেশী, অতএব পরিত্যাজ্য। রামায়ণ মহাভারতের তো কথাই নেই। এ যুগে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের এ এক চমৎকার হাস্যকর নজির। নজরুলকে নিয়ে এখনো অবশ্য মনকে চোখ ঠারানো হচ্ছে। তার নামের জোরেই বোধ হয় তিনি বেঁচে গেলেন। অথচ তার রচনা বহু ঐতিহ্যের সংমিশ্রণেরই ফল।
রাষ্ট্র ও জাতীয়তার দিক দিয়ে ইকবালের সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব নেই সত্য কিন্তু ভাষার দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে তার সঙ্গে দূরত্ব অনেক বেশি। বিশেষত ইকবালের প্রায় সব শ্রেষ্ঠ রচনাই পারসিতে লেখা, দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশ থেকে পারসির পাঠ উঠে গেছে–যেটুকু আছে তাও উঠে গেল বলে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে আমি এটাকে অত্যন্ত শোচনীয় মনে করি। কারণ, মুসলমানদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যের ভাণ্ডার হচ্ছে পারসি। শিক্ষা ও চর্চার অভাবে এর ভাণ্ডার-দ্বার যদি রুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে যারা সাহিত্যে ও মননশীলতায় খাস মুসলিম ঐতিহ্যের পরশ পেতে চায়, ওই থেকে নিজেদের মন-মানসের খোরাক সংগ্রহ করতে চায় তারা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবে। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ভূমিকা একরকম আমাদের ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় প্রয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ–তা কখনো আমাদের মনকে কল্পনার রঙে রাঙাতে পারে নি। কিন্তু পারসির বেলায় তা বলা যায় না। পারসি সাহিত্য, বিশেষ করে তার কাব্যাংশ, একদিন আমাদের দেশের বহু বিদ্বজ্জনের রসবোধ তৃপ্তির ও মানস-চেতনার খোরাক হয়েছিল। উর্দু-পারসি বাংলা একই ভাষাগোষ্ঠীর শাখা-প্রশাখা মাত্র। আরবির তুলনায় এ কারণেও পারসি আমাদের ভাবুকদের মনে অধিকতর সহজগম্য ছিল ও অনায়াসে হতে পেরেছিল তাদের মনের দোসর। তদুপরি পারসি ছিল সুদীর্ঘ কাল ধরে পাক ভারতে শিক্ষা, রাজকার্য ও মননশীলতার বাহন। ফলে পারসি ভাষার কবিরাও এদেশের সাহিত্য-শিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে পড়েছিল। সেই ঐতিহ্য ধারা থেকে আজ আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। এ কারণেই পারসি পাঠ উঠে যাওয়াকে আমি শোচনীয় বলেছি। পারসি কাব্যে মাধুর্যের সঙ্গে যে অপূর্ব সৌন্দর্য-চেতনা, জীবনের প্রতি যে সকৌতুক দৃষ্টি আর তার যে রূপকল্প ও প্রকাশের কলাকৌশল দেখা যায় তা যে শুধু মনোহর তা নয়, স্বাস্থ্যপ্রদও। সমুদ্রের বিস্তৃতি এতে না থাকলেও নিস্তরঙ্গ সরোবরের অনাবিল সৌন্দর্যে জীবনের বোধকে এ সাহিত্য জাগিয়ে তুলতে ও জাগিয়ে রাখতে সক্ষম। জীবিকার তাড়নায় আজ আমার সৌন্দর্য ও রসের সেই ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হতে চলেছি, এ কি দুঃখের বিষয় নয়?
পারসি সাহিত্যের আর একটি বড় সম্পদ সুফি ভাবধারা–এই ভাবধারার অন্য ত্রুটি যাই থাক, এ মানুষকে অনেক গোঁড়ামির হাত থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে সহিষ্ণু করে তোলে। এই সহিষ্ণুতা ও মনের উদার পরিমণ্ডল সাহিত্যিক-শিল্পীর অত্যাবশ্যক। তাই আমার বিশ্বাস, পারসি সাহিত্যের ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে মনের অনেক মূল্যবান সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকা। অথচ আমাদের নিজেদের অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানের নিজস্ব কোনো সাহিত্যিক ঐতিহ্য নেই–নেই আমাদের কোনো ক্লাসিকস বা এপিক। এদিক দিয়ে উর্দু-বাংলার অবস্থা প্রায় সমান। উর্দুরও নেই কোনো উল্লেখযোগ্য ক্লাসিকস বা এপিক। ফলে আমাদের সাহিত্য জীবনের বুনিয়াদ কিসের ওপর প্রতিষ্ঠা করা হবে তা আমাদের সাহিত্যসেবীদের সামনে এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা সবাই প্রায় দিশেহারা। তাই কেউ আশ্রয় নিতে চাইছে ইসলামে, কেউ দেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শে, কেউ সাম্যবাদে, কেউবা অন্য কিছুতে। সাহিত্যিক-শিল্পীর জন্য এর কোনোটাই নিরাপদ আশ্রয় নয়। ধর্মের কাজ মানুষের সামজিক নীতিবোধ জাগিয়ে তোলা ও মানুষের মনকে দেওয়া আধ্যাত্মিক খোরাক। সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ছাড়া ধর্ম কখনো সাহিত্যের পথ ও পাথেয়। হতে পারে না। ধর্ম ব্যাপারটি অত্যন্ত অনড়, যাকে বলে rigid; তাতে পান থেকে চুন খসবার উপায় নেই। তেমনি রাষ্ট্র, রাজনৈতিক মতবাদ বা ইজমগুলিও তাই। এ সবের কোনো একটাকে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাভূমি করতে গেলে বনের বাঘকে খাঁচায় বন্ধ করলে যে দশা হয় সাহিত্য শিল্পেরও সেই ঘটে। তেমন বাঘের স্থান চিড়িয়াখানা বা সার্কাস ছাড়া আর কোথাও নয়। কোনো কোনো দেশে কোনো কোনো সাহিত্যিক শিল্পীও কি আজ এ করুণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন নি? শাস্ত্র, রাষ্ট্র ও মতবাদ–এ সবই এক একটা শৃঙ্খল। সাহিত্য হল মানুষের মনের মুক্তির ক্ষেত্র। তাই সাহিত্যিককে এসব শৃঙ্খল ভেঙে ভেঙেই এগুতে হয়। শৃঙ্খল বা শাসন সবই সামাজিক মানুষের জন্য। লেখকের জন্য লেখার শাসন ছাড়া অন্য কোনো শাসন নেই, অন্তত যখন তিনি লিখতে বসেন তখনকার মতো তিনি সামাজিক বা শাস্ত্রীয় মানুষ নন। তখন তিনি শুধু শিল্পী। শিল্পের শাসনে তিনি যুগপৎ বন্দি ও মুক্ত। নিজের শিল্পের কাছে তিনি বন্দি কিন্তু বাইরের আচার অনুষ্ঠান ও নানা সংস্কারের শৃঙ্খল থেকে তিনি মুক্ত। এ যুগে রাষ্ট্র ও মতবাদের শৃঙ্খল ভাঙার এ স্মরণীয় দৃষ্টান্ত পাস্তেরনাকের ডক্টর জিভাগো। বাংলা সাহিত্যে শাস্ত্রের শৃঙ্খল ভাঙার নজির দেদার। এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম তো রীতিমতো কালাপাহাড়।
শাস্ত্রীয় লৌকিক ও সামাজিক শৃঙ্খল ভাঙতে পেরেছেন বলেই শরৎচন্দ্রের পক্ষে শ্রীকান্ত বা রাজলক্ষ্মীকে, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে গোরা বা আনন্দময়ীকে আঁকা-নজরুল ইসলামের পক্ষে বিদ্রোহী’ বা ‘বারাঙ্গনা’ লেখা সম্ভব হয়েছে। শাস্ত্রের মাপকাঠি দিয়ে। বিচার করলে এসব চরিত্র বা লেখা নিশ্চয়ই দণ্ডনীয়। শাস্ত্রের বিচারে রাজলক্ষ্মী বা সাবিত্রী পতিতা ছাড়া কিছুই না। জীবনে সেকুলার আইন তাদের আশ্রয় দিলেও, মৃত্যুর পর শাস্ত্র নরকবাসের কম কোনো দণ্ডই দেবে না। কিন্তু সাহিত্যের বিচারে তারা শুধু। স্মরণীয় নয়, চিরস্মরণীয়ই। বিদ্রোহী’ ও ‘বারাঙ্গনার বেলায়ও তাই। ওই দুই কবিতায় শাস্ত্রের বহু বিধান ও বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। আমীর খসরুর সেই বিখ্যাত উক্তি : ‘কাফিরে ইশকাম মুসলমানি মারা দরকার নিস্ত’ অর্থাৎ আমি প্রেমের কাফের, মুসলমানি দিয়ে আমার দরকার নেই–কবিতা হিসেবে অনবদ্য কিন্তু শাস্ত্রের দিক থেকে মারাত্মক, চুড়ান্ত ব্লাসফেমি! খ্রিস্টানি শাস্ত্র বা মতবাদকে ভিত্তি করে শেক্সপিয়র যেমন তার অমর নাটকগুলি লেখেন নি, তেমনি রবীন্দ্রনাথও হিন্দু শাস্ত্র বা আচার-বিচারকে ফলাও করার জন্য লেখনী ধরেন নি। বিচার করে দেখলে দেখা যাবে, কোনো কালে কোনো মহৎ শিল্পীই কোনো বিশেষ শাস্ত্র, রাষ্ট্র বা মতবাদের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েন নি। সাহিত্যের এই ঐতিহ্য সৎ-সাহিত্য ও সাহিত্যিকেরই ঐতিহ্য।
সাহিত্যের ঐতিহ্যের এ গেল অন্তরের দিক অর্থাৎ ভাবের দিক, কিন্তু তার একটা বাইরের দিকও আছে অর্থাৎ ভাষা ও আঙ্গিকের দিক। প্রাণের সঙ্গে দেহের যে সম্পর্ক ভাবের সঙ্গে ভাষারও সেই সম্পর্ক। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিকের অর্থাৎ শব্দ, উপমা, ছন্দ, রূপক, প্রতীক, রূপকল্প ইত্যাদিরও পরিবর্তন ঘটে, ঘটেছে। ভাষা নিত্য বহু নতুন আঙ্গিক গ্রহণ করেছে–এ না করে কোনো জীবন্ত ভাষাই চলতে পারে না। তা হলেও এর অনেক কিছু প্রয়োগনৈপুণ্যে, দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে, অর্থ ব্যাপ্তি ও ইঙ্গিতময়তার জন্য এমনভাবে সাহিত্যের অঙ্গ ও ঐতিহ্য হয়ে পড়েছে যে তা কখনো সাহিত্যের আঙ্গিক থেকে বাদ যাবে না। জোর করে বাদ দিলে ভাষা দুর্বল হবে। তার অঙ্গহানি ঘটবেই। ‘মরিয়া না মরে রাম’–রামায়ণ কাহিনীর সঙ্গে বহু পরিচয় ও ব্যবহারের ফলে এই উক্তিটির বিশেষ অর্থ ও ইঙ্গিত বাংলা ভাষা-ভাষীদের ‘স্মৃতি’ ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি নতুন ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার মতলবে লিখতে বা বলতে শুরু করেন। ‘মরিয়া না মরে রহিম’ তা হলে কোনো allusion-এর স্মৃতি ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো অর্থ বা ইঙ্গিত কারো মনে জাগাবে না বলে পাঠক বা শ্রোতার কাছে এ এক অর্থহীন উক্তি হয়েই থাকবে। ‘মজনু পাগল লাইলি প্রেমে, আমি পাগল লা-ইলা’র’–লাইলি-মজনুর কাহিনী আর মুসলিম ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যার পরিচয় নেই নজরুলের এই উক্তির পুরোপুরি তাৎপর্য সে কখনো বুঝতে পারবে না। আর স্বয়ং লেখকের যদি না থাকতো এই ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর পরিচয় তাহলে এমন অর্থ-গর্ভ ও ইঙ্গিতময় উক্তি করা তার পক্ষেও অসম্ভব হত। ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, কিংবদন্তি ও সাহিত্যের মাধ্যম বহু বাগধারা ও প্রকাশপদ্ধতি সাহিত্যিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সাহিত্যিক তথা ভাষাশিল্পীর পক্ষে এই ঐতিহ্যকে না মেনে উপায় নেই। মানা মানে বিশ্বাস করা নয়–মানা মানে প্রয়োগ করা। ‘মরিয়া না মরে রাম’ এই উক্তির শব্দহত অর্থে বিশ্বাস না করেও একে প্রয়োগ করা যায়। বিশ্বাস সত্য মিথ্যা বা বাস্তব অবাস্তবের দৃষ্টি দিয়ে সাহিত্য-শিল্পের ঐতিহ্যের বিচার করতে গেলে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। আমার এক অধ্যাপক বন্ধু হাড়গোড় বের করা কোনো কুৎসিৎ মেয়েকে দেখলে বলে উঠতেন শেক্সপিয়রের তৃতীয় ডাইনির অস্তিত্বে বিশ্বাস করার দরকার হয় না। শেপিয়রের লেখার গুণে অবাস্তব ডাইনিও এভাবে প্রকাশের ঐতিহ্যে তথা সাহিত্যের সত্যে পরিণত হয়েছে। নুরুল মোমেনের এক রচনার নাম নেমেসিস। মরহুম এস. ওয়াজেদ আলী তার এক রচনার নাম দিয়েছিলেন কিউপিডের দুষ্টামী, বিষ্ণু দে তাঁর এক গ্রন্থের নাম দিয়েছেন উর্বশী ও আর্টেমিস; গ্রিক ও হিন্দু পুরাণের সঙ্গে পরিচয় ছাড়া এসব নামের তাৎপর্য বোঝাই তো মুশকিল। দেবতা বা অপদেবতায় বিশ্বাস না করেও আঙ্গিকের এসব ঐতিহ্য যে কোনো লেখকের রচনার অঙ্গ হতে পারে। বরং যত বেশি ঐতিহ্যের সঙ্গে লেখকের পরিচয় হবে তার রচনায় ঐশ্বর্য ও বৈচিত্র্যও তেমনি তত বাড়বে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ এমনি বিচিত্র ঐতিহ্যেরই এক লীলাভূমি, ওই কবিতার শব্দগত অর্থ বুঝতে হলেও হিন্দু, মুসলমান ও গ্রিক পুরাণের কিছুটা জ্ঞানের দরকার। যিনি নিজস্ব ধর্মীয় ও খাস জাতীয় ঐতিহ্যের পক্ষপাতী তাঁর কাছে এই কবিতা অস্পৃশ্য বিবেচিত না হয়ে পারে না। ‘ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’, ‘ধরি স্বর্গীয় দূত জিবরাইলের আগুনের পাখা সাপটি,’ আমি অফিসের বাঁশরী এই তিনটি পংক্তি হিন্দু মুসলমান ও গ্রিক এই তিন ঐতিহ্যের ত্রিবেণী সঙ্গম। সাহিত্যে যারা নিছক সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের পক্ষপাতী তারা নজরুলের এই তিনটি পংক্তি নিয়ে কী যে দুরবস্থায় পড়বেন একবার ভেবে দেখুন। তিনটি সম্প্রদায়ের তিন তিনটি সাম্প্রদায়িক মাথা একত্র হলেই তবে এই লাইন তিনটির মর্মোদ্ধার সম্ভব হতে পারে, তার আগে নয়। একতরফা ও বিচ্ছিন্ন ঐতিহ্য-বিশ্বাসের এ হচ্ছে শোচনীয় পরিণাম। অথচ আপনি যদি সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সার্বজনীনতায় বিশ্বাসী হন তাহলে এক মাথা দিয়েই আপনি তিন তিনটি স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবাদী মাথাকে ঘায়েল করে দিতে পারেন অর্থাৎ এক মাথা দিয়ে তিন মাথার কাজ সারতে পারেন। যেমন নজরুল সেরেছেন।
জীবনানন্দ দাশের অতিপরিচিত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় বনলতা সেন নামক কয় লাইনের কবিতাটির রস গ্রহণ করতে হলেও প্রাচীন ইতিহাস ভূগোলের জ্ঞান দরকার। ‘বিদর্ভ’, ‘বিদিশা’, ‘শ্রাবস্তী’, ইত্যাদি সম্বন্ধে যার কোনো ধারণা নেই, এসব উপমা তার কল্পনায় কোনো রূপকল্পেরই সৃষ্টি করবে না। ফলে জাগবে না তার মনে কোনো রসবোধ। শব্দগুলির একমাত্র ধ্বনিগত সৌন্দর্যেই তাকে থাকতে হবে পরিতপ্ত। তাই ঐতিহ্যের অন্তরের দিক অর্থাৎ ভাবের দিকের পরিচয় যেমন দরকার তেমনি তার বহিরঙ্গের পরিচয়ও অত্যাবশ্যক। ঐতিহ্যের এই দুই রূপের মিলন ঘটেছে ‘বিদ্রোহী’ ও ‘বনলতা সেনে’। এর ফলে কবিতা দুটির অর্থ-ব্যাপ্তি ও আকর্ষণ যে বেড়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। ইতিহাস, ভূগোল পুরাণ-কাহিনী, রূপকথা, কিংবদন্তি, লিজেন্ড এপিক আর ব্যাপক অর্থে যাকে ক্লাসিক্স বলা হয় এসবই সাহিত্যের ঐতিহ্য। ক্লাসিকস শুধু যে রচনার দেহ অলঙ্করণের উপকরণ জোগায় তা নয়, রচনার অন্তরলোকের রূপায়ণেও তা সাহায্য করে। সাহিত্যের একটা চিরন্তন নীতি ও নিজস্ব চরিত্র আছে–ঐতিহ্যবোধ সেই ধারণাকে স্পষ্টতর করে তোলে। ফলে লেখকও বেঁচে যায় বহু বিভ্রান্তির হাত থেকে। সাহিত্যের নীতি বা চরিত্র কোনোক্রমেই সাম্প্রদায়িক বা দলীয় নয়। তাই খাঁটি সাহিত্য ব্যক্তিক হয়েও নৈর্ব্যক্তিক, সামাজিক হয়েও অসামাজিক, জাতীয় হয়েও আন্তর্জাতিক।
বলেছি আমাদের এক বড় অভাব–আমাদের নিজস্ব কোনো ক্লাসিক্স নেই। তবে আজকের দিনে তাতে বিশেষ কিছু এসে যায় না। কারণ, এখন কোনো দেশই আগের মতো খণ্ড-বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে পারবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে এখন সব দেশের মানুষের মনের পটভূমি অন্তত এক হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও আয়ত্ত করতে হবে সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি, করতে হবে বিশ্বসাহিত্যের খবরদারি। আজ সাহিত্যের ঐতিহ্য মানে বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিকেও দিতে হবে স্থান এবং তাকে নিতে হবে নিজের করে। শুধু বাপের মিরাছ নিয়ে যেমন কোনো ছেলেরই দীর্ঘকাল চলে না তেমনি শুধু দেশগত ঐতিহ্য নিয়েও আমাদের দীর্ঘকাল চলবে না। শুধু আমাদের কেন কোনো দেশেরই চলে না। এখন দেশের ঐতিহ্য ও বিশ্বসাহিত্যের ঐতিহ্য–এই দুইয়ের মিলনভূমির ওপর হবে নতুন ঐতিহ্যের গোড়াপত্তন।
এর মানে এই নয় যে, সমসাময়িককে উপেক্ষা করতে হবে। (সব দেশের) সমসাময়িক সাহিত্যের সঙ্গে ব্যাপক পরিচয় ছাড়া সমসাময়িক যুগের মন, চরিত্র, তার চাহিদা, তার আঙ্গিক ও রূপকল্পের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে কী করে? এ পরিচয় ছাড়া যে কোনো রচনা কালানুসারে আধুনিক হয়েও যেতে পারে সেকেলে বা out of date হয়ে।
যে ঐতিহ্যের কথা আমি এতক্ষণ ধরে বললাম তাকে গ্রহণ করতে হলে আমাদের মনের গ্রহণশীলতাকে আরো বাড়াতে হবে–সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে আমাদের মনের চাহিদা ও দিগন্তকেও।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই চমৎকার উক্তিটা স্মরণীয়; ‘পাত্র যত বড়ো জল তাহার বেশি ধরে না।’ যত বেশি সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটবে আমাদের মনের পাত্রও তত বেশি বড়ো হবে, বাড়বে তার পরিধিও। যে মনে যত বেশি নানা ঐতিহ্যের সম্পদ সঞ্চিত হবে সে মন তত সহজে কূপমণ্ডুকতা ছেড়ে সমুদ্র উত্তরণে সক্ষম হবে। বলা বাহুল্য, একমাত্র বড় মনেই জাগবে বড় কিছু সৃষ্টির তাগাদা।
কিন্তু একমাত্র সচেতন বিবেকী মনই পারে যে কোনো ঐতিহ্যের মূল্য বুঝতে ও তাকে নিজের করে নিতে। অতীতকে অতীত জেনে ও সাময়িককে সাময়িক জেনেই গ্রহণ করতে হয়। ঐতিহ্যও ঐতিহ্যই শুধু। ঐতিহ্যের জাবরকাটা কখনো ঐতিহ্যকে গ্রহণ নয়। গ্রহণ মানে যাচাই করে গ্রহণ–নির্বিচারে গ্রহণ নয়। এ বিষয়ে সাহিত্যের ইতিহাসে গ্যেটে, শেকস্পিয়র ও রবীন্দ্রনাথ তিন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এঁরা অতীত থেকে প্রচুর মাল মসলা নিয়ে নিজেদের কল্পনার সাহায্যে যুগোপযোগী বহু ইমারত গড়ে তুলেছেন; যে সব ইমারত অতীতকে বহু পেছনে ফেলে এসেছে। এর জন্য বুদ্ধি ও মনের চর্চা অত্যাবশ্যক; যে মন যাচাই করবে, গ্রহণ করবে, বর্জন করবে আর শিল্পীর কল্পনাকে দেবে কায়া। এই প্রসঙ্গে টি. এস. এলিয়টের মন্তব্যও শোনা যেতে পারে : ‘What we can do is to use our minds, remembering that a tradition without intelligence is not worth having, to discover what is the best life for us not as a political abstraction, but as a particular people in a particular place; what in the past is worth preserving and what should be rejected; and what conditions, within our power to bring about, would foster the society that we desire.’
সমাজ-সচেতন সাহিত্য শিল্পীর যেমন এই ভূমিকা তেমনি ঐতিহ্যেরও সীমা এ পর্যন্তই।
[‘সাহিত্যের ঐতিহ্য’ প্রথম প্রকাশিত হয় উত্তরণ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় (১৯৬০)। পরে তা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা গ্রন্থে সংকলিত হয়।]